বাংলার বাণী
ঢাকা : ২১শে নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ৫ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
সাদা কাগজের মূল্য বৃদ্ধি
পেপার বোর্ড ও কর্পোরেশন হোয়াইট প্রিন্টের দাম শতকরা ৩০ ভাগ বৃদ্ধি করেছেন। খবরটি সাধারণ্যে প্রকাশ করা হয়নি, সেজন্য মূল্য বৃদ্ধির কারণও আমাদের কাছে অজ্ঞাত। তবে কারণ যাই থাকুক না কেন, বিগত কয়েক মাস আগে নিউজপ্রিন্ট অর্ডিন্যান্স জারীর ফলে দেশের প্রকাশনা শিল্প ও প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর জীবনে যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল—গৃহীত নতুন সিদ্ধান্তের ফলে সে অনিশ্চয়তা আরো জমাট বাঁধবে এবং এদের ভবিষ্যতকে আরেক ধাপ অন্ধকারের গহ্বরে ঠেলে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। হোয়াইট প্রিন্টের নতুন দাম বৃদ্ধির আগে দেশে সরকার নির্ধারিত প্রতি রীম হোয়াইট প্রিন্টের মূল্য ছিল ১ শত বিশ টাকা। কিন্তু এ দামে কোথাও সাদা কাগজ পাওয়া যেতো না। সব সময়ই খোলাবাজারে তা বিক্রি হয়েছে প্রায় দুইশত টাকা করে, সেক্ষেত্রে এখন রীম প্রতি শতরা ৩০ ভাগ মূল্য বৃদ্ধি করলে প্রতি রীম কাগজের সরকারী মূল্য দাঁড়ায় ১শত ৫৬ টাকা এবং খোলাবাজারে তার দাম নিঃসন্দেহে আড়াইশত টাকায় উঠে যাবে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে প্রতি রীম সাদা কাগজের দাম ৫৮ টাকা ছিল এবং সেই মূল্যে কাগজ কিনে পুস্তক প্রকাশকরা বইয়ের যে মূল্য নির্ধারণ করতেন, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের পক্ষে সেই চড়াদামে বই কেনা কতদূর কষ্টকর ছিল সেটা সবাই জানেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর দফায় দফায় কাগজের মূল্য বৃদ্ধি করে দেশের প্রকাশনা শিল্প ও ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতকে কোন্ দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, সুফলটা ভাবার আগে এর কুফল ও ভয়াবহ দিকটা সরকারের একটুখানি ভেবে দেখা উচিত।
অবশ্য শুধুমাত্র সাদা কাগজ দিয়েই যে বই পুস্তক ছাপা হয় তা নয়, কিন্তু অর্ডিন্যান্স জারী করে নিউজপ্রিন্ট ছাপাখানার মালিকদের কাছে দুর্লভ করে দেয়া হয়েছে এবং নিউজপ্রিন্টের বদলে তাদেরকে কেমিক্যাল পেপার সরবরাহ করা হচ্ছে। ভ্রান্তনীতি ও এজেন্টদের কারসাজিতে ছাপাখানাগুলো কেমিক্যাল পেপার সরকার নির্ধারিত রীম প্রতি সত্তর টাকাতে পায়না। এক্ষণে সেই কেমিক্যাল পেপারেও মূল্য শতকরা ৩০ ভাগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সুতরাং কেমিক্যাল পেপারের নির্ধারিত মূল্য প্রায় একশত টাকা হলেও খোলা বাজারে তার দাম সোয়া শ’ টাকায় গিয়ে পৌঁছাবে। তাই একদিকে নিউজপ্রিন্ট বন্ধ, অপরদিকে সাদা ও কেমিক্যাল পেপারের মূল্য বৃদ্ধি—এতে সাময়িক পত্র-পত্রিকা, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং দেশের অগণিত ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্য বইয়ের সমস্যা কতদূর বৃদ্ধি করলো সরকারকে ব্যাপারটা একটুখানি ধীর মস্তিষ্কে ভাবতে অনুরোধ করছি। ধাপে ধাপে কাগজের দাম বৃদ্ধি করায় হয়তো দেশের সাময়িক পত্র-পত্রিকাগুলোর যে অবশিষ্টাংশ চালু আছে অচিরেই তা বন্ধ হয়ে যাবে, গল্প কবিতার বইগুলো নিউজপ্রিন্ট নিয়ন্ত্রণাদেশের ফলে এমনিতেই ছাপা বন্ধ হতে বসেছে, নতুন মূল্য বৃদ্ধিতে প্রকাশকরা হয়তো ছাপাখানার ব্যবসা লাটে তুলে দিয়ে অন্য ব্যবসায়ে মনোনিবেশ করবে, কিন্তু দেশের অগণিত ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যত কি হবে তা কি নতুন মূল্য বৃদ্ধির আদেশ দেয়ার আগে সরকার একটুখানিও ভেবে দেখেছেন? কারণ এ কথাও ঠিক যে, যারা বই ছাপিয়ে বিক্রি করেন ব্যবসাটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। সেক্ষেত্রে দেশের অগণিত ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রেখে তারা লোকসানের বোঝা বইবে না বা আমরা তাদের কাছ থেকে তা আশাও করিনা। তাদের তরফ থেকে পাল্টা প্রশ্ন যদি উঠে যে, সরকারই যদি দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যত নিয়ে মাথা না ঘামায় তাহলে আমরা তো কোন্ ছার। আমরা আগেই বলেছি, সাদা কাগজের মূল্য বৃদ্ধির কারণ আমাদের জানা নেই। কর্মকর্তারা বোধ হয় উৎপাদন খরচের কথাই তুলবেন। সেটাই আমাদের আশংকা। তবে জাতির বৃহত্তর কল্যাণের প্রশ্নকে সামনে রেখে অনেক সময় লোকসানের বোঝা বইতে হয় এবং সরকার দেশের অগণিত ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যতকে সর্বাধিক মূল্য দেবেন আশা করি।
গতকালকেরই খবর ছিল, খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলে ছেচল্লিশ লক্ষ টাকার নিউজপ্রিন্ট শীট রপ্তানীর অভাবে গুদামে পড়ে আছে এবং এই বাইপ্রোডাক্ট সম্পদটি নিউজপ্রিন্ট অর্ডিন্যান্সের আওতায় পড়ে ছাপাখানাগুলোতেও বিক্রি হতে পারছে না। জাতির কল্যাণের জন্য জারীকৃত অর্ডিন্যান্স এক্ষেত্রে লোকসানের মাত্রা বৃদ্ধি করছে। তাই যে কোনো কাজেরই ভালো-মন্দ দু’টো দিক আছে। সাদা কাগজের নতুনভাবে মূল্য বৃদ্ধি সেই জাতির কাছে বৃহত্তর কোনো কল্যাণের পথ উন্মুক্ত করবে কিনা সরকারকে তা ভালোভাবে ভেবে দেখতে হবে।
বিদ্যুৎ চুরি প্রতিরোধ করুন
কিছুদিন আগে সরকারীভাবে বিদ্যুতের মূল্য-হার বাড়ানো এবং কমানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধ, চুরি, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, বিশৃঙ্খলা এবং কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিই অন্যতম। এ ছাড়া, বিদ্যুত খাতে বকেয়ার পরিমাণ ৬ কোটি টাকা, এমনকি একমাত্র আদমজী মিলের কাছেই নাকি বিদ্যুৎ বিভাগের পাওনার পরিমাণ দেড় কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগকে সরকার লাভজনক খাতে পরিণত করতে চান, কিন্তু বিদ্যুৎ চুরি বন্ধ না করে বিদ্যুৎ বিভাগকে কি রাতারাতি লাভজনক খাতে পরিণত করা যাবে? বিদ্যুৎ বিভাগের ব্যবস্থাপনায়ও চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। সেজন্যই বিদ্যুতেরর মূল্য-হার বাড়িয়ে-কমিয়ে বিদ্যুৎ খাতের ঘাটতি পুরণ করা সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ বিভাগকে একটি লাভজনক খাতে পরিণত করতে হলে চুরি এবং বিশৃঙ্খলা সবার আগে দূর করতে হবে।
গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে বিদ্যুৎ চুরির এক তাৎপর্যপূর্ণ রিপোর্ট। বিভিন্ন শিল্প কারখানার উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত বিদ্যুতের মিটার রিডিং অনুযায়ী যে বিল হওয়ার কথা, কার্যতঃ নাকি তা না হয়ে সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার ঘটছে। অভিযোগে জানা যাচ্ছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ বিভাগের কতিপর্য অসাধু কর্মকর্তার কারসাজির ফলে কলকারখানার মালিক এবং ব্যবসায়ীরা বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের একটা হিল্লে করে নেন। এতে করে যেখানে হাজার হাজার টাকার বিল উঠার কথা, সেখানে নামে মাত্র কয়েক শ’ টাকা বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করা হয়ে থাকে। কলকারখানার মালিক এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের ‘ইনাম’ বাগিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগীয় অসাধু কর্মকর্তারা নিজেদের উদর পূর্তি করে থাকেন। এ ছাড়া কোনো কোনো কলকারখানায় দু’তিন বছর বিদ্যুৎ ব্যবহার করার পরও নাকি বকেয়া বিল পরিশোধের কোনো রকম তাগিদ নেই। এই সব বকেয়া বিল শেষ পর্যন্ত নাকি বিদ্যুৎ বিভাগীয কর্মকর্তা এবং কলকারখানার মালিকরা যৌথভাবে পরিশোধের জন্য ‘মনগড়া’ বিল তৈরী করে থাকেন। ফলে যা হবার তাই হয়। বকেয়া বিলের সব টাকা পরিশোধ হয় না। এই হচ্ছে অসাধুপনার একদিক। অন্যদিকে ছোট ছোট কলকারখানায় নাকি বেআইনীভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ধুম পড়ে গেছে। যাদের নামে দশঘোড়া শক্তি বিদ্যুৎ বরাদ্দ রয়েছে, তারা অবলীলাক্রমে কুড়ি পঁচিশ ঘোড়া শক্তি ব্যবহার করে চলেছে এ ছাড়া মিটারবিহীন বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর সংখ্যাও নিতান্ত নগণ্য নয়। অন্যের মিটার থেকে বেআইনীভাবে লাইন নিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীরাও নির্দ্বিধায় তাদের কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছে। ঢাকায় বিদ্যুৎ গ্রাহকের মোট সংখ্যা প্রায় দেড় লাখের মতো। এ ছাড়া ৫০ হাজারের মতো অবৈধ বিদ্যুৎ গ্রাহক তো রয়েছেই। মোদ্দাকথা, বিদ্যুৎ বিভাগে এক ভানুমতির খেল চলছে। চুরি, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি কারণে বিদ্যুৎ বিভাগ আজ এক আশংকার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। একমাত্র রাজধানী ঢাকা শহরেই যদি প্রতিমাসে কমপক্ষে ২০ লাখ টাকার বিদ্যুৎ চুরি হয়, তাহলে সরকার এই খাত থেকে লাভের অংক গুণবেন কেমন করে? অথচ সরকারের ইচ্ছে বিদ্যুৎ খাতকে একটি লাভজনক পর্যায়ে উন্নীত করা। বিদ্যুৎ মূল্য বাড়িয়ে এবং সাংসারিক কাজের জন্য বিদ্যুতের খরচ কমিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার আগামী আর্থিক বছরে চার কোটি টাকা আয় করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। বিদ্যুৎ বিভাগ একটি লাভজনক খাতে পরিণত হোক, এটাই আমরা কামনা করি। কিন্তু বিদ্যুৎ চুরি প্রতিরোধ এবং বিভাগীয় কর্মকর্তাদের অসাধুতা ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূর করা একটি অবশ্য করণীয় কাজ। বকেয়া বিদ্যুতের বিল আদায়ের ব্যাপারেও যাতে কোনো রকম কারচুপি না ঘটে, সেদিকে সংশ্লিষ্ট বিভাগের শুভদৃষ্টি দেয়া দরকার। বিদ্যুতের যারা মিটার রীডার তারা যাতে ‘ইনাম’ পেয়ে নির্দিষ্ট বিলের চেয়ে কম টাকা না নিতে পারেন, সেদিকেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাবলম্বন করা প্রয়োজন। বিদ্যুতের বকেয়া বিল, মাসেরটা মাসের শেষেই আদায় করতে হবে। বকেয়া বিল যদি দু’তিন বছর পড়ে থাকে, তাহলে অনাদায়ী বিল আদায়ের ব্যাপারে নানারকম জটিলতা সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিদ্যুৎ চুরি বন্ধ করার জন্য সমুদয় ব্যবস্থা অচিরেই গ্রহণ করবেন। নইলে দিনের পর দিন বিদ্যুৎ খাতের লোকসানের পরিমাণ বাড়বে ছাড়া কমবে না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক