দেখেছি মুক্তির আনন্দঃ জয়ের উল্লাসঃ স্বপ্ন সফল দৃষ্টি
(স্টাফ রিপাের্টার)
যশাের, ৯ ডিসেম্বর-বেনাপােল থেকে যশাের, যশাের থেকে খুলনার পথে পদ্মভিলা ঘুজি পর্যন্ত যতদূর গিয়েছে, লােকের মুখে দেখেছি মুক্তির আনন্দ, জয়ের উল্লাস, স্বপ্ন সফল দৃষ্টি। আর রাস্তার দুধারে ক্ষেতে ছড়ানাে পাকিস্তানীরা সৈন্যদের উর্ধ্বশ্বাসে পালানাের পথে ফেলে যাওয়া অজস্র গােলাবারুদ, অস্ত্র, বিধ্বস্ত গাড়ি, আর কিছু খানসেনাদের মৃতদেহ। সেই মৃতদেহকে ঘিরে এতদিনের বিভীষিকা মুক্ত মানুষবাঙলাদেশের মানুষ প্রতিহিংসা চরিতার্থ হবার উল্লাসে যেন ফেটে পড়েছে। তাদের মুখে ধ্বনি, “জয় বাঙলা, জয় ভারত”, হাতে সবুজ লাল সােনালি পতাকা। যশাের থেকে ১৬ মাইল পশ্চিমে নাভারণের কাছে শিয়ালকোণা গাতিপাড় গ্রামের জলিল সাহেব বলেন, আট মাস পরে এই তিনদিন হল একটু স্বস্তিতে আছে। একই কথা শুনলাম ঝিকরগাছায় গােরুহাটায় দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষের মুখে। ৮ মাস পর নাভারণ, ঝিকরগাছ, পুণের হাটের বাজারে কাতারে কাতারে মানুষ এসে ভিড় করছেন। কেউ গরুর গাড়িতে, কেউ রিক্সায়, কেউ মাথায় বোচকা বুচকি নিয়ে দীর্ঘদিন খান সেনাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার পর নির্ভয়ে নিজেদের গ্রামের দিকে শহরগঞ্জে ফিরে চলেছেন। যশাের শহর এখনাে থমথমে, কিন্তু মানুষ ফিরে আসতে শুরু করেছে, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি ভারতীয়বাহিনী এই এলাকায় মানুষের কাছে মুক্তির দূত। ভারতীয় বাহিনী ও পাকসেনাদের আচরণের মধ্যে, দখলদারবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে পার্থক্য প্রতিটি মানুষ উপলব্ধি করছেন। ভারতীয় জওয়ানরা মুখােমুখি পাক সৈন্যদের মােকাবিলা করে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে চলেছেন খুলনার দিকে। আর মুক্তিবাহিনীর সৈনিকেরা দায়িত্ব নিচ্ছেন আশু শান্তিরক্ষা ও শত্রুর দালালদের খুঁজে খুঁজে বের করে জনমতের দরবারে হাজির করার। গতকালই নাভারণের কাছে ইয়াহিয়া ফৌজের দালাল তিনজন ডাকাতকে গণআদালতের সামনে হাজির করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ও তা কার্যকরী করা হয়েছে। এই মৃত্যু পরওয়ানায় ৫০০ জন ভুক্তভােগী গ্রামবাসী স্বাক্ষর করেন। ফলে সমাজবিরােধীরা মাথা চাড়া দেবার আর কোনাে সুযােগ পায় নি বলে নাভারণের ইউনিয়ন কাউন্সিলের জনৈক সদস্য জানালেন। এই এলাকার প্রশাসন চালাবার জন্য ইতিমধ্যে মুক্তিবাহিনী, মুক্তিফৌজ, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি হয়েছে। আগামীকাল সেখান থেকে নির্বাচিত এম পি এ ঐ এলাকায় গিয়ে থানা পুলিশ প্রশাসক কাঠামােকে আরাে সুসংহত রূপ দেবার বিষয়ে আলােচনা করবে। উক্ত ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য জানালেন, দুই ন্যাপ’ এর কয়েকজন সদস্যও উল্লেখিত কমিটিতে আছেন, তবে আওয়ামী লীগের সভ্যরাই বেশি। তিনি জানালেন, “ ন্যাপ”-এর কর্মীরা প্রধানত গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছেন। ভারতীয় বাহিনীর প্রশাসনের ব্যাপারে কোনােও হস্তক্ষেপ করছেন না তারা শত্রু সৈন্যদের হঠাবার জন্যই লড়াই চালাচ্ছেন। যশাের থেকে দু’মাইল দূরে পশ্চিমে পুলের হাটে সড়ক সেতু দক্ষভাবে পাকিস্তানীরা ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু যে বিপুল সামরিক প্রস্তুতি এই এলাকায় পাকিস্তানীরা করেছিল, তা কাজে লাগাবার বদলে রণেভঙ্গ দেবার ব্যাপারে তাদের পারদর্শিতা বিস্ময়ের উদ্রেক না করে পারে না। পশ্চিম থেকে পূর্ব যশাের রােড ধরে এগুবার পথেই নজরে পড়ল নাভারণের ৬ মাইল ও ১ মাইল পশ্চিমে রাস্তার দু’ধারে উত্তর-দক্ষিণে আড়াআড়িভাবে প্রায় ৩ মাইল দীর্ঘ দুটি বাঁধ জুড়ে অসংখ্য বিবর ঘাঁটি। এই রকম আরাে একটি বিবর ঘাঁটির ‘ম্যাজিনে লাইন রয়েছে নাভারণের পূর্ব দিকে উগের বাগানে। স্থানীয় লােকদের বাগানে শুনলাম, মাত্র ১৫ দিন আগেই পাক সৈন্যরা এইসব বিবর ঘাঁটি তৈরি করেছিল। কিন্তু এইসব বিবর ঘাঁটি একেবারেই অক্ষত রেখে পাকফৌজ পালিয়েছে। আজ যশাের ক্যান্টনমেন্টে যশাের-খুলনা সেক্টরের ভারতীয় অধিনায়ক কর্ণেল দেশ পান্ডে ভারতীয় বাহিনীর অভিযান ব্যাখ্যা করে জানান যে, বয়ড়া থেকে গরীবপুর প্রথম যে সংঘর্ষ হয়, তারপর চৌগাছা পাক কবলমুক্ত করে উত্তর-পশ্চিমে আফরা, চূড়ামণকাটি হয়ে পিছন থেকে ভারতীয় বাহিনী হঠাৎ ৭ ডিসেম্বর যশাের ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে ফেলার ফলেই দিশেহারা পাক ফৌজ কোনও রকম প্রতিরােধ ছাড়াই ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়েছে। তিনি জানান আফরায় শত্রু সৈন্যরা একটা দৃঢ় প্রতিরােধ দেবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এই প্রতিরােধ চূর্ণ হবার পরেই পাক বাহিনীর প্রতিরােধ ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। ভারতীয় বাহিনী যশাের মুক্ত করার পর এখন খুলনার পথে যশাের থেকে প্রায় ৬ হাজার গজ এগিয়ে গিয়েছেন বলে তিনি জানান। পাকবাহিনীর প্রতিরােধ নামমাত্র হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় বাহিনীর অগ্রগতি এত মন্থর কেন এবং কেনইবা পাক সৈন্যদের খতম করা যাচ্ছে না, জনৈক বিদেশী সাংবাদিক এই প্রশ্ন করলে তিনি জানান, সরকারী নীতি অনুযায়ী অযথা প্রাণহানি তারা এড়াতে চান বলেই পলায়মান পাকিস্তানীদের উপর আক্রমণ, চালানাে হচ্ছে না। পাক বাহিনী যশাের ছাড়বার আগে নারী ও শিশুদের (এদের সংখ্যা প্রায় ১০০০) সঙ্গে নিয়েছে। এই নির্দোষ নারী ও শিশুদের প্রাণহানি হােক এটা ভারতীয় বাহিনী চায় না। কিন্তু ভারতীয় বাহিনী পাক বাহিনীর পিছু ধাওয়া করে ইতিমধ্যেই তাদের সন্ধান পেয়েছে। এই রকম একটি পলায়ন পাক বাহিনী গতকাল রূপদিয়ায় ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষে পাকিস্তানীদের একজন মেজরসহ ৪০ জনেরও বেশি হতাহত হয়েছে। রূপদিয়ার কাছে যশাের-খুলনা রােডের ধারে এই খান সেনাদের আট মৃতদেহ আমি পড়ে থাকতে দেখেছি।
সূত্র: কালান্তর, ১০.১২.১৯৭১