You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৭শে নভেম্বর, বুধবার, ১৯৭৪, ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

টেস্ট রিলিফ ও ওয়ার্কস প্রোগ্রাম

সম্প্রতি আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় দেশব্যাপী ওয়ার্কস প্রোগ্রামের কাজ শুরু ও সেই সাথে টেস্ট রিলিফ ব্যবস্থা জোরদার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। পার্টির উক্ত সভায় প্রধানতঃ বাধ্যতামূলক ধান চাল সংগ্রহ কর্মসূচী ও তা বাস্তবায়ন সম্পর্কিত আলোচনায় বেশীর ভাগ সময় ব্যয় হয়েছে বলেই হয়তো ওয়ার্কস প্রোগ্রামের কাজ ও টেস্ট রিলিফ জোরদার কর্মসূচী ঠিক কবে নাগাদ শুরু হবে সে সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। ব্যাপারটি যেহেতু অতীব গুরুত্বপূর্ণ, সেজন্য ঐ বৈঠকেই কাজ শুরু করা সম্পর্কিত দিন তারিখ ঠিক করতে পারলে একদিকে সরকার তার কর্মসূচী সম্পর্কে জনগণকে যথাযথ সময়ে অবহিত করতে পারতেন, অপরদিকে যাদেরকে নিয়ে কাজ করতে হবে সেই কর্মপ্রত্যাশী অভাবী লোকজনও অশেষ উপকৃত হতো। কিন্তু তা না হয়ে শুধুমাত্র সংসদ সদস্যদের উপর টেস্ট রিলিফ ও ওয়ার্কস প্রোগ্রামের দিন তারিখবিহীন দায়িত্ব অর্পণের সিদ্ধান্তের ব্যাপারটি যেন এই কাজের মুহুর্তেই খানিকটা দায়সারা গোছের হয়ে গেছে। সংসদের অধিবেশন শেষ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক বাধ্যতামূলক ধান চাল সংগ্রহ করতে সদস্যদের চলে যাওয়ার কথা ঠিক এই সাথেই কাজের সমন্বয় বিধান ও জাতীয় প্রয়োজনকে সামনে রেখে টেস্ট রিলিফ ও ওয়ার্কস প্রোগ্রাম সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী ঘোষণার প্রয়োজন ছিল।
শীত এসে গেছে। বিলের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। ওয়ার্কস প্রোগ্রাম শুরু করার সময়ই এটা। সেদিক দিয়ে যথা সম্ভব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করতে পারলে সামনে অন্ততঃপক্ষে আগামী তিন চার মাসে কাজও অনেকখানি এগিয়ে যেতো। তদুপরি এ কথাও ঠিক যে, যদিও নতুন ধান উঠতে শুরু করেছে তবু ফসলের পরিমাণানুযায়ী বাংলাদেশ কর্মপ্রত্যাশী বেকারের সংখ্যা অনেক বেশী। সবাই ধান কাটার কাজও যোগাড় করতে পারবে না। আর পারলেও জীবিকার এ মাধ্যমটি অত্যন্ত স্বল্পস্থায়ী। যারা আগেও বেকার ছিল, ভাগ্য আজও তাদের অনিশ্চিত। টেস্ট রিলিফের প্রয়োজনটা অতি জরুরী—সরকার নিজেও যখন তা বলছেন, তাহলে সেই জরুরী কাজটা অবিলম্বে শুরু করতে সরকারের কোনো অসুবিধা না থাকারই কথা।
এখন প্রশ্ন হলো : টেস্ট রিলিফ ব্যবস্থা এই প্রথম নয় আমাদের দেশে। অতীতে টেস্ট রিলিফ নিয়ে বহু কেলেংকারী হয়েছে। যাদের জন্য বরাদ্দ সেই অভাবী লোকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত থেকেছেন। আর সরকারের ওয়ার্কস প্রোগ্রামও বানচাল হয়ে গেছে জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের মধ্যে টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারাতে। রাস্তায় এক কোদাল মাটি ফেলে বা ছোট্ট একটা নালা কেটে পুরো টাকাটাই গায়েব করার নজির বিরল নয়। সুতরাং বিনা বিলম্বে এ সম্পর্কে সুষ্ঠু একটা কর্মসূচীত প্রণয়ন এবং অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এবারের টেস্ট রিলিফ ওয়ার্কস প্রোগ্রামের সাফল্যের দিক নির্দেশ করা সরকারের একান্ত অপরিহার্য।

ভুয়া তাঁতী সমবায় সমিতি প্রসঙ্গে

সরকারের সমবায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভুয়া তাঁতী সমবায় সমিতি খুঁজে বের করে তা বাতিল করার জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বলে একটি সংবাদে প্রকাশ। সারাদেশে তিন হাজার একশত ছিয়ানব্বইটি প্রাথমিক তাঁতী সমবায় সমিতি রয়েছে। কর্তৃপক্ষের অনুমান, এই বিরাট সংখ্যার মধ্যে শতকরা পঁচিশ ভাগই ভুয়া সমিতি। জানা গেছে, আগামী জানুয়ারী মাসের প্রথম দিকেই ভুয়া তাঁতী সমবায় সমিতি খুঁজে বের করার কাজ সমাপ্ত হবে। এ উপলক্ষে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তাতে সারাদেশে একটি প্রশ্নমালা বিতরণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। প্রত্যেকটি তাঁতী সমবায় সমিতিকে তিনটি প্রশ্নমালা পূরণ করে তার একটি ৭ই ডিসেম্বরের মধ্যে থানা সমবায় সমিতির কার্যালয়ে এবং একটি সমবায় দপ্তরে প্রেরণ করতে হবে। ঐ প্রশ্নমালায় তাঁতী সমবায় সমিতি সম্পর্কিত কয়েকটি প্রয়োজনীয় তথ্য সম্বলিত প্রশ্ন ও একটি শপথনামা রয়েছে। জিজ্ঞাসিত প্রশ্নসমূহের উত্তর পূরণ করে প্রাথমিক তাঁতী সমবায় সমিতির ছয়জন ডিরেক্টরের ছবি সহ পরিচিতি একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে সত্যায়িত করতে হবে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর পৌঁছার পর তা বাছাই করা হবে। এবং পরবর্তীকালে বাছাইকৃত প্রশ্নগুলোর তদন্ত অনুষ্ঠানের জন্য মহকুমা পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসনযন্ত্রের প্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধি গ্রহণ করা হবে। এ তদন্ত কাজ শেষ হলেই ভুয়া সমিতি বাতিল করা হবে বলে ঘোষণায় জানা গেছে। ভুয়া তাঁতী সমবায় সমিতি খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষ উপরিউক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করেছেন। উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে মহৎ এবং কার্যকরী করতে পারলে ফলদায়ক হবে। ভুয়া তাঁতী সমবায় সমিতি খুঁজে বের করে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা আমরা ইতিপূর্বে বহুবার বলেছি। আমরা বার বার কর্তৃপক্ষের কাছে সূতা কেলেংকারীর মূলে ভুয়া তাঁতী সমবায় সমিতি ও ভুয়া ফ্যাক্টরীর মালিকদের কারসাজির কথা উল্লেখ করেছি। মানুষের বস্ত্র সমস্যার প্রাথমিক সমাধান ও তার জন্য উৎপাদন বাড়ানো ব্যাহত হওয়ার মূলে সূতা কেলেংকারী ছিল একটি অন্যতম ব্যাপার। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষও বহুবার বহু আশ্বাস বাণী জাতিকে শুনিয়েছেন। কিন্তু ভুয়া তাঁতী বা ফ্যাক্টরী তারা খুঁজে বের করতে পারেননি। দেশে নানা প্রকার ভুয়া প্রতিষ্ঠান জন্ম নিয়েছে কর্তৃপক্ষের এমনি নানা গাফিলতির দরুণ। কয়েকদিন পূর্বে কর্তৃপক্ষ নারায়ণগঞ্জ থেকে একটি হোসিয়ারী সমিতির কাগজপত্র আটক করেছেন। দুর্নীতি ও টাকা আত্মসাতের কারণে বাংলাদেশ হোসিয়ারী সমিতির কাজ কর্ম বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। এবং সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সতেরো লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এমনি প্রকার বহু প্রতিষ্ঠান আজ দুর্নীতি ও টাকা আত্মসাতের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষ যদি এ ধরনের দুর্নীতি দমন করতে না পারেন তাহলে অবশ্যই সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমান্বয়ে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হতে বাধ্য। সরকারের সমবায় বিভাগ ভুয়া তাঁতী সমবায় সমিতি খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার যে পরিকল্পনা নিয়েছেন তা অত্যন্ত বাস্তব এবং প্রয়োজনীয় একটি ব্যাপার। আমরা এর সাফল্য কামনা করি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা কর্তৃপক্ষকে স্মরণ করিয়ে দেবো তদন্ত নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য। সকল রাজনৈতিক ক্ষমতাধর মানুষের বেলায়ও যাতে করে কর্তৃপক্ষের আইন সমানভাবে প্রযোজ্য হয় সেদিকেও তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে। ভুয়া সমিতি বা প্রতিষ্ঠানের উচ্ছেদ অভিযান যত দ্রুত সফল হয় ততই জাতির মঙ্গল বলে আমরা মনে করি।

অন্ধ জনে দেহ আলো

মানুষ চিরদিন বেঁচে থাকে না। এই ধরণীর ধুলিধাম থেকে একদিন সবাইকেই বিদায় নিতে হবে। সব আলো নিভে যাবে, সব হাসি-গান, দেনা-পাওনা একদিন চুকিয়ে বুকিয়ে দিতে হবে। প্রতিটি মানুষের জীবনেই এটা চিরন্তন সত্য। কিন্তু যাঁরা বেঁচে থেকেও পৃথিবীর সব আলো, সব দৃশ্যমান সুখ-স্বাচ্ছন্দ থেকে বঞ্চিত, সেইসব হতভাগ্যদের দুর্ভাগ্যের কি কোনো অবসান নেই? অন্ধত্বের অভিশাপ নিয়ে যারা পৃথিবীর বুকে বেঁচে থেকেও বিড়ম্বিত জীবন যাপন করছেন, তাদের জীবন কি আলোময় করে তোলা প্রতিটি মানব প্রেমিক কল্যাণকামী মানুষের কাম্য হওয়া উচিত নয়? ‘অন্ধজনে দেহ আলো’ এই কথাটি কি শুধু কবির কথা হিসেবেই বিরাজিত থাকবে? কিছুদিন আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ তথ্য প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের প্রায় দশ লক্ষ নর-নারী দৃষ্টিহীনতায় ভুগছেন। পুষ্টিহীনতা এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিনের অভাবই বিপুল সংখ্যক মানুষ দৃষ্টিশক্তি হীনতায় ভুগছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দৃষ্টিহীনদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে দেশে-বিদেশে চিকিৎসক সম্প্রদায় যে একেবারেই চিন্তা-ভাবনা করছেন না, তা নয়। মৃত ব্যক্তির চোখ দৃষ্টিহীনদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে পারে। সে জন্য দরকার চক্ষু হাসপাতাল এবং চক্ষু ব্যাংকের। কিছুদিন আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন লায়ন্স ক্লাবের উদ্যোগে দেশের প্রথম চক্ষু ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই চক্ষু ব্যাংকের সহায়তায় দেশের লক্ষ লক্ষ দৃষ্টিহীন মানুষ যে নতুন জীবনের স্পন্দনে উজ্জীবিত হয়ে উঠবেন তাতে কারো দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দু’দিনব্যাপী বাংলাদেশ চক্ষু চিকিৎসক সমিতি’র দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। সম্মেলনে অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্তির আলোক স্পর্শে উত্তরণের জন্য মৃত ব্যক্তির চক্ষু সংগ্রহ সম্পর্কে চক্ষু চিকিৎসক সমিতির পক্ষ থেকে আইনগত সাহায্য চাওয়া হয়েছে। এই আইনগত ব্যাপারটি অদূরভবিষ্যতে সরকারীভাবে বাস্তবায়িত করার কথাও বিবেচনা করা হচ্ছে। অন্ধ কল্যাণ সমিতিও অন্ধত্ব মোচনের সংগ্রামে শরীক রয়েছে। মৃতজনের চক্ষু দানের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে বহুবার বহুভাবে আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু চক্ষু ব্যাংকে চক্ষু দানের ব্যাপারে কতটা সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, তা আমরা সঠিক জানিনা। আমরা শুধু এইটুকু উপলব্ধি করতে পারি যে, মৃত ব্যক্তিদের চক্ষু ‘আই ব্যাংকে’ দানের ব্যবস্থা করা হলে, এদেশের দৃষ্টিহীনরা উপকৃত হবে, ফিরে পাবে দৃষ্টিশক্তি। জনৈকা বিদেশিনী বাংলাদেশে সেবা কার্যে এসে মৃত্যুবরণ করলে, তার অন্তিম ইচ্ছেনুযায়ী তার চোখ দু’টি চক্ষু ব্যাংকে দান করা হয় এবং এতে করে একজন অন্ধ মানুষ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে। ঐ বিদেশিনীর মতো আমরাও যদি চক্ষু দানের উজ্জ্বল উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলে দেশের অন্ধজনের নতুন জীবন প্রাপ্তি ঘটবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্ধত্ব একটি অভিশাপ। এ অভিশাপের হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে হলে আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্নতার অন্ধকারে ডুবে থাকলে চলবে না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!