You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১০ই নভেম্বর, রবিবার, ১৯৭৪, ২৩শে কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

সুস্পষ্ট পরিকল্পনাহীন সৎ ইচ্ছা

খাদ্য সংগ্রহের জন্য সরকারের তরফ থেকে সুস্পষ্ট পরিকল্পনাহীন কিছু সরল সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। ক’দিন আগে উত্তরবঙ্গে এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে খাদ্যমন্ত্রী এমনি একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন। আমরা এই পদক্ষেপের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এবং গত বৎসরের ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা সামনে রেখে ভেবেছিলাম এবার খাদ্য সংগ্রহ অভিযান সফল করে তোলার ব্যাপারে নিশ্চয়ই সরকারী প্রশাসনযন্ত্র এবং সরকারী দল, আওয়ামী লীগ সকল শক্তি সংহত করে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেই সম্ভাব্য ব্যাপক কর্মযজ্ঞের খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে সার্বিক একটা পরিকল্পনা গ্রহণে দলীয় নেতৃবৃন্দ, সরকারী প্রশাসনযন্ত্র এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় কিছু সময় নিলেও কারো কিছু বলার ছিল না। কিন্তু অন্ততঃ এই একটি ব্যাপারে সরল সিদ্ধান্ত ঘোষণায় খাদ্য মন্ত্রণালয় বিলম্ব করেননি। সেক্রেটারিয়েটে বসে একটা ফাইল তৈরী করে তা মন্ত্রী মহোদয়ের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তিনিও সাংবাদিক সম্মেলনে ডেকে ‘উদার এবং প্রগতিশীল’ এই সিদ্ধান্তের কথা সাংবাদিকদের জানিয়ে দিয়েছেন।
সরকারী পর্যায়ে খাদ্য সংগ্রহের উদ্যোগকে আমরা বরাবর অভিনন্দন জানিয়ে এসেছি। অভাবের দিনে এই সংগৃহীত খাদ্যশস্য যে বাজারে সরবরাহ অব্যাহত রাখতেই সাহায্য করে তাই শুধু তাই নয়, বরং মওজুতদার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারেও তা সরকারকে যথেষ্ট শক্তি যোগায়। এর গুরুত্বের কথা উপলব্ধি করেই আমরা তা বাস্তবায়নে একটা ব্যাপক বাস্তব, সুস্পষ্ট এবং সমন্বিত কার্যক্রম গৃহীত হবে বলে আশা করেছিলাম।
গত বৎসর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে খাদ্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করা হলেও শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে তা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। এবার খাদ্য সংগ্রহের কোনো লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়নি। মূল্য নির্ধারণের বিষয়টিও স্থগিত রাখা হয়েছে চারদিনের জন্য। খাদ্য সংগ্রহের এই মূল্য নির্ধারণের ব্যাপারে চারদিন বিলম্ব করার কারণ হয়তো বাজারে চালের দাম একদিনে কোথায় গিয়ে ঠেকবে সে সম্বন্ধে কোনো ধারণার অভাব।
বিগত বৎসরে খাদ্য সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হবার কারণগুলো সময়ের সাথে সাথে শেষ হয়ে যায়নি। যাদের সঙ্গে বার বার বৈঠক করে খাদ্য দপ্তরের পূর্বতন মন্ত্রী এবং একের পর এক হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বর্তমান মন্ত্রী চালের দাম নিজেদের ইচ্ছে মতো এক পয়সাও কমাতে পারেননি সেই চাল ব্যবসায়ীরা যাতে সরকারের সাথে প্রতিযোগিতা করে খাদ্যশস্য ক্রয় করতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সাংবাদিক সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। ঘোষণা করেছেন সীমান্তে চোরাচালান রোধ করার ব্যাপারে সেই একই ‘কঠোর ব্যবস্থা’র অস্ত্র প্রয়োগের কথা। সব মিলিয়ে আমাদের খাদ্যশস্য সংগ্রহের এই পদক্ষেপকে ‘সৎ ইচ্ছের’ প্রতিফলন ছাড়া আর বেশী কিছু মনে হয়নি।

অনধিকার প্রবেশরত ট্রলার সম্পর্কে

গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজার উপকূল থেকে মাত্র চার মাইল দূরে আমাদের মাছ চুরি করছিল ২০টি বিদেশী ট্রলার। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জওয়ানরা তার মধ্য থেকে ৩টি থাই ট্রলার আটক করতে সক্ষম হয়েছে, বাকীগুলো পালিয়ে গেছে এবং সেগুলো কোন্ দেশের তা জানা যায়নি। আটক ৩টি ট্রলারের চুরি করা মাছের পরিমাণ হলো ত্রিশ টন। দেশের দু’টি জাতীয় দৈনিকে সবিস্তারে গতকাল এ সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে।
বিদেশী ট্রলারের আমাদের সমুদ্র সীমায় মাছ ধরার ঘটনা এই প্রথম নয়। সপ্তাহখানেক আগেও অনুরূপ দু’টি ট্রলার আটক করা হয়েছিল, তবে বহিঃনোঙরে থেকে সে দু’টো কেন বা কি কারণে পালিয়ে যায় তা জানা যায়নি। গত মার্চ মাসেও একটি থাই ট্রলার ধরা পড়েছিল। উপযুক্ত মুচলেকা প্রদানের পর সেটাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল এ কারণে যে, পুনরায় তারা বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় মাছ চুরি করতে আসবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল—নরম কথায় কোনো ফল হলো না। বাংলাদেশের মাছ চুরি অব্যাহত রয়েছে সমান গতিতে।
মাছ—বিশেষতঃ সামুদ্রিক মাছ বাংলাদেশের এক অমূল্য সম্পদ। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক আমলে শাসক চক্র বাংলার এ অফুরন্ত সম্পদ রক্ষার দিকে কোনো নজর দেয়নি।
ফলে বিদেশী মাছ ধরা জাহাজগুলো অবাধে বাংলাদেশের সাগরে থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টন মাছ ধরে নিয়ে গেছে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী কালেও তাদের সে চৌর্যবৃত্তি অব্যাহত রয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের দেয়া ট্রলারগুলো প্রমাণ করেছিল বাংলাদেশের সাগরবক্ষ এক মহাসম্পদের ভান্ডার—কিন্তু সেই থেকেই এই ট্রলারগুলোর নাবিক ও উপকূল ভাগের জেলেদের কাছ থেকে প্রায়ই অভিযোগ আসছিল যে, তারা আপন দেশের সমুদ্র সীমায় বিদেশী ট্রলারের উৎপাতে অতিষ্ঠ এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তারই উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
আমাদের প্রধান কথা, যে কোনো দেশেরই ট্রলার হোক না কেন, আমাদের সমুদ্র সীমায় যে-ই অনধিকার প্রবেশ করবে সে অপরাধী এবং কোনোক্রমেই এই ধরনের বেআইনী ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী তৎপরতা চালাতে দেয়া যেতে পারে না। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় একচ্ছত্র অধিকারী বাংলাদেশ। সুতরাং অনধিকার প্রবেশ ও অন্যায়ভাবে যারা আমাদের সম্পদ লুন্ঠন করতে এসে ধরা পড়েছে—সংশ্লিষ্ট সেদেশের সরকারের তরফ থেকে তাদের কার্যবিধির জিম্মাদার হতে হবে এবং সে সরকারের তরফ থেকে পরিপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যেন বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় তাদের দেশের কোনো ট্রলারকে অনধিকার প্রবেশরত দেখা না যায়।
এ প্রসঙ্গে আমাদের সরকারের কাছে কিছু বক্তব্য রাখা প্রয়োজন মনে করি। বাংলাদেশের উপকূলভাগ বিস্তীর্ণ এবং সাগরবক্ষ অঢেল সম্পদে পরিপূর্ণ। শুধুমাত্র বহিঃশত্রু আক্রমণ প্রতিহত করা নয়, অমূল্য সম্পদ পাহারা দেয়ার জন্য যদি রণতরী অথবা গানবোটের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হয়, সে কথাই সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবেন।

সম্পদ থাকতেও আমরা ভিখিরি কেন?

দুঃখ হয় সম্পদ থাকতেও আজ আমরা ভিখিরি সেজে বসে আছি। বিদেশী বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, বাংলাদেশ নাকি প্রাকৃতিক সম্পদের আকররূপী। রোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব খাদ্য সম্মেলন সূত্র থেকে প্রকাশিত এক তথ্যে বলা হয়েছে যে, নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে অপরিমেয় গ্যাস মওজুত আছে। এই অপরিমিত প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অন্ততঃপক্ষে আরো দু’টি নতুন ইউরিয়া সারকারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিলে ১৯৮০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সার রপ্তানীকারক দেশে পরিণত হতে পারে।
রোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব খাদ্য সম্মেলন সূত্র থেকে আরো বলা হয়—বিশ্বব্যাপী সার ঘাটতির প্রেক্ষিতে অনেক দেশে খাদ্যেৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ সূত্র থেকে বলা হয়েছে যে, উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে যদি বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ সার আমদানী না করা হয়, তবে দেশ ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন হবে। একদিকে দেশের চাহিদা ও অন্যদিকে বিশ্বে সার উৎপাদন ঘাটতি—এই দুই পটভূমির প্রেক্ষিতেই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে পর্যাপ্ত সার উৎপাদনের কথাটা আজ আন্তর্জাতিক পর্যালোচনায় স্থান পেয়েছে।
এ কথা সত্য যে, বিশ্বের খাদ্য ঘাটতি সমস্যা ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যায় ভারাক্রান্ত দেশগুলোকে খুবই আতংকগ্রস্ত করে তুলেছে। কারণ, উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের খাদ্য ঘাটতির ব্যাপারে যে সমস্ত খাদ্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত দেশগুলোর প্রতি নির্ভরশীল ছিল-বলা হচ্ছে তাদের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এবং এও ঠিক যে, খাদ্য ঘাটতির মোকাবেলা করা কোনো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষেই দু’এক বছরের কাজ নয়। মোটামুটিভাবে একটু লম্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে তাদেরকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মসূচী বাস্তবায়িত করতে হবে। ফলে নির্ভরশীল দেশগুলো আজ উভয় সংকটে। এই অবস্থায় নিজেদের উৎপাদন বাড়ানোর বাস্তব চিন্তাই তাদের রক্ষা করতে পারে। সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সারের প্রয়োজন হবেই।
আমরা জানি যে, সাজসরঞ্জাম ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব আনতে পারে। এবং জমির উর্বরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একর প্রতি ফসল উৎপাদন বাড়ানোও সম্ভব। আর সকল ক্ষেত্রেই সারের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সৌভাগ্য যে আমাদের তথা বাংলাদেশের মানুষের এমন সম্পদ আছে যাকে কাজে লাগালে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার সুফল প্রাপ্তি প্রত্যক্ষ হয়ে উঠবে।
সার কারখানা করার ব্যাপারে বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতা পাবে, বিশ্ব খাদ্য সম্মেলন সূত্র সে দিকেও ইঙ্গিত করে। উক্ত সূত্র জানায় যে, উন্নত দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যেই সার কারখানা স্থাপনে বাংলাদেশকে সাহায্য দানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চট্টগ্রাম ও সিলেট সার কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা ইতিমধ্যে কয়েকটি দেশের পরীক্ষাধীন রয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সফর শেষে জাপানের নাগানো মিশন কৃষি শিল্পের কাঁচামাল ও খুচরা অংশ সরবরাহের মাধ্যমে শিল্প কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা পূর্ণভাবে কাজে লাগানো এবং উপকূলবর্তী সমুদ্রগর্ভে তেল ও গ্যাস সন্ধান প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে সহযোগিতার সুপারিশ করে এক রিপোর্টও পেশ করা হয়েছে।
পরিশেষে বক্তব্য এই যে, আমাদের সম্পদ আছে এটা সত্য, সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস আসছে এ কথাও যথার্থ, কিন্তু এসব প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির বিলম্বিত ধানাই-পানাই অসহ্য। ঘরে একতাল সোনা রেখে না খেয়ে মরার কোনো বাহাদুরী নেই। বিশেষ করে প্রতিযোগিতার বিশ্বে নিজস্ব সম্পদ ও সামর্থ নিয়ে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার চূড়ান্ত সময়। এখন সময়ের অপব্যবহার মানেই ধ্বংস। তাই সর্বাত্মক চেষ্টায় আশু তাগাদার ভিত্তিতে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে এ ভাঙা অর্থনীতির মেরুদন্ডকে ঋজু করে তুলতেই হবে, যাকে অবলম্বন করে আমরা বাঁচবো এবং সুখ সমৃদ্ধির মুখ দেখতে পাবো।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!