You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
১২ই জানুয়ারী, ১৯৭৩, শুক্রবার, ২৮শে পৌষ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

প্রতিরোধের শপথ দীপ্ত পল্টন

ঢাকা পল্টন বিক্ষুব্ধ অথচ সংযত। লাখো লাখো মানুষ এসেছে, এসেছে ঢাকা নগরীর বিভিন্ন প্রান্তর থেকে হাজারো মিছিল, ফেস্টুন, ব্যানারে উৎকীর্ণ বিক্ষোভের ভাষা বহন করে সকল মিছিল-শোভাযাত্রা আছড়ে পড়েছে পল্টনের জনসমুদ্রে। প্রতিরোধের সংগ্রামী মানুষ সোচ্চার ঢাকার অগণিত জনতা আর আবার প্রমাণ করেছে বাংলার বিরুদ্ধে, বাঙালীর আশা-আকাঙ্ক্ষার বিমূর্ত প্রতীক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কোন চক্রান্ত, কোন ষড়যন্ত্র জাতি বরদাস্ত করতে রাজী নয়।
বিশ্ব যখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার উপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্ত যখন বাংলার শান্তিকামী অগ্রযাত্রার উপর শ্যেন ‍দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে, বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র ভূখন্ডকে সীমানা যখন ‘মহাশক্তিধরদের’ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা উত্ত্যুঙ্গে মেতেছে তখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রতিক্রিয়াশীলদের প্ররোচনায় অথবা বিদেশী প্রভুদের নির্দেশে জনমনে ত্রাস, আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রয়াস যে গণবিরোধী দুশমনদেরই কারসাজি এ বিষয়ে আজ আর কারো দ্বিমত নেই। এই প্রয়াসকে স্বাভাবিকভাবেই সংগ্রামী জনতা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক একটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সংগ্রামী এই গণসংগঠনের মূলশক্তি বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনতা। এই জনশক্তিকে সম্বল করেই আওয়ামী লীগ অতীতে নানা প্রতিক্রিয়াশলি চক্রান্তের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের পর মুহূর্তেই তাই জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতার উপর পরিপূর্ণ আস্থা রেখে আওয়ামী লীগ সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই উদ্যোগকে সফল গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন রয়েছে গণতন্ত্রকামী সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনের সহযোগিতা। গত পরশুর বিক্ষুব্ধ জনসমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়েও সেই একই মনোভাব ও মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে।
গত পরশু ছিল আওয়ামী লীগের প্রতিরোধের দিবস। এই প্রতিরোধ কোন দল বা ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে নয়, বরং সেই মানসিকতার বিরুদ্ধে যা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে তার সার্বভৌমত্ব, অগ্রযাত্রা ও মর্যাদার বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত। এই প্রতিরোধ আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের প্রবীণতম নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র, উৎপাদন ব্যাহত করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাঁধা সৃষ্টি, দুর্নীতি এবং সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে যারা রাজনৈতিক আবহাওয়াকে কলুষিত করতে চায় তাদেরই বিরুদ্ধে আজ বলিষ্ঠ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’ পরশুর পল্টন সেই প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতেই শপথ নিয়েছে, নির্বাচন তথা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে সকল বাঁধা-বিঘ্নকে অপসারণ করে, দেশী-বিদেশী সকল চক্রান্তকে নস্যাৎ করে সাম্প্রদায়িকতা ও যুদ্ধোন্মদনার বিষদাঁত উপড়ে দিয়ে বাংলার বুকে সুখী-সমৃদ্ধিশালী এক সমাজ গঠনের। এ পথ মুজিবের পথ, এ পথ বাংলার মেহনতী মানুষের পথ, এ পথে মুক্তি, এ পথেই শান্তি। পল্টন পুনরায় সেই মুক্তি ও শান্তির স্বপক্ষেই রায় দিয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ এই রায়কে সহজভাবে মেনে নিতে পারবেন কিনা জানিনা। জানিনা গুপ্ত হত্যা ও উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্য দিয়ে তারা কোন্ সোনার হরিণ শিকার করতে চান। কিন্তু সুস্থ ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সকল ব্যক্তি ও সংগঠনের কাছে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে, জনগণের বৃহত্তর কল্যাণের প্রয়োজনে হিংসা, হানাহানি ও কুৎসা রটনার পথ পরিহার করতে। অতীত ভ্রান্তিকে স্বীকার করে নিয়ে ভবিষ্যত কর্মসূচী প্রণয়ন করতে। ভুল, সে যে কারণেই হয়ে থাকুক না কেন তা স্বীকার করে নেয়ার মধ্যে কোন লজ্জা নেই। জনগণের রায়কে মাথা পেতে নেয়াই রাজনৈতিক বিচক্ষণতার কাজ বলে আমরা মনে করি।
০০০

যমুনার উপর সেতু নির্মাণ প্রসঙ্গে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাটোরের জনসভায় পুনরায় ঘোষণা করেছেন—‘আমি বেঁচে থাকলে যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মিত হবেই।’ ইতিমধ্যে জাপানের একটি প্রতিনিধিদল প্রাথমিক জরিপ কাজ শেষ করে গেছেন বলেও তিনি জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী নাটোরো আরো বিস্তারিতভাবে ঘোষণা করেছেন যে, যমুনার উপর পৃথিবীর সবচাইতে দীর্ঘ সেতু নির্মিত হবে। এটি তৈরী করতে দু’শো কোটি টাকার মতো খরচ হবে বলে তিনি জানান। ইতিমধ্যেই যোগাযোগমন্ত্রী এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সেতু নির্মাণ সম্পর্কিত আনুষ্ঠানিক কাজ সমাপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। জাপান থেকে যে বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিদল ইতিমধ্যে জরিপ করে গেছেন তাদের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ-জাপান সরকারের যৌথ উদ্যোগে অনতিবিলম্বে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করার জন্যে চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে বলেও জানা গেছে। মূলতঃ বাংলাদেশ সরকার বদ্ধপরিকর যমুনার উপর সেতু নির্মাণের জন্যে। স্বাধীনতার পূর্বে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও এটা ছিলো একটি অন্যতম সাংগঠনিক দাবী। পরবর্তীকালে স্বাধীনতার পর সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই এই সেতু নির্মাণের প্রকল্পের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এবং বিভিন্ন সভা-সমিতিতেও বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের কথা ঘোষণা করেছেন। আর এজন্যে জাপান সরকারের সঙ্গে আলোচনা মধ্য দিয়ে সেতু নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। জাপানী বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিদলের প্রাথমিক জরিপ কাজও ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নিমিত্তেই যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণ অপরিহার্য। পূর্বের দিনেও রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ হতাশাব্যঞ্জক ছিলো। তৎকালের সরকার উত্তরবঙ্গের মানুষের কল্যাণের জন্যে যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নাই। ফলে উত্তরবঙ্গের মানুষের আঞ্চলিক দাবী-দাওয়া বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো। তাদের ক্ষোভ ছিলো, একেতো বাংলাদেশ অবহেলিত তার উপর উত্তরবঙ্গ সম্পূর্ণভাবেই কর্তৃপক্ষের দয়ার আশ্রিত। সমস্ত প্রকার উন্নয়ন প্রকল্প থেকেই উত্তরবঙ্গকে দয়া প্রদর্শন করা হতো। কেননা পাকিস্তানী সরকারের যৎকিঞ্চিৎ উন্নয়নের কাজ ঢাকামুখী হয়েছে। একই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতি বিভিন্ন প্রকার বিমাতাসুলভ সরকারী আচরণের বিরুদ্ধে অন্যান্যদের চেয়ে উত্তরবঙ্গের মানুষের ক্ষোভ আরও বেশী প্রকট ছিলো। সারা বাংলাদেশের মানুষের ন্যায় উত্তরবঙ্গের মানুষও চিরদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা প্রদর্শন করে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর কন্ঠেই বার বার প্রতিধ্বনিত হয়েছে গোটা দেশের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের মানুষেরও আশা-আকাঙ্ক্ষা। আজ বঙ্গবন্ধুর সরকার বদ্ধপরিকর দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে অবহেলিত উত্তরবঙ্গের ও উন্নয়ন করতে। বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের সঙ্গে সারা বাংলাদেশের সকল অঞ্চলের সম্পর্ক নিবিড়। তাই তিনি বলেছেন—আঞ্চলিকতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে সকল অঞ্চলের সমভাবে উন্নয়নের কথা। তবে যারা বেশী ক্ষতিগ্রস্ত তাদেরকে তিনি সর্বদাই অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী। আর সে কারণেই উত্তরবঙ্গের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন রাজধানীর সঙ্গে তার যোগাযোগের উন্নতি সাধন করা। রাজধানীর সঙ্গে উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি তথা গোটা উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবনের উন্নতি নির্ভর করছে যমুনা নদীতে সেতু নির্মাণের উপর। আধুনিক যুগের সমাজ গঠনে এবং সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ সুদৃঢ় ও বাস্তবায়নের জন্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন একান্ত অপরিহার্য। এই ‘অপরিহার্যতার’ জন্যই যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণ হলে আমাদের সোনার বাংলা গড়ার পথেও একটি ভিত্তি নির্মাণের সূচনা হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!