You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৫ই মার্চ, শুক্রবার, ১৯৭৪, ১লা চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

দুর্নীতিবাজদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দাও

দুর্নীতি জিনিসটা আমাদের রক্তে-মাংসে হাড়ে মজ্জায় যেন মিশে গেছে। বর্তমান সমাজ সংসারে নীতি-দুর্নীতির তাই বড়ো একটা বালাই নেই। বরং দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্তির জন্যে যদি কেউ কোনোদিন ক্ষীণতম আশার আলোয় আলোকিত হন, তাহলে তাঁর মনের জোর এবং ইচ্ছে শক্তিরই প্রশংসা করতে হয়। কিন্তু সমাজের চারদিকে দুর্নীতি আর অনাচারের সীমাহীন প্রাবল্য দেখে কেউ কি তেমন আশাবাদী হতে পারেন? সমকালীন সমাজদেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এমন কি, গৃহ নির্মাণ ঋণদান সংস্থার বিরুদ্ধেও চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির অভিযোগ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। গৃহনির্মাণ ঋণদান সংস্থা এখন আর সাধারণ মানুষের কল্যাণব্রতে নিয়োজিত নেই, গৃহনির্মাণ ঋণদান সংস্থার কর্মচারীরা নাকি চরম অসাধুপনায় নিমগ্ন। বাস্তুভিটা, জমিজমা ইত্যাদি বন্ধকী রেখে যদি কেউ পঁচিশ হাজার টাকা ঋণ নিতে চান, তাহলে তাকে দশ হাজার টাকা ঋণদান সংস্থার কর্মচারীদের পকেটে গুঁজে দিয়ে আসতে হয়। পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ নিতে গেলে ক্রমানুপাতে সেলামীর পরিমাণ বিশ হাজার টাকায় উন্নীত হয়ে যায়। গৃহনির্মাণ ঋণদান সংস্থার কর্মকর্তারা নিরীহ জনসাধারণের পকেটে এভাবে হানা দিয়ে চলেছে। যারা ঋণ গ্রহণ করতে চেষ্টা করে সেই সব ভুক্তভোগীরা নিরুপায় হয়েই তাদের নাস্তানাবুদ অবস্থার ফিরিস্তি ব্যাখ্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। ঋণগ্রহীতারা ঋণদান সংস্থার কর্মকর্তাদের পাল্লায় পড়ে নাকের জলে চোখের জলে একাকার হচ্ছেন ক্রমাগত। পাঁচ হাজার টাকার একটি চেক সংগ্রহ করতে নাকি ঋণগ্রহীতাকে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা দিতে হয় আক্কেল সেলামী। এছাড়া, লালফিতার কারবার তো আছেই। এক টেবিল থেকে অপর টেবিলে একটি ফাইল মুভ করতেও নাকি কর্তাদের নগদ প্রাপ্যটুকু কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে না দিলে ফাইলের গতি স্তব্ধ হয়ে মুখ থুবড়ে নির্দিষ্ট টেবিলে গড়াগড়ি যায়। সবকিছুই ‘সেলামীর নিগড়ে বাঁধা।’ গৃহনির্মাণ ঋণদান সংস্থার অভ্যন্তরে এই সেলামী নামক প্রথাটির প্রকোপ থেকে কোনো ঋণগ্রহীতারই নিস্তার পান না। এর চেয়েও মারাত্মক এবং পরমাশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, বিগত আর্থিক বছরের চূড়ান্ত হিসেব নিকেশও গৃহনির্মাণ ঋণদান সংস্থার মতো একটি প্রতিষ্ঠান নাকি অদ্যাবধি দেয়ার কোনো সময় পাননি। তাই চূড়ান্ত হিসেব দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বড়ো কর্তাদের টনক নড়েছে। ফলে, তড়িঘড়ি একটা হিসেব যাও বা দাঁড় করানো হয়েছে, তা থেকেও সর্ষের ভূত অপসারিত হয়নি। অবাঙালীদের বাড়ী হস্তান্তর নিয়েও চলছে এক ভানুমতির খেল। মোটা অংকের উৎকোচ গ্রহণ করে বড়ো কর্তারা ভুঁড়ি ফুলিয়েছেন এবং বাড়ীর মূল্য কমিয়ে পাইকারী হারে এই সব বাড়ী হস্তান্তরের কর্মটি সমাধা করেছেন। এদিকে ঋণদান সংস্থা বিপুল পরিমাণে আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গৃহনির্মাণ ঋণদান সংস্থার নিজস্ব ভবনের নীচের তলায় কিছু দোকানপাট ভাড়া দেয়া হয়েছে। এখানেও কর্তাব্যক্তিদের কারচুপির ফলে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থার উদ্রেক হয়েছে। সংস্থা প্রতিমাসে কুড়ি থেকে পঁচিশ হাজার টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। দুর্নীতির ব্যাপকতা আরো আছে। সংস্থার ৭ থেকে ১০ তলা ভবন নির্মাণের কাজেও দেখা দিয়েছে ভাঁটা। লিফটের সাজসরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু লিফট আমদানী এখনো বিলম্বিতই রয়ে গেছে। মোদ্দা কথায় গৃহনির্মাণ ঋণদান সংস্থার অভ্যন্তরে অমাবস্যা বেশ জমাট হয়ে উঠেছে। দুর্নীতির ডিপো এই সংস্থাটির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো গভীরভাবে অনুধাবন করে এর একটি বিহীত অবিলম্বে করা দরকার। দুর্নীতি জিনিসটা আজকাল এমন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে যে, এর মুলোৎপাটন না ঘটানো হলে দেশের সাধারণ মানুষ অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যাবে। গৃহনির্মাণ ঋণদান সংস্থার কাজ যা তা থেকে যে ঐ সংস্থার কর্মকর্তাদের বিচ্যুতি ঘটেছে, ঋণগ্রহীতাদের অভিযোগ থেকে তা আমাদের কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। এ রকম একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সম্পর্কে ঘুষ গ্রহণ এবং দুর্নীতির অভিযোগকে একেবারে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। যদি সত্যি সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যে অসাধুপনার প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই হবে শ্রেয়তর। ব্যাপারটি এতোই জরুরী যে, এ সব মারাত্মক অভিযোগ শোনার পর হাত-পা গুটিয়ে নিঃশব্দে বসে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষে হবে সম্পূর্ণ অনুচিত। দুর্নীতিবাজদের বিষ দাঁত ভেঙে না দিয়ে সমগ্র সমাজ ব্যবস্থায় এক নিদারুণ নৈরাশ্যের জমাট অন্ধকার আমাদের গ্রাস করে ফেলবে। অতএব, পরগাছাদের আর বাড়তে দেয়া যায় না।

অদূরদর্শিতার জন্যে গচ্চা

বাংলাদেশের অন্যতম ঘোড়াশাল সার কারখানাটি বেশ কিছুদিন হলো বন্ধ হয়ে গেছে। একটি বিশেষ সংবাদে জানা গেছে, গ্যাস লাইনের পাইপ ফেটে গিয়ে বয়লার বন্ধ হয়ে যায় এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়। ইলেকট্রোড নামক এক প্রকার ঝালাই পদার্থ দ্বারা ফেটে যাওয়া পাইপ ঝালাই করা যেতো এবং সেটাই এ কারখানায় এতোদিন নিয়ম ছিল। কিন্তু সার কারখানায় ঐ ঝালাই পদার্থের মওজুত হঠাৎ শেষ হয়ে যায়। অথচ মওজুত শেষ হওয়ার পূর্বাহ্নেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ছিল। ইলেকট্রোড নামক ঐ ঝালাই পদার্থটি আনিয়ে নেবার কোনো উদ্যোগই নাকি কারখানার কর্তৃপক্ষ নেননি। এদিকে কারখানা বন্ধ থাকার ফলে এ পর্যন্ত এক কোটি ষাট লক্ষ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। কেননা, প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাত কোটি টাকা। উল্লেখ করা যেতে পারে, ঘোড়াশাল সার কারখানায় প্রতিদিন এক হাজার টন সার উৎপাদিত হয়ে থাকে। কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালীর দরুণ গত ১৯৭২ সালের উৎপাদন শুরু হবার থেকে ঘোড়াশাল সার কারখানাটি সাত আটবার নাকি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সংবাদে বলা হয়েছে, সার কারখানাটি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেবার জন্য একটি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। বছরে তিন চারবার কারখানা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও কর্মচারীরা চার পাঁচবার বোনাস আদায় করে নিয়েছে। ঘোড়াশাল সার কারখানাটি দেশের একটি সম্পদ। একে সজীব করে রাখার কোনো ব্যবস্থাই কর্তৃপক্ষ পূর্বাপর গ্রহণ করেননি। ফলে মাঝে মধ্যেই মিলটি বন্ধ ছিল। অথচ দেশের অর্থকরী কারখানার মধ্যে এটি একটি অন্যতম কারখানা। বাংলাদেশের এমন অনেক সম্ভাবনাময় কারখানাই অদূরভবিষ্যতে বন্ধ হয়ে যাবে। কেননা, এর পেছনে একটি গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। দেশের আর্থিক মেরুদন্ড শক্ত হোক—এটা একশ্রেণীর আমলা কর্মকর্তারা চায়না। তাদের সকল শক্তি আজ নিয়োজিত হয়েছে উন্নয়ন বা প্রগতিকে স্যাবোটাজ করার জন্য। আমাদের কর্তৃপক্ষও এ সকল খবর রাখেন। লাল ফিতার বদৌলতে যে দেশের বহু কাজই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা কর্তৃপক্ষের জানা রয়েছে। তবু তার কোনো প্রতিকার নেই। একটি মিলের প্রয়োজনে যে সকল কাঁচামাল বা যন্ত্রপাতি দরকার তা পূর্ব থেকেই সাধারণতঃ মওজুত করে রাখা হয়। এবং তা দিয়ে জরুরী অবস্থার মোকাবেলা করা হয়। ঘোড়াশাল সার কারখানায়ও এ ব্যবস্থা পূর্ব থেকেই করে রাখা যেতো। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কেন করেননি সেটাই প্রশ্ন। অনেকদিন পূর্বে আমরা শুনেছি ‘দেশে আর তেল নেই’ এই—ফাইলটি যখন বঙ্গবন্ধুর সামনে দেয়া হয় তখনই তিনি জানতে পারেন যে দেশের তেল ফুরিয়ে গেছে। অথচ মওজুত তেল ফুরিয়ে যাবার পূর্বেই তাঁকে জানানো যেতো এবং সময় থাকতে ব্যবস্থা গ্রহণ করাও সম্ভব হতো। আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের জন্যেই সেদিন অবিনার্যভাবে তেলে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। দেশের প্রত্যেক ব্যাপারেই আজ এই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। মিল-কারখানাও বন্ধ করে দেবার পেছনে এ ধরনের ষড়যন্ত্র রয়েছে। কাঁচামালের বা খুচরা যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে সত্য কিন্তু তার জন্যে পূর্বাহ্নেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারী দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের মধ্যেই রয়েছে ঘাপলা। যার দরুণ একটা মিল বা কারখানা বন্ধ হয়ে যাবার পর কর্তৃপক্ষ চালু করার চেষ্ট করেন। অথচ পূর্ব থেকে চেষ্টা করলে মিল বা কারখানা বন্ধ হতে পারে না। কোটি কোটি টাকা লোকসানও হয় না। দেশের প্রত্যেকটি সেক্টরে আজ এই স্যাবোটাজ চলছে। এর প্রতিরোধ কবে হবে আমরা জানিনা। শুধু এটুকুই আমরা বলতে পারি, কর্তৃপক্ষ যদি পূর্ব থেকে সতর্ক না হন তাহলে দেশের সকল মিল-কারখানাই একদিন বন্ধ হয়ে যাবে। এবং সেটা জাতির হলে ভবিষ্যত সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়বে। আমরা সেই দুর্দিন কামনা করি না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!