মুজিবনগর উপজেলা : একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা
১.১ মেহেরপুর জেলার কনিষ্ঠতম এবং ঐতিহাসিক উপজেলা মুজিবনগর। এর আয়তন ১১২.৬৮ বর্গকিলােমিটার এবং জনসংখ্যা (২০০১ সালের গণনা অনুসারে) = ৯০,০২০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪৫,৬৮০ জন এবং নারী ৪৪,৩৪০ জন। সীমানা নবগঠিত মুজিবনগর উপজেলার উত্তরে মেহেরপুর সদর উপজেলা, দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গ ও চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা, পূর্বদিকে মেহেরপুর সদর, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ (ভারত)। উপজেলা সৃষ্টির তারিখ : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০০। ১.২ স্থানীয় ইতিহাস : মুজিব নেই, তবু মুজিবের নামেই মুজিবনগর। সেদিন ছিল ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল। দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ বাংলাদেশ। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে শত্রুমুক্ত করা এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে প্রবাসে বসেই বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ গঠন করেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (১০ এপ্রিল ১৯৭১)। এই সরকারের মন্ত্রিপরিষদ হানাদারকবলিত বাংলাদেশেরই কোনাে মুক্ত অঞ্চলে শপথ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। কোথায় সেই মুক্তাঞ্চল? ভারত সীমান্তের নিকটবর্তী মেহেরপুর মহকুমার বাগােয়ান ইউনিয়নের নিভৃত এক পল্লী বৈদ্যনাথতলা, সেখানে আছে বিশাল এক ছায়াঘন আমবাগান, তখন পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর ছােবল পড়ে নি সেই মুক্তাঞ্চলে, নানাদিক ভেবেচিন্তে প্রবাসী সরকারের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের এই মুক্তভূমিতেই ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মন্ত্রিপরিষদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
সরকারের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান, অথচ তিনি নেই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে। তার অবর্তমানে, কিন্তু তারই নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিপরিষদ শপথ গ্রহণর পর বৈদ্যনাথতলায় অনুষ্ঠিত এই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতি সম্মান জানাতে বৈদ্যনাথতলার নতুন নামকরণ করেন মুজিবনগর। এরপর থেকে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মুজিবনগর । গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানীর নাম মুজিবনগর, যেনবা একাত্তরে গােটা বাংলাদেশের নাম হয়ে যায় মুজিবনগর। অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের তিন দশক পর মেহেরপুরের ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে মুজিবনগর নামে একটি উপজেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। মুজিবনগরে স্মৃতিসৌধের অদূরেই গড়ে উঠেছে মুজিবনগর উপজেলা পরিষদ।
স্থানীয় সরকার ও এর কাঠামােয় বিবর্তনধারা আজকের মুজিবনগর উপজেলা পরিষদ এবং মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ যে-ভূখণ্ডে অবস্থিত তা মূলত ২০০০ সালের আগেও ছিল মেহেরপুর সদর উপজেলার বাগােয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়ন পরিচিতির পূর্বে বাগােয়ানের পরিচয় ছিল পরগনা । কথিত আছে, ভৈরববক্ষে বজরায় ভেসে আসা নবাব আলীবর্দী খাঁ এতদ্ঞ্চলে শিকারে এসেছিলেন ১৯৫০ সালে। প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে নবাব আশ্রয় নিয়েছিলেন এক দরিদ্র বিধবার পূর্ণ কুটিরে বিধবার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে তার ছেলে গােয়ালা চৌধুরীকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করে বাগােয়ান পরগনা দিয়ে যান তার হাতে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু হলে এ-এলাকা চলে যায় মেদিনীপুর কোম্পানির কাছে। সেখান থেকে জমিদারী যায় বৈদ্যনাথ বাবু এবং কেদারনাথ বাবুর হাতে। জমিদার বৈদ্যনাথবাবুর নাম অনুসারে স্থানের নাম বৈদ্যনাথতলা, যেখানে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার শপথগ্রহণ করে এবং সে-দিন থেকে নতুন নাম হয় মুজিবনগর। ২০০০ সাল থেকে সেই মুজিবনগর মেহেরপুরের নতুন উপজেলা। এ-উপজেলায় ইউনিয়ন সংখ্যা০৪টি, গ্রামের সংখ্যা-৩১টি।
১.৩ ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব : মুজিবনগর উপজেলা নবপ্রতিষ্ঠিত মুজিবনগর উপজেলা মূলত মেহেরপুর সদর উপজেলারই সীমান্ত এলাকার চারটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত উপজেলা। বিভাগ-পূর্বকালে এই উপজেলার আধিবাসীদের মেহেরপুরকেন্দ্রিক যােগাযােগের চেয়ে কৃষ্ণনগর-কলকাতাকেন্দ্রিক যােগাযােগই প্রধান ছিল। এ-অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনেকেই দেশভাগের পর দেশত্যাগ করে ভারতে চলে গেছেন। ফলে তাদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ এখন কষ্টসাধ্য ১৯৪৭-এর পর যারা এ দেশে বাস করে রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিত্ব : ১, অ্যাডভােকেট মােঃ আবুল হায়াত ১৯২২ সালে মুজিবনগর উপজেলার গৌরিনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবুল হায়াত। তার পিতা আব্দুল জলিল বিশ্বাসও অবিভক্ত নদীয়া জেলার বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আবুল হায়াত ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে জড়িত নন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাসের পর ১৯৫২ সাল থেকে আইন পেশায় এবং সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ। দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মেহেরপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সূচনা করেন। ১৯৬২ সালে অ্যাডভােকেট হায়াত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন বিরােধীদল থেকে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তিনি অনেক সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন নিষ্ঠার সঙ্গে। মেহেরপুর কলেজে সূচনালগ্নে তিনি ছিলেন পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি।
১৯৭২ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন আইনজীবী সমিতির সভাপতি। ১৯৮৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২. কিয়ামউদ্দীন খান : পাবনা জেলায় জন্ম হলেও কিয়ামউদ্দীন খান সারা জীবন কাটিয়েছেন মুজিবনগর উপজেলার খ্রিস্টান অধ্যুষিত ভবেরপাড়া গ্রামে। আজীবন তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক ও নেতা। ১৯৩৫ সালের দিকে তিনি খ্রিস্টান মিশনারিদের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তােলেন। ১৯৩৭ সালে ভবেরপাড়া গ্রামেই তিনি নদীয়া মুসলিম মিশন নামের প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলেন। নদীয়া মুসিলম মিশনের উদ্যোগে ১৯৫০ সালে ভবেরপাড়া মুসলিম লীগের বিরাট সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনের শের-এ-বাংলা ফজলুল হক এবং হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বক্তৃতা করেন বলে জানা যায়। এতদৃঞ্চলে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ নেতা কিয়ামউদ্দীন খান মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বিতর্কিত ভূমিকা পালনের কারণে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান। ৩, আবু লায়েছ মােহাম্মদ আব্দুল মতিন : ১৯৩৪ সালের ১ মে মুজিবনগর উপজেলার বাগােয়ান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবু লায়েছ মােহাম্মদ আব্দুল মতিন। সংক্ষেপে মতিন উকিল নামেই তিনি বিশেষ পরিচিতি। প্রথমে মুসিলম লীগের সমর্থক হলেও পরে তিনি জামায়াতে ইসলামের প্রার্থী হিসেবে ১৯৭১ সালে জাতীয় পরিষদ উপ-নির্বাচনে (বিতর্কিত) নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মেহেরপুর মহকুমা পিস কমিটির সভাপতি হিসেবে স্বাধীনতাবিরােধী অসংখ্য কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কুখ্যাতি অর্জন করেন। ৪, আবুল কালাম মহাম্মদ ইদ্রিস আলী : ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি মুজিবনগর উপজেলার দারিয়াপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনেই ছিলেন রাজনীতি সম্পৃক্ত। মেহেরপুর জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার অবদান অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধেও তিনি সংগঠক হিসেবে পালন করেন।
গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মীও। আজকের মুজিবনগর কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আ.কা.ম. ইদ্রিস আলী। ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তাঁর ছিল অবিচল আস্থা। ৫. মুন্সী সাখাওয়াৎ হােসেন : ১৯৩৮ সালের ১ জানুয়ারি মুন্সী সাখাওয়াত হােসেন জন্মগ্রহণ করেন মুজিবনগর উপজেলার বাগােয়ান গ্রামে। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি সম্পৃক্ত হন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৪ সালে মেহেরপুর মডেল স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৫৬-৫৭ সালে মেহেরপুরে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধেও সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। অনেক পরে ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত হন। ৬. দোয়াজউদ্দিন মাস্টার ভবেরপাড়ার দোয়াজউদ্দিন মাস্টারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে সীমান্ত সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল এই কমিটির নেতৃত্বে এবং উদ্যোগে মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মঞ্চ নির্মাণ, মাঠ প্রস্তুতি, তােরণ নির্মাণ প্রভৃতি কাজ সম্পন্ন হয়। দোয়াজউদ্দিন মাস্টার এবং তার সঙ্গীরা সে-দিন এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। সীমান্ত সংগ্রাম কমিটিই পরবর্তীতে বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটি নামে পরিচিত হয়। ১.৪ সমাজসংস্কারক, ধর্মীয় নেতা : মুজিবনগর ১. শেখ ফরিদ : বাংলাদেশে ইসলামের শান্তির বাণী প্রচারের মহান উদ্দেশ্যে ইরাক, ইরান, আরব থেকে যে-সব পীর আউলিয়ার আগমন ঘটে, মুজিবনগর উপজেলার বাগােয়ান গ্রামে আগত দরবেশ শেখ ফরিদকে তাদেরই একজন বলে মনে করা হয়। যােড়শ শতকের দিকে তার আগমন বলে অনুমান করা হয়।
তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এতদঞ্চলে ইসলামের প্রসার ঘটে। ২. আব্দুল জলিল বিশ্বাস মুজিবনগর উপজেলার গৌরিনগর গ্রামে আব্দুল জলিল বিশ্বাস শুধু একজন সমাজপতি ছিলেন তাই নয়, ছিলেন। সমাজসংস্কারকও। তঙ্কালীন সময়ে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানদের সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন। ১.৫ লেখক, কবি, সাহিত্যিক : মুজিবনগর ১. হীরালাল বিশ্বাস মুজিবনগর উপজেলার দারিয়াপুর গ্রামে উনবিংশ শতকের শেষার্ধে জন্মগ্রহণ করেন হীরালাল বিশ্বাস। তিনি নিজে কী কী সাহিত্যকীর্তি রচনা করেছেন, আজ আর তা বিশেষভাবে জানা যায় না। তবে তিনি ছিলেন সাহিত্য-সংস্কৃতির একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপােষক। তারই উদ্যোগে এবং সভাপতিত্বে ১৩১৯ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ (১৯১২ ইং) এই দারিয়াপুরেই প্রতিষ্ঠিত হয় নদীয়া সাহিত্য সম্মিলনী নামের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। নদীয়া সাহিত্য সম্মিলনীর প্রতিমাসের সভার অবিভক্ত নদীয়া জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কবি সাহিত্যিকের আগমন ঘটে। এ-সব কবি-সাহিত্যিকের ঐকান্তিক আগ্রহের প্রতি লক্ষ রেখে ১৯১৩ আলে নদীয়া সাহিত্য সম্মিলনীর পক্ষ থেকে শিল্প সাহিত্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রকাশনা অব্যাহত থাকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত। ২. সতীশ চন্দ্র বিশ্বাস মুজিবনগর উপজেলার দারিয়াপুরে জন্মগ্রহণ করেন আরেক সাহিত্যসাধক সতীশচন্দ্র বিশ্বাস। নদীয়া সাহিত্য সম্মিলনীর উদ্যোগে শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা মাসিক সাধক-এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন সতীশচন্দ্র বিশ্বাস। সম্পাদক সতীশচন্দ্র বিশ্বাসের সাহিত্যসৃষ্টি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।
৩. অবিনাশচন্দ্র বিশ্বাস মুজিবনগর উপজেলার দারিয়াপুর থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা সাধক-এর প্রকাশক ছিলেন অবিনাশচন্দ্র বিশ্বাস। প্রতিমাসে কৃষ্ণনগর থেকে ছেপে পত্রিকাটির নিয়মিত প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছিলেন দুই বছর। ব্যক্তিগত জীবনে অবিনাশবাবু ছিলেন নাট্যামােদি মানুষ। নিজেই নাটক লিখতেন, আবার গ্রামের নাট্যমঞ্চে সে নাটকে অভিনয়ও করতেন। ৪. ফজলুল হক সিদ্দিকী : মুজিবনগর উপজেলায় দীর্ঘদিনের মধ্যে আর কোনাে কবি-সাহিত্যিকের জন্মের খবর জানা যায় না। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল এ-উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন কবি ফজলুল হক সিদ্দিকী। পেশায় প্রকৌশলী হলেও নেশায় তিনি কবি। ছাত্রজীবন থেকেই লিখে চলেছেন কবিতা ও গান। ইতােমধ্যে তার ৫টি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে এবং তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন।
১.৪ মুজিবনগর উপজেলার ইউনিয়ন : ০৪টি, গ্রাম : ৩১টি ১. দারিয়াপুর ইউনিয়নের গ্রাম : বিদ্যাধরপর, দারিয়াপুর, খাপুর, পুরনদরপুর, গৌরীপুর ও গােপিনাথপুর। ০৬টি। ২. মােনাখালী ইউনিয়নের গ্রাম : মােনাখালী, বিশ্বনাথপুর, শিবপুর, গােপালপুর, রামনগর, ভবানীপুর ও রশিকপুর। ০৭টি। ৩. বাগােয়ান ইউনিয়নের গ্রাম : মানিকনগর, নাজিরাকোলা, ভবেরপাড়া, | সােনাপুর, মাঝপাড়া, আনন্দবাস, জয়পুর, তারানগর, বাগােয়ান, যােলমারী, বল্লভপুর ও রতনপুর। ১২টি। ৪. মহাজনপুর ইউনিয়নের গ্রাম : যতারপুর, গােপালপুর, মহাজনপুর, কোমরপুর, পরানপুর ও বাবুপুর। ০৬টি। ১.৬ ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও প্রত্ন নিদর্শন, মসজিদ, মন্দির, মঠ, তীর্থস্থান, চারুকারু কীর্তি : ১. শেখ ফরিদের দরগা : মুজিবনগর উপজেলার বাগােয়ান অত্যন্ত প্রাচীন জনপদের নাম। বাগেরহাটের খান জাহান আলীর সমসাময়িক কালের অন্যতম ইসলাম প্রচারক আউয়ালিয়া শেখ ফরিদ আসেন বাগােয়ানে। এখানে এখনাে শেখ ফরিদের দরগা বলে পরিচিত একটি প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে। দরগাটির পাদদেশে রক্ষিত সাতটি কালাে পাথর এবং বেশ কিছু টেরাকোটা ছােট মাপের ইট এখনাে এর প্রাচীনত্ব ঘােষণা করছে। দরগার পূর্বে প্রায় ২০০ গজ দূরে মাটির নিচে প্রােথিত একটি বিরাট আকারে লৌহপাতের রহস্য আজো উদ্ঘাটিত হয় নি। ২. আমদহ গ্রামের স্থাপত্য নিদর্শন : কথিত আছে, নবাব আলীবর্দী খান ও তার সঙ্গীগণ একদা (১৭৫০) ভৈরব নদীপথে শিকারে বেরিয়ে বর্তমান মুজিবনগর উপজেলায় বাগােয়ানে এসে হঠাৎ ভীষণ ঝড়ের কবলে পড়ে এক বিধবা গােয়ালিনীর কুটিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ঐ বিধবার আতিথেয়তায় মুগ্ধ নবাব তার পুত্র রাজু গােসাইকে রাজা গােয়ালা চৌধুরী উপাধিতে ভূষিত করে বাগােয়ান পরগনা দান করেন।
রাজা গােয়ালা চৌধুরী বাগােয়ানের অদূরে আমদহে বিশাল রাজপ্রসাদ নির্মাণ করেন, মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু অচিরেই বর্গীদের আক্রমণে সেই রাজপ্রসাদ-মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে সেই প্রত্নস্থল আবাদী জমিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু প্রাচীন আমলের পােড়ামাটির টালি ইট এবং ইটের ভগ্নাংশ সারা এলাকাতেই ছড়িয়ে আছে। ১৯৭৪ সালে এ অঞ্চলে পুকুর খননের সময় ৬ ফুট দীর্ঘ এবং ১৮ ইঞ্চি প্রস্থের কারুকার্যখচিত একটি চৌকোণা প্রস্থরখণ্ড আবিষ্কৃত হয়। এই প্রস্তরখণ্ডটি এখনাে মেহেরপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ফুলবাগানের মাঝে স্থাপিত আছে। ৩, বল্লভপুরের প্রাচীন মন্দির : নদীয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার বর্তমানে মুজিবনগরের অদূরে বল্লভপুরে রাজপ্রাসাদ ও শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ১৬০৬/০৭ সালে। বর্তমানে তার কোনাে অস্তিত্ব নেই। তবে শিব মন্দিরের গায়ের টেরাকোটা ইট (জীবজন্তু ও নৃত্যরতা যুবতীর চিত্র। সম্বলিত) এখনাে এলাকাবাসীর ঘরে-ঘরে সংরক্ষিত আছে। ৪. বল্লভপুর মিশন ও গির্জা : খ্রিস্টান অধ্যুষিত বল্লভপুরে রয়েছে ১৮৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত খ্রিস্টান মিশন গির্জা। প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের এই মিশন ও গির্জা মুজিবনগর উপজেলায় ইউরােপীয় স্থাপত্যরীতির প্রাচীন নিদর্শন।
৫. মুজিবনগরের ভবেরপাড়ায় রয়েছে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের একটি প্রাচীন গির্জা। এই গির্জাটিতেও প্রাচীন ইউরােপীয় স্থাপত্যরীতির প্রতিফলন ঘটেছে। ৬. মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ : স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারি উদ্যোগে যে-সব স্থাপত্যকীর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ তার মধ্যে অন্যতম প্রধান। বাংলাদেশের জন্ম, জাতীয় ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব রক্ষায় ২৩ বছরের সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ-স্মৃতিসৌধের স্থাপত্যনকশা প্রণয়ন করেন। স্থপতি তানভির কবীর। আধুনিককালের স্থাপত্যরীতির নিদর্শন এই মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ দেখতে আসছে প্রতিদিনই, শত-শত দর্শনার্থী। ১.৭ রাজনৈতিক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা : ১. মুজিবনগর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম খ্রিস্টান অধ্যুষিত। বিশেষত ভবেরপাড়া বল্লবপুর রতনপুর। এতদঞ্চলের দারিদ্রপীড়িত মুসলমানদের অশিক্ষা কুশিক্ষা-কুসংস্কার, অভাব-অসহায়ত্বের সুযােগ নিয়ে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকেরা অসংখ্য সাধারণ মানুষকে ধর্মান্তরিত করে চলেছিল। তারা সত্য ধর্মনিরূপণ নামে একটি পুস্তক প্রকাশ ও বিতরণ করে, যেখানে হযরত মুহাম্মদ (স) সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছে। এই পুস্তক এলাকায় উত্তেজনার সৃষ্টি করে।
এমনই একদিনে, ১৯৪২ সালের ৭ আগস্ট ভবেরপাড়ায় একটি ইসলামী ধর্মসভার আয়ােজন করা হয়। সেখানে বক্তৃতা করেন অ্যাডভােকেট মােহাম্মদ মহসিন এবং খ্রিস্টধর্মত্যাগী ইসলামপ্রচারক মুন্সী জমিরুদ্দীন। সে-দিনের ধর্মসভা থেকে সত্যধর্ম নিরূপণ পুস্তকের সত্যতা ও কুরুচিপূর্ণ তথ্যের আপত্তি জানিয়ে প্রবল ভাষায় জবাব দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, এ-বিষয়ে পনের হাজার কপি প্রতিবাদপত্র ছেপে প্রচার করা হয়। অ্যাডভােকেট মােহাম্মদ মহসিন এবং মুন্সী জমিরুদ্দীনের যৌথ স্বাক্ষরে প্রচারিত বিবৃতি সে-সময়ের বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়। ফলে টনক নড়ে সরকারের। এক সরকারি ইশতেহারে স্বীকার করা হয় যে, সত্যধর্ম নিরূপণ নামক পুস্তকে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি আহত হওয়ার। যুক্তি এবং উপাদান আছে। | ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ এই ঘটনা এলাকার অনেক প্রাচীন মানুষ এখনাে স্মরণ করেন। ২. মুজিবনগরবাসীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাই হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং একাত্তরের ১৭ এপ্রিল এই মুজিবনগরের পুণ্যভূমিতে বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদের শপথগ্রহণ। দেশী-বিদেশী শত-শত সাংবাদিকের মাধ্যমে বৈদ্যনাথতলা নামের এই সাদামাটা গ্রামের নতুন নাম মুজিবনগর প্রচার হয়ে যাওয়ার ঘটনা এই এলাকাবাসীর কাছে সবচেয়ে বড়, রাজনৈতিক ঘটনা।
৩. একেবারে সীমান্তবর্তী উপজেলা বলেই একাত্তরে এ-এলাকার ওপর দিয়ে বহু দূর-দূরান্তরের দেশত্যাগী শরণার্থী ভারতে গমন করে। তাদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা এখনাে এই এলাকাবাসী বেদনার সঙ্গে স্মরণ করে। ৪. সীমান্তবর্তী উপজেলা বলেই এই উপজেলাবাসীর স্মৃতিতে রয়েছে একাত্তরের যুদ্ধস্মৃতি। মুজিবনগর নামে একটি উপজেলা প্রতিষ্ঠাই রীতিমতাে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১.৭ মুজিবনগরের নদনদী, জলমহল : ভৈরব নদীর দু’পাশে গ্রাম নিয়েই মুজিবনগর উপজেলা। সেই অর্থে এউপজেলার একটি মাত্র নদী-ভৈরব। সরস্বতী খালকে অনেকে নদী বলতে চান। একদা নাব্যতা থাকলেও এখন শুকনাে খাল বিশেষ মাত্র। মুজিবনগরের জলমহল : ১. দাদপুর বিল ২. সরস্বতী খাল ৩. পদ্মবিল ২. ভৌগােলিক-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য : ভূমির বৈশিষ্ট্য : গাঙ্গেয় অববাহিকার সামান্য অসমতল এবং সমতল পলল ভূমিই মুজিবনগর উপজেলার ভূমির বৈশিষ্ট্য। সমুদ্রগর্ভ থেকে কত বছর পূর্বে জেগে উঠেছে এই ভূভাগ তা অনুমান করা বেশ কঠিন। এখানকার উঁচু ভূমির প্রকৃতি হচ্ছে বেলে দোআঁশ এবং নিচু অঞ্চলের মাটি মেটেল তবে উঁচুনিচু সর্বত্রই চুনযুক্ত গাঢ় ধূসর বর্ণের মাটি। এই মাটি যথেষ্ট উর্বরাশক্তি যুক্ত ভৈরব নদীখাতের দিকে কিঞ্চিত ঢালু বলে বর্ষাকালেও এখানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় না। এই এলাকা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অপেক্ষাকৃত বেশি গভীরে অবস্থিত ভূমির ব্যবহার : মুজিবনগর উপজেলায় আবাদী জমির মােট পরিমাণ ২১.৮৮৭ একর। কৃষিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগার কারণে ভূমির ব্যবহারও বেড়ে গেছে। পূর্বের এক ফসলি জমিতেও এখন তিনবার ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। মুজিবনগর উপজেলার অধিকাংশ আবাদী জমিতেই ধানপাটের আবাদ হয়। রবিশস্য বলতে গম, সরিষা, ডাল, আলু, তামাক উৎপাদিত হয়। শীতকালীন শাকসবজিও এখানে ভালাে হয়। এছাড়া আঁখ, কলার চাষ সারা বছর জুড়েই হয়ে থাকে। মুজিবনগর উপজেলায় আম-লিচুও বেশ ভালাে অর্থকরী ফসল হয়ে উঠেছে। জলবায়ু : মুজিবনগর উপজেলার সমভাবাপন্ন আবহাওয়া বিরাজ করে। গ্রীষ্মকালে জলবায়ু বেশ উষ্ণ ও সিক্ত। আর শীতকালে জলবায়ু থাকে ঠাণ্ডা ও শুষ্ক। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০,১১৪ মিলিমিটার। মুজিবনগরে গড়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্র ৩৬.৫০ ডিগ্রি সেলিসিয়াস। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
৩. সমাজ-সংস্কৃতি ৩.১ সমাজকাঠামাে, সমাজবিন্যাস, সামাজিক শ্রেণী ও বৈশিষ্ট্য : মুজিবনগর উপজেলা মেহেরপুর জেলার একটি নতুন উপজেলা। এই উপজেলার অধিকাংশ মানুষই ধৰ্মপরিচয়ে মুসলমান, তবে এখানে ভবেরপাড়া, বল্লভপুর, রতনপুর প্রভৃতি গ্রামজুড়ে খ্রিস্টান পল্লীও রয়েছে। এতদ্ঞ্চলের মানুষের দারিদ্র ও অশিক্ষার সুযােগে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে খ্রিস্টান মিশনারিরা এসে সেবামূলক কার্যক্রম ও অন্যান্য প্রলােভন দেখিয়ে ধর্মান্তর প্রক্রিয়া শুরু করে। এর ফলে এ-অঞ্চলে খ্রিস্টধর্মের অনুসারীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক সম্পর্কের ভারসাম্য বিপন্ন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় দরিদ্র, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তােলার জন্য ব্যাপক তৎপরতা শুরু হয়। ভবেরপাড়ায় গড়ে ওঠে নদীয়া মুসলিম মিশন-এর মতাে প্রতিষ্ঠান। এ-ধরনের তৎপরতার কারণে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তর প্রক্রিয়া অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে বটে, মুসলিম-খ্রিস্টান-হিন্দু নির্বিশেষে সাধারণ জনগণের ভাগ্যের বিশেষ উন্নতি হয় না। এদিকে ১৯৪৭-এর দেশভাগের ফলে এতঞ্চলের হিন্দু জমিদার এবং ধনীরা দেশত্যাগ করলে স্থানীয় মুসলমানদের একটি অংশ এ-সব পরিত্যক্ত সহায়-সম্পত্তির মালিক হয়ে বসে। রাতারাতি বদলে যায় তাদের ভাগ্য। কিন্তু সমাজের নিচুতলার মানুষের বিশেষ পরিবর্তন হয় না। ধনী-দরিদ্রের শ্ৰেণীবৈষম্য প্রকটভাবেই থেকে যায়।
মুজিবনগর উপজেলায় এখনাে সম্পূর্ণরূপেই কৃষিনির্ভর সমাজকাঠামাে বিদ্যমান। কৃষিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগার ফলে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে, তবে তার সুফলও ভােগ করছে মুষ্টিমেয় ভূমি মালিকরাই, কৃষি শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান বাড়ে নি, অশিক্ষা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার থেকে মুক্তি ঘটে নি। ৩.২ ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক শ্রেণী : মুজিবনগর উপজেলার অধিবাসীদের মধ্যে ‘৪৭-পূর্ব সময়েও সংখ্যায় মুসলমানেরাই বেশি ছিল, কিন্তু শিক্ষা, অর্থ, বিত্ত, সামাজিক প্রতিপত্তি-এ সবক্ষেত্রে হিন্দুদেরই ছিল একচেটিয়া প্রতিপত্তি। এ-উপজেলায় খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীর সংখ্যাও কম নয়। তবে তাদের জীবনযাপন, সামাজিক সম্পর্ক ও রীতিনীতি একেবারেই ভিন্ন এবং তারা কয়েকটি গ্রামের খ্রিস্টান পল্লীর মধ্যেই নিজেদের গতিবিধি সীমিত রাখে। অবশ্য ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের অধিকাংশ অন্ত্যজশ্রেণীর হিন্দুসমাজ থেকে এসেছে এবং দারিদ্র্যপীড়িত অশিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে থেকেও অনেকে এসেছে। নব্যধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পরও পূর্বধর্মের অহমিকাবােধ ভুলতে তাদের সময় লাগে।
যাই হােক, ‘৪৭-এর দেশভাগের পর এ-উপজেলার উচ্চবিত্তের হিন্দু ভূস্বামী ও জমিদারেরা দেশত্যাগ করে চলে যায় ভারতে। তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি ভােগদখলে উন্মত হয়ে ওঠে একশ্রেণীর মুসলিম, তারাই এখন সমানে নেতৃত্ব দিচ্ছে। উপজেলায় মুসলমান খ্রিস্টান হিন্দুর যৌথ বসবাস, তবু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য কখনাে ভেঙে পড়ে নি। দূর অতীতে কখনাে সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে সবাই সৌহার্দ্যপূর্ণ। পরিবেশেই বসবাস করছে। ৩.৩ আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতি : এ-উপজেলায় দূর অতীতেও কখনাে আদিবাসীদের বসবাস ছিল বলে জানা যায় না। তবে শােনা যায়, অনেক আগে সীমান্ত অঞ্চলে কিছু আদিবাসী ছিল, তারা অনেকেই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। এখন আর আদিবাসী নেই বললেই চলে। ৩.৪ লােকসংস্কৃতি : | লােকসংস্কৃতি : একদিকে নবদ্বীপের শ্রী চৈতন্যদের, অন্যদিকে হেঁউড়িয়ার মরমী লালন মুজিবনগর উপজেলা থেকে দুইই সমান দূরে, দুইই সমান কাছের। এই দুই মানবতাবাদী মহান দার্শনিকেরই প্রভাব পড়েছে এ-অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন, লােকাচার ও লােকসংস্কৃতির ওপরে। সে-কারণেই এখানকার মানুষ অধিক পরমতসহিষ্ণু, উদার, অতিথিপরায়ণ। দীর্ঘদিন থেকে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা একত্রে বসবাস করার মধ্য দিয়ে এখানে গড়ে উঠেছে মিলিত সংস্কৃতি। জাতপাত বর্ণভেদ শ্রেণী ভেদের উর্ধ্বে ওঠার আহ্বান সম্বলিত লােক সংস্কৃতির ধারা এ-উপজেলায় এখনাে নীরবেই প্রবহমান।
লােকউৎসব : লােকউৎসব ছিল সকলের অংশগ্রহণে আনন্দমুখর উৎসব। এই উদার ক্ষেত্রটিও দিনে-দিনে সংকুচিত হয়ে এসেছে। মুজিবনগর উপজেলায় একদা দুর্গাপূজা হয়েছে, সর্বজনীন অংশগ্রহণ এবং আনন্দ উপভােগের মধ্য দিয়েই। খ্রিস্টানদের বড়দিন কিংবা মুসলমানদের মহররম বা ঈদ উৎসবও অনেকটাই সর্বজনীন হয়ে উঠেছে, ধর্মীয় নিয়মকানুনের দিকটিরও উর্ধ্বে যে আনন্দময় অংশ রয়েছে, সে-টুকু তাে সবারই। হালখাতা, নবান্ন উৎসব— এখনাে এসব লােক উৎসবগুলাে এ-সমাজে চালু আছে। ভৈরবে নৌকাবাইচ ছিল সবার প্রিয় একটি উৎসব, বছর দশেক থেকে সে। বাইচ বন্ধ হয়ে গেছে। লােকসাহিত্য মুজিবনগর উপজেলার আয়তনে ছােট হলেও লােকসাহিত্য সম্পদে অনেক বড়। এ-উপজেলা শুধু নয় এই জেলারই প্রাচীন জনপদ হচ্ছে বাগােয়ান। এই বাগােয়ানে পাঁচ শ’ বছর আগে ইসলাম প্রচারের জন্য এসেছেন দরবেশ শেখ ফরিদ। সে-কাল থেকেই এ-অঞ্চলে চালু আছে। ফার্সি ভাষায় রচিত মর্সিয়া। এ-পর্যন্ত বংশপরম্পরায় বাগােয়ানের মর্সিয়া শিল্পীরা তাদের কণ্ঠে ধরে রেখেছেন। এ-অঞ্চলের প্রায় সব গ্রামেই বিয়ের গান, গায়ে হলুদের গান, কন্যা সম্প্রদায়ের গান এখনাে চালু আছে। মুখেমুখে ছড়া কাটা কিংবা ধাঁধা (স্থানীয় নাম ফটকি), কৌতুক ও প্রতিনিয়ত বলা হয়। এছাড়াও লােকসাহিত্যের প্রচুর উপাদান এ-উপজেলার প্রতিটি গ্রামে পথেপ্রান্তরে ছড়িয়ে আছে। লােকসংগীত ছােট্ট এ-উপজেলায় লােকসংগীতের ভাণ্ডারও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। বিশেষ করে বাউল ধারার গান খুবই প্রচলিত। এছাড়া এখানে অনেক গ্রাম্যশিল্পী ভাবগান, দেহতত্তের গান, শাস্ত্রগান গেয়ে থাকেন। নিজে ভাবগান লিখে নিজেই গেয়ে পরিবেশন করেন এমন গায়কও বেশ কয়েকজন আছেন।
লােককবি : মুজিবনগরের লোেককবিদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে বাগােয়ান গ্রামের গফুর মুন্সীর (১৮৮১-১৯৪০) কথা। তিনি অসংখ্য ধুয়াজারি, মারফতি, পালাগান ও কবিগান রচনা করেন। তার সুযােগ্য পুত্র ওলিদাদ মুন্সী ও একই ধারায় মারফতি পালাগান, শব্দগান, কৃষ্ণলীলা প্রভৃতি রচনা করেছেন এবং শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে গেয়ে বেড়িয়েছেন। পিতা-পুত্রের কেউই আজ বেঁচে নেই, কিন্তু তাদের অসংখ্য গান এতঞ্চলের মানুষের মুখেমুখে আজো বেঁচে আছে। বিদ্যাধরপুরের ইয়াছিন ঘরামি (১৮৭৫-১৯৪৫) আরেকজন বিশিষ্ট লােক কবি। সমসমায়িক প্রসঙ্গ নিয়ে মুখে-মুখে কবিতা রচনা করে কাজের ফাকে-ফাকে শােনাতেন। বাগােয়ানের মসলেম মীর, হিরাজতুল্লাহ শেখ, দারিয়াপুরের কবিয়াল দয়াল শেখ, মেহের গাইন এঅঞ্চলের উল্লেখযােগ্য লােককবি। ৩.৫ সঙ্গীত, নৃত্য, নাট্যকলা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য : মুজিবনগর উপজেলার সঙ্গীত, নৃত্য কিংবা নাট্যকলার প্রাতিষ্ঠানিক কোনাে সুযােগ নেই। ফলে এ-সব অঙ্গনের মানসম্মত শিল্পীও গড়ে ওঠে নি। খ্রিস্টান পল্লীতে নিজেদের উদ্যোগে সামান্য কিছু সঙ্গীতচর্চা হয় মাত্র। অথচ এতদঞ্চলে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় লােকসঙ্গীতের ধারাটি এখনাে বেশ বেগবান আছে। অতীতে এ-উপজেলার বাগােয়ান যেমন লােকসঙ্গীতের পীঠস্থান ছিল তেমনি দারিয়াপুর ছিল নাট্যচর্চার কেন্দ্রভূমি।
১৮৯০ সালে দারিয়াপুরে যােগাদতা রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুরু হয়। নাট্যচর্চা। ‘৪৭-পূর্ব সময়ে হিন্দু জমিদারদের পৃষ্ঠপােষকতায় পরিচালিত এ রঙ্গালয়ে নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ডা. এন. এন. বিশ্বাস, গগনচন্দ্র বিশ্বাস, সুনীল কুমার বিশ্বাস, পাঁচু গােপাল, ডা. সদরউদ্দীন, জবেদ আলী মােল্লা প্রমুখ। ‘৪৭-এর পর প্রতিষ্ঠানটির পরিবর্তিত নাম হয় প্রগতি রঙ্গালয়, ১৯৭১-এর পর হয় দারিয়াপুর ক্লাব ও লাইব্রেরি। পাশাপাশি গড়ে ওঠে পল্লীশ্রী অপেরা। এদিকে ভৈরবের পূর্বপাড়ে রামনগরে প্রতিষ্ঠিত জনকল্যাণ ক্লাবেও সমসাময়িক সময়েই শুরু হয় যাত্রা ও নাটকের চর্চা। এখানে নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জমিদার শিববাবু, মটুবাবু, নূরু মােল্লা, শামসুদ্দিন, জলিল গাজী প্রমুখ ব্যক্তি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, নাট্যচর্চার এ-ধারা বর্তমানে স্তিমিত প্রায়।
৩.৭ চারু ও কারু শিল্প, বুনন শিল্প, মৃৎশিল্প : মুজিবনগর এলাকার প্রতি ঘরে ঘরে নকশিকাঁথার প্রচলন আছে এর কোনাে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নেই, তবে প্রায় সব পরিবারেই নারীরা নিজে হাতে এই কাঁথা তৈরি করে। খেজুরপাতার পাটিও এ-এলাকার একটি কারুশিল্প; পাটের তৈরি কার্পেট বল্লভপুর এবং ভবেরপাড়ার খ্রিস্টান পল্লীতে পাওয়া যায়। চার্চ অব বাংলাদেশ-এর সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ সহায়তায় মেয়েদের পাটের কার্পেট তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং উৎপন্ন দ্রব্যাদি নির্দিষ্ট মূল্যে বিক্রির সুযােগ করে দেওয়া হয়। একদা রতনপুরে তাঁতশিল্প ছিল, স্থানীয় তাঁতীরা গামছা, লুঙ্গি তৈরি করত। এখন সে তাঁতশিল্প উঠে গেছে। মুজিবনগর উপজেলায় মৃৎশিল্প উৎপাদিত হয় না বললেই চলে। ৩.৮ হাটবাজার : হৃদয়পুরের জমিদার বৈদ্যনাথবাবুর পৃষ্ঠপােষকতায় গড়ে ওঠা বৈদ্যনাথতলার হাট। একদা ছিল অবিভক্ত নদীয়া জেলার বাণিজ্যকেন্দ্র। দেশভাগের পর সেই বিখ্যাত হাট উঠে গেছে। বর্তমানে মুজিবনগর উপজেলার হাটবাজারগুলাে হচ্ছে ১. দারিয়াপুর হাট ২. আনন্দবাস হাট, ৩, কেদারগঞ্জ হাট, ৪ বিশ্বনাথপুর হাট ৫. মােনাখালী হাট ৬. পুরন্দরপুর হাট ৭. গৌরীনগর হাট ৮, বাগােয়ান হাট ৯. কোমরপুর হাট ১০. মহাজনপুর হাট ১১. রতনপুর হাট। ৩.৯ যােগাযােগ ব্যবস্থা : মুজিবনগর উপজেলার সঙ্গে জেলা শহরের এবং রাজধানী শহরের যােগাযােগ প্রধানত সড়কপথেই; এ-উপজেলায় পাকারাস্তার দৈর্ঘ্য ৪৪.৭২ কিলােমিটার এবং কাঁচারাস্তার দৈর্ঘ্য ৯৩ কিলােমিটার। পাকারাস্তায় সব রকমের মােটরযান এবং যন্ত্রবিহীন যানবাহন চলাচল করে। কাঁচারাস্তায় যন্ত্রবিহীন যানবাহন যথা-গরুগাড়ি, ঘােড়াগাড়ি, মহিষের গাড়ি, সাইকেল, ভ্যান ইত্যাদি চলে। ৩.১০ খাদ্যাভাস, মিষ্টি মিঠাই পিঠা-সংস্কৃতি, স্থানীয় বিশেষ খাবার, বিবাহ উৎসব এ-অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত-তরকারি। মাছমাংসের দুমূল্য হবার কারণে তরকারি হিসেবে সাধারণত শাকসবজি খায়। খাদ্যের তালিকায় ডালও থাকে, তবে তার পরিমাণ খুবই কম। কোনােকোনাে পরিবারে একবেলা গমের রুটি খাওয়া হয়।
নানারকম পিঠাপুলি নিয়ে এখানকার মানুষ উৎসবে মেতে ওঠে। শীতকালের পিঠে খাওয়ার জন্য বাড়িতে ঝি-জামাই দাওয়াত দেওয়া হয়। পাকান, পাটিসাপটা, পুলি পিঠা, ভাপাপিঠা—খুবই জনপ্রিয়। দুধের ক্ষীর ও পায়েস এখানে প্রিয় মিষ্টান্ন।। পাত্র এবং পাত্রীপক্ষের মধ্যে দেখাশােনা, কথাবার্তা পাকা করার মাধ্যমে উৎসবমুখর পরিবেশে হয় এ-অঞ্চলের বিয়ের অনুষ্ঠান। বাল্যবিবাহ এখনাে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ হয় নি। যৌতুকের প্রচলন প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে দু’ভাবেই আছে। ৩.১১ স্থানীয় পত্রপত্রিকা : দেশবিভাগের পূর্বে মুজিবনগর উপজেলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম দারিয়াপুর হীরালাল বিশ্বাসের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে নদীয়া সাহিত্য সম্মিলনী। সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক এই প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র হিসেবে ১৯১২ সালে (১ বৈশাখ ১৩২০) সতীশচন্দ্র বিশ্বাসের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মাসিক পত্রিকা সাধক। এ-প্রকাশনা রীতিমতাে অব্যাহত থেকে দুই বছর। মাসিক সাধকের প্রকাশক ছিলেন অবিনাশচন্দ্র বিশ্বাস। | তারপর এই দীর্ঘ সময়ে এতদৃঞ্চল থেকে প্রকাশিত আর কোনাে পত্রপত্রিকার খবর জানা যায় না। তবে দারিয়াপুর ক্লাব ও রামনগর ক্লাবের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস কিংবা একুশের সংকলন দু’একবার করে থাকলেও তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।
৩.১২ ব্যক্তিগত ও সরকারি গ্রন্থাগার : মুজিবনগর উপজেলার সরকারি উদ্যোগে এখনাে কোনাে গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে নি। তবে মুজিবনগর কমপ্লেক্সএর ভিতরে বাংলা একাডেমীর একটি নিজস্ব পাঠাগার প্রতিষ্ঠার কথা আছে। দেশভাগের পূর্বে কারাে-কারাে ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল বলে জানা যায়। বর্তমানে দারিয়াপুর, গৌরীনগর, রামনগরে ক্লাবের সঙ্গে পাবলিক লাইব্রেরিও আছে। ৩.১৫ পর্যটন স্থান : ১. মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ ও কমপ্লেক্স, ২. বল্লভপুর মিশন। ৪. অর্থনীতি ৪.১ প্রধান প্রধান কৃষিপণ্য, শিল্পপণ্য, (কুটির ও মাঝারি), মৎস্য চাষ, গবাদিপশু ও হাঁসমুরগী পালন প্রধান কৃষিপণ্য : ধান, পাট, গম, ভুট্টা, কলা, সবজি, তামাক, ইক্ষু, আম।
কুটির শিল্পজাত পণ্য : গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত বাঁশ ও বেতের ঝুড়ি, ধামা, কুলা, খেজুর পাতার পাটি, নকশিকাঁথা, পাটের তৈরি কার্পেট, কাঠের লাঙল, গরু গাড়ি ইত্যাদি। মৎস্য চাষ : দাদপুর, পদ্মবিল এবং স্বরসতী খালের জলমহলে পরিকল্পিত মৎস্য চাষ হয়। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন : গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনের মাধ্যমে এ-উপজেলার অনেকেই পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে।
৪.২ বেকারত্ব : জেলার অন্যান্য উপজেলার তুলনায় বেকারত্ব কম। চার্চ অব বাংলাদেশ খ্রিস্টান যুবক-যুবতীর আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে। কৃষিশ্রমিকদের মধ্যেই কোনাে-কোনাে মৌসুমে বেকারত্ব দেখা যায়।
শ্রমের মজুরি : জনপ্রতি ৫০-১০০/- টাকা প্রতিদিন।
ভিক্ষাবৃত্তি : ভিক্ষুকের সংখ্যা খুব কম। গড়ে প্রতি গ্রামে ২/১ জন হতে পারে।
জমির মূল্য : ফসলি ভূমি বিঘাপ্রতি পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা। বসতভূমি বিঘাপ্রতি এক লক্ষ থেকে দশ লক্ষ পর্যন্ত।
বাড়িঘর : কাঁচা ৬৫%, আধা-পাকা ৩০%, পাকা ০৫%,
৫. স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ৫.১ সাধারণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা : এ-উপজেলায় সাধারণ স্বাস্থ্যব্যবস্থার চিত্র অত্যন্ত করুণ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণাধীন রয়েছে। ০৪টি ইউনিয়নের মধ্যে তিনটিতে উপ-স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র আছে। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বল্লভপুর মিশন হাসপাতাল খ্রিস্টান-মুসলিম নির্বিশেষে সবারই ভরসার স্থল হয়ে আছে।
৫.২ লােকায়ত চিকিৎসা এ-উপজেলায় অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের কাছে এখনাে তন্ত্রমন্ত্র, ঝাড়ফুক, দোয়াতাবিজের গুরুত্ব কম নয়। সাপ ধরা, বিষঝাড়া, ভূত ছাড়ানাে, বাণ মারা, বশ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে এ-অঞ্চলের মানুষ মন্ত্রতন্ত্র, ঝাড়ফুকের মতাে লােকায়ত চিকিৎসার উপরেই ভরসা করে। ৫.৩ পানীয় জল : উপজেলার সব গ্রামেই টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করা হয়। | ৫.৪ আর্সেনিক সমস্যা : মুজিবনগর উপজেলার কোনাে-কোনাে গ্রামে পানিতে আর্সেনিকের প্রবণতা বেশি। যেমন—তারানগর। মােট টিউবওয়েলের মধ্যেও ১১.৬৮% টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিক পাওয়া গেছে।
৬. সমসাময়িক ব্যক্তত্ব : ১. আ.কা.ম. ইদ্রিস আলী ১৯৩৬ সালে ১ জুলাই দারিয়াপুরে জন্মগ্রহণ করেন। এলাকার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক হিসেবে সারা জেলাজুড়ে রয়েছে তার সুনাম। জেলার মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করে তােলার ক্ষেত্রে তার অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের তিনি।
বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তারই সুযােগ্য নেতৃত্বে ও উদ্যোগে ১৯৮৩ সালে দারিয়াপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুজিবনগর কলেজ। | ২. মুন্সী সাখাওয়াত হােসেন : মুজিবনগর উপজেলার অন্যতম কৃতি সন্তান মুন্সী সাখাওয়াত হােসেন ১৯৩৮ সালে বাগােয়ান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি সম্পৃক্ত হন। মহান একুশে উদযাপনকে কেন্দ্র করে ১৯৫৪ সালে মেহেরপুর মডেল স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। মেহেরপুরে কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন আজীবন। মেহেরপুরের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি সুস্থ ধারা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। ৩. মােঃ আসাদুল হক : দারিয়াপুরের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক মােঃ আসাদুল হক কলেজছাত্র থাকাকালে মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের দুর্লভ সুযােগ লাভ করেন। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল এই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মােঃ আসাদুজ্জামান হক, মােঃ শাহাবুদ্দিন (সেন্টু), পিন্টু বিশ্বাস প্রমুখ জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যাপক।
৪. মােঃ বাকের আলী : মুজিবনগর উপজেলার গৌরিনগর গ্রামের কৃতি সন্তান মােঃ বাকের আলীও তার ছাত্রজীবনেই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের শুরুতেই পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করেন। বর্তমানে মুজিবনগর কলেজে অধ্যাপনারত মােঃ বাকের আলী এই দুর্লভ সুযােগ পাওয়ায় নিজেকে কৃতার্থ মনে করেন। মুজিবনগরবাসীও তাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করে। ৫. দোয়াজউদ্দিন মাস্টার : ভবেরপাড়ার দোয়াজউদ্দিন মাস্টার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অনিবার্য কিন্তু অপরিহার্য চরিত্র। তিনি একাত্তরের অসহযােগ আন্দোলনের সেই অগ্নিঝরা দিনে আইয়ুব হােসেন, মােমিন চৌধুরী, সারিকা প্রমুখ যুবককে সঙ্গে নিয়ে গঠন করেছিলেন সীমান্ত সংগ্রাম কমিটি। এই কমিটির তত্ত্বাবধানেই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের মঞ্চ নির্মাণ, মাঠ প্রস্তুতি, তােরণ নির্মাণ প্রভৃতি প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন হয়। মুক্তিযুদ্ধের সহযােগিতার উদ্দেশ্যে ভারতীয় জনগণের দেওয়া নানা প্রকার শুভেচ্ছাসামগ্রীও স্বাধীন বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করে দোয়াজউদ্দিন মাস্টারের নেতৃত্বে এই সীমান্ত সংগ্রাম কমিটি। তাই শুধু দোয়াজউদ্দিন নন, সে-দিনের এই কমিটির সব সদস্যই আজ এ-দেশের ইতিহাসের গর্বিত চরিত্র। ৬. মােঃ আমিরুল ইসলাম ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে নবগঠিত মুজিবনগর উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান মােঃ আমিরুল ইসলাম। ৭. স্মরণীয় ঘটনা : ১. ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং হােসেন শহীদ
সােহরাওয়ার্দীর আগমন। ২. ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রী পরিষদের
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। ৩. ১৯৯৯ সালে হঠাৎ ভারতীয় নদ নদীর পানি মাঠ ঘাট উপচিয়ে
মুজিবনগর পর্যন্ত চলে আসার ঘটনা। ৮. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান :
১. দারিয়াপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়-প্রতিষ্ঠা-১৯৪৬ সাল ২. মুজিবনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়-প্রতিষ্ঠা-১৯৩৭ সাল।
৩. মুজিবনগর ডিগ্রি কলেজ-প্রতিষ্ঠা-১৯৮৩ সাল। ৯. পরিবার একান্নবর্তী ও যৌথ পরিবার সম্পর্কিত তথ্য :
মুজিবনগর উপজেলায় কৃষি নির্ভর গ্রামীণ সমাজ কাঠামাে বিদ্যমান। একান্নবর্তী যৌথ পরিবারের সংখ্যা অতি দ্রুত কমে আসছে। বিশেষ করে নিম আয়ের দরিদ্র শ্রেণীর ভিতরেই এই প্রবণতা খুব বেশি। পরিবারের সদস্য উপার্জনক্ষম হয়ে ওঠার পর যে যৌথ পরিবার ছেড়ে দ্রুত পৃথক হয়ে যেতে চায়। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম। ১০. উপজেলায় প্রকাশিত বই/পত্রিকার লেখক/সম্পাদকের নাম : ১. সাধক মাসিক পত্রিকা-সম্পাদক, সতীশচন্দ্র বিশ্বাস-১৯১৩-১৯১৪
সাল পর্যন্ত। | ২. জলােচ্ছ্বাসের কবিতা-ফজলুল হক সিদ্দিকী (১৯৮৭)।
সূত্রঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর – রফিকুর রশীদ