You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.12.12 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | আত্মরক্ষার স্বার্থে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা | বাংলা-ভারত যুক্ত ইশতেহার | সূতা এবং কাপড় বন্টনের নতুন সিদ্ধান্ত | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১২ই ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, ২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮১

আত্মরক্ষার স্বার্থে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও জোট নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি শান্তিকামী মানুষ মনে প্রাণে বিশ্বাস করে সর্বনাশা অস্ত্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কোন সমস্যার সমাধান হয় না। হবে না। হতে পারেনা। বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষকে অভুক্ত রেখে মারণাস্ত্র নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতাকেও কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশের মানুষ সমর্থন করে না। গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে ঈসা খাঁ নৌঘাঁটিতে নৌবাহিনীকে কালার প্রদান উপলক্ষে বাংলাদেশ নৌবাহিনী অফিসার ও সৈনিকদের এক সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ মৌল বক্তব্যকে সামনে রেখে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে আমরা যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সেজন্য আমাদের অবশ্যই নৌশক্তি সহ প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। আমাদের এই প্রস্তুতি কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য নয়। আমাদের আত্মরক্ষার জন্যই এটা অপরিহার্য।
আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জোরদার করার স্বপক্ষে বঙ্গবন্ধুর এ বক্তব্য বিস্তারিত বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। কেননা আগেই আমরা বলেছি যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মৌল বক্তব্যই হলো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও জোট নিরপেক্ষতা। আমরা কারা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে চাইনা আবার কেউ আমাদের নিজস্ব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করুক এটাও আমরা চাই না। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই আমাদের বলতে হচ্ছে বাস্তবে কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। বাংলাদেশ এমন একটা সমস্যা ও সংকটের মুখোমুখি হবার তেমন কোনো সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সদা সতর্ক থাকতে হবে বৈকি। আর সর্তকতার বিশেষ শর্ত হলো শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে গড়ে তোলা। এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলার জন্য ঘরে-বাইরে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চলছে জন্মলগ্ন থেকেই। এ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকে রুখতে হলে ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রয়োজন। মোদ্দা কথা হলো, সকলের সঙ্গেই আমরা বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই-কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য সুরে সুর মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই যে, শত্রু যেন কোনো অবস্থাতেই আমাদের দুর্বল মনে করতে না পারে সে জন্যই আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে।

বাংলা-ভারত যুক্ত ইশতেহার

বাংলাদেশে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী ওয়াই বি চ্যবনের তিনদিনব্যাপী সফর শেষে বাংলা-ভারত যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয়। কয়েক দফায় বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে প্রণীত এই যুক্ত ইশতেহারে পানিবণ্টন ও চোরাচালান বন্ধের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপসহ তার সন্তোষজনক সমাধানেরও আশা প্রকাশ করা হয়। এছাড়া উপমহাদেশ পরিস্থিতি, জোট নিরপেক্ষ নীতি, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও বাংলা-ভারত পারস্পরিক সামগ্রিক সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারেও বিশদ বক্তব্য রাখা হয়।
উভয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলা- ভারত সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে মতবিনিময় করতে গিয়ে এ বছরের শুরুর দিকে ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং-এর সঙ্গে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন এবং চলতি সালের ১৬ই মে দিল্লিতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেন। ওই দিল্লি চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ বাস্তবায়নে যেসব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার প্রতি ইঙ্গিত রেখে বর্তমান যুক্ত ইশতেহারে বাংলা- ভারত দু’পক্ষই একমত হন যে, দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার কর্মসূচী ও প্রকল্প যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রাস্ফীতি ও আমদানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির দরুন দুই দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক তৎপরতার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এবং তদুপরি দেশের আভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় অর্থনৈতিক সুবিধা থাকলেও দু’দেশের সরকার পারস্পরিক স্বার্থেই তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা জোরদার করবে বলে মতৈক্য জ্ঞাপন করেন।
শান্তি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রশ্নের জোট নিরপেক্ষ নীতি এবং সমসাময়িক বিষয়ের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি মোকাবেলায় উভয় পক্ষ তাদের অভিন্ন ঐকান্তিকতার কথা উল্লেখ করেন। বিশ্বব্যাপী সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অস্থিতাবস্থা প্রবনতার কারণে উন্নয়নশীল দেশসমূহ যাদের অধিকাংশই জোট নিরপেক্ষ যে অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে -তার সমাধানের জন্য জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগীতার উপরও জোর দেওয়া হয় এই যুক্ত দলিলে।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সহ পারস্পরিক সম্পর্ক এবং শান্তি ও সহ অবস্থানের প্রতি বাংলা ভারত-যুক্ত ইশতেহারে যে সকল বক্তব্য রাখা হয় তারমধ্যে পানিবণ্টন ও চোরাচালান সম্পর্কিত বক্তব্যকেই আমরা শীর্ষস্থানীয় ভাবছি। কারণ আমরা দেখছি একদা স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে বাংলা-ভারত সম্পর্কে যে স্বতঃস্ফুর্ত গভীর বন্ধুত্ব, আন্তরিকতা এবং সাহায্য-সহযোগিতা পূর্ণ সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল-পরবর্তীকালে সেই সম্পর্কের উপর কালো ছায়াপাতের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে যে পারস্পরিক সমস্যাগুলো নিয়ে-তার মধ্যে চোরাচালান এবং পানিসম্পদ বণ্টনেই অন্যতম প্রধান দুটি সমস্যা।
এযাবত ফারাক্কা বাঁধ চালু তথা গঙ্গার পানি বন্টনের ব্যাপারে দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে যত আলোচনা হয়েছে, সেই আলোচনা ভিত্তিক অগ্রগতির প্রতি আস্থা রেখেই যুক্ত ইশতেহারে সেই জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সমাধান অভিন্ন দৃষ্টিকোণ সৃষ্টি ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট সন্তোষজনক সমাধান পাবার গভীর আশা প্রকাশ করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে আমরা আশা করবো যে, এই বিরাট সমস্যা যাকে আমাদের জীবন-মরণ সমস্যার পর্যায়ে গণ্য করা যায়-তারই সমাধানে ক্রুগ মিশনের রিপোর্ট ভিত্তিক যৌথ প্রচেষ্টা নিয়ে উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ আরো বাস্তবমুখী পরিকল্পনা নিতে আন্তরিকতার পরিচয় অবশ্যই দেবেন। উন্নয়নশীল দেশে চোরাচালানের অভিশাপ যে মারাত্মক অর্থনৈতিক অস্থিতাবস্থার সৃষ্টি করে সে কথা ব্যাখ্যার অতীত। এতে দুটি প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের ফাটল ধরে, বিশেষ চক্রের চুরির প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং কতিপয় সমাজবিরোধী ব্যক্তির কু তৎপরতায় সহ-অবস্থানের আশ্বাসও হুমকির মুখে পড়ে। আশার কথা সে দিকে লক্ষ্য রেখেই অর্থনৈতিক সম্পর্ক আলোচনাকালে উভয় পক্ষ উভয় দেশের স্বার্থ ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর চোরাচালান সমস্যার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন যুক্ত দলিলের বক্তব্যে। উভয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীই চোরাচালানী ও সমাজ বিরোধীদের বিরুদ্ধে দুই দেশেই যে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তার উল্লেখ করেন এবং এদের দৌরাত্ম্য যথাসম্ভব বন্ধ করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পের কথা উল্লেখ করেন।
পরিশেষে বাংলা-ভারত যুক্ত ইশতেহারে সামগ্রিকভাবে দুটি দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের যে সম্ভাবনা ও প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাসহ আশা পোষণ করছি। আর মনে প্রাণে আমরা একথাও বিশ্বাস করি যে, আন্তরিকতা, সৌহার্দ্যময় বন্ধুত্বের সুকুমার বন্ধন ও সহঅবস্থান কল্যাণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে এলে সকল সমস্যার জটিলতা দূর হয়ে সমঝোতা ও পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের নির্মল পরিবেশ সৃষ্টি হবেই। যা বিশ্ব শান্তি ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পক্ষে ও কল্যাণকর হবে।

সূতা এবং কাপড় বন্টনের নতুন সিদ্ধান্ত

সরকার সূতা এবং কাপড় বন্টনের উপর আরোপিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ক্রেতা সাধারণের চাহিদা মেটানো এবং বাজারে পরিমিত সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করার জন্যই সরকার বর্তমানে মজুদের ব্যবস্থাকে আরও সুষ্ঠু এবং গতিশীল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এই নতুন অবাধ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত এবং স্থানীয় মিলে উৎপাদিত কাপড় বন্টনের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ তুলে নেয়া হয়েছে। এখন প্রতিটি ক্রেতা বিনা রেশনকার্ডে রকমারি শ্রেণীর ১০ গজ করে কাপড় ক্রয় করতে পারবেন। সরকার অনুমোদিত বিক্রয় সংস্থাগুলোর মাধ্যমে মার্কিন কাপড়, ধুতি, শাড়ি, লুঙ্গি বিক্রির ব্যাপারে কোনো রকম বিধিনিষেধ থাকবেনা। এছাড়া সুতা সরবরাহ ব্যবস্থাকে সুগম করার জন্য তাঁতি অধ্যুষিত এলাকায় নতুন সুতার ডিলার নিয়োগের জন্য জেলা প্রশাসক এবং মহকুমা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুতার ডিলারের সংখ্যা প্রয়োজন অনুপাতে অপ্রতুল। এরমধ্যে আবার কিছু অযোগ্য ডিলারো রয়েছে। জেলা এবং মহকুমা প্রশাসক অযোগ্য ডিলারের পরিবর্তে নতুন ডিলার নিয়োগ করতে পারবেন এবং যেখানে ডিলারের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়, সেখানেও নতুন ডিলার নিযুক্তির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এই ভাবেই টিসিবি আমদানিকৃত এবং দেশীয় মিলে তৈরি সুতা বন্টনের ব্যবস্থা পাকাপাকি করা হয়েছে। আপাতঃদৃষ্টিতে ব্যবস্থাটি ভালোই হয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলোঃ অযোগ্য ডিলার নির্বাচনের মাপকাঠিটি কি হবে? যারা নতুন ডিলার মনোনীত হবে, তাদের যোগ্যতাই বা যাচাই হবে কোন নিরিখে?
বিধি নিষেধ প্রত্যাহারের ফলে এখন ক্রেতাসাধারণের সুবিধা অনেকটা বেড়ে যাবে এবং এতে করে বাজারে কাপড়ের সরবরাহও বেড়ে যাবে। সরবরাহ বাড়ায় কাপড়ের দাম কিছুটা ভাটা পড়া স্বাভাবিক। কারণ ইতিমধ্যে ওয়েজ আর্নার স্কীমে প্রচুর পরিমাণে দামি বিদেশী কাপড় আমদানি হওয়াতে দামি কাপড়ের দাম অনেকাংশে কমে এসেছে। বস্ত্র সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্ত যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায় তাহলে বস্ত্র সংকট নিরসনের আশা করা যায় সঙ্গতভাবেই। কিন্তু জেলা এবং মহাকুমা প্রশাসকরা যদি তাদের ক্ষমতা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হন তাহলে সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে যাবে। আমরা আশা করি, জেলা এবং মহাকুমা প্রশাসকরা অযোগ্য ডিলারদের পরিবর্তে যোগ্যতার ডিলারদের সুযোগ দানের ব্যাপারেই যত্নবান হবেন। এ ব্যাপারে কোনো রকম স্বজনপ্রীতি কিংবা পক্ষপাতিত্বের অবকাশ কম হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন