বাংলার বাণী
১লা জানুয়ারী, ১৯৭৩, সোমবার, ১৭ই পৌষ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
নতুন বছরের নতুন দিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
কালের পথ পরিক্রমায় মিলিয়ে গেলো একটি বছর। নতুন সম্ভাবনা, নতুন প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাংলাদেশের আকাশে উদিত হলো তিয়াত্তর সালের নতুন সুর্য। একটি বছর মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠছে কি পেয়েছি আর কি পাইনির খতিয়ান।
রক্তের নদী সাঁতরে কুলে উঠতে চেয়েছিলো বাংলা মায়ের সুর্য সৈনিকরা একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চ থেকে ষোলই ডিসেম্বর পর্যন্ত। অশেষ ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রাম ও সাধনার বিনিময়ে অর্জিত হলো সোনার চেয়ে দামী লক্ষ প্রাণের আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। বাহাত্তর সালের শেষ প্রান্ত থেকে আরম্ভ হলো নতুন দিগন্তের পানে যাত্রা।
এ যাতাপথ ছিলো না মসৃণ। ছিলো না গতিময়। হানাদার বাহিনীর নজিরবিহীন ধ্বংসলীলা আর হত্যা যজ্ঞের ফলে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত ও বিপন্ন বাংলাদেশের মানুষ—তবু এগিয়ে চললো পোষণমুক্ত সমাজ রচনার দিকে। সকলের মনে সেদিন ছিলো একটিমাত্র প্রত্যয়—স্বাধীন বাংলার মাটিতে থাকবেনা কোন শোষণ ও অন্যায় শাসন। বাংলার মাটিতে আর কোনদিন রচিত হবে না বঞ্চনার ইতিহাস। বাংলার দুখী মানুষ হাসবে, গাইবে, প্রাণভরে আনন্দমেলায় মেতে উঠবে। সবার চোখে একই স্বপ্ন। একই প্রতিজ্ঞা সবার কন্ঠে।
স্বপ্ন সবার চোখে সেদিন ছিলো ঠিকই কিন্তু এ স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা ছিলো সবচেয়ে কঠিন। স্বাধীনতা অর্জন করা যতটা কঠিন তার চেয়ে অধিকতর কঠিন কাজ হলো স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখা।
বিধ্বস্ত বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলবার জন্যে সরকার চালাবার দায়িত্বভার গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ সরকার দেখলেন সবই শূন্য। কোথাও কিছু নেই। হানাদার বাহিনী ‘পোড়ামাটি’ নীতি অনুসরণ করে সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে দিয়ে গেছে। সরকারের সম্মুখে পর্বত প্রমাণ সমস্যা ও সংকট। এ সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে চাই অসীম মনোবল, কঠোর সাধনা ও সংগ্রাম। একটা অতলান্ত শূন্যতার মধ্যে দাঁড়িয়েও হতাশায় ভেঙ্গে না পড়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মানুষকে উদাত্ত কন্ঠে আহ্বান জানালেন এই বলে যে, এবারের সংগ্রাম দেশ গড়ার সংগ্রাম। বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্যে প্রয়োজন সকলের অকুন্ঠ সাহায্য ও সহযোগিতা।
তিয়াত্তরের নতুন বছরের নতুন দিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যদি পেছনের দিকে ফিরে তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে দেশকে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে কি কঠিন সংগ্রামই করতে হয়েছে বর্তমান সরকারকে।
কোষাগার শূন্য। খাদ্যের গুদাম খালি। বন্ধুরাষ্ট্র ভারত থেকে এক কোটির বেশী শরণার্থীরা স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসছে—তাদের পুনর্বাসন। এ দু’টো মূল সমস্যার মোকাবেলা করা যতটা সহজ আজ মনে হচ্ছে ততটা সহজ সেদিন ছিলো না। সরকার দৃঢ়তার সঙ্গেই সে সমস্যার মোকাবেলা করলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের অক্লান্ত প্রয়াস ও প্রচেষ্টাতেই সম্ভব হলো অনিবার্য দুর্ভিক্ষকে প্রতিরোধ করা।
গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের সেইলার্স রিপোর্টে এ ইঙ্গিতই দেয়া হয়েছিলো যে, বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষকে কেউ রোধ করতে পারবে না। অথচ সুখের বিষয় মাত্র কয়েক মাস অতিবাহিত হতে না হতেই কেউ মরেনি। জাতিসংঘের একজন বিশিষ্ট কর্মকর্তা স্যার জ্যাকসন কিছুদিন পূর্বে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আহুত সাংবাদিক সম্মেলনে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন যে, বাংলাদেশে কেউ না খেতে পেয়ে মারা যায়নি। বাংলাদেশ খাদ্য সমস্যার মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে।
এদিকে খাদ্য ও শরণার্থী পুনর্বাসনের সমস্যা অন্যদিকে চারটি মৌল আদর্শের ভিত্তিতে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের সংগ্রাম। এ দুটো মহান দায়িত্বকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারকে।
বাংলাদেশের বুকে আর কোনদিন যাতে একচেটিয়া পুঁজিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে সেজন্যে সরকার জাতীয়করণ করলেন শতকরা আশি ভাগ কলকারখানা ও ব্যাংক বীমা প্রতিষ্ঠান। নিপীড়িত নির্যাতিত কৃষক শ্রেণী যাদের সংখ্যা শতকরা আশি ভাগ তাদের ভাগ্য উন্নয়নের প্রতিও দৃষ্টি দিলেন সরকার। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, পরিবার প্রতি ১০০ বিঘা জমি নির্ধারণ ও উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টনের মহতী পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে দেশের সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থার প্রাণ সঞ্চার হলো।
ত্রাণ, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের মত বিরাট দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার পরও আওয়ামী লীগ সরকার দেশে গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য মাত্র এগার মাস সময়ের মধ্যে জাতিকে দিলেন রক্তের আঁখরে রচিত সংবিধান। ঘোষণা করলেন নির্বাচনের দিন তারিখ। দেশের যুব সমাজের একটা বিরাট অংশ যাতে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারেন সেজন্যে ভোটারদের বয়ঃসীমা কমিয়ে একুশ থেকে আঠারোতে নির্ধারিত করলেন। এতে ৪০ লক্ষ নতুন ভোটার নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ পেলো। নির্বাচন হবে। আর এ নির্বাচনে জনগণ যে রায় দেবেন তাই মাথা পেতে নেবেন সংগ্রামী রাজনৈতিক পার্টি আওয়ামী লীগ।
একটি দেশ বা একটি জাতির পক্ষে একটি বছর কিছুই নয়। সমুদ্রে গোস্পদ মাত্র। তবু এ স্বল্প সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার ঘরে বাইরে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন যে করেছেন এতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ কারো সঙ্গে শত্রুতা সৃষ্টির পক্ষপাতী নয়। সকলের বন্ধুত্বই কাম্য। এবং বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী। এ মৌল বৈদেশিক নীতির ভিত্তিতে এগিয়ে যাবার ফলে বিশ্বের প্রায় ১০০টির মত দেশ বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছে। চীন ও পাকিস্তানের বিরোধিতা সত্ত্বেও জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভের বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অকুন্ঠ সমর্থন পেয়েছে। একই কারণে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাগুলোর সদস্যপদ লাভ করেছে বাংলাদেশ।
অতি অল্প সময়ের মধ্যে যা আমরা পেয়েছি এতে যে কোন মানুষ আনন্দিত ও গর্বিত হবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। যা পেয়েছি আর যা পাইনি—সেই আলোকে যদি বিচার করে দেখি সামগ্রিক পরিস্থিতিকে তাহলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশের আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো শহর ও গ্রাম বাংলার মানুষকে আতঙ্কের মধ্যে দিন-রাত্রি অতিবাহিত করতে হয়। খুন, জখম, ডাকাতি, রাহাজানি, আর দুর্নীতিকে এখনো রাশ টানা সম্ভব হয়নি। ষোলই ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে আহুত জনসভায় বঙ্গবন্ধু সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করেই বলেছিলেন, বাংলার মানুষ শান্তিতে ঘুমুতে চায়।
বছরের শেষপ্রান্তে এসে যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে তাতে উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নির্বাচন এগিয়ে আসছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে যদি আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হয় তাহলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কাজ চালানো সম্ভব হবে না। শহরের কলেজগুলোতে নির্বাচনের সময় যেভাবে ব্যালট বাক্স চুরির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে—সাধারণ নির্বাচনেও যে এমন ঘটনা ঘটবে না তেমন মনে করার কোন সঙ্গত কারণ নেই। তাই দেশের বৃহত্তর কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রেখেই সেই সব অশুভ শক্তিকে দমন করতে হবে। দুষ্কৃতিকারীদের শায়েস্তা করতে হবে নির্মমভাবে।
পরিশেষে আমরা আরও একটি বিষয়ের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সরকার চারটি মৌল নীতির ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে বদ্ধপরিকর এবং তা করতে গেলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি। সরকারী প্রশাসন যন্ত্র যদি সেই দিকে লক্ষ্য রেখে এগিয়ে না যান তাহলে সামগ্রিকভাবে ‘মহতী পরিকল্পনা’ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। বঙ্গবন্ধু ও তার সরকার যে এ বিষয়ে সচেতন নন এমন নয়। তাই বঙ্গবন্ধু বারংবার আমলাদের পুরাতন মানসিকতা পরিবর্তন করে কঠোর পরিশ্রম করতে আদেশ করেছেন। আবেদন জানিয়েছেন। আশা করি আমলারা এদিকে সজাগ ও সচেতন হবেন। যদি তা না হন তাহলে তার পরিণতি যে শুভ হবে না সেকথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তিয়াত্তরের নতুন দিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকদের এই প্রতিজ্ঞাই নিতে হবে যে, আমরা এগিয়ে যাবো দৃপ্ত পদক্ষেপে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে। দেশের সকল ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা সোনার বাংলাকে গড়ে তুলবো। সোনার বাংলার বুক থেকে আমরা সকল দুর্নীতি, মুনাফাখোরী, মজুদদারী, চোরাচালানী ও সমাজবিরোধী অশুভ তৎপরতাকে উচ্ছেদ করবোই। আমরা এগিয়ে যাবো। এগিয়ে চলার গান সকলের কন্ঠে ধ্বনিত হবে—এ আশাই আমরা করছি তিয়াত্তর সালের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক