You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.25 | মুজিবনগর অঞ্চলের কয়েকটি যুদ্ধ-তৎপরতা - সংগ্রামের নোটবুক
মুজিবনগর অঞ্চলের কয়েকটি যুদ্ধ-তৎপরতা

সামগ্রিক যুদ্ধপ্রস্তুতি দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে এতদঞ্চলের প্রতিরােধ ব্যবস্থা মধ্য-এপ্রিল থেকে দুর্বল হয়ে আসে। ১৫ এপ্রিল ঝিনাইদহে পাকসৈন্য চলে আসার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা ১৬ এপ্রিল সরিয়ে নেওয়া হয় মেহেরপুর। এ দিন চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয় পাকিস্তানি বাহিনী। ফলে ১৬ তারিখ রাতেই মেহেরপুর থেকে দক্ষিণ পশ্চিম কমান্ড আরাে পিছিয়ে নেওয়া হয় মেহেরপুরের প্রত্যন্ত সীমান্ত ইছাখালী বিওপিতে। এভাবেই আমাদের প্রতিরক্ষবলয় একেবারে সংকুচিত হয়ে আসে। কিন্তু এখান থেকেই আবার শুরু হয় ঘুরে দাঁড়ানাের আয়ােজন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ সমগ্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যুক্ত করে নতুন মাত্রা, এতােদিনের প্রতিরােধ যােদ্ধারা একটি গণসমর্থিত সরকারের দ্বারা পরিচালিত হয়ে নিজেদের দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্যে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। সব পরিচয় ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে তাদের মুক্তিযােদ্ধা পরিচয়টি।  এতদ্ঞ্চলে প্রতিরােধ যুদ্ধের বীরসৈনিক ইপিআর বাহিনীর অনেক সদস্যই ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে যান, শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। আবার বেশকিছু সদস্য সীমান্ত পেরিয়ে বেতাই লালবাজারে একত্রিত হন। প্রতিরােধযােদ্ধা আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র, যুবকেরাও ১৭ তারিখ থেকে বিভিন্ন পথে ভারতে প্রবেশ করে একটুখানি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য, আবার নতুন করে যুদ্ধপ্রস্তুতি গ্রহণের জন্য। কিন্তু এরই মাঝে ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রবেশ ঘটে মেহেরপুরে। শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে তাদের আগ্রাসন সম্প্রসারিত হলে তা প্রতিহত করাও খুবই জরুরি হয়ে ওঠে। দেশত্যাগী বিভিন্ন রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক, ইপিআর, আনসার, পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করে এ বি ও সি নামের তিনটি কোম্পানিতে ভাগ করে ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সি-কোম্পানির সৈনিকেরা থাকে বেতাই লালবাজার সাব-সেক্টরের অধীনে।

 
এই সৈনিকদেরই বেশ কয়েকটি সেকশন এপ্রিলের ২০ তারিখ থেকে মুজিবনগর তাে বটেই, মেহেরপুরের সীমান্ত-এলাকায় নিয়মিত টহল দেওয়া শুরু করে। প্রতিহত করতে চেষ্টা করে পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর তৎপরতা। মুজিবনগর এলাকায় শত্রুপক্ষের অবস্থান। ১৮ এপ্রিল মেহেরপুর শহর দখলের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শহরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এবং এ-জেলার পশ্চিম প্রান্তে দীর্ঘ সীমান্ত-এলাকায় তাদের ছাউনি স্থাপন করে, নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা-লুণ্ঠন ধর্ষণ চালিয়ে জনজীবন দুর্বিষহ করে তােলে। মেহেরপুর কলেজ, ভােকেশনাল, নজরুল স্কুল এ-তিন প্রতিষ্ঠানজুড়ে গড়ে তােলে তাদের প্রধান ঘাটি। ছােট্ট এই শহরেই কোর্ট এলাকা, টিবি হাসপাতাল এবং থানা-ঘাটে তিনটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ এক প্লাটুন করে পাকসৈন্য অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে মুজিবনগর’ একটি বিস্ময়কর এবং ভয়াবহ নাম। তাদের কাছে অজানা রহস্যে ঘেরা ভীতিপ্রদ এক স্থানের নাম মুজিবনগর। কিন্তু কোথায় সে মুজিবনগর? না, মুজিবনগরের অবস্থান জানতে দেরি হয় নি তাদের। এ-দেশেরই কতিপয় বাঙালি নামের কুলাঙ্গার অতি দ্রুত হাত বাড়িয়ে দেয় সহযােগিতার। চিনিয়ে দেয় গৌরবময় মুজিবনগরের ঐতিহাসিক আম্রকানন। এই আম্রকাননেরই দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ইপিআর ক্যাম্পটি দখল করে নিয়ে এখানেই পাকসৈন্যের ঘাঁটি তৈরির চেষ্টা হয় শুরু থেকেই। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে তাদের সে-চেষ্টা বার-বার ব্যর্থ হয়। তবু এই এলাকায় পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা ৩০ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে তিন কিলােমিটার উত্তরে মানিকনগরে কোম্পানি সদর প্রতিষ্ঠা করে। ২টি রিকয়েললেস রাইফেল, একটি ভারী মেশিনগানসহ এক কোম্পানি পাকসৈন্য এখানে অবস্থান গ্রহণ করে। মুজিবনগর থেকে ২/৩ কিলােমিটার দূরে ১টি রিকয়েললেস রাইফেল, ২টি ভারী মেশিনগানসহ এক প্লাটুন পাকসৈন্য নূরপুর নামক স্থানে একটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে ১ মে, ১৯৭১। 
 

এতদঞ্চলের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে শক্তিশালী পাকঘাঁটি ছিল মুজিবনগর থেকে ৫ কিলােমিটার দূরে, মহাজনপুর ইউনিয়নের পাশে, নাটুদা হাইস্কুলে। বর্তমানে নাটুদার অবস্থান চুয়াডাঙ্গা জেলার মধ্যে হলেও ‘৭১ সালে এই নাটুদা ক্যাম্পের পাকসৈন্যের মেহেরপুর এবং চুয়াডাঙ্গা ঘাঁটির সঙ্গে ছিল নিবিড় যােগাযােগ। মুজিবনগর এলাকার জনজীবন বিপর্যস্ত করে তােলার ক্ষেত্রে নাটুদা ক্যাম্পের ভূমিকা কম নয়। 

 
তাদের সে-সাধ পূরণ হয় নি। প্রকৃতিই এ-দিনে মুক্তিযােদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। প্রবল ঝড়-বৃষ্টি আর বজ্রপাত তাদের গতিপথ রােধ করে দাঁড়ায়। ফলে প্রথমদিনের আক্রমণে একেবারে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় পাকিস্তানি। | সৈন্যবাহিনী। এই ব্যর্থ অভিযান সম্পর্কে পরের দিন ভারতীয় দৈনিক যুগান্তরে লেখা হয় : মুজিবনগর আক্রমণের চেষ্টা ব্যর্থ এদিকে গতকাল মঙ্গলবার পাকিস্তানি সৈন্যরা মুজিবনগর আক্রমণের চেষ্টা ও পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু বিকেল থেকে প্রবল বৃষ্টি হওয়ায় এবং রাস্তাঘাট চলাচলের পক্ষে সুবিধাজনক না হওয়ায় পাকবাহিনীর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়।
 
মুজিবনগর যুদ্ধ-২
 
মাত্র ২ দিনের ব্যবধানে, ২৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে নটা-দশটার দিকে শতাধিক পাকিস্তানি সৈনিকের একটি সশস্ত্র দল মুজিবনগরের ঐতিহাসিক আম্রকাননে প্রবেশ করে। এ-দিনও তারা দখল করতে চায় প্রায় পরিত্যক্ত ইপিআর ক্যাম্পটি। তাদের লক্ষ্য এখানে তাদের একটি ঘাঁটি স্থাপন করা। কিন্তু আম্রকাননে পাকসেনাদের উপস্থিতির খবর দ্রুত পৌছে যায় বেতাইলালবাজার সাব-সেক্টরে। সেখান থেকে ক্যাপ্টেন এ.আর আজম চৌধুরীর নির্দেশে সুবেদার আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা তীব্র আক্রমণ রচনা করে। উভয় পক্ষে প্রচুর গুলি বিনিময়ের পর পাকসেনারা এদিনও ব্যর্থ মনােরথে ফিরে যায়। | শুধু এদিনই নয়, এরপরও পাকিস্তানি সৈন্যেরা বারবার হামলা চালিয়েছে ঐতিহাসিক মুজিবনগর আম্রকাননে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে বৈদ্যনাথতলা ইপিআর ক্যাম্পে তাদের ঘাঁটি কখনােই প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বরং এ-সব যুদ্ধে পাকসেনাদেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মে-জুন মাসে এ-অঞ্চলের ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণে ব্যস্ত থাকে। এসময়ে সীমান্ত এলাকা জুড়ে সাহসিকতার সঙ্গে পাকবাহিনীর প্রতিটি আক্রমণ মােকাবিলা করেন মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত যােদ্ধারা। এ-সব যুদ্ধও অনেকাংশেই ছিল নিয়মিত পদ্ধতির যুদ্ধ। ট্রেনিং শেষে গেরিলা যােদ্ধারা দেশের ভিতরে ঢুকে গেরিলা হামলা শুরু করলে মুক্তিযুদ্ধে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। মুজিবনগর এলাকায় এসে নাটুদা, নূরপুর কিংবা মানিকনগরের পাকসৈন্যরা বহুবার গেরিলাদের চোরাগােপ্তা হামলার শিকার হয়েছে, যার যুদ্ধ-বিবরণ লেখা বেশ কঠিন।
 
মুজিবনগর যুদ্ধ-৩
 
জুন মাসের ৩ তারিখে মুজিবনগর এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের এক বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। এ-সময় নায়েব সুবেদার মতিন পাটোয়ারী ইপিআর-আনসার মিলিয়ে ৪৫ জনের ট্রপস নিয়েই এলাকার প্রতিরক্ষায় ছিলেন। ৩ জুন তারিখের যুদ্ধ সম্পর্কে মতিন পাটোয়ারীর সাক্ষাৎকারের বরাত দিয়ে ড. সুকুমার বিশ্বাস তার মুক্তিযুদ্ধে রাইফেলস ও অন্যান্য বাহিনী’ শীর্ষক গ্রন্থে লেখেন : পাকসেনাদের প্রধান ঘাঁটি ছিল মেহেরপুরে। ঐ তারিখে বিকাল ৪টার দিকে পাকসেনারা প্রায় এক ব্যাটেলিয়ান শক্তি নিয়ে কিছুসংখ্যক মূল ডিফেন্সে রেখে মুজিবনগর আম্রকাননের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। নায়েব সুবেদার পাটোয়ারী পাকসেনাদের আগমন টের পেয়ে তার ৪৪ জন সৈন্যকে দুটি ভাগে ভাগ করে একটিতে নিজে এবং অপরটি নায়েব সুবেদার তােফাজ্জল হােসেনের নেতৃত্বে ডিফেন্স নিল। পাকসেনারা ঐতিহাসিক আমবাগানের নিকটবর্তী হলে মুক্তিবাহিনীর গানগুলাে। একসঙ্গে গর্জে ওঠে। পাকসেনারা ছিল খােলা মাঠে। ফলে মুক্তিবাহিনী নির্দিষ্ট লক্ষে গুলিবর্ষণ করতে লাগল।
মুজিবনগর সম্পর্কে পাকসেনাদের মনে নানা অজানা রহস্য বাসা বাঁধায় মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করে তারা তীব্রগতিতে অগ্রসর হতে থাকে। পাকসেনাদের তীব্র আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনীর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে তারা পিছু হটতে থাকে। পাকসেনারা শেষ পর্যন্ত মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর মূল ঘাঁটি দখল করে নিয়ে ঘরদুয়ার জ্বালিয়ে ধ্বংস করে বিরাট বিজয়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে নৃত্য করতে থাকে। মুক্তিবাহিনী নীরবে পিছু হটে পুনরায় সবাই একত্রিত হয়। নায়েব সুবেদার পাটোয়ারী এই দুর্যোগময় মুহূর্তেও মনােবল হারালেন না। তুরিত সিদ্ধান্ত নিলেন। আমবাগানের পিছনে ছিল আখক্ষেত। মুক্তিবাহিনীর ঐ স্বল্পসংখ্যক যােদ্ধাকেই বিস্তীর্ণ এলাকাতে ছড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক কায়দায় বজ্রকণ্ঠে নায়েব সুবেদার পাটোয়ারী হাঁকলেন ‘আলফা-ব্রোভাে রাইট, চার্লি-ডেল্টা লেফট, ইকো ইহাসে অ্যাডভান্সড আওর সালে লােককো জিন্দা পাকাড় লে আও।’ এরপরই মুক্তিবাহিনী বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে গুলি ছোঁড়া শুরু করে। একই সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে গুলি আসায় এবং কমান্ডে এমন দৃঢ়তা শুনে পাকসেনারা বিচলিত হয়ে পড়ল। তারা ভাবল, ব্যাপকভাবে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে তাদেরকে আক্রমণ করছে। মুক্তিবাহিনী আখক্ষেত থেকে তাদেরকে দেখতে পাচ্ছিল।
 
আর তাই বুলেট যথার্থই পাকিস্তানিদের ধরাশয়ী করছিল। পাকসেনারা হতচকিত হয়ে শেষপর্যন্ত জয়ে পিছনে সরে যায়। সংঘর্ষে ২৮ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ২০ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনী পুনরায় তাদের মুজিবনগর ঘাঁটি পুনরুদ্ধার করে। মুক্তিবাহিনীর এই গ্রুপটি মুজিবনগরে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে বহু অপারেশনে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিযেছে। ১৪ জুন মানিকনগর, ২০ জুন এবং ২১ জুন মুজিবনগর বিওপি ইত্যাদি স্থানের সংঘর্ষের কথা সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। বল্লভপুর-বাগােয়ান সড়কের যুদ্ধ মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুজিবনগরের বিপরীতে হৃদয়পুর বিএসএফ ক্যাম্পের পাশেই নিয়মিত বাহিনীর একটি অ্যাকশন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। মুজিবনগর এবং এর আশপাশের গ্রামগুলাে রক্ষা করা এ-ক্যাম্পের দায়িত্ব। এখান থেকে মুক্তিযােদ্ধারা নিয়মিতভাবে মুজিবনগর, সােনাপুর, ভবেরপাড়া, বল্লভপুর, বাগােয়ান প্রভৃতি গ্রামে টহল দেয়। হাবিলদার আবু তৈয়ব, হাবিলদার মতিন পাটোয়ারী, হাবিলদার শামসুর রহমান, সেপাই মােহাম্মদ আলী, আনসার সদস্য বরকত আলী, শফি, মহিসহ মােট ১৫ জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল ২৭ মে বল্লভপুর এলাকায় টহলে আসে। নাটুদা ক্যাম্পে থেকে পাকবাহিনীর জিপ আসতে দেখে বল্লভপুর-বাগােয়ান সড়কের মাঝামাঝি জায়গায় মুক্তিযােদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ চালায়।

মাত্র ৫০ গজের ব্যবধানে উভয়পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। জিপে বসে থাকা সবাই প্রায় হতাহত হয়। একজন অফিসার নিহত এবং পাঁচজন অন্যান্য পদবির পাকসেনা নিহত কিংবা আহত হয়। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে নাটুদা থেকে পাকবাহিনীর একটি ডজ ও একটি ৩ টনের ট্রাক ঘটনাস্থলে এসে মৃতদেহ এবং আহতদের তুলে নিয়ে চলে যায়। পড়ে থাকে জিপ। শত্রুপক্ষের হাল্কা ও ভারী মেশিনগানের প্রচণ্ড গুলিবর্ষণের মধ্যে মুক্তিবাহিনীকে পিছু হটতে হয় বটে, কিন্তু পাকসৈন্য চলে যাওয়ার পরই তারা ফিরেএসে জিপ গাড়িটি নিয়ে যায়। এ-সময়ে তাদের দখলে আসে একটি সাব-মেশিনগান, গুলিভর্তি দুটি ম্যাগজিনসহ একটি বাইনােকুলার, একটি মার্ক-ফোর রাইফেল। মুক্তিযােদ্ধাদের শুধু একটি হালকা মেশিনগানের ম্যাগজিন হারিয়ে যায়। দখলকৃত জিপ গাড়িটি বেতাই লালবাজার সাব-সেক্টরে জমা দিয়ে আসা হয়। আরাে একটি ব্যর্থ অভিযান। ১০ জুন বেলা দুটোর দিকে এক কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা মুজিবনগরের কাছে পেীছে সীমান্তবর্তী গ্রাম মানিকনগর, কেদারগঞ্জ, বল্লভপুর এবংনাজিরাকোনায় কয়েক প্লাটুনে বিভক্ত হয়ে অবস্থান গ্রহণ করে এবং প্রত্যেক গ্রামে তল্লাশি চালায়। কয়েক দিন আগে বেদখল জিপটি উদ্ধারই তাদের এঅভিযানের লক্ষ্য। তারা জানতে পেরেছে জিপ গাড়িটি মুজিবনগর সন্নিহিত এসব গ্রামের মধ্যেই কোথাও লুকানাে আছে। কিন্তু বাস্তবে মােটেই তেমনটি ছিল না। জিপ চলে গেছে অনেক আগেই বেতাই সাব-সেক্টরে। এদিকে মুক্তিযােদ্ধারাও মাত্র কিছুক্ষণ আগে আমবাগান ছেড়ে চলে গেছে হৃদয়পুর ক্যাম্পে। ফলে জিপ উদ্ধার কিংবা মুক্তিযোেদ্ধাদের সংঘর্ষ কোনােটিই এ-দিন ঘটে নি। ব্যর্থ অভিযান শেষে পাকবাহিনী সন্ধ্যার কিছু আগে ক্যাম্পে ফিরে যায়।

 
অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা
 
২৮ জুন মুজিবনগর এলাকার মুক্তিযােদ্ধারা আকস্মিকভাবে পাকসেনাদের বেষ্টনীর মধ্যে আটকে পড়েছিল প্রায়, কিন্তু অল্পের জন্য সবাই প্রাণে রক্ষা। পায়। বর্তমানে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ যেখানে নির্মিত হয়েছে, তার দক্ষিণপশ্চিম দিকে ২০/২৫ গজ দূরে বেশ কয়েকটি পরিত্যক্ত মাটির ঘর ছিল। হৃদয়পুর ক্যাম্প থেকে মুক্তিযােদ্ধারা এই এলাকায় টহলে এসে যে-কোনাে পরিত্যক্ত ঘরে বসে দুপুরের আহার সম্পন্ন করত। ২৮ জুন দুপুরে বল্লভপুরের পচা মল্লিক দৌড়াতে-দৌড়াতে এসে হাবিলদার মতিন পাটোয়ারীকে জানায়, পাকসেনারা এসে আখক্ষেতের মধ্যে পজিশন নিয়েছে এবং মুক্তিবাহিনীকে। ঘিরে ফেলেছে। ততক্ষণে কেবল আল আমিনের আহার সম্পন্ন হতে বাকি। অন্য সবাই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে সােনাপুরের রাস্তার পশ্চিমে পজিশন নেয়। এরই মাঝে গােলাগুলি শুরু হয়ে গেলে আল আমিনের পক্ষে আর বাইরে আসা সম্ভব হয় না। সাতচালা ঘরের মাটির দেয়ালের ওপর সে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। ঘণ্টাখানেক পর গােলাগুলি থেমে গেলে সে বাইরে এসে সহযােদ্ধাদের খুঁজে নেয়। রহমতউল্লাহ খান, বদরউদ্দিন, রমজান আলী, বরকত আলী, রায়হানউদ্দিন, সাদেক হােসেন, আব্দুল বারি, সিরাজুল ইসলাম, নায়েক ফজলুর রহমানসহ দলের সবাই কোনাে ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আল আমিনকে ফিরে পেয়ে আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। গেরিলা-তৎপরতা বৃদ্ধি। জুন-জুলাই মাসের মধ্যেই মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ব্যাচ প্রশিক্ষণ শেষে নিজ এলাকায় ফিরে এসে সাব-সেক্টরের সার্বিক নিয়ন্ত্রণে দেশের ভিতরে প্রবেশ করে এবং গেরিলা-তৎপরতা বাড়িয়ে তােলে। নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তারা কখনাে-কখনাে পাকসৈন্যের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়, তবে অধিকাংশ সময়ে গেরিলা-কৌশলে পাকসেনা কিংবা তাদের দোসর পিস কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের ওপরে ঝাপিয়ে পড়ে, বিস্ফোরকের সাহায্যে ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংস করে পাকসৈন্যদের চলাচল ও পণ্য সরবরাহ বিঘ্নসংকুল করে তােলে। এ-সব তৎপরতা চালাতে গিয়ে তারা নিজেরাও কখনাে-কখনাে বিপদের সম্মুখীন হয়।
 
তেমনি এক ঘটনা ঘটে ১ জুলাই। লুত্যর রহমান লালার নেতৃত্বে একটি গেরিলাদল একদিন কোমরপুরের পিস কমিটির নেতা আফতাব বিশ্বাস ও লুত্যর রহমানকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসে। এ-দলে ছিলেন কোমরপুরের হারুন, মতিয়ার, ফকির মােহাম্মদ, ইবাদত, আমঝুপির মাহতাব, তমছের এবং আরাে ৫ জন মুক্তিযােদ্ধা। কিন্তু তাদের আগমনের খবর জেনে ফেলার কারণে নাটুদা ক্যাম্প থেকে পাকসৈন্যের এক বিশাল বহর এসে রাত তিনটার দিকে সারা গ্রাম ঘিরে ফেলে। মুক্তিযােদ্ধারা খুব নিরাপদ জায়গায় তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখে ভােরবেলা কেউ লাঙ্গল কাঁধে, কেউবা নিড়ানি হাতে সাধারণ কৃষকের ছদ্মবেশে গ্রামের বাইরে বেরিয়ে আসে। অবশ্য পরে পাকসৈন্যরা গ্রামের সাধারণ মানুষের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। কিন্তু কেউ মুক্তিযােদ্ধাদের সম্পর্কে কোনাে তথ্য ফাঁস করে নি। এ-রকম ঘটনা সে-সময় বহুবার সংঘটিত হয়েছে।  ১৩ জুলাই মুক্তিযােদ্ধা বশির আহমেদ, ম্যাজিক আব্দুল, আফসার, জমির। এবং আরাে কয়েকজন মেহেরপুর-নূরপুর রাস্তার মাঝে কোলার কাছে একটি মাইন স্থাপন করে। পাকবাহিনীর একটি ৩ টন ট্রাক ঐ পথে যাওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরণ ঘটে। ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়, আহত হয় বেশ কয়েকজন।
 
রতনপুর ঘাটের যুদ্ধ
 
জুলাইয়ের ১৭ তারিখে মুজিবনগর এলাকায় বাগােয়ান এবং রতনপুর ঘাটের মাঝামাঝি জায়গায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের এক ঘণ্টা স্থায়ী সংঘর্ষ হয়। সে-দিনের এই মুক্তিযােদ্ধাদলের অধিনায়ক নায়েব সুবেদার আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর ভাষায় ঘটনাটি ছিলেন এ-রকম : আমাদের ইনফরমার ছিল ভাদু মণ্ডল (গােপালনগর)। সে পাকসেনাদের সাথে থাকত এবং খবরাখবর সংগ্রহ করে আমাদের দিত। ভাদু মণ্ডল আমাকে খবর দিল যে, ১৭ জুলাই তারা গরুর গাড়ি করে নাটুদা থেকে রেশন নিয়ে মানিকনগর যাবে। সঙ্গে ১৫ জনের মতাে পাকসেনা থাকবে। ভাদু মণ্ডল হুঁশিয়ারি করে দিল- ‘আমার গাড়ােয়ান যেন না মরে।’ আমি ১৫ জনের একটি দল নিয়ে একজন সিভিল গাইডের সহায়তায় বাগােয়ান এবং রতনপুর ঘাটের নিকট ওঁৎ পেতে থাকি। গাইডও আমাদের সঙ্গে রইল। ভাের ৬টায় যখন। পাকসেনাদের দলটি রেশন নিয়ে চলছিল, ঠিক তখনই আমরা। পাকসেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। এক ঘণ্টা সংঘর্ষ চলল। গােলাগুলির শব্দে মানিকনগর এবং নাটুদা হাইস্কুলে অবস্থানরত পাকসেনারা ঘটনাস্থলে দ্রুত চলে আসে এবং আমাদের দু’দিক থেকে ঘিরে ফেলে। পাকসেনারা আমাদের আত্মসমর্পণ করতে বলল। আমি বললাম, ক্ষমতা থাকে তাে এসে ধর। সামনাসামনি গালাগালি চলছে গুলি চালাচ্ছি আর পিছু হটছি। আমাদের গাইড পিছু পড়ে গেল এবং সে পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ল। আমরা শেষপর্যন্ত নিরাপদে মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসি। ঐদিন বিকালে পাকসেনারা আমাদের গাইডের দু’ হাত-পা বেঁধে নাটুদা স্কুলে উপস্থিত জনতার সামনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করল। এই হত্যাযজ্ঞ নিরীহ গ্রামবাসীকে দেখতে বাধ্য করা হল, বলা হলে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করলে এমনি শাস্তি পেতে হবে। এ-দিনের এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা বশির আহমেদ তাঁর স্মৃতিচাণে বলেন : কেদারগঞ্জ-নাটুদা রাস্তার দক্ষিণে ১০ হাত ব্যবধানে ৩টি এলএমজি সেট করা হয়। কথা ছিল পায়ে হাঁটা সবকটা পাকসেনা টার্গেটের মধ্যে চলে আসার পর ফায়ার ওপেন করা হবে। কিন্তু কয়েকজন সেনা টার্গেটের বাইরে থাকতেই ইদ্রিস আলী এলএমজির ব্রাশ ফায়ার দেয়। ফলে ৭ পাকসেনা বেঁচে যায়।
 
সেগুনবাগানের যুদ্ধ
 
বাগােয়ান সেগুনবাগানের মধ্যে পাকসেনাদের ঘােরাঘুরি করতে দেখে ২০ জুলাই দুপুরে একজন কৃষক তার গরু মােষ তাড়াতে-তাড়াতে এসে মুজিবনগর এলাকায় টহলরত মুক্তিযােদ্ধাদের খবর দেয়। মতিন পাটোয়ারীআল আমিন, সােনা, মফিজুল, রবিন, বরকত অস্ত্র কাঁধে ছুটে যায় বল্লভপুরবাগােয়ান রাস্তার দক্ষিণে। সুবিধামতাে অবস্থান থেকে তারা একযােগে গুলিবর্ষণ করে ২ জন পাকসৈন্যকে খতম করতে সক্ষম হয়। এ-যুদ্ধ মাত্র ১০/১৫ মিনিট স্থায়ী হয়।
 
মানিকনগরে আবার যুদ্ধ
 
সেগুনবাগানের ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধ শেষে ফিরে আসতে-না-আসতেই হাবিলদার আব্দুর রউফের কাছে বিশেষ সংবাদ পেয়ে এই মুক্তযােদ্ধাদলকেই আবার মানিকনগরে পাকসৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। এ-সময় কমরুদ্দীনের গেরিলাবাহিনীও তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী এ-যুদ্ধে কমপক্ষে ৫ জন পাকসৈন্য নিহত হয় বলে খবর পাওয়া যায়। আবার মানিকনগরে আক্রমণ। আবার ২৬ জুলাই সাব-সেক্টর অধিনায়ক এ. আর আজম চৌধুরীর কড়া নির্দেশে আব্দুল মতিন পাটোয়ারী এবং এস.এম. আল আমিন তার ৯নং প্লাটুনের মুক্তিযযাদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে আক্রমণ করে মানিকনগর পাকবাহিনীর ক্যাম্প। কয়েকজন পাকসৈন্য হতাহত হয় বটে, তবু তাদের লক্ষ্য পূরণ হয় না। রতনপুর ঘাটে হামলা ২৭ জুলাই নায়েব সুবেদার আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা রতনপুর ঘাটে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের রেশন সামগ্রী ও রসদ হস্তগত করে। এ-অভিযানে জার্মান আলী, জামাত আলী, রবিন, মােঃ সারিসহ মােট ১৫ জন মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করে। মানিকনগরে চূড়ান্ত আক্রমণ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এ. আ, আজম চৌধুরী জুলাই মাসের শেষদিকে বারবার মানিকনগরের দিকে মনােযােগ দেন। এখানে পাকসেনাদের ক্যাম্প থাকায় মুজিবনগর এলাকার পবিত্রতা ও নিরাপত্তা রক্ষা করা দুরূহ হয়ে ওঠে। হাবিলদার আবু তৈয়ব এবং ল্যান্স নায়েক রহমতুল্লাহ্ খান সােনার যৌথ নেতৃত্বে এক শক্তিশালী মুক্তিযােদ্ধাদল ১ আগস্ট মানিকনগর পাক-ক্যাম্পে প্রবল আক্রমণ করে। পাকসেনারা হালকা অস্ত্রের সাথে ভারী মেশিনগানও ব্যবহার করে মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এক ঘণ্টা স্থায়ী এ-যুদ্ধে মাত্র একজন পাকসেনা নিহত হয়। যুদ্ধের এ-ফলাফলে ক্যাপ্টেন চৌধুরী মােটেই সন্তুষ্ট হতে পারেন না। তিনি মানিকনগরের জন্য নতুন পরিকল্পনা করতে বলেন। মুক্তিযােদ্ধা এস,এম, আল আমিন বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। এবারের তার ভিন্ন রকমের প্রস্তুতি। 
 
আল আমিন হৃদয়পুর থেকেই ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত-এলাকার বিভিন্ন দুর্ধর্ষ ডাকাত প্রকৃতির দুঃসাহসী লােকের সঙ্গে যােগাযােগ করে প্রায় ৪০/৫০ জনকে ডেকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। পরদিন ২ তারিখে গভীর রাতে সবাই মিলে একযােগে মানিকনগর গিয়ে পাকসেনা ক্যাম্পের চতুর্দিকে ব্যাঙ্কারে হ্যান্ড গ্রেনেড, শক্তিশালী বােমা ছুঁড়তে হবে। তাদের দায়িত্ব এ| টুকুই। পরিকল্পনা অনুযায়ী এক রাতের নবীন মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে মতিন পাটোয়ারী সি-কোম্পানির ৯নং প্লাটুনের অধিকাংশ সৈনিকসহ রাত দুটোর পর রওনা হয় মানিকনগরে। বােমা-বাহিনী যথারীতি ৩০টি ব্যাঙ্কারে অতি সফলভাবে বােমা ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। লক্ষ্য তাদের অব্যর্থ। একই সঙ্গে গর্জে ওঠে মুক্তিযােদ্ধাদের সবগুলাে অস্ত্র। মাত্র ৩০/৪০ মিনিটের মধ্যে যুদ্ধ শেষ। অধিকাংশ পাকসৈন্য এবং রাজাকার খতম হয়ে যায়। সকাল হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে অবশিষ্ট পাকসৈন্য মানিকনগর থেকে ক্যাম্প উঠিয়ে নিয়ে যায় ভৈরব নদীর পূর্বপাড়ে। মােনাখালী ঘাটে। মুক্তিবাহিনী মানিকনগর ক্যাম্প থেকে ২৭টি অ্যান্টিপার্সন মাইন উদ্ধার করে। মানিকনগর ও বল্লভপুরে টহল দিয়ে ৮২ মিমি মর্টার বােমা উদ্ধার করা হয়। মানিকনগরের পর মাত্র সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে নূরপুর থেকেও পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ক্যাম্প উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এ-দুটি ক্যাম্প উঠে যাবার পর মুজিবনগর এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব অনেকাংশে প্রতিষ্ঠিত হয়।
 
একটি শােকাবহ অধ্যায়
 
আগস্ট মাসের ৫ তারিখে ঘটে যায় এ-অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চরম এক বেদনাদায়ক ঘটনা। এ-ঘটনা সংঘটনের স্থান মেহেরপুর জেলার বাগােয়ান গ্রাম এবং রতনপুর ঘাট। কিন্তু এ-ঘটনার শিকার অধিকাংশই চুয়াডাঙ্গা জেলার মুক্তিযােদ্ধা। মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম জয়পুরে শেল্টার নেয় ৩১ জন মুক্তিযােদ্ধা। দেশের ভিতরে বিভিন্ন জায়গায় গেরিলা-তৎপরতা চালানাের উদ্দেশ্যে তারা ট্রেনিং শেষে সবেমাত্র ভারত থেকে এসেছে। ৫ তারিখে খুব সকালে তাদের কাছে নালিশ এলাে বাগােয়ানের মাঠ থেকে দু’জন রাজাকার ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। নালিশ শুনে রাজাকারদের শায়েস্তা করার জন্য সঙ্গে-সঙ্গে বাগােয়ানের মাঠে ছুটে যায় ৭ জন মুক্তিযােদ্ধা- হাসান, তারিক, থােকন, কাশেম, পিন্টু, আশা ও আফাজউদ্দিন। কিন্তু সেখানে কাউকে দেখতে না-পেয়ে, ৫ জনকে সেখানেই দাঁড়াতে বলে পিন্টু ও আফাজউদ্দিন খানিকটা এগিয়ে রতনপুর ঘাটের কাছে যায় কৌতূহলবশত। নদীর ওপারে নাটুদা স্কুলে পাকবাহিনীর ক্যাম্প। সেখানে খানিকটা দূরে। আপাতত নদীর ওপারে বটগাছের মাথায় দু’জন ওপিকে দেখে আফাজউদ্দিন গুলি ছুঁড়ে বসে। সঙ্গে-সঙ্গে নদীর ওপারে থেকে শত-শত গুলি ছুটে আসে। মুক্তিযােদ্ধারা অতি দ্রুত বাগােয়ান গ্রামের এক বাগানে এসে আশ্রয় নেয়। এ-দিকে রতনপুর ঘাটে গােলাগুলির শব্দ শুনে জয়পুর শেল্টার থেকে ২৪ জুন মুক্তিযােদ্ধা এসে হাজির। সংখ্যাধিক্যের কারণে মনােবল বেড়ে গেল। সিদ্ধান্ত হল রতনপুর ঘাটে তারা পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধই করবে। ১৫ আর ১৬ জনে বিভক্ত হয়ে ৩১ জন মুক্তিযােদ্ধা দু’ভাগ হলাে। ১৫ জনের গ্রুপ রওনা হল রতনপুর ঘাটে। পিছনে থাকল ১৬ জনের কভারিং পার্টি। | কিন্তু পাকবাহিনী ইতােমধ্যেই নদীর পার হয়ে এসে আখক্ষেতের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের খুঁজতে শুরু করেছে। তারপর ইংরেজি U আকারে অ্যামবুশ করে মুক্তিযােদ্ধাদের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু না বুঝে, রেকি না করে মুক্তিযােদ্ধারা এসে ধীরে-ধীরে ঢুকে পড়ে ঐ ইউ (U) এ্যামবুশের মধ্যে। তারপর প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ। তখন আর কিছুই করার নেই। এমনকি পিছিয়ে আসার জন্যও মাত্র একটি পথই মাত্র খােলা। পায়ে হেঁটে নয়, পিছয়ে আসতে হবে বুকে ক্রলিং করে। ডানহাতে গুলিবিদ্ধ হাসান কভারিং ফায়ারের দায়িত্ব নিয়ে অন্যদের পিছিয়ে যাওয়ার সুযােগ করে দেয়।
 
কিন্তু হঠাৎ একটি গুলি এসে কিয়ামুদ্দিনের মাথায় লাগলে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অন্যরা পিছু হটতে থাকলেও অবস্থানগত অসুবিধার কারণে খােকন, কাশেম, রবিউল, তারিক, রওশন ও আফাজউদ্দিন শেষপর্যন্ত একেবারে পাকবাহিনীর নাগালের মধ্যে পড়ে যায়। খুব কাছ থেকে গুলি করে, বেয়ােনেটে খুঁচিয়ে ৮ জন বীর মুক্তিযােদ্ধাকে তারা হত্যা করে। অবশ্য এই সম্মুখযুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনাও হতাহত হয়। ৮ জন শহীদের মধ্যে তাহাজ ও আফাজ মেহেরপুরের কোমরপুরের মানুষ। অন্যরা চুয়াডাঙ্গার। বাগােয়ানের আবু তায়েজ খানের জমিতে এই যুদ্ধ হয়। কিন্তু জনৈক লালর্চাদের গরুগাড়িতে করে ৮ শহীদের লাশ এনে রাখা হয় জগন্নাথপুরে । পরদিন শুক্রবার এলাকাবাসীকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে লাশ প্রদর্শন করে সতর্ক করে দেওয়া হয় মুক্তিযােদ্ধা হলে এই হবে তার পরিণাম। পরদিন শনিবার জগন্নাথপুরের কিতাব হালসানার জমিতে পাশাপাশি দুটি গর্ত খুঁড়ে ৮ শহীদের লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়। মাটি চাপা দেওয়ার কাজে অংশগ্রহণকারী গ্রামবাসীর মধ্যে রমজান আলী, কিতাব আলী, বিশারত মণ্ডল, গােলাম গাদী অন্যতম।
 
আরাে এক শহীদ
১৭ আগস্ট তারিখে বল্লভপুরের চিত্ত মল্লিক নাটুদা ক্যাম্পের কাছে। পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে এবং অমানুষিক নির্যাতনে শহীদ হয়। মআবার মানিকনগরে পাকবাহিনীর হামলা বারংবার মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে আক্রান্ত হয়ে মানিকনগর থেকে ক্যাম্প গুটিয়ে। ফেলার গ্লানি মুছতে পারে না পাকবাহিনী। তাই ২৪ আগস্ট নাটুদা এবং মেহেরপুর থেকে বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরােধ গড়ে তােলে। একজন পাকসেনা নিহত হয়। পাকবাহিনীর মর্টার শেলের আঘাতে মুজিবনগরের মুক্তিযােদ্ধা আয়াতুল্লাহ মল্লিক শহীদ হন।
 
আবারও শহীদ ৭ সেপ্টেম্বর বাগােয়ানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের এক সম্মুখযুদ্ধ। সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে পিরােজপুরের মুক্তিযােদ্ধা আফসার আলী অস্ত্রসহ পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং নির্মম নির্যাতনে শহীদ হন। সােনাপুর-মাঝপাড়ার যুদ্ধ ২০ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে প্রায় ৩০০ পাকসেনা সােনাপুর-মাঝপাড়ায় মুক্তিযােদ্ধা অবস্থানের উপরে আক্রমণ চালায়। এই এলাকা অনেকদিন থেকেই মুক্ত এলাকা বলে গণ্য হয়ে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ পাকসৈন্যের বিশাল বহর এসে চারদিক ঘিরে ধরলে মুক্তিযােদ্ধারা প্রবল গুলিবর্ষণের মাধ্যমে নিজেদের সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়। ৪ জন পাকসৈন্য নিহত এবং অনেকে আহত হয়। আনন্দবাসের আফসার আলী এবং চুয়াডাঙ্গার রবিউল হক নামে দু’জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হয়। পাকসেনাদের পশ্চাদৃপসরণ অক্টোবর থেকেই মুজিবনগর সন্নিহিত গ্রামগুলাে হানাদার মুক্ত হয়ে যায়। পাকসৈন্যরা চলাচল সীমিত করে ফেলে। নাটুদা-মেহেরপুর সড়কের দু’ধারে বাগােয়ান, কেদারগঞ্জ, দারিয়াপুর, মােনাখালী প্রভৃতি স্থানে গেরিলাযােদ্ধারা ওঁৎ পেতে থেকে হামলা চালায় এবং পাকসেনারা নভেম্বর নাগাদ পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ-সম্পর্কে ২৫ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায়।
সংবাদ প্রকাশিত হয় : মুজিবনগর, ২৪ নভেম্বর ॥ কুষ্টিয়া জেলার গুরুত্বপূর্ণ মেহেরপুর শহরটির চারদিকে এখন মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা। পিছু হটে যাওয়ার মুখে পাকসৈন্যরা গােলাবর্ষণ করছে। এ-সময়ে মেহেরপুর জেলায় ছড়িয়ে থাকা ক্যাম্পগুলাে সব গুটিয়ে মেহেরপুরে নিয়ে আসে পাকবাহিনী। মাঝে-মধ্যে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে টহল দিতে বের হলে ও মুজিবনগরের মতাে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে তারা যেতে সাহসী হয় না। এদিকে মুক্তিযােদ্ধারা হয়ে ওঠে বেপরােয়া দুঃসাহসী। দিনে-রাতে যে-কোনাে সময় সুযােগ পেলেই মুক্তিযােদ্ধারা হামলা চালায় পাকসেনাদের উপরে। তাদের চোরাগুপ্তা গুলিবর্ষণ পাকসেনাদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তােলে। ২৫ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর নিক্ষিপ্ত শেলের আঘাতে পৌর এলাকার রিকশাচালক আইনালের স্ত্রী হাওয়া বিবি মারা যায়। ২৬ নভেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয় : মেহেরপুর শহর দখল নিয়ে জোর লড়াই চলছে। প্রকৃতপক্ষে পুরাে মেহেরপুরের দখল পাওয়ার জন্য মুক্তিবাহিনীকে আর বেশিদিন অপেক্ষা করা লাগে নি। ডিসেম্বরের শুরুতে পাকিস্তান। সেনাবাহিনী একেবারেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। মুজিবনগরের পবিত্র মাটিতে আর কখনাে পাকিস্তানি দুবৃত্তের পায়ের ছাপ পড়ে নি। ৬ ডিসেম্বর যখন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত আনুষ্ঠানক স্বীকৃতি দিচ্ছে বাংলাদেশকে, তখন মেহেরপুরের পাকবাহিনী লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে রাতের অন্ধকারে। মূলত ৭ ডিসেম্বর প্রভাতবেলা থেকেই মেহেরপুর জেলা শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। শেষ হয় মুজিবনগর সন্নিহিত মুজিবনগরের মুক্তিযুদ্ধ। 
 

সূত্রঃ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর – রফিকুর রশীদ