You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২১শে আগস্ট, বুধবার, ৪ঠা ভাদ্র, ১৩৮১

প্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্ভাবনা

আর দশটি উপনিবেশায়ন মত পূর্ববাংলা এবং তৎপরবর্তী কালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ যথাযথভাবে কাজে লাগানো হয়নি। বহু সম্পদ অনাবিষ্কৃত থেকে গেছে। আবার কোন কোনটির অনুসন্ধান মিললেও তা সংগ্রহ এবং সদ্ব্যবহারে উপনিবেশিক শাসন কোন প্রকার আগ্রহ দেখায়নি। আমাদের দেশের লুকায়িত সম্পদের সম্ভাবনা নিয়ে উপনিবেশিক আমলে বহু মনীষী-বিজ্ঞানী প্রচুর তথ্য পরিবেশন করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সম্ভাবনা বেড়েছে। প্রচেষ্টাও নেয়া হচ্ছে।
প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং তার সদ্ব্যবহার অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এর জন্য অর্থের প্রয়োজন, প্রয়োজন কারিগরি জ্ঞান। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত অর্থের সংস্থান ছিলনা, ছিলনা কারিগরি দক্ষতা। এই সীমাবদ্ধতার ফলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং সহযোগিতার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।
এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে আমাদের উপকূল অঞ্চলের এলাকায় তৈল সন্ধান এর ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। গত পরশু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী দশ দিনের মধ্যে কয়েকটি বিদেশী তৈল কোম্পানির স্বার্থে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে তৈল অনুসন্ধানের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
বন্যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যখন বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে, হতাশার অন্ধকারে যখন গোটা জাতি প্রায় নিমজ্জিত তখন এমন একটা সংবাদ জনমনে অবশ্যই আশার সঞ্চার করবে। বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে যখন জাতি অবগত হয় যে, এমন দিন খুব বেশি দূরে নয় যখন বিদেশের উপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা তো দূরের কথা বরং অনেক বিদেশি রাষ্ট্রকেই বাংলাদেশের উপর নির্ভর করতে হবে, -তখন তা শত সমস্যা জর্জরিত মানুষের মনেও আশার উদ্রেক করে। মানুষ তখন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে আশ্বস্ত হয়।
পাকিস্তানি শাসনামলে ২৪ বছর ওরা শুধু আমাদের শোষণ করে ক্ষান্ত হয়নি, গোটা অর্থনীতিকে বিদেশের উপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি লগ্নে সেই পরনির্ভরশীল অর্থনীতিটাও তারা ভেঙে চুরে তছনছ করে দিয়েছে। এছাড়া যে সম্পদের হিসাব আগের পাওনা ছিল, যে কোনো বৈধ আচরণবিধিতে যে সম্পদ ফিরিয়ে দিতে তারা বাধ্য ছিল তাও প্রত্যর্পণের ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার গড়িমসি করে চলেছে। এমতাবস্থায় স্বাভাবিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির যেমন বিকৃত হয়েছে তেমনি কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের অর্থনীতি তেমন সবল বলে বিবেচিত হয়নি। আজ যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা নিপতিত হয়েছে এর মোকাবেলা করার মতো যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি আমাদের নেই। দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসনের স্বাভাবিক পরিণতি এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ এবং ধন-সম্পদের সদ্ব্যবহারের অভাবে আজ আমরা চরম দুর্যোগের মুখোমুখি এসে পৌঁছেছি। এ দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার জন্য যেমন একদিকে প্রয়োজন রয়েছে গোটা জাতির ঐক্য বদ্ধ কর্মপ্রচেষ্টা তেমনি বৈদেশিক সাহায্য ও সহযোগিতা। এ দেশের সম্পদ রয়েছে, রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনার বাস্তবায়নে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা নিয়ে এগিয়ে আসলে একদিন আমরা স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে পারব।

উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক ব্যবধান কমাতে হবে

বিশ্ব জনসংখ্যা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন রোমানিয়ার রাজধানীর বুখারেস্টে শুরু হয়েছে। জাতিসংঘ এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে। রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট এই সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছে তাতে একটি আশাব্যঞ্জক চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের অর্থনৈতিক ব্যবধান রয়েছে তা হ্রাস করার আহ্বান জানিয়েছেন। সংবাদে প্রকাশ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কয়েক হাজার বিজ্ঞানী ও সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দ এই সম্মেলনে যোগদান করেছেন। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল নানা আন্তর্জাতিক সমস্যার কারনে ব্যস্ত থাকা সত্বেও সম্মেলনে যোগদান করেছেন। রোমানিয়া প্রেসিডেন্ট মিঃ চৌসিস্কো তার ভাষণে আরো বলেছেন- ‘বিশ্বের সামরিক খাতে যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারিনা।’ যে পরিমাণ অর্থ স্বাস্থ্য সুরক্ষা খাতে ব্যয় হয় তার শতকরা ৫০ ভাগ বেশি ব্যয় করা হয় সামরিক খাতে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার খাতে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয় তার প্রায় অর্ধেকটা সামরিক প্রয়োজনে গবেষণায় ব্যয় করা হয়। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল ডঃ কুর্ট ওয়াল্ডহেইম তার উদ্বোধনী ভাষণে বলেছেন, সম্মেলন চলাকালীন সময়ের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ বেড়ে যাবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ মারাত্মক ব্যবস্থা গোটা বিশ্বের কাছে উদ্বেগজনক ব্যাপার। বিশ্ব জনসংখ্যার রোধ সংক্রান্ত সম্মেলন থেকে একটা সুস্পষ্ট অভিমত পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বিশেষ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা, বিশেষ নিরাপত্তা, শান্তি ও অগ্রগতির জন্যে আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
এই মহাসম্মেলনে রুমানিয়ার প্রেসিডেন্ট উন্নত ও অনুন্নত দেশের মধ্যে বিরাট অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করার জন্য এবং অস্ত্র তৈয়ার খাতে ব্যাপক পরিবর্তনের ব্যাপারে যে দ্বিমত পোষণ করেছেন তা অনুধাবনযোগ্য। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিগত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও অস্ত্র তৈরিতে ব্যয় কমিয়ে মানবকল্যাণে অর্থ ব্যয় করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। যে হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতিবছর অস্ত্র তৈরির জন্য ব্যয় করা হয় তা দিয়ে বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর অসহায় মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্যও ব্যয় করা যেত। কিন্তু বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের তাদের অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নীতি থেকে সরে আসেনি। কয়েক শত কোটির দুঃখী মানুষ আজও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বাঁচবার তাগিদে সংগ্রাম করে চলেছে। অন্যদিকে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা অব্যাহত রয়েছে।
রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট মিঃ চৌসিস্কোর অভিমতের সঙ্গে আমরাও একমত পোষণ করি। আমরা বিশ্বের ধনী দেশগুলো যারা মারণাস্ত্র তৈরীর জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে তাদেরকে আহ্বান জানাবো অস্ত্র তৈরির খাতে টাকা ব্যয় করার নীতি বাদ দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দরিদ্র মানুষের মানবেতর জীবন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য এগিয়ে আসুন। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আজও মানুষ না খেয়ে দিন যাপন করছে। সেখানে বিলাসবহুল অস্ত্র প্রতিযোগিতার স্থান কোথায়? ধনী দেশগুলো যত দ্রুত সাড়া দেবে-বিশ্বের শান্তি ও প্রগতি ততই সুনিশ্চিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!