You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুজিবনগর নিয়ে স্মৃতিচারণ
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরের মুক্তমাটিতে অনুষ্ঠিত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। ঐতিহাসিক এ-অনুষ্ঠান সার্থক হয়েছে যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিক অংশগ্রহণে, তাঁদের মধ্যে কেউ-কেউ পরবর্তীতে সাহসী ও শৌর্যপূর্ণ সেই-দিনের স্মৃতিচারণ করেছেন লিখিতভাবে। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত সেই-সব স্মৃতিচারণমূলক রচনার মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযােগ্য কয়েকটি লেখার প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে ছাপা হল।
স্মৃতিচারণ-১
ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম। কুষ্টিয়া থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তাে বটেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতাসনদের রচয়িতাদেরও অন্যতম তিনি। প্রথম সরকার গঠন এবং মুজিবনগরের সেই সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের নেপথ্যেও তিনি পালন করেন নিষ্ঠাবান সংগঠকের ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম অস্থায়ী সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানান । শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার ডার ছিল আমার ও আবদুল মান্নানের ওপর। ১৬ এপ্রিল আমরা দু’জনে কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দু’জন প্রতিনিধি বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হই। সমস্ত প্রেসক্লাব লােকে-লােকারণ্য। তিলধারণের ঠাঁই নেই। সার্চলাইটের মতাে অসংখ্য চোখ আমাদের দিকে নিবন্ধ। প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি উপস্থিত সাংবাদিকদের ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। 
তাদেরকে প্রথম অনুরােধ জানাই, আমদের উপস্থিতির কথা গােপন রাখতে হবে। এরপর বললাম, আমরা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি বার্তা নিয়ে এসেছি। আপনারা আগামী কাল ১৭ এপ্রিল ভােরে কষ্ট করে এই প্রেসক্লাবে এসে হাজির হবেন। তখন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের একটি বিশেষ বার্তা দেওয়া হবে। সাংবাদিকদের কেউ-কেউ আরাে কিছু প্রশ্ন করতে চাইলেন। কিন্তু আমরা কোনাে উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করলাম। এতে তাঁরা কেউ-কেউ হতাশও হলেন। সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের গাড়ি তৈরি থাকবে বলেও জানালাম। এদিকে আওয়ামী লীগের এম.পি.এ, এম.এন.এ ও নেতাদের রাত বারােটার মধ্যে লর্ড সিনহা রােডে সমবেত হওয়ার জন্য খবর পাঠানাে হয়। বি.এস.এফ-এর চট্টোপাধ্যায়কে অনুরােধ করি, আমাদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে। এর কয়েকটা থাকবে প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের বহন করার জন্য। অবশিষ্ট গাড়িগুলােতে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছানাে হবে। সাইক্লোস্টাইল করা স্বাধীনতা-সনদের কপিগুলাে গুছিয়ে নিলাম। হাতে লেখা কিছু সংশােধনী রয়েছে। কয়েকজনকে এগুলাে সংশােধন করার। জন্য দিই। ১৭ এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। স্বাধীনতাযুদ্ধে। নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রিসভায় শপথগ্রহণের দিন। সারা রাত ঘুম হয় নি। ভােরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, খােন্দকার মােশতাক আহমদ, এম, মনসুর আলী, এ.এইচ.এম, কামরুজ্জামান ও ওসমানী একটি গাড়িতে রওনা হয়ে যান। আমি ও আব্দুল মান্নান ভােরের দিকে পূর্ব-কর্মসূচি অনুযায়ী কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। সেই ভােরেও ক্লাবে লােক ধরে নি, ক্লাবের বাইরেও অনেক লােক।
 
আমি সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে বিনীতভাবে বললাম, আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের জন্য একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। বাংলাদেশ সরকার আজকে স্বাধীন বাংলার মাটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করবে। আপনারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। কেউ জানতে চাইলেন, কিভাবে যাবেন, কোথায় যাবেন। জবাবে আমি বলি, পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে আমি আপনাদের সঙ্গে রয়েছি। আমাদের গাড়িগুলাে তখন প্রেসক্লাবের সামনে। উৎসাহিত সাংবাদিকরা গাড়িতে উঠলেন। তাঁদের অনেকের কাঁধে ক্যামেরা। আমি ও আবদুল মান্নান দুজন দুই গাড়িতে। আমার গাড়িতে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক ছিলেন। পথে তাঁদের সঙ্গে অনেক কথা হল।  
 
শপথ অনুষ্ঠানে নির্ধারিত স্থান আম্রকাননে পৌছুতে ১১টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়ােজন প্রায় শেষ। ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দিন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। আগেই ঠিক করা হয়েছিল যে, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার সনদ পাঠ করবেন। কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হল। একটি ছােট্ট মঞ্চে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ, ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? জবাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। তার সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ রয়েছে। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু বন্দি, কিন্তু আমরা তা বলতে চাই নি। পাকিস্ত নি বাহিনী বলুক- এটাই আমরা চাচ্ছিলাম। কারণ আমরা যদি বলি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি, কিন্তু তারা যদি অস্বীকার করে, তবে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আমবাগানের অনুষ্ঠানে ভরদুপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার-হাজার লােক জমায়েত হন। হাজারাে কষ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/বাংলাদেশ স্বাধীন কর ইত্যাদি শ্লোগান। আমার কাজ ছিল অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের ফেরত পাঠানাে। দুপুরের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে সাংবাদিকদের ফেরত পাঠানাে হয়। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ফেরেন সন্ধ্যায়। কলকাতা ফিরে সাংবাদিকরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের খবর পরিবেশন করেন।
 
স্মৃতিচারণ-২
ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দিন আহমদ ১৯৭১ সালে মাহবুবউদ্দিন আহমদ ছিলেন ঝিনাইদহে এসডিপিও। বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ পুলিশ অফিসার। ২৫ মার্চের পূর্বেই মেহেরপুর, নড়াইল, মাগুরা, গােয়ালন্দের দেশপ্রেমিক বাঙালি এসডিওদের নিয়ে নিজের বাসায় তিনদিনব্যাপী মিটিং করে নিজেদের করণীয় ঠিক করেন। প্রত্যক্ষভাবে প্রতিরােধযুদ্ধে অংশ নিয়ে কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত করেন। যুদ্ধের ময়দানে ক্যাপ্টেন র‌্যাঙ্ক লাভ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধেও তিনি দক্ষতার সঙ্গে সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দিন আহমদ ই.পি.আর ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। সে-দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন : স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে প্রবাসী বাঙালি নেতৃত্বের যে-সব সাহসী। পদক্ষেপ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গতি সঞ্চারিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলেন, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সর্বপ্রথম সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারে আত্মপ্রকাশ ছিল সে-সব পদক্ষেপের অন্যতম। অকুতােভয় বাঙালির অতুলনীয় আকাশচুম্বী আত্মপ্রত্যয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল সে-দিন বৈদ্যনাথতলার ছায়াঘেরা, পাখিডাকা, আলােছায়ার লুকোচুরি খেলায়। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। আমরা তখন কুষ্টিয়া-যশোের ফ্রন্টে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে ঘেরাও করে রেখেছি। ভারত থেকে বড় রকম হাতিয়ার। পাওয়ার আশায় দিন গুনছি। এমনি সময়ে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ভাসা-ভাসা খবর এল, চুয়াডাঙ্গায় নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করবে। কিন্তু ১৪ এপ্রিল যখন পাকিস্তানি বিমান চুয়াডাঙ্গায় বােমার আঘাত হানল, তখন নেতৃবৃন্দ চুয়াডাঙ্গায় অনুষ্ঠান আয়ােজনের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়েন। ১৪ এপ্রিল প্রত্যুষে পাকিস্তানি বাহিনী যশাের-ঝিনাইদহ সড়কের বারােবাজার এলাকায় বড় ধরনের আক্রমণ চালিয়ে আমাদের রক্ষা-ব্যহ তছনছ করে দেয়। ১৬ এপ্রিল ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা হয়ে আমি সদলবলে মেহেরপুরে পৌছুই।
 
ঐদিন গভীর রাতে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে মেহেরপুর শহরে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতিয়ার, গাড়ি আর পাঁচ টনের দুই ট্রাক ভর্তি টাকা ও সােনা নিয়ে উপস্থিত হই। আমাদের সঙ্গে ছিলেন মাগুরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়ার বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে আগত হাজার-হাজার মুক্তিযােদ্ধা, সরকারি কর্মচারী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রসহ মুক্তিপাগল মানুষ। ১৭ এপ্রিল সকালে তৌফিকের কাছ থেকে জানতে পারলাম, বৈদ্যনাথতলায় এক অনুষ্ঠান হবে। আমরা আমাদের মাতৃভূমি স্বাধীন করার জন্য একটা সরকার পাব। তাই সদলবলে সীমান্ত-চৌকিতে পৌছুতে হবে। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা সীমান্ত-চৌকিতে সে মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত এবং আমরা সবাই সে মহাপার্বণে যােগ দেব—এটা মনে হতেই চেতনার অজান্তে আমরা প্রাণ-বিহ্বল। কিন্তু গােপনীয়তা রক্ষার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশিত হয়ে তৌফিক আর আমি মেহেরপুর থেকে কাঁচা, মেঠো, ইট বিছানাে পথ পেরিয়ে সকাল সাড়ে দশটার দিকে ভবেরপাড়া সীমানায় বৈদ্যনাথতলায় এসে পৌছুলাম। মেহেরপুর থেকে ১৮ মাইলের মাথায় এই সীমান্ত-চৌকি। বাংলাদেশের ভূখণ্ড পাহারা দেওয়ার জন্য এ-চৌকিতে অবস্থান করছেন কয়েকজন ই.পি.আর। আম্রকুঞ্জের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন ভারতীয় বাহিনীর কিছু সদস্য। আমার গাড়িতে সঙ্গী কয়েকজন সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধা। তৌফিকের গাড়িতেও আরাে কয়েকজন সহযােদ্ধা। আমি পরেছিলাম কদিন আগে। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নিজ হাতে পরিয়ে দেয়া ই.পি.আর-এর কালাে বেল্ট আর কাঁধে কালাে ধাতব তারা লাল জমিনে খাকি সােন্ডার স্ট্রাপে বসানাে ক্যাপ্টেনের ব্যাজ।। খাকি পােশাক কয়েকদিনের ব্যবহারে মলিন— মাটি, কাদা আর বৃষ্টির জলে ভিজে শুকিয়ে বিধ্বস্ত। পােশাক আর পােশাক নেই। মাথায় সবুজ বেরেট, পায়ে জাংগল বুট, বেল্ট আর বেরেট ছাড়া খাকি পােশাকে অপরিচ্ছন্নতার ছাপ সুস্পষ্ট। আমার সঙ্গী সৈনিকদের অবস্থা আরাে খারাপ।
 
এক পােশাক দীর্ঘ তিন সপ্তাহের ব্যবহারে জীর্ণ। পরনের জামা, প্যান্ট কোথাও কোথাও ছেড়া, জুতা আছে কি নেই, দু’একজনের পায়ে লাল ক্যানভাসের জুতা। কেউবা বুট পায়ে, কিন্তু বুটের ছাল উঠে গেছে। যত্নের ছাপ নেই কোথাও। মাথায় টুপি, কেউ বেরেট, কেউ কিস্তি টুপি, আবার কেউ পুলিশের ব্লু বেরেট পরিহিত। ওদের সবার হাতে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, কিন্তু বুকে অসীম সাহস। এদের হাতেই পুরাে এক ব্যাটালিয়ন খান সেনা মার খেয়ে অক্কা পেয়েছে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহে। এদের তেজোদীপ্ত পদভারে ধরণী কাপে, চোখের হিংস্র ফুলিঙ্গ পাকিস্তানি হানাদারদের মৃত্যুস্বপ্ন। আগের দিন রাতে প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল। ভােরে মাটির ভেজা গন্ধ তখনাে ভরে আছে পথে-প্রান্তরে। আম্রকুঞ্জের ভারী বাতাসকে ফাকি দিয়ে সূর্য উঠেছে। পরিচ্ছন্ন আলাে পৃথিবী ভাসিয়ে দিয়েছে। আকাশে মেঘের সঙ্গে আলাের লুকোচুরি প্রথম বােশেখের সােনালি রােদ আর কালবোেশখির মাতম ক্ষণে-ক্ষণে নিবিড় আম্রকুঞ্জের কানে দুরন্ত বাতাসের শাে-শাে শব্দে উচাটন জাগিয়ে বৈদ্যনাথতলায় জড়াে হওয়া মানুষগুলােকে আনন্দের কুহুতানে ভরে রেখেছে। হাজার-হাজার মানুষ। কোনাে আগমনী সঙ্গীতের আশায় বিহ্বল। হঠাৎ করে জনতার পদভারে জেগে ওঠা। বসতিবিহীন ভূখণ্ড। মুহুর্মুহু জয়বাংলা স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত। ভারত সীমান্তের কাছাকাছি পায়েচলা পথের বড়জোড় এক শ’ গজের ভিতর চৌকি পাতা মঞ্চ, উপরে একখানা টুল, ক’খানা চেয়ার পাতা। সভামঞ্চে বসার স্থান। মঞ্চের সামনে বাঁশের মাথায় টাঙানাে মাঝারি সাইজের স্বাধীন বাংলার হলুদ মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ পতাকা। কখনাে বাতাসে আন্দোলিত, কখনাে-বা শান্ত সমাহিত। হঠাৎ করেই ভেঁস করে হর্ন বাজিয়ে অনেকগুলাে অ্যাম্বাসেডর গাড়ি সীমান্তের ওপার থেকে মেঠো পথ ধরে এগিয়ে এল। ঝাঁকে-ঝাঁকে মানুষ নেমে এলেন। সাংবাদিক, আওয়ামী নেতৃবৃন্দ, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, জনতা ও মুক্তিযােদ্ধা। আমার চেনা-জানাদের মধ্যে তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম, মনসুর আলী, এ.এইচ.এম, কামরুজ্জামান, ইউসুফ আলী আর একজন ছােটখাটো একটা মানুষ। তিনি এসেই তৃরিত বি.ও.পিতে ঢুকে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলেন ফিটফাট খাকি পােশাক পরে কে যেন পরিচয় করিয়ে দিল, কর্নেল এম.এ ওসমানী, সিলেটের নির্বাচিত প্রতিনিধি। এলেন পাবনার ডি.সি, নূরুল কাদের খান, ব্যারিস্টার আমীর-উলইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ আরাে অনেক চেনা-অচেনা লােক। সবার মধ্যে একটা হৈ-চৈ ভাব।
 
কেবলমাত্র সৌম্যশান্ত গম্ভীর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভাবলেশহীন গম্ভীর তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, আবদুল মান্নান। সবাই সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিধান করে এসেছেন। কেবল মােশতাক ফিটফাট মুজিব কোট আর কিস্তি টুপি পরা। অনেক সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার, মুভি ক্যামেরাম্যান ছােটাছুটি করছেন। তৌফিকও বেশ ব্যস্ত। সবাইকে তাগাদা দিচ্ছে এটা-ওটা করার জন্য। সব মিলিয়ে একটা ব্যস্ততা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। আমি এদিক-সেদিক ছােটাছুটি করছিলাম। ভারতীয় কমান্ডােবাহিনীর একজনের সঙ্গে একটু আলাপ পরিচয় হল। একজন বিদেশী সাংবাদিক এক-পা, এক-পা হেঁটে মেপে দেখছিলেন অনুষ্ঠানের মঞ্চটা (যে-মঞ্চে দাঁড়িয়ে অস্থায়ী সরকার শপথ নেবে) সীমান্ত থেকে কত দূরে। মঞ্চস্থল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের একটা ছােট এনক্লেভের মধ্যে। পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান চেষ্টা করলেও ভারতীয় আকাশসীমা লঙ্ঘন না করে এখানে বােমা ফেলতে পারবে না। তৌফিক সবাইকে অভ্যর্থনা জানাতে ব্যস্ত। এক ফাকে আমাকে ডেকে বলল, ওসমান ভাইকে (মেজর আবু ওসমান চৌধুরী) বলেছিলাম সদলবলে আসতে। এখনাে এলেন না, সময় বেশি নেই। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী তাঁর কন্টিনজেন্ট নিয়ে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গার্ড অব অনার দেওয়ার কথা। তিনি না এলে তাে এঁরা বসে থাকবেন না, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। গার্ড অব অনার না দিতে পারলে এ-অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে বলল, তুই তাে পুলিশে এ-সব ট্রেনিং নিয়েছিলি। তুইই না-হয় গার্ড অব অনার দেওয়ার ব্যবস্থা কর। আমি বললাম, আমার সঙ্গে যে সৈনিকরা আছে, তাদের দিয়ে গার্ড অব অনার দেব। তুই কিছু ভাবিস না, আমি পাঁচ মিনিটেই তৈরি হয়ে আসছি। আমি আমার সঙ্গী সৈনিক আর উপস্থিত ক’জন আনসারকে ডেকে একত্রিত করে ফল-ইন-করলাম, কয়েকবার অ্যাটেনশন, স্ট্যান্ড অ্যাট ইজ করালাম। বার কয়েক সেলিডার আর্মস, প্রেজেন্ট আমস করালাম। সবাইকে যুৎসইভাবে তৈরি করে ফল-ইন অবস্থায় দাঁড় করিয়ে সালাম দেওয়ার জন্য তৈরি হলাম। বাঁশের মাথায় উড়ন্ত পতাকা নামিয়ে মাটি থেকে দুই-তিন ফুট উপর বাঁশের গায়ে বেঁধে রাখলাম। সারদা পুলিশ একাডেমিতে হাতিয়ার চালনার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। পাসিং আউটের সময়ে গার্ড অব অনারে শরিক হয়েছলাম। তারপর আর কাউকে গার্ড অব অনার দেয়ার প্রয়ােজন হয় নি।
 
ঝিনাইদহের এস.এ.ডি.পি.ও হিসেবে প্রতি সপ্তাহে পুলিশের গার্ড পরিদর্শন করতাম। আজই প্রথম গার্ড অব অনার দেওয়ার সুযােগ এল আমার নেতৃত্বে। নিজের অজান্তে কত বড় একটা কাজের সঙ্গী হয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম, তা বুঝতেও পারলাম না। উৎসাহ, উদ্দীপনা আর তারুণ্যের আতিশয্যে টালমাটাল প্রাণশক্তি অস্তি ত্বের পরতে-পরতে তখন চিৎকার করে বলছে, স্বাধীনতা! স্বাধীনতা!! স্বাধীনতা!!! এরই মধ্যে সৌম্যশান্ত ধীর পদক্ষেপে অস্থায়ী সরকারের নেতৃবৃন্দ অকিঞ্চিৎকর এক চৌকিপাতা মঞ্চে উঠলেন। সবাই দাঁড়ালেন স্থির হয়ে আমাদের সামনে মঞ্চের ওপরে। তারা মঞ্চে উঠতেই আমার পিছনে আড়াআড়ি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানাে দুই সারি আনসার, পুলিশ, ই.পি.আর, সদস্যদের নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি হওয়া জোয়ানদের কমান্ড করলাম, অ্যাটেনশন। পরবর্তী নির্দেশ  সােল্ডার আর্মস। তারপর কণ্ঠস্বর উচ্চকিত করে কণ্ঠের সকল পেশী বিদীর্ণ করে কমান্ড দিলাম, প্রেজেন্ট আর্মস। সবাই রাইফেলগুলাে বুকের ছয় ইঞ্চি সামনের আকাশের দিকে নল তুলে সামরিক কায়দায় অভিবাদন করে ঋজু ও অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমার ডান হাত উঠে এল স্যালুটের ভঙ্গিতে মাথার ডান পাশে। জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে উঠলেন একদল তরুণ। ধীরে-ধীরে আমার হৃদয়ে প্রােথিত স্বাধীন দেশের পতাকা উড্ডীয়মান হল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঊর্ধ্বমুখে পতাকার দিকে স্থির চোখে পতাকা উত্তোলন করছেন। চোখের আলােয় পরাধীনতার তমসা হরণের বিম্বিত জ্যোতি। গান গাইছেন শিল্পীরা। তাদের সঙ্গে গাইছেন অজুত জনতা—আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালবাসি। আমার অবয়বের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে তখন শিহরণ, দেহের ধমনীতে প্রবহমান প্রতিটি লােহিত কণিকার রন্ধ্রে শিহরিত কণ্টক স্পর্শ, আমার চোখ সামনে স্থির; হৃদয়ে নিঃশব্দ এক শ্লোগান জয়বাংলা। পতাকা উড্ডয়ন শেষ হল— আমার কষ্ঠ সর্বশক্তি দিয়ে হেঁকে উঠল, সােলডার আর্মস। ঝটঝট শব্দ তুলে রাইফেলগুলাে একত্রে নেমে এল। সৈনিকদের কাঁধে। আমর হাত নেমে এল। আমি এগিয়ে গেলাম দু’পা। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে আবার স্যালুট দিয়ে চিৎকার করে বললাম, গার্ড রেডি ফর ইন্সপেকশন স্যার। রাষ্ট্রপতি মঞ্চ থেকে নেমে এলেন, তিনি আমার বামপাশে। ধীরে-ধীরে পরিদর্শন করলেন। কাধে রাইফেলধারী জওয়ানেরা পাথরের মতাে দাঁড়িয়ে। পিছনে কর্নেল ওসমানী। শেষে পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলেন মঞ্চের দিকে। মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন আমার সামনে। আমি আবার সালাম দিয়ে জানালাম, গার্ড রেডি ফর মার্চপাস্ট স্যার। উনি মার্চপাস্টের সম্মতি দিলেন।
 
আমি সৈনিকদের সামনে এসে দাঁড়ালাম। হুকুম দিলাম রাইট টার্ন, কুইক মার্চ। গার্ডদল মার্চ করে মঞ্চের ডান দিকে চলে এল। হুম দিলাম, ডিসমিস। সবাই সুবিধামতাে স্থান ত্যাগ করে জনতার সাথে মিলে গেল। গার্ড অব অনারের পর শুরু হল কুরআন, বাইবেল, গীতা ও ত্রিপিটক পাঠ। অধ্যাপক ইউসুফ আলী সাহেব মঞ্চে উপস্থিত সবাইকে শপথবাক্য পাঠ করালেন। তিনি পাঠ করলেন স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র। ঘােষণাপত্র পাঠের সময়ে জনতা করতালিতে দশদিক মাতােয়ারা করে তুলল। রু হল বক্তৃতার পালা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইংরেজি ভাষায় কঠোর হুঁশিয়ার দিলেন পাকিস্তানি জান্তা ইয়াহিয়াকে দৃপ্ত অথচ রাগান্বিত কণ্ঠস্বরে পরিচ্ছন্ন বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে বক্তৃতা করলেন তিনি। পৃথিবীর বিবেকবান জনগােষ্ঠীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে বললেন, এই যুদ্ধে আমরা পাকিস্তানি হানাদারদের হটাব, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ পরিচ্ছন্ন সাবলীল ভাষায় বাংলায় বক্তৃতা ও প্রেস কনফারেন্স করলেন বক্তৃতায় বললেন, পূর্ব-পাকিস্তানের কবর হয়েছে লাখাে বাঙালির মৃতদেহের স্তুপে। বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা আজ বাস্তবতা। তিনি পাকিস্তানসহ পৃথিবীর সব শক্তিকে বাস্তবতা মেনে নিতে আহ্বান জানান। ঘন-ঘন করতালির মধ্যে তাঁর বক্তৃতা শেষ হল। দিগ্বিদিক কাপিয়ে শ্লোগান উঠল জয়বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু! সে-দিনই প্রথম আমার মনে হল, আমি বিরাট গৌরবােজ্জ্বল এক অধ্যায়ের গৌরবদীপ্ত খেলােয়াড়। আনন্দে সে-দিন বুকের ছাতি কয়েক ইঞ্চি ফুলে উঠেছিল! ১৭৫৭ সালে পলাশীর আমবাগানে সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি দু শ বছর পরাধীনতার বিগঢ়ে আবদ্ধ হয়েছিল। ঠিক দু শ’ তের বছর নয় মাসের মাথায় সেই আমবাগানের মাত্র পঞ্চাশ মাইল পূর্ব-দক্ষিণে আরেক আমবাগানে আমরা স্বাধীনতার সূর্যকে জাগরুক করলাম। সে জাগরণের ক্ষণে নবােদিত সূর্যকে যারা প্রথম দেখেছিলেন, আমিও তাদের একজন-এ শ্লাঘা চিরকাল আমৃত্যু আমাকে, আমার বংশধরদের গৌরবদীপ্ত করবে।
 
স্মৃতিচারণ-৩
ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী

মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী। চৌধুরী শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি সম্পর্কে বলেন : এই সময় আমরা তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উলইসলামের সঙ্গে যােগাযােগ অব্যাহত রাখি। আমরা আশা করছিলাম যে, অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং ঘােষণা করা হবে। এই সময় আমাদের মুক্তাঞ্চলে প্রতিদিন অনেক বিদেশী সাংবাদিক ও টেলিভিশনের প্রতিনিধি এসে ঘুরে-ফিরে দেখছিলেন। প্রতিকূল অবস্থার ভিতরেও আমরা যে শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে প্রতিরক্ষা করছিলাম তা নয়, আমরা এ-রকম একটা সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযান চালিয়ে জয়ীও হয়েছিলাম। আমাদের এই সামরিক বিজয়, জনগণের উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা ও দৃঢ় সংকল্প সাংবাদিকদেরকে বিমােহিত করেছিল। আমরা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দিকে মেহেরপুরের কোনাে এক স্থানে বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণের প্রস্তাবের কথা শুনতে পারি। আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য সেনাবাহিনী আমাদের প্রতিরক্ষা করতে লাগলাম। এই সময় যশােরের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে এগিয়ে আসছে। ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে আমরা পশ্চাদূপসরণ শুরু করি। ওদের সৈন্যসংখ্যা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের রণকৌশলগত পশ্চাদপসরণ ছিল প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধে অনিবার্য পতনের সূচনামাত্র। এমন এক সঙ্কটজনক দিনে আমি খবর পেলাম, বাংলাদেশ সরকার ১৬ কিংবা ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণ করবেন। তার আগেই আমি প্রাথমিক ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করে ফেলেছিলাম। তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে আমাদের স্থান নির্ধারণের কাজ করতে হয়েছে—১. শহর থেকে দূরত্ব বজায় রাখা, ২, ভারতীয় এলাকা থেকে বিদেশী সাংবাদিকরা যাতে সহজে আসতে পারেন এবং ৩. শত্রুর সম্ভাব্য বিমান আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ছদ্মাবরণের ব্যবস্থা করা। ১৬ এপ্রিল মাহবুব ও আমি চূড়ান্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানের দিকে যাত্রা করি। তখন ছিল অত্যন্ত সঙ্কটজনক সময়। আমরা আমাদের বাহিনীর পশ্চাদৃপসরণের খবর পাচ্ছি। অগ্রবর্তী এলাকার সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমাদের সেনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দলে পরিণত হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। মেজর ওসমান তখন আমাদের বাহিনীর প্রধান। তিনি তাঁর বাহিনী মেহেরপুরে সরিয়ে এনেছেন। মেজর ওসমান ভীষণ ব্যস্ত ও চিন্তিত। পাকিস্তানি বাহিনী একের-পর-এক আমাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেদ করে এগিয়ে আসছে। আমরা তখনাে জানতাম না আর কতদিন মাতৃভূমির বুকে আমাদের শেষ ঘাঁটি টিকিয়ে রাখতে পারব। ১৭ এপ্রিল সকালেই আমি আর মাহবুব বৈদ্যনাথতলায় ছুটলাম। বাঁশ 

 
 
দিয়ে ঘেরা একটা সাধারণ মঞ্চ তৈরি হচ্ছে। এলাকাটি সীমান্তঘেঁষা বলে আমরা ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ৭৬ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল চক্রবর্তীর সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে কাজ করছিলাম। অনাড়ম্বর আয়ােজন সম্পন্ন হল। তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে পৌছলেন। আমি তাদের নিয়ে এলাম বৈদ্যনাথতলায়। ওখানে আশেপাশের গ্রাম থেকে কিছু চেয়ার সংগ্রহ করে আনা হয়েছে। সংগৃহীত চেয়ারের মধ্যে কোনােটার একটা হাতল নেই, কোনােটার একটা পায়া খােয়া। মাহবুব আর আমি দ্রুত একটা অনুষ্ঠানসূচি প্রণয়ন করে ফেললাম। আমরা নেতৃবৃন্দকে গার্ড অব অনার দেওয়ার মতাে মাত্র কয়েক প্লাটুন ই.পি.আর, ও মুজাহিদ মােতায়েন করি। মাহবুব তাঁদের নিয়ে গার্ড অব অনার দেওয়ার মহড়া শুরু করল। আমি তখন কর্নেল ওসমানী ও অন্যদের সঙ্গে কয়েকটি সমস্যা নিয়ে আলােচনা করছিলাম। হাজার দু’য়েক লােক জমায়েত হয়েছে অনুষ্ঠানে। তার মধ্যে অন্তত শতাধিক বিদেশী সাংবাদিক, আলােকচিত্রীও টিভি ক্যামেরাম্যান। নীরব আম্রকুঞ্জ। সমবেত গ্রামের মানুষের কখনােই এমন অনুষ্ঠান দেখার সুযােগ হয় নি, আর কোনােদিন হবেও না। গ্রামের মানুষের দৃষ্টির ভাষা আমি বুঝতে পেরেছি—তাঁরা বিস্ময়াবিষ্ট। বেলা ১১টা নাগাদ বহু প্রতীক্ষিত অনুষ্ঠান শুরু হল। আমি জিপে করে তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল এম.এ.জি, ওসমানী ও অন্যান্য কয়েকজনকে মঞ্চের ৫০ গজের মধ্যে তােরণের কাছে নিয়ে এলাম। মাহবুব গার্ড অব অনারের নেতৃত্ব দিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অভিবাদন গ্রহণ করলেন। পিছনে জেনারেল ওসমানী দাড়িয়ে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম যখন পতাকা উত্তোলন করছিলেন, তখন সাংবাদিকরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটা ছােট দল ‘আমার সােনার বাংলা’ গান গাইল। একটা রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন প্রত্যক্ষ করলাম। এমন জন্মের কাহিনী ইতিহাসে পড়েছি, কিন্তু বিশ্বাস হয় না চোখের সামনে একটি রাষ্ট্রের প্রাণস্পন্দিত হচ্ছে! গার্ড অব অনারের পর মন্ত্রিসভার সদস্যরা মঞ্চে উঠলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষণা দিলেন। তারপর এক-এক করে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠান শেষে একে-একে সবাই রওনা হলেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ তার সহযােদ্ধাদের কাছে চলে গেলেন। মাহবুব আর আমি চললাম আমাদের কর্মক্ষেত্রে। পথে আমরা উপলব্ধি করলাম, একটি রাষ্ট্র আজ জন্ম নিল বটে, কিন্তু এই শিশুরাষ্ট্রকে বিশ্বসভায় আসন গ্রহণের জন্য অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এই পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য আরাে রক্তমূল্য দিতে হবে। আমাদের কাহিনী রক্তাক্ষরে লিখতে হবে। আমার মনে হল, সদ্যোজাত জাতি বড় হবে সে-দিন, যে-দিন বিশ্বসভায় মর্যাদার আসন পাবে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত কি আমরা আদৌ বেঁচে থাকব?
 
স্মৃতিচারণ-৪ মেজর আবু ওসমান চৌধুরী
 
চুয়াডাঙ্গাস্থ ইপিআর ৪র্থ উইং-এর প্রথম বাঙালি অধিনায়ক ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলােতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপরে বর্বরােচিত আক্রমণ চালালে ২৬ মার্চ নিজের অধীন বাঙালি ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য ত্যাগ করেন। এবং বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। চুয়াডাঙ্গাকে সদর দপ্তর করে গড়ে তােলেন দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন। তারই সফল নেতৃত্বে পরিচালিত হয় কুষ্টিয়া পুনর্দখলের যুদ্ধ। এ-যুদ্ধে সম্পূর্ণ পর্যদুস্ত হয় পাকিস্তান বাহিনী। সাহসী অধিনায়ক এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে প্রতিরক্ষা-বলয় গােয়ালন্দ থেকে যশাের বারােবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। এবং পাকহানাদারের কবলমুক্ত রাখতে সক্ষম হন। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ আকাশপথে ও নৌ-পথে শক্তি বৃদ্ধি ঘটানাের পর পাকবাহিনী প্রবল আক্রমণ রচনা করলে সংকুচিত করতে হয় প্রতিরক্ষাব্যুহ, এমনকি ১৬ এপ্রিল এ-রণাঙ্গনের সদরদপ্তরও মেহেরপুরে স্থানান্তর করতে বাধ্য হন। অতঃপর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে নতুন সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যােগ দেন, একটু বিলম্বে। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী যুদ্ধকালে ৮নং সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী বীরত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। 
 
 
মুজিবনগর দিবসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অধিনায়ক আবু ওসমান চৌধুরী বলেন : পঁচিশে মার্চের কালরাতের ভয়াবহ সেই হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়েই শুরু হয় বাঙালি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ অধ্যায়—সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। তকালীন কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা মহকুমা সদরে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (বর্তমান বি.ডি.আর) বাহিনীর ৪র্থ উইং-এর অধিনায়ক হিসেবে আমি আমার বাহিনী ও ছাত্র-জনতা সহকারে পদ্মার পশ্চিমের বিস্তীর্ণ এলাকাকে দক্ষিণ-পশ্চিমে রণাঙ্গন (পরবর্তীকালে ৮ ও ৯নং সেক্টর) নামকরণ করে পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করি। ভয়াবহ যুদ্ধের মাধ্যমে আমি দীর্ঘ চার সপ্তাহ কুষ্টিয়া জেলা (সদর ব্যতীত) শত্রুমুক্ত রাখতে সক্ষম হই, যার পরিপ্রেক্ষিতে আমার কর্মস্থল চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ১০ এপ্রিল গঠিত স্বাধীন বাংলা মন্ত্রিপরিষদকে চুয়াডাঙ্গায় শপথগ্রহণ করানাে হবে বলেও প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ১৪ এপ্রিল থেকে যুদ্ধপরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনের ফলে শপথগ্রহণের স্থান চুয়াডাঙ্গার পরিবর্তে আমার ই.পি.আর, উইং-এর অধীন মেহেরপুরের। সীমান্ত এলাকার বৈদ্যনাথতলাকে মনােনীত করা হয়। বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধের যে-সশস্ত্র অধ্যায়, বিশ্বের দরবারে সে-যুদ্ধের বৈধতা প্রমাণ করে সমর্থন লাভ ও একটা রাষ্ট্রীয় কাঠামােতে বিভিন্ন দেশ কর্তৃক সাহায্য-সহযােগিতাকে আইনসিদ্ধ করার অপরিহার্য কারণেই নবগঠিত অস্থায়ী সরকার ১৭ এপ্রিল বাংলার মুক্তভূমিতে মন্ত্রিপরিষদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমান মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে অনুষ্ঠিত এই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠসহ পুরাে অনুষ্ঠানের আলােকচিত্র, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ সারা বিশ্বে আলােড়ন সৃষ্টি করে, যা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি বিশ্ববাসীর সমর্থন অর্জনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিল।
 
সেদিন থেকেই মন্ত্রিপরিষদের ঘােষণা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামানুসারে অখ্যাত গ্রাম বৈদ্যনাথতলার নতুন নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। পুরাে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিশ্বের দরবারে সেই মুজিবনগর যুদ্ধরত বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে পরিচিত হয়। ভারত সরকারের একান্ত সহযােগিতা ও ব্যবস্থাপনায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই বিশ্বের ৩৯টি দেশের শতাধিক সাংবাদিকের উপস্থিতিতে এই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল। তখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বাংলার মাটিতে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশের গুরুত্ব ছিল সময়ােচিত। অন্যথায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের স্বপক্ষে স্বীকৃতি ও সমর্থন লাভে অনেক বিলম্ব হত। ১৭ এপ্রিল নির্দিষ্ট সময়ের আগেই মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ এসে পৌছলেও আমি পৌছতে পারি নি। ঝিনাইদহের এস.ডি.পি.ও. ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দিন উপস্থিত কয়েকজনকে ক্ষিপ্রগতিতে একত্রিত করে মন্ত্রিপরিষদকে সালাম প্রদান করেন। পরে আমি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করি। ই.পি.আর.-এর ৩৪ জন সদস্য এই গার্ড অব অনারে অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার প্রেক্ষিতে ও যৌক্তিকতা এত বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়, যার তুলনা করা চলে শুধু আমেরিকার স্বাধীনতার ঘােষণার সঙ্গে। তারপর দেশী ও বিদেশী। শতাধিক সাংবাদিকের উপস্থিতিতে এবং বিপুল জনসমাবেশে নবজাত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদের নাম ঘােষণা করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানীকে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান সেনাপতি মনােনীত করা হয়। এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে সারা বাংলাদেশের নারী জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন আমার স্ত্রী বেগম নাজিয়া ওসমান, আমার দুই মেয়ে চম্পা ও কলি এবং কুষ্টিয়া-যুদ্ধের বীরসেনানী ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর মা ও বােন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে মন্ত্রিপরিষদ ও নিমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়ন করা সম্ভব হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী বাড়িঘর থেকে পুরনাে আসবাবপত্র ধার করে এনে অত্যন্ত সাদামাটাভাবে এ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। ঐতিহাসিক মুজিবনগর, মুক্তিযুদ্ধের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৭ এপ্রিল একটি স্বর্ণোজ্জ্বল দিবস।
 
স্মৃতিচারণ-৫ এম. নূরুল কাদের
 
১৯৭১ সালে এম, নূরুল কাদের ছিলেন পাবনার জেলা প্রশাসক, বাঙালি জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত বীরযােদ্ধা। যুদ্ধ করেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আগ্রাসন থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পাবনাকে মুক্ত রেখেছিলেন। ৮ এপ্রিল ঈশ্বরদী থেকে চালভর্তি ৩০টি রেলওয়ে ওয়াগনসহ ট্রেন নিয়ে চলে আসেন চুয়াডাঙ্গা, যােগ দেন দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে। যুক্ত হন মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। প্রবাসী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষার মাধ্যমে মুজিবনগরে প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের নেপথ্যে তিনিও বিরাট ভূমিকা পালন করেন। | ১৭ এপ্রিল নবগঠিত সরকারের শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে নবউদ্যমে নানামুখী কর্মকাণ্ড শুরু হলে এম, নূরুল কাদের গ্রহণ করেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব। তাঁর নিষ্ঠাপূর্ণ দায়িত্ব পালনের ফলে সরকারের সার্বিক কর্মকাণ্ডেও বিশেষ গতি সঞ্চারিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের সংস্থাপন সচিব এম. নূরুল কাদের মুজিবনগরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান । ১৯৭১ সালে আমি ছিলাম পাবনার জেলা প্রশাসক। সেখান থেকেই আমি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে তুলি কিন্তু হানাদার বাহিনী বিকল্প পথে পাবনায় ঢুকে পড়ায় ৮ এপ্রিল দুপুরে আমরা ট্রেনভর্তি রসদ ও রণসামগ্রী নিয়ে চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা হই। চুয়াডাঙ্গায় তখন যে-কোনাে মুহূর্তে হানাদার বাহিনীর আক্রমণ আশঙ্কা করা হচ্ছিল। চুয়াডাঙ্গার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ডা, আসহাব-উল হক, ই.পি.আর.-এর মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেহেরপুরের এস.ডি.ও. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও ঝিনাইদহের এস.ডি.পি.ও. মাহবুব উদ্দিন আহমদ প্রমুখ তখন প্রতিরােধ গড়ে তােলা নিয়ে ব্যস্ত। ইতােমধ্যে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও মাহবুবউদ্দিন আহমদ ২৯ মার্চ জীবনগর সীমান্তপথে তাজউদ্দিন আহমদ ও আমীর-উলইসলামকে সীমান্ত পার করে দেন। ভারত সরকারের পক্ষে ঐ এলাকার বি,এস,এফ-এর অধিনায়ক কর্নেল এইচ.আর, চক্রবর্তী তাঁদের স্বাগত জানান। পরদিন তাদের অবস্থান ও তাদের সঙ্গে যােগাযােগসূত্রের সন্ধানে সকালে আমি এবং তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর জিপে করে সীমান্ত এলাকায় যাই। আমরা চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানার চেংখালী সীমান্তে কাঁটাতারের এপাশ থেকে ওপরের লােকদের সঙ্গে কথা বলি। তাঁরা আমাদেরকে তাঁদের আউট পােস্টে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালে আমরা কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করে সেখানে যাই।। কর্নেল এইচ.আর. চক্রবর্তী আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে চা-বিস্কিট দিয়ে আপ্যায়ন করেন।
 
তিনি অত্যন্ত প্রশংসামূলক সমবেদনার সঙ্গে বাংলাদেশের ভিতরের বিভিন্ন রণাঙ্গনের খবরা-খবর জানতে চান। আমরা মােটামুটিভাবে এ-দিককার অবস্থা সম্বন্ধে তাঁকে অবগত করে আমাদের নেতৃবৃন্দের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি সরাসরি আমাদের প্রশ্নের উত্তর না-দিলেও আভাস-ইঙ্গিতে আমরা নিশ্চিত হলাম যে, আমাদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের কেউ-কেউ কলকাতাতেই অবস্থান করছেন। আমাদেরকে তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগ করিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে বিশেষভাবে অনুরােধ করলাম। এমন সময় দূরে ধুলা উড়িয়ে একটা জিপ আসতে দেখা গেল। বি.ও.পি.’র লােকজন সেটা কৃষ্ণনগরের ডি.সি.’র জিপ বলে শনাক্ত করলেন। তখন কর্নেল চক্রবর্তী তাড়াতাড়ি আমাদের বি.ও.পি, ছেড়ে চলে যেতে বললেন। তাতে করে মনে হল আমাদের সম্পর্কে তখন পর্যন্ত ভারত সরকারের নীতি নির্ধারিত হয় নি কিংবা মাঠপর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে কোনাে নির্দেশ পৌছে নি। এ-দিকে ঝিনাইদহ থেকে খবর এসেছে, হানাদারবাহিনী দ্রুত চুয়াডাঙ্গার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাই প্রতিরােধব্যবস্থা আরাে জোরদার করা হল। কলকাতা থেকে আমাদের নেতাদের টেলিফোনের আশায় চুয়াডাঙ্গার সার্কিট হাউসে সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষায় থাকলাম। রাত এগারােটায় টেলিফোন এল। আমি আমার পরিচয় দিয়ে কার সঙ্গে কথা বলছি জানতে চাইলে তাজউদ্দিন আহমদ নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, পাবনায় প্রতিরােধে আপনার ভূমিকার জন্য অভিনন্দন জানাই। তারপর বললেন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিচ্ছিন্নভাবে কে কোথায় কী অবস্থায় আছেন সঠিক জানা নেই। তাছাড়া পার্টির সিদ্ধান্তে রও প্রশ্ন রয়েছে। এমতাবস্থায় সরকার ঘােষণার ব্যাপারে নিশ্চিত কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমি বললাম, পাবনায় হানাদারবাহিনীর চাপে আমরা চুয়াডাঙ্গায় এসেছি। আমরা চতুর্দিক থেকে পরিবেষ্টিত অবস্থায় আছি। ঝিনাইদহ, মাগুরার দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনী দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা যে-কোনাে মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারে। আমাদের সঙ্গে ইউনিফর্ম পরিহিত ই.পি.আর., পুলিশ, আনসার, মুজাহিদসহ মুক্তিবাহিনীর কয়েক শ’ যােদ্ধা রয়েছে। আমরা মেহেরপুরে পশ্চাদ্‌পসরণ করার চিন্তা করছি।
 
সেখানে গিয়েও যে আমরা আক্রমণ থেকে রেহাই পাব, তার কোনাে নিশ্চয়তা নেই। চেংখালী বি.ও.পি.-তে আলােচনার অভিজ্ঞতায় আমরা পশ্চাদ্‌পসরণ করে ভারতে আশ্রয় পাব, তেমন কোনাে ইঙ্গিতও পাই নি। অপরদিকে, পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে ইউনিফর্ম পরিহিতরা নিশ্চিত কোর্টমার্শালের সম্মুখীন হবেন। কিন্তু সরকার-ঘােষিত হলে অন্তত যুদ্ধবন্দির মর্যাদা লাভের সুযোেগ থাকবে। সুতরাং আপনার অবিলম্বে সরকার গঠনের ঘােষণা দিন। তাজউদ্দিন আহমদ যথাসাধ্য চেষ্টার আশ্বাস দিলেন। ১১ এপ্রিল সকালে আমি লােকমুখে জানতে পারলাম, গত রাতে কেউকেউ রেডিওতে সরকার গঠনের ঘােষণা শুনছেন। এ-নিয়ে শহরে একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী মাইকযােগে বাংলাদেশ সরকার গঠনের বার্তা প্রচারের ব্যবস্থা করেন। টেলিফোনে ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, ভেড়ামারা প্রভৃতি স্থানেও প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। সরকার গঠনের ঘােষণার সঙ্গে-সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এলাকার সমস্ত ব্যাংকে একটি নির্দেশ পাঠানাে হয়। তাতে বলা হয় : বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ায় অত্র এলাকার সকল ব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের আওতাধীন হয়েছে এবং শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কায় ব্যাংক কর্মকর্তাদেরকে আদেশ দেওয়া যাচ্ছে যে, তারা যেন নিজ-নিজ ব্যাংকের নগদ টাকা স্বল্পসময়ের নােটিশে স্থানান্তরের জন্য চলমান হওয়ার প্রস্তুতি নেন। ১১ এপ্রিল রাতে মেহেরপুর এস.ডি.ও’র অফিসে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়। ১২ তারিখ সকালে চুয়াডাঙ্গার কন্ট্রোলরুমে খবর এল যে, দুজন আর্মি অফিসার ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এঁরা হলেন ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান (পরবর্তীতে লে. জেনারেল ও সেনাবাহিনীপ্রধান) ও অন্যজন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন। দুজনেই ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের বড় ভাই মেহেরপুরের ম্যাজিস্ট্রেট মতিউর রহমানের বাসায় অবস্থান করছিলেন। তারা সেই মুহূর্ত থেকে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। ১২ তারিখে ডাকবাংলাের চৌকিদার কন্ট্রোলরুমে এসে জানাল, একটা ইন্ডিয়ান জিপে করে ডাকবাংলােয় দু’জন লােক এসেছেন। তৌফিক-ইএলাহী তখন অফিসে ছিলেন না, আমি গেলাম। যদিও তাঁরা সাদা পােশাকে ছিলেন, তবু চিনতে অসুবিধা হল না। পরিচয় পর্বে জানতে পারলাম, তারা বি.এস.এফ.-এর কর্মকর্তা। যতদূর স্মরণে আসে, একজন ছিলেন রুস্তমজী, অপরজন গােলােক মজুমদার। তাঁরা প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের, বিশেষ করে কুষ্টিয়াচুয়াডাঙ্গা এলাকা সম্পর্কে জানতে চাইলেন এবং আমাদের মনােবল যাচাই করলেন।
 
১৬ তারিখে আমরা জানতে পারলাম, পরদিন বৈদ্যনাথতলায় অস্থায়ী মন্ত্রিপরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করবেন। পরে জানতে পেরেছিলাম, এই অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েই বি.এস.এফ.-এর দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মেহেরপুরে এসেছিলেন সরেজমিনে দেখতে। খুব অল্পসময়ের নােটিশে সবরকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ১৭ তারিখ সকালে সভাস্থল থেকে আড়াই/তিন মাইল ব্যাসে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে অর্ধবৃত্তাকারে নিরাপত্তা ব্যুহ তৈরি করা হয়। মেহেরপুরে ভবেরপাড়া মৌজার বৈদ্যনাথতলায় মঞ্চ তৈরি করা হয়। সকাল দশটার মধ্যে বহুসংখ্যক ভারতীয় ও বিদেশী সাংবাদিক সভাস্থলে এসে উপস্থিত হন। কৃষ্ণনগরের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির কয়েকজন কর্মকর্তা ও কলকাতার কয়েকজন বাংলাদেশ সমর্থক গণ্যমান্য ব্যক্তিও অনুষ্ঠানে যােগ দেন। স্বল্প প্রচার সত্ত্বেও হাজার পাঁচেক লোেক মুক্তিযুদ্ধের নেতা-নায়কদের, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের ও অন্য নেতৃবৃন্দকে স্বাগতম জানাতে সকাল থেকে সমবেত হন। এগারােটার দিকে নেতৃবৃন্দ এলে উপস্থিত জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনি ও করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানায়। বহুসংখ্যক লােক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে করমর্দন করার জন্য ছুটে যান এবং অনেকেই পদ স্পর্শ করে তাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। ভােরের আলােয় অনেকের চোখেই চিকচিক করে ওঠে আনন্দের অশ্রু। নেতৃবৃন্দ সভাস্থলে পৌছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, খােন্দকার মােশতাক আহমদ ও প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি. ওসমানী মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন। টাঙ্গাইলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। প্রথমেই কুরআন, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠ করা হয়। অতঃপর অধ্যাপক ইউসুফ আলী ঘােষণাপত্র পাঠ করেন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের পরিচিতিপর্ব শেষে নেতৃবৃন্দ মঞ্চে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালে অধ্যাপক ইউসুফ আলী শপথবাক্য পাঠ করান। শপথ শেষে উপস্থিত একদল ছেলেমেয়ে আমার সােনার বাংলা গাইতে শুরু করলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মঞ্চের ডানদিকে স্থাপিত স্তম্ভে পতাকা উত্তোলন করেন। উত্তোলন-শেষে তিনি পুনর্বার মঞ্চে এসে সারিভুক্ত হন। ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে জনাবিশেক ইউনিফর্মধারী পুলিশ ও আনসার নিয়ে গঠিত একটি ছােট বাহিনী রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদ আদ্র কণ্ঠে বক্তৃতা করেন। 
অনুষ্ঠান-শেষে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ বি.ও.পি’তে গিয়ে আমাকে ডেকে পাঠান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও কামরুজ্জামান সাহেব আমাকে আলিঙ্গন করে অভ্যর্থনা জানান। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, ওসমানী ও ইউসুফ আলী সাহেব আমার সঙ্গে করমর্দন করেন। তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে আমার পূর্ব-পরিচয় ছিল না। আমি তাজউদ্দিন সাহেবের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিই। তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, পাবনায় আপনার ভূমিকার জন্য আমরা গর্বিত এবং সেজন্য আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। এরপরই তাজউদ্দিন সাহেব আমাকে কলকাতায় গিয়ে সরকারের প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও কামরুজ্জামান সাহেব এতে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে কলকাতা যেতে বলেন। দ্বি-প্রহরের স্বল্প পরেই নেতৃবৃন্দ কলকাতা রওনা হন। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সূচনা হল জনসমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত সরকারের নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম, যার চূড়ান্ত পরিণতিতে ১৬ ডিসেম্বর হানাদারবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। লাখে শহীদের রক্তে রাঙানাে লাল সূর্য খচিত হল বাংলার সবুজ বুকে।
 
স্মৃতিচারণ-৬ লে. হাফিজউদ্দিন আহমদ
 
১৯৭১ সালের মার্চে লে. হাফিজউদ্দিন আহমদ ছিলেন যশাের সেনানিবাসে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবাঙালি অফিসারেরা বাঙালি সৈন্যদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। ফিল্ড এক্সারসাইজ বন্ধ করে চৌগাছা থেকে এই রেজিমেন্টের সৈনিকদের যশাের সেনানিবাসে ফিরিয়ে এনে নিরস্ত্র করার পর রাতের অন্ধকারে গুলি চালিয়ে হত্যা করার উদ্যোগ নিলে লে, হাফিজউদ্দিন আহমদসহ কয়েকজন দেশপ্রেমিক জুনিয়র অফিসার প্রবল ঝুঁকি মাথায় নিয়ে বিদ্রোহ করেন। প্রায় শ তিনেক বাঙালি সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় এসে তিনি যােগ দেন দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে। অংশ নেন একাধিক প্রতিরােধযুদ্ধে। যুদ্ধক্লান্ত অবস্থাতেও তিনি উপস্থিত হন ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে। নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানটি তিনি প্রত্যক্ষ করেন খুব কাছে থেকে। সে-দিনের এই ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লে. হাফিজউদ্দিন আহমদ বলেন : বৈদ্যনাথতলা একটি সীমান্তবর্তী গ্রাম। বিশাল এলাকাজুড়ে আমবাগান রয়েছে এখানে। সবুজ গাছগাছালিঘেরা আম্রকাননকে চমকার সাজে সজ্জিত করা হয়েছে। বহু সাংবাদিক এবং দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির আগমন ঘটেছে। বিদেশী সাংবাদিকরা এই অনুষ্ঠান কভার করার জন্য উপস্থিত হয়েছেন ভিডিও ক্যামেরাসহ। সুসজ্জিত মঞ্চের ঠিক একপাশে প্রথম সারির তিনটি চেয়ারে পাশাপাশি বসলাম ক্যাপ্টেন এ.টি, সালাউদ্দিন, মেঘ সিংহ ও আমি। এই অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী। জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের বহু প্রতিনিধি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ইতােমধ্যে এসে গেছেন প্রধান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে পুলিশ ও ইপিআর নিয়ে গঠিত সম্মিলিত বাহিনী মাহবুবের নেতৃত্বে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এখানেই দেখা হল মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর সঙ্গে।
 

পরনে সবুজ ফুলহাতা সাফারি, মাথায় সামরিক টুপি, ক্যাপ, বেরেট। এক সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন, চলাচলে এখনাে তার রেশ রয়ে গেছে। বহু বছর আগে তিনি আমাদের ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বার্ষিক পুনর্মিলনীতে আগ্রহভরে অংশ নিতেন। বছর দুয়েক আগে এ-অনুষ্ঠানেই তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তার কাছ থেকে পুরনাে দিনের ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অফিসারদের জীবনযাত্রার অনেক কাহিনী শুনেছি। আমাদের কমান্ডিং অফিসারদের কয়েকজন পঞ্চাশের দশকে ওসমানীর মাধ্যমে ২য় লেফটেন্ট্যান্ট পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন। তাদের মতে, সিও-রূপে ওসমানী খানিকটা একগুয়ে ও খামখেয়ালি ধরনের ছিলেন। তার আমলের অনেক মজার ঘটনা ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে আজও কিংবদন্তী হয়ে আছে। তবে ওসমানীর সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দেশপ্রেম বরাবরই প্রশ্নের উর্ধ্বে ছিল। আমাকে দেখে তিনি খুশি হলেন। ৩০ মার্চ যশােরে বিদ্রোহ ঘােষণার জন্য বারংবার পিঠ চাপড়ে ছিলেন। যশােরের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের জন্য তাদের সঙ্গে দেখা করতে বেনাপােলে যেতে চাইলেন। মােস্ট ওয়েলকাম, আপনার অপেক্ষায় থাকব আমরা, হাসিমুখে জানালাম। মূল অনুষ্ঠান শুরু হল। সুসজ্জিত মঞ্চে শপথগ্রহণ করল বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং মন্তিবর্গ-মনসুর আলী, কামরুজ্জামান ও খন্দকার মােশতাক আহমদ। 

 
স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেন ইউসুফ আলী। স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি, সরকারের আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে ইংরেজিতে নীতি-নির্ধারণী ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। তার চমৎকার কণ্ঠস্বর, মাইকের গমগমে আওয়াজ, ভাবগম্ভীর পরিবেশ—সব মিলিয়ে উপস্থিত শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ। সভ্যতা ও মানবতার স্বার্থে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তিনি বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানান। সে-দিনের পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর। একটি জাতি, নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে—আমরা সেই গৌরবের সাক্ষী। বসন্তের শেষলগ্নে প্রকৃতি যেন নিজ হাতে আম্রকাননকে সাজিয়েছে, বাতাসে ভেসে আসছে ভেজা বাতাবি লেবুর সুঘ্রাণ। হাজার-হাজার দেশী-বিদেশী মানুষ মুক্তিযোেদ্ধাদের হৃদয়-নিংড়ানাে রক্তিম আশিসে অভিষিক্ত করার জন্য বরণডালা সাজিয়ে কমলা রঙের নরম বােদ সবুজ পাতার ফাঁকে-ফাকে লুকোচুরি খেলছে। কোকিলের ডাকও শুনতে পেলাম। পলাশীর আম্রকানন এখান থেকে বেশি দূরে নয়। দীর্ঘদিন পরে মেহেরপুরের আরেক আম্রকাননে আজ আবার বাঙালির স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখার সুযােগ পেয়ে আনন্দে, ভাবাবেগে বিহ্বল হয়ে পড়লাম। বৈদ্যনাথতলার নতুন নামকরণ হল মুজিবনগর। অনুষ্ঠান শেষ হলেও উঠতে ইচ্ছে করছিল না। মেঘ সিং-এর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে আছে মননে—ফিরে চললাম কাগজপুকুরের রক্ষণব্যুহের উদ্দেশ্যে।
 
স্মৃতিচারণ-৭ আব্দুল মােমিন চৌধুরী 
 
মুজিবনগরের আলাে-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষ আব্দুল মােমিন চৌধুরী। স্বাধীনতাপ্রিয় এই জনপদের মাটি ও মানুষের সঙ্গে আন্তরিক পরিচয় তার আশৈশব। এতদৃঞ্চলের মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামে বরাবরই তিনি থেকেছেন। সামনের সারিতে। ১৯৭১ সালেও ঘটেছে তাই। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে পাড়া-মহল্লা গ্রামে-গঞ্জে সংগ্রাম কমিটি গঠনের আহ্বান জানানাে হলে বহু দূরে এই নিভৃত পল্লীতে কয়েকজন মিলে গড়ে তােলেন বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটি। ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়ােজনের ক্ষেত্রে এই কমিটির লােকজন বিরাট ভূমিকা পালন করে। সে-অনুষ্ঠানের একজন প্রত্যক্ষদর্শী 
হিসেবে স্মৃতিচারণ করেন আব্দুল মােমিন চৌধুরী। তিনি লেখেন : বাংলাদেশের স্থপতি, মুজিবনগর সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আমাদের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ও সম্মানে আমাদের এই মুজিবনগর। যা সেই দিন ‘৭১এর ১৭ এপ্রিল শিশুর মতাে জন্ম দিয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম একটি ছােট দেশ, যার নাম ‘বাংলাদেশ। আজ এই দিন ২০০১-এর ১৭ আব্দুল মােমিন চৌধুরী এপ্রিল যা ঐ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাই শিশু বাংলাদেশের সাথে সাথে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় উদযাপন করবেন মুজিবনগর দিবস। সেই দিন থেকে এই দিন পর্যন্ত আমি একজন যথার্থ বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে মুজিবনগরের সমস্ত ঘটনার সাক্ষী। ১৯৭১… থেকে ২০০১এর মুজিবনগর আওয়ামী লীগ এবং মুজিবনগর দিবসের প্রতিটা কর্মসূচি ও কর্মকাণ্ডেই আমার নিজ হাতের স্পর্শ আছে। সেজন্য আমি ধন্য ও গর্বিত। ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা কর্মসূচি প্রণয়নের সময় থেকে আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে বিভিন্ন নেতৃত্বে ও দায়িত্ব পালন করে চলেছি। ১৯৬৬ সাল থেকেই আন্দোলনসংগ্রামের মাধ্যমে ‘৭০-এর নির্বাচনে জয়লাভের পর বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে প্রত্যেক গ্রামে-গ্রামে দুর্গ গড়ার কথা বললেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রত্যেক গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গঠনের কথা বললেন এবং সব শেষে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ঐ আহ্বানেই মার্চের এক উত্তাল দিনে বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (যা আজ মুজিবনগর) বৈদ্যনাথতলার সংগ্রাম কমিটি গঠন করি আমাদের এলাকার আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতাদের নিয়ে।
 

এ সংগ্রাম কমিটিতে মূল নেতৃত্বের দায়িত্বে ছিলাম আমি, দোয়াজ উদ্দিন মাস্টার, আইয়ুব হােসেন, রস্তম আলী, রফিকুল ইসলাম, সৈয়দ আলী, জামাত আলী মােল্লাসহ আরও কয়েকজন এ-সংগ্রাম পরিষদের সক্রিয় নেতৃত্বে স্থানীয় আনসারদের সহযােগিতায় বৈদ্যনাথতলা (ভবেরপাড়া) ইপিআর ক্যাম্পের পাঞ্জাবি সদস্যদের বিতাড়িত ও হত্যা করার মধ্য দিয়ে আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি এবং ইপিআর ক্যাম্পেই ছিল আমাদের সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয়। ১৯৭১-এর ১৪/১৫ এপ্রিলের দিকে কলকাতা থেকে আগত কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নির্দেশনায় ১৭ এপ্রিলের অনুষ্ঠানে প্রাথমিক কাজগুলাে যেমন মঞ্চ নির্মাণ, তােরণ নির্মাণ আমরাই সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা ১৬ এপ্রিলের মধ্যেই আমার ভবেরপাড়া গ্রামের সাধারণ মানুষকে নিয়ে সুসম্পন্ন করি। পরের দিন সকাল বেলা সেই দিন ১৭ এপ্রিল যে-দিন বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জন্ম হল নবজাতক বাংলাদেশ-এর, যার ইতিহাস। আজ সকলের জানা। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে ৯ মাসের যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের কাজে একজন আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে নিজেকে আত্মনিয়ােগ করি। যুদ্ধশেষে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ পুনর্গঠনের কাজে নিয়ােজিত হয়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি পদের দায়িত্ব সেই ‘৭২ সাল থেকে আজ এই দিন ২০০১-এর ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত পালন করছি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও মুজিবনগর সরকারের জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর আমার জীবনেও গেছে বহু অত্যাচার ও নির্যাতন। তারপরও আজ পর্যন্ত একদিনের জন্যও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে বিপথগামী হই নি। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি মুজিবনগর দিবসের আওয়ামী লীগের সভামঞ্চে আমি সভাপতিত্ব করেছি। ১৯৮৪ এবং ১৯৯২ সালে। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর (তখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বিরােধীদলের নেত্রী ছিলেন) অনুষ্ঠানেও আমাকে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আজকের এই দিনে ১৭ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে পেয়ে আমিসহ মুজিবনগরবাসী মহাখুশি। মুজিবনগরের স্মৃতিস্মরণে মুজিবনগর কমপ্লেক্স স্থাপন, মুজিবনগরকে আলাদা থানা/উপজেলায় উন্নীত করাসহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক প্রকল্পের ঘােষণা ও বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আমার মুজিবনগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংগ্রামী সালাম ও অভিনন্দন।’ স্মৃতিচারণমূলক এ-রচনাটি মুজিবনগর দিবস ‘০১ উপলক্ষে জেলা প্রশাসন, মেহেরপুরের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ২০০১ সালের স্মরণিকা ‘শপথ থেকে সংকলিত হয়েছে।

 
স্মৃতিচারণ-৮ আইয়ুব হােসেন
 
মেহেরপুর জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জনপদের প্রায় সব মানুষের অতি কাছের মানুষ, আপনজন আইয়ুব হােসেন। ১৯৭১ সালে বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে বসে গঠন করেন ‘বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটি এবং এই 
 
 
কমিটির পক্ষ থেকেই ১৭ এপ্রিলের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়ােজন সম্পন্ন করেন। ঐতিহাসিক এ-অনুষ্ঠানটি তিনি প্রত্যক্ষ করেন খুব কাছে থেকে, খুব ভিতর থেকে। তার সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেছেন নিচের রচনাটিতে। তিনি লিখেছেন : ১৯৭০ সাল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশের জনগণ যখন। আইয়ুব হােসেন পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, সেই আন্দোলনের ঢেউ আমাদের এই সুদূর পল্লীকে উত্তাল করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণের পর ১১ মার্চ ১৯৭১ ভবেরপাড়া বাজার প্রাঙ্গণে ‘বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম পরিষদের লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বতােভাবে সাহায্য ও সহযােগিতা করা। আমি উক্ত সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম। ২৬ মার্চে চুয়াডাঙ্গা ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে খবর এল ঢাকা ইপিআর ও পুলিশবাহিনীকে পশ্চিমা হানাদারবাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। তখন আমরা এলাকাবাসী মিছিল করে বৈদ্যনাথতলা ইপিআর ক্যাম্পে যাই এবং ইপিআর সুবেদার মােঃ মােজাফফর সাহেবের। নেতৃত্বে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলি এবং বাংলাদেশের লাল সূর্যের মাঝে মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করি। পরবর্তীতে ইপিআর বাহিনীকে কুষ্টিয়া আক্রমণ করার জন্য চুয়াডাঙ্গা হেডকোয়ার্টার থেকে ক্লোজ করায় ক্যাম্পের প্রতিরক্ষার জন্য মেহেরপুরের আনসার অ্যাডজুটেন্টসহ এসডিও অফিস থেকে কিছু আনসারকে নিয়ােগ দেয়া হয়। কুষ্টিয়াসহ সারা বাংলাদেশে যখন যুদ্ধ চলছে, তখন আমাদের এখানে পশ্চিমবঙ্গের বেথিয়াডৌর, কৃষ্ণনগর ও কলকাতা থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগতভাবে ওষুধ, ব্যান্ডেজ, জ্বালানি ও চিড়াসহ বিভিন্ন মালামাল পশ্চিমবাংলার জনগণ আনতে লাগলেন। আমরা সেগুলাে সংগ্রাম পরিষদের রশিদ মারফত সংগ্রহ করতাম। এ-সময় বিভিন্ন সাংবাদিক ও প্রশাসনের লােকজন আসতেন। ভারতের বিশ্বনাথ ব্রহ্ম আমাদের খুব সাহায্য-সহযােগিতা করেছিলেন। ১৭ এপ্রিল শপগ্রহণ অনুষ্ঠানের জন্য আমরা স্থানীয়ভাবে মঞ্চ তৈরির লক্ষ্যে কিছু চৌকি নিয়ে আসি। এলাকা থেকে কিছু শতরঞ্জি ও কার্পেট নেওয়া হয়েছিল। কয়েকটি ব্যানার স্থানীয় মিশনের সিস্টারদের কাছ থেকে লালসালুর ওপর তুলা দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তাতে লেখাছিল, ‘ওয়েলকাম-স্বাগতম’। স্থানীয় জনসাধারণ বাঁশ-দড়ি ও দেবদারু গাছের পাতা দিয়ে তৈরি করেছিলেন গেট। ১৬ তারিখে দিন এবং রাতে মঞ্চ ও গেট তৈরির কাজ শেষ হয়। ভােরে ইপিআর ক্যাম্পে গিয়ে দেখি বারান্দায় ৪ ব্যক্তি এক লাইনে দক্ষিণদিকে মুখ করে বসে আছেন। জানলাম, তারা হচ্ছেন জনাব নজরুল ইসলাম, জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, জনাব মনসুর আলী ও জনাব কামরুজ্জামান। কিছুক্ষণ পর আমাকে ডেকে বলা হল, পবিত্র কুরআন থেকে তেলওয়াত করার জন্য একজনকে নির্বাচন করতে হবে।
 
আমি গৌরীনগরের মােঃ বাকের আলীকে চার নেতার কাছে হাজির করলাম। তারা শুনতে চাইলেন কোন আয়াত তেলাওয়াত করবেন। বাকের সাহেব তেলাওয়াত করলেন এবং তাজউদ্দিন সাহেব বললেন, ‘এটা করলেই হবে।’ কিছুক্ষণ পর আমাকে ডেকে বলা হল জাতীয় সঙ্গীত গাইবার জন্য লােক, হারমােনিয়াম ও ডুগি-তবলা দিতে হবে। আমরা স্থানীয়ভাবে এগুলাে জোগাড় করেছিলাম। পিন্টু বিশ্বাস এবং আসাদুল হকসহ আরাে কয়েকজন জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছিলেন। জাতীয় সঙ্গীত কোরাস আকারে হয়। গেটটি তৈরি হয়েছিল উত্তরদিকে মুখ করে। ক্যাম্প থেকে মঞ্চ পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে হাজার-হাজার জনসাধারণ নেতৃবৃন্দকে স্বাগত জানায় এবং শত শত ডেলিগেট ও সাংবাদিকের উপস্থিতিতে জনসভা আরম্ভ হয়। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন, পতাকা উত্তোলন ও কুরআন তেলাওয়াত-এর মাধ্যমে সভার কাজ আরম্ভ হয়। শপথগ্রহণ শেষে মিষ্টি বিতরণ করা হয় এবং শেষে আনছার বাহিনী গর্ড অব অনার প্রদান করে। আমরা এলাকাবাসী এ-কাজে অংশগ্রহণ করতে পারায় গর্বিত। স্মৃতিচারণমূলক এ-রচনাটি মুজিবনগর দিবস ‘৯৯ উপলক্ষে জেলাপ্রশাসন, মেহেরপুরের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ২০০১ সালের স্মরণিকা প্রতিশ্রুতি থেকে সংকলিত হয়েছে।
 
স্মৃতিচারণ-৯ দোয়াজউদ্দিন মণ্ডল
 
পেশায় স্কুল-শিক্ষক দোয়াজউদ্দিন মণ্ডলের সঙ্গে মুজিবনগরের অবিচ্ছেদ্য নাড়ির সম্পর্ক। মুজিবনগর থেকে মাত্র ১ কিলােমিটার দূরে তার বাস।  শিক্ষকতা করেছেন দারিয়াপুর এবং পরে কেদারগঞ্জ (বর্তমানে মুজিবনগর) 
 
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৭১ সালে তারই নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটি। এ-কমিটি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়ােজনের নেপথ্যে ছিল এ-কমিটির অনেক অবদান। শপথগ্রহণের এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে নিজে অংশগ্রহণ করেছেন শুধু তাই নয়, প্রাক্তন ছাত্রদেরও দোয়াজ উদ্দিন মাস্টার নানা কাজে লাগিয়েছেন, ধন্য হয়েছে তাদের জীবন। দোয়াজউদ্দিন মণ্ডল সে-সব দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আমি, মােমিন চৌধুরী, আইয়ুব হােসেন ও রুস্তম আলীসহ মােট ১৩ সদস্যবিশিষ্ট বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটি গঠন করি। কমিটির মাধ্যমে আমরা গ্রাম থেকে চাঁদা তুলি এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রয়ােজনে কেন্দ্রে প্রেরণ করতে থাকি। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণার পর স্থানীয় ইপিআর বাহিনী কুষ্টিয়া ফ্রন্টে যুদ্ধে চলে যায়। আমরা কয়েকজন আনসারসহ বৈদ্যনাথতলার ইপিআর ক্যাম্পের দায়িত্ব গ্রহণ করি। মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারত থেকে যুদ্ধের সাহায্য গ্রহণ ও বিতরণে অক্লান্তভাবে কাজ করতে থাকি। ১২ এপ্রিল একজন অচেনা ব্যক্তি জিপযােগে মুজিবনগর আসেন এবং আমাদের বাগানের মধ্যে কিছু এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে বলেন। তিনি বলেন, এখানে বাংলাদেশ সরকারের একটি অনুষ্ঠান হবে। ১৬ এপ্রিল আমি, আইয়ুব হােসেন, মােমিন চৌধুরীসহ আরাে অনেক স্থানীয় লােকজনের সহযােগিতায় আমবাগানে একটি মঞ্চ তৈরি করে। ১৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। দেশ-বিদেশের অনেক সাংবাদিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে কুরআন পাঠ ও জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। আমি আইয়ুব হােসেন, রুস্তম আলী ও আরাে অনেকে সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে ছিলাম।
 
স্মৃতিচারণ-১০ আসাদুল হক
 
মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যাপক আসাদুল হক (সম্প্রতি প্রয়াত) ১৯৭১ সালে ছিলেন কলেজ ছাত্র। মুজিবনগর সন্নিহিত এলাকা দারিয়াপুরে বাড়ি। বেড়ে ওঠা এ-অঞ্চলের ধুলােমাটি মেখে। 
১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে ছুটে গিয়েছিলেন তারুণ্যের কৌতূহল থেকে। যাওয়ার পর দেখতে পান সেখানে বিরাট আয়ােজন। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে। বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে। স্কুলজীবনের শিক্ষক দোয়াজউদ্দিন স্যার তাকে ধরে নিয়ে এসে ভিড়িয়ে দেন জাতীয় সঙ্গীত গাইবার দলে। রাস্তার ধারে হারমােনিয়াম নিয়ে আসাদুল হক রিহার্সেল চালাচ্ছিল কয়েকজন স্থানীয় শিল্পী। আসাদুল হকও তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে শুরু করেন। তারপর একসময় নেতৃবৃন্দের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিবেশন করেন জাতীয় সঙ্গীত। ঐতিহাসিক এ-দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকেই আসাদুল হক লেখেন : সারা পৃথিবীর মানুষের চোখ তখন বাংলাদেশের ওপর, কি হচ্ছে সেখানে, সত্যিকার অর্থে কি ঘটতে চলেছে। সময়টা এপ্রিল মাস ‘৭১এর ১০ এপ্রিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়ে গেছে। ক্ষুদ্র আকারের একটা মন্ত্রিপরিষদও ঘােষিত হয়েছে। সমস্ত পৃথিবীর মানুষের কাছে এ-সংবাদ তখন পৌছে গেছে মিডিয়ার মাধ্যমে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটা চলে আসে কোথায়, কিভাবে কাজ করছে এই সরকার। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে তখনাে পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা। অবস্থান করছে এবং তারাই মূলত দখল করে রেখেছে দেশটাকে। যদিও সারা বাংলাদেশজুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ২৬ মার্চের রাত্রি থেকে এবং কোনাে-কোনাে অঞ্চলকে তারা মুক্তও করেছে বা রেখেছে বিভিন্ন ব্যারিকেডের মাধ্যমে। এমনি একটা মুহূর্তে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছে যে প্রশ্নটা সব চাইতে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হল সারা বিশ্বকে দেখানাে যে, বাংলাদেশের বুকেই এই সরকার গঠিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের মুক্ত মাটিতে বসেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনভাবে তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে এবং সেটা করতে হলে সারা পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যমকে তা দেখাতে হবে। পৃথিবীর মানুষকে জানাতে হবে যে, বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি চায়, স্বাধীনতা চায় এবং তারা সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। পাকসেনাদের বিরুদ্ধে এবং এই ন্যায্য মুক্তিসংগ্রামে তারা পৃথিবীর সব স্বাধীনতাকামী দেশকে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে আহ্বান করছে।
 
এ প্রেক্ষাপটেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করে যে, মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের ব্যাপক আমন্ত্রণ জানানাে হবে। সিদ্ধান্ত হয় যে, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা আমবাগানটিই হবে এর জন্য সবদিক দিয়ে উপযুক্ত স্থান। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে গােটা সময়টাজুড়ে এই মুজিবনগরকে কেন্দ্র করেই সমগ্র বাঙালি জাতির আশ-আকাক্ষা, মুক্তিচেতনা আন্দোলিত হয়েছে প্রতিমুহূর্তে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির জীবনে শ্রেষ্ঠতম ঘটনা। আর মুজিবনগর হচ্ছে সেই ইতিহাসের সূতিকাগার। পৃথিবীতে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে, পৃথিবীতে যতদিন শশাষণ থাকবে, নিপীড়ন থাকবে, থাকবে মুক্তির আন্দোলন, ততদিন মুজিবনগরকে যুগে-যুগে স্মরণ করবে পৃথিবীর বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষ। ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ মুজিবনগর যে-ঘটনাকে বুকে ধারণ করেছিল, বাঙালি জাতি তথা পৃথিবীর সমগ্র মুক্তিকামী মানুষ সে-দিন যে-স্বাধীন শােষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেছিল, সেই সমাজের প্রতিষ্ঠা, সেই মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যেই আজ, এই দিনে নিনাদিত হােক আমাদের সবার শ্লোগান। সেই স্লোগানে গলা মিলিয়ে সে-দিনের সেই ১৭ এপ্রিলের প্রত্যক্ষদর্শী এবং অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনকারীদের অন্যতম হিসেবে আমার আজ শুধু বলতে ইচ্ছে করে বাংলা মায়ের মুক্তিকামী সােনার ছেলেরা তােমরা থেম না, সামনে অনেক পথ, জয় তােমাদের হবেই।”
স্মৃতিচারণ-১১ শাহাবুদ্দিন আহমেদ সেন্টু
সােনালী ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন যাপনকারী শাহাবউদ্দিন আহমেদ সেন্টু ১৯৭১ সালে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র । ছিলেন সংস্কৃতিমনা, রাজনীতিসচেতন এবং খেলাধুলাপ্রিয় চৌকস ছাত্র। একাত্তরের মার্চে ঢাকাতেই মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে অনেক পথ ঘুরে, অনেক কষ্ট স্বীকার করে বাড়ি ফেরেন, মুজিবনগর সন্নিহিত গ্রাম- বাগােয়ানে। যুক্ত হন নিজ এলাকার প্রতিরােধ আন্দোলনে। অতঃপর বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে গান শেখার প্রচেষ্টাটুকুই খুব কাজে লেগে যায় ১৭ এপ্রিল, মুজিবনগরে। নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণের প্রাক্কালে স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে 
নিয়ে পরিবেশন করে জাতীয় সঙ্গীত। সেই সাথে খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেন সেদিনের ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠান সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শাহাবউদ্দিন আহমেদ সেন্টু বলেন : মহান মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে আমাদের অহঙ্কার নিত্যক্ষণের। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করি মহান স্বাধীনতা। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ঐতিহাসিক নির্দেশে স্বাধীনতাকামী লক্ষ-লক্ষ ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক আর সব স্তরের জনগণের ন্যায় আমিও ঝাপিয়ে পড়ি মহান শাহাবুদ্দিন আহমেদ সেন্টু মুক্তিযুদ্ধে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের – পদার্থবিজ্ঞান এমএসসি প্রথম পর্বের ছাত্র । ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য। পরিবারে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি চর্চার সূত্রে আমি খেলাধুলা ও গান-বাজনায় উৎসাহী। শহীদ শেখ কামালের প্রতিষ্ঠিত আবাহনীর একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, আর বুলবুল ললিতকলা একাডেমী (বাফা)-তে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখি। শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ সহযােগীদের একজন বিধায় বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাতের সুযােগে আমি ধন্য আর ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত। শহীদ শেখ কামালের নেতৃত্বে আবাহনী মাঠের পাশে নিরিবিলি এক খােলা জায়গায় ১০ মার্চ থেকে আবাহনীর ১০/১৫ জন সদস্যের সাথে আমি গেরিলাযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন-হারুন, বাচ্চু, তারেক, তান্না, সেন্টু (আমার ডাকনাম) ইকবাল, জিলু, ইকবাল (মােহাম্মদপুর) ও নূর আলী প্রমুখ। প্রশিক্ষণ দিতেন কর্নেল শওকত আলী খান (তৎকালীন মেজর) মাননীয় এমপি শরিয়তপুর এবং অন্য একজন মেজর (যিনি নাম প্রকাশ করেন নি)।
 
প্রশিক্ষণে আমাদেরকে রাইফেল চালনা, গ্রেনেড ছােড়া, ক্রলিং এবং আত্মরক্ষার কৌশল শেখানাে হল । প্রশিক্ষণ চলত দুপুর ২.৩০ মিঃ থেকে বিকাল ৫.০০টা পর্যন্ত এবং ২৫ মার্চের বিকাল পর্যন্ত তা চলে। জুলফিকার আলী ভুট্টো ও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং মুক্তিসংগ্রামে সর্বস্তরের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য বুলবুল ললিতকলা একাডেমী (বাফা), ছায়ানট এবং দেশের গুণী শিল্পী ও ছাত্রছাত্রীদের সমন্বয়ে গঠিত বিক্ষুব্ধ শিল্পী। সমাজ উত্তাল মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রতি সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ  মিনারে দেশাত্মবােধক সঙ্গীত পরিবেশন করত। প্রখ্যাত অভিনেতা—শিল্পী সৈয়দ হাসান ইমাম উক্ত সংগঠনের আহ্বায়ক ছিলেন আর প্রথম সারির শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ, সমর দাস, ওয়াহিদুল হক, আতিকুল ইসলাম, হামিদা বেগম, বেনু ভাই আরাে অনেকে। বুলবুল একাডেমীর ছাত্র হিসেবে তাদের সাথে উক্ত গণসঙ্গীতে আমি অংশগ্রহণ করি। ঐ অনুষ্ঠানে দেশাত্মবােধক, উদ্দীপনামূলক রণসঙ্গীত গাওয়া হত আর সব শেষে ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি। ২৫ মার্চের সন্ধ্যাতেও ঐ সঙ্গীতানুষ্ঠানে আমরা অংশগ্রহণ করি। তারপর আসে সেই কালাে রাত্রি, ২৫ মার্চ ১৯৭১। শুরু হয় নির্বিচারে বাঙালি হত্যাযজ্ঞ। রাত ১২টা থেকে ঢাকার আকাশে-বাতাসে প্রচণ্ড গােলাগুলির শব্দ আর অসহায় নিরস্ত্র মানুষের আর্তচিঙ্কার।
২৬ মার্চ সকালে শেখ কামালের নেতৃত্বে আমরা আবাহনীর ১০/১৫ জন সদস্য আবাহনী মাঠের পার্শ্বে রাস্তার ধারে বড়-বড় ৪/৫টি গাছ কেটে সাতমসজিদ রােডের ওপর ফেলে রেখে, আর আবাহনী মাঠে স্তুপ করে রাখা ইট রাস্তায় বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে রেখে রাস্তা অবরােধ করি, যাতে পাঞ্জাবিরা রাস্তায় চলাচল না করতে পারে। বাধা পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা ২২নং রােড দিয়ে এসে মেশিনগান দিয়ে গুলি ছুঁড়তে-ছুঁড়তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। আমরা আশপাশের বাড়ির দেয়াল টপকিয়ে আত্মরক্ষা করি। কিছুক্ষণ পরেই আবার একত্রিত হয়ে চোরাগােপ্তা হামলা চালাই বর্বর হানাদারবাহিনীর ওপর। এভাবে ২৯ মার্চ পর্যন্ত আমরা বিক্ষিপ্ত এবং অতর্কিত হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের পর্যদস্ত করি। যখন আমাদের ধরার জন্য বাড়ি-বাড়ি তল্লাশি চালানাে হয় তখন শেখ কামাল আমাদের সবাইকে নির্দেশ দেয়, যে যার এলাকায় চলে গিয়ে যুবকদের সংগঠিত করে দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। ৩০ মার্চ ঢাকা থেকে রওনা দিই নিজেদের বাড়ি মেহেরপুরের উদ্দেশ্যে। কখনাে হেঁটে, কখনাে নৌকায়, সাইকেলে, ট্রাকে চেপে ৫ দিন পর ৩ এপ্রিল মেহেরপুরে পৌছাই। ২ এপ্রিল কুষ্টিয়া হয়ে আসার সময় দেখি সব পাকিস্তানি সেনা খতম করা হয়েছে। সকাল ৯টার দিকে কুষ্টিয়ায় বিমান থেকে বােমা নিক্ষেপ করা হয়। গড়াই নদীর চরে গিয়ে আত্মরক্ষা করি। মেহেরপুরে বন্ধু মােঃ ইসমাইল হােসেন পাঞ্জাবিদের প্রতিরােধ করতে ছাত্র, যুবক সবাইকে সংগঠিত করছেন। আমিও তার সাথে যুক্ত হয়ে গেলাম। ৮ এপ্রিল মধ্য রাতে শশারগােল শােনা গেল, পাকিস্তানি সেনারা চুয়াডাঙ্গা দখল করে মেহেরপুরের দিকে এগিয়ে আসছে, পায়ে হেঁটে বাবা, মা, ভাই বােনদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি বাগােয়ানের দিকে ছুটলাম। আমার বড় ভাই শেখ নজরুল ইসলাম বাগােয়ান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, গ্রামের বাড়িতেই থাকেন।
বাগােয়ানে এসে মুন্সি শাখাওয়াৎ হােসেন (বাটুল ভাই)-এর সাথে মিলে বাগােয়ান এবং ভবেরপাড়ার যুবক, তরুণদের সংগঠিত করতে থাকি। ১৪ এপ্রিল সীমান্ত পার হয়ে কৃষ্ণনগরে গিয়ে আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখা করি এবং দরকারি জিনিসপত্র কিনে আনি। সন্ধ্যায় ফিরে এসে শাখাওয়াৎ ভাইদের বৈদ্যনাথতলার বাড়িতে দেশের অবস্থা নিয়ে আলাপ করছি, শুরু হল কালবৈশাখী ঝড়। প্রচণ্ড বৃষ্টি হল। রাত্রে ওখানে থেকে গেলাম। পরদিন ১৫ এপ্রিল সকালে আমবাগানের (মুজিবনগর আম্রকানন) মধ্য দিয়ে (বাগােয়ানের এক মাইল পূর্বে) যাওয়ার সময় দেখি কিছু লােক বাগান পরিষ্কার করছেন। জিজ্ঞাসা করলে তারা বললেন, এখানে একটা অনুষ্ঠান হবে। কবে হবে সঠিকভাবে তারা জানেন না। এ-কাজে তাদের সাহায্য করলে ভালাে হয়। গ্রামে গিয়ে ৫/৬ জনকে নিয়ে আবার বাগানে এসে দেখি শাখাওয়াৎ ভাই ভবেরপাড়ার ছেলেদের নিয়ে এবং ফাদার ফ্রান্সিস ভবেরপাড়া মিশনের সিস্টারদেরসহ বেশকিছু লােকজন নিয়ে বাগান পরিষ্কার করার কাছে লেগে গেছেন। আমরা সবাই ঝাটা, কোদাল, ঝুড়ি নিয়ে এসে বাগানের মাটি সমান করার, ঝাট দিয়ে পরিষ্কারের কাজ করতে থাকি। বাগানের চারদিকে ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছিল। বাগানের মধ্যে পশ্চিমপ্রান্তের রাস্তার কাছে স্টেজ করা হয়েছিল। স্টেজের সামনের দিকে মােটা দড়ির বেষ্টনী করা হয়েছিল। বাগানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রাস্তার ওপর কলাগছি, দেবদারু পাতা দিয়ে সাজিয়ে গেট করা। হয়েছিল আর সাদা অক্ষরে তুলা দিয়ে লেখা হয়েছিল স্বাগতম। লেখার কাজে বিশেষভাবে অংশ নিয়েছিলেন ভবেরপাড়া মিশনের সিস্টারগণ। সারাটা বাগানের গাছে-গাছে মাইক লাগানাে হয়েছিল আর স্টেজের পাশে বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দের জন্য ছিল চেয়ার সাজানাে। এ-সব। কাজ মেহেরপুরের এসডিও জনাব তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, এসডিপিও জনাব মাহবুবউদ্দিন আহমেদ এবং মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে করা হয়েছিল। শনিবার, ১৭ এপ্রিল ১৯৭১। প্রতিদিনের মতাে উৎসুক হয়ে গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি এই বুঝি নির্দেশ আসে অনুষ্ঠানের। সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে সকাল ৯টার দিকে ভারত সীমান্তের হৃদয়পুরের দিক থেকে ২/৩টা মােটরগাড়ি এল। ছুটে গেলাম গাড়ির কাছে। নামলেন আমার অতি পরিচিত শ্রদ্ধেয় রাজ্জাক ভাই, আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান এবং ছাত্রনেতা আ, স, ম, আব্দুর রব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য এবং আবাহনীতে শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ সহযােগী হিসেবে তারা দু’জনই আমাকে ভালােভাবে চেনেন। রাজ্জাক ভাই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন তুই এখানে আসছিস কিভাবে? আমি বললাম, আমার গ্রামের বাড়ি এখান থেকে এক মাইল পূর্বে।
বাগানের পশ্চিমপার্শ্বের পাকা বাড়িটা দেখিয়ে বললাম, ওটা আমার বড়চাচা মুন্সী অলিদাদ হােসেনের। শাখাওয়াৎ ভাইকেও ভালােভাবে চেনেন তারা। রব ভাই বললেন, ক্ষিদে পেয়েছে, নাস্তা খাওয়া। শাখাওয়াৎ ভাইদের বাড়ি থেকে চিড়া ও আখের গুড় এনে ক্ষেতে দিলাম । রাজ্জাক ভাই আমাকে কাছে ডেকে বললেন, অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি’ জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হবে, ব্যবস্থা কর। তার নির্দেশে স্থানীয় তরুণদের মধ্যে কে-কে গান গাইতে জানে খোঁজ করতে ভবেরপাড়ার পিন্টু বিশ্বাস, রামনগরের মুনসুর মােল্লা, দরিয়াপুরের আসাদুল হক এগিয়ে এলেন। আমরা সবাই মিলে ছুটাছুটি করে হারমােনিয়াম, তবলা, বায়া সংগ্রহ করে রাস্তার পশ্চিমপাশে গাছতলায় বসে রিহার্সেল শুরু করি। রব ভাই (আ, স, ম, আব্দুর রব)ও এসে রিহার্সেলে যােগ দিলেন। আমরা ৫ জন মিলে ১৫/২০ মিনিট রিহার্সেল করি। সে-সময় বিদেশী সাংবাদিক, ফটোগ্রাফারগণ আমাদের নাম লিখে নিলেন আর ছবি তুলে নিলেন। সকাল সাড়ে এগারটার দিকে পবিত্র কুরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হল, তেলাওয়াত করলেন, গৌরীনগরের মােঃ আব্দুল বাকের। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করছিলেন, মেহেরপুরের এসডিও জনাব তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, এসডিপিও জনাব মাহবুব উদ্দিন আহমদ এবং মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। এরপর মাইকে ঘােষিত হল ‘এবার স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করবেন, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম’। রাজ্জাক ভাই এসে আমাদের মঞ্চে বসে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে নির্দেশ দেন। আমরা ৫ (পাঁচ) জন স্টেজে গিয়ে সমস্ত আবেগ ও আকুতি দিয়ে গাইলাম আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি’। আমরা পুরা জাতীয় সঙ্গীতটি গাইতে থাকলাম আর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমাদের সমগ্র বাঙালি জাতির পরিচয়, গৌরব ও আশা-আকাক্ষার প্রতীক সবুজের মাঝে রক্তিম সূর্য যার মধ্যে বাংলাদেশের মানচিত্র শােভা পাচ্ছে সেই জাতীয় পতাকা আস্তে-আস্তে উঠাতে থাকলেন। শীর্ষে উঠল পতাকা, আমরাও গান শেষ করে স্টেজের পাশে এসে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান দেখতে থাকলাম।
স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র বাংলায় পাঠ করলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীবর্গ শপথগ্রহণ করলেন। প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ তার বক্তব্যে বললেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হল। যুদ্ধ করে হানাদারবাহিনীর কবল থেকে এদেশ মুক্ত করব, ইনশাআল্লাহ।” আমরা পরে জেনেছি বৈদ্যনাথতলার এই অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগর নামকরণ তিনিই করেছিলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার বক্তৃতায় বললেন, ২০০ বছর আগে এখান থেকে ৪০ মাইল দূরে পলাশীর এক আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গিয়েছিল। আজ আবার সেই সূর্য উদয় হল মুজিবনগরের এই আম্রকানন থেকে। বিকাল ৪টার দিকে অনুষ্ঠান শেষ হল। আগেই মিষ্টি এনে রাখা হয়েছিল শাখাওয়াৎ ভাইদের বৈঠকখানা ঘরে। উপস্থিত সবাইকে মিষ্টি মুখ করানাে হল। নেতৃবৃন্দ চললেন ভারত সীমান্তের দিকে। রাজ্জাক ভাইয়ের জিপে চড়ে ওপারে গেলাম হৃদয়পুরে। আমাদের নেতৃবৃন্দ ভারত সরকারের সহযােগিতা নিয়ে প্রথম মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করলেন নদীয়া জেলার হৃদয়পুরে। যােগ দিলাম সেই ক্যাম্পে। পৃথিবীর ইতিহাস ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হল।
স্মৃতিচারণ-১২
বাকের আলী মুজিবনগর কলেজের সহকারী অধ্যাপক বাকের আলী একাত্তরে ছিলেন কলেজছাত্র। বাড়ি গৌরীনগর। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের দিন মুজিবনগরে উপস্থিত হলে স্কুলজীবনের শিক্ষক দোয়াজউদ্দিনের আহ্বানে মূল অনুষ্ঠানে পবিত্র কুরআন তেলওয়াত করেন। ঐতিহাসিক সেই দিনের স্মৃতি এখনাে উজ্জ্বল হয়ে আছে তার মানসপটে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন : ১৯৭১ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছিল বর্বর পাকহানাদার বাহিনীর গণহত্যা। ১৬ এপ্রিল আমি দর্শনা থেকে বাড়ি আসি। সন্ধ্যার দিকে লােকমুখে বাকের আলী শুনতে পাই যে, বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে 
(বর্তমান মুজিবনগর) ১৭ এপ্রিল সকল ৭টায় এক জনসভা হতে যাচ্ছে। আমি আমার কয়েকজন বন্ধুসহ পায়ে হেঁটে মুজিবনগর যাত্রা করলাম। যাওয়ার সময় পথের দুপাশে বিভিন্ন বাড়ি ও দোকান থেকে গান ভেসে আসছিল ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি’। আমগাছতলায় একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। মঞ্চের আশপাশে বহু অপরিচিত লােকজন দেখতে পেলাম। আমার হাইস্কুলের শিক্ষক জনাব মােঃ দোয়াজউদ্দিন আমাকে খুঁজে নিয়ে কুরআন শরিফ তেলওয়াত করার জন্য বললেন। আমাকে ইপিআর ক্যাম্পে ডেকে আনা হল। সেখানে উপবিষ্ট ছিলেন জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, জনাব মােঃ কামরুজ্জামান, জনাব মােঃ ইউসুফ আলী, জনাব ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী এবং জনাব মােশতাক আহমেদ প্রমুখ। জনাব কামরুজ্জামান সাহেব আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন এবং কুরআন তেলওয়াত করার জন্য নােটবুকে আমার নাম লিখে নিলেন। মঞ্চের পশ্চিমপাশে তঙ্কালীন সময়ে মেহেরপুর মহকুমার এসডিও জনাব মােঃ তৌফিক-ই-এলাহী সাহেব কাঁধে স্টেনগান নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। ১২ জন আনসার দ্বারা সরকারপ্রধানকে গার্ড অব অনার। প্রদান করলেন জনাব মাহবুব সাহেব। মঞ্চে একে-একে সবাই উপবিষ্ট হলেন। মাইকে আমার নাম ডাকা হল, আমি আনন্দে শিহরিত চিত্তে মঞ্চে উঠলাম। শতাধিক সাংবাদিক আমার ছবি নিতে শুরু করলেন। আমি পবিত্র কুরআন তেলওয়াত করলাম। জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন আমার শ্রদ্ধেয় আসাদুল ভাই, পিন্টু আরাে কয়েকজন যা আমার মনে নেই। এরপর অস্থায়ী মন্ত্রিসভার সদস্যগণের শপথগ্রহণের পালা শুরু হল। অধ্যাপক ইউসুফ আলী শপথবাক্য পাঠ করান। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের এ-পর্বে আমার অংশগ্রহণের সুযােগ আমার জীবনের। একটি শ্রেষ্ঠ ঘটনা।
স্মৃতিচারণ-১৩ এস, এম. রুস্তম আলী
আজকের সুপরিচিত অ্যাডভােকেট রুস্তম আলী ১৯৭১-এ ছিলেন কলেজছাত্র। মুজিবনগরের সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক। প্রতিরােধযুদ্ধের প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটিতে তিনি পালন করেন কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব। ১৭ এপ্রিলের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন : দীর্ঘ ২৮ বছর পরে মুজিবনগরের সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য আমরা যারা ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের সাথে প্রকৃতভাবে জড়িত ছিলাম তাদের স্মৃতিচারণমূলক লেখা আহ্বানের ব্যবস্থা করা হয়েছে শুনে খুবই ভালাে লাগছে। ১৯৭১ সালে আমি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র এবং বৈদ্যনাথতলা সীমান্ত সংগ্রাম কমিটির একজন কর্মী ছিলাম। পরে ভারত কর্তৃক প্রেরিত মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সাহায্যগ্রহণকারী কর্মকর্তা হিসেবে এলাকার মানুষের সাথে পরিচিত হই। ১৬ এপ্রিল অনুমান বেলা ১১টায় ভারতের একজন নন-বাঙালি আর্মি অফিসারের সাথে আমার দেখা হয়। আর্মি অফিসার আমাকে দুপুর এস,এম, রুস্তম আলী ৩টায় মুজিবনগর বাগানে থাকার জন্য বলেন এবং চিরকুটে আমার নাম লিখে নিয়ে যান। আমি, সগ্রাম কমিটির আবু তৈয়ব মল্লিক, আকবত, মােমিন চৌধুরী ও আরাে অনেককে খবর। দিই এবং ঐ সময় উপস্থিত থাকি। আমরা ভারতের যুগান্তর পত্রিকার প্রথম পাতায় বাংলাদেশ সরকারের (অস্থায়ী) শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান মুজিবনগরে হবে মর্মে খবর দেখতে পাই। আমরা খবরের কাগজ পড়ে আরও অনেক বিষয়ে জ্ঞাত হই। গ্রামের লােকজনের সহায়তায় আমরা আমবাগানে একটি মঞ্চ তৈরি করি। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার শপথগ্রহণ করে। আনসার বাহিনীর লােকেরা গার্ড অব অনার দেয়। বাকের মিয়া পবিত্র কুরআন তেলওয়াত করে। পিন্টু ও তার সাথীরা জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে। হাজারহাজার সাংবাদিক ও গণ্যমান্য লােকের সামনে নেতারা বক্তব্য দেন। এলাকার মানুষ সবাই খুবই আনন্দিত ছিল। বর্তমানে মুজিবনগরের উন্নয়ন হচ্ছে শুনে আমি খুবই আনন্দিত। অদূর ভবিষ্যতে আরাে সুন্দর কিছু হােক এই আশায় আজকের মতাে সবার মঙ্গল কামনা করে সেই দিনের সেই সুখস্মৃতি রােমন্থন করতে-করতে বুকের ভিতর স্বাধীনতার শত স্বপ্ন নিয়ে শেষ করছি।”
স্মৃতিচারণ-১৪ সােললমান বিশ্বাস
মুজিবনগর সন্নিহিত পিরােজপুর ইউনিয়নের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান সােলেমান বিশ্বাস যৌবনে নিজ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত সংগঠনে এবং আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তিনি মুজিবনগরের উপস্থিত ছিলেন। তার সৌভাগ্য হয়েছে—ঐতিহাসিক শপথগ্রহণ দিবসের অনুষ্ঠানের জন্য জাতীয় পতাকা 
সংগ্রহ করে আনা। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সােলেমান বিশ্বাস বলেন ১৭ এপ্রিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। এদিনটিতে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে। এই মহতী অনুষ্ঠানে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরে আমি গৌরব বােধ করি। তখন আমি পিরােজপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় সদস্য। ১৬ এপ্রিল বিকাল থেকে প্রচণ্ড গােলাগুলির শব্দে আমরা টের পেলাম যে চুয়াডাঙ্গা থেকে পাকবাহিনীর সদস্যরা মেহেরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। এই মুহূর্তে কি করা উচিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রওনা হলাম বাগােয়ান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব মাহবুব খান ওরফে মৰু গােমস্তার বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখি সার্কেল অফিসার জনাব এস, এস, এম, আনােয়ারুল ইসলাম তার ফ্যামিলিসহ অবস্থান করছেন। সার্কেল অফিসার সাহেবের সাথে আলাপকালে জানতে পারলাম আজ ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে নেতৃবৃন্দ মিটিং করবেন। তখন সকাল আটটা সাড়ে আটটা বাজে। বাগােয়ান থেকে রওনা হলাম বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে। সেখানে দেখি এসডিও জনাব তৌফিকই-এলাহী সাহেবসহ আরাে অনেকেই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। আমাকে দেখেই জনাব তৌফিক-ই-এলাহী বললেন, “চেয়ারম্যান সাহেব কলকাতা থেকে আমাদের নেতৃবৃন্দ আসছেন। কিছুক্ষণ পর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আরম্ভ হবে। কিন্তু জাতীয় পতাকা তাে নেই, আপনি বরং মােটরসাইকেল নিয়ে আনন্দবাস হাইস্কুল, আনন্দবাস প্রাইমারী স্কুল, ও আনন্দবাস ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে সেঁজ করে পতাকার ব্যবস্থা করুন। তৎক্ষণাৎ আমি মােটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পতাকা খোঁজার জন্য। সমস্ত জায়গা খুঁজে আনন্দবাস হাইস্কুল ও আনন্দবাস ইপিআর ক্যাম্প থেকে মােট ২টা পতাকা নিয়ে জনাব তৌফিক-ই-এলাহী সাহেবের হাতে দিলাম। মাইকে ঘােষণা করা হল—’এবার স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করবেন, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আমি আনন্দে শিউরে উঠলাম। আজ এইক্ষণে আমারই সংগৃহীত পতাকা কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতাসে উড়বে। শিল্পীরা জাতীয় সঙ্গীত গাইছেন আর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম আস্তে-আস্তে জাতীয় পতাকা উঠাতে লাগলেন। স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র বাংলায় পাঠ করলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। অস্থায়ী 

সূত্রঃ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর – রফিকুর রশীদ

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!