You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৫ই নভেম্বর, সোমবার, ১৯৭৩, ১৯শে কার্তিক, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান

আগামী ১৬ই নভেম্বর থেকে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হবে। চোরাকারবারী ও মওজুতদারদের অশুভ তৎপরতা বন্ধ এবং জনসাধারণের মধ্যে ধান-চাল সমবন্টনের জন্যেই সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছেন।
গত শনিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী শ্রী ফণীভূষণ মজুমদার বলেছেন যে, সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান সফল করার জন্যে প্রত্যেক মহকুমায় গণ-কমিটি গঠন করা হবে। স্থানীয় এম.পি. কাজ করবেন উপদেষ্টা হিসেবে। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাও এতে থাকবেন।
খাদ্যমন্ত্রী আরো জানান যে, চুয়াত্তর সাল পর্যন্ত আমন ও ইরি ২০ চালের হিসেবে তিন থেকে চার লক্ষ টন সংগ্রহ করার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। ১৯৪৩ সালের ধান কল নিয়ন্ত্রণ আদেশ বলে সীমান্তের দশ মাইল ভেতরে উৎপাদিত সমস্ত ধান-চাল সরকার একচেটিয়াভাবে কিনবেন। ১৯৪৮ সালের খাদ্য সংগ্রহ ও বিলি আইন সীমান্তের দশ মাইলের ভেতর পর্যন্ত কার্যকরী থাকবে। প্রয়োজন হলে দেশের অভ্যন্তরেও এই আইন কার্যকর করা হবে।
সরকার ধান-চাল সংগ্রহ করার যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব ‍জিল্লুর রহমান এক বিবৃতিতে সরকারের খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযানের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করে বলেন যে, খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলার এটি একটি বলিষ্ঠ ও বাস্তব পদক্ষেপ। তিনি দেশবাসী, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ কর্মী ও জাতীয় সংসদ সদস্যদের প্রতি খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযানকে সফল করে তোলার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
কথায় বলে যার শেষ ভালো তার সব ভালো। সরকার যে শুভ উদ্যোগ নিয়েছেন তা সফল হোক এটা আমরাও চাই। দেশবাসীও চায়। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে কতকগুলো প্রশ্ন উত্থাপিত হবে। ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান এমন একটি কাজ যা সামান্যতম ভুল, অবহেলা বা অযোগ্যতার জন্যে ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে। আর তাই যদি হয় তাহলে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হবে সরকারকে।
ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই অসাধু ব্যবসায়ী, চোরাকারবারী আর মওজুতদাররা তৎপর হয়ে উঠবে। তাদের লক্ষ্য হবে সরকারী প্রচেষ্টাকে বানচাল করে দেওয়া। এমতাবস্থায় নামতে হবে আট ঘাট বেঁধেই। আমরা যতদূর জানি, এবারে রেকর্ড পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা এ জাতীয় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে ধান-চালের দাম কমবে।
খাদ্যমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, যেসব চাষী এই অভিযান সফল করার জন্যে সহযোগিতা করবেন কৃষি ঋণ, সার, কীটনাশক ওষুধ ও বীজলাভের ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তাদের খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে সার্টিফিকেট ইস্যু করা হবে। এই সার্টিফিকেট অতিরিক্ত উৎপাদনকারী চাষীদের বেলায় প্রযোজ্য হবে। তবে যে সব চাষীর উৎপাদনের ঘাটতি থাকবে এবং সরকারের কাছে বিক্রি করার মতো ধান-চাল থাকবে না, কিন্তু সরকারের সাথে সহযোগিতা করবেন তাদেরও কৃষিঋণ, সার, বীজ ও কীটনাশক ওষুধ দেওয়া হবে। যে সব জায়গায় সি.এস.ডি বা এল.এস.ডি’র গুদাম নেই সে সব জায়গায় ধান-চাল ক্রয়ের জন্যে অস্থায়ী কেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যাংকের মাধ্যমে সাথে সাথেই টাকা দেওয়া হবে।
পরিশেষে আমরা একথাই বলবো, এ অভিযানকে সফল করে তোলার দায়িত্ব একদিকে যেমন গণ-কমিটিগুলোর উপর অর্পিত অন্যদিকে সরকারী কর্মচারীদের দায়িত্বও কম নয়। যেসব সুযোগ সুবিধা বিশেষ করে ধান-চালের ন্যায্যমূল্য যাতে চাষী ভাইদের ঘরে গিয়ে পৌঁছে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান সফল হোক এ কামনাই আমরা করছি।

কয়লা সংকট : সময় থাকতে সমাধান করুন

আমাদের এই সংকটাকীর্ণ দেশে নিত্য নতুন সংকটের অন্ত নেই। এক সংকটের ক্ষত শুকোতে না শুকোতেই অপর সংকটের জন্ম হচ্ছে। কল-কারখানায় অচলাবস্থা, রেল চলাচল বন্ধ, সর্বোপরি জাতীয় উন্নয়ন কাজে বিঘ্ন যতোই তীব্রতর হোক না কেন, কয়লা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সীমাহীন ঔদাসীন্যের ফলেই যে আবার নতুন করে কয়লা সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এ বছর ভারত থেকে ছয় লক্ষ ষাট হাজার টন কয়লা আমদানীর কথা ছিলো। কিন্তু কথানুযায়ীতো আমাদের সরকারী আমলারা কাজ কারবার করার প্রয়োজনীয়তা তেমন অনুভব করেন না। তাই দেখা যায়, এ বছর মাত্র চার লক্ষ পঁচাত্তর হাজার টন কয়লা ভারত থেকে আমদানী করা হয়েছে। কিন্তু বাকী এক লক্ষ পঁচাশি হাজার টন কয়লা আনার ব্যাপারে নাকি কর্তৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত কোনো রকম কার্যকর ব্যবস্থাবলম্বন করেন নি। চুক্তি অনুযায়ী আমদানীকৃত কয়লা ভারতীয় ট্রেনে করে বাংলাদেশের সীমান্তে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিলো। রেলওয়ে বগির অভাবে ভারত সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে নি। কিন্তু আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যিক দপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা ভারত থেকে বাকী কয়লা আনার ব্যাপারে নিজস্ব কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করাটাও জরুরী মনে করেননি। কাজেই কয়লার তীব্র সংকটের ফলে কল-কারখানার দরজায় খিল পড়তে শুরু করেছে। উত্তরাঞ্চলের ট্রেন যোগাযোগও সম্পূর্ণ বন্ধ হবার উপক্রম। কয়লা আমদানীর ব্যাপারে বৈদেশিক বাণিজ্য দপ্তরের ব্যর্থতা তো রয়েছেই, আমদানীকৃত কয়লা সুষ্ঠুভাবে বন্টনের ক্ষেত্রেও কয়লা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কারচুপি ও আমলাতান্ত্রিক শৈথিল্য জাতীয় উৎপাদন ও উন্নয়ন কাজে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার কারণ হিসেবে দেখা দিতে বাধ্য। শুধুমাত্র কয়লার অভাবে এ বছরই নয়, আগামী বছরেও উন্নয়ন কাজের উপর থেকে বিঘ্ন দূরীভূত হবেনা বলে আমরা আন্দাজ করছি।
এ ধরনের জরুরী সংকট মোচনের জন্যে তড়িঘড়ি হয়তো একটা ব্যবস্থা শেষতক নেওয়া হবে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, রোগী যখন মুর্মূর্ষু তখন কেন ডাক্তারের জন্যে আকুল আর্তি প্রকাশ করা হয়, সময় থাকতে কি এসব অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন মেটানোর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায় না? স্বাধীনতার পর নানা রকম সংকটের চিত্র আমাদের চোখের সামনে নিত্যদিনই ঝুলন্ত রয়েছে। ইতিপূর্বেও আরো একবার কয়লা সংকট বিপর্যয়ের সূচনা করেছিলো। এবারও সেই কয়লা সংকটের খবরটি তাই আমাদের কাছে বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে। জাতীয় নির্মাণ কার্যের অন্যতম উপকরণ ইট প্রস্তুতের জন্যে প্রয়োজন কয়লার। রেল যোগাযোগের বাহন হিসেবে কয়লা অপরিহার্য। এছাড়া, কল-কারখানা তো কয়লা ছাড়া সচল থাকতে পারে না। অথচ ভাবতে আশ্চর্য লাগছে এই জন্যে যে, কয়লার মতো জরুরী জিনিস আমদানীর ব্যাপারে এ রকম গড়িমসি কেমন করে ঘটছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করছি, ভারত থেকে বাকী কয়লা আনার ব্যাপারে অবিলম্বে ব্যবস্থা করা দরকার এবং কয়লার বন্টন যাতে সুষম হয় সেদিকেও কর্তৃপক্ষকে সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে।

গৃহ সংকট ও বহুতলা ফ্লাট নির্মাণ প্রকল্প

বাসস্থানের তীব্র সংকট লাঘবের পরিকল্পনা অনুসারে রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে বহুতলা বিশিষ্ট ফ্লাট নির্মাণ করে সেগুলো নিম্ন ও উচ্চ আয়ের গৃহহীন ব্যক্তিদের মধ্যে বিক্রি করার প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে বলে গত শনিবার বাংলার বাণীর খবরে প্রকাশ। প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, বাংলাদেশ গৃহনির্মাণ অর্থসংস্থান সংস্থার প্রণীত প্রকল্প অনুযায়ী এই ফ্লাটবাড়ীর মধ্যে উচ্চ আয়ের লোকদের জন্যে প্রতিটি ভবন হবে ১৩ তলা এবং প্রথম অবস্থায় এই কর্মসূচী অনুসারে ৬২৪টি ফ্লাট নির্মাণের লক্ষ্য স্থিরীকৃত হয়েছে। নিম্ন আয়ের লোকদের জন্যে নির্মিতব্য ফ্লাটগুলো হবে ১৫ তলা বিশিষ্ট এবং এগুলো ভাড়া ক্রয়ের ভিত্তিতে বিক্রি হবে।
রাজধানী এবং মহানগরী ঢাকা শহরে সমস্য সংকটের অন্ত নেই। হাজারো সমস্যার মধ্যে অধিক সংকট কোনটি বিবেচনা করলে এক বাক্যে সবাই বলবেন গৃহ সংকট এবং যানবাহনের সমস্যাই সবচাইতে মারাত্মক। গৃহ সংকটের দরুণ শত শত চাকুরীজীবী এবং মফস্বল শহর থেকে আগত লোকদেরকে যে কি নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা বলে শেষ করা যাবে না। উপরন্তু বেশ কিছুদিন থেকে ভাড়াটিয়াদের উপর বাড়ীওয়ালাদের ‘বৈচিত্রময় নির্যাতনে’ ভাড়াটিয়াদের যে কি করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সে খবরও সময়ে সময়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। হয়তো বা তাদের সেই দুরবস্থায় কিছুটা সহানুভূতিশীল হয়েই সরকার একসময় বাড়ী ভাড়া সংক্রান্ত এ প্রেসনোট প্রকাশ করেছিলেন। বহুতলা বিশিষ্ট ভবন তৈরী করে গৃহ সংকটের সমাধান করা হবে বলেও ইতিপূর্বে বেশ ক’বার খবর বেরিয়েছে। গতকালও আবার অনুরূপ খবর বেরিয়েছে। অর্থাৎ এতে এটাই প্রমাণ হচ্ছে অদ্যাবধি সে প্রকল্প ‘বাস্তবায়িত হবে’ পর্যায়েই রয়েছে—তা সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়নের কার্যকর ব্যবস্থা আজও হয়নি।
এতদসংক্রান্ত খবর অনুযায়ী গৃহ নির্মাণ অর্থ সংস্থান সংস্থার প্রণীত পরিকল্পনাটি ভালো সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই পরিকল্পনা কতদিনে বাস্তবায়িত হবে এক্ষণে সেটাই প্রশ্ন। প্রয়োজনের তুলনায় প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পটি নগণ্য হলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বর্তমান গৃহ সংকটের কিছুটা লাঘব হবে এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে আরো সুযোগ ঘটবে বলে আমাদের ধারণা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!