বাংলার বাণী
৯ই আগস্ট, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ২৪শে শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক
বার্মা থেকে বাণিজ্যমন্ত্রী ফিরেছেন। এই সফরে তিনি ভারতীয় বাণিজ্যমন্ত্রী এবং থাইল্যান্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। এ তিনটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং বৃদ্ধির ব্যাপারে তিনি নানা আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। এছাড়া রয়েছে অন্যান্য ক্ষেত্রে এই দেশ সমূহের অভিজ্ঞতা আমাদের দেশে কাজে লাগাবার প্রশ্ন। কর্মঠ বাণিজ্যমন্ত্রী আলোচনার পরিধি সীমাবদ্ধ রাখেননি। আলোচনা হয়েছে বার্মার সমবায় আন্দোলন এবং ভোগ্যপণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পর্কেও। বার্মার অভিজ্ঞতা স্বচক্ষে দেখে আসবার জন্য আমাদের দেশ থেকে কিছু কর্মী আর কর্তাব্যক্তিদেরও সেখানে পাঠানো হবে বলে বাণিজ্যমন্ত্রী বক্তব্য রেখেছেন।
ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ের কিন্তু অন্য ব্যাপারে। বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে। আলোচনা হয়েছে তার কথায় ‘সে বাণিজ্য কেমন করে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে’ তা নিয়ে। আলোচনায় তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন। আশা প্রকাশ করেছেন যে ভবিষ্যতে এ দু’টি দেশের বাণিজ্য সুষ্ঠুভাবে হবে, কোন অন্তরায় ঘটবে না। আমরা তার কথায় আশ্বস্ত হয়েছি, আশান্বিত হয়েছি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং বৃদ্ধির ব্যাপারে যে সম্ভাবনাময় চিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন।
বাণিজ্যিক সম্পর্ক আসলে আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল। যে যে ক্ষেত্রে উৎপাদন আমাদের চাহিদা সীমাকে ছাড়িয়ে যাবে তাই বিদেশের বাজারে আমরা রপ্তানী করতে পারবো। আর উৎপাদন যদি আমাদের চাহিদা পরিপূরণে ব্যর্থ হয় তবে প্রশ্ন আসে, বিদেশ থেকে সে পণ্য আমদানীর। ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট এবং সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন সম্ভব হয়নি। তাই নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসের জন্যই আমাদের বিদেশের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। অনুন্নত একটি রাষ্ট্রের সাধারণ নিয়মেই যা কিছু আমরা বিদেশে রপ্তানী করছি তার অধিকাংশই কাঁচামাল।
বিদেশে আমাদের পণ্যের যতটুকু চাহিদা রয়েছে ততটুকুও সরবরাহ করা আমাদের পক্ষে এখন সম্ভব হচ্ছে না।
এটাকে সম্ভব করে তোলার জন্য যে প্রচেষ্টা থাকা দরকার তা-ই কি আর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে; কিন্তু কি করে? গত বাণিজ্য মওসুমে বাণিজ্য নিয়ে যে সকল কেলেংকারী আমাদের দেশে ঘটে গেছে এবার তা বন্ধ করবার কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থা কি গ্রহণ করা হয়েছে? যা ঘটেছে তা হলো বাণিজ্যের পরিমাণ নির্ধারণে সরকারের বাস্তবতাবোধের একটা প্রতিফলন।
সত্যি কথা বলতে কি, এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং বৃদ্ধি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের ভিতর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং বৃদ্ধিরও সহায়ক। প্রথমটায় সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং দূরদৃষ্টির অভাব ঘটলে তা দ্বিতীয়টার উপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বাণিজ্যমন্ত্রী তা বোঝেন। এবং বোঝেন বলেই বাণিজ্য প্রশ্নে নানা কালো দাগগুলো মুছে ফেলবার ব্যাপারে তিনি অক্নান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। তার এ পরিশ্রম সফল হোক এবং তা সফল হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় বাস্তব পন্থাগুলো অনুসৃত হোক এটাই কামনা করি।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং বন্যা
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও কৃষি কাজে আমরা প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হইনি। দুঃখজনক হলেও এ নির্মম সত্যটি আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন আমাদের শুধু স্বপ্ন নয় স্বয়ংসম্পূর্ণতাই আমাদের লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাই নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেছেন : ‘বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী রাখা হবে না।’ বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যের অর্থ অত্যন্ত প্রাঞ্জল। জমি অনাবাদী থাকলে ফসল ফলবে না। ফসল না ফললে সোনার বাংলা সোনায় গড়ে উঠবে কেমন করে? ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যদি সংগ্রাম করতে হয় এবং সেই সংগ্রামে ইপ্সিত সাফল্য যদি আমরা কায়মনোবাক্যে কামনা করি, তা হলে লাঙ্গলকেই প্রধানতম হাতিয়ারে পরিণত করা বাঞ্ছিত। কিন্তু দেখতে হবে, লাঙ্গলধারী কৃষকরা আজ কোন পথে? তাদের সামনে আজ কোন্ সমস্যাটি সবচাইতে বেশী প্রতিবন্ধকতার পাহাড় খাড়া করে রেখেছে। সব সমস্যাকে ছাপিয়ে যে সমস্যাটি আজ খাদ্য উৎপাদন বিঘ্নিত করে চলেছে, তা হচ্ছে সর্বনাশা বন্যার তান্ডবলীলা। বিধ্বংসী বন্যার করালগ্রাসে দেশের চৌদ্দটি জেলাই আজ প্লাবিত হয়ে গেছে। ফসল নষ্ট হয়েছে চার কোটি চব্বিশ লক্ষ তিন হাজার আটশ’ ছত্রিশ একর জমির। ঘরবাড়ী, জানমাল, গবাদি পশুর হিসেব না হয় অনুল্লেখ্যই রইলো। বন্যার তোড়ে উৎপাদিত ফসলের যে ক্ষতি সাধিত হচ্ছে, সে ক্ষতি ইচ্ছে করলেই পূরণ করা যাবেনা। বানের জলে যা ভেসে গেছে, মুখের কথায় সেই ক্ষতিপূরণের সব সম্ভাবনাই সুদূরপরাহত। ফি বছরই বন্যার ছোবলে আমাদের কৃষককূলকে সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে। বছর বছর তাই আমরা খাদ্য সমস্যার যাঁতাকলে পিষ্টিত হয়ে চলেছি। বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্পর্কে সরকারী পর্যায়ে নানা রকম পরিকল্পনা প্রণীত হচ্ছে বলেই আমরা জানি। এ ব্যাপারে সরকারকে যে অনতিবিলম্বেই একটি কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়িত করা একান্ত দরকার তাও আমরা বহুবার বহু কন্ঠে উচ্চারণ করেছি। সরকার বন্যা প্রতিরোধকল্পে নির্বিকার দার্শনিকের মতো ধ্যান মগ্ন হয়ে বসে নেই—‘একটা কিছু’ সুরাহার বন্দোবস্ত করছেন। এমতাবস্থায় কৃষিমন্ত্রী আবদুস সামাদ শস্য উৎপাদনকারী কৃষকদের এক সমাবেশে ঘোষণা করেছেন যে, সবাই মিলে যদি সার্বিক প্রচেষ্টা চালানো হয়, তাহলে নাকি আগামী দুই বৎসরের মধ্যেই আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে ‘কামিয়াব’ হবো। আমাদের কৃষিমন্ত্রী মহোদয় খুবই আশাবাদীর মতো উচ্চারণ করেছেন। এবং এই উক্তি নাকি তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে প্রাণে বিশ্বাসও করেন। বলা বাহুল্য যে, আমরা কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ের এহেন মন্তব্যে তাজ্জব বনেছি। এ কথা অবশ্যই সত্য যে, প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়নকারীরা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার কথা বলেছেন। কিন্তু আমাদের কৃষিমন্ত্রী সাহেব খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্পর্কে তাঁর ভাষ্যে কয়েক ডিগ্রী এগিয়ে রয়েছেন, লক্ষ্য করে আমরা রীতিমতো প্রমাদ গুণছি। কারণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন চাট্টিখানি কথা নয়। কারো মুখের কথায় আর যাই হোকনা কেন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা কস্মিনকালেও অর্জিত হবেনা। দেশের কৃষককূলের সামনে আজ নানা সমস্যা বাহু বিস্তার করে রয়েছে। বন্যা সমস্যা ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের অন্যতম অন্তরায় হিসেবে বিরাজ করছে। বন্যা সমস্যা যেমনি রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব নয়, তেমনি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনও সম্ভব নয়। হাততালি কুড়ানোর জন্যে দুই বছরের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ঘোষণাটি আমাদের কৃষিমন্ত্রী মহোদয় না দিলেই পারতেন। কারণ মিথ্যে আশ্বাস কারো পেট ভরেনা। আর খাদ্য সমস্যা নিয়ে কারচুপি কিংবা প্রহেলিকা সৃষ্টিরও কোন মানে হয়না। খাদ্য সমস্যা সম্পর্কে আজ আমরা প্রত্যেকেই অবগত। আমরা চাই, আমাদের খাদ্যশস্য দিয়েই যেন আমরা নিজেদের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করতে পারি। আমাদের যেন অন্য কোন দেশের কাছে হাত পাততে না হয়।
শাহজীর শাদী মোবারক!
ইরানের শাহজী আবার শাদী করেছেন। তাঁর এই দয়িতা কোন্ বা দেশের কন্যে (রাজকন্যে নয় নিশ্চয়ই) তা এখনো জানা যায়নি। লেবাননের বামপন্থী দৈনিক আল মোহারের এক খবরের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকান্তরে বলা হয়েছে, শাহজী এক অজ্ঞাত কুলশীল রমণীকে শাদী করেছেন। তাঁর নব পরিণীতা বধুয়ার নামটিও এখনো জানা যায়নি। অতি সঙ্গোপনে শাহজী তাঁর এই নতুন এবং একুনে তিন নম্বরের শাদী মোবারকের কর্মটি সমাধা করেছেন। অবশ্য তাঁর এই শাদীর ফলে তাঁর বর্তমান মহিষী ও বিশ্বের অন্যতমা সুন্দরী রাজবধূ ফারাহ দিবার পদবী ও আইনগত মর্যাদা অক্ষুন্নই থাকবে। কাজেই শাহজীর মতে, ফারাহর এ বিয়েতে ক্ষুন্ন হবার কোন কারণ নেই।
শাহজীর বিয়েতে ফারাহ দিবার কথা বাদ দিলেও আর কারোও মনঃক্ষুন্ন হবার কিছু নেই। কেননা বয়স যতই বাড়ছে—শাহজীর ভীমরতিটাও যেন ততটা বাড়ছে। তাঁর সেই ভীমরতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কেউ তাঁর এই শাহী মোবারকটাকে চিহ্নিত করলেও তাতে কারো কিছু যায় আসে না।
শাহজী সম্প্রতি ব্যাপকভাবে মার্কিন মুল্লুক সহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন। সওদা করেছেন। তাঁর নব-পরিণীতাকে সাজাবার সওদার কোন তালিকা এতে ছিলো কি না, তা কারো জানা না থাকলেও তাঁর ইরানকে সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত করার এক বিরাট সওদা তালিকা কিন্তু এ সময় তাঁর হাতে ছিলো। এ তালিকা অনুযায়ী সমরাস্ত্রের সওদা কিনতে গিয়ে তাঁকে ব্যয় করতে হয়েছে ২৫০ কোটি ডলার। পেন্টাগন ভান্ডারের বাছাই করা সমর অলঙ্কারগুলো তিনি সওদা করেছেন। ৮ খানা অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান ছাড়াও ৮০টি ট্যাংক রয়েছে এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া মার্কিন সমরাস্ত্র ভান্ডারে এমন কোন অস্ত্র নেই—যা শাহজী তাঁর ইরানের ভান্ডারে এনে তোলেননি।
বস্তুতঃ শাহী মোবারক শাহজীকে এখন যেন নেশাগ্রস্ত করে তুলেছে। শাদীর নামে তিনি দিওয়ানা। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে নিজের দেশ আর দেশের ঐশ্বর্যকে শাদী দিয়ে উপঢৌকন পাওয়া সমরাস্ত্রের অলঙ্কারের বলে তিনি এখন পারস্যোপসাগরীয় এলাকা তো বটেই পাকিস্তানের বেলুচিস্তানকেও শাদী করার জন্য যারপরনাই—বেশক বেচইন হয়ে রয়েছেন। তিনি এখন বনে গেছেন পারস্যোপসাগরীয় এলাকার স্বঘোষিত অভিভাবক। বেলুচিস্তানের ব্যাপারে তাঁদের আঁতাতের কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ও আফগানিস্তানে নতুন প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠিত হওয়ায় আপাততঃ তিনি সে দিকটার ক্ষেত্রে নিরস্ত হয়েছেন বলেই অনুমিত হয়।
যাইহোক, কথা হচ্ছে শাহজীর এই তেসরা নম্বরের শাদী নিয়ে। বস্তুতঃ ইরানের তেল ও পারস্যোপসাগরী এলাকার বাণিজ্যিক বন্দরগুলোর মাধ্যমে অর্জিত অর্থে মার্কিন সমর সম্ভারে নিজ দেশকে সুসজ্জিত করার পর বর্তমান বিশ্বে শাহজীই সম্ভবতঃ একমাত্র রাজন্য যিনি বেশ খোশহালতেই দিন গোজরান করছেন। তাছাড়া মার্কিন প্রভুরা তো আছেনই। অতএব ভয় কিসের! তিনি এবার হয়তো চতুর্থ নম্বরের শাদীর আয়োজনও করতে পারেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক