You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৮শে জুন, শনিবার, ১৪ই আষাঢ়, ১৩৮১

সমুদ্রের সীমানা

আকাশের গ্রহরাজ্যে মানুষের অভিযান যেমন চলছে তেমনি চলছে সমুদ্রের তলদেশও। উদ্দেশ্য একটাই। যদি কোন সম্পদের সন্ধান পাওয়া যায়। গ্রহরাজ্যে এখনও সম্পদ মেলেনি। সমুদ্র তলদেশে মিলেছে। অফুরন্ত সম্পদের সম্ভাবনাও রয়েছে। বিশেষ করে তেল সংকটের জন্য এ প্রচেষ্টা আরো জোরদার হয়েছে। তেল সম্পদ আহরণের চেষ্টা চলছে সমুদ্রের তলদেশে, সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায়। বিশেষজ্ঞদের মতে সমুদ্র সম্পদ আহরিত হলে বর্তমান সমস্যা ও সংকটের সুরাহা হবে অনেকটা। অন্ততঃ মানুষ খেয়ে পরে বাঁচতে পারবেন। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ লাভের চেষ্টা চলছে সমুদ্রের তলদেশে অবস্থিত বিভিন্ন খাদ্য সংগ্রহের মাধ্যমে। সমুদ্রের জলজ সম্পদের মধ্যে কতটা খাদ্যপ্রাণ আছে তা নিয়ে বৈজ্ঞানিকরা ভাবনা চিন্তা করছেন। গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক কথায় বলতে গেলে সমুদ্র সম্পদের প্রতি ছোট বড় সকল দেশের দৃষ্টিই নিবন্ধন রয়েছে। আর তাই নিয়ে শুরু হয়েছে সমুদ্রের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিষয়ে আলাপ-আলোচনা এবং এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য গত বৃহস্পতিবার থেকে কারাকাসে শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী সম্মেলন। এ সম্মেলনে পেরুর প্রেসিডেন্ট পুরান ভেলাসিকা বলেছেন, সমুদ্রসীমা আইনের ব্যাপারে বৃহৎ শক্তিগুলো যদি ছোট ছোট দেশগুলোর ওপর শর্ত আরোপ করতে চায় তাহলে বিশ্ব সমুদ্র সংগঠন থেকে তাদের বহিষ্কার করা হবে।
তিনি আরো বলেছেন যে. ধনী দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোর দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে নিজেদের স্বার্থদ্ধায়ের খেলায় মেতে ওঠে। দারিদ্র্য দূরীকরণের নামে তারা যে সাহায্য প্রদান করে শেষ পর্যন্ত সাহায্য গ্রহণকারী দেশগুলোর পক্ষে তা গলার কাটা হয়ে দাঁড়ায়। শর্তহীন সাহায্য তারা কেউ করে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলোর সমুদ্রসীমা ২শ নটিক্যাল মাইল বলে বিভিন্ন দেশ প্রত্যক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু স্বীকার করার পরও সমুদ্রসীমার মধ্যে যে কোন দেশকে মাছ ধরার অধিকার দিতে হবে এ দাবি তোলা হয়েছে কোন কোন দেশের পক্ষ থেকে। অথচ এটা যে পরোক্ষভাবে সমুদ্র সীমা লংঘন ও আধিপত্য বিস্তারের নামান্তর তা মেনে নিতে চান না কেউ। কারাকাস সম্মেলনেও এমনি ধরনের শর্ত আরোপ করা হয়েছে। ফলে এ নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক।
এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, বৃহৎ শক্তিবর্গের বিভিন্ন সময়ে সমুদ্রে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছে। দিয়াগো গার্সিয়াতে মার্কিন নৌঘাঁটি নির্মাণের প্রতিষ্ঠা তার একটি নমুনা। দিয়াগো গার্সিয়াতে মার্কিন নৌঘাঁটি নির্মাণের ফলে যে সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলোর শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে একথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার মেনে নিতে নারাজ। তাই বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের মুখেও মার্কিন সরকার ও ন্যক্কারজনক প্রচেষ্টা থেকে নিবৃত্ত হয়নি। স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে বৃহৎ শক্তিবর্গের সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তারের মারাত্মক প্রবণতার বদৌলতে সমুদ্রতীরবর্তী দেশগুলোর অস্তিত্ব আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ছোট ছোট দেশ তথা সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলোকে আজ সম্মিলিতভাবে আওয়াজ তুলতে হবে যে মাছ ধরার নামে অথবা ছল ছুতো করে সমুদ্র সীমা লংঘন করা চলবে না। এবং এ বক্তব্যকে বাস্তবায়িত করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলোর মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য।

ওষুধ শিল্পের সংকট

ওষুধ সংকট জনিত অভাব-অভিযোগ আজকাল প্রায়ই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ পাওয়া যায় না, যা পাওয়া যায় তার কালোবাজারি দাম অত্যাধিক, ওষুধ পাচার হচ্ছে, আমদানিকৃত ওষুধের বিতরণ ব্যবস্থা শোচনীয় ইত্যাকার সংবাদের প্রতিবেদন দেখতে দেখতে আমরা এখন প্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তবে শারীরিক দিক থেকে ওষুধের অভাবজনিত ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্ভাবনার জন্য বহুকোষ বিশিষ্ট দেহ যন্ত্রটি অভ্যস্ত হয়ে পড়তে পারেনি। তাই ওষুধ সংক্রান্ত প্রতিবেদন আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
পত্রিকান্তরে প্রতিবেদনে প্রকাশ, কাঁচামালের অভাবে দেশের ওষুধ শিল্প আজ চরম বিপর্যয়ের মুখে। প্রতিবেদনসূত্র জানাচ্ছে যে, একমাত্র কাঁচামালের অভাবে আগামী অক্টোবর মাসের মধ্যে দেশীয় ১৬০টি ওষুধ কারখানার অধিকাংশ সম্পূর্ণ এবং আংশিক উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ ওষুধ কারখানাগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের শতকরা ৯৯ ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সেই কাঁচামাল প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। ফলে যে পরিমাণ কাঁচামাল এখন মজুদ আছে এবং ১৯৭৩ সালের জুলাই ডিসেম্বর শিপিং পিরিয়ডের যে পরিমাণ কাঁচামাল আমদানির পথে তা এসে পৌঁছলেও দেশের ১৬০টি ওষুধ কারখানায় অক্টোবর পর্যন্ত ওষুধ উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। তদুপরি ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি-জুন শিপিং পিরিয়ডের জন্য নির্ধারিত কাঁচামাল দেশে এসে পৌছবে কবে তারও ঠিক নেই। এবং যে পরিমাণ কাঁচামাল জানুয়ারি-জুনের আসার কথা তা দেশীয় ঔষধ কারখানাগুলোর প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ৬/৭ ভাগ। পরিস্থিতি দৃষ্টে মনে হয় যে, ওষুধ সংকটের এই অক্টোপাস বন্ধনী সামগ্রিকভাবে দেশের ওষুধ শিল্পকে অনিবার্যভাবে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে।
আমাদের দেশে বর্তমানে প্রতি বছর ৪০ কোটি টাকার ওষুধ প্রয়োজন। এ চাহিদা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অঙ্গীভূত সরকারের গণ স্বাস্থ্য প্রকল্প কার্যকরী হলে আগামী ১৯৭৮ সালের দিকে গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় দুশো কোটি টাকায়। অথচ কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে এই বাস্তবতা উপেক্ষিত হচ্ছে। সংবাদ সূত্রটি আরও জানাচ্ছে যে, বর্তমানে দেশীয় ওষুধ কারখানাগুলোর জন্য কাঁচামাল আমদানির যে লাইসেন্স সরকার দিচ্ছেন টাকার দিক দিয়ে তা স্বাধীনতা-পূর্ব আমলের সমান পরিমানের। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম ১৯৭০ সালের তুলনায় বর্তমানে শতকরা প্রায় ১৬০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ওই টাকায় স্বাধীনতা-পূর্ব যতটা পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করা যেতো বর্তমানে সে টাকায় তার চেয়ে শতকরা ৭৫ ভাগ কম কাঁচামাল আমদানি করা সম্ভব।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে (ওষুধ শিল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ) দেশের চাহিদার প্রায় ৭৫ ভাগ ওষুধই দেশীয় কারখানাগুলো মেটাচ্ছে। দেশীয় কারখানাগুলো ১৯৭৩-৭৪ আর্থিক বছরে প্রায় ২৭ কোটি টাকার ঔষধ উৎপাদন করেছে। বিদেশ থেকে ১১ কোটি টাকার ওষুধ আমদানি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহলের অভিমত ওষুধের কারখানাগুলোয় দেশের মানুষের শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ চাহিদা মেটাতে সক্ষম। এবং বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানি না করে ওষুধ তৈরির জন্য কাঁচামাল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি আমদানি করলেই আমদানিকৃত ওষুধের শতকরা ৮০ ভাগই দেশে উৎপাদন করা সম্ভব। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বাজবে কারণ মাত্র আড়াই কোটি টাকা কাঁচামাল আমদানি করলে তা দিয়ে নাকি প্রায় ১১ কোটি টাকার ওষুধ উৎপাদন সম্ভব। তদুপরি প্রয়োজনীয় ঔষধের শতকরা ৭৫ ভাগ কাঁচামাল দেশে উৎপাদন করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্ট মহল জানাচ্ছে। এ জন্যে দেশে পেট্রোকেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ প্রয়োজন। সেদিকে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন দপ্তরের আশু দৃষ্টি পড়ুক। এছাড়াও সমস্যা আছে। আবার একদফা ওষুধ তৈরির কাঁচামালের দাম বাড়লো। আন্তর্জাতিক বাজারে ওষুধ তৈরির কাঁচামাল ও রাসায়নিক দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং দেশে সাম্প্রতিককালে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় ২৪টি কারখানায় উৎপাদিত ওষুধের দাম কোন ক্ষেত্রে শতকরা ২০, কোন ক্ষেত্রে শতকরা ৩০ ভাগ বাড়ানো হয়েছে। পত্রিকান্তরে মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। দেশ আজ সার্বিক সমস্যার আবর্তে নিমজ্জিত-প্রায়। খাদ্য, বস্ত্র, ঠাঁই, ওষুধ সব একত্রে এদেশের নিরীহ জনসাধারণকে আক্রমণ করেছে। এরই মাঝে সর্বত্রই এক শ্রেণীর অসাধু চক্র নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে যাচ্ছে। ফলে এক পক্ষে দেশে ওষুধ শিল্পের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে এবং অন্যপক্ষে জনসাধারণের কষ্ট সীমার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আবার ওষুধের কাঁচামাল আমদানির নামে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করা হয়, কিন্তু তুলনামূলকভাবে অনেক কম টাকায় দেশের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল উৎপাদনের কারখানা গুরুত্ব আরোপ করা হয় না। ফলে আজ ওষুধশিল্প চরম সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহলকে এ ব্যাপারে আর নিষ্ক্রিয় থাকলে চলবে না। ওষুধের উৎপাদন অব্যাহত রাখা, ওষুধ সরবরাহের যথার্থ ব্যবস্থা নেয়া, কাঁচামাল আমদানি, দেশে কাঁচামাল উৎপাদনের কারখানা স্থাপনা, ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সকল দিকেই কল্যাণকামী সক্রিয় দৃষ্টি রাখতে হবে তাদের। কারণ খাদ্য, বস্ত্র ও ঠাঁইর সঙ্গে নিরাময় প্রশ্নটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ বৈকি!

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!