You dont have javascript enabled! Please enable it!
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ
 
১৭ এপ্রিল ১৯৭১ ঐতিহাসিক মুজিবনগরের আম্রকাননে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ ও শপথগ্রহণ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার। শপথগ্রহণের পর অত্যন্ত উৎফুল্ল ও আনন্দ-উদ্দীপনাময় পরিবেশে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় নবগঠিত এ-সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ও সশস্ত্রবাহিনীর চিফ অফ স্টাফের সঙ্গে। পরিচয়পর্বের পর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ উপস্থিত পরিষদ সদস্য, সুধী, দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও বিশ্ববাসীর উদ্দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। সে-দিন তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর ভাষণে বলেন : বাংলাদেশে এখন যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানের উপনিবেশবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন ছাড়া আমাদের হাতে তার কোনাে বিকল্প নেই। বাংলাদেশে গণহত্যার আসল ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারের মুখে বিশ্ববাসীকে অবশ্যই জানতে হবে, কিভাবে বাংলার শান্তিকামী মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতিকেই বেছে নিয়েছিল। তবেই তারা বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে ছয়-দফার আলােকে বাংলাদেশের জন্য স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। ১৯৭০-এ আওয়ামী লীগ এই ছয়-দফা নির্বাচনী ইশতিহারের ভিত্তিতেই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মােট ৩১৩টি আসনের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের স্থলে মােট ১৬৭টি আসন লাভ করেছিল। নির্বাচনী বিজয় এতই চূড়ান্ত ছিল যে, আওয়ামী লীগ মােট শতকরা ৮০ ভাগ ভােট পেয়েছিল। এই বিজয়ের চূড়ান্ত রায়েই আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।  স্বভাবতই নির্বাচন পরবর্তী সময়টি ছিল আমাদের জন্য এক আশাময় দিন। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের এমনি চূড়ান্ত রায় ছিল অভূতপূর্ব। দুই প্রদেশের জন্য একটি গ্রহণযােগ্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভব হবে। তবে সিন্ধু ও পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টি তাদের নির্বাচন অভিযানে ছয়-দফাকে এড়িয়ে গিয়েছিল।
 
কাজেই ছয়-দফাকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার জন্য জনগণের কাছে এই দলের জবাবদিহি ছিল না। বেলুচিস্তানের নেতৃস্থানীয় দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছিল ছয়-দফার পূর্ণ সমর্থক। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রভাবশালী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও ছয়-দফার আলােকে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী ছিল। কাজেই প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজয় সূচনাকারী ১৯৭০এর নির্বাচনে পাকিস্তান গণতন্ত্রের আশাপ্রদ ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত বহন করেছিল। আশা করা গিয়েছিল যে, জাতীয় পরিষদ আহ্বানের প্রস্তুতি হিসেবে প্রধান-প্রধান রাজনৈতিক দল আলােচনায় বসবে। এমনি আলােচনার প্রস্তাব, পাল্টা প্রস্তাবের ওপর গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যা উপস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ সবসময়ই সম্মত ছিল। তবে এই দল বিশ্বাস করেছে যে, যথার্থ গণতান্ত্রিক মূল্যবােধকে জাগ্রত রাখার জন্য গােপন সম্মেলনের পরিবর্তে জাতীয় পরিষদেই গঠনতন্ত্রের ওপর বিতর্ক হওয়া উচিত। এরই প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল যথাসত্বর জাতীয় পরিষদ আহ্বানের জন্য। আওয়ামী লীগ আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে উপস্থাপনের লক্ষ্যে একটি খসড়া গঠনতন্ত্র তৈরির কাজে লেগে গেল এবং এ-ধরনের একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়নের সব আইনগত এবং বাস্তব দিকও তারা পরীক্ষা করে দেখল। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর আলােচনার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারি ১৯৭১-এর মাঝামাঝি সময়ে। এ-বৈঠকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের ছয়-দফাভিত্তিক কর্মসূচিকে বিশ্লেষণ করলেন এবং ফল কী হতে পারে তারও ধারণা নিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। কিন্তু প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্র সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান তার নিজস্ব মন্ত ব্য প্রকাশে বিরত থাকলেন। তিনি এমন এক ভাব দেখালেন যে, ছয় দফায় সাংঘাতিক আপত্তিজনক কিছুই তিনি খুঁজে পান নি। তবে পাকিস্তান পিপলস পার্টির সাথে একটি সমঝােতায় আসার ওপর তিনি জোর দিলেন। পরবর্তী আলােচনা অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং আওয়ামী লীগের সাথে ঢাকায় ২৭ জানুয়ারি ১৯৭১। ভুট্টো ও তার দল আওয়ামী লীগের সাথে গঠনতন্ত্রের উপর আলােচনার জন্য এ-সময়ে কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হয়।
 
ইয়াহিয়ার ন্যায় ভুট্টোও গঠনতন্ত্রের অবকাঠামাে সম্পর্কে কোনাে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আনয়ন করেন নি। বরং তিনি ও তার দল ছয়-দফার বাস্তব ফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে আলােচনার প্রতিই অধিক ইচ্ছুক ছিলেন। যেহেতু এ-ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল না-সূচক এবং যেহেতু এনিয়ে তাদের কোনাে তৈরি বক্তব্যও ছিল না, সেহেতু এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আপােস ফরমুলায় আসাও সম্ভব ছিল না। অথচ দুই দলের মধ্যে মতানৈক্য দূর করার জন্য প্রচেষ্টার দুয়ার সবসময়ই খােলা ছিল। এই আলােচনা বৈঠক ডেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কোন পর্যায় থেকে আপােস ফরমুলায় আসা সম্ভব সে-সম্পর্কেও ভুট্টোর নিজস্ব কোনাে বক্তব্য ছিল না। এখানে একটি কথা আরাে পরিষ্কারভাবে বলে রাখা দরকার যে, আওয়ামী লীগের সাথে আলােচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের কোনাে আভাসও পাকিস্তান পিপলস পার্টি ঢাকা ত্যাগের আগে দিয়ে যাননি। উপরন্তু তারা নিশ্চয়তা দিয়ে গেলেন যে, আলােচনার জন্য সব দরজাই খােলা রয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলােচনার পর পাকিস্তান পিপলস পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে দ্বিতীয় দফায় আরাে অধিক ফলপ্রসূ আলােচনায় বসবেন অথবা জাতীয় পরিষদে তাদের ভিন্নভাবে আলােচনায় বসার জন্য অনেক সুযােগ পাবেন।

পরবর্তী পর্যায়ে ভুট্টোর জাতীয় পারিষদের অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্ত সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করে। তার এ-সিদ্ধান্ত এ-জন্যই সবাইকে আরাে বেশি বিস্মিত করে যে, শেখ মুজিবের দাবি মােতাবেক ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান না-করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোর কথামতােই ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছিলেন। পরিষদ বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘােষণার পর ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য সব দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শনের অভিযান শুরু করেন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে পরিষদের অধিবেশনে যােগদান থেকে বিরত রাখা। এ-কাজে ভুট্টোর হাতকে শক্তিশালী করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর লে. জেনারেল ওমর ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের ওপর পরিষদের অধিবেশনে যােগদান না-করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। ভুট্টো ও লে. জেনারেল ওমরের চাপ সত্ত্বেও পিপিপি ও কাইউম লীগের সদস্যগণ ব্যতীত অপরাপর দলের সব সদস্যই ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদানের জন্য বিমানে পূর্ব বাংলায় গমনের টিকিট বুক করেন। এমনও আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছিল যে, পিপিপি-র বহু সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে ঢাকায় আসতে পারেন।

 
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেও যখন কোনাে কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন জেনারেল ইয়াহিয়া ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘােষণা করেন তাঁর দোস্ত ভুট্টোকে খুশি করার জন্য। শুধু তাই নয়, জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব বাংলার গভর্নর আহসানকেও বরখাস্ত করলেন। গভর্নর আহসান ইয়াহিয়া প্রশাসনে মধ্যজীবী বলে পরিচিত ছিলেন। বাঙালিদের সংমিশ্রণে কেন্দ্রে যে সভা গঠিত হয়েছিল, তাও বাতিল করে সরকারের সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারি জান্তার হাতে তুলে দেওয়া হল। এমতাবস্থায় ইয়াহিয়ার সব কার্যক্রমকে ভুট্টোর সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে বাংলাদেশের গণরায় বানচাল করার প্রয়াস ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। জাতীয় পরিষদই ছিল একমাত্র স্থান, যেখানে বাংলাদেশ তার বক্তব্য কার্যকরী করতে পারত এবং রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করতে পারত। এটাকে বানচাল করার চেষ্টা চলতে থাকে। চলতে থাকে জাতীয় পরিষদকে সত্যিকার ক্ষমতার উৎস না-করে একটা ঠুটো জগন্নাথ-এ পরিণত করার। জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের প্রতিক্রিয়া যা হবে বলে আশা করা হয়েছিল তাই হয়েছে। ইয়াহিয়ার এই স্বৈরাচারী কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সারা বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। কেননা বাংলাদেশর মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনাে ইচ্ছাই ইয়াহিয়া খানের নেই এবং তিনি পার্লামেন্টারি রাজনীতির নামে তামাশা করছেন। বাংলাদেশের জনগণ এটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, এক পাকিস্তানের কাঠামােতে বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের কোনাে সম্ভাবনা নেই। ইয়াহিয়া নিজেই আহ্বান করে আবার নিজেই যেভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন, তা থেকেই বাঙালি শিক্ষা গ্রহণ করেছে। তাই তারা একবাক্যে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপ দিতে থাকেন। শেখ মুজিব এতদসত্ত্বেও সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। ৩ মার্চ অসহযােগ কর্মসূচির আহ্বান জানাতে গিয়ে তিনি দখলদার বাহিনীকে মােকাবিলার জন্য শান্তির অস্ত্রই বেছে নিয়েছিলেন। তখন তিনি আশা করেছিলেন যে, সামরিক চক্র তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ফিরে পাবে।
 
গত ২ ও ৩ মার্চ ঠাণ্ডা মাথায় সামরিক চক্র কর্তৃক হাজার-হাজার নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষ লক্ষ্য করে হত্যা করার মুখে বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করলেন এক নতুন ইতিহাস। বাংলাদেশে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযােগ আন্দোলন যেভাবে এগিয়ে গেছে, মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এত কার্যকরী অসহযােগ আন্দোলন কোথাও সাফল্য লাভ করে নি। পূর্ণ অসহযােগ আন্দোলন চলেছে দেশের সর্বত্র। নতুন গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য পাওয়া গেল না হাইকোর্টের কোনাে বিচারপতি। পুলিশ ও পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসসহ গণপ্রশাসন বিভাগের কর্মচারীগণ কাজে যােগ দিতে অস্বীকার করেন। জনগণ সেনাবাহিনীর সরবরাহ বন্ধ করে দিল। এমনকি সামরিক দপ্তরের বেসামরিক কর্মচারীগণ তাদের অফিস বয়কট করলেন। কেবল কাজে যােগদান থেকে বিরত থেকেই তারা ক্ষান্ত হলেন না। বেসামরিক প্রশাসনও পুলিশ বিভাগের লােকেরা সক্রিয় সমর্থন ও নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন শেখ সাহেবের প্রতি। তারা স্পষ্টভাবে ঘােষণা করলেন যে, আওয়ামী লীগ প্রশাসনের নির্দেশ ছাড়া তারা অন্য কারাে নির্দেশ মেনে চলবেন না। এ-অবস্থার মুখখামুখি হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন না-হয়েও অসহযােগের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণে আওয়ামী লীগ বাধ্য হল। এ-ব্যাপারে শুধু আপামর জনগণই নয়, বাংলাদেশের প্রশাসন ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনও তারা লাভ করেছিলেন। তাঁরা আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলি সর্বান্তকরণে মাথা পেতে মেনে নিলেন এবং সমস্যাবলির সমাধানে আওয়ামী লীগকে একমাত্র কর্তৃপক্ষ বলে গ্রহণ করলেন। অসহযােগ আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ফাটল ধরলে দেখা দেয় নানাবিধ দুরূহ সমস্যা।
 
কিন্তু এ-সব সমস্যার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দপ্তরের কাজ যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের কোনাে আইনানুগ কর্তৃপক্ষ না থাকা সত্ত্বেও পুলিশের সহযােগিতায় আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকগণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় যে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন, তা স্বাভাবিক সময়েও অন্যদের অনুকরণীয় হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ ও ঐতিহাসিক অসহযােগ আন্দোলনের প্রতি জনগণের সর্বাধিক সমর্থন দৃষ্টে জেনারেল ইয়াহিয়া তার কৌশল পাল্টালেন। ৬ মার্চ ইয়াহিয়াকে একটা কনফ্রন্টেশনের জন্য উত্তেজনা সৃষ্টিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হল। কেননা তার ঐদিনের প্ররােচনামূলক বেতার বক্তৃতায় সঙ্কটের সম্পূর্ণ দায়িত্ব চাপালেন আওয়ামী লীগের ওপর। অথচ যিনি ছিলেন সঙ্কটের স্থপতি, সেই ভুট্টো সম্পর্কে তিনি একটি কথাও বললেন। মনে হয় তিনি ধারণা করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন। অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তা নির্মূল করার জন্য ঢাকায় সেনাবাহিনীকে করা হয় পূর্ণ সতর্কীকরণ। লে. জেনারেল ইয়াকুব খানের স্থলে পাঠানাে হল লে. জেনারেল টিক্কা খানকে। এই রদবদল থেকে সামরিক জান্তার ঘৃণ্য মনােভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু ইতােমধ্যে মুক্তিপাগল মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য পাগল হয়ে ওঠে। এ সত্ত্বেও শেখ মুজিব রাজনৈতিক সমাধানের পথে অটল থাকেন। জাতীয় পরিষদে যােগদানের ব্যাপারে তিনি যে ৪-দফা প্রস্তাব পেশ করেন, তাতে যেমন একদিকে প্রতিফলিত হয়েছে জনগণের ইচ্ছা, অপরদিকে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌছানাের জন্য ইয়াহিয়াকে দেওয়া তাঁর শেষ সুযােগ। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটি অবশ্যই সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট নিরসনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ইয়াহিয়া ও তার জেনারেলদের ছিল না। তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে সামরিক শক্তিকে জোরদার করার জন্য কালক্ষেপণ করা। ইয়াহিয়ার ঢাকা সফর ছিল আসলে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এটা আজ পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছে যে, অনুরূপ একটি সঙ্কট সৃষ্টির পরিকল্পনা বেশ আগেভাগেই নেওয়া হয়েছিল।
 
১ মার্চের ঘটনার সামান্য কিছু আগে রংপুর থেকে সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়ােজিত ট্যাঙ্কগুলাে ফেরত আনা হয়। ১ মার্চ থেকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানি কোটিপতি ব্যবসায়ী পরিবারসমূহের সাথে সেনাবাহিনীর লােকদের পরিবার-পরিজনদেরকেও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাননা হতে থাকে। ১ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি গড়ে তােলার কাজ ত্বরান্বিত করা হয় এবং তা ২৫ মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলে। সিংহলের পথে পিআইএ-র কমার্শিয়াল ফ্লাইটে সাদা পােশাকে সশস্ত্র বাহিনীর লােকদের বাংলাদেশে আনা হল। অস্ত্র ও রসদ এনে বাংলাদেশে স্কপিকৃত করা হয় সি-১৩০ পরিবহন বিমানগুলাের সাহায্যে। হিসাব নিয়ে জানা গেছে, ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে প্রয়ােজনীয় সরঞ্জামসহ অতিরিক্ত এক ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে আনা হয়। সমগ্র বিমানবন্দর এলাকার আর্টিলারি ও মেশিনগানের জাল বিস্তার করা হয়। যাত্রীদের আগমন-নির্গমনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা চালু করা হয়। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও হত্যাকাণ্ড সংগঠনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত একদল এসজি কমান্ডাে গ্রুপকে বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২৫ মার্চের পূর্ববর্তী দুই দিনের ঢাকা ও সৈয়দপুরে যে-সব কুকাণ্ড ঘটে, এরাই সেগুলাে সংঘটিত করেছিল। সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে একটা উত্তেজনার পরিবেশ খাড়া করাই ছিল এ-সবের উদ্দেশ্য প্রতারণা বা ভণ্ডামির এই স্ট্র্যাটেজি গােপন করার অংশ হিসেবেই ইয়াহয়া শেখ মুজিবের সাথে তার আলােচনায় আপােসমূলক মনােভাব গ্রহণ করেছিলেন। ১৬ মার্চ আলােচনা শুরু হলে ইয়াহিয়া তৎপূর্বে যা ঘটেছে, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের সাথে আলােচনার এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হস্তান্তরের ৪-দফা শর্তের প্রতি সামরিক জান্তার মনােভাব কী?
 

জবাবে ইয়াহিয়া জানান যে, এ-ব্যাপারে তাদের তেমন কোনাে আপত্তি নেই। তিনি আশা করেন যে, ৪-দফা শর্তপূরণের ভিত্তিতে উভয়পক্ষের উপদেষ্টাগণ একটা অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হবেন। আলােচনাকালে যে-সব মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়, সেগুলাে হলাে : ১. সামরিক আইন প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের একটি ঘােষণার মাধ্যমে একটা বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। ২. প্রদেশগুলােতে সংখ্যগরিষ্ঠ দলসমূহের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। ৩. ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন এবং ৪. জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যগণ পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন। আজ ইয়াহিয়া ও ভুট্টো জাতীয় পরিষদের পৃথক-পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাবের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইয়াহিয়া নিজেই ভুট্টোর মনােরঞ্জনের জন্য এ-প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ-প্রস্তাবের সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া সে-দিন নিজেই বলেছিলেন যে, ছয়-দফা হল বাংলাদেশের এবং কেন্দ্রের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নির্ভরযােগ্য নীলনকশা। পক্ষান্তরে, এটার প্রয়ােগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সৃষ্টি করত নানারূপ অসুবিধা। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানি এম.এন.এ-দের পৃথকভাবে বসে ছয়-দফার ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র ও এক-ইউনিট ব্যবস্থা বিলােপের আলােকে একটা নতুন ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তােলার সুযােগ অবশ্যই দিতে হবে। শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যকার এই নীতিগত মতৈক্যের পর একটি মাত্র প্রশ্ন থেকে যায়, তা হল অন্তর্বর্তী পর্যায়ে কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন। এক্ষেত্রেও উভয়পক্ষ এই মর্মে একমত হয়েছিলেন যে, মােটামুটি তার আলােকেই কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন হবে। অন্তর্বর্তীকালীন মীমাংসার এই সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম.এম. আহমদকে বিমানে করে ঢাকা আনা হয়। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ-আলােচনায় তিনি স্পষ্টভাবে এ-কথা বলেন যে, রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ছয়-দফা কার্যকরী করার প্রশ্নে দুর্লজ্জ কোনাে সমস্যা দেখা দেবে না, এমনকি অন্তর্বর্তী পর্যায়েও না। আওয়ামী লীগের খসড়ার ওপর তিনি যে-তিনটি সংশােধনী পেশ করেছিলেন, তাতে এ-কথাই প্রমাণিত হয় যে, সরকার ও আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন যে ব্যবধানটুকু ছিল, তা নীতিগত নয় বরং কোথায় কোন শব্দ বসবে সে-নিয়ে। ২৪ মার্চের বৈঠকে ভাষায় সামান্য রদবদলসহ সংশােধনীগুলাে আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে।

 
অতঃপর অন্ত বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র চূড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শেষ দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পথে আর কোনাে বাধাই ছিল না। এ-প্রসঙ্গে একটা জিনিস পরিষ্কার হয় নি। ইয়াহিয়া বা তার উপদেষ্টারা আভাস-ইঙ্গিতেও এমন কোনাে কথা বলেন নি যে, তাদের এমন একটা বক্তব্য আছে, যা থেকে তারা নড়চড় করতে পারেন না। গণহত্যাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত ছত্রছায়ার প্রশ্নেও আজ জোছুরির আশ্রয় নিয়েছেন। আলােচনায় তিনি ও তার দলবল একমত হয়েছিলেন যে, ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল, তিনিও প্রস্তাবের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইয়াহিয়া নিজেই ভুট্টোর মনােরঞ্জনের জন্য এ-প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ-প্রস্তাবের সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া সে-দিন নিজেই বলেছিলেন যে, ছয়-দফা হল বাংলাদেশের এবং কেন্দ্রের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নির্ভরযােগ্য নীলনকশা। পক্ষান্তরে, এটার প্রয়ােগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সৃষ্টি করত নানারূপ অসুবিধা। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানি এম.এন.এ-দের পৃথকভাবে বসে ছয়-দফার ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র ও এক-ইউনিট ব্যবস্থা বিলােপের আলােকে একটা নতুন ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তােলার সুযােগ অবশ্যই দিতে হবে। শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যকার এই নীতিগত মতৈক্যের পর একটি মাত্র প্রশ্ন থেকে যায়, তা হল অন্তর্বর্তী পর্যায়ে কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন।
এক্ষেত্রেও উভয়পক্ষ এই মর্মে একমত হয়েছিলেন যে, মােটামুটি তার আলােকেই কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন হবে। অন্তর্বর্তীকালীন মীমাংসার এই সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম.এম. আহমদকে বিমানে করে ঢাকা আনা হয়। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ-আলােচনায় তিনি স্পষ্টভাবে এ-কথা বলেন যে, রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ছয়-দফা কার্যকরী করার প্রশ্নে দুর্লজ্জ কোনাে সমস্যা দেখা দেবে না, এমনকি অন্তর্বর্তী পর্যায়েও না। আওয়ামী লীগের খসড়ার ওপর তিনি যে-তিনটি সংশােধনী পেশ করেছিলেন, তাতে এ-কথাই প্রমাণিত হয় যে, সরকার ও আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন যে ব্যবধানটুকু ছিল, তা নীতিগত নয় বরং কোথায় কোন শব্দ বসবে সে-নিয়ে। ২৪ মার্চের বৈঠকে ভাষায় সামান্য রদবদলসহ সংশােধনীগুলাে আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে। অতঃপর অন্ত বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র চূড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শেষ দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পথে আর কোনাে বাধাই ছিল না। এ-প্রসঙ্গে একটা জিনিস পরিষ্কার হয় নি।
 

ইয়াহিয়া বা তার উপদেষ্টারা আভাস-ইঙ্গিতেও এমন কোনাে কথা বলেন নি যে, তাদের এমন একটা বক্তব্য আছে, যা থেকে তারা নড়চড় করতে পারেন না। গণহত্যাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত ছত্রছায়ার প্রশ্নেও আজ জোছুরির আশ্রয় নিয়েছেন। আলােচনায় তিনি ও তার দলবল একমত হয়েছিলেন যে, ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল, তিনিও পাকিস্তানে সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে তিনি তাদেরকে দিয়ে গেলেন বাঙালি হত্যার এক অবাধ লাইসেন্স। কেন তিনি এই বর্বরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, পরদিন রাত ৮টার সময় বিশ্ববাসীকে জাননাে হল এর কৈফিয়ত। এই বিবৃতিতে তিনি নরমেধযজ্ঞ সংগঠনের একটা ব্যাখ্যা বিশ্ববাসীকে জানালেন। তাঁর বক্তব্য একদিকে ছিল পরস্পরবিরােধী এবং অন্যদিকে ছিল মিথ্যার বেসাতিতে ভরা। মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগেও যে-দলের সাথে তিনি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলাপ আলােচনা চালাচ্ছিলেন, সে-দলের লােকদের দেশদ্রোহী ও দলটিকে অবৈধ ঘােষণার সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বা আলাপ-আলােচনায় কোনাে সঙ্গতি খুঁজে পেল না বিশ্ববাসী। বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল ও জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগুরু আসনের অধিকারী আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘােষণা করে গণপ্রতিনিধিদের হাতে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের ওয়াদাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবাধ মতপ্রকাশের প্রতি তামাশা ছাড়া মানুষ আর কিছু ভাবতে পারল না। তাঁর বক্তব্য থেকে এ-কথা স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হল যে, ইয়াহিয়া আর যুক্তি বা নৈতিকতার ছত্রছায়া আশ্রয় নিতে চান না এবং তিনি বাংলাদেশের মানুষকে নির্মূল করার জন্য জঙ্গি আইনের আশ্রয় নিতে বদ্ধপরিকর। পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শত সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তা পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে একটা দুর্লজ্জ প্রাচীর হিসেবে বিরাজ করছে। পূর্ব-পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল, তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন। তাঁরই নির্দেশে তার লাইসেন্সধারী কসাইরা জনগণের ওপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, তা কোনােমতেই একটা জাতীয় ঐক্যের অনুকূল ছিল না। বর্ণগত বিদ্বেষ ও একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল এর লক্ষ্য। মানবতার লেশমাত্রও এদের মধ্যে নেই।

 
উপরওয়ালাদের নির্দেশে পেশাদার সৈনিকরা লজ্জন করেছে তাদের সামরিক নীতিমালা এবং ব্যবহার করেছে শিকারি পশুর মতাে। তারা চালিয়েছে হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ ও নির্বিচারে ধ্বংসলীলা। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এর নজির নেই। এ-সব কার্যকলাপ থেকে এ-কথারই আভাস মেলে যে, ইয়াহিয়া খান ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের মনে দুই পাকিস্তানের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রােথিত হয়ে গেছে। যদি না হত, তা হলে তারা একই দেশের মানুষের ওপর এমন নির্মম বর্বরতা চালাতে পারত না। ইয়াহিয়ার এই নির্বিচার গণহত্যা আমাদের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে অর্থহীন নয়। তার এ-কাজ পাকিস্তানে বিয়ােগান্ত এই মর্মান্তিক ইতিহাসের শেষ অধ্যায়, যা ইয়াহিয়া রচনা করেছেন বাঙালির রক্ত দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়া বা নির্মূল হওয়ার আগে তার গণহত্যা ও পােড়ামাটি নীতির মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে শেষ করে দিয়ে যেতে চায়। ইত্যবসরে ইয়াহিয়ার লক্ষ্য হল আমাদের রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী মহল ও প্রশাসনব্যবস্থাকে নির্মূল করা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কারখানা, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করা ও চূড়ান্ত পর্যায়ে শহরগুলােকে ধূলিসাৎ করা- যাতে একটি জাতি হিসেবে কোনােদিনই আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি। ইতােমধ্যে এ-লক্ষ্যপথে সেনাবাহিনী অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যে বাংলাদেশকে তারা দীর্ঘ ২৩ বছর নিজেদের স্বার্থে লাগিয়েছে, শােষণ করেছে, তাদেরই বিদায়ী লাথির উপহার হিসেবে সেই বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তান থেকে ৫০ বছর পিছিয়ে পড়ল। অসহযােগের পর গণহত্যা- এমন জঘন্যতম ঘটনা আর ঘটে নি। অথচ বৃহৎ শক্তিবর্গ বাংলাদেশের ঘটনার ব্যাপারে উটপাখির নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। তারা যদি মনে করে থাকেন যে, এর দ্বারা তারা পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়তা করেছেন, তা হলে তারা ভুল করছেন। কেননা পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান নিজেও মােহমুক্ত। তাদের বােঝা উচিত যে, পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী স্বাধীন বাংলাদেশে আজ এটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনােবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার-হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিরাষ্ট্রকে লালিত-পালিত করছেন। দুনিয়ার কোনাে জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না।
আজ হােক কাল যােক দুনিয়ার ছােট-বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে; স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে। সুতরাং রাজনীতি এবং মানবতার স্বার্থেই আজ বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিত ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা, তার লাইসেন্সধারী হত্যাকারীদের খাঁচায় আবদ্ধ করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করা। আমাদের সংগ্রামকে সােভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন, তা আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করব। গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও আমরা অনুরূপ সমর্থন আশা করি এবং তা পেলে তাদেরকে অভিনন্দন জানাব। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজ-নিজ পর্যায়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং তারা যদি তা করেন, তাহলে ইয়াহিয়ার পক্ষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর একদিনও হামলা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অষ্টম রাষ্ট্র। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর সৃষ্ট ভগ্ন ও ধ্বংসস্তুপের ওপর একটা নতুন দেশ গড়ে তােলা। এ একটা দুরূহ ও বিরাট দায়িত্ব। কেননা আগে থেকেই আমরা বিশ্বের দরিদ্রতম জাতিসমূহের অন্যতম। এছাড়া একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মানুষ এক ঐতিহাসিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণপণে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণ দিচ্ছে। অকাতরে। সুতরাং তাদের আশা আমরা ব্যর্থ করতে পারি না।

তাদের ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করতেই হবে। আমার বিশ্বাস, যে-জাতি নিজে প্রাণ ও রক্ত দিতে পারে, এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, সে-জাতি তার দায়িত্ব সম্পাদনে বিফল হবে না। এ-জাতির অটুট ঐক্য স্থাপনের ব্যাপারে কোনাে শক্তি, ব্লক বা সামরিক জোটভুক্ত হতে চাই না। আমরা আশা করি শুধুমাত্র বন্ধুত্বপূর্ণ মনােভাব নিয়ে সবাই নিঃসঙ্কোচে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। কারাে তাঁবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এত রক্ত দেয় নি, এত ত্যাগ স্বীকার করছে না। আমাদের এই জাতীয় সংগ্রাম তাই আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং বৈষয়িক ও নৈতিক সমর্থনের জন্য বিশ্বের জাতিসমূহের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি। এ-ব্যাপারে প্রতিটি দিনের বিলম্ব ডেকে আনছে সহস্র মানুষের অকালমৃত্যু এবং বাংলাদেশের মূল সম্পদের বিরাট ধ্বংস। তাই বিশ্ববাসীর প্রতি আমাদের আবেদন আর কালবিলম্ব করবেন না। এই মুহূর্তে এগিয়ে আসুন এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিরন্তন বন্ধুত্ব অর্জন করুন। বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোনাে জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করে নি। জয়বাংলা।

সূত্রঃ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর – রফিকুর রশীদ

 
 
 
 
 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!