You dont have javascript enabled! Please enable it!
উত্তর-মুজিবনগর অধ্যায়
মােটা দাগে ভাগ করলে এ-অধ্যায়কে সােজাসুজি দুই ভাগে ভাগ করা যায়—১. পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর ও বর্বর আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের ব্যাপক সম্প্রসারণ ও ২. নিরস্ত্র বাঙালির সশস্ত্র যুদ্ধের জন্যে সামরিক সংগঠনের প্রতি গুরুত্ব আরােপ, তথা প্রতিরােধযুদ্ধের গতিমুখ পরিবর্তিত হয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে রূপ পরিগ্রহ করা। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ও শপথগ্রহণের পর ১৮ এপ্রিল, রবিবার, সকাল ১০টা থেকে ১টার মধ্যে পাকবাহিনীর প্রবেশ ঘটে মেহেরপুর শহরে। শহরে তখন প্রাণের স্পন্দন নেই বললেই চলে। আগের দিন চুয়াডাঙ্গা আক্রমণের খবরে উৎকণ্ঠিত শহরবাসীর অধিকাংশই প্রিয় শহর ছেড়ে চলে গেছে নিরাপত্তার সন্ধানে। কেউ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে। কেউবা দূর নিভৃত কোনাে পাড়াগাঁয়ে। শহর ত্যাগের এই হিড়িক শুরু হয় ১৪ এপ্রিল, চুয়াডাঙ্গায় বিমান হামলার দিন থেকে। ১৮ এপ্রিল সকাল পর্যন্ত তা একইভাবে অব্যাহত থাকে। পাকসেনারা এ-দিন খুব সকালে চুয়াডাঙ্গা থেকে রওনা হয়ে আমঝুপিতে এসে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। ২৩ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে তারা আমঝুপি থেকেই মেহেরপুর শহরের উদ্দেশ্যে মর্টার থেকে শেল নিক্ষেপ করে। শেলের আঘাতে মেহেরপুরের টিবি হাসপাতাল, ফিসারিজ বিল্ডিং, ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি শেল ওয়াপদা মােড়ে এসে আছড়ে পড়ে। এ-সম্পর্কে ১৯ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত ভারতীয় পত্রিকা যুগান্তরে’ রিপাের্ট ছাপা হয় : কৃষ্ণনগর থেকে পিটিআই’র খবরে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা মেহেরপুর দখলের জন্য অভিযান শুরু করেছে এবং পরবর্তীতে সৈন্যরা মেহেরপুর থেকে চার মাইল দূরে আমঝুপিতে পৌছেছে। আম ঝুপি থেকে ভারতসীমান্ত সাত মাইল দূরে। আমঝুপি থেকে তারা মেহেরপুরের ওপর গােলাবর্ষণ শুরু করেছে। যথার্থ অর্থে শুধু গােলাবর্ষণ নয়, ঐদিন তারা প্রায় প্রতিরােধহীন অবস্থায় মেহেরপুর দখল করে নেয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতি মেহেরপুর কলেজ, ভকেশনাল, নজরুল স্কুলসহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মােড়ে বা স্থানে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে তারপর মনােযােগ দেয় এ-জেলার বিভিন্ন গ্রাম-গ্রামান্তরের প্রতি, এমনকি মাত্র ৪ দিনের মধ্যে তারা বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে আক্রমণ চালানাের মতাে দুঃসাহসও প্রদর্শন করে।
 
ফলে প্রতিরােধযােদ্ধাদের এবার সামরিক সংগঠনের আওতায় এনে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের যােগ্য বীরসেনানী করে তােলার দিকে মনােযােগ দিতেই হয়। গড়ে তুলতে হয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, জোগাড় করতে হয় উপযুক্ত পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র; একইসঙ্গে যুদ্ধ তৎপরতা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়—দুই। ফ্রন্টেই তৎপর থাকতে হয় মুজিবনগর সরকারকে ক. বিপর্যস্ত প্রতিরােধ : গেরিলাযুদ্ধের প্রস্তুতি পাকিস্তানি শাসকদের দীর্ঘদিনের শােষণ বঞ্চনা, অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সমগ্র বাঙালি জাতিকে মুক্তির স্বপ্ন ও প্রত্যাশায় উচ্চকিত করে তােলেন একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর ও কাপুরুষােচিত সশস্ত্র আক্রমণের মুখে নিরস্ত্র বাঙালি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা ও মনােবলের জোরে গড়ে তােলে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোেধ। এমনকি এ-অঞ্চলের লাখাে-লাখাে প্রতিরােধযােদ্ধা কেবল ‘জয়বাংলা রণধ্বনির হুঙ্কারেই কুষ্টিয়া শহরে আগত দুর্ধর্ষ বেলুচ রেজিমেন্টকে সম্পূর্ণ পর্যদস্ত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর নানামুখী আক্রমণ তীব্র হয়ে উঠলে কৌশলগত কারণেই প্রতিরােধযােদ্ধাদের পিছু হটতে হয়। নিরাপদ আশ্রয়, নিজেদের কর্মকাণ্ডে সমন্বয় সাধন, সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র, গােলাবারুদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতে অবস্থান গ্রহণ করতে হয়। বাঙালি জাতির মুক্তির প্রশ্নটি রাজনৈতিকভাবে মীমাংসার সব সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়ায় পাকিস্তান সামরিকজান্তা কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া অসম যুদ্ধ।
ফলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারকে শপথগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই ঐ যুদ্ধ মােকাবিলার জন্য মনােযােগ দিতে হয় সামরিক সংগঠনের দিকে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরােধ পর্যায় পর্যন্ত রাজনৈতিক সংগঠনের ভূমিকা যথেষ্ট হলেও এপ্রিলের শেষ নাগাদ রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে অনিবার্যভাবেই যুক্ত হয় সামরিক সংগঠন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সামান্য সংখ্যক বাঙালি সদস্য নিয়ে গড়ে তােলা হয়। বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী। প্রধান সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের রণাঙ্গনকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সেক্টর কমান্ডার নিয়ােগের মাধ্যমে ইস্ট বেঙ্গল ইপিআর-এর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা নিয়মিত বাহিনীর সদস্য দিয়ে সীমিত সাধ্যের মধ্যেই সীমান্ত এলাকাজুড়ে যুদ্ধের মােকাবিলা শুরু হয়ে যায় নিয়মিত পদ্ধতিতেই। তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় কিছু পুলিশ-আনসারমুজাহিদ। তবু প্রায় তিন-চার ডিভিশন পাকসৈন্যের মুখােমুখি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য সংখ্যাগত এবং কৌশলগত কোনাে দিক থেকেই বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী যে যথেষ্ট নয়—এটা মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠকদের কাছে স্পষ্ট উপলব্ধ হয়। কিন্তু এ-কথা সবার জানা—মুক্তিকামী বাঙালি জাতির সাহস, শক্তি, মনােবল, দেশপ্রেম আছে অপরিমেয়। এর সঙ্গে সামরিক জ্ঞান আর প্রশিক্ষণ যুক্ত হলেই অসম্ভবকে সম্ভব করা সম্ভব।

দেশপ্রেম আর তারুণ্যে ভরপুর অসংখ্য ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিক সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিদিন পাড়ি জমাচ্ছে ভারতে, দাবি জানাচ্ছে প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদের। এদের সুসংগঠিত করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে এপ্রিলের শেষার্ধ থেকেই ভারতীয় সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে ভােলা হয় যুব অভ্যর্থনা কেন্দ্র, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, এমন কি মে মাস থেকেই উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বাছাই করা যুবকদের পাঠানাে হয় সুদূর বিহার প্রদেশের চাকুলিয়ায়। প্রশিক্ষণ শেষে জুন মাসের মাঝামাঝি নাগাদ মুক্তিযােদ্ধারা এসে যুক্ত হতে শুরু করে বিভিন্ন অ্যাকশন ক্যাম্পে। অচিরেই গড়ে ওঠে গণবাহিনী বা গেরিলা বাহিনী। এপ্রিলের শেষার্ধে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল নিয়মিত পদ্ধতিতে, মাত্র মাস দু’য়েক পরে জুনের শেষার্ধ থেকে সেই যুদ্ধ বাঁক পরিবর্তন করে গেরিলা পদ্ধতিতে। আর গণমানুষের আশ্রয়ে, সহযােগিতায়, এমনকি সক্রিয় অংশগ্রহণে এ-যুদ্ধ গণযুদ্ধেরও চারিত্র্য লাভ করে তখন থেকেই।

খ, মেহেরপুরের ছাত্র-যুবকদের অভ্যর্থনা ও প্রশিক্ষণ ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন জেলা মেহেরপুর। কুষ্টিয়া এবং চুয়াডাঙ্গা শক্র দখলে চলে যাওয়ার পর ১৮ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা থেকে দখলদার পাকসৈন্যরা মেহেরপুর অভিমুখে রওনা হয়ে আমঝুপিতে নির্মম গণহত্যা চালালে এ অঞ্চলের প্রতিরােধব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে। ভীতসন্ত্রস্ত জনসাধারণ ঘর-গেরস্থালি, ডিটেমাটি ত্যাগ করে এ-জেলার প্রায় ৭০ কিলােমিটার বিস্তৃত সীমান্তপথে ভারতের পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রতিরােধযুদ্ধে অভিজ্ঞ ছাত্র-যুবক, আনসার-মুজাহিদরাও সীমান্তপাড়ি দিয়ে মেহেরপুরের বিপরীতে অবস্থিত নিকটতম ভারতীয় শহরগুলােতে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাদের অভ্যর্থনা 
 
জানিয়ে আশ্রয় দেওয়া এবং সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের ভিতরে যুদ্ধে পাঠানাের যােগ্য করে তােলার জন্য এ-সব ভারতীয় শহরে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সংগঠকদের উদ্যোগে এপ্রিলের শেষার্ধ থেকেই ভােলা হয় যুব অভ্যর্থনা কেন্দ্র এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এ-সব কেন্দ্রে প্রতিদিন অসংখ্য যুবক এসে ভিড় জমাতে থাকে। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তাদের ব্যাকুলতার অন্ত নেই। এ-সম্পর্কে নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকায় বলা হয় : নতুন মুক্তিযােদ্ধার অভাব নেই। দলে-দলে এত যুবক আসছে যেতাদের গ্রহণ করা অসম্ভব। দুই পর্যায়ে ট্রেনিং চলছে প্রাথমিক ঘাঁটিতে ওদের শুধু সামরিক মূল সূত্রগুলাে শিক্ষা দেওয়া হয়। এটাকে বলা যেতে পারে শারীরিক যােগ্যতা অর্জনের শিবির। মূল ঘাঁটিগুলাে তাদের অল্পসংখ্যক লােককে পুরাে ট্রেনিং দিতে পারে। এর প্রধান কারণ অস্ত্রশস্ত্রের অভাব  একজন ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈনিককে যদি বন্দুক না দিতে পারা যায়, তা হলে তার মনােবল ভেঙে পড়ে। এ-কারণে অস্ত্রশস্ত্র না থাকলে নতুন লোককে ট্রেনিং দেওয়া হয় না। নতুন সৈনিকদের। বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছর। তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে ঘাঁটিগুলােতে ভিড় করছে। কলেজপড়ুয়া ছাত্ররাই সৈন্যদলে নাম লেখাচ্ছে। এজন্য বাংলাদেশের সৈন্যরা হবে সর্বাপেক্ষা শিক্ষিত সৈনিক। তাদের ট্রেনিং দেওয়া খুবই সহজ। কমান্ডার মনে করেন যে, এক মাসের মধ্যে মূল ট্রেনিং-এর সঙ্গে তাদের উচু ধরনের নিজস্ব তাগিদ থাকায় তারা অতি উত্তম সৈনিক হতে পারে।
 
হৃদয়পুর যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প
 
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী দেশত্যাগী যুবকদের জন্য এপ্রিলের ১৯ তারিখে মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরের বিপরীতে ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন গ্রাম হৃদয়পুরে এ-অঞ্চলের প্রথম যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প ভােলা হয়। মেহেরপুরসহ বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার ছাত্র-যুবকদের অনেকেই প্রথমে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। নদীয়া জেলা প্রশাসকের অর্থানুকূল্যে এবং প্রাপ্ত ত্রাণসামগ্রী দ্বারা ক্যাম্পটি পরিচালিত হত। ক্যাম্প পরিচালনার সঙ্গে মেহেরপুরের কেউ-কেউ জড়িত থাকলেও ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন চুয়াডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভােকেট ইউনুস আলী। বিএসএফ ক্যাম্পের পাশে অবস্থিত এই ক্যাম্পে সামান্য অস্ত্র প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়। তবে এখানে আগত যুবকদের মধ্যে প্রশিক্ষণে আগ্রহীদের অধিকাংশকেই পাঠানাে হতাে চাপড়া থানার বাঙালঝি এবং ডােমপুকুর ক্যাম্পে। হৃদয়পুর ক্যাম্পটি একেবারে মুজিবনগর সংলগ্ন ছিল বলে একে মুজিবনগর ক্যাম্পও বলা হত। এ-প্রসঙ্গে যুগান্তর পত্রিকায় লেখা হয় : গত কাল বাংলাদেশের মুজিবনগরে মুক্তিফৌজের ট্রেনিং ক্যাম্প খােলা হয়েছে এবং আজ সকাল থেকে তার কাজ শুরু হয়েছে। এই ক্যাম্পে। ২০০ জন করে শিক্ষার্থীকে সমর শিক্ষা দেওয়া হবে এবং শিক্ষা শেষে তাদের লড়াইয়ে পাঠানাে হবে। বেতাই যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প হৃদয়পুরের পর ২১ এপ্রিল মেহেরপুরের বিপরীতে অপর নিকটতম সীমান্তবর্তী ভারতীয় শহর বেতাইয়ে ভােলা হয় যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প। এখানে প্রধানত মেহেরপুরের ছাত্র-যুবকরা আশ্রয় নেয়। তবে কুষ্টিয়া চুয়াডাঙ্গাসহ অন্যান্য স্থানের যুবকেরা মেহেরপুর হয়ে বেতাইয়ে পৌছে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছাড়াও এখানে অল্পদিনের মধ্যেই প্রাথমিক অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমদিকে সশস্ত্রবাহিনী ও ইপিআর সদস্যরা এ প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।
পরে সােনাপুরের আনসার কমান্ডার আব্দুল ওয়াহেদ এবং নূর মােহম্মদ খান। প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই ক্যাম্পটি পরিচালনা করেন মেহেরপুরের আওয়ামী লীগ নেতা সহিউদ্দিন, রমজান আলী, এ কে আশকারী পটল ও খাদেমুল ইসলাম। শিকারপুর যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে শিকারপুরে নিয়মিত বাহিনীর অ্যাকশন ক্যাম্পের পাশাপাশি যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্পও খােলা হয়। মেহেরপুরসহ বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার ছাত্র যুবকরা এখানে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এ-ক্যাম্পের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মেহেরপুর জেলার আওয়ামী লীগ নেতা মােঃ নূরুল হক, কুষ্টিয়া জেলার আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভােকেট আজিজুর রহমান আক্কাস এবং ভেড়ামারার রাজা মিয়া। করিমপুর যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প মে মাসের শুরুতেই করিমপুর থানা শহরে গড়ে ওঠে যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প। প্রধানত মেহেরপুর এবং কুষ্টিয়া অঞ্চলের ছাত্র-যুবকরা এখানে আশ্রয় ও প্রাথমিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এ ক্যাম্প পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গাংনী থানা আওয়ামী লীগ নেতা হিসাবউদ্দীন, কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রউফ চৌধুরী, কুমারখালীর আওয়ামী লীগ নেতা গােলাম কিবরিয়া, আলমডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতা শাফায়েত উল ইসলাম এবং খােকসার আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম।
 
মুজিবনগর : অমর কাব্যের প্রথম পাতা আমাদের মহান স্বাধীনতাকে যদি ধরা যায় কোনাে অমর কাব্য, তাহলে মুজিবনগর সেই কাব্যের প্রথম পাতা। যে-কোনাে কাব্যের প্রথম পাতায় কিংবা প্রচ্ছদে লেখা থাকে কবির নাম। এখানেও তাই ঘটেছে। স্বাধীনতা কাব্যের প্রথম পাতায় সেই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল লেখা হয়ে গেছে চির অমর সেই কবির নাম—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর একেবারে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন এ-কাব্যের প্রতিটি পাতায় লেখা হয়েছে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের বীরত্বগাথা। কখনােবা নির্যাতিত মা-বােনের অশ্রুজল আর শহীদের রক্তধারা এসে সেই বীরত্বগাথাকে করে তুলেছে আর্দ্র, বেদনাবিধুর কিন্তু এই অশ্রুধারা দেশপ্রেমিক মুক্তিসেনার পথ আগলে দাঁড়ায় নি। শােক হয়েছে শক্তি বীরবিক্রমে ছিনিয়ে এনেছে বিজয়ের রক্তিম সূর্য। সমাপ্ত হয়েছে। স্বাধীনতা-কাব্য। স্বাধীনতার সূতিকাগার মুজিবনগরের আদি নাম বৈদ্যনাথতলা, মেহেরপুরের অখ্যাত এক গ্রাম। বাংলাদেশের সব সাধারণ গ্রামের মতােই। বৈচিত্র্যহীন, তরঙ্গহীন। ব্যতিক্রম বলতে এই গ্রামে রয়েছে ছায়াঢাকা বিশাল এক আমবাগান। তা এ-রকম বাগানসমৃদ্ধ গ্রামও এ-দেশে নিতান্ত কম নেই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যদি ছায়া সুনিবিড় শাস্তির নীড়ও বলি, তবু প্রশ্ন জাগে কুল।
 
পরিচয়হীন একটি গ্রাম সহসা কী করে সব গ্রামকে ছাড়িয়ে একেবারে আলাদা হয়ে উঠে এলাে? মাত্র ক’দিন আগেও যে-গ্রামটি তার পাশের গ্রামেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে নি, সেই সামান্য বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন হঠাৎ কীভাবে পরিচিত হয়ে গেল স্বনামে এবং নতুন নামে? একাত্তরের সেই তরঙ্গবিক্ষুব্ধ বাঙালি জাতি যখন হাজার বছরে গড়ে ওঠা স্বতন্ত্র পরিচয়কে পৃথিবীর মানচিত্রে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে চাইছে, সেই মহালগ্নটিকে আপন বুকে ধারণ করেছিল বৈদ্যনাথতলা, এই অখ্যাত গ্রামটি। এক রাষ্ট্রের শেকল ভেঙে বেরিয়ে আসছে আরেক রাষ্ট্র। কৃত্রিম এক জাতি পরিচয়ের বাঁধন ছিড়ে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে সত্যিকারের জাতিপরিচয়। এরই মধ্যে নিরস্ত্র জনগণের কাঁধে চেপে বসেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সশস্ত্র যুদ্ধ। সেই যুদ্ধজয়ের শক্তি, সাহস, মনােবল, ঐক্য সবই আছে; নেই যুদ্ধ পরিচালনা এবং দেশ চালানাের জন্য সরকার। নেই সেই নেতা, যিনি শৈল্পিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিনের সচেতন প্রচেষ্টায় বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছেন।
তিনি শারীরিকভাবে উপস্থিত নেই বটে, কিন্তু দেশের সব মানুষের অন্তরে আছেন, সারা দেশে আছেন, বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননেও আছেন। শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে একাত্তরের ১৭ এপ্রিল শকবলিত দেশের মুক্তাঞ্চল বৈদ্যনাথতলায় তারই নামে গঠিত হল অস্থায়ী সরকার। নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আর প্রধানমন্ত্রী হলেন তাজউদ্দিন আহমদ। অস্থায়ী সরকারের শপথগ্রহণ, তাকে গার্ড অব অনার প্রদান, স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ—সবই হল ঐ অজপাড়াগাঁয়ে। মুজিব নেই, তবু তিনিই প্রধান সেই সরকারের। মুজিব নেই, তবু তিনিই মধ্যমণি সে-দিনের অস্থায়ী সরকারের। সারা দেশের মানুষ মনে করে, তিনি আছেন, ৭ মার্চে ছিলেন, ২৬ মার্চে ছিলেন, ১৭ এপ্রিলেও আছেন। বৈদ্যনাথতলাতেও আছেন। কাজেই তার নামে সরকার গঠিত হল যে-স্থানে সেটিও ১৭ এপ্রিলের পর আর বৈদ্যনাথতলা নয়, নতুন নাম-মুজিবনগর। মুজিব শব্দটি তখন গােটা জাতির কাছে সাহস আর শক্তির প্রতীক, লড়াই আর মুক্তির অন্য নাম। মুজিবনগর নামধারণ করে একটি সাধারণ গ্রাম সমগ্র জাতির মুক্তিসংগ্রামের সূতিকাগারে পরিণত হল, হঠাৎ আলাের ঝলকানিতে একটি অখ্যাত গ্রাম সারা দুনিয়ার চোখ ঝলসে দিল। বাংলাদেশের অন্যনাম হয়ে গেল মুজিবনগর।
 
অতঃপর মুজিবনগর সরকারের সফল নেতৃত্বে বীর বাঙালি অসীম সাহসে যুদ্ধ করে দখলদার শত্রুকে করেছে পরাজিত, বিজয়ের সূর্য এনেছে ছিনিয়ে। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের ব্যস্ততায় তৎকালীন সরকারের পক্ষে আর পিছনে ফিরে তাকানাের সুযােগ হয় নি। রাজধানী থেকে বহুদূরে অবস্থিত মুজিবনগর আবার চলে গেছে আড়ালে। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর ‘মুজিব’ শব্দটিকেই নির্বাসনে পাঠাননার চেষ্টা চলেছে ক্রমাগত। মুজিবনগরও হয়েছে উপেক্ষিত। এরই মাঝে ১৯৮৮ সালে এসে তকালীন রাষ্ট্রপতি মুক্তিযুদ্ধকালে নিজের কুৎসিত ভূমিকা এবং ক্ষমতারােহণের কদর্য প্রক্রিয়া আড়াল করার জন্য মুজিবনগরকে অবলম্বন করেন। তাতে লাভ হয়। আমাদেরই। সরকারি পৃষ্ঠপােষকতায় ১ কোটি ৯৩ লাখ ১১ হাজার ১৩৩ টাকা। ব্যয়ে নির্মিত হয় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা বিষয়ে সারা দেশে এ-নাগাদ যে স্থাপত্যকীর্তিগুলাে গড়ে উঠেছে। মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ সেগুলাের মধ্যে অন্যতম। এই ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধের স্থপতি তানভীর কবির।  বাঙালির দেশ বাংলাদেশ। পূর্ণাঙ্গ একটি জাতিসত্তার অস্তিত্ব ও রাজনৈতিক মর্যাদা নিয়ে এই প্রথম একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, স্বাধীনতার সূর্যোদয়-মুজিবনগরে। সূর্যোদয়’-এর ধারণাটিই মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের সমগ্র অবয়বজুড়ে প্রতিফলিত হয়েছে। উদীয়মান এই সূর্যের বিচ্ছুরিত রশ্মি আছে, রশ্মিগুলাের কেন্দ্রে আছে লালটকটকে গােলাকার সূর্য।
 
সূর্যরশ্মির প্রতীক হিসেবে কংক্রিটের তৈরি বিভিন্ন মাপের ২৩টি ত্রিকোণাকৃতির দেয়াল ব্যবহার করা হয়েছে এই সৌধের বহিরঙ্গে। প্রতিটি দেয়াল একেকটি বছরের পরিচায়ক। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে জাতীয় ঐতিহ্য এবং অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এই ২৩টি দেয়াল। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ২৩টি বছর। পাকিস্তানি শােষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অবিস্মরণীয় ২৩টি বছর। ‘৪৮ থেকে এ-আন্দোলন যেমন ক্রমান্বয়ে বেগবান হয়ে ‘৭১-এ এসে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নিয়েছে, স্বাধীনতা সূর্যকে স্পর্শ করেছে; উদীয়মান সূর্যের আদলে নির্মিত মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের ত্রিকোণাকৃতি ২৩টি দেয়ালও তেমনি ক্রমান্বয়ে ছােট থেকে বড় মাপে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি দেয়াল যেনবা সূর্যের রশ্মিফলক। প্রথম দেয়ালটির দৈর্ঘ্য ২০ ফুট, উচ্চতা ৯ ফুট। পরবর্তী প্রতিটি দেয়াল ক্রমান্বয়ে দৈর্ঘ্যে ১ ফুট ও উচ্চতায় ৯ ইঞ্চি করে বাড়তে-বাড়তে সর্বশেষ দেয়ালটির দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট ও উচ্চতা ২৫ ফুট ৬ ইঞ্চি দাঁড়িয়েছে। এভাবেই একাত্তরের মর্যাদায় বিভূষিত শেষ দেয়ালটি স্বাধীনতা। সংগ্রামের শীর্ষবিন্দুটি স্পর্শ করেছে।
 
সূর্য থেকেই বিচ্ছুরিত হয় সূর্যরশ্মি। মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে বিভিন্ন মাপের ২৩টি দেয়াল যেমন সূর্যরশ্মির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত, তেমনি সেই দেয়ালগুলাের কেন্দ্রের আছে ১৬০ ফুট ব্যাসের গােলাকার স্তম্ভ। সূর্যের প্রতীক এই গােলাকার স্তম্ভ ভূতল থেকে বিভিন্ন উচ্চতায় তিনটি চত্বরে বিভক্ত। প্রথমটি ২ ফুট ৬ ইঞ্চি, দ্বিতীয়টি ৩ ফুট এবং তৃতীয়টি ৩ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতায় অবস্থিত। আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে ৭ মার্চ, ২৬ মার্চ এবং ১৭ এপ্রিল—এই তিনটি তারিখের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বােঝাতে ঐ গােলাকার স্তম্ভের তিনটি স্তর দেখানাে হয়েছে। একই সঙ্গে তা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—আমাদের সংগ্রামী ঐতিহ্যের এই তিনটি স্তরেরও ধারণা বহন করে। এ তিনটি পর্যায়ের স্তর পেরিয়েই তাে উদিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতাসূর্য। সূর্যের উদীয়মানতা প্রকাশ করার জন্য ১৬০ ফুট ব্যাসের গােলাকার স্তম্ভের সম্পূর্ণ অংশ না-নিয়ে অর্ধাংশকে বেদি করে, সেই বেদির ওপর সূর্যরশ্মির দেয়ালগুলাে নির্মাণ করা হয়েছে। মূলত ভূতল থেকে ৩ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতায় নির্মিত বেদির উপরে ২০ ইঞ্চি পুরু বিভিন্ন আকৃতির এই ২৩টি দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদের আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণ হয়েছিল যেখানে, সুনির্দিষ্ট সেই স্থানটির ঐতিহাসিক তাৎপর্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য ২০ ফুট দীর্ঘ এবং ১৪ ফুট প্রশস্ত আয়তাকার ক্ষেত্রটিকে স্থান দেওয়া হয়েছে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের মূল ভিতের মাঝখানে। সমগ্র স্মৃতিসৌধের অবয়ব থেকে এ স্থানটিকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করার জন্য এ আয়তাকার ক্ষেত্রটি নির্মিত হয়েছে লাল সিরামিক ইটে। ঐতিহাসিক স্থানটি স্মৃতিসৌধের কেন্দ্রে লাল সিরামিকে নির্মিত হওয়ায় রক্তে পাওয়া স্বাধীনতার তাৎপর্যে উদ্ভাসিত হয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল যেখান থেকে, সেই বৈদ্যনাথতলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত মুজিবনগর স্মৃতিসৌধটি বাংলাদেশের স্থাপত্যকীর্তির ইতিহাসে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করেছে। 
 
বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের উপেক্ষিত বিষয় আশয়গুলাে আবার জাতীয় মর্যাদা এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব লাভ করে। দেশের পশ্চিম সীমান্তের নিভৃত পাড়াগাঁ বৈদ্যনাথতলাও আবার মুজিনগরের ঐতিহ্য শিরােপা মাথায় নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং সারা দেশের মানুষের মনােযােগ লাভ করেছে। ইতােমধ্যেই এই স্মৃতিসৌধের চারপাশ ঘিরে মুজিবনগর কমপ্লেক্স নামের উচ্চাভিলাষী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ-পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল দেশী-বিদেশী সব মানুষের তীর্থভূমি হয়ে উঠবে এই মুজিবনগর, আমাদের স্বাধীনতা-কাব্যের প্রথম পাতা। প্রথমে রাষ্ট্রপতির ঘােষণা থেকে এবং পরের বছর প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে মুজিবনগর কমপ্লেক্সের মতাে উচ্চাভিলাষী কিন্তু প্রয়ােজনীয় পরিকল্পনার স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু বর্ণাঢ্য এ-পরিকল্পনা বাস্তবায়নের গতিধারা দেখে দেশের মানুষ আশান্বিত হওয়ার চেয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ছে বেশি। বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে প্রস্তাবিত এই কমপ্লেক্সের কাজ আদৌ শেষ হবে কি? সরকার কি আশা করেন ক্ষমতা থেকে তাদের অনুপস্থিতি ঘটলেও এই কমপ্লেক্সের কর্মকাণ্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতেই থাকবে? বিগত দিনের ইতিহাস কিন্তু এমন আশাপ্রদ অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য দেয় না।

একাত্তরের ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলার নাম বদলে মুজিবনগর হওয়ার ঘটনাটি গােটা বাঙালি জাতির মানসিক সমর্থনধন্য এবং সম্পূর্ণ অবিতর্কিত। সম্ভবত শেখ মুজিব এবং তার দল ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে এটিই প্রথম তার নামে কোনােকিছুর নামকরণ। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, গত দুই দশকে মুজিনগর প্রসঙ্গটি আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যকোনাে রাজনৈতিক দলের কাছে যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদা পায় নি। জানি, কেবল মুজিবের নামই নয়, এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও যুক্ত এবং সশ্রদ্ধচিত্তে মুজিবনগর প্রসঙ্গটি স্মরণ করার পথে প্রধান অন্তরায়ও সেখানেই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে যারা নিজেদের দাবি করেন, তারাও এ-প্রসঙ্গে কৌশলগত নীরবতা দ্বারা নিরপেক্ষ থাকার ভান করে। এভাবেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের সর্বজনীন রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’-কে নির্বাসনে পাঠিয়েছি। ঐ অবিস্মরণীয় স্লোগানে দশদিক কাঁপিয়ে যারা বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেছিলেন, তাদের অনেকেই নিজেদের আওয়ামী লীগবিশ্লিষ্টতা প্রমাণের জন্য অবলীলায় ত্যাগ করেছেন ঐ শ্লোগান।

 
ভাবখানা যেন, মুজিবনগর, জয়বাংলা এ-সব আওয়ামী লীগের ঘরেই জমা থাকুক, তাদের আর প্রয়ােজন নেই। জানি না, ব্যক্তিগত জীবনের আর কোনাে ক্ষেত্রে তারা এভাবে নিজের ভাগ ছেড়ে দেওয়ার নজির স্থাপন করেছেন কি-না। এ-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ‘৭৫-এর পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং উৎসমুখ থেকে মুখ ফেরালেই পুরস্কৃত করা হয়েছে অঢেল। তবু স্বাধীনতা দিবস আসে, বিজয় দিবস আসে- কেউবা স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারী, কেউবা স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠকের (!) মর্যাদা পুনরুদ্ধারে গলদঘর্ম হয়; স্বাধীনতা নামের এই মহাকাব্যের মহাকবিকে কনুই মেরে পিছনে ফেলার কী প্রাণান্তকর প্রয়াস; চাঁদ সওদাগরের বামহাতের পূজা দেওয়ার মতাে শেখ মুজিবকে চার/পাঁচ নম্বর নেতায় নামিয়ে আনার তৎপরতায় নিবেদিতপ্রাণ; মুজিবনগর প্রসঙ্গে তারা রা করবেন না বােধগম্য কারণেই। অপরপক্ষে বর্তমান সরকার তাদের নৈতিক দায়বােধ থেকেই মুজিবনগরের দিকে মুখ ফিরিয়েছেন, অবহেলার অন্ধকারে নিমজ্জিত মুজিবনগরকে পুনর্বার আলােকিত করতে চাইছেন—সেটা খুবই স্বাভাবিক মুজিবনগর কমপ্লেক্সের মতাে বর্ণাঢ্য পরিকল্পনাও যেমন তাদের কাছে প্রত্যাশিত, সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যথাসময়ে যথাযথ উদ্যোগও সমভাবে প্রত্যাশিত  নইলে স্বাধীনতা নামের মহাকাব্যের প্রথম পাতা অর্থাৎ প্রচ্ছদপাতাটি একদিন হারিয়ে যাবে। আর প্রচ্ছদপাতা হারিয়ে গেলে সে গ্রন্থের কী-ইবা পরিচয় থাকে।
মহাকাব্য একদিনে রচিত হয় না। তার পিছনে থাকে দীর্ঘদিনের ব্যাপক প্রস্তুতি। আমাদের স্বাধীনতা কাব্যের ক্ষেত্রেও সেই প্রস্তুতি ছিল। বায়ান্ন, ছেষট্টি, ঊনসত্তর সেই প্রস্তুতিকাল; আর একাত্তরের ১ মার্চ, ৩ মার্চ, ৭ মার্চ, ২৬ মার্চকে বলা যায় চূড়ান্ত প্রস্তুতির হিরণয়লগ্ন। এত প্রস্তুতির পর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু ১৭ এপ্রিল; প্রথম পাতায় প্রথম লেখা-মুজিবনগর।
 

 সমস্যা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুজিবনগর শব্দযুগল একাত্তরে এসে অভিন্ন ও একাকার হয়ে গেছে। আরাে সমস্যা—শেখ মুজিব নামের এই মানুষটি বাঙালির দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের মর্মবাণীকে নিজের ভিতরে ধারণ ও লালন করে জাতীয় আকাক্ষা ও স্বপ্নকে শৈল্পিক প্রক্রিয়ায় জাতীয় স্বাধীনতার সঙ্গে সমন্বিত করার মধ্য দিয়ে নিজের নামটিকে এতটাই সুউচ্চে উপস্থাপন করে গেছেন যে, আজ সেই পর্বতপ্রমাণ নামটিকে অস্বীকার করতে হলেও পাহাড় অতিক্রমের শ্রম স্বীকার করতে হয়, ঐ পাহাড়ের পাশে নকল পাহাড় গড়তে হয়, ঘােষণা পাঠের আকস্মিক বাহাদুরীর আড়ালে দীর্ঘদিনের লড়াইসংগ্রাম ঢাকার চেষ্টা করতে হয়। সে-প্রচেষ্টায় সফল হােক বা না-হােক, নতুন প্রজন্মকে খানিকটা হলেও বিভ্রান্ত যে করা সম্ভব, তার আলামত বিগত দুই দশকে ঢের দেখা গেছে। তারপরও স্বাধীনতা নামক এই প্রস্ফুটিত কুসুমটি কারাে রাগ-অনুরাগ-রক্তচক্ষুর তােয়াক্কা না করে নীরবে-নিঃশব্দে মুজিব নামের সুরভি ছড়িয়ে চলছে, ছড়াবেই। ঐ নামটি অস্বীকার করতে হলে এই কুসুমটিকেই সমূলে উৎপাটন ছাড়া অন্যকোনাে উপায় নেই। আর ঐ বিপুল

ব্যঞ্চনাময় নামটি অতিক্রম করতে হলে স্বাধীনতার অচরিতার্থ স্বপ্নসমূহকে বাস্তবায়ন করতে হবে; অবশ্য এই প্রক্রিয়ার সফল ব্যক্তির নাম অতিশয় উজ্জ্বলতা লাভ করবে। কিন্তু তাতে শেখ মুজিবের নামের ঔজ্জ্বল্য এতটুকুও ম্লান হবে না। বরং মােলকলায় পূর্ণ হয়ে সে-দিন ঐ নামের উজ্জ্বল বিভা বিকশিত হবে। অতিক্রম নয়, শেষপর্যন্ত ঐ বিকশিত হওয়ার ব্যাপারটিই মুখ্য হয়ে উঠবে, উজ্জ্বল হয়ে উঠবে স্বাধীনতা-কাব্যের প্রথম পাতা। এর জন্য মেহনত করে কোনাে সড়ক বা প্রতিষ্ঠানের মাথায় ঐ নামে মােটা-মােটা হরফে সাইনবাের্ড লটকানাের প্রয়ােজন হবে না। মহাকাব্যের পাতায়-পাতায় কবির নাম লেখার প্রয়ােজন হয় না, প্রথম পাতায় বা প্রচ্ছদে এক-দু’বার লেখাই যথেষ্ট। ঐ কাব্যের প্রতিটি পঙক্তি ও চরণে, শব্দে ও উপমায় কবিসত্তা মিশে থাকে আপন বৈশিষ্ট্যে। আর অমরকাব্য থেকে কবিকে বিশ্লিষ্ট করা তাে কিছুতেই সম্ভব নয়—
স্বাধীনতা মানে অমরকাব্য মুজিবুর তার কবি
স্বাধীনতা মানে চিত্রলেখা মুজিবের আঁকা ছবি।
প্রাকৃতিক নিয়মে প্রতিদিনই সূর্য ওঠে। প্রতিদিন তা আবার অস্ত যায়। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরের এই সবুজে সবুজ, নীলিমায় নীল প্রকৃতিজুড়ে যে স্বাধীনতাসূর্যের উদ্ভাস ঘটেছিল তার কেবল উদয় আছে, অস্ত নেই। শকুনের কালাে পাখায় সেই সূর্যের আলাে সাময়িকভাবে স্নান করতে পারে মাত্র, মুছে দিতে পারে না কিছুতেই। মহাকাব্যের এই প্রথম পাতা গােটা জাতিকে জাগিয়ে রাখবে মুজিবনগর স্মৃতির মিনার ফিরে আসি বারেবার বাঙালি জাতির অন্তর থেকে নয়কো তা হারাবার।
নিবন্ধটি মুজিবনগর দিবস ১৯৯৯ উপলক্ষে জেলা প্রশাসন, মেহেরপুর-এর স্মরণিকা ‘প্রতিশ্রুতি’তে প্রকাশিত। 
 

সূত্রঃ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর – রফিকুর রশীদ

 
 
 
 
 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!