১৭ এপ্রিল ১৯৭১, শনিবার পঁচিশে মার্চ থেকে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে পরিচালিত বাঙালি জাতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরােধ সংগ্রাম অনেকাংশে অসংগঠিত, পারস্পরিক সম্পর্ক ও শৃঙ্খলাবিহীন এবং একক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার কারণে যখন বিপর্যস্তপ্রায়, ঠিক তেমনি সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ এবং সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ তৎপরতাকে সেই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে এনে সুপরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে সরকারেরই নেতৃত্বে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে ১৭ এপ্রিলের অঙ্গীকার ঘােষণা সত্যিই বাঙালি জাতির জীবনে অত্যন্ত গৌরবময় ও তাৎপর্যমণ্ডিত ঘটনা। পাকিস্তান নামক কৃত্রিম এক রাষ্ট্রের শেকল ভেঙে বেরিয়ে আসছে নতুন রাষ্ট্র। পাকিস্তানি জাতি পরিচয়ের কৃত্রিম বাঁধন ছিড়ে সৃষ্টি হয় স্বাধীন বাঙালি জাতি পরিচয়। আর নয় মুসলিম কিংবা অমুসলিম পরিচয়। বাংলা নামে এভূখণ্ডের জনগণ খুঁজে আবিষ্কার করেছে তাদের আত্মপরিচয়—সবাই বাঙালি। কিন্তু এরই মাঝে নিরস্ত্র বাঙালির কাঁধে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা চাপিয়ে দিয়েছে তাদের সেনাবাহিনীর সশস্ত্র যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে জেতার শক্তি, সাহস, মনােবল, ঐক্য—সবই আছে বাঙালির, নেই শুধু যুদ্ধ পরিচালনা ও দেশ চালানাের মতাে সরকার। অবশ্য একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের যােগ্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও আছে। কাছে নেই সেই প্রতিনিধিদের প্রাণপুরুষ, যিনি রাজনৈতিক শৈল্পিকতায় দীর্ঘদিনের সচেতন প্রচেষ্টায় বাঙালি জাতিকে পৌছে দিয়েছেন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। এখন বহু যুগের স্বপ্নলালিত সেই স্বাধীনতার রক্তগােলাপ ছিনিয়ে আনতে হলে চাই দেশের আপামর জনসাধারণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার। সারা দেশের চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠাময় দুর্দিনেও একেবারে সঠিক সিদ্ধান্তটিই গ্রহণ করেছেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিবৃন্দ। প্রবাসী নেতৃবৃন্দ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপাত অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তাকেই রাষ্ট্রপ্রধান করে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠন করেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এই সরকার বাংলাদেশের মুক্ত মাটিতে রাজধানী স্থাপন করে সেই রাজধানীতে বসে শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে চায় নিজেদের এবং তারপর আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়ােজনীয় সব উদ্যোগ গ্রহণ করতে চায়।
সে-দিনের বাস্তবতা হচ্ছে—ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব প্রধান শহরই তখন আগ্রাসী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দখলে। তাহলে কবে এবং কোথায় হবে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ এবং শপথগ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা? কোথায়, বাংলাদেশের কোন মুক্তাঞ্চলে? মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক এবং নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ৩০ মার্চ বহু পথ ঘুরে চুয়াডাঙ্গার সীমান্তপথে ভারত গমনের সময় দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সাহসিকতাপূর্ণ কর্মকাণ্ড ও তৎপরতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সুযােগ পান। তদুপরি বিভিন্ন সময়ে সীমান্ত এলাকায় এসে এই রণাঙ্গনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপআলােচনার মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর এলাকার নিরাপত্তা ও ভৌগােলিক অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর এই এলাকাকেই বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচনা করেন এবং উক্ত অনুষ্ঠানের জন্য প্রাথমিকভাবে তারিখ নির্ধারণ করেন ১৪ এপ্রিল। মেহেরপুরের তদানীন্তন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এ-প্রসঙ্গে জানাচ্ছেন : মেহেরপুরের কোন এক স্থানে বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণের প্রস্তাবের কথা আমরা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দিকে জানতে পারি। আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য গভীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু প্রতীক্ষার প্রহর গুণে সময় নষ্ট করতে চান নি দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ডের উপদেষ্টামণ্ডলী। প্রবাসী সরকারের নেতৃবৃন্দের কথাবার্তা থেকে যেটুকু আভাস পাওয়া যায় তারই সূত্র ধরে তারা চুয়াডাঙ্গাতে অস্থায়ী রাজধানী স্থাপনসহ উক্ত সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করতে শুরু করেন। এ-প্রসঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। তার স্মৃতিচারণে জানান : ১০ এপ্রিল গঠিত স্বাধীন বাংলা মন্ত্রিপরিষদকে চুয়াডাঙ্গায় শপথগ্রহণ করানাে হবে বলেও প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কিন্তু ১৪ এপ্রিল থেকে যুদ্ধপরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনের ফলে শপথগ্রহণের স্থান চুয়াডাঙ্গার পরিবর্তে আমার ইপিআর উইং-এর অধীন মেহেরপুরের সীমান্ত এলাকা বৈদ্যনাথতলাকে মনােনীত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির খবর শেষপর্যন্ত গােপন রাখা যায় নি। দেশীবিদেশী সাংবাদিকদের প্রশ্নের চাপে চুয়াডাঙ্গার নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে কোনাে অসতর্ক মুহূর্তে এই আয়ােজনের কথা আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে চলে আসে। এমনকি আকাশবাণীর খবরেও এ-অনুষ্ঠানের আভাস দেওয়া হয়। ফলে যশাের সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কয়েকগুণ বেশি শক্তিসামর্থ্য নিয়ে চুয়াডাঙ্গা দখলের উদ্দেশ্যে সড়কপথে রওনা হয়। সেই সঙ্গে আকাশপথেও শুরু হয় বােমা হামলা। এ-প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেরও অন্যতম উদ্যোক্তা ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম জানাচ্ছেন । মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা প্রথমে চিন্তা করি। কিন্তু পাক-হানাদারবাহিনী সেখানে বিমান থেকে বােমাবর্ষণ করে। এ-রকম বৈরী পরিস্থিতিতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)এর সঙ্গে আলােচনাক্রমে মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথতলার আমবাগানের ছায়াঘেরা মনােরম চত্বরকেই মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত স্থান বলে নির্বাচন করা হয়। চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর থেকে এস্থানের দূরত্ব ও সড়কপথে এ-দুর্গম এলাকার সঙ্গে যােগাযােগের অসুবিধা এবং নিকটস্থ ভারতীয় সীমান্ত হৃদয়পুর থেকে সড়কপথে কলকাতায় যােগাযােগের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই সীমান্তসংলগ্ন আরাে অনেক জায়গা মুক্ত থাকলেও বৈদ্যনাথতলাকেই বেছে নেওয়া হয়।
বিশেষ করে বৈদ্যনাথতলার ভৌগােলিক অবস্থানটা এমনই সুবিধাজনক স্থানে যে, পাকিস্তানি বাহিনী যদি আকাশপথে এসে বিমান হামলা করতে চায়, তা হলেও ভারতীয় আকাশসীমায় তাদের প্রবেশ করতে হবে; পাকিস্তানি বাহিনী নিশ্চয় সে ঝুঁকি নেবে না। বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির লােকজন এ-রকম একটা অনুষ্ঠানের আভাস পান এপ্রিলের ১২ তারিখে দোয়াজউদ্দীন মাস্টার এবং আইয়ুব হােসেনের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটির সদস্যবৃন্দ যখন পক্ষকালের নৈমিত্তিক রুটিন অনুযায়ী বৈদ্যনাথতলা ইপিআর ক্যাম্পের সামনে চেয়ার-টেবিল পেতে ভারতীয় জনগণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের দেওয়া সাহায্য সামগ্রী গ্রহণ করছেন, এমন সময় গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ এসে দোয়াজউদ্দীন মাস্টার ও আইয়ুব হােসেনকে ডেকে বৈদ্যনাথতলা আমবাগানে নিয়ে যায়। তারা সেখানে সাদা পােশাকে ভারতীয় বিএসএফ-এর দু’জন কর্মকর্তাকে দেখতে পান। তারা দোয়াজউদ্দীনের পরিচয় জানার পর বাগানের বেশকিছু জায়গা (বর্তমানে যেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে) আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে বলেন। এ-কাজের জন্য তারা কিছু ভারতীয় টাকাও দিতে উদ্যত হন। কিন্তু বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ টাকা নেওয়ার বদলে জায়গা পরিষ্কার করতে বলার কারণ জানতে চান। সে-কারণ পরে জানাবেন বলে তারা সীমান্ত পেরিয়ে চলে যান। এরপর স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির সবাই সঠিক কারণ না-জেনেই পরিচ্ছন্নতা অভিযানে ঝাপিয়ে পড়েন। তাদের দেখাদেখি ঐ গ্রামের শারি, করম আলী, মােমিনসহ আরাে অনেক যুবক কাজে লেগে যায়। ভবেরপাড়া মিশনের ব্রাদার ফ্রান্সিসও এঅভিযানে অংশগ্রহণ করে।
মেহেরপুরেরই এক প্রত্যন্ত এবং সীমান্তপল্লীতে যখন ঐতিহাসিক এক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয় নীরবে-নিভৃতে, তখন মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এ-আয়ােজনের বিষয়ে জানতে পারেন আরাে একদিন পর। এ-প্রসঙ্গে তার সাক্ষাঙ্কারে জানান । ১২ এপ্রিল, দিনের পর দিন মরণপণ যুদ্ধের পরও আমরা যখন কোন স্বীকৃতি পাচ্ছি না, তখন আমাদের মনােবল ভাঙতে শুরু করে। এমন এক সংকটজনক দিনে আমি খবর পেলাম, বাংলাদেশ সরকার ১৬ কিংবা ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণ করবেন।’ বস্তুতপক্ষে, তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এ-খবর অবহিত হন এপ্রিলের ১৩ তারিখে। পাবনার জেলা প্রশাসক মােহাম্মদ নূরুল কাদের এ-সময় মেহেরপুরে থেকেই দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত হন। মুজিবনগরে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন : ১৩ এপ্রিল। মেহেরপুর কোর্টভবনে বসে হাতিয়ার পর্যবেক্ষণ করছি। তত্ত্বাবধান করছি আহত যােদ্ধাদের এবং আশ্রয়গ্রহণকারীদের। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এলেন চুপি চুপি বললেন, স্যার, ভারতীয় দু’জন আর্মি অফিসার এসেছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম শহরের বাইরে রাস্তায় দাঁড়ানাে আর্মি জিপ দুটিই ভারতীয়। বােঝা গেল দুজনই ইন্ডিয়ান বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে আলােচনায় বসলাম বললাম, আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার ঘােষণা করা জরুরি সাহায্য সামগ্রী গ্রহণ করছেন, এমন সময় গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ এসে দোয়াজউদ্দীন মাস্টার ও আইয়ুব হােসেনকে ডেকে বৈদ্যনাথতলা আমবাগানে নিয়ে যায়। তারা সেখানে সাদা পােশাকে ভারতীয় বিএসএফ-এর দু’জন কর্মকর্তাকে দেখতে পান। তারা দোয়াজউদ্দীনের পরিচয় জানার পর বাগানের বেশকিছু জায়গা (বর্তমানে যেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে) আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে বলেন এ-কাজের জন্য তারা কিছু ভারতীয় টাকাও দিতে উদ্যত হন। কিন্তু বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ টাকা নেওয়ার বদলে জায়গা পরিষ্কার করতে বলার কারণ জানতে চান। সে-কারণ পরে জানাবেন বলে তারা সীমান্ত পেরিয়ে চলে যান। এরপর স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির সবাই সঠিক কারণ না-জেনেই পরিচ্ছন্নতা অভিযানে ঝাপিয়ে পড়েন। তাদের দেখাদেখি ঐ গ্রামের শারি, করম আলী, মােমিনসহ আরাে অনেক যুবক কাজে লেগে যায়।
ভবেরপাড়া মিশনের ব্রাদার ফ্রান্সিসও এঅভিযানে অংশগ্রহণ করে। মেহেরপুরেরই এক প্রত্যন্ত এবং সীমান্তপল্লীতে যখন ঐতিহাসিক এক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয় নীরবে-নিভৃতে, তখন মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এ-আয়ােজনের বিষয়ে জানতে পারেন আরাে একদিন পর। এ-প্রসঙ্গে তার সাক্ষাঙ্কারে জানান ১২ এপ্রিল, দিনের পর দিন মরণপণ যুদ্ধের পরও আমরা যখন কোন স্বীকৃতি পাচ্ছি না, তখন আমাদের মনােবল ভাঙতে শুরু করে। এমন এক সংকটজনক দিনে আমি খবর পেলাম, বাংলাদেশ সরকার ১৬ কিংবা ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণ করবেন।’ বস্তুতপক্ষে, তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এ-খবর অবহিত হন এপ্রিলের ১৩ তারিখে। পাবনার জেলা প্রশাসক মােহাম্মদ নূরুল কাদের এ-সময় মেহেরপুরে থেকেই দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত হন। মুজিবনগরে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন : ১৩ এপ্রিল মেহেরপুর কোর্টভবনে বসে হাতিয়ার পর্যবেক্ষণ করছি। তত্ত্বাবধান করছি আহত যােদ্ধাদের এবং আশ্রয়গ্রহণকারীদের। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এলেন। চুপি চুপি বললেন, স্যার, ভারতীয় দু’জন আর্মি অফিসার এসেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম শহরের বাইরে রাস্তায় দাঁড়ানাে আর্মি জিপ দুটিই ভারতীয় বােঝা গেল দুজনই ইন্ডিয়ান বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে আলােচনায় বসলাম বললাম, আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার ঘােষণা করা জরুরি।
মেহেরপুরেরই একেবারে সীমান্তপল্লী বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে চলে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী স্থাপনের তােড়জোড়। আয়ােজন অত্যন্ত অপ্রতুল। ইপিআর ক্যাম্পের চৌকি জোড়া দিয়ে হয়েছে মঞ্চ। মঞ্চে প্রবেশের সম্মুখভাগে নির্মিত হয়েছে দেবদারু পাতা জড়ানাে একটি অতি সাধারণ তােরণ। নিকটস্থ গ্রাম থেকে চেয়েচিন্তে জোগাড় করা চেয়ার-বেঞ্চের কোনটির হাতল ভাঙা, কোনােটির একটি পায়া নেই। এ-সব গুছিয়ে উঠতেই বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির নেতাকর্মীদের গলদঘর্ম হওয়ার দশা। ১৭ এপ্রিল খুব সকালে ভবেরপাড়া মিশন হাসপাতালের নার্স মিস ক্যাথেরিনা ও মিস তেরেজিনা ছুটে এসে অকিঞ্চিৎকর ঐ তােরণের মাথায় টাঙানাের জন্যে লাল। কাপড়ের ছােট্ট একটি ব্যানার মেলে ধরেন। সেই ব্যানারে তুলাে এবং কাপড় দিয়ে তারা প্রথমে লিখেছেন WELCOME, তার নিচে লিখেছেন ‘জয় বাংলা’ সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় উৎসুক জনতার আনাগােনা। তারা সবাই বৈদ্যনাথতলার আশপাশের গ্রামের অধিবাসী। ওদিকে হৃদয়পুর সীমান্ত পার হয়ে একের-পর-এক আসছে নানান ধরনের গাড়ি। আসছে উৎসাহী মানুষজন। অনুষ্ঠান শেষে বিতরণের জন্য কয়েক মণ মিষ্টিও আসে একটি গাড়িতে। দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের আগমনও শুরু হয়ে গেছে। এরই মাঝে ছােট্ট একটি পিকআপ ভ্যান এসে থামে ইপিআর ক্যাম্পের কাছাকাছি। সংগ্রাম কমিটির নেতা দোয়াজউদ্দীন এবং আইয়ুব হােসেনকে ডেকে ওই ভ্যানের ওপর রক্ষিত কাগজে মােড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আবক্ষমূর্তির উপরের অংশ দেখিয়ে আগম্ভক জানতে চান—এটা কোথায় স্থাপন করা হবে? জবাব দেবেন কী, দু’জনই মন্ত্রমুগ্ধের মতাে চেয়ে থাকেন মূর্তির দিকে কৃষ্ণনগরের পটুয়াদের জগৎজোড়া খ্যাতি। অবিকল বঙ্গবন্ধুকেই বানিয়েছে তারা কিন্তু মুসলিমপ্রধান এই দেশে কি মূর্তি বসানাে ঠিক হবে? তাছাড়া মূর্তি দেখে জনতা যদি মনে করে বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই! সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ ভেবেচিন্তে জানিয়ে দেন—এ মূর্তি কোথাও বসানাের দরকার নেই।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রারম্ভিক পর্যায়ের বর্ণনা প্রসঙ্গে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেছেন : সকাল নটার দিকে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যদের সাথে নিয়ে সেখানে পৌছলেন। আমি তাদের নিয়ে এলাম বৈদ্যনাথতলার মণ্ডপে। ওখানে আশপাশের গ্রাম থেকে কিছু চেয়ার সংগ্রহ করে আনা হল সংগৃহীত চেয়ারের মধ্যে সবগুলাে পূর্ণাঙ্গ নয়। কোনােটায় একটা হাতল নেই, কোনােটায় এক পায়া খােয়া গিয়েছে। মণ্ডপ প্রহরার জন্য নিয়ােজিত আনসারদের জন্য কিছু রান্না হয়েছিল। বেলা প্রায় এগারটা নাগাদ বহু প্রতীক্ষিত অনুষ্ঠান শুরু হল। আমি জিপে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও অন্যান্য কয়েকজনকে মঞ্চের ৫০ গজের মধ্যে তােরণের কাছে নিয়ে এলাম।’ নেতৃবৃন্দ মঞ্চের সামনে এসে পৌছতেই তৎপর হয়ে ওঠেন ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দিন আহমদ। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর পরামর্শক্রমে নেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানানাের জন্য স্থানীয় আনসারের ছােট একটি দল নিয়ে তিনি প্রস্তুত হয়েছিলেন। অনুষ্ঠানস্থলে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর পৌছতে বিলম্ব ঘটায় ক্যাপ্টেন মাহবুব ঐ ছােট্ট দলটি নিয়েই বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। সে-দিনের এই ছােট্ট দলের সদস্য ছিলেন মীর ইয়াদ আলী, আজিমউদ্দিন, সাহেব আলী, অস্থির মল্লিক, লিয়াকত আলী, ফকির মােহম্মদ, হামিদুল হক, নজরুল ইসলম, মফিজউদ্দিন, মহিউদ্দিন (মহিম শেখ), সিরাজুল ইসলাম ও কেসমত আলী। অভিবাদন গ্রহণের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ধীর, প্রশান্ত ও দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসেন পতাকাবেদির কাছে। গভীর দেশপ্রেম এবং আত্মপ্রত্যয়ে ধীরে-ধীরে উত্তোলন করেন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। এরই সঙ্গে স্থানীয় শিল্পীদের কণ্ঠে পরিবেশিত হয় জাতীয় সঙ্গীত—’আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি’।
ঐতিহাসিক এই অনুষ্ঠানে পরম মমতামাখা কণ্ঠে সে-দিন যারা জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য নাম মােঃ আসাদুল হক (পরবর্তীতে মেহেরপুর মহিলা কলেজের অধ্যাপক), শাহাবুউদ্দিন আহমেদ সেন্টু (পরবর্তীতে সােনালী ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা), পিন্টু বিশ্বাস (বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত)। এদের সঙ্গে ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রবও জাতীয় সঙ্গীতে অংশগহণ করেন। জাতীয় সঙ্গীত শেষ হলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি গার্ড পরিদর্শন করেন এবং সালাম গ্রহণ করেন। এরপর অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে মূল অনুষ্ঠানের উপস্থাপন শুরু করেন। টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নান। তার কণ্ঠে মাইক্রোফোনে উচ্চারিত হয় জাতীয় নেতৃবৃন্দের নাম। যেন বা গুচ্ছ-গুচ্ছ পুষ্পসুরভি ছড়িয়ে পড়ে সারা প্রাঙ্গণে। মঞ্চে উঠে আসনগ্রহণ করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খােন্দকার মােশতাক আহমদ ও কর্নেল এম এ জি ওসমানী। স্বেচ্চাসেবকরা মঞ্চে উপবিষ্ট নেতৃবৃন্দের হাতে ফুলের তােড়া তুলে দিয়ে বরণ করে নেন। উপস্থিত জনতা উষ্ণ করতালিতে অভিনন্দন জানান। অনুষ্ঠানের শুরুতে কুরআন তেলওয়াত করেন গৌরীনগরের বাকের আলী (পরবর্তীতে মুজিবনগর কলেজের সহকারী অধ্যাপক), বাইবেল পাঠ করেন ভবের পাড়ার পিন্টু বিশ্বাস। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠের মধ্য দিয়েই সূচনা ঘটে ঐতিহাসিক এই দিনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমের এরপর আওয়ামী লীগের নির্বাচিত চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী বাংলাদেশের মুক্ত মাটিতে স্বাধীনতাকামী কয়েক হাজার জনতা এবং শতাধিক দেশী-বিদেশী সাংবাদিকের সামনে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ বা ঘােষণাপত্র পাঠ করে শােনান।
আমেরিকার স্বাধীনতার সনদকে বাদ দিলে এমনভাবে গণমানুষের সামনে স্বাধীনতার সনদ উপস্থাপন পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল ঘটনা। বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ সেদিনের সেই ঘােষণাপত্রে খুব স্পষ্ট করে বলা হয় : যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ইং জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হইয়াছিল, যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করিয়াছিলেন, এবং যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করিয়াছেন, এবং যেহেতু আহূত এই অধিবেশন স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করা হইয়াছে, এবং যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি পালন করিবার পরিবর্তে বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের সহিত পারস্পরিক আলােচনা চলাকালে হঠাৎ ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘােষণা করিয়াছেন, এবং যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করিয়াছেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাইয়াছেন, এবং যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করিয়াছে এবং এখনাে বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাইতেছে, এবং যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ, গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের একত্রিত হইয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিয়া জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে, এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর তাহাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, এবং যেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়াছে সেই ম্যান্ডেট মােতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করিয়া পারস্পরিক আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য মনে করি, সেই হেতু আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিতেছি এবং উহার দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণা অনুমােদন করিতেছি।
এতদ্বারা আমরা আরাে সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিতেছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন। রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকিবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসন ও আইন প্রণয়নের অধিকারী। রাষ্ট্রপ্রধানের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ােগের ক্ষমতা থাকিবে। তাঁহার গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও উহার অধিবেশন আহ্বান মূলতবী ঘােষণার ক্ষমতা থাকিবে। তাহার কর ধার্য ও অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা থাকিবে। উহা ছাড়া বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়ােজনীয় সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হইবেন। বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা আরাে সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিতেছি যে, যে-কোনাে কারণে রাষ্ট্রপ্রধান যদি না থাকেন, অথবা রাষ্ট্রপ্রধান যদি কাজে যােগদান করিতে না পারেন অথবা তাহার কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে যদি অক্ষম হন তাহা হইলে রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করিবেন।
আমরা আরাে সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিতেছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করিবার জন্য আমরা অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ ও নিযুক্ত করিলাম। বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্যগণের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের ঘােষণাপত্র পাঠ করা হলে উক্ত ঘােষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে অধ্যাপক ইউসুফ আলী রাষ্ট্রপ্রধানের অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শপথবাক্য পাঠ করান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপ্রধান এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এরপর তার সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমদের নাম ঘােষণা করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্যগণের নাম ঘােষণা করে উপস্থিত সুধী, দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও জনতার সামনে সবার পরিচয় করিয়ে দেন। উপস্থিত সবাই বিপুল করতালিতে নতুন মন্ত্রিপরিষদকে অভিনন্দিত করেন। মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে এরপর বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্নেল এম এ জি ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ পদে কর্নেল আব্দুর রবের নাম ঘােষণা ও পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। অত্যন্ত উৎফুল্ল ও আনন্দ-উদ্দীপনাময় পরিবেশে পরিচয়পর্ব শেষ হওয়ার পর শুরু হয় বক্তৃতাপর্ব।
প্রথমেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত পরিষদ সদস্য সুধী দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও বিশ্ববাসীর উদ্দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। ৩০ মিনিটব্যাপী দীর্ঘ ভাষণের শুরুতেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তুলে ধরে পাকিস্তানি শাসকরা কিভাবে বাঙালি জাতিকে অন্যায় এক যুদ্ধের মুখােমুখি দাঁড় করিয়েছে, তার ব্যাখ্যা দেন। ৬-দফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন এবং ‘৭০-এর নির্বাচনে বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও জয়লাভের প্রেক্ষিতে বাঙালির প্রত্যাশা এবং পাকিস্তানিদের প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ আচরণের বিশদ বর্ণনা দিয়ে বিশ্ববিবেকের কাছে বাংলাদেশের সংঘটিত পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম গণহত্যার বিবরণও তুলে ধরেন। বাংলাদেশের ব্যাপারে বৃহৎশক্তিবর্গের নীরবতায় ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেন, স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনােবল ও সাহস্যের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম নিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার-হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই শিশু রাষ্ট্রকে লালিত-পালিত করছেন। দুনিয়ার কোনাে জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। নির্যাতিত বাঙালি জাতির নেতা বিশ্বের সবার বন্ধুত্ব, সহযােগিতা এবং স্বীকৃতি কামনা করে পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ অবস্থানেরও কথাও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন। বক্তৃতা শেষে ঘােষণা দেন, আজ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হবে এ বৈদ্যনাথতলা এবং এর নতুন নাম হবে মুজিবনগর। মন্ত্রীবর্গের বক্তৃতার এক ফাঁকে প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী তার বক্তৃতায় অপেক্ষমাণ জনতা এবং সাংবাদিকবৃন্দকে জানান, দরকার হলে। আমরা বিশ বছর ধরে লড়াই করব। হতে পারে এ-যুগের ছেলেরা লড়াই করে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু পরের যুগের ছেলেরা স্বাধীনতা ভােগ করতে পারবে। বাংলাদেশ যদি রক্ষা না পায় তা হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সমস্ত মানবিকতাবােধ নষ্ট হয়ে যাবে।’ মুজিবনগরের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামও ভাষণ দেন। তিনি বলেন : আজ এই মুজিবনগরে একটি নতুন স্বাধীন জাতি জন্ম নিল। বিগত ২৪ বৎসর যাবৎ বাংলার মানুষ তার নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব নেতাদের নিয়ে এগুতে চেয়েছেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমি। স্বার্থবাদীরা কখনই তা হতে দেয়নি, তারা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও তারা বাধার সৃষ্টি করে আমাদের ওপর চালালাে বর্বর আক্রমণ। তাই আমরা আজ মরণপণ যুদ্ধে নেমেছি।
এ যুদ্ধে আমাদের জয় অনিবার্য আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করবই। আজ না জিতি, কাল জিতব, কাল না জিতি পরশু জিতবই। বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার ঘটনা দেখেও বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রবর্গ আজ যে নীরবতা অবলম্বন করছেন, তার জন্য তিনি গভীর দুঃখ প্রকাশ করে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন-“লক্ষ-লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করাকে ইসলাম কি অনুমােদন করে? মসজিদ, মন্দির বা গির্জা ধ্বংস করার কোনাে বিধান কি ইসলাম ধর্মে আছে?’ তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘােষণা করেন, ‘বাংলার মাটিতে আর কোনাে সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে যুদ্ধ করছে। নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে স্তব্ধ করা যাবে না।’ তিনি দৃঢ়কণ্ঠে ঘােষণা করেন, পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের সংযােজন হল, তা চিরদিন থাকবে। এমন কোনাে শক্তি নেই যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে পারে। বক্তৃতাপর্ব শেষ হলে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিসহ মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্য মঞ্চ থেকে নিচে নেমে আসেন। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। অনুষ্ঠানের এ-পর্বে উপস্থিত ছিলেন ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরী, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন মােস্তাফিজুর রহমান, লেফটেন্যান্ট হাফিজ প্রমুখ। বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি চৌকস। দলও প্রস্তুত ছিল। তারা কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন এবং প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ দেশী-বিদেশী শতাধিক সাংবাদিকের উদ্দেশ্যে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন : বাংলাদেশ আজ এক মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করা ছাড়া আর কোনাে গত্যন্তর ছিল না।
বর্বর পাকবাহিনী বাংলাদেশে যে নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে, তার ফলে, বাংলাদেশের জনগণের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ইয়াহিয়া খানের বােঝা উচিত, বাংলাদেশে সুপরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালিয়ে তিনি পাকিস্তানেরই কবর খুঁড়েছেন। তার এ-হত্যাযজ্ঞ একটি জাতির একতা ও সংহতি রক্ষার্থে চালানাে হয়। নি, বরং এটা ছিল মানবতার বিরুদ্ধে এক জঘন্যতম অপরাধ, বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। সেনাবাহিনী তাদের চিরাচরিত রীতিনীতি ভঙ্গ করে যে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও ধ্বংসলীলায় লিপ্ত রয়েছে তা বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে বিরল। যে-সব বৃহৎশক্তি এ-গণহত্যার প্রতি উদাসীনতা প্রকাশ করেছে, তাদের উপলব্ধি করা দরকার, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ইয়াহিয়া খান হত্যা। করেছে, পাকিস্তান আজ মৃত এবং স্বাধীন বাংলাদেশ আজ এক বাস্তব সত্য কেননা সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রত্যহ তাদের রক্ত দিয়ে এই শিশু রাষ্ট্রকে সঞ্জীবিত করছে। পৃথিবীর কোনাে শক্তিই এই নতুন রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে পারবে না এবং আজ হােক কাল হােক বিশ্বের ছােটবড় সব রাষ্ট্রকে বাংলাদেশের এ-বাস্তবতা মেনে নিতে হবেই। সুতরাং বিশ্ব রাজনীতি এবং মানবতার স্বার্থে বৃহৎশক্তিবর্গের উচিত ইয়াহিয়া খানের। ওপর প্রভাব বিস্তার করা; যেন তিনি হত্যাকারীদের পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিয়ে যান। আমাদের এ নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি এবং মুক্তিসংগ্রামে বৈষয়িক ও নৈতিক সাহায্যদানের জন্য বিশ্বের সব রাষ্ট্রের। কাছে আমি আবেদন জানাচ্ছি। এ-ব্যাপারে প্রতিটি দিনের বিলম্ব ডেকে অনিছে সহস্র মানুষের অকালমৃত্যু ও বাংলাদেশের সম্পদের বিরাট ধ্বংস। তাই বিশ্ববাসীর প্রতি আমাদের আবেদন, কালবিলম্ব না করে এই মুহূর্তে এগিয়ে আসুন এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিরবন্ধুত্ব অর্জন করুন বিশ্ববাসীর নিকট আমরা আমাদের আবেদন পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোনাে জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করে নি, অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করে নি।
দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের এই বিবৃতি প্রদানের পরও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে দাঁড়াতে হয় সাংবাদিকের সম্মুখে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অভ্যুদয়ের লগ্নে সেই রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে অজস্র কৌতূহল। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাংবাদিকদের সব প্রশ্নেরই জবাব দেন রাষ্ট্রনায়কোচিত দৃঢ়তার সঙ্গে। এরই মাঝে সেলিম মুন্সী তার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে শুরু করে দেন মিষ্টি বিতরণের কাজ। সব মিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের অনুষ্ঠান। এ দু’ঘন্টায় স্থানীয় জনসাধারণের কারাে বুঝি চোখের পলক পড়ে নি, এমনকি হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনও কেউ টের পায় নি। এতক্ষণে চোখের পলক ফেলে দেখতে পায়—অনুষ্ঠান শেষে মন্ত্রিপরিষদের সবাই চলে যাচ্ছেন, কাঁধে বিশাল ক্যামেরাঅলা সাংবাদিকেরা, অন্যান্য অচেনা সুধীজন—সবাই চলে যাচ্ছে পশ্চিমে, সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে এলাকাবাসীর তবু মনে হয়—ঐ তাে সারিবদ্ধ হয়ে বসে আছেন সবাই তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী খােন্দকার মােশতাক আহমদ আইন, সংসদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী— অর্থমন্ত্রী ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল—বাঙালি জাতির জীবনে অবিস্মরণীয় একটি দিন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা হয়ে গেল মুজিবনগর এই মুজিবনগরই হল বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী। নবগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে এই ‘মুজিবনগর’ নামই সাড়ে সাত কোটি বাঙালি এবং বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হয় মুক্তিযুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পরদিনই হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দখলে চলে যায় মেহেরপুর অঞ্চল। ফলে বাধ্য হয়ে মুজিবনগর প্রশাসনকে সুবিধামতাে মুক্তাঞ্চলে নিয়ে যেত হয়। তবু মুজিবনগরের নামেই চলে মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ সরকারের সময় কার্যক্রম। অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে মুজিবনগর নামের আর পরিবর্তন হয় নি। বরং সমগ্র বাংলাদেশেরই অন্যনাম হয়ে গেছে মুজিবনগর।
সূত্রঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর – রফিকুর রশীদ