You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২৬শে আগস্ট, রোববার, ১৯৭৩, ৯ই ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

গলদটা তো গোড়ায়

পাট ব্যবসায়ের জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান এবং পাটক্রয় কেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি সরকার গ্রহণ করেছেন। এ তথ্য প্রকাশ করে আমাদের পাটমন্ত্রী গত পরশু এক সাংবাদিক সম্মেলনে শতকরা পঁচাশি ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পাট ব্যবসাকে তেজী করে তুলতে সর্বশ্রেণীর মানুষের সহযোগিতা কামনা করেছেন। পাট ক্রয় কেন্দ্রের স্বল্পতা পাটের মূল্য নির্ধারণে উৎপাদনকারী কৃষক শ্রেণীর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দান, ফড়িয়াদের অবশ্যম্ভাবী দৌরাত্ম্য প্রভৃতি বাস্তব প্রায় সবগুলো অবস্থার চিত্র তুলে ধরবার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী মহোদয় ভবিষ্যতে এ সকল সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয়তাও গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। চলতি মওসুমের পাটনীতি ঘোষণা করবার পর প্রায় একমাস যেতে না যেতেই মন্ত্রী মহোদয় যে অভিজ্ঞতা সমূহ সঞ্চয় করেছেন এবং আগামী আরো তিনমাসে তিনি পাট ব্যবসা সংক্রান্ত যে অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন তার প্রেক্ষিতে ডিসেম্বরে নাকি সমগ্র পাটনীতিই পুনর্বিবেচিত হবে এবং প্রয়োজনে তার সংশোধনও করা হবে।
অভিজ্ঞতা মানুষকে পরিশুদ্ধ করে। আমাদের পাটমন্ত্রীও নিশ্চয়ই এতদিনে তাঁর ঘোষিত পাটনীতির দুর্বলতাগুলো সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। চলতি মওসুমের পাটনীতি ঘোষিত হবার পর থেকে নানা সংবাদপত্রে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়ে আসছে তা থেকে পাট ব্যবসায়ের যে দুর্বলতাগুলো আমাদের চোখের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো : এক. ভারত এবং বাংলাদেশের পাটের বাজারে বড় বেশী ফারাক থাকায় বাংলাদেশের পাট চোরাচালানীদের মাধ্যমে ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে, দুই. পাট গুদামগুলোর অধিকাংশ গত মওসুমের পাটে ভর্তি হয়ে থাকায় নতুন পাট গুদামজাত করার মতো জায়গার অভাব পরিলক্ষিত হবে। তিন. অর্থের অভাবে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নাকি কর্মকর্তাদের চক্রান্তেই পাট ক্রয়কেন্দ্র খোলায় গড়িমসি করা হচ্ছে। চার. পাটক্রয় কেন্দ্রের স্বল্পতার সুযোগ নিয়ে মুনাফাশিকারী ফড়িয়ারা সাধারণ চাষীদের নিকট থেকে জলের দামে পাট কিনে নিচ্ছে। এগুলোই বাংলার সোনালী আঁশ পাটের বর্তমান অবস্থা। অবশ্য পাট ব্যবসায়ের জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান হওয়ায় অতঃপর পাট কেন্দ্রগুলো না খোলার আর কোন কারণ থাকবে না।
গত এক মাসে সংবাদপত্রে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে তার সবক’টি আশঙ্কাই কিন্তু আমরা নয়া পাটনীতি ঘোষিত হবার পরদিনই সম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রকাশ করেছিলাম। বর্তমান বাস্তব অবস্থার কিছুটা স্বীকৃতি মন্ত্রী মহোদয়ের গত পরশুর সাংবাদিক সম্মেলনেও পাওয়া গেছে। কিন্তু শুধুমাত্র এই সহজ স্বীকৃতিই কি আমাদের সোনালী আঁশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার পক্ষে ‍খুব একটা সহায়ক হবে? অবস্থা যেমনভাবেই চলতে থাকুক না কেন বর্তমান পাটনীতিতে কোনভাবেই লাভবান হবে না তারা যারা গায়ের ঘাম ঝরিয়ে পাট চাষ করেন, যুগ যুগ ধরে যারা বঞ্চিত হয়ে এসেছেন। বঞ্চিত হবেন তারা স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশেও অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুসারেই পাটচাষীরা অতঃপর পাট চাষের চাইতে ধান চাষে অধিকতর আগ্রহী হবেন, আর শতকরা পঁচাশি ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী দেশের এই সম্পদ বিনষ্ট হবে শুধু সরকারের ভ্রান্ত নীতি অনুসরণের ফলে। এ অবস্থা কতদিন চলবে আমরা জানিনা, শুধু জানি এটা জাতির প্রগতির পথ নয়, পথ এটা নয় সমৃদ্ধি লাভের। আমরা তাই এর নিন্দা করি, এই ভ্রান্ত নীতির অবসান কামনা করি।

জহির শাহ-র আনুগত্য

আফগানিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত বাদশা মোহাম্মদ জহির শাহ শেষাবধি সিংহাসনের প্রতি তাঁর দাবী পরিত্যাগ করেছেন। জহির শাহ আফগানিস্তানের জনগণের ইচ্ছায় সাড়া দিয়ে বর্তমান প্রজাতান্ত্রিক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন বলে রোম থেকে প্রচারিত এক সংবাদে জানা গেলো। এইতো মাস খানেক আগের কথা। বাদশা জহির শাহ তখন রোমে অবস্থান করছিলেন। এমনি সময়ে বাদশা জহিরের চাচাত ভাই এবং শ্যালক সর্দার মোহাম্মদ দাউদের নেতৃত্বে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে গেলো এবং এই অভ্যুথানের মাধ্যমেই বাদশা জহির ক্ষমতাচ্যুত হলেন। গত পরশু ক্ষমতাচ্যুত বাদশা জহির শাহ-র সিদ্ধান্তের কতা জানা গেলো যে, আফগানিস্তানের সিংহাসনে নতুন করে বসার তাঁর কোন ইচ্ছে নেই। তিনি নতুন প্রজাতান্ত্রিক সরকারের আনুগত্য অবলীলাক্রমে মেনে নিচ্ছেন। রোমের আফগান দূতাবাসের মাধ্যমে জহির শাহ-র এই সিদ্ধান্তের কথা প্রচারিত হয়েছে। একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর এতো সহজে এবং এতো অল্প সময়ের মধ্যে খুব কম ক্ষমতাচ্যুত শাসকই নতুনের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে জহির শাহ খুবই দ্রুত পাকা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আমরা মনে করি। গত সতেরোই জুলাই আফগানিস্তানে অভ্যুত্থান ঘটেছে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত জহির শাহ রোমেই অব্স্থান করছেন। এই সময়ের মধ্যে অবশ্য আফগানিস্তানের প্রজাতান্ত্রিক সরকারের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন কিংবা বৈরী আচরণ করাটা ছিলো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু জহির শাহ আফগানিস্তানের জনগণের ইচ্ছের কাছে নিজের শ্রদ্ধাটুকু নিবেদনের জন্যে সিংহাসনের প্রতি তাঁর দাবী ছেড়ে দিয়ে অন্ততঃ শুভবুদ্ধিরই পরিচয় দিয়েছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, জহির শাহ কোন চক্রান্তকারী মহলের শিকারে না হয়ে আফগান জনগণের রায় শিরোধার্য করেছেন। ভালোই করেছেন। কারণ, জনতা যেখানে পরিবর্তন চায়, সেখানে জহির শাহ-র নাক না গলানোই শ্রেয়। সর্দার দাউদ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের অঙ্গীকার করেছেন। আফগান জনগণ এখন তাঁর কাছে সেই পরিবর্তনেরই বাস্তবায়ন দেখতে চায়। এতে যদি তিনি ব্যর্থ হন, তাহলে জনগণ নিশ্চয়ই আবার নতুন রায় গেবে। কাজেই জহির শাহ আফগানিস্তানের প্রজাতান্ত্রিক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে আফগান জনগণের রায়কেই মেনে নিলেন। আশা করি অতঃপর জহির শাহ আর নতুন চক্রান্তের সঙ্গে নিজেকে জড়াবেন না। বরং সেটাই হবে তাঁর জন্যে প্রকৃষ্ট পথ।

নারিকেল তেলের বোতলে কেরোসিন!

‘চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য’
জীবনানন্দ দাশ বড় সাধ করে রূপকের সংমিশ্রণে গভীরতম অনুভূতির প্রচ্ছায়ায় তাঁর কল্পিত মানসীর চুলের বর্ণনা দিয়েছিলেন। শুধু তিনি নন, বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক বিভিন্ন অলঙ্কারে হাজারো কবিতা গল্প ইত্যাদি লিখেছেন প্রেয়সীর কালো দীর্ঘ কেশদামকে উপলক্ষ করে, বর্ণনা দিয়েছেন প্রেমিকার চুলের নানা ভাব, ভাষা, বিশেষণের মাধ্যমে। বলা বাহুল্য বাঙালী ললনার মেঘবরণ দীর্ঘ চিকন রেশমী চুলের জন্যে তাঁরা পৃথিবীতে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যতায় সুপরিচিতা। প্রসঙ্গতঃ ‍উল্লেখ্য, তাঁদের সেই চুলের পরিচর্যার জন্যে আজ পর্যন্তও পাশ্চাত্য দেশীয় নানা ‘কসমেটিকের’ ব্যবহার আমাদের দেশের মেয়েদের সৌন্দর্য চর্চার বিশেষ প্রয়োজনীয় বস্তু হিসেবে পরিগণিত হয়নি। আজও সে চুলের পরিচর্যা হচ্ছে কেবলমাত্র নারিকেল তেল অথবা অন্য কোন সুগন্ধি তেলের ব্যবহারে। যাঁরা পাশ্চাত্যের নারীদের ন্যায় সৌন্দর্য চর্চার অনুকরণ করছেন তাঁরা সাধারণতঃ এই তেলের পরিবর্তে শ্যাম্পু ক্রিম ইত্যাদি ব্যবহার করছেন। কিন্তু এদের সংখ্যা সামগ্রিক বিচারে নেহায়েতই গণনার বাইরে বলা চলে। সুতরাং বলতে কোন দ্বিধা নেই—সুদীর্ঘকাল থেকে প্রচলিত বাঙালী ললনাদের কেশ বিন্যাসের অতি পরিচিত ও সহজলভ্য বস্তু হচ্ছে নারিকেলের তেল। সত্যি বলতে কি, সে কারণেই বুঝি আজও বঙ্গ ললনাদের অতীব প্রিয় মাথার চুলের রং এখনো ফিকে হয়নি, অবশ্য পূর্বের চাইতে যদিও লম্বায় খাটো হতে শুরু করেছে। আর যারা শ্যাম্পু, ক্রিম ব্যবহার করছেন তাদের কেশ গুচ্ছের বর্ণ গন্ধে যে কবির বর্ণনায় দেয়া ‘চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা’র মাদকতা নেই সে কথা বলাই বাহুল্য। তাই বলছিলাম বঙ্গ ললনা তার অতি প্রিয় যে কেশ গুচ্ছের জন্যে সারা পৃথিবীতে এবং প্রিয়জনের কাছে ছিলেন অনন্যা হিসেবে গর্বিতা, ছিলেন কবি-সাহিত্যিকদের ধ্যানের ছবি, তাঁদের সেই গর্ব আর থাকবে কিনা।
এইতো গতকালকের স্থানীয় একটি দৈনিকেই খবর দেখলাম ‘নারিকেল তেলের সীল করা বোতলে কেরোসিন তেল।’ এ ধরনের খবর হয়তো নতুন নয়, কিন্তু তবু উদ্বেগজনক বই কি! ‘বৈজ্ঞানিক উপায়ে শোধিত সর্বোৎকৃষ্ট নারিকেলের তেল’ সীল করা বোতল খুললে যদি চুলো জ্বালানোর কিংবা বাতি লাগানোর সাদা কেরোসিন তেল পাওয়া যায় তাহলে উদ্বিগ্ন না হয়ে কি পারা যায়? আমাদের বঙ্গ ললনারা তাহলে চুলের পরিচর্যা করবেন কি দিয়ে? কি দিয়ে করবেন কেশ বিন্যাস?
কোম্পানীর নিরাপত্তামূলক হাঁস মার্কা সবুজ রংয়ের মুখ লাগানো এবং উপরে ‘যে কোন রূপ ভেজাল ও খারাপ গন্ধ হইতে সুনিশ্চিত’ কথা লিখিত লেবেলওয়ালা বোতলের মধ্যেও যদি ভেজাল তেল মেলে তাহলে এর চেয়ে আর দুঃখের কি হ’তে পারে? ভেজাল না খাঁটি তা চিনবার আর পথ থাকলো কি? শুধু কি তাই? আসল জিনিসের মধ্যে অন্য জিনিসের কম আনুপাতিক দ্রব্য মিশ্রণ বলতেই সেটাকে ভেজাল বলা হয়। কিন্তু সেই ভেজালের স্থলে নারিকেল তেলের জায়গায় পুরোপুরি কেরোসিন! কিন্তু এটা হলো কি করে? যেখানে কোম্পানীর নিরাপত্তামূলক প্রতীক চিহ্ন ও লেবেল আঁটা সেক্ষেত্রে এই ভেজাল কোম্পানীতে না হয়ে অন্যত্র হয়েছে এই কথাই বা বলা যায় কি করে? বর্তমানে যেখানে সর্বত্র ভেজালের ছড়াছড়ি সেখানে হয়তো বা এই খবরটি আশঙ্কিত হবার তেমন কিছু নয়। কিন্তু তবু বলবো—এই ভেজাল আর কতদিন চলবে? ভেজালের সমুদ্রে গা ভাসিয়ে গোটা বাঙালী জাতি ময়ুরপুচ্ছ পরা দাঁড়কাকের পরিচিতি লাভ করবে নাতো? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এদিকটাতে একটু চোখ মেললে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। এবং সেজন্যে আমরাও তা কামনা করি। কিন্তু তাঁরা কি দয়া করে একটু চোখ মেলবেন?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!