You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরােধের দুর্গ মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গায়

ডেটলাইন ২৫ মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা কালাে অধ্যায় সূচিত হয় পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে, নিকষ কালাে অন্ধকারে, ঢাকায়। স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত বাঙালির বীরত্বপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে আলাপ-আলােচনার নামে সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র, গােলা-বারুদ এবং পর্যাপ্ত সৈন্য মােতায়েন সম্পন্ন হলে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান বেসামরিক জনগণের ওপর শুরু করে বর্বরােচিত আক্রমণ, নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোেগ। এ-দিন রাতের আঁধারে ঘটে যায় ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যা। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এক ঢাকা শহরেই লক্ষাধিক মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করার এই রেকর্ড, সত্যিই তুলনাবিহীন ঘটনা। ঢাকার খবর মেহেরপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই তুলনারহিত গণহত্যার খবর ঢাকা থেকে সর্বপ্রথম মেহেরপুরে পৌছে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নূরুল হকের মাধ্যমে মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর কাছে। ১৪.১০.৭৩ তারিখে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান : ২৫ মার্চ রাতে নূরুল হক এমপি আমাকে টেলিফোনে জানালেন যে, ঢাকায় পাকবাহিনী শহরে বের হয়ে পড়েছে এবং জনগণের ওপর। আক্রমণ চালিয়েছে। আমি তাকে আমার বাসায় অবিলম্বে আসতে অনুরােধ করি। অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম যে, ঢাকা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কুষ্টিয়াকে ঢাকায় সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর জানিয়েছে এবং কুষ্টিয়া এক্সচেঞ্জ মেহেরপুরে এই খবর জানিয়েছে। এ-খবর পাওয়ার পর মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী। 

চৌধুরী তৎক্ষণাৎ জাতীয় পরিষদ সদস্য মােঃ সহিউদ্দীন এবং আওয়ামী লীগের অন্য নেতৃবৃন্দকে অবহিত করেন। সবাই মিলে অতি দ্রুত মেহেরপুর থানায় এসে পুলিশ ওয়ারলেসের মাধ্যমে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করেন। অপারেটর আব্দুস সামাদ বহু কষ্টে একবার মাত্র সংযােগ স্থাপনে সক্ষম হন রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে ছােট্ট একটি সংবাদ ভেসে আসে—Movement start’ এরপর ওয়ারলেস সেট বন্ধ হয়ে যায়। অপারেটরও সম্পূর্ণ নিঃসংশয় হতে পারে না—এ ছােট্ট খবরটি এলাে কোথেকে!

পাকসেনাদের কুষ্টিয়া দখল

দেশের প্রধান শহরগুলাের মতাে মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা মহকুমার জেলা শহর কুষ্টিয়াতেও ২৫ মার্চ রাতেই প্রায় বিনা বাধায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগমন ঘটে। যশাের সেনানিবাস থেকে ২৭তম বেলুচ রেজিমেন্টের অফিসারসহ ১৪৭ জন সৈন্য রাত এগারটার পর কুষ্টিয়ায় পৌছে সমস্ত ব্যারিকেড উচ্ছেদ করে পুলিশ লাইন, জেলা স্কুল, থানা ওয়ারলেস অফিস ও টেলিগ্রাফ অফিসে অবস্থান গ্রহণ করে। এই বাহিনীর অধিনায়ক মেজর শােয়েব সারা শহরে ৩০ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করে। মেজর সােয়েবের অধীনে আরাে যে-সব অফিসার ছিল ক্যাপ্টেন সামাদ, ক্যাপ্টেন শাকিল এবং লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ শাহ তাদের মধ্যে অন্যতম। কুষ্টিয়া দখল করার সময় ২৭তম বেলুচ রেজিমেন্টের ছিল জিপ আরােহিত ১০৬ মি.মি. ট্যাংক বিধ্বংসী কামান; ভারি, মাঝারি ও হালকা চাইনিজ মেশিনগান, সাব-মেশিনগান, স্বয়ংক্রিয় চাইনিজ রাইফেল, প্রচুর গােলাবারুদ, যানবাহন ও শক্তিশালী বেতারযন্ত্র। কুষ্টিয়া শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অবস্থান সম্পর্কে পরবর্তীতে কুষ্টিয়ার প্রতিরােধ যুদ্ধের সফল অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী লিখেছেন : কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে তাদের প্রধান ঘাঁটি ছিল। দুই প্লাটুনের অবস্থান ছিল পুলিশ লাইনে, এক প্লাটুন পজিশন নিয়েছিল ওয়ারলেস স্টেশনে, এক প্লাটুন ছিল প্রধান ঘাঁটি জেলা স্কুলে এবং এক সেকশন ছিল কোতােয়ালি থানায় শক্তিশালী বেতার মারফত যশােরের সঙ্গে তাদের সংযােগ ছিল এবং আন্তঃপ্লাটুন সংযােগও স্থাপন করেছিল। এ-সময় কুষ্টিয়া শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জকে সম্পূর্ণরূপে বিকল করে রাখা হয়েছিল।

চুয়াডাঙ্গায় ঢাকার খবর

ব্যাপক প্রস্তুতির পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত মানুষ হত্যায় মেতে উঠেছে এ খবর ঐ রাতেই চুয়াডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাছে পৌছে যায় । একাধিক অজ্ঞাত টেলিফোনে ঢাকা পতনের খবর আসে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা, আসহাব-উল-হক-এর কাছে। গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কায় তিনি গভীর রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। কুষ্টিয়া জেলার পুলিশ সুপার ঐ দিন দাপ্তরিক কাজে চুয়াডাঙ্গা এসে রাত্রিযাপন করেন। ফলে চুয়াডাঙ্গা সদর থানা এবং এসডিপিও অফিসের টেলিফোন এবং ওয়্যারলেস সারা রাত ছিল সক্রিয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন থেকে ঐ রাতে করণীয় কী জানতে চাইলে এসপি সাহেব চুয়াডাঙ্গা থেকে ফোনে নির্দেশ দেন আত্মসমর্পণ করার জন্য। ঘটনাচক্রে চুয়াডাঙ্গা শহরের রিকশাচালক (নৈশকালীন) আকবর আলী থানা থেকে ঢাকা এবং কুষ্টিয়ার খবর জানার পর নিজে উদ্যোগী হয়ে সেই মধ্যরাতে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে জানিয়ে দেন। আওয়ামী লীগের তৎকালীন তরুণ নেতা সেলুন জোয়ার্দার এ-খবর জানার পর বিভিন্নজনকে ডেকে হেঁকে চুয়াডাঙ্গা শহরে প্রতিরােধ গড়ে তােলার উদ্যোগ নেন। স্বাধীনতা ঘােষণার বাণী চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণার যে বাণীটি বিশেষ ব্যবস্থায় ইপিআর-এর অয়্যারলেস মারফত সারা দেশে প্রেরণের উদ্যোগ নেন, চুয়াডাঙ্গায় ইপিআর-এর উইং সদর দপ্তরে সে বাণী ঠিকই পৌছায় মধ্যরাতে। সে রাতে উইং অধিনায়ক আবু ওসমান চৌধুরী এবং সহ-অধিনায়ক এ আর আজম চৌধুরী—দুজনই ছিলেন চুয়াডাঙ্গার বাইরে। এ অবস্থায় কোনাে এক দায়িত্বশীল ইপিআর কর্মকর্তা ঐ রাতেই স্বাধীনতা ঘােষণার বাণীটি মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভােকেট ইউনুস আলীর হাতে এনে দেন।

 

তিনি সে রাতের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন। ২৫ মার্চ দিনগত রাত ২টা হবে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলতেই বাকি পােশাক পরিহিত একজনকে দেখে চমকে উঠলাম। আগন্তুক বলল—ভয় নেই, এই নিন বার্তা। রাত সােয়া একটায় ইপিআর-এর ওয়ারলেসে ধরা পড়েছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতাে চিরকুটটি হাতে নিয়ে পড়লাম : This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh…. চুয়াডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী মহকুমা মেহেরপুরে স্বাধীনতা ঘােষণার বাণীটি বয়ে নিয়ে আসেন আমঝুপি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. মহিউদ্দীন। ২৬ মার্চ সকালে টিক্কা খান বেতার ভাষণে সামরিক আইনের কঠোর বিধিবিধান জানিয়ে তা অমান্য করার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কেও হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কিন্তু মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গার মুক্তিকামী জনগণ কান দেয় নি সেই ধমকানিতে। জনতা ঠিকই ভাের নাহতেই রাস্তায় নেমে আসে। 

ডা. মহিউদ্দীন আমঝুপি থেকে সকালে যান চুয়াডাঙ্গা। সেখানে প্রতিরােধ প্রস্তুতি দেখে খুবই অনুপ্রাণিত হন। অ্যাডভােকেট ইউনুস আলীর কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘােষণায় অয়্যারলেস বার্তাটির কথা তিনি জানান মেহেরপুরের নেতা জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দীনকে। জনাব সহিউদ্দীন তৎক্ষণাৎ স্থানীয় নেতাকর্মীদের জানিয়ে দেন। এভাবেই ইপিআর অয়্যারলেস মারফত প্রেরিত স্বাধীনতা ঘােষণার ঐতিহাসিক বার্তাটির কথা জানতে পারে মেহেরপুরবাসী। অবশ্য এ-খবর মুজিবনগরবাসীও জানতে পারে ২৬ মার্চেই, চুয়াডাঙ্গা উইং হেডকোয়ার্টার থেকে বৈদ্যনাথতলা ইপিআর ক্যাম্পে অয়্যারলেস মেসেজ পৌছানাের পর। চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণার যে বাণী বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথম প্রচার করা হয় তা ছিল মেহেরপুরের কৃতিসন্তান এম এ হান্নানের কণ্ঠে। তার শৈশব-কৈশাের মেহেরপুরের আমঝুপিতে কাটলেও অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভার অধিকারী হান্নান শ্রমিক-রাজনীতির সূত্র ধরে ষাটের দশকে চট্টগ্রাম আওয়ামী রাজনীতিতেও যুক্ত হয়ে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা, যাত্রা অভিন্ন জেলা শহর কুষ্টিয়া। সেই জেলারই যমজ ভ্রাতৃতুল্য দু’টি মহকুমা মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা। দুই মহকুমার রয়েছে ছয়টি থানা। রয়েছে হাজার দেড়েক গ্রামজুড়ে বিস্তীর্ণ জনপদ এবং স্বাধীনতাকামী সাহসী জনতা। অসহযােগ আন্দোলনের উদ্দীপনাময় দিনগুলােতে দূর-দূরান্তের নিভৃত গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে দীর্ঘ মিছিল এসে থানা কিংবা মহকুমা শহরের প্রতিবাদসভায় যােগ দিয়েছে, শ্লোগানে-স্লোগানে  শহরের রাজপথ মুখরিত করে চোখে স্বপ্ন আর বুকে আশা নিয়ে গ্রামে ফিরে গেছে। জনগণের বিশ্বাস—স্বাধীনতা বুঝি খুব দূরে নয়।

 

দুর্ভাবনাও হয়, গ্রামে বটতলার মাচায় বসে তর্কও হয়—পাকিস্তানি শাসকরা এমনিতেই ছেড়ে দেবে সব? ভােটে পাস করার পরও যারা বিজয়ীদের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে চায় না, তারা সহজে হাত গুটিয়ে নেবে? তাই কখনাে হয়? গ্রামের মানুষও কান খাড়া। করে থাকে, রেডিওর কাছে ভিড় জমায়, জানতে চায় ঢাকার খবর, দেশের খবর। | তারপর খবর যখন আসে তখন শুধু ঢাকার খবর নয়, ২৬ মার্চ ভাের হতে-না-হতেই জানা যায় জেলা শহর কুষ্টিয়ার খবরও দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ ঢাকা, অবরুদ্ধ কুষ্টিয়াও। কুষ্টিয়াতে পাকসেনা এসেছে যশাের সেনানিবাস থেকে ওই একই পথে ঝিনাইদহ কিংবা কালিগঞ্জ হয়ে তারা যে-কোনাে মুহূর্তে চুয়াডাঙ্গা আক্রমণ করতে পারে, আর চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুরে হানা দেওয়াও মােটেই অসম্ভব নয়।

আবার কুষ্টিয়া থেকেও পশ্চিমে এগিয়ে যমদূতরা আক্রমণ করতে পারে মেহেরপুর সীমাহীন উদ্বেগ আর উকণ্ঠায় অস্থির চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর। এ-উত্তষ্ঠার কথা অতি দ্রুত নিভৃত পাড়াগ্রামেও পৌছে যায়, পৌছে যায় আজকের মুজিবনগরেও  বিশেষত বৈদ্যনাথতলায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এর কোম্পানি হেডকোয়ার্টার (সি-কোম্পানি) হওয়ায় তাদের নিজস্ব বেতার মারফত অনেক সাম্প্রতিক সংবাদ তারা অবহিত হতে পারে। আবার ইপিআর ক্যাম্প থেকে বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে এলাকাবাসীরও জানা হয়ে যায় খবরাখবর এতঞ্চলের স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য বিরাট সৌভাগ্য যে, একাত্তরের সেই চরম উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠার দিনগুলােতে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক হিসেবে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, চুয়াডাঙ্গায় ইপিআর-এর উইং কমান্ডার হিসেবে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, সহ-অধিনায়ক এ আর আজম চৌধুরী, ঝিনাইদহে পুলিশপ্রধান হিসেবে এসডিপিও মাহবুবউদ্দিনের মতাে বাঙালি জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ অসীম সাহসী দেশপ্রেমিক মানুষকে তারা সংগ্রামী সহযাত্রী হিসেবে কাছে পেয়েছিল। শুধু সহযাত্রী কেন, এতঞ্চলকে দখলদারমুক্ত রাখার লড়াইয়ে, অবরুদ্ধ কুষ্টিয়াকে শত্রুমুক্ত করার সফল যুদ্ধে এবং সর্বোপরি এই মুক্ত মাটিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিপরিষদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানকে সম্পূর্ণ নির্বিঘ্ন করার আয়ােজনে তারা এ-অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশে দাঁড়িয়ে, কখনাে বা সামনে এগিয়ে যে-বিশাল ভূমিকা পালন করেছেন, তা কিছুতেই বিস্মৃত হওয়ার নয়। তাদের কাছে এঅঞ্চলের মানুষ অপরিশােধ্য ঋণে আবদ্ধ হয়ে আছে চিরদিনের জন্য  সামনে তখন ৩টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ১. মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গায় দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগমন এবং আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রয়ােজনীয় সব উদ্যোগ গ্রহণ। ২. নিজেদের সীমিত সামর্থ্যকে সুসংহত করে অবরুদ্ধ কুষ্টিয়াকে দখলমুক্ত করার জন্য যথাসাধ্য উদ্যোগ গ্রহণ। ৩নং দায়িতৃটির ভাবনা এসেছে আরও পরে, বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ ও আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানকে এ-অঞ্চলের মুক্ত মাটিতে নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত করার পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে।

এই তিনটি কাজই মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গার মানুষ গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। ২৫ মার্চ রাতেই দেশপ্রেমিক এসডিও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী মেহেরপুরের পথে-প্রান্তরে ঘুরে-ঘুরে ঘুম ভাঙিয়েছেন জনগণের, রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে লাগিয়েছেন। চুয়াডাঙ্গার ইপিআরপ্রধান মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ২৫শের রাতে ছিলেন কুষ্টিয়া; সকালে চুয়াডাঙ্গা পৌছেই স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন প্রতিরোেধ প্রস্তুতিতে। এরপর উল্লিখিত তিনটি কাজ করতে গিয়ে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, মহকুমা বা থানার সীমানা নয়, পুরাে দেশের মানচিত্রই তখন সবার কাছে অভিন্ন ঠিকানা হয়ে ওঠে।

অবরুদ্ধ কুষ্টিয়া : নানামুখী প্রতিরােধ

শক্রর দখলে জেলা শহর কুষ্টিয়া। যে-কোনাে-মুহূর্তে তারা কুষ্টিয়া থেকে বেরিয়ে হানা দিতে পারে মহকুমা কিংবা থানা শহর অথবা যে-কোনাে গ্রামে তবু এ আতঙ্কের কাছে পরাস্ত হয় নি এ-অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী জনতা ২৬ মার্চ ভােরবেলা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য। ভেড়ামারা, কুমারখালী, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা, দর্শনা, মেহেরপুর, গাংনী-ব্যারিকেড, প্রতিবােধ প্রচেষ্টা সর্বত্র। প্রতিরােধের এই স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আগ্রাসী আক্রমণ রুখতে হলে আশু প্রয়ােজন কুষ্টিয়ার চতুর্দিকের প্রতিরােধকামী জনতার মধ্যে সমন্বয় সাধন, যােগাযােগ স্থাপন। মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এবং চুয়াডাঙ্গায় ইপিআর উইং কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী স্থানীয় প্রতিরােধ উদ্যোগ উৎসাহিত করা এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণকে সমধিক গুরুত্ব দেন। 

মেহেরপুরে প্রতিরােধের প্রস্তুতি

দেশের প্রধান শহরগুলাের মতাে মেহেরপুরের ৩৬ মাইল পূর্বের জেলা শহর কুষ্টিয়া পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে গেলেও ১৮ মাইল দক্ষিণ-পূর্বের শহর চুয়াডাঙ্গা তখনাে শত্রুমুক্ত। কিন্তু আক্রমণ যে-কোনাে মুহূর্তে যে-কোনাে-দিক থেকে হতে পারে। দেশে সামরিক সংঘর্ষ যে অনিবার্য হয়ে উঠেছে, সেটা উপলব্ধি করেই ২১, ২২ ও ২৩ মার্চ ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমদের বাসায় বৈঠক করে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, নড়াইলের মহকুমা প্রশাসক কামালউদ্দিন সিদ্দিকী, মাগুরার মহকুমা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম এবং গােয়ালন্দের মহকুমা প্রশাসক শাহ মােহম্মদ ফরিদ প্রতিরােধের সম্ভাব্য উপায় নিয়ে আলােচনা করেন। তিন দিনের বৈঠকে গৃহীত প্রতিরােধ-পরিকল্পনার সঙ্গে ২৫ মার্চ রাতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শের সমন্বয় ঘটিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ইএলাহী চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে মেহেরপুরকে রক্ষা করার জন্য আশু করণীয় বিষয়গুলাে স্থির করে ফেলেন। মেহেরপুরে প্রতিরােধের প্রচারণা ২৫ মার্চ গভীর রাতেই মাইকে প্রচার করে মেহেরপুরবাসীকে জানিয়ে দেওয়া হয়—পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ঢাকাসহ জেলা শহর কুষ্টিয়া আক্রান্ত হয়েছে। এখন জনগণকে প্রতিরােধের প্রস্তুতি নিতে হবে। শহরে এ প্রচারের দায়িত্ব নেন ছাত্রলীগের সভাপতি শাহজাহান খান বিশু।

এদিকে আওয়ামী লীগের সম্পাদক ইসমাইল হােসেন সাব-রেজিস্ট্রার আবু বকরকে সঙ্গে নিয়ে সয়েলটেক-এর একটি গাড়িতে চড়ে গাংনী আসেন। রাতেই থানা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, আনসার কমান্ডার আলতাফ হােসেন ও আবুল কাশেম কোরাইশীকে ডেকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। অতঃপর জোড়পুকুরে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহমানকে ডেকে মেহেরপুরের পূর্ব-সীমান্তে খলিসাকুণ্ডি কাঠের ব্রিজ অচল করার দায়িত্ব দেন। ছাত্রলীগের সম্পাদক মেহেদী বিল্লাহও গভীর রাতে গাংনীতে এসে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে পরিস্থিতি অবহিত করে আশু করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেন এবং থানা আওয়ামী লীগের সম্পাদক হিসাবউদ্দিনকে সমস্ত  খবর জানান। মহকুমা প্রশাসক নিজেই গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটে যান আমঝুপি, বাড়াদি, রাজনগর প্রভৃতি এলাকায় প্রতিরােধের প্রস্তুতি গ্রহণের কথা বলতে।

মেহেরপুরকে বিচ্ছিন্নকরণ

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে মেহেরপুরকে রক্ষা করতে হলে কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার সঙ্গে সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন বা বিঘ্নিত করাটাই প্রথম কর্তব্য বলে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ মনে করেন। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে জনগণের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণাকারী মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ইএলাহী চৌধুরী তার সাক্ষাৎকারে জানান : ২৫ মার্চ রাতে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা পাকা সড়কে গাছ কেটে বেরিকেড তৈরি করা হয় এবং মেহেরপুরকে চুয়াডাঙ্গার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করা হয়। মেহেরপুর-কুষ্টিয়া রাস্তায় খলিশাকুণ্ডি কাঠের পুল ভেঙে দেওয়া হল। একদল যুবক এই পুল ভাঙার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মেহেরপুর শহরের ভৌগােলিক অবস্থানটা এমন যে কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার সঙ্গে সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করতে পারলেই অনেকাংশে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। তাছাড়া মাত্র দু-তিন মাইলের মধ্যে ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে বেতাই-কৃষ্ণনগর হয়ে কলকাতার সঙ্গেও যােগাযােগ করা সম্ভব। ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে মেহেরপুর জেলার প্রায় ৪০ মাইল সীমানা অবস্থিত। প্রয়ােজন হলে অতি সহজে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। তাই সবকিছুর আগে কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার সঙ্গে যােগাযােগ বিচ্ছিন্নকরণের দিকেই মনোেনিবেশ করা হয়। 

মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের প্রায় মাঝামাঝি স্থানে মাথাভাঙ্গা নদীর ওপর খলিশাকুণ্ডি কাঠের ব্রিজ। ইসমাইল হােসেন ২৫ মার্চ রাত দুটোর সময় জোড়পুকুরে এসে আব্দুর রহমান এবং জালালউদ্দিনকে ডেকে সামগ্রিক পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলেন। তারপর আব্দুর রহমানকে খলিশাকুণ্ডিতে পৌছে দিয়ে ব্রিজের দায়িত্ব দেন। আব্দুর রহমান খলিসাকুণ্ডি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মােয়াজ্জেম হােসেনের নেতৃত্বে গ্রামবাসীদের ডেকে এনে সবাই মিলে ভাের হওয়ার আগেই মাথাভাঙা নদীর উপরের কাঠের ব্রিজ ভেঙে ফেলেন। ফলে কুষ্টিয়ার সঙ্গে মেহেরপুরের সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।  এ-দিকে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর নির্দেশ পেয়ে আমঝুপিতে রীতিমতাে সাড়া পড়ে যায়। ডা. মহিউদ্দিন, ডা. আজহার আলী, শামসুজ্জোহা, সিরাজ মাস্টার, সাত্তার মাস্টার, গােলজার আলী, কোবাদ | আলী, আতর আলী, এ কে এম শামীম, নজরুল ইসলাম, আমিরুল আজিম প্রমুখ অসহযােগ আন্দোলনের সৈনিকেরা পঁচিশে মার্চের মধ্য রাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন রাস্তায়। গ্রামের আরাে লােকজন তাদের আহ্বানে ছুটে আসেন। শুরু হয় মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের দু’পাশের প্রাচীন গাছ কাটা। মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় গাছ কাটার শব্দে। সেই সঙ্গে মাঝে মধ্যেই গগনবিদারী শ্লোগান ওঠে—জয়বাংলা।

তৌফিক-ই-এলালী চৌধুরী রাজনগরের ফণীভূষণ সাহা ও বাড়াদির এমদাদুল হককে গাছ কাটার নির্দেশ দিলে তারা ঐ রাতেই পাটকেলপােতার মােজাহার, শিংহাটির হাবিবুর, দরবেশপুরের নাসিরকে ডেকে গ্রামবাসীর সহযােগিতায় গাছ কাটার কাজ শুরু করে দেন। ভাের হওয়ার আগেই মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কে বড়-বড় গাছের গুড়ি ফেলে ব্যারিকেড তৈরি হয়ে যায়। মেহেরপুরে সামরিক আয়ােজন মেহেরপুরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও মহকুমা প্রশাসক ২৫ মার্চ রাতে সামরিক প্রস্তুতির দিকে নজর দেন। বিদ্যমান বাস্তবতা হচ্ছে—ইপিআর বাহিনীর চুয়াডাঙ্গাস্থ ৪নং উইং-এর অধীন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (মুজিবনগর) অবস্থিত সি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে এক কোম্পানি ইপিআর সদস্য আছে বটে, কিন্তু তাদের অবস্থান বিভিন্ন সীমান্ত ফাঁড়িতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রায় প্রত্যেক ফাড়িতে দু-একজন অবাঙালি ইপিআরও আছে। আশার কথা, সি-কোম্পানির বাঙালি অধিনায়ক সুবেদার মুকিত নিজেই। অবাঙালি ইপিআরদের নিরস্ত্র করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু সে-খবর না-জেনেই আওয়ামী লীগ নেতা ইসমাইল হােসেন সাব-রেজিস্ট্রার আবু বকরের মােটরসাইকেলে চড়ে ২৫ মার্চ ভাের রাতে ইছাখালি ইপিআর ক্যাম্পের উদ্দেশে রওনা হন। পথিমধ্যে কামদেবপুরে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য তােফাজ্জেল হােসেনকে পেয়ে এই দায়িত্ব দিয়ে তারা আবার মেহেরপুরে ফিরে আসেন। ২৫ মার্চ রাতে মূলত বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে থাকা আনসার ও মুজাহিদদের একত্রিত করার প্রতি মনোেযােগ দেওয়া হয়। এ-প্রসঙ্গে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী জানান ।

মেহেরপুরের আনসার কমান্ডারকে আমি আদেশ দিই ২৬ মার্চের মধ্যে। মেহেরপুর মহকুমার সমস্ত আনসার ও মুজাহিদকে একত্রিত করার জন্য। মহকুমা প্রশাসকের আদেশ পেয়ে রাত ১২টার পর নজরুল ইসলাম ভোদা চাদু-যাদবপুর থেকে আনসার ইন্সট্রাক্টর এস এম আল আমিনকে এবং ওলি ড্রাইভার আরাে দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে টুঙ্গি থেকে বশির আহমেদকে ডেকে আনেন। এস এম আল আমিন মেহেরপুরে এসে সার্বিক পরিস্থিতি জানার পর শহর ও শহরসন্নিহিত বামুনপাড়ার আনসারদের কিছুক্ষণের মধ্যে একত্রিত করেন। তারপর অস্ত্রাগার খুলে সবার হাতে একটি করে রাইফেল ও ৫ রাউন্ড করে গুলি তুলে দিয়ে শহরে টহল দেয়ার কাজে নিয়ােজিত করেন।  এদিকে আনসার কমান্ডার আলতাফ হােসেন ও আবুল কাশেম কোরাইশী তাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত এক প্লাটুন আনসারকে একত্রিত করার জন্যে সেই রাতেই উদ্যোগী হন। মাগুরার আনসার অ্যাডজুটেন্ট হাশেম খান এ সময়ে ছুটিতে বাড়িতে থাকায় মেহেরপুরের স্থানীয় তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হন। মেহেরপুরে জ্বালানি তেল সংগ্রহ। যুদ্ধকালীন সময়ে জরুরি প্রয়ােজনে পড়ে জ্বালানি তেলের। এস এম আল আমিন আনসারদের অস্ত্র দেওয়ার পর তেল সংগ্রহে সচেষ্ট হন। রাত তিনটার সময় আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক ইসমাইল হােসেন মণ্ডল ওরফে মানিক মিয়ার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে বাড়াদি ফার্মের একটি গাড়িতে করে তেলের সন্ধানে চুয়াডাঙ্গা রওনা হন।

ভাের হওয়ার আগেই ৯৬ গ্যালন পেট্রোল নিয়ে তিনি মেহেরপুরে ফিরে আসেন  জ্বালানি তেলের সংকটের কথা বিবেচনা করে অসহযােগ আন্দোলনের শেষ দিকে তেঁতুলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা নূরুল হুদা মহকুমা প্রশাসকের বিশেষ নির্দেশে ডা. মােশাররফ হােসেনকে সঙ্গে নিয়ে তেল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতের করিমপুরে যান। বেলডাঙ্গার এমএলএ খেদের সাহেবের সঙ্গে দেখা করলে তিনি বেলডাঙ্গা হাইস্কুলে নিয়ে গিয়ে ১০০০ টাকা চাঁদা তুলে দেন। নূরুল হুদা সে-দিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন : কিন্তু করিমপুরে এসে তেল কেনার জন্য আমাদের কোনাে টাকাই খরচ হয় নি। ‘জয়বাংলা’ পতাকাশশাভিত গাড়ি দেখে করিমপুরের জনসাধারণ উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। পেট্রোল পাম্পেও কোনাে টাকা। লাগে নি, তারা স্লিপ দিয়ে তেল নিয়ে যেতে বলেন। করিমপুর বাজার কমিটিই নাকি চাঁদা তুলে মূল্য পরিশােধ করবে। নূরুল হুদা প্রথম চালানের দু’ব্যারেল তেল মেহেরপুরে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয় পৌছে দেওয়ার পর নিজ বাড়িতে তেলের মজুদ গড়ে তােলেন। মেহেরপুরে জনগণের অভূতপূর্ব সাড়া। ২৬ মার্চ সকাল হতে-না-হতেই মেহেরপুর ও গাংনীতে জনগণের অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ করা যায়।

সেই সঙ্গে চোখেমুখে অজানা আশঙ্কা ও কৌতূহল  সবাই যেন ব্যক্তিসত্তা ও স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সম্মিলিত সত্তায় রূপান্তরিত হয়েছেন। দেশের জন্য একটা কিছু করতে ব্যাকুল সবাই। খবর পেয়ে বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছুটে আসছেন আনসার-মুজাহিদরা। তাদের খাদ্যরসদ যােগাড় করার জন্য স্বেচ্ছাসেবকরাও মহা ব্যস্ত গাংনীতে সকালবেলায় হিসাবউদ্দিন, জালালউদ্দিন, আব্দুর রহমান, ডা. ইসমাইল হােসেন প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতা যখন স্বেচ্ছাসেবকদের কর্মপরিকল্পনা ভাগ করছিলেন, ঠিক তখনি মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ইএলাহী চৌধুরী গিয়ে হাজির হন। সবার কর্ম-উদ্দীপনায় তিনি খুশি হন। বিশেষত খলিশাকুণ্ডি কাঠের ব্রিজ ভেঙে ফেলার খবরে উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি আব্দুর রহমানকে আগামী যুদ্ধের সেনাপতিত্ব গ্রহণ করতে বলেন। এ-দিকে গাংনী থেকে ৩২ জন আনসারের একটি প্লাটুন চিলা ফার্মের ট্রলিতে করে মেহেরপুরে রওনা হন। মেহেরপুর থানার আনসাররাও ততক্ষণে একত্রিত হয়েছেন। এস এম আল আমিনের ভাষ্যমতে, ২২৩টি রাইফেল আনসারদের হাতে তুলে দিয়ে পুনরায় সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ ও কুচকাওয়াজের আয়ােজন করা হয়। প্রয়ােজন হলে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ছাত্র-যুবকদের অনেকেই প্রস্তুত। মেহেরপুরে শাহাবাজউদ্দিন নিজু ও মেহেদী বিল্লাহ, গাংনীতে নূরুল হুদা ও আক্তারুজ্জামান ইতােমধ্যে আগ্রহী যােদ্ধাদের সম্ভাব্য তালিকাও তৈরি করেন। এখন জরুরি প্রয়ােজন অস্ত্র প্রশিক্ষণের মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন : সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, আমাদের যে-কোনাে জায়গা থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে এবং শুধু ভারতই আমাদের এই সাহায্য করতে পারে। 

মেহেরপুরে মেডিকেল টিম

একদিকে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরােধের প্রস্তুতি, প্রতিরােধ যােদ্ধাদের সংগঠিত করার উদ্যোগ, অন্যদিকে যুদ্ধাহতদের চিকিত্স—সবদিকেই সজাগ দৃষ্টি রাখেন মেহেরপুরের নেতৃবৃন্দ। দক্ষিণপশ্চিম রণাঙ্গন থেকে বিভিন্ন ফ্রন্টে পাকসেনাদের মােকাবিলার সিদ্ধান্ত হলে যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসা ও সেবাশুশ্রুষার পরিকল্পনা করা হয়। মেহেরপুর হাসপাতালের ডাক্তার শামসুজ্জোহা কোরেশী দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তরে নবউদ্যোগে গঠিত হাসপাতালে যােগদান করলে ডা. আবু আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে মেহেরপুরে একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়। বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত ওষুধপত্র সংরক্ষণ ও সরবরাহের দায়িত্ব পালন করেন শামসুল হুদা। ২৮ মার্চের পর বেশ কিছু ভারতীয় ওষুধপত্র এই মেডিকেল টিমের হাতে এসে পৌছায়। | দক্ষিণে মুজিবনগরে গঠিত বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির সংগৃহীত ওষুধপত্রও প্রায় প্রতিদিনই মেহেরপুরের এই মেডিকেল টিমের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে সেদিনের সেই সংকটময় মুহূর্তে মেহেরপুরের নেতৃবৃন্দের এই উদ্যোগ ছিল প্রয়ােজনীয় এবং প্রশংসনীয়। মেহেরপুর থেকে ভারতে যােগাযােগের চেষ্টা। ২৬ মার্চ সকালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গেই সর্বপ্রথম যােগাযােগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ভারত-পাকিস্তানের ঐতিহাসিক বিরােধের পটভূমিকায় এটা সুস্পষ্ট ছিল যে, বাংলাদেশের যেকোনাে সামরিক বা গণঅভ্যুত্থানে ভারতের সমর্থন পাওয়া সম্ভব এছাড়া মেহেরপুরের অবস্থান একেবারে ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন হওয়ায় বহু আগে থেকেই দু’পারের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল।

এ-সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ইএলাহী চৌধুরী ভারতের কাছে সাহায্য চেয়ে দুটি পৃথক চিঠি পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেন। একটি চিঠি ভারতে পৌঁছানাের দায়িত্ব পান আওয়ামী লীগ নেতা আ কা ম ইদ্রিস এবং শাহাবাজউদ্দিন নিচ্ছু তারা দুজনে দারিয়াপুরের আলীজান মাস্টার এবং ডা. শামসুল হুদার মাধ্যমে সেই চিঠি পৌছে দেন ভারতের নাটনা বিএসএফ ক্যাম্পে।  এ-চিঠিটি ছিল নদীয়ার জেলা প্রশাসকের কাছে লেখা। চিঠিটির একটি অনুলিপি মেহেরপুর সীমান্তের বিপরীতে অবস্থিত ৭৬ বিএসএফ-এর কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল চক্রবর্তীর কাছে পাঠানাে হয়। এটি পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন ছাত্রলীগের সম্পাদক মেহেদী বিল্লাহ।  নদীয়ার জেলা প্রশাসকের কাছে লেখা চিঠিটি অনতিবিলম্বে দিল্লিতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানাে হয়েছিল। তারই ফলশ্রুতিতে ২৯ মার্চ তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীকে মেহেরপুরের বিপরীতে অবস্থিত বেতাই বিএসএফ ক্যাম্পে এসে দেখা করতে বলা হয়।  মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসকের অপর চিঠিটি ছিল ভারতীয় জনগণের উদ্দেশে লেখা Indian Brother help us- এই আবেদন সংবলিত। জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দিন ও মহকুমা প্রশাসকের আদেশক্রমে এ-চিঠি। ভারতের বেতাই বিএসএফ ক্যাম্পে পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন সীমান্তবর্তী বাড়িবাঁকা গ্রামের দুই যুবক ইদ্রিস আলী ও মজিবর রহমান। বর্তমানে মুজিবনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ইদ্রিস আলী এক সাক্ষাৎকারে জানান  হারিকেনের আলােতে আমরা প্রথমে নাটনা ক্যাম্পে যাই। এসডিও সাহেবের চিঠি দেখিয়ে আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য খুলে বলতেই দু’জন বিএসএফ সঙ্গে করে বেতাই লালবাজারে পৌছে দেন। সেখানে | আমরা ক্যাপ্টেন যাদবের হাতে এসডিও সাহেবের চিঠি হস্তান্তর করি।” সেই রাতেই ক্যাপ্টেন যাদব চৌধুরী, বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক এবং ভারতীয় জনগণ পত্রবাহক ইদ্রিস আলী ও মজিবুর রহমানকে নানান প্রশ্ন করে মেহেরপুর তথা বাংলাদেশের খবর জানতে চান। অতঃপর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর চিঠির কথা জানানাে হয়। অমৃতবাজার’ ও ‘যুগান্তর পত্রিকার ২৭, ২৮, ২৯ ও ৩০ মার্চ সংখ্যায় এই সংক্রান্ত খবর অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। মেহেরপুর-বেতাই সংবাদপ্রবাহ।

২৬ মার্চ রাতে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর বিশেষ চিঠি নিয়ে বাড়িবাঁকা গ্রামের ইদ্রিস আলী ও মজিবর রহমানকে মেহেরপুরের তিন মাইল পশ্চিমে বেতাই বিএসএফ ক্যাম্পে পাঠানাের নেপথ্যে ঐ গ্রামের আফসার আলী ও মােহম্মদ ইদ্রিস আলী নামের দুই আনসার বিশেষ ভূমিকা রাখেন। | পত্রবাহক ইদ্রিস আলী ও মজিবর রহমান বেতাই থেকে ৩০ মার্চ ফিরে এসে আনসার দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে ১ এপ্রিল জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেন। তারা বেতাই-লালবাজারের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির খবরা-খবর জানান। বাড়িবাঁকা গ্রামের এই চার যুবককে পরবর্তীতে মেহেরপুর ও বেতাইয়ের মধ্যে সংবাদ আদান-প্রদানের দায়িত্বে নিয়ােজিত করা হয়। চারজনের মধ্যে পালাক্রমে দু’জন বেতাইয়ে থাকতেন, আর দু’জন মেহেরপুর হােটেলবাজারে আনসার অ্যাডজুট্যান্টের অফিসে থাকতেন। প্রতিদিন সকালে পালাবদলের সময় প্রায়ই সাব-রেজিস্ট্রার আবু বকর ও সাহারবাটির আব্দুর রহিম খােকন তাদের মােটরসাইকেলে চড়িয়ে আনা-নেয়া। করতেন। আর বেতাই থেকে ফিরে আসার সময় তারা প্রতিদিন আনন্দবাজার, যুগান্তর প্রভৃতি ভারতীয় পত্রিকা মেহেরপুরে নিয়ে আসতেন। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে মেহেরপুরের প্রতিনিধি। জেলা শহর কুষ্টিয়াকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে রেখে মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা থেকে নিরাপদে যুদ্ধ পরিচালনা সম্ভব নয়—এই বিবেচনা থেকে কুষ্টিয়াকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গায় ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ২৬ মার্চ রাতে চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ডের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আশু করণীয় বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করেন। দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ডের সহঅধিনায়ক ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে জানান । ২৬ মার্চ রাতে মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী সাহেব এবং ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমদের সঙ্গে কুষ্টিয়া সম্পর্কে আলােচনা হয়। কুষ্টিয়াতে ইতােমধ্যে পাকিস্তানি সৈন্য চলে এসেছিল।

কিভাবে আক্রমণ করা হবে এ বিষয়ে আমরা মতবিনিময় করি।” মেহেরপুরে বিস্ফোরক তৈরি ২৬ মার্চ জেলখানা থেকে বেশ কিছু দুর্ধর্ষ ডাকাতকে বিশেষ শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া হয়। তাদেরকে ভারত থেকে বিস্ফোরক দ্রব্যাদি নিয়ে এসে মেহেরপুরে বসে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বােমা তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। জামাত কানা, আকবর, ইদ্রিস, শক্তি দাস জেলখানা থেকে মুক্তি লাভের পর দেশের কাজে লাগার এই দুর্লভ সুযােগ পেয়ে ভীষণ খুশি হন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হােসেন এদের নিয়ে এসে মানিক মিয়ার পুরাতন গােডাউনে বসিয়ে বেশকিছু বােমা বানিয়ে নেন। শাহাবাজউদ্দিন নিৰ্জ্জু ও নজরুল ইসলাম সেই বােমা গুনে খাতায় লিখে রেকর্ড রাখেন।

মেহেরপুরে কন্ট্রোলরুম স্থাপন

মেহেরপুরে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয় ২৬ মার্চ থেকেই প্রতিরােধ আন্দোলনের কন্ট্রোলরুম হয়ে উঠেছিল। প্রকৃতপক্ষে ২৭ তারিখের পর তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রক্ষা করে চলেন এবং নিজ কার্যালয়ে টেলিফোন সুবিধাসহ কন্ট্রোলরুম খােলেন। কন্ট্রোলরুমে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন ইসমাইল হােসেন, আ কা ম ইদ্রিস, শাহাজাহান খান বিশু, মেহেদী বিল্লাহ প্রমুখ নেতা। ২৭ মার্চ গাংনী বাজারের মাঝখানে জলিল মিয়ার মিল ঘরে কন্ট্রোলরুম খােলা হয়। তবে টেলিফোনের পাবলিক কল অফিসটিই হয়ে ওঠে। যােগাযােগের প্রধান কেন্দ্রস্থল। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পােস্টমাস্টার শামসুদ্দিন মিয়া। | স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সব কাজকর্মের তদারকি করার ফাকে-ফাকে কন্ট্রোলরুমে দায়িত্ব পালন করেন আব্দুর রহমান, জালালউদ্দিন, ইসমাইল ডাক্তার, শামসুদ্দিন মিয়া, এনামুল হক, আব্দুর রশীদ প্রমুখ নেতা। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নুরুল হক ও হিসাবউদ্দিন মেহেরপুরের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ অব্যাহত রাখেন। মেহেরপুরে খাদ্য সগ্রহ কেন্দ্র কুষ্টিয়ার প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ২৭ মার্চের মধ্যেই মেহেরপুর ও গাংনী থানার বিভিন্ন গ্রাম থেকে আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর প্রায় শ দুয়েক সদস্যকে মেহেরপুরে একত্রিত করে আনসার ব্যারাকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তাদের নিয়মিত খাদ্য সরবরাহের জন্য মেহেরপুর নিউমার্কেটের একটি ঘরে ও গাংনীতে জলিল মিয়ার মিল ঘরে খাদ্য সংগ্রহ কেন্দ্র খােলা বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা চাল, ডাল, ময়দা, গম, গুড়, চিনি, লবণ ও তরকারি সংগ্রহ করেন। সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছায় পৌছে দেন বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী। এমনকি গৃহবধূরা পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে গাছের লাউ, শিম, শাকসবজি, মুরগির ডিম স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে তুলে দেন সংগৃহীত খাদ্যসামগ্রী গাংনীতে তদারক করতেন ডা. ইসমাইল, শামসুদ্দিন মিয়া, হারান থানদার, ওমর আলী মাস্টার, গােলাম রহমান, সবদেল মণ্ডল প্রমুখ।

মেহেরপুরে বন্দুকবাহিনী গঠন

মেহেরপুরের অধিকাংশ বন্দুক মালিকের সহযােগিতায় মুছাদ মিয়ার বাড়িতে গড়ে ওঠে বন্দুকবাহিনী। এ-বাহিনী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সিরাজুল ইসলাম পটল, প্রশান্ত ভট্টাচার্য মানু, আবুল হাশেম, শাহাবাজউদ্দিন নিচ্ছু প্রমুখ। বন্দুকবাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই দায়িত্ব ভাগ করে নিয়ে সারা শহরে দিনরাত টহল দেওয়ার এবং শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা করেন। এ-দিকে গাংনীতে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বন্দুকবাহিনী। গাংনী থানার বিভিন্ন গ্রামের বন্দুক মালিকের কাছে আহ্বান জানিয়ে তাদের বন্দুক সংগ্রহ করে গাংনী বাজারে জলিল মিয়ার মিল ঘরে জমা করা হয়। এই বন্দুকবাহিনী সংগঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। হিসাবউদ্দিন, আফজালুল হক, নূরুল হুদা, আক্তারুজ্জামান, খােকন প্রমুখ।

মেহেরপুর প্রশাসকের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তান সরকারের কর্মচারী নই’ বলে ঘােষণা করার পর মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ২৬ মার্চ সকালে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর থেকে তিনি নিজ গাড়িতে সর্বদা এই পতাকা ব্যবহার করতে থাকেন। ২৭ মার্চ গাংনী থানায় নিভৃত এক পাড়াগাঁয়ে এই পতাকা তােলাকে কেন্দ্র করে ঘটে যায় এক অসাধারণ ঘটনা। তেঁতুলবাড়িয়া সীমান্ত ফাঁড়ির পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্থানীয় জনতা বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়ে আসেন। কিন্তু প্রত্যেকবারই অবাঙালি ইপিআর আকরাম খান সেটা নামিয়ে ফেলেন। এমনকি নূরুল্ল হুদা চেয়ারম্যান তাকে নিষেধ করলে কাজ হয় নি। ফলে ২৭ মার্চ শাহাদৎ হােসেনের নেতৃত্বে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা আকরাম খানকে হত্যা করে তেঁতুলবাড়িয়া সীমান্ত ফাঁড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। সেইদিনই অন্য ইপিআর সদস্যরা চুয়াডাঙ্গায় চলে আসেন।

ভারতীয় সহযােগিতার অন্বেষণে মেহেরপুরের প্রতিনিধিদল মেহেরপুরের অবস্থান একেবারে সীমান্তবর্তী এলাকায় হওয়ায় ২৮ মার্চ তারিখেই বেশ কয়েকজন ছাত্র-যুবক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাহায্যের আবেদন নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যান। ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) কর্মী মােজাম্মেল হক তার সঙ্গী আনছারুল হক ও আব্দুল গণিকে নিয়ে ভারতের পাটিকাবাড়ির সিপিএমকর্মী দুলাল সরকার, কেশবচন্দ্র, সূর্য ডাক্তার এবং  আর এসপি কর্মী বাসুদেব দত্ত ও সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে যােগাযােগ করে সাহায্যের আবেদন জানান।  ২৮ মার্চ সকালে মেহেরপুর শহর থেকে সাইকেলে চেপে ভারতের উদ্দেশে রওনা হন ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) আরেকটি গ্রুপ। এ-গ্রুপে ছিলেন মীর রওশন আলী মনা, আব্দুস সামাদ, সাদেক হাসান রুমী, স্বপন চৌধুরী, আব্দুস সালেক হারু, লুৎফুর রহমান লালা ও নজরুল ইসলাম ভোদা। এ-দল প্রথমে যান তেহট্টের এমপি মাধব মােহন্তের কাছে। তিনি মেহেরপুরের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাকে না-পেয়ে তেহট্ট থেকে বালিউড়িতে গিয়ে শাহাবুদ্দিন এমপির সঙ্গে দেখা করে সাহায্যের আবেদন জানান। পরদিন তেহট্টে এসে মাধব মােহন্তের সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে উদ্যোগী হয়ে স্থানীয়ভাবে কিছু সাহায্য তুলে দেন। ভারতীয় জনগণের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ করে এ দল মুগ্ধ হন। স্থানীয় লােকজন নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী চা-পাতা, বিস্কুট, ম্যাচ, বিড়ি জোগাড় করে বিশাল এক বস্তায় ভরে এ দলের হাতে দেন। তারা এ সাহায্যসামগ্রী এনে মেহেরপুর নিউমার্কেটের সংগ্রহ কেন্দ্রে জমা দেন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জাতীয় জনগণের সহযােগিতামূলক মনােভাবের কথা অবহিত করেন।

২৭মার্চ বৈদ্যনাথতলা থেকে সি-কোম্পানির সব ইপিআর সদস্য কুষ্টিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে চুয়াডাঙ্গা উইং হেডকোয়ার্টারে চলে গেলে ইয়াদ আলী মীরের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের আনসার দল জনশূন্য ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থান নেন। বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটি স্থানীয়ভাবে চাল-ডাল সংগ্রহ করে আনসারদের খাদ্য সরবরাহ করেন। ২৮ মার্চ সকালে বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি দোয়াজ উদ্দিন মাস্টার কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে ‘নাে ম্যানস ল্যান্ড’-এ দাঁড়িয়ে একজন ভারতীয় কৃষককে দিয়ে হৃদয়পুর বিএসএফ ক্যাম্পে খবর পাঠান। একজন উৎসাহী বিএসএফ সদস্য এগিয়ে এলে দোয়াজ উদ্দিন দেশের অবস্থা বর্ণনা করে ভারতীয় জনগণের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। বিএসএফ সদস্যটি ক্যাম্প থেকে ভারতীয় স্টেটসম্যান’ পত্রিকা এনে সেখানে মুদ্রিত মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসকের আহ্বান সংবলিত সংবাদটি দেখান। প্রকৃতপক্ষে ২৮ মার্চ বিকাল থেকেই ভারতীয় জনগণের শুভেচ্ছা-সাহায্য আসতে শুরু করে এবং ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে ভারত থেকে চাু , বিস্কুট, হরলিকস, চাল, ডাল, ওষুধপত্র, ডিজেল, পেট্রোল নিয়ে এ সময়ে যে-সব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বৈদ্যনাথতলায় (মুজিবনগর) এসেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী বিশ্বনাথ ব্রহ্ম, চাপড়া কিং এডওয়ার্ড মিশনারি স্কুল, কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ, শান্তিপুর সরকারি কলেজ, ক্যালকাটা রেইনবাে ক্লাব, কলকাতা এশিয়াটিক সােসাইটি প্রভৃতি। এমনকি বাঙালিঝি, তারাতলা, ডােমপুকুর, বেতবাড়ি, বেলতলা প্রভৃতি সীমান্তবর্তী গ্রামের সাধারণ মানুষও প্রত্যেক বাড়ি থেকে চাল-ডাল সংগ্রহ করে নিয়ে চলে আসেন বৈদ্যনাথতলায়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রতিদিন দুই-তিন ট্রাক সামগ্রী এসে পৌছত।

সে-দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির নেতা দোয়াজ উদ্দিন মাস্টার বলেন : প্রতিদিন এত বিপুল পরিমাণ সাহায্যসামগ্রী আসত যে সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে আমি, মােমিন চৌধুরী, আইয়ুব হােসেন, রুস্তম আলী দিনরাত পরিশ্রম করেও সামলে উঠতে পারছিলাম না। রসিদ কেটে সাহায্যসামগ্রী জমা নেওয়া, রেজিস্টারে লিখে জমা করা এবং লিখিত ডকুমেন্টসহ ট্রাকে তুলে মেহেরপুরে পাঠাননা-এ-সব কাজে সহযােগিতা করার জন্য অবশেষে এসডিও সাহেব ফ্যামিলি প্ল্যানিং অফিসার ইশারত আলীকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে বৈদ্যনাথতলায় পাঠান। একদিন দেখি কিং এডওয়ার্ড মিশনারি স্কুলের প্রায় শ তিনেক ছাত্র টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে অভিভাবকদের কাছ থেকে আরাে কিছু চেয়ে নিয়ে প্রাণধন খাঁ স্যারের সঙ্গে দল বেঁধে চলে এসেছে বৈদ্যনাথতলায়। আমি স্যারের পা ছুঁয়ে ছালাম করতেই বুকের ভিতরে জড়িয়ে ধরে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। চোখ মুছে বললেন, একদিন আমিও এই দেশেরই মানুষ ছিলাম।” বৈদ্যনাথতলায় সাহায্যসামগ্রী গ্রহণের সময় এ-রকম আবেগঘন অনেক ঘটনাই ঘটেছে। ট্রাক থেকে জিনিসপত্র নামানাে এবং মেহেরপুরের ট্রাকে তুলে দেওয়ার কাজে অংশ নিতে পেরে ভবেরপাড়া, মানিকনগর, সােনাপুর, মাঝপাড়ার কিশাের-যুবকরা গর্ব অনুভব করেছেন। আর দিন শেষে দু’-এক টুকরাে ব্রিটানিয়া কিংবা মিল্কমেড বিস্কুট হাতে পেলে তাে বিমল আনন্দ! মেহেরপুরে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরােধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কুষ্টিয়া দখল করে নিয়েছে—এ-খবর জানার পর গাংনী থানার বিভিন্ন গ্রামের সাধারণ মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য

আক্রমণ প্রতিরােধ করার লক্ষে লাঠিসোটা, তীর-বল্লম, দা-হেসাে হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরােধে এ প্রস্তুতি নিতান্তই অপ্রতুল।

তবু জনগণের সেই মনােবল ও দেশপ্রেমের বুঝি তুলনা হয় না। এ-প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমসের বৈদেশিক সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গ লিখেছেন : ঘরে তৈরি বন্দুক, লাঠি ও বল্লমে সজ্জিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে—যারা বিমান, বােমা, ট্যাঙ্ক ও ভারি কামানে সশস্ত্র।* মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের খলিশাকুণ্ডি কাঠের ব্রিজ উপড়ে ফেলার পরও আকবপুরের মাতু বিশ্বাসের নেতৃত্বে আকবপুর, হােগলবাড়ি, মােহাম্মদপুর প্রভৃতি গ্রামের সাধারণ মানুষ প্রধান সড়কের দু’ধারে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে পাহারা বসিয়েছেন। বামুন্দীর হারেজউদ্দিন বিশ্বাস, শামসুজোহা, আব্দুল ওহাব, নিশিপুরের বদরুল, ওহিদুল, খেদু বিশ্বাস, জাগের মণ্ডল প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বামুন্দী, নিশিপুর, ছাতিয়ানের লােকজন বামুন্দী মােড়ের আশপাশে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। ইতােমধ্যে কাজীপুর ক্যাম্পের ইপিআরদের যুদ্ধে পাঠানাের লক্ষে চিলা ফার্মের ট্রাক্টরে করে চুয়াডাঙ্গায় পাঠিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক। তিনি ফেরার পথে হাটবােয়ালিয়ার আক্কেল মিয়ার কাছ থেকে দুই বস্তা চাল এবং নগদ ১০০০/- টাকা এনে গাংনী বাজারের খাদ্য সংগ্রহ কেন্দ্রে জমা দেন। তেরাইল ব্রিজ তখন ভাঙা। পাশ দিয়ে বাঁশের মাচা করে বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাজেই এখানে বসানাে হয়েছে কড়া পাহারা। ব্রিজের পশ্চিমের তেরাইল-জোড়পুকুরের লােকজনকে উৎসাহিত করে পাহারায় বসিয়েছেন বামুন্দী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল আজিজ। তাকে সার্বক্ষণিক সহযােগিতা করেন তেরাইলের আলতাফ হােসেন, নূর মােহাম্মদ, রমজান আলী, আব্দুল করিম, আব্দুর রহমান, ওমর শাহ প্রমুখ। তেরাইল ব্রিজের পূর্বপ্রান্তে প্রস্তুতি নিয়ে অবস্থান করেন বাদিয়াপাড়ার শুকুর বিশ্বাস, আব্দুর রহমান, মহব্বতপুরের আব্দুর রশিদ, আলতাফ বিশ্বাস, শহীদ সরােয়ার, আব্দুল খালেক, মােয়াজ্জেম হােসেন মহসিন, হাসান মণ্ডল প্রমুখ।

বামুন্দী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হােসেন আহমেদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দুই গ্রামের লােকজনকে সংগঠিত করেন তরুণ ছাত্রলীগ কর্মী নূরুল হুদা। গাংনী বাজারে সার্বক্ষণিক সতর্ক প্রহরায় থাকেন আফজাল, অলড্রাম, ধুনা, নূরুল হুদা, মান্নান মিয়া, সেকেন্দার, আকরাম, মকছুদ, আব্দুর রশীদ, ঠাণু প্রমুখ ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কর্মীবৃন্দ। ২৮ মার্চ সকালে কুষ্টিয়ার প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে মেহেরপুর। থেকে আনসার বাহিনী রওনা হওয়ার আগে মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ইএলাহী চৌধুরী মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়ক পরিদর্শনে এলে তেরাইল ব্রিজের দু’পাশের জাগ্রত গ্রামবাসী তাকে চিনতে না পেরে লাঠিসোটা হাতে গাড়ির সামনে দাড়িয়ে গতিরােধ করে। অবশ্য পরক্ষণেই সবাই ভুল বুঝতে পারেন। গাড়ি থেকে নেমে এসে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী উপস্থিত জনতাকে ধন্যবাদ জানান এবং সবাইকে সুশৃঙ্খলভাবে কর্তব্য পালন করতে বলেন। প্রয়ােজন হলে কুষ্টিয়ার প্রতিরােধযুদ্ধে সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হতে পারে—তিনি সে আহ্বানও জানিয়ে রাখেন। উপস্থিত জনতা ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তাদের সম্মতি জ্ঞাপন করেন। মেহেরপুরে জনপ্রতিনিধিদের তৎপরতা ও জনতার মিছিল অসহযােগ আন্দোলনের দিনগুলােতে গ্রামে কিংবা শহরে রাস্তায় রাস্তায় স্বাধীনতাকামী জনতার যে মিছিল শুরু হয়, তা বুঝি শেষ হবার নয়। কুষ্টিয়াযুদ্ধে বিস্ময়কর সাফল্যের পর এই মিছিল ক্রমশ জঙ্গি হয়ে ওঠে। সবার হাতে লাঠিসােটা, তীর-বল্লম। প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রাম থেকে জঙ্গি মিছিল আসে মেহেরপুর ও গাংনীতে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি মহিউদ্দিন ও নজরুল হকের কাছে জনতা জানতে চায়, তাদের করণীয় কী? নেতৃবৃন্দ প্রতিরােধের প্রস্তুতি নিতে পরামর্শ দেন। শহর প্রদক্ষিণ শেষে মিছিল ফিরে যায় গ্রামে, কণ্ঠে তাঁদের ঐক্যবদ্ধ শ্লোগান- বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/ বাংলাদেশ স্বাধীন কর। তুমি কে? আমি কে? বাঙালি বাঙালি। তােমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা।

 সেসব দিনের মিছিলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাংবাদিক তারিক-উল ইসলাম জানান : আমি তখন কিশাের, ক্লাস সেভেন-এ পড়ি। মেহেরপুরে মিছিলের শব্দ পেলেই ছুটতাম। বাবা-মা আটকাতে পারেননি। কতােদিন ঘুমের ঘােরেও রাস্তায় ছুটে গেছি। এমনও হয়েছে, মােটর গাড়ির শব্দকেই

মিছিলের শ্লোগান বলে ভুল হয়েছে। একটি বিচিত্র শ্লোগান এখনাে বেশ মনে পড়ে- এক সের দুধে দু’সের পানি/ টিক্কা খানের কলমাছানি। কলমাছানি অর্থ কুলখানি। এরকম বিচিত্র শ্লোগানে উদ্দীপ্ত হয়ে এক জঙ্গি মিছিল এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মেহেরপুরের বিশিষ্ট মুসলিম লীগ নেতা মাহতাব খানের বাড়িতে চড়াও হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে কুষ্টিয়া যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ আনসার কমান্ডারদের নেতৃত্বে মেহেরপুর ও গাংনী থানার বিভিন্ন এলাকায় ছাত্রযুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদ্বয় এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিদর্শনে যান। তাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদের অভাবের কথা তুলে ধরা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মােঃ নূরুল হক আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হককে ভারত থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্ব দেন। ৩ এপ্রিল এনামুল হক বামুন্দীর শামসুজ্জোহা এবং বালিয়াঘাটের আবুল হােসেনকে সঙ্গে নিয়ে অস্ত্রের সন্ধানে ভারতের ফুলবাড়ি সীমান্ত হয়ে আসানসােলের রানীগঞ্জ চলে যান। কাজীপুরের কমান্ডার আব্দুল জলিলের দেয়া ৫০০ টাকা এ সময় তাদের খুব কাজে লাগে। রানীগঞ্জ গিয়ে কংগ্রেসকর্মীদের সহযােগিতায় তারা অস্ত্র সাহায্য পান। তবে পরিবহনের অসুবিধা বিবেচনা করে তিনটি টিনের বাক্সে ৩০৩ রাইফেলের গুলি ভর্তি করে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।

এ-দিকে জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দিনও অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিশেষ চিঠি দিয়ে গােভীপুরের আবুল কাশেম, জালালউদ্দিন ও হরিরামপুরের আজিজুল হককে ভারতে পাঠান। সেই চিঠি বেতাই-এর বিএসএফ ক্যাম্পে দেখানাের পর তারা পত্রবাহক তিনজনকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু এই অস্ত্রের চালান আসতে বিলম্ব হয়। কলকাতা থেকে ট্রাকযােগে কাঠের বড়-বড় বাক্সে প্যাকেটকৃত এই অস্ত্রশস্ত্র বেতাই-এ পৌছলে আবুল কাশেম তার সঙ্গীদের নিয়ে ১৮টি গরুর গাড়িতে করে গােভীপুরের আমবাগান পর্যন্ত নিয়ে আসেন। কিন্তু ততদিনে চুয়াডাঙ্গায় বিমান হামলার কারণে মেহেরপুরের পরিবেশ থমথমে হয়ে ওঠে। ফলে এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের আর সুযােগ পাওয়া যায় নি। মেহেরপুরের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের ভারত গমন। ৫ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ভারতীয় বুদ্ধিজীবী মহলের সমর্থন ও সহযােগিতা লাভের আশায় মেহেরপুর থেকে অ্যাডভােকেট আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদল কলকাতা যান। জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দিনের পরামর্শক্রমে মহকুমা প্রশাসকের পক্ষে ম্যাজিস্ট্রেট মতিয়ার রহমান প্রতিনিধিদলের হাতে একটি বিশেষ পত্র লিখে দেন। সেই পত্রে লেখা হয় : This is a request in the name of Swadhin Bangladesh Government that all sorts of facilitics and help may kindly be extended to the undermentioned persons, who are representatives of Swadhin Bangladesh. They are authorised to nagotiate any sort of material help for thc Swadhin Bangladesh in its straggle. অ্যাডভােকেট আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে এ-প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যগণ হলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার ও নাট্যব্যক্তিত্ব কামাল আহমেদ, অ্যাডভােকেট হাফিজুর রহমান ও প্রকৌশলী আব্দুস সােবহান। এরা সবাই মেহেরপুরের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। কামাল আহমেদ মেহেরপুরের মুসলিম লীগ নেতাদের স্বাধীনতাবিরােধী কর্মকাণ্ডের নাট্যরূপ দিয়ে সবাইকে নিয়ে প্রভাষ ভট্টাচার্যের বাড়িতে নিয়মিত স্বরচিত নাটকের মহড়া করতেন। সংগ্রাম সংগ্রাম’ নামের সেই নাটক মঞ্চায়নের কথা ছিল ২৬ মার্চ। কিন্তু পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পরও সে নাটক মঞ্চস্থ হতে পারে নি। এ-নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই পরবর্তীতে প্রতিরােধ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।

কুষ্টিয়া যুদ্ধের সাফল্যের পর এই চারজন অন্যরকম কিছু একটা করার কথা ভাবেন। ৫ এপ্রিল কলকাতা যাওয়ার পর ‘জল্লাদের দরবার’-এর খ্যাতিমান অভিনেতা বাবুয়া বােসের ভাই কাকুয়া বােসকে সঙ্গে নেন। মেহেরপুরের এই কৃতিসন্তানের ততদিনে কলকাতার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ঢের পরিচিতি এসেছে। তিনিই স্বাধীন বাংলাদেশের এই প্রতিনিধিদলকে ৬ এপ্রিল আনন্দবাজার ও অমৃতবাজার পত্রিকা অফিসে নিয়ে যান। সেখানে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনে ভারতীয় সাংবাদিকদের ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। দু’টি পত্রিকার পক্ষ থেকেই বলা হয়, ইতােমধ্যে তাদের পত্রিকায় ‘জয়বাংলার খবর বিশেষ গুরুত্ব সহকারে ছাপা হচ্ছে। এরপর স্বাধীন বাংলার প্রতিনিধিদল হুগলিতে গিয়ে বিশিষ্ট সাহিত্যিক ‘অবধূত’-এর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে সাক্ষাতের পরামর্শ দিয়ে সংক্ষিপ্ত একটি পত্র লিখে দেন : গুরুদেব, জয়বাংলার ভাইদের প্রণাম গ্রহণ করবেন। পরদিন সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দেশের সার্বিক অবস্থা অবহিত করলে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্য কামনা করেন। ৮ এপ্রিল প্রতিনিধি দল কলকাতার উপকণ্ঠে বেহুলায় গিয়ে বিশিষ্ট সাহিত্যিক দক্ষিণারঞ্জন বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি অত্যন্ত আবেগাপ্লুত কণ্ঠে সবাইকে অভ্যর্থনা জানান। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে তার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থের প্রচ্ছদে উত্তীর্ণ বাণীটুকু কণ্ঠে পাঠ। করে শােনান। সেখানে লেখা রয়েছে : রবীন্দ্রনাথকে নজরুলকে আমরা খণ্ড করে ভাবতে পারি না। দু’ বাঙলা নয়, এক বাঙলাই আমাদের চিত্তলােকে প্রতিষ্ঠিত বিভেদের সমস্ত প্রাচীরকে ধূলিসাৎ করতে স্বার্থপরায়ণ রাজনীতিকদের লােভ চারিতার্থতার সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে বাঙলার তারুণ্য আজ দ্ধপরিকর।

সবশেষে ‘পদ্মা আমার গঙ্গা আমার কাব্যের প্রথম পাতায় আমার বাঙলাদেশের ভাইদের হাতে বাক্যটিকে লিখে তার নিচে স্বাক্ষর করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেন। ৯ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল কলকাতায় ‘ফিলিপস ইন্ডিয়া’র উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভাস্কর বাবুর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তথ্য প্রচারের জন্য একটি ট্রান্সমিটারের আবেদন জানান। ভাস্কর বাবু দিল্লির সঙ্গে যােগাযােগ করে ১০ কিলােওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ট্রান্সমিটার দেওয়ার আশ্বাস দেন। তিনি জানতে চান—এটি কোথায় স্থাপন করা হবে? প্রতিনিধিদল বলেন, বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী কোনাে এলাকায়। ভাস্কর বাবু কলকাতার সঙ্গে দূরত্ব এবং যােগাযােগের মাধ্যম উল্লেখ করে প্রস্তাবিত স্থানের একটি মানচিত্রসহ সপ্তাহখানেক পর পুনরায় যােগাযােগ করতে বলেন। চট্টগ্রাম থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে একটি বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ িলিপস ইন্ডিয়া-এর কাছ থেকে আশ্বাস লাভের পর এই প্রতিনিধিদল বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার নানাদিক নিয়ে পরিকল্পনা আঁটেন। কিন্তু মেহেরপুরে ফিরতে তাদের আরাে দু’দিন বিলম্ব হয়।

পরদিন ১০ এপ্রিল প্রতিনিধিবৃন্দ জাতীয় জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যান। নির্বাক কবিকে পুষ্পগুচ্ছ দিয়ে তারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। দর্শনার্থীরা সবাই মেহেরপুর থেকে এসেছেন। জানতে পেরে কবির পুত্রবধূ উমা কাজী অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। মেহেরপুরে কবি নজরুলের নামে একটি স্কুল (কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল, যেখানে পরে পাকিস্তানি বাহিনী আস্তানা গেড়ে অপবিত্র করেছে) প্রতিষ্ঠার পর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যােগদানের জন্য কবি পরিবারকে আমন্ত্রণ জানানাের কথা স্মরণ করেন এবং স্কুলটির খোঁজ-খবর নেন। ১২ এপ্রিল প্রতিনিধিদল মেহেরপুরে ফিরে এসে দেখতে পান, পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। সর্বত্র থমথমে ভাব বিরাজ করছে। জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দিন ও মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী প্রতিরােধযুদ্ধ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। ম্যাজিস্ট্রেট মতিয়ার রহমানকে সব খুলে বললেও সেই উদ্বেগজনক ও সংকটময় পরিস্থিতিতে বেতারকেন্দ্রের জন্য স্থান নির্ধারণ বা এ-সংক্রান্ত আর কোনাে উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয় নি। মেহেরপুরের এই ছােট্ট সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের উদ্যোগটি যথাসময়ে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হলে হয়তাে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠান শােনার জন্য ২৫ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত না।

প্রতিরােধের দুর্গ : চুয়াডাঙ্গা

ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর গণহত্যার খবর এবং যশাের সেনানিবাস থেকে পাকসৈন্য গিয়ে কুষ্টিয়া দখলের খবর ২৬ মার্চ সকালে চুয়াডাঙ্গায় ছড়িয়ে পড়ামাত্র সবার মধ্যে প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সাধারণ জনগণের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। প্রাথমিক অবস্থায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও যেন খানিকটা দিশাহারা। আওয়ামী লীগের তৎকালীন তরুণ নেতা সােলায়মান হক জোয়ার্দার সেলুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার মােকাররম হােসেনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে তাৎক্ষণিকভাবে করণীয় স্থির করে ফেলেন। শহরের প্রবেশমুখগুলাে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য তিনি ছাত্র-জনতাকে আহ্বান জানান।  ২৬ মার্চ সকালেই রেডিওতে প্রচারিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের ভাষণ। সামরিক আইন জারির কথা পূর্বাহ্নেই বলা হয়েছে। টিক্কা খান তার ভাষণে সামরিক আইনের বিধিগুলাে জানিয়ে দিয়ে তা অমান্য করার পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে, কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণের মাধ্যমে তা স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু এ-ভাষণে ফল হয় উল্টো। প্রাথমিক উদ্বেগ খানিকটা থিতিয়ে এলে চুয়াডাঙ্গা, দর্শনা, আলমডাঙ্গার ছাত্র-জনতা ঐ ভাষণ শােনার পর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাস্তায় বেরিয়ে এসে গাছের ডাল কেটে ব্যারিকেড দেয়, গগনবিদারী শ্লোগান দেয়—জয়বাংলা। সামরিক আইন অগ্রাহ্য করে দুঃসাহসী জনতা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে তীর-ধনুক, ঢাল-সড়কি, বল্লম-বন্দুক যার যা আছে তাই নিয়ে। এ-দিন সকাল ৯টার দিকে চুয়াডাঙ্গা চৌরাস্তার মােড়ে জনসভার আয়ােজন করা হয়। মুখে-মুখেই প্রচার হয়ে যায় জনসভার কথা। অল্পসময়ের মধ্যে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতায় ভরে ওঠে জনসভার প্রাঙ্গণ। মুহুর্মুহু শ্লোগানের মধ্যে এ-দিনের জনসভায় অত্যন্ত আবেগময়ী ভাষায় বক্তব্য রাখেন মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. আসহাব-উল-হক এবং সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভােকেট ইউনুস আলী। জনগণের ভােটে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ডা, আসহাব-উল-হক উত্তেজিত জনতাকে বলেন, জনগণের দেওয়া ভােট তিনি জনগণকেই ফিরিয়ে দিতে চান। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচনী রায়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের শােষণ-বঞ্চনার অবসানকল্পে ৬-দফার ভিত্তিতে একটি নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের যে পবিত্র দায়িত্ব জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দিয়েছে, পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর সীমাহীন প্রতারণা আর ষড়যন্ত্রের কারণে সে দায়িত্ব পালনের সব সুযােগ এখন বন্ধ হয়ে গেছে। পাকিস্তানি জঙ্গি-শাসকরা এখন এ-দেশের নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর সামরিক হামলা শুরু করেছে। বাংলার মানুষের সামনে দু’টি পথ খােলা আছে। বলে তিনি জানান—হয় আত্মসমর্পণ, না হয় প্রতিবাদ। তিনি বিক্ষুব্ধ জনতার কাছে প্রশ্ন রাখেন—আপনারা কোনটা বেছে নেবেন?

জনসভার রায়—প্রতিবাদ। প্রতিবাদ শুধু নয়, কার্যত সে-দিন থেকেই চুয়াডাঙ্গাতে শুরু হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগ্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিরােধের শক্ত প্রস্তুতি। চুয়াডাঙ্গার উৎকণ্ঠিত এবং আতঙ্কিত জনগণ সে-দিনের এই জনসভা থেকেই যেন খুঁজে পায় পথের দিশা। জনসভা শেষে বিশাল মিছিল বের হয় শহরের প্রধান সড়কে। ছাত্র-যুবক-জনতার দীর্ঘ ও বিক্ষুব্ধ মিছিলটি ঝিনাইদহ বাসস্ট্যান্ডের কাছে পৌছলে ইপিআর চতুর্থ উইংয়ের বাঙালি সৈন্যরাও ধর্মীয় শিক্ষকের নেতৃত্বে দুই সারিতে মার্চ করে এসে মিছিলে যােগ দেয়। সৈনিকজনতার সম্মিলনে সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়।

জনসভার ঘােষণা

২৬ মার্চ চৌরাস্তার জনসভা থেকে স্পষ্ট কয়েকটি ঘােষণা আসে। ১. পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগ্রাসন ও আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য বড়-বড় গাছের গুঁড়ি কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে চুয়াডাঙ্গা শহরের সব কটা প্রবেশমুখ বন্ধ করে দিতে হবে। ২. প্রতিরােধযােদ্ধা হিসেবে গণ্য করে আশপাশের আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যদের অবিলম্বে শ্ৰীমন্ত টাউন হলে সমবেত হওয়ার জন্য আহ্বান জানানাে হবে। ৩. প্রতিরােধযােদ্ধাদের আহারের জন্য বাজারের দোকানে-দোকানে কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকরা গিয়ে চাল-ডাল, আলু-পেঁয়াজ, টাকা-পয়সা যে যা দেয় চাঁদা হিসেবে সংগ্রহ করবে। ৪. প্রতিরােধযােদ্ধা হিসেবে আগত আনসার-মুজাহিদদের শ্ৰীমন্ত টাউন হলে অভ্যর্থনা জানানাের দায়িত্ব পালন করবেন ইউনুস আলী, মীর্জা সুলতান রাজা, আবুল হাশেম প্রমুখ নেতা। ৫. ব্যাংক থেকে টাকা উঠানাের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

কন্ট্রোলরুম স্থাপন

চুয়াডাঙ্গায় প্রতিরােধ আন্দোলনের সবরকমের খবরা-খবর আদান-প্রদান তথা জনগণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যােগাযােগ রক্ষার জন্য আওয়ামী লীগের অফিসে অস্থায়ী কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়। মিসকিন আলী, দোস্ত মােহম্মদ আনসারী প্রমুখ পালাক্রমে কন্ট্রোলরুমের দায়িত্ব পালন করেন। আলমডাঙ্গা কলেজ এবং আনসারবাড়িয়াতেও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অনুরূপ দু’টি কন্ট্রোলরুম প্রতিষ্ঠা করেন। আলমডাঙ্গায় সাফায়েত-উলইসলাম ও ডা. সাহাবুদ্দিন সাবু, মুন্সীগঞ্জে মকবুলার রহমান, জীবননগরে আফসার আলী মিয়া, দর্শনায় তাহেরউদ্দিন খান প্রমুখ নেতা স্থানীয়ভাবে প্রতিরােধ বাহিনী সংগঠিত করে তােলেন। চুয়াডাঙ্গা মহকুমার বিভিন্ন কন্ট্রোলরুমের মধ্যে আন্তঃকন্ট্রোলরুম টেলিফোন যােগাযােগ রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন চুয়াডাঙ্গার ফকির মােহাম্মদ, পরিতােষ কুমার এবং আলমডাঙ্গায় আইনুদ্দিন ও কাজী জয়নাল আবেদীন প্রমুখ অপারেটর। চুয়াডাঙ্গা থেকে ভারতের সাহায্য প্রার্থনা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার একেবারে প্রাথমিক পর্বেই চুয়াডাঙ্গার নেতৃবৃন্দ নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কাছে নানাবিধ  সাহায্য-সহযােগিতা প্রত্যাশা করেন। ২৭ মার্চ আওয়ামী লীগের দলীয় প্যাডে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য আলমডাঙ্গার জনপ্রিয় নেতা ব্যারিস্টার বাদল রশীদের সার্বিক পরিচয় উল্লেখ করে হানাদারকবলিত বাংলাদেশের পক্ষে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যােগাযােগ, প্রচার ও সহযােগিতার প্রত্যাশায় ভারতে পাঠানাে হয়। পরবর্তীতে তিনি শুধু ভারতেই নয়, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে ইংল্যান্ডে গিয়েও বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির হয়ে নানান ফোরামে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছেন এবং সহযােগিতার আশ্বাস আদায় করেছেন। | এ-দিকে চুয়াডাঙ্গা মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদ্য প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অন্যতম উপদেষ্টা অ্যাডভােকেট ইউনুস আলী ও ২৭ মার্চ সন্ধ্যার পর দর্শনার অদূরে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত নিরাপত্তাবাহিনীর প্রধান কর্নেল এইচ আর চক্রবর্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি নিয়ে আলােচনা করেন। তিনি তার সরকারের সঙ্গে আলােচনার দায়িত্ব নেন এবং বেসামরিক সাহায্য প্রদানের আশ্বাস দেন।

অ্যাডভােকেট ইউনুস আলী বলেন : যুদ্ধক্ষেত্রে বেশি প্রয়ােজন পেট্রোল ও ডিজেলের। তার (কর্নেল চক্রবর্তীর) ভাণ্ডার থেকেই আপাতত দিতে পারবেন বলে আশ্বাস দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে তার সঙ্গী ক্যাপ্টেন মহাপাত্রকে আদেশও দিয়ে দিলেন। তারপর থেকে টেলিফোনে যােগাযােগ করে প্রায় রাতেই কথা হত পরবর্তীকালে রসদ, পেট্রাল, ডিজেল, গােলাবারুদ পাওয়া গেল। ঐ কনেলের মাধ্যমেই ভারতীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের একজন। ঊর্ধ্বতন অফিসার অসীম ঘােষের সঙ্গে পরিচয় হয়।” ২৭ মার্চ ইপিআর উইং কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর লেখা বিশেষ চিঠি নিয়ে ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী যান ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সে-দিনের স্মৃতির কথা ক্যাপ্টেন চৌধুরী লিখেছেন : ভারতীয় অফিসারদের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। আমার পুরাে ইউনিফর্ম ও আমসহ তিনজন গার্ড ছিল। আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন ভারতীয় বিএসএফ ক্যাপ্টেন মহাপাত্র। ক্যামেরাম্যান আমার ছবি তুলবে বলে আমি গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে বর্ডার পার হই। আমি মেজর ওসমানের পত্র দেই। সেখানে একটি আর্টিলারি ব্যাটারি, এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক, এক ইনফ্যানট্রি ব্যাটেলিয়ন সৈন্য যশাের আক্রমণের জন্য চাইলাম। ভারতীয় প্রধান বললেন, আমরা সরাসরি সাহায্য করতে পারছি না। তবে গােপনে আপনাদের গােপনে সাহায্য করব এবং আপনাদের এই চাহিদা দিল্লি নিয়ে যাচ্ছি আলােচনার জন্য।

যুদ্ধাহতদের সেবায় চুয়াডাঙ্গায় নতুন হাসপাতাল

যুদ্ধ মানেই রক্তপাত, যুদ্ধ মানেই হতাহতের চিত্র। মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গাঝিনাইদহ সর্বত্র চলছে প্রতিরােধযুদ্ধের প্রস্তুতি; অচিরেই এ-যুদ্ধ আক্ৰণাত্মক রূপ নেবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই কুষ্টিয়া শহরকে দখলদারমুক্ত করতে হবে। কাজেই যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত হাসপাতালও দরকার। চুয়াডাঙ্গার বর্তমান সদর হাসপাতাল ভবনের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলেও তখনাে চালু হয় নি। পুরনাে হাসপাতালটিও যুদ্ধকালীন প্রয়ােজন মেটানাের পক্ষে যথেষ্ট নয়। এমনই প্রেক্ষাপটে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার কথা বিবেচনা করে চুয়াডাঙ্গার নেতৃবৃন্দ জরুরিভিত্তিতে চুয়াডাঙ্গার নতুন হাসপাতালটি চালু কর দেন। এজন্য প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্র, খাট-বিছানা সবকিছুরই ব্যবস্থা হল ভারতীয় রেডক্রসের আনুকূল্যে। ডাক্তারের স্বল্পতা ঘুচানাের জন্য মেহেরপুর হাসপাতাল থেকে ডা. শামসুল হক কোরেশীকেও চুয়াডাঙ্গায় আনা হয়। বেসরকারি ডাক্তার হয়েও সে-সময় ডা, আফিলউদ্দিন, ডা. মােজাম্মেল হক, ডা, সাইদুর রহমান, ডা. আলী আশরাফ প্রমুখ যথেষ্ট সহযােগিতা করেন। বাংলাদেশ রেডক্রসের জন্ম যুদ্ধকালীন প্রয়ােজনে চুয়াডাঙ্গায় নতুন হাসপাতাল ভবন চালু করার সূত্র ধরেই বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা (পরবর্তীতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ রেডক্রস সােসাইটির জন্ম হয় ৩ এপ্রিল। রেডক্রস সােসাইটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন ডা. আসহাব-উল হক জোয়ার্দার।১৭ এ-প্রসঙ্গে চুয়াডাঙ্গার বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভােকেট ইউনুস আলী জানান । কুষ্টিয়া জেলা শহরকে পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনাকে সামনে নিয়ে ২৮ মার্চ চুয়াডাঙ্গার বুকে বাংলাদেশ। রেডক্রসের জন্ম। সভাপতি ডা. আসহাব-উল হক ও সম্পাদক সামসুজ্জোহা কোরেশী। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক রেডক্রস গঠিত হয় আমাকে সভাপতি ও ডা. সাইদুর রহমানকে সম্পাদক করে। পরে আমরা একটি অ্যাম্বুলেন্স কোরও গড়ে তুলতে সক্ষম হই। প্রতিরােধ নয় শুধু, প্রস্তুতি যুদ্ধের পাকিস্তানের আগ্রাসী সেনাবাহিনী যশাের সেনানিবাস থেকে রাতের আঁধারে গিয়ে জেলা শহর কুষ্টিয়া, এরপর যে-কোনাে সময় হানা দিতে পারে মেহেরপুর বা চুয়াডাঙ্গা, ভেড়ামারা কিংবা কুমারখালী। সেই আশঙ্কা থেকেই এ-সব জনপদে গড়ে ওঠে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরােধ প্রস্তুতি। পাকসেনাদের আগমন বাধাগ্রস্ত এবং বিয়সংকুল করে তােলার জন্য রাস্তায়-রাস্তায় দেওয়া হয় ব্যারিকেড। তারপরও সেই ব্যারিকেড অপসারিত করে যদি দখলদার পাকসেনা হানা দেয় শহরে কী গ্রামে, তাদের সেই আগমন ও আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মেহেরপুরে এবং চুয়াডাঙ্গায় আনসার-মুজাহিদদের অতিদ্রুত একত্রিত করে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে, এই প্রতিরােধবাহিনীর খাদ্য যােগানের জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিরন্তর কাজ করে চলেছে। প্রতিরােধের এই সার্বিক প্রস্তুতি বা আয়ােজন অতিদ্রুত পরিণত হয় আক্রমণের সিদ্ধান্তে। আক্রমণ করেই জেলা শহর কুষ্টিয়াকে দখলমুক্ত করতে হবে। কেননা কুষ্টিয়াকে শক্রর দখলে রেখে মেহেরপুর বা চুয়াডাঙ্গার নিরাপত্তা বিধানও সম্ভব নয়, আবার এখান থেকে প্রতিরােধের প্রস্তুতিও নিশ্চিত করে তােলা সম্ভব নয়। কাজেই কুষ্টিয়া পুনরুদ্ধারই জরুরি।

আবু ওসমান চৌধুরী : অন্য প্রমিথিউস

সীমান্ত প্রহরার পাশাপাশি সােমরিক প্রশাসনে সাহায্যকারী আধা-সামরিক একটি বাহিনী ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)। বাঙালি সৈন্যবহুল এই বাহিনীর অফিসারদের মধ্যে অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি। অফিসার। মাত্র কয়েকজন ছিলেন বাঙালি অফিসার। তাদেরই একজন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ইপিআর ৪নং উইংয়ের তিনিই প্রথম বাঙালি অধিনায়ক বা কমান্ডিং অফিসার। তার অধীনে দু’জন সহকারী অধিনায়ক ছিলেন—একজন বাঙালি ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী, অন্যজন অবাঙালি ক্যাপ্টেন সাদেক হােসেন। অসহযােগ আন্দোলনের উত্তাল সময় থেকেই ইপিআর-এর বাঙালি সৈনিকরা স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছাকাছি আসার সুযােগ লাভ করে। আর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানায় গণহত্যা চালানাের পর সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি ইপিআর সদস্যরা চেতনাগত দিক থেকে অধিকারবঞ্চিত বিক্ষুব্ধ বাঙালি জাতির আত্মরক্ষার আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পােষণ করে। এমনই প্রেক্ষাপটে চুয়াডাঙ্গা উইংয়ের অধিনায়ক হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে এই উইংয়ের বাঙালি সৈনিকরা অন্য এক প্রমিথিউস বলেই গণ্য করে।

প্রমিথিউসের মতােই তিনি অধীন বাঙালি সৈনিকের বুকে জ্বালিয়ে দেন দেশাত্মবােধের অগ্নিমশাল, প্রবল সাহসিকতার সঙ্গে তিনি নেতৃত্ব দেন বাঙালির প্রতিরােধযুদ্ধ এবং সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধে। কুষ্টিয়া মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গার আপামর জনসাধারণের কাছে তাে বটেই, ৮নং সেক্টরের সব মুক্তিযােদ্ধার কাছে তিনি যথার্থই অন্য এক জাগ্রত প্রমিথিউস হয়ে ওঠেন। মেহেরপুরে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী মেহেরপুরের জনসাধারণের কাছে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর ভূমিকা এবং ভাবমূর্তি ছিল প্রায় একই রকম। তিনি মেহেরপুরের বাঙালি মহকুমা প্রশাসক অসহযােগ আন্দোলনের দিনগুলােতেই নিজের কর্তব্য স্থির করে নেন। তাই তাে দেখা যায় ২৫ মার্চের গণহত্যা এবং ধ্বংসলীলার পূর্বেই তিনি আরও কয়েকজন বাঙালি এসডিওকে সঙ্গে নিয়ে ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দীনের বাসায় বসে টানা তিন দিন ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্ভাব্য আক্রমণের মুখে তাদের কী করণীয় তাই আলােচনা করেন। সামরিক সংঘর্ষ যে অনিবার্য হয়ে উঠছে, অসামরিক কর্মকর্তা হয়েও তারা সেটা অনুধাবন করেন। দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদে প্রবল আস্থাশীল এই মানুষটি ২৫ মার্চ রাতেই ‘পাকিস্তান সরকারের কর্মচারী নই’ বলে ঘােষণা করেন এবং বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেন। মেহেরপুরের স্বাধীনতাকামী জনতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। চুয়াডাঙ্গায় গঠিত দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গনে হাইকমান্ডের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে কুষ্টিয়ার প্রতিরােধযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ করে নানাবিধ সাহায্য-সহযােগিতা আদায় করেন, মুজিবনগরে প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের নেপথ্যে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, সর্বোপরি নিজে বেসামরিক ব্যক্তি হয়ে যুদ্ধের মধ্যেই সামরিক পদবি ক্যাপ্টেন অর্জন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে একটি সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে অত্যন্ত সাহসিকতা এবং বীরত্বের সঙ্গে নেতৃত্ব দেন। এই বীর সৈনিকের নেতৃত্বেই একাত্তরের মেহেরপুর অগ্নিগর্ভ মেহেরপুর হয়ে ওঠে। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের কমান্ড গঠন ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পৈশাচিক গণহত্যার খবর পাওয়া মাত্র রাস্তায় নেমে আসে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গার স্বাধীনতাকামী জনতা। সম্ভাব্য আক্রমণের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য নানাবিধ প্রতিরােধ প্রস্তুতিও গ্রহণ করে তারা। এমনকি এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আনসার-মুজাহিদদেরও অতি দ্রুত খবর দিয়ে একত্রিত করা হয়, তাদের হাতে ৩০৩ রাইফেল তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু তাই বলে যুদ্ধ করা সম্ভব? কে দেবে সেই যুদ্ধে নেতৃত্ব? কোথায় পাওয়া যাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধ করার মতাে দক্ষ সৈন্যদল? ভরসা বলতে চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)এর ৪নং উইং এবং এর অধীন সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ক্যাম্পের বাঙালি ইপিআর সদস্য। সেই সঙ্গে প্রধান ভরসা হচ্ছে এই প্রথম ৪নং উইংয়ের অধিনায়ক হয়ে এসেছেন বাঙালি মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, তার সঙ্গে সহকারী অধিনায়কও আছেন বাঙালি ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী। কিন্তু এ দুজনের কেউই তখন চুয়াডাঙ্গায় ছিলেন না। চুয়াডাঙ্গা উইংয়ের সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী ২৩ মার্চ থেকেই চুয়াডাঙ্গার বাইরে ছিলেন বিভিন্ন সীমান্ত চৌকি পরিদর্শনের কাজে, তিনি চুয়াডাঙ্গা হেডকোয়ার্টারে ফিরে আসেন ২৫ মার্চ গভীর রাতে। আর উইং কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী দাপ্তরিক কাজে কুষ্টিয়ায় গিয়ে ২৫ মার্চ রাত্রিযাপন করেন সার্কিট হাউজে। ২৬ মার্চ ভােরে যখন টের পান কুষ্টিয়া শহর পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাতের আঁধারে দখল করে নিয়েছে, তখনই অত্যন্ত সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিজের গাড়ি নিয়ে ঝিনাইদহ হয়ে চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশে রওনা হন।

এরই মাঝে ২৫ মার্চ বিকালে ইপিআর যশাের সেক্টরের সেকেন্ড-ইনকমান্ড অবাঙালি মেজর আব্দুল কাদের চুয়াডাঙ্গা আসেন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল সেক্টর হেডকোয়ার্টারে জরুরি সভার অজুহাতে চুয়াডাঙ্গা থেকে উইং কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এবং সহকারী কমান্ডার ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী, এই দুই বাঙালি অফিসারকে যশােরে নিয়ে এসে বন্দী করা। কিন্তু এই দুই বাঙালি অফিসারকে না-পেয়ে মেজর কাদের ব্যর্থ মনােরথে ২৬ মার্চ ভােরে চুয়াডাঙ্গা থেকে যশােরে ফিরে আসেন। আসার সময় তার স্বজাতি চুয়াডাঙ্গা উইংয়ের অপর সহকারী অধিনায়ক অবাঙালি ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার পরিবার-পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। ২৬ মার্চ সকালে কুষ্টিয়া রওনা হয়ে ইপিআর ৪নং উইংয়ের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী দুপুরে চুয়াডাঙ্গা পৌছে অবাঙালি মেজর কাদেরের কাণ্ড সম্পর্কে অবহিত হন। উইং হাবিলদার মেজর মজিবর রহমান বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া ঢাকার সব ঘটনা বিশেষ করে পিলখানার মর্মান্তিক ঘটনার বিবরণ তাঁকে জানান। এই সঙ্গে তিনি আরাে বলেন, ‘উইং হেডকোয়ার্টারের সহকারী কমান্ডার ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীর নির্দেশ ছাড়াই হেডকোয়ার্টারের সব অবাঙালি ইপিআর সদস্যকে বন্দী করেছি। অস্ত্রাগার থেকে সব অস্ত্র অন্যত্র নিরাপদে সরিয়ে রেখেছি।’ এদিকে চুয়াডাঙ্গার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তখন নানামুখী প্রতিরােধ গড়ে তােলার কাজে ব্যস্ত। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী চুয়াডাঙ্গায় ফিরে আসার পর এ-দিনই দুপুরের পর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সরকারি অফিসারদের সমন্বয়ে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐ সভাতেই মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে অধিনায়ক, ডা, আসহাব-উল হককে প্রধান উপদেষ্টা এবং ব্যারিস্টার বাদল রশীদ ও অ্যাডভােকেট ইউনুসকে উপদেষ্টা করে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ড গঠন করা হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ড অনেক গৌরবময় ভূমিকা পালন করে। এ-দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবু ওসমান চৌধুরী পরবর্তীতে লিখেছেন : চুয়াডাঙ্গার ইপিআর বাহিনী পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে প্রস্তুত হয়েই ছিল। শহরের ছাত্র, শ্রমিক, পুলিশ, জনতা উন্মুখ হয়ে আমার নির্দেশের অপেক্ষা করছিলেন। আমি সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলাম। এদিকে বিশ্বের সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পৃথিবীর সেরা যােদ্ধাদের অন্যতম পাকিস্তানি বাহিনী, আর অন্যদিকে বাংলা ও বাঙালি জাতির অস্তিত্ব। হাতের মূলধন তখন শুধু ৩০৩ রাইফেল সজ্জিত পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর এক উইং (আনুমানিক ৬০০ জন) সৈন্য। বাসায় (চুয়াডাঙ্গা) পৌছে একমুহূর্ত দেরি না করে জরুরি ভিত্তিতে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্রনেতা, পুলিশ আনসার ও সামরিকবেসামরিক সর্বস্তরের কর্মকর্তার সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসলাম। ঐ রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ঢাকার পরিস্থিতি, বর্তমানে করণীয় এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে ব্যাপক ও বিস্তৃত আলােচনা করি। বৈঠকে প্রত্যেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়িয়ে ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। সভাশেষে বাইরে অপেক্ষমাণ উত্তাল জনসমুদ্রের প্রলয়ঙ্করী হুঙ্কারে বুঝতে একটুও কষ্ট হল না যে, আমার মূলধন শুধু ইপিআর বাহিনী ও তাদের ৩০৩ রাইফেলই নয়, আমার চূড়ান্ত হাতিয়ার—যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীরও নেই, তা হল বাংলার স্বাধীনতাকামী আপামর জনসাধারণ। আমি পদ্মা-মেঘনার পশ্চিমপাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকাকে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন নামকরণ করে অধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করি ।

প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা ও ব্যারিকেড স্থাপনের পর সেদিনই উইং সদর থেকে সীমান্তবর্তী সব বিওপি ও কোম্পানিকে প্রকৃত অবস্থা জানিয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিই। প্রত্যেক কোম্পানি অধিনায়কের সঙ্গে আমি ওয়ারলেস মারফত কথা বলি। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী সে-দিন যথার্থই বড় রকমের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। বিশেষ করে যখন কোনাে রকম সংযােগবিহীন অবস্থায় বিনা নির্দেশে এবং আর কেউ বিদ্রোহ করেছে কিনা সেটা না-জেনেই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত চেতনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতাে একটা এতবড় শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করা বিরাট চ্যালেঞ্জই বটে। দেশপ্রেমিক এই বীর সেদিন স্পষ্ট জানিয়ে দেন । এ অন্যায় আমরা সইব না। শপথ নিলাম আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব, যুদ্ধ করব এবং যেমন করেই হােক নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও মাতৃভূমিকে এই পশুশক্তির কালাে হাত থেকে রক্ষা করব।” আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ইপিআর-এর ৪নং উইং হেডকোয়ার্টারই সেই মুহূর্ত থেকে ওঠে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অস্থায়ী সদর দপ্তর। সে-দিন এই রণাঙ্গনের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী তার সদর দপ্তরে নিজে হাতে বাংলাদেশের পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করেন এবং নতুন পতাকাকে অভিবাদন জানান। এ-প্রসেঙ্গ তিনি বলেন : সমস্ত সিদ্ধান্তের পর আমি সমস্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের সমভিব্যহারে আমার উইংয়ের কোয়াটার গার্ডে বাংলাদেশের পতাকা সসম্মানে উত্তোলন করে ওটাকে জাতীয় অভিবাদন দিলাম। কিন্তু আনুষ্ঠানিক এই পতাকা উত্তোলনের তারিখ এবং সময় নিয়ে পরবর্তীতে দু’টি ভিন্ন বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-গবেষক এবং একাত্তরে এই রণাঙ্গনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মুক্তিযােদ্ধা ড. সুকুমার বিশ্বাস জানাচ্ছেন । এরপর রুদ্ধদ্বার আলােচনাসভার পর) বেলা আড়াইটায় ৪নং ইপিআর উইংয়ের সদর দপ্তরে হাজার-হাজার জনতার উপস্থিতিতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন মেজর এম এ ওসমান।

চৌধুরী নিজে। অর্থাৎ পতাকা উত্তোলন হয় ২৬ মার্চ বেলা আড়াইটায়। কিন্তু চুয়াডাঙ্গা জেলার ইতিহাস গবেষক রাজিব আহমেদ জানাচ্ছেন :

২৭ মার্চ সকাল ১১টার দিকে চুয়াডাঙ্গার ইপিআর হেডকোয়ার্টারে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন হয়। সম্পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় চুয়াডাঙ্গার কয়েকজন কর্মকর্তাসহ ৩০/৪০ জন লােকের উপস্থিতিতে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে হলুদ মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন। যাহােক, চুয়াডাঙ্গাস্থ ৪ নং উইং সদর দপ্তর থেকে ২৬ মার্চ তারিখেই অধীন বিওপিগুলােতে অয়্যারলেস দ্বারা প্রকৃত অবস্থা জানিয়ে হুশিয়ার থাকতে বলা হয় ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী সব কোম্পানি, প্লটুন, বিওপি হেডকোয়ার্টারগুলােতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের আদেশ দেন।

মেহেরপুরে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গণের প্রভাব

২৫ মার্চ গভীর রাতে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য নূরুল হকের কাছ থেকে টেলিফোনে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার সংবাদ অবহিত হওয়ার পর থেকে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর চোখে আর ঘুম নেই। সেই মধ্যরাত থেকেই শুরু হয় তার কর্মব্যস্ততা। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জরুরি আলােচনা করেছেন। আমঝুপি, বারাদি, গাংনী প্রভৃতি স্থানে নিজে গিয়ে গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরির আদেশ দিয়েছেন। ২৬ মার্চের মধ্যে সব আনসার-মুজাহিদকে মেহেরপুরে একত্রিত করার জন্য এস এম আল আমিন, বশির উদ্দীন, আবুল কাশেম কোরাইশী প্রমুখ আনসার ইন্সট্রাক্টরকে জরুরি দায়িত্ব দিয়েছেন। ২৬ মার্চ সকালে নিজ কার্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে নতুন দিনের সূচনা করেছেন। পাকবাহিনী কর্তৃক কুষ্টিয়া দখলের খবর পাওয়ার পর প্রতিরােধযুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। আনসার-মুজাহিদদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে একদিনের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, প্রতিরােধযােদ্ধাদের আহার এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করা—সব মিলিয়ে নানামুখী আয়ােজন তার। ২৬ মার্চ রাতে তিনি মেহেরপুর থেকে যান চুয়াডাঙ্গা, ওদিকে ঝিনাইদহ থেকে চুয়াডাঙ্গা আসেন এসডিপিও মাহ্বুবউদ্দীন। তারা দু’জনে মিলে দেখা করে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর সঙ্গে। খুলে বলেন তাদের প্রতিরােধ প্রস্তুতির কথা। উভয়ের কথা শােনার পর মেজর ওসমান দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন গঠনের খবর জানিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেন-কুষ্টিয়াকে শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধ। বেসামরিক লােক হওয়া সত্ত্বেও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী যুদ্ধের কথায় অনুপ্রাণিত বােধ করেন। মেহেরপুরে আনসার-মুজাহিদদের সংগঠিত করা হয়েছে। এবার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সংগঠিত করবেন। কুষ্টিয়া-যুদ্ধের নানাদিক নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা শেষে তিনি গভীর রাতে মেহেরপুরে ফিরে আসেন।

যুদ্ধই যখন অনিবার্য : Point of No Returen ২৭ মার্চ দিনটা ছিল একটু অন্যরকম দিন। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর জীবনে আত্মােপলব্ধির দিন, সিদ্ধান্ত চূড়ান্তকরণের দিন। এদিন সকাল সাতটায় মাসলিয়া (যাদবপুর) বিওপি কোম্পানি হেডকোয়ার্টার থেকে কোম্পানি কমান্ডার মজিদ মােল্লা অয়্যারলেসে জানালেন—চুয়াডাঙ্গা থেকে সপরিবারে চলে যাওয়া অবাঙালি ক্যাপ্টেন সাদেক ৩ জন সৈন্য সঙ্গে নিয়ে যশাের থেকে সীমান্তপথে মাসলিয়া বিওপিতে প্রবেশ করেছে। এ-খবর শুনে ক্যাপ্টেন সাদেকের এই আগমন সন্দেহজনক মনে হয়, হয়তাে চাতুর্যের সঙ্গে এই কোম্পানির বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে চায়। তিনি ক্যাপ্টেন সাদেকের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দেন। মিনিট দশেকের মধ্যে ডি-কোম্পানির অধিনায়ক মজিদ মােল্লা একটি দুঃসংবাদ জানান। অবৈধ আদেশ পালন না করার অপরাধে একজন বাঙালি। সেপাইকে নিজের পিস্তল দিয়ে গুলি করে ক্যাপ্টেন সাদেক যশােরের দিকে জিপ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এ-খবর শুনে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী পরবর্তী বিওপিতে আদেশ দেন ক্যাপ্টেন সাদেকের গাড়ির গতিরােধ করতে। এটা করতে গিয়ে বাধ্য হয়ে গুলি ছুড়তে হয়। উভয়পক্ষের গােলাগুলিতে এক পর্যায়ে ওই গাড়ির বাঙালি ড্রাইভার ওয়াহেদ ছাড়া ক্যাপ্টেন সাদেকসহ সবাই মারা যায়। কিছুক্ষণ পর সুবেদার মজিদ মােল্লা অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে অয়্যারলেসযােগে এ-অঘটনের কথাও উইং হেডকোয়ার্টারে জানান। উইং কমান্ডার তাকে অভয় দেন। এ-প্রসঙ্গে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী বলেন : এইখানেই শুরু হল আমার এলাকায় পদ্মার ওপারে পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর হনন পর্ব। এখানেই বুঝতে পারলাম—I am in a point of no return. Either I have to kill the enemy or get killed.” এরপর আর পিছনে তাকানাের কোনাে সুযােগ রইল না। দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে দৃষ্টি কেবলই সামনে, যুদ্ধই তখন অনিবার্য।

কুষ্টিয়া পুনর্দখলের পরিকল্পনা

মার্চের ২৫ তারিখে যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে মেজর সােয়েবের নেতৃত্বে বেলুচ রেজিমেন্টের শ দুয়েক সৈন্য এসে রাতের আঁধারে বিনা বাধায় কুষ্টিয়া জেলা শহর দখল করে নেয়। বাধা দেওয়ার মতাে সংগঠিত শক্তি হিসেবে তারা পুলিশবাহিনীকেই গণ্য করে এবং সেই বিবেচনায় প্রথমেই হানা দেয়। কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনে। কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার তখন ছিলেন চুয়াডাঙ্গায় । কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন থেকে সেই রাতে চুয়াডাঙ্গা থানার অয়্যারলেসে তার সঙ্গে যােগাযােগ করা হলে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনকে নির্দেশ দেন। এভাবে জেলার পুলিশ বাহিনীকে কজা করার পর অনেকটা নিশ্চিন্তে জেলা স্কুলকে প্রধান ঘাঁটি করে সদর থানা, অয়্যারলেস স্টেশন, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ প্রভৃতি স্থানে তারা আস্তানা গেড়ে বসে। এমনি করেই রাতারাতি কুষ্টিয়া শহর চলে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে। নিরাপদ নয় মেহেরপুর বা চুয়াডাঙ্গা শহরও। দখলদার বাহিনী যেকোনাে মুহূর্তে আগ্রাসী থাবা বাড়াতে পারে এ-দু’টি মহকুমা শহরের দিকেও। এ-দু’টি শহরকে ঘিরে এরই মধ্যে সর্বস্তরের জনসাধারণ সাধ্যমতাে প্রতিরােধ প্রস্তুতিও নিয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কিন্তু জেলা শহর কুষ্টিয়াকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে দখলমুক্ত না-করা পর্যন্ত মেহেরপুরে বা চুয়াডাঙ্গা থেকে নির্বিঘ্নে যুদ্ধ পরিচালনার পরিকল্পপনা করাও দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ২৭ মার্চ কুষ্টিয়া পুনর্দখলের পরিকল্পনাই করে ফেললেন। এ-প্রসঙ্গে তিনি। ৩১.০১.১৯৭৪-এ প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন : ডা, আসহাব-উল হক (দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের প্রধান উপদেষ্টা) সাহেবকে খবর দিলাম। দুই কমরেড মিলে ছক আঁকলাম-কুষ্টিয়া আমাকে পুনরুদ্ধার করতেই হবে। পরিকল্পনা করলাম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। সীমান্তের সৈন্যবাহিনীকে জরুরি ভিত্তিতে চুয়াডাঙ্গায় জমায়েত হবার নির্দেশ দিলাম। এরপর কুষ্টিয়া পুনর্দখলের জন্য যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছে, সেই যুদ্ধের খুঁটিনাটি নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা শেষে ২৯ মার্চ অতিপ্রত্যুষে কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানের ওপর একযােগে তিনদিক থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়।

কার নেতৃত্বে কোন বাহিনী কুষ্টিয়া শহরের কোন এলাকায় অবস্থান করবে এবং কখন কীভাবে আক্রমণ রচনা করবে সে-সব পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করা হয়। আর এই কুষ্টিয়া-যুদ্ধ পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয় ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীর ওপর। | যেহেতু প্রতিপক্ষ অর্থাৎ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে আছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, তাই প্রচলিত পদ্ধতির যুদ্ধকৌশলের সঙ্গে কিছু অভিনব বিষয় যুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়। ১. ত্রিশূলসদৃশ্য তিনদিক থেকে একযােগে হামলা চালানাের সময় সৈনিকদের পিছনে থাকবে হাজার-হাজার সাহসী জনগণ। তারা সম্মিলিত কণ্ঠে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত করে রাখবে আকাশবাতাস, যেন পাকবাহিনী আক্রমণকারীর প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে অনুমান করতে পারে। তা হলে তাদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এমন কি জেলা স্কুলের মূল ঘাঁটিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও করা হয়। কুষ্টিয়া পুনর্দখলের প্রস্তুতি যে-কোনাে কাজেই পরিকল্পনার-পর-পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। কুষ্টিয়া পুনর্দখলের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা চূড়ান্তভাবে প্রণয়নের পূর্বেই প্রস্তুতি গ্রহণের কাজ শুরু হয়ে যায়; শুরু হয় প্রতিরােধের ভাবনা থেকে এবং সেটা ২৬ মার্চ থেকেই মেহেরপুর এবং চুয়াডাঙ্গা মহকুমার সর্বত্র। এছাড়া ২৭ তারিখ থেকে প্রস্তুতি শুরু হয় দৌলতপুর, ভেড়ামারা, কুমারখালী, ঝিনাইদহ, কোটচাদপুর প্রভৃতি এলাকাতেও। প্রস্তুতিপর্বের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল : ১. আনসার-মুজাহিদদের একত্রে সংগঠিত করা। তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা। তাদের জন্য অস্ত্র ও গুলির ব্যবস্থা করা, সংক্ষিপ্ত ট্রেনিংয়ের আয়ােজন করা। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে যে-কোনাে প্রয়ােজনে সদাসর্বদা প্রস্তুত রাখা। ৩. স্থানীয়ভাবে কন্ট্রোলরুম খুলে জনগণের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রাখা। জ্বালানি তেল সংগ্রহে উদ্যোগ গ্রহণ। মেহেরপুরে স্থানীয় উদ্যোগ ছাড়াও গাংনী থানার সীমান্তবর্তী গ্রাম তেঁতুলবাড়িয়ার নূরু চেয়ারম্যান এবং মােশাররফ ডাক্তার ভারতীয় সহযােগিতায় তেল সংগ্রহ করে মেহেরপুরে মহকুমা প্রশাসকের কন্ট্রোলরুমে পৌছে দেন এবং নিজ গ্রামে মজুদ গড়ে তােলেন। অস্ত্র ও গােলাবারুদের প্রত্যাশায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে যােগাযােগের নানামুখী প্রচেষ্টা গ্রহণ।

৬. মেডিকেল টিম গঠন এবং জরুরি প্রয়ােজনীয় ওষুধপত্র সংগ্রহের প্রচেষ্টা। ৭. যুদ্ধের সময় টেলিযােগাযােগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চুয়াডাঙ্গার টেলিফোন বিভাগের দক্ষকর্মী ফকির মােহম্মদ, পরিতােষ বাবু, কাজী জয়নাল আবেদীন প্রমুখ সে অভাবও অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে পূরণ করেন। টেলিফোন বিভাগের সহযােগিতায় পােড়াদহের খােলা প্রান্তরে সেই দুঃসময়ে একটি ফিল্ড এক্সচেঞ্জ বসানাে হয়, যা কুষ্টিয়া পুনর্দখলের যুদ্ধের মাঠে বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সংযােগরক্ষা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গণের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পালন করে। এ-প্রসঙ্গে অধিনায়ক আবু ওসমান চৌধুরী লিখেছেন :নিঃসন্দেহে এটা ছিল চুয়াডাঙ্গার টেলিফোন বিভাগের তৎাকীলীন ্মচারীদের এক অতি প্রশংসনীয় ভূমিকা। এই ফিল্ড এক্সচেঞ্জ বসানাের ফলেই কুষ্টিয়া রণাঙ্গন ও চুয়াডাঙ্গা রণ-সদরের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষা করা সহজ হয়েছিল।

রণক্ষেত্র কুষ্টিয়া শহর

দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে কুষ্টিয়াকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধ অনিবার্য। সেই যুদ্ধের সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ন চলছে চুয়াডাঙ্গায়, দক্ষিণপশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তরে। আর সেই যুদ্ধকে ঘিরে নানামুখী প্রস্তুতির জোর তৎপরতা চলছে সে-দিনের কুষ্টিয়া জেলার সব থানা-মহকুমা এমনকি গ্রামেগ্রামে পর্যন্ত। গ্রামে-ইউনিয়নে-থানায় গঠিত সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। প্রধানত ছাত্র-যুবকেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংশ্লিষ্ট হয় এ-বাহিনীর সঙ্গে। কুষ্টিয়া-যুদ্ধকে সফল করার জন্য তারাই স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেয় নানা রকমের কাজের বােঝ। হাসিমুখে পালন করে নানান দায়িত্ব। অবশ্য স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই এই স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠিত করে তােলেন এবং পরিচালিত করেন। চুয়াডাঙ্গায় আওয়ামী লীগ নেতা ডা, আসহাব-উল হক, অ্যাডভােকেট ইউনুস আলী, মীর্জা সুলতান রাজা, দোস্ত মােহাম্মদ আনসারী, ওবায়দুল হক জোয়ারদার কবু, আল্লা হাফিজ প্রমুখের নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে অত্যন্ত শক্তিশালী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। এ-দিকে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ২৫ মার্চ রাতেই মেহেরপুরের সব আনসার মুজাহিদকে ডেকে একত্রিত করার আদেশ দেন। আনসার ইন্সট্রাক্টর এস এম আল আমিন, রহমতুল্লাহ খান সােনা, বশিরউদ্দীন, আবুল কাশেম কোরাইশী প্রমুখের নেতৃত্বে আনসারমুজাহিদেরা ২৬ মার্চের মধ্যেই মেহেরপুরে একত্রিত হন এবং ২৭ মার্চ তাদের একদিনের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ শেষে একটি করে ৩০৩ রাইফেল ও প্রাথমিকভাবে ৫ রাউন্ড গুলি প্রদান করা হয়। গাংনী থেকেও আবুল কাশেম কোরাইশী এবং আলতাফ হােসেনের নেতৃত্বে এক প্লাটুন আনসার মেহেরপুরে হাজির হয় ২৬ তারিখে। | শুধু আনসার-মুজাহিদ নয়, গ্রামে-গ্রামে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তােলার ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মেহেরপুরে আওয়ামী লীগ নেতা মােঃ সহিউদ্দীন, মােঃ নঈমউদ্দীন, ইসমাঈল হােসেন প্রমুখের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। গাংনীতে জালালউদ্দীন, আব্দুর রহমান (জোড়াপুকুর), গােলাম রহমান, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। গাংনীতে জালালউদ্দীন, আব্দুর রহমান (জোড়পুকুর), গােলাম রহমান, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। মুজিবনগর এলাকায় এ-দায়িত্ব কাঁধে নেন আ ক ম ইদ্রিস, মান্নান মাস্টার, ডা. কমরউদ্দীন, আব্দুল মমিন চৌধুরী প্রমুখ নেতা। এছাড়াও কুষ্টিয়ার মিরপুরে রউফ চৌধুরী, নূরুল হক, আব্দুল জলিল, ইসমাঈল হােসেন; দৌলতপুরভেড়ামারায় রাজা মিয়া, নূরুল হুদা, মজিবুল হক, শফিউল ইসলাম, কুমারখালী-খােকসায় গােলাম কিবরিয়া, আওয়াল মিয়া, আব্দুল আজিজ, আব্দুল মজিদ, আব্দুর রহিম, আবুল কালাম, সৈয়দ আলতাফ হােসেন, ডা. রবিউল বারী, আব্দুল গফুর, নূর-এ আলম জিকু প্রমুখের নেতৃত্বে আনসার, মুজাহিদ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী একত্রে সংগঠিত হয় এবং কুষ্টিয়া-যুদ্ধে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন। | মজার বিষয় হচ্ছে, কুষ্টিয়া শহরকে শত্রুমুক্ত করার জন্য যখন বৃহত্তর কুষ্টিয়ার গােটা জনপদজুড়ে চলছে নানা প্রকার প্রস্তুতি, তখন কুষ্টিয়া দখলকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ-প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত হলেও উদ্বিগ্ন হয় নি মমাটেই। এ-প্রসঙ্গে সিদ্দিক সালিক তাঁর Witness to Surrender গ্রন্থে লিখেছেন।

On 28 March, At about 9.30 P.M, the local (Kushtia) Superitendent of Police, pale with fear, came to the Company Commander Major Shoib, and reported to the rcbcls had gathered in the border town of Chuadanga, about 46 kilometers from Kushtia and were about to attack the town at night. The were also threateoving to

kill all collaborators. The Company Commander passed a word of caution to his platoons, but the troops did not take it very seriously. They did not even bother to dig

their trenches. অথচ এই কুষ্টিয়া জেলারই মহকুমা শহর চুয়াডাঙ্গায় দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর স্থাপন করে উপদেষ্টামণ্ডলীর (রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ) সার্বক্ষণিক পরামর্শ অনুযায়ী মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ-ভেড়ামারামিরপুর-কুমারখালী—সর্বত্রই চলছে কুষ্টিয়াকে শত্রুমুক্ত করার জোর প্রস্তুতি। ইপিআর ৪ নং উইংয়ের অধীন সব কোম্পানির বাঙালি ইপিআর সদস্যদের নিয়ে কুষ্টিয়া শহরে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের জন্য সামগ্রিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এবং সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী। সৈন্য, অস্ত্র, রসদ, টেলিযােগাযােগ, মেডিকেল টিম, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন—সবদিক প্রায় গুছিয়ে আনা হয়েছে; এখন পরিকল্পনামাফিক ২৯ মার্চ অতি প্রত্যুষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শুরু হবে বাঙালির মরণপণ লড়াই—এটাই সবার প্রত্যাশা। একটি অনভিপ্রেত ঘটনা এরই মাঝে ঘটে গেল একটি অনভিপ্রেত ঘটনা।

দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর সর্বাধিক মনােযােগ তখন কুষ্টিয়া-যুদ্ধের দিকে। তবু তাকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে যশাের সেনানিবাসের দিকেও। যশাের সেনানিবাস থেকে যে-কোনাে সময় তিনি আক্রান্ত হতে পারেন এই আশঙ্কা থেকে শুধু নয়, কুষ্টিয়া দখলমুক্ত করার পর বরং যশােরকে শত্রুমুক্ত করার জন্য তাকেই যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে—এই প্রত্যয় থেকেই তিনি যশােরের দিকে দৃষ্টি রেখেছেন। এরই মাঝে চুয়াডাঙ্গা ইপিআর উইংয়ের অধীন যাদবপুরের ডি-কোম্পানি থেকে অয়্যারলেসে খবর দিলেন কোম্পানি কমান্ডার মজিদ মােল্লাইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন, যারা ‘সিনিয়র টাইগার’ নামে পরিচিত, তাদের সব সৈন্য অস্ত্র ও রসদসহ বাঙালি কমান্ডার লে. কর্নেল রেজাউল জলিলের নেতৃত্বে চৌগাছায় অবস্থান করছে। এই ব্যাটালিয়নটি ২৪ মার্চ থেকেই সেনানিবাসের বাইরে আছে। বাৎসরিক ফিল্ড এক্সারসাইজ করার জন্য তারা যশােরের অদূরে চৌগাছায় অবস্থান করছে। এই ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার বাঙালি বলেই মেজর আবু ওসমানের মনে প্রত্যাশা জাগে—অস্ত্র

গােলাবারুদসহ বাঙালি অধ্যুষিত পুরাে ব্যাটালিয়নটিকেই যদি নিজেদের পক্ষে পাওয়া যায়! এমন প্রত্যাশা নিয়ে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে লে. কর্নেল রেজাউল জলিলের কাছে একটি চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে তিনি লেখেন :

দেশ ও দেশের লােকের নিরাপত্তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বিপর্যস্ত, মা-বােনর ইজ্জত লুষ্ঠিত, জ্ঞানীগুণী ও ছাত্ররা হতাহত হচ্ছে। তাই এর বিরুদ্ধে আমি আমার ইপিআর বাহিনীকে নিয়ে বিদ্রোহ করেছি, বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। আর কে কি করেছে জানি না, কিন্তু আপনি সিনিয়র, আপনার কাছে সৈন্য আছে, হাতিয়ার আছে, আপনি আসুন অধিনায়কত্ব গ্রহণ করুন। আমরা সম্মিলিতভাবে এদের

হনন করতে সক্ষম হব।” সুবেদার মজিদ মােল্লার মাধ্যমে ২৭ মার্চেই এ-চিঠি পৌছে যায় লে, কর্নেল রেজাউল জলিলের কাছে। কিন্তু পত্রপ্রেরকের কাছে এ-প্রস্তাবের কোনাে উত্তর আসে না। এদিকে কুষ্টিয়া অভিযানের শেষমুহূর্তের প্রস্তুতি ও সার্বিক দায়িত্ব নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ততা ও উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। এই ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ২৮ মার্চ আবারও অনুরূপ আহ্বান জানিয়ে আরেকটি চিঠি লিখলেন লে. কর্নেল জলিলের কাছে, পাঠালেন দানেশ (এটি সম্ভবত ছদ্মনাম, চুয়াডাঙ্গা জেলার ইতিহাস-গবেষক রাজিব আহমেদের মতে আসল নাম—মতিয়ার রহমান মন্টু) নামে এক মুক্তিযােদ্ধার হাতে। তিনি মােটর সাইকেলযােগে চৌগাছা পৌছে প্রাপকের হাতে সে-চিঠি হস্তান্তর করেন।

| দানেশ চুয়াডাঙ্গা ফিরে এসে জানান-ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লে. কর্নেল জলিল সেই চিঠি পড়ার পর এ প্রস্তাব। পাগলের প্রলাপ’ বলে উড়িয়ে দেন। শুধু তাই নয় এ-ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আর কখনাে তার কাছে না-যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে দেন। কিন্তু এর পরের ইতিহাস বড়ই করুণ এবং মর্মান্তিক। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি এমন সীমাহীন আনুগত্য সত্ত্বেও তার বর্বর প্রভুবাহিনীর জঘন্য চক্রান্ত এবং নিষ্ঠুর ছােবল থেকে তিনি নিজেকে কিংবা তার ব্যাটালিয়নকে শেষরক্ষা করতে পারেন নি।

চৌগাছায় বার্ষিক ফিল্ড এক্সারসাইজ শেষ না-হতেই ২৮ মার্চ যশাের সেনানিবাসের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার লে. কর্নেল রেজাউল জলিলের কাছে নির্দেশ আসে—অনতিবিলম্বে যশাের সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার জন্য। সে-নির্দেশ পালন করেন কমান্ডার।

চৌগাছা থেকে লাটবহর গুটিয়ে রওনা দেন যশােরের পথে। দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে গিয়ে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা ২৯ মার্চ গভীর রাতে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে সেনানিবাসে পেীছে অস্ত্র জমা দেন। যশাের সেনানিবাসের অধিনায়ক অবাঙালি ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম দুররানী তৎক্ষণাৎ অস্ত্রাগারের চাবি হস্তগত করেন। ৩০ মার্চ সকাল ৯টায় যশাের সেনানিবাসের অবাঙালি সৈন্যরা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিরস্ত্র সৈনিকের ওপর চালায় নির্মম হামলা। নিহত হয় অধিকাংশ হতভাগ্য বাঙালি সৈনিক। লে, হাফিজউদ্দীনসহ মাত্র কয়েকজন সৈনিক শূন্যহাতে বিপর্যস্ত অবস্থায় পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করে।

কুষ্টিয়া পুনর্দখলের চূড়ান্ত আয়ােজন ও কুষ্টিয়া অভিমুখে যাত্রা কুষ্টিয়া পুনর্দখলের লক্ষ্যে ২৯ মার্চ ভােরে তিনদিক থেকে একযােগে কুষ্টিয়াস্থ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থানসমূহের ওপর আক্রমণ চালানাের পরিকল্পনা করা হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর থেকে সেই মােতাবেক সেনাবিন্যাসও করা হয়। এমন কি বিভিন্ন দায়িত্বে বিন্যস্ত ও নিয়ােজিত বাহিনীকে ২৮ মার্চের মধ্যে লক্ষ্যস্থলে পৌছানাের উদ্দেশ্যে রওনা করিয়েও দেওয়া হয়।

 ইপিআর-এর ৪নং উইংয়ের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নির্দেশে তার অধীন সবগুলাে কোম্পানি এবং সীমান্ত চৌকির সব ইপিআর সদস্য ২৮ মার্চ বেলা ১২টার মধ্যেই উইং সদর চুয়াডাঙ্গায় রিপাের্ট করে। এই সঙ্গে যুক্ত হয় একদিনের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণে প্রস্তুত করে নেওয়া শ’ পাঁচেক আনসার-মুজাহিদের বহর। প্রথমেই ইপিআর-একটি কোম্পানি 

চুয়াডাঙ্গা থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঝিনাইদহে। কুষ্টিয়া-যুদ্ধের পরিকল্পনা অনুযায়ী এই কোম্পানির দায়িত্ব যশাের-ঝিনাইদহ সড়ক অবরােধ করা, যশাের সেনানিবাস থেকে অস্ত্র-রসদ-সৈন্য কোনাে রকম সহযােগিতা কুষ্টিয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে যেন পৌছতে না পারে। যশাের থেকে চুয়াডাঙ্গার ওপর আঘাত এলে সেটাও প্রতিরােধ করবে এই কোম্পানি। ইপিআর-এর সুসংগঠিত কোম্পানিটির সঙ্গে যুক্ত হয় আনসারমুজাহিদের দল এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আর ঝিনাইদহের এই পুরাে প্রতিরােধ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক শফিউল্লাহ। চুয়াডাঙ্গায় মূল ঘাটি বা সদর দপ্তর রক্ষা এবং প্রয়ােজনে পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর নিকটস্থ অবস্থানে আক্রমণের জন্য নায়েব সুবেদার জিয়াউল হকের নেতৃত্বে ২০০ জনের মতাে মুক্তিযােদ্ধা বিশাখালী গড়ে তােলে। প্রতিরক্ষা ব্যুহ। সুবেদার মজিদ মােল্লা কোটচাদপুরে দু’টি প্লাটুন সঙ্গে নিয়ে ডিফেন্স গড়ে তােলেন। কালিগঞ্জেও প্রতিরক্ষার দায়িত্বে রাখা হয় শ দুয়েক মুক্তিযােদ্ধা। ঝিনাইদহ-বিশাখালি-কালিগঞ্জ-কোটচাঁদপুর-গােটা এই প্রতিরক্ষা বলয়ের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ ঝিনাইদহের তৎকালীন এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন। এই প্রতিরক্ষা বলয় ছড়িয়ে দেওয়া হয় ২৭ মার্চ থেকেই। | কুষ্টিয়া-যুদ্ধের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী নিজেই এক কোম্পানি ইপিআর এবং আনসার-মুজাহিদের বিশাল বাহিনী নিয়ে ২৮ মার্চ চুয়াডাঙ্গা-পােড়াদহের কাঁচা রাস্তা ধরে কুষ্টিয়ার পথে অগ্রসর হন। এ-বাহিনী যথাসময়ে, অর্থাৎ ২৮ মার্চ রাতেই পৌছে যায় কুষ্টিয়া শহরের সন্নিকটে, তাদের পূর্বনির্ধারিত জায়গায়। | গােলমাল দেখা দেয় দৌলতপুর থানার প্রাগপুরে অবস্থিত ইপিআর-এর কোম্পানিটি নিয়ে। সুবেদার মােজাফফরের নেতৃত্বে এই কোম্পানিও ২৮ মার্চই রওনা দেয় হাইকমান্ডের নির্দেশে। পথের অসুবিধা ও একটি গাড়ি বিকল হওয়ার কারণে এই কোম্পানির সৈন্যদের ভেড়ামারা হয়ে কুষ্টিয়ার সন্নিকটে পৌছতে ২৮ তারিখের রাত পেরিয়ে ২৯ মার্চ সকাল হয়ে যায়। অনাকাক্ষিত এই বিলম্বের কারণেই কুষ্টিয়া-যুদ্ধের সময়সূচিতে পরিবর্তন এনে ১ দিন পিছিয়ে দিতে হয়। অর্থাৎ আক্রমণের দিন ধার্য হয় ৩০ মার্চ ভােরবেলা। মেহেরপুর থেকে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর পাঠানাে আক্রমণকারী যােদ্ধাদল ২৮ মার্চ সন্ধ্যার মধ্যেই কুষ্টিয়ার অদূরে পৌছে যায়। এ-দলে ইপিআর সদস্য ছিল না, ছিল আব্দুল বারি, রহমতুল্লাহ খান সােনা, শেখ জহিরুদ্দিন এবং রাহেনউদ্দীনের নেতৃত্বে ৪ প্লাটুন সশস্ত্র আনসার। এ-দিনেই। গাংনী থেকে আবুল কাশেম কোরেশীর নেতৃত্বে আরেক প্লাটুন আনসার ও পূর্বের বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় কুষ্টিয়ার পশ্চিমে মশানের বাঁশবাগানের মধ্যে।

এছাড়াও কমান্ডার আলতাফ হােসেনের নেতৃত্বে আরেক প্লাটুন আনসার গাংনী থেকে রওনা হয়ে খলিশাকুণ্ডি ব্রিজের কাছে প্রস্তুত থাকে। রাজবাড়ী কুমারখালী থেকে পুলিশ, আনসার, স্বেচ্ছাসেবকের একটি বহর এসে কুষ্টিয়ার পূর্বদিকে অবস্থান নেয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী কুষ্টিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান গ্রহণকারী যােদ্ধাদের বিভিন্ন স্কুলে থাকার এবং আহারের ব্যবস্থা করে। মূলত ২৯ মার্চের মধ্যেই সুবেদার মােজাফফরের কোম্পানিও বারােখাদার কাছে পৌছে যায় এবং সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। কুষ্টিয়া-যুদ্ধ : অপারেশন ফার্স্টলেগ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নানান বিবেচনায় কুষ্টিয়া-যুদ্ধের অবস্থান অত্যন্ত গৌরবময় এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। তারিখ ৩০ ও ৩১ মার্চ, ১৯৭১। মাত্র সপ্তাহখানেক আগে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর লেলিয়ে দেওয়া বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকাসহ দেশের প্রধান জেলা শহরগুলাে দখল করে নিয়েছে, দেশজোড়া বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক-উত্তষ্ঠা, প্রাণের ভয়ে মানুষ শহর ছেড়ে পালাচ্ছে গ্রামে, গ্রাম ছেড়ে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে ভারতে। দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বত্র শক্ত ও সক্রিয় প্রতিরােধ গড়ে ওঠে নি বললেই চলে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঠিক দিক-নির্দেশনা নেই। বাঙালি ইপিআর-আনসার মুজাহিদ এবং বিভিন্ন রেজিমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা কিছু বাঙালি সৈনিক মিলে দেশের কোথাও-কোথাও যে সামান্য প্রতিরােধ উদ্যোগ গ্রহণ করে তাও শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভারী আগ্নেয়াস্ত্র এবং কামানের গােলার মুখে অচিরেই গুঁড়িয়ে যায়।

তারা পিছু হটে গিয়ে সীমান্ত এলাকাজুড়ে প্রতিরােধ বলয় গড়ে তােলার জন্য আবারও সচেষ্ট হয়। এমনই বিপর্যস্ত অবস্থায় দেশের একপ্রান্তে চুয়াডাঙ্গা থেকে ইপিআর ৪নং উইংয়ের অধিনায়ক বাঙালি মেজর আবু ওসমান চৌধুরী স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহায়তায় অত্যন্ত সীমিত সামরিক সামর্থ্য নিয়ে কুষ্টিয়াকে দখলদারমুক্ত করার জন্য যে সফল যুদ্ধ পরিচালনা করেন, তা সত্যি এক বিরল ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। নিজের বাহিনীর সে-দিনের শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে ৩১.০১.৭৪ তারিখে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন : আমার মােট সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০০ জন ইপিআর সৈনিক। তাদের অস্ত্র বলতে ছিল ৩০৩ রাইফেল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ৩০৩ এলএমজি, এমজি ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মরচেপড়া চারটা ৩৫ রকেট লাঞ্চার। গােলা-বারুদের সংখ্যা একেবারেই অপর্যাপ্ত। তদুপরি ছিল আধুনিক যুদ্ধে অনভিজ্ঞ ও অশিক্ষিত লােকজন। অফিসার বলতে আমার সাথে। ছিল একমাত্র ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী। তবে ভরসা ছিল এই যে আমার সাথে ছিল সমস্ত জনগণ।

হ্যা, এ-কথা সত্যি—বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে ছিল না মােটেই। জনগণ ছিল মুক্তিবাহিনীর পক্ষে, দেশের স্বাধীনতার পক্ষে। তাই মেজর আবু ওসমান চৌধুরী সে-দিন সামরিক শক্তি অপেক্ষা জনগণের শক্তির উপরে ভরসা করেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিপুল পরিমাণ সামরিক শক্তি ও সামর্থ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের পরিকল্পনা করেন। সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে ৩০ মার্চ দিনের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ ভাের পৌনে পাঁচটায় শুরু হয় পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ত্রিমুখী আক্রমণ। এ অপারেশনের নাম দেওয়া হয় অপারেশন ফাস্টলেগ।। কুষ্টিয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল ঘাঁটি এবং অস্ত্রভাণ্ডার জেলা স্কুলে হলেও তারা পুরাে শহরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন স্থানে ঘাঁটি খুলে জাঁকিয়ে বসে। সে-কারণেই আক্রমণকারী বাহিনী তিনদিক থেকে একযােগে আক্রমণ চালানাের পরিকল্পনা করে। সমগ্র যুদ্ধ পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব থাকে ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীর ওপর। পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দেশ দেওয়া হয়—১. সুবেদার মােজাফফর তার বাহিনী নিয়ে পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি আক্রমণ করবেন। ২. ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী নিজে তার বাহিনী নিয়ে শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অর্থাৎ কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসের দিক দিয়ে আক্রমণ করবেন জেলা স্কুলে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাদের মূল ঘাঁটিতে। ৩. নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামান (শহীদ) তার বাহিনী নিয়ে পূর্বদিক থেকে মােহিনী মিল ও অয়্যারলেস স্টেশনের ওপর বিপুলবিক্রমে আক্রমণ চালাবেন। এভাবেই তিনপ্রান্ত থেকে একই সময়ে শত্রুবাহিনীর তিনটি শক্তিশালী অবস্থানের ওপর জোর হামলা চালিয়ে পরাজিত করাই মূল লক্ষ্য। সৈনিকদের সামরিক আক্রমণের সঙ্গে-সঙ্গে শত্রুবাহিনীর মনােবল ভেঙে দেওয়ার জন্য চালানাে হবে মনস্তাত্ত্বিক আক্রমণও। পরিকল্পনা করা হয় প্রতিটি প্রান্তে প্রতিটি প্রতিরােধ বাহিনীর পিছনে থাকবে পাঁচ থেকে দশ হাজার জনগণ, তারা জয়বাংলা ধ্বনিতে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করবে শত্রুদের ওপর। তারা যেন আক্রমণকারীর প্রকৃত সংখ্যা আন্দাজ করতে না পারে। পুলিশ লাইনে আক্রমণের দায়িত্ব প্রাগপুর থেকে আগত সুবেদার মােজাফফর আহমদের কোম্পানির। তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
এ কোম্পানিরই এক অংশ নিয়ে নায়েব সুবেদার আব্দুল মতিন পাটোয়ারী পুলিশ লাইনের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে মজমপুরে এক হাজিবাড়ির তিনতলার উপরে পজিশন নেন। তারপর সেখান থেকে পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ রচনা করেন। এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য ছিল। মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে আক্রমণ শুরু হওয়ার পরপরই মেহেরপুর থেকে এক কোম্পানি আনসার এবং এক কোম্পানি মুজাহিদ এসে ইপিআর বাহিনীর মূল দলের সঙ্গে যােগ দেয়। ফলে মূল দলের শক্তি বৃদ্ধি পায়। মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে তারা আঘাতের-পরআঘাত হানে পুলিশ লাইনের পাকঘাঁটিতে। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণকারী বাহিনীর পিছনে কমপক্ষে পাঁচ হাজার বেসামরিক জনগণ সম্মিলিতভাবে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে থাকে। আঘাতে-আঘাতে এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে পাকসেনারা হয়ে পড়ে দিশেহারা, স্তম্ভিত। এত ভােরে ঘুমের ঘাের না-কাটতেই এই আক্রমণের মুখে তারা প্রাথমিকভাবে একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়—সবচেয়ে বেশি এবং ভারি আঘাত আসছে তিনতলা থেকে। এটা বুঝে ওঠার পর বেলা দেড়টার দিকে চারজন পাক সৈন্য ঐ তিনতলা ভবনটি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে একটি আর/আর প্রস্তুত করে। মতিন পাটোয়ারী সমূহ বিপদ বুঝে সঙ্গে-সঙ্গে নির্দেশ দেন শক্রর আর/আর-এর ওপর একযােগে আঘাত হানার।
একটি রকেট লাঞ্চার, তিনটি এলএমজি এবং ২ ইঞ্চি মর্টার একইসঙ্গে আঘাত হানে আর/আর-এর ওপর। পাকসেনারা ভাবতেই পারে নি এমন প্রবল আক্রমণ আসতে পারে। মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তিশালী আঘাতে-আঘাতে পাকসেনাদের আর/আর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই নিহত হয় ঐ চারজন পাকিস্তানি সৈন্য। এর ফলে তারা অতিদ্রুত হতােদ্যম হয়ে পড়ে। বেলা পাঁচটার মধ্যে তারা রণে ভঙ্গ দিয়ে অনেকেই জেলা স্কুলের মূল ঘাটির দিকে পালিয়ে যায়, পথিমধ্যে কেউ-কেউ নিহত হয়। ৩০ মার্চ বিকাল নাগাদ পুলিশ লাইন সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর নেতৃত্বে তার বাহিনী সার্কিট হাউসের দিক থেকে জেলা স্কুলের মূল ঘাটিতে প্রবলভাবে আক্রমণ রচনা করে। ভাের পৌনে পাঁচটা থেকে বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে এই আক্রমণ। এদিকে নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামান (শহীদ) তার বাহিনী নিয়ে শহরের পূর্বদিক থেকে মােহিনী মিল এবং অয়্যারলেস স্টেশনের পাকঘাটিতে শক্তিশালী আঘাত হানে। আক্রমণকারী প্রতিটি বাহিনীর পিছনেই এসে জড়াে হয় হাজার হাজার মুক্তিকামী জনতার বিশাল গণবাহিনী। তাদের কণ্ঠে গগনবিদারী শ্লোগান জয়বাংলা।
শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্যরা ভাবতেই পারে নি–ইপিআর-এর মতাে একটি আধা-সামরিক বাহিনী এভাবে আক্রমণ করে তাদের পর্যদুস্ত করে ফেলতে পারে। বাঙালির দেশপ্রেম সম্পর্কে তাদের কোনাে ধারণাই ছিল না। তাই ৩০ মার্চ ভােরে ঘুমভাঙা চোখে সহসা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে তারা, যেন-বা সৈনিক হিসেবে প্রাথমিক প্রতিরােধ গড়তেও তারা ভুলে যায়। এ-রকম বিমূঢ় বিপর্যস্ত অবস্থায় ঘাের কাটিয়ে ওঠার আগেই অনেকে ধরাশায়ী হয়। সকাল ৯টার দিকে আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এদিন দুপুরের মধ্যেই ডিসি কোর্ট, সদর থানাসহ বেশকিছু জায়গা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে, দখলে আসে বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্রও। জেলা স্কুল, পুলিশ লাইন এবং অয়্যারলেস স্টেশনে যুদ্ধ চলে একেবারে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত। তুমুল যুদ্ধ। পুলিশ লাইনে হতাহতের পরিমাণ এবং আক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে পাকিস্তানি হানাদাররা পুলিশ লাইন থেকে পালিয়ে এসে নিকটস্থ টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আশ্রয় নেয়। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না সেখানেও। মুক্তিযােদ্ধারাও সুযােগ বুঝে প্রবল আঘাত হানে। পাকিস্তানি বাহিনী এক্সচেঞ্জ ভবনের জানালার ফাক দিয়ে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করতে থাকে। | এ-সময় দুঃসাহসী এক ঘটনা ঘটে যায় চোখের পলকে। ১৩/১৪ বছরের এক দুর্ধর্ষ তরুণ হঠাৎ টেলিফোন এক্সচেঞ্জের পিছনের পাইপ বেয়ে ঐ বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী যে জানালার ফাঁক গলিয়ে মেশিনগানের গুলি চালাচ্ছিল, দুরন্ত সেই ছেলেটি অন্য একটি পাইপ বেয়ে সেই জানালার কাছে পৌছে যায়। তারপর আর একমুহূর্তের বিলম্ব নয়। অত্যন্ত ক্ষীপ্র হাতে নিজের গায়ের জামা খুলে পাক সেনাদের মেশিনগানের নলের উপরে ফেলে দিয়ে অতি দ্রুত ম্যাচ কে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘটনাটি এক নিমেষের। বারুদের সংস্পর্শে এসে সে আগুন মুহূর্তের সারা এক্সচেঞ্জ ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণভয়ে পাকিস্তানি সেনারা দ্রুত এক্সচেঞ্জ ভবন ছেড়ে পালিয়ে যায় জেলা স্কুলের মূল ঘাঁটিতে। প্রকৃতপক্ষে ৩০ মার্চ সন্ধ্যার পূর্বেই প্রতিরােধযােদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে শহরের বিভিন্ন অবস্থানে শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং সব অবস্থান ত্যাগ করে। ৪ জন অফিসারসহ ৬৫ জন সৈন্য জেলা স্কুলের মূল ঘাঁটিতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তারা যদিও আত্মরক্ষার স্বার্থে গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখে, তবু তাদের অধিনায়ক মেজর শােয়েব এই শোচনীয় অবস্থা থেকে পরিত্রাণের আশায় যশাের সেনানিবাসে সাহায্যের আবেদন জানান। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, যশাের থেকে অয়্যারলেসে তাকে জানানাে হয় : 
No reinforcement possible. Air strike called off due to poor visibility. Try to live on your own.” যশাের সেনানিবাস থেকে অয়্যারলেসযােগে পাঠানাে এ বার্তাটি ধরা। পড়ে যায় প্রতিরােধযােদ্ধাদের অয়্যারলেসে। রি-ইনফোর্সমেন্ট সম্ভব। নয়-জেনে তাদের মনােবল আরও বেড়ে যায়। তারা আক্রমণের তীব্রতা বাড়াতে সচেষ্ট হয়। প্রকৃত চিত্র হচ্ছে, সারা দিনের যুদ্ধশেষে জেলা স্কুলের মূল ঘাঁটিতে অফিসারসহ মাত্র ৬৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য তখনও বেঁচে ছিল। এ প্রসঙ্গে সিদ্দিক সালিকের Witness to Surrender বইতে লেখা হয়েছে : Mejor Shoaib collected the remnants of his command to reorganize them. He found that only 65 had survived out of 150.12 জেলা স্কুলের ঘাঁটিতে অবরুদ্ধ ৬৫ জন পাকিস্তানি সৈনিক ৩১ মার্চ সকাল নাগাদ সাংঘাতিক মরিয়া হয়ে ওঠে। যশাের সেনানিবাস থেকে সহযােগিতা পাচ্ছে না—এটা জানার পর নিজেরাই ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। তারা ভারী অস্ত্রের সাহায্যে একনাগাড়ে গােলাবর্ষণের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধাদের সন্ত্রস্ত করে তােলে। ২৪ ঘণ্টা একটানা যুদ্ধশেষে মুক্তিযােদ্ধারাও রণকৌশলে অভূতপূর্ব পরিবর্তন নিয়ে আসে। পরিকল্পনা করা। হয় আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার। যেহেতু পাকসৈন্যরা গুছিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। জেলা স্কুলে, তাই এই সুযােগে চতুর্দিক থেকে ঐ আস্তানায় আগুন জ্বালিয়ে শনিধনের পরিকল্পনা আঁটা হয়। সেই উদ্দেশ্যে জেলা স্কুলের চারদিকে খড়ের গাদা, কেরােসিন তেল এনে জড়াে করা হয়। এই অগ্নৎসবের জন্য সময় নির্ধারণ করা হয় রাতের আঁধার।  পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঁচার কোনাে উপায় নেই দেখে রাত ৮টার দিকে শেষ চেষ্টা হিসেবে হঠাৎ দু’টি জিপ ও দুটি ডজ গাড়িতে চড়ে রাতের অন্ধকারে মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যুহ ভেদ করে তীব্রবেগে গুলিবর্ষণ করতে করতে কুষ্টিয়া-যশাের রােড ধরে ঝিনাইদহের দিকে দ্রুতগতিতে পালিয়ে যায়। তাদের লক্ষ্য ছিল যশাের সেনানিবাসে পৌছানাে। কুষ্টিয়া থেকে পালাতে পারলেও তাদের সে লক্ষ্যে পৌছানাের সাধ পূরণ হয় নি। সন্ধ্যার পর ঘন অন্ধকারে কাছে কিংবা দূরের লক্ষ্যবস্তু কিছুই ভালাে। দেখা যাচ্ছিল না বলে মুক্তিযােদ্ধারা গুলিবর্ষণ কিছুটা স্থগিত রাখে। পাকিস্তানি সৈন্যরা ঠিক এই সুযােগটুকুই গ্রহণ করে। তীব্রগতিতে গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটে চলে যশােরের পথে । মুক্তিযােদ্ধাদের একটা গ্রুপ তাদের পিছু ধাওয়া করে। মুক্তিবাহিনীর অপর একটি গ্রুপ আগে থেকেই ফাঁদ পেতে পাকসেনাদের অপেক্ষাতেই কুষ্টিয়া-যশাের সড়কের দু’পাশে বসেছিল এটাও একরকম অভিযান বটে।
 
জায়গার নাম গাড়াগঞ্জ ব্রিজ। ঝিনাইদহ মহকুমার শৈলকূপা। থানায় অবস্থান। মুক্তিযােদ্ধার এ-দলটি গাড়াগঞ্জ সেতুটি ভেঙে ফেলে। শূন্যস্থান পূরণ করেছে বাঁশের চাটাই বিছিয়ে। সেই চাটাই আলকাতরা মাখিয়ে কালাে রঙের পিচঢালা পথের মতাে করে দিয়ে তার দু’পাশে নিজেরা। এমুশ পেতে অপেক্ষায় থাকে—যদি নাগালের মধ্যে পাওয়া যায় পাকসেনাদের। অবশেষে এলাে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রতীক্ষার হলাে অবসান। কুষ্টিয়া থেকে তীব্রগতিতে ছুটে আসা পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়িবহরের মধ্যে প্রথম দু’টি জিপ সােজা উঠে পড়ে ফঁাদে, তারপর ধপাস করে খাদে। অপেক্ষমাণ মুক্তিবাহিনী সঙ্গে-সঙ্গে শুরু করে আঘাত হানতে। সেই আঘাতে ঘটনাস্থলেই মেজর সােয়েবসহ বেশ কয়েকজন পাকসৈন্য নিহত হয়। অবশিষ্ট সৈনিকরা বিপর্যস্ত অবস্থায় বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লে গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে তারা প্রাণ হারায়। কুষ্টিয়া থেকে পলায়নপর পাকিস্তানি সৈন্যদের মনােবল এ-সময় এতটাই ভেঙে পড়ে যে তাদের হাতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র থাকা সত্ত্বেও তার ব্যবহার করার সাহস তারা পায় নি; আত্মসমর্পণ করেছে অথবা করুণভাবে মৃত্যুবরণ করেছে।  ৩১ মার্চ রাতেই আহত অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একমাত্র জীবিত অফিসার লে, আতাউল্লাহ শাহ ধরা পড়েন মুক্তিবাহিনীর হাতে। ঝিনাইদহে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাকে ২ এপ্রিল বিকাল নাগাদ দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গাতে আনা হয়। অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী তার জবানবন্দী গ্রহণ করেন, ফরাসি টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান সে দৃশ্য ধারণ করে বহির্বিশ্বে প্রচার করে।  পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখল থেকে কুষ্টিয়া শহরকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত করা সম্ভব হয় ৩১ মার্চ রাতেই। ২৫ মার্চ রাতে কুষ্টিয়ার বুকে যে জগদ্দল পাথর চেপে বসেছিল, ৩০ ও ৩১ মার্চ দু’দিনব্যাপী বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধশেষে মুক্তিবাহিনী এবং এতদঞ্চলের বীর জনতা সেই পাথর সরিয়ে দিলে ১ এপ্রিল থেকে আবারও কুষ্টিয়ার মানুষ মুক্ত বাতাসে শ্বাস গ্রহণের সুযােগ পায়। কিন্তু কুষ্টিয়া পুনর্দখলের এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ৬ জন বীরসৈনিক উৎসর্গ করেন তাদের অমূল্য জীবন। সেই ৬ জন শহীদের তালিকা নিমরূপ :  শহীদের নাম পিতার নাম গ্রাম থানা মহকুমা গােলাপ শেখ।
 

নাজির শেখ মশান। মিরপুর কুষ্টিয়া সদর আশরাফ আলী হচেন আলী মশান। মিরপুর কুষ্টিয়া সদর দেলােয়ার হােসেন আলম হােসেন মিরপুর দৌলতপুর কুষ্টিয়া সদর হামেদ আলী ওমেদ আলী দুধকুমড়া কুমারখালী কুষ্টিয়া সদর ফজলুর রহমান নাছির উদ্দীন মেহেরপুর মেহেরপুর মেহেরপুর আব্দুর রশীদ আঃ রহমান মেহেরপুর মেহেরপুর মেহেরপুর কুষ্টিয়া-যুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করতে গিয়ে ১১ জন যােদ্ধা আহত হন গুরুতর রূপে। এই ১১ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা হচ্ছেন আব্দুল মােমেন, আব্দুর রহমান, আনছার আলী, হজরত আলী, রায়হানউদ্দীন, পাতান আলী, গােলাম রহমান, আব্দুর রশীদ, আব্দুল মজিদ, রবিন ও জামাত আলী। এছাড়া আরও প্রায় পঞ্চাশজনকে চুয়াডাঙ্গায় এনে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়। | বীর মুক্তিযােদ্ধারা ২ দিনব্যাপী প্রাণপণ লড়াইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৭নং বেলুচ রেজিমেন্টের কুষ্টিয়াস্থ ব্যাটালিয়নকে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করে শুধু যে কুষ্টিয়া শহর পুনর্দখল ও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তাই নয়, পরাজিত শত্রুবাহিনীর কাছ থেকে তারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ ও যানবাহন উদ্ধার করে। পরবর্তীতে সেগুলাে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত হয়। সেই উদ্ধারকৃত অস্ত্রশস্ত্র, গােলা-বারুদ ও যানবাহনের বিবরণ : ১, ১০৬ মিলিমিটার রিকয়েললেস রাইফেল/ জিপ আরােহী আরআর ৫টি ২. ৭.৬২ মিলিমিটার চাইনিজ মেশিনগান ৮টি ৩. ৭.৬২ মিলিমিটার চাইনিজ হালকা মেশিনগান ১৯টি ৪. ৭.৬২ মিলিমিটার চাইনিজ সাব-মেশিনগান ৫. ৭.৬২ মিলিমিটার চাইনিজ রাইফেল ৮৯টি ৬. জিপ গাড়ি ৭. ১ টন ডজ গাড়ি ৫টি ৮. ৩ টন বড় মােটরগাড়ি ৭টি ৯. বড় (লং ডিসট্যান্ট) সিগন্যাল সেট ৪টি ১০.সব রকমের গােরাবারুদ প্রচুর পরিমাণ ৩১টি ১২টি  কুষ্টিয়া-যুদ্ধের গর্বিত অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী সাফল্যের সঙ্গে কুষ্টিয়া জয় করার পর সেখানে কিছু সৈন্য রেখে অবশিষ্টদের নিয়ে ঝিনাইদহের দিকে রওনা হন। এই বাহিনীর কিছু সৈন্য মাগুরা, কিছু সৈন্য ঝিনাইদহের দক্ষিণে বিষয়খালী (বিশাখালীও বলে) ও কিছুসংখ্যক সৈন্য কোটচাদপুরে প্রতিরক্ষায় মােতায়েন করা হয়। 

 
কুষ্টিয়া থেকে ফিরে আসার পর মেহেরপুরের এক প্লাটুন আনসারকে পাঠানাে হয় চুয়াডাঙ্গায়। মাথাভাঙ্গা নদীর ব্রিজের কাছে তাদের পাহারায় রাখা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা চুয়াডাঙ্গার আকন্দবাড়িয়া, বেলগাছি ও আলমডাঙ্গাতে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। | এই প্রতিরক্ষার প্রধান কারণ ছিল যশাের সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা আক্রমণের সব পথ রুদ্ধ করা। সেই সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মূল ঘাঁটি যশাের সেনানিবাস আক্রমণের পরিকল্পনা করা। | ১ এপ্রিল আহত অবস্থায় পাকিস্তানি লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ শাহ ধরা পড়ে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাকে চুয়াডাঙ্গায় আনা হয়। ২ এপ্রিল কুষ্টিয়ার যুদ্ধে প্রাপ্ত সমরাস্ত্র চুয়াডাঙ্গায় আনা হয়। এ-যুদ্ধ সম্পর্কে সুকুমার বিশ্বাস লিখেছেন : কুষ্টিয়ার যুদ্ধের বুঝি তুলনা হয় না। আমাদের পেছনে লাখে লাখে লােক ঢাল-তলােয়ার, লাঠি-সড়কি, বল্লম নিয়ে প্রস্তুত ছিল। তারা বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য, দেশ থেকে শত্রুসৈন্য বিতাড়িত করার জন্য বদ্ধপরিকর। তাঁদের চোখেমুখে দেখেছি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে যুদ্ধ করার চাইতেও আমাকে অবাক করল মেয়েরা। এগিয়ে গেলাম-দেখি স্থানীয় ছেলেরা শত শত ডাব নিয়ে হাজির। তাদের সঙ্গে বাড়ির ঝি-বৌরা যার যার মত রুটি, ভাত, মাংস। এমনকি পােলাও পর্যন্ত এনে হাজির করছেন! বাড়ির বৌ, মেয়ে যারা কোনােদিন বাড়ির বাইরে বের হত না, তারাও যুদ্ধের ময়দানে হাসিমুখে খাবার এনে ভাইদের মুখে ধরছেন।” তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী লিখেছেন : সাধারণ মানুষের সেই সময়কার সাহসিকতা পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলার গ্রামের আবাল-বৃদ্ধবণিতা সমষ্টিগতভাবে রুখে দাঁড়ায়। আমরা ১ এপ্রিল থেকে অনবরত গ্রামের লােকজনের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র পেতে থাকি, যা তারা পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল।
 
পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক বাংলার ওপর ক্র্যাক ডাউনের এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ বাহিনীর কুষ্টিয়া বিজয় ছিল সামরিক দিক দিয়ে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।  এ-যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি অতি শক্তিশালী ব্যাটালিয়ন যুদ্ধের অনুপযােগী হয়ে পড়ে। ফলে ব্যাটালিয়নকে পুনর্বিন্যাস করার জন্য এর অবশিষ্টাংশকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যেতে হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর মনােবল আকাশচুম্বী হয়। কুষ্টিয়া-যুদ্ধে সাফল্যের স্বীকৃতি গাংনী থানার যে-সব আনসার কুষ্টিয়া-যুদ্ধে বিশেষ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতা আব্দুর রহমান তাদের মধ্যে তিনজনকে বিশেষ পুরস্কারে সম্মানিত করার প্রস্তাব দেন। থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নূরুল হক এমপিএ এবং সাধারণ সম্পাদক হিসাবউদ্দিন এ-প্রস্তাবে সম্মতি জানান।  তিনজন সাহসী যােদ্ধার প্রত্যেককে ১০০ টাকা করে প্রদান করা হয়। এই তিন সাহসী প্রতিরােধযােদ্ধা হচ্ছেন : হারুন অর রশীদ, দোয়ত আলী ও হারেজউদ্দিন। তিনজনই পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং হারেজউদ্দিন শহীদ হন। কুষ্টিয়ার যুদ্ধে জয়লাভের পরে কুষ্টিয়া পুনর্দখলের পর প্রতিরােধ ব্যবস্থাকে পুনরায় ঢেলে সাজানাে হয়। মেহেরপুরের আনসার বাহিনীর একটি প্লাটুনকে চুয়াডাঙ্গায় পাঠানাে হয়। তারা মাথাভাঙ্গা নদীর উত্তরে দৌলতদিয়াড়ে অবস্থান নেন। আনসার বাহিনীর একটি দলকে বাড়াদি এলাকায় মােতায়েন করা হয়। গাংনী থানার আনসার প্লাটুনটি আবুল কাশেম কোরেশীর নেতৃত্বে খলিশাকুণ্ডির পশ্চিমে শুকুরকান্দি-আকবপুর মাঠের মধ্যে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের পাশে অবস্থান নেন। অবশিষ্ট আনসারদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আনসার ব্যারাকে। বন্দুকবাহিনীর প্রতিরােধ তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয় যুদ্ধঅভিজ্ঞ আনসারদের সক্রিয় উপস্থিতি। এ-সময়ে বেশকিছু বিহারিকে আটক করে জেলখানায় রাখা হয়। চুয়াডাঙ্গা থেকে বেশ কিছু ভারী অস্ত্র ও গােরাবারুদ মেহেরপুরে এনে প্রতিরােধ ব্যবস্থায় নতুন শক্তি সঞ্চয় করা হয়। ইপিআর বাহিনীর একটি প্লাটুন।
 
এসে মেহেরপুর থানা কাউন্সিলের ভিতরে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। ইপিআর জোয়ানদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১ এপ্রিল থেকে মেহেরপুর আনসার ব্যারাকে ছাত্র-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। মেহেরপুর মডেল স্কুল মাঠেও আনসার কমান্ডারদের নেতৃত্বে অনুরূপ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এসময় সীমান্ত এলাকার শূন্য ইপিআর ফাড়িগুলােতেও আনসার বাহিনীর একটি করে দলকে পাঠানাে হয়। প্রতিরােধ বলয়ের সম্প্রসারণ দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে কুষ্টিয়া শহরকে মুক্ত করার পর প্রতিরােধযােদ্ধাদের মনােযােগ কেবল কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের দিকেই থাকে না। যশাের সেনানিবাস থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরােধের জন্য কোটচাদপুর ও ঝিনাইদহের দক্ষিণে বিষয়খালীতেও ইপিআর ও আনসার মােতায়েন করা হয়। পদ্মা পার হয়ে পাকিস্তান সেনারা যাতে পাবনা থেকে কুষ্টিয়ার দিকে আসতে না পারে, সেজন্য কুষ্টিয়া, ভেড়ামারা ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে প্রতিরােধব্যবস্থা জোরদার করা হয়। ২৮ মার্চ গােয়ালন্দের এসডিও শাহ মােঃ ফরিদ প্রতিরােধ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে সামরিক সহযােগিতার প্রস্তাব পাঠালে ইপিআর-এর ক্ষুদ্র একটি দল গােয়ালন্দে পাঠানাে হয়। | ঢাকা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর রি-ইনফোর্সমেন্ট প্রতিরােধ করার জন্য নগরবাড়িতেও সৈন্য পাঠানাের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, বিষয়খালীসহ প্রতিরােধের প্রায় সব অবস্থানেই মেহেরপুরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিছু আনসার-মুজাহিদ অংশগ্রহণ করেন। ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের দূত নদীয়ার জেলা প্রশাসকের কাছে সহযােগিতার আবেদন জানিয়ে চিঠি লিখে এবং সেই চিঠির অনুলিপি ৭৬ বিএসএফ-এর কমান্ডিং অফিসারের কাছে পাঠানাের পরিপ্রেক্ষিতে উর্ধ্বতন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমােদনক্রমে পত্রলেখক মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীকে ২৯ মার্চ ভারতের বেতাই বিওপি’তে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানানাে হয়।  কুষ্টিয়ার প্রতিরােধযুদ্ধ নিয়ে সবাই তখন ব্যস্ত। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ২৮ মার্চ মেহেরপুর থেকে প্রতিরােধযােদ্ধা পাঠিয়েছেন। ২৯ মার্চ সকালে যুদ্ধের একটি প্ল্যান তৈরি করে আনসার কমান্ডার এস এম আল আমিন ও বাদশাকে দিয়ে কুষ্টিয়ায় পাঠানাের পর তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বেতাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
 
মেহেরপুর থেকে মাত্র মাইল চারেক উত্তর-পশ্চিমে ভারতীয় ছােট শহর বেতাই। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বেতাই বিওপি’তে পৌছলে তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানান নদীয়ার জেলা প্রশাসক মি. মুখার্জি ও ৭৬ বিএসএফ-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল চক্রবর্তী। এ-দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী জানান : স্থানীয় বিএসএফ-এর একটি ছােট্ট দল গার্ড অব অনার দেয়। আমি এবং কর্নেল চক্রবর্তী গার্ড অব অনার পরিদর্শন করি। নদীয়ার জেলা প্রশাসক আমাকে বাংলাদেশের দূত হিসেবে মর্যাদা দেন। বেতাই বিওপি’তে প্রায় এক ঘন্টা স্থায়ী এ বৈঠকে নদীয়ার জেলা প্রশাসক বাংলাদেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির খবর জানতে চান। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে মি. মুখার্জি ভারতীয় জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে সমর্থন জানান এবং সবরকম সহযােগিতার আশ্বাস দেন। তবে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসকের ২৬ মার্চের চিঠির উত্তরে ভারত সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমােদন পেলেই অবহিত করবেন বলে জানান। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী সামরিক সহযােগিতার প্রত্যাশার কথা পুনর্ব্যক্ত করে সে-দিনের মতাে মেহেরপুরে ফিরে আসেন।

কিন্তু ২৯ মার্চ বিকাল নাগাদ বিশেষ মাধ্যমে এল খবর তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী যেন একজন সামরিক অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে চেংখালী চেকপােস্টের অদূরে ভারতীয় বিওপি’তে গিয়ে দেখা করেন। প্রয়ােজনীয় সামরিক সহযােগিতার নানাদিক নিয়ে সেখানেই কথা হবে। তাজউদ্দিন আহমদের ভারত গমন। আওয়ামী লীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ঢাকা থেকে গােপনে রাজবাড়ি, ফরিদপুর, মাগুরা ও ঝিনাইদহ হয়ে ৩০ মার্চ দুপুরের দিকে চুয়াডাঙ্গায় আসেন। স্থানীয় মহকুমা প্রশাসকের খালি বাসভবনে তাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়। তাজউদ্দিন আহমেদ চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন। তিনি চুয়াডাঙ্গার প্রতিরােধ প্রস্তুতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং অস্থায়ী সরকার গঠিত হলে চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী করার পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন। বিকালে তাজউদ্দিন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী লিখেছেন : চুয়াডাঙ্গা থেকে সীমান্তের উদ্দেশ্যে দুটি জিপ গাড়িতে রওনা দিলাম। পথে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। আমরা ব্যারিকেড সরিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম। আমাদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীয়মান ছিল। রাস্তার দু’পাশে জনতা মুহুর্মুহু ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে আমাদেরকে সংবর্ধনা জানাচ্ছিলেন। এই দু’টি জিপ গাড়ি যেন আমাদের কাছে স্বাধীনতার শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছিল।

 

এরা অনেকেই আমাদের চিনতেন। গ্রামবাসীরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমরা বিশেষ কোনাে উদ্দেশ্যে সীমান্তে যাচ্ছি। পথে দেখতে পেলাম স্বতঃস্ফূর্ত জনতা প্রতিরােধ গড়ে তুলেছেন। অস্ত্র বলতে ছিল একটাদু’টি শটগান। তখনই এদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নিউক্লিয়াস এবং আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে, ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি, সামরিক প্রতিরােধ ও সংঘর্ষে এই ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অথচ দলবদ্ধ জনতাই প্রেরণা জোগাবে। সন্ধ্যার পরে আমরা জীবননগরের চ্যাংখালী সীমান্তে পৌছলাম। বড়বড় শিরীষ গাছের সারি দু’পাশ থেকে রাস্তার ওপর একটা লম্বা ছাতার মতাে আবরণ সৃষ্টি করেছিল। কোনাে লােকালয়-জনপদ দৃষ্টিগােচর হল। চারদিকে ধু-ধু খাঁ-খাঁ করছিল। অপসৃয়মাণ গােধূলির আলােয় সমস্ত এলাকায় একটা থমথমে অলৌকিক, অশরীরী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। শুক্লপক্ষের চাঁদের আলাে পরিবেশকে আরও গম্ভীর করে তুলেছিল। পিছনে গাড়ি রেখে আমি ও মাহবুব সতর্কতার সঙ্গে অপরিচিত গন্তব্যের দিকে এগুচ্ছিলাম। বারবার আমাদের গায়ের লােম শিউরে উঠেছিল। প্রায় আধ-মাইল চলার পর সামনে একটা পাকা ঘরের ধ্বংসস্থূপ দেখতে পেলাম। হঠাৎ সেই ভূতুড়ে ধ্বংসস্তুপ থেকে যেন এক অশরীরী আত্মার আওয়াজ শুনতে পেলাম—হলট। আমরা একটু ভড়কে গিয়েছিলাম। অনতিবিলম্বে ঝােপের আড়াল থেকে একজন মানুষ বের হয়ে এল; সে বিএসএফ-এর সৈনিক। আমাদের পরিচয় পাওয়ার পর আমাদের নিয়ে চলল তাদের বিওপিতে। আরও আধ-মাইল চলার পর আমরা বিওপিতে পৌছলাম। আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন বিএসএফ-এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গােলােক মজুমদার এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচআর চক্রবর্তী। দীর্ঘ আলােচনার পর দুটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হল—আমাদের সামরিক অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হবে এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের যােগাযােগ করিয়ে দেওয়া হবে। তখনাে তারা জানতেন না যে, আমাদের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম রয়েছেন। আমি ও মাহবুব নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলােচনা করে নিয়ে আমাদের সঙ্গে যে তাজউদ্দিন আহমেদ আছে, তা গােলােক মজুমদারকে জানাতেই তিনি আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে তাড়াতাড়ি দুজনকে নিয়ে আসতে বললেন। আমরা তাজউদ্দিন আহমেদকে তার কাছে নিয়ে গেলাম। তারা একে অপরকে আন্তরিকভাবে করমর্দন এবং আলিঙ্গন করলেন। রাতে আমরা একসঙ্গে খাবার খেলাম। তাজউদ্দিন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে গােলােক মজুমদার নিয়ে গেলেন আর আমরা চুয়াডাঙ্গায়

ফিরে এলাম। চুয়াডাঙ্গা সীমান্তপথে ভারতে যাওয়ার বিবরণ দিতে গিয়ে ব্যারিস্টার আমীরউল ইসলাম লিখেছেন :
 
তাজউদ্দিন ভাই ও আমি চুয়াডাঙ্গা থেকে সীমান্তের পথে রওনা হই। তৌফিক ও মাহবুব আমাদের সঙ্গে ছিল। আমরা পলায়নী মনােবৃত্তি নিয়ে সীমান্ত পার না হয়ে স্বাধীন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে যােগ্য মর্যাদা নিয়েই ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। স্বাধীন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করলেই কেবল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের আলােচনা সম্ভব। চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে ছােট্ট খালের ওপর একটি ব্রিটিশ যুগের তৈরি কালভার্ট। কালভার্টের ওপর তাজউদ্দিন ভাই ও আমি বসে আছি। কিছুক্ষণ পর অন্ধকারে মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। তাজউদ্দিন ভাইকে ডেকে নিয়ে একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। শব্দ ক্রমশ আমাদের দিকেই আসছে। আগন্তকরা আমাদের কাছে এসে হাতের অস্ত্র উঁচু করে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে বললেন, আমাদেরকে যথােপযুক্ত সম্মান দিয়ে নিয়ে যেতে এসেছেন।  ঐ রাতে তাজউদ্দিন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম কৃষ্ণনগরে পৌছান। সেখান থেকে কলকাতায় যান। তারপর একটি মালবাহী। বিমানে করে দু’জনকে দিল্লি, নিয়ে যাওয়া হয়। নিরাপত্তার স্বার্থেই এই সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছিল।
 
অস্ত্রের আশায় ভারত গমন
৩১ মার্চ চুয়াডাঙ্গা শহরের ছাত্রলীগকর্মী আজম আক্তার জোয়ারদার পিন্টু, হাসান জামান, আবুল কাশেম, আলাউল ইসলাম খােকন ও মেসবাহ-উল হক। মেনাল অস্ত্র সংগ্রহের আশায় বাইসাইকেল চালিয়ে কার্পাসডাঙ্গা হয়ে কৃষ্ণনগরে যান। সেখানে তরুণ সংঘের আতিথেয়তায় অস্ত্রের সন্ধান করেন।  স্থানীয় নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অগ্নিযুগের বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলােক্যনাথ-এর পৌত্র পাঁচদিন পর চারটি দেশী বন্দুক ও দুই ব্যাগ হাতবােমা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। নির্ধারিত দিনে অস্ত্রপ্রত্যাশী চুয়াডাঙ্গার ছাত্রলীগকর্মীরা আবার সীমান্তে গিয়ে অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু প্রতিশ্রুত অস্ত্রসাহায্য আর আসে নি। মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসকের সিল ও পাসপাের্ট ৩০ মার্চের আলাপ-আলােচনার ভিত্তিতেই পরদিন থেকে ভারতীয় সামরিক সরঞ্জামাদি এবং অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্য আসতে থাকে। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী জানাচ্ছেন : এই সাক্ষাৎকারের পর থেকে ভারত থেকে আমরা কমবেশি অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ এবং জ্বালানি পেতে থাকি। আমি নিজে প্রায় এক পক্ষকাল ধরে এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র চেংখালী চেকপােস্টের বিপরীত দিকে ভারতীয় বিওপি থেকে নিয়ে এসেছি। আমি প্রায়ই সন্ধ্যায় ভারত সীমান্ত অভিমুখে চুয়াডাঙ্গা থেকে যাত্রা করতাম। সাথে থাকত ইপিআর-এর। দুটি এসকর্ট পেট্রোল, কয়েকটা ট্রাক এবং কোনাে কোনাে সময় দর্শনা চিনিকলের ট্রাক ও তার সঙ্গে লাগানাে ঐলি। এই অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করার সময় আমি ভারতীয় কাগজপত্রে দস্তখত করে নিতাম এবং মেহেরপুরের এসডিও’র সরকারি সিলমােহর ব্যবহার করতাম। শুধু অস্ত্র গ্রহণের ক্ষেত্রেই নয়, মেহেরপুরের তৎকালীন এসডিও’র সিলমােহর এবং স্বাক্ষর সংবলিত সার্টিফিকেট কার্যত পাসপাের্টের মর্যাদা পেয়ে যায়।
 
ভারতের সঙ্গে বিশেষ সমঝােতামূলক এই পাসপাের্ট ব্যবস্থা এপ্রিলের মাঝামাঝি বলবৎ ছিল। জয়বাংলা এক্সচেঞ্জ একাত্তরের যুদ্ধদিনে ‘জয়বাংলা’ বিশেষ কোনাে দলীয় স্লোগান মাত্র ছিল না, তা ছিল সারা বাংলাদেশের সব বাঙালির মুক্তিমন্ত্র। এই মন্ত্র মুক্তিসেনার বুকে জাগিয়েছে অন্তহীন প্রেরণা, জ্বালিয়েছে সাহসের অনির্বাণ মশাল; অন্যদিকে এই মন্ত্রই শত্রুর বুকে সৃষ্টি করেছে সীমাহীন আতঙ্ক, শত্রুপক্ষের কাছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন অপেক্ষা অধিক ভয়ঙ্কর ছিল অবিস্মরণীয় এই শ্লোগানের হুঙ্কার। ২৮ মার্চ চুয়াডাঙ্গার টেলিফোন বিভাগের কয়েকজন দুঃসাহসী কর্মী দীর্ঘকালের অব্যবহৃত রেলওয়ে ট্রাঙ্ক লাইনটিকে মেরামত করে কলকাতার টেলিফোন লাইনের সঙ্গে যুক্ত করার ফলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে চুয়াডাঙ্গার টেলিযােগাযােগের দুয়ার খুলে যায়। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের প্রধান উপদেষ্টা ডা, আসহাব-উল হক পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখােপাধ্যায় এবং কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে রণাঙ্গনের খবর জানান। সে সময় চুয়াডাঙ্গাস্থ এই টেলিফোন এক্সচেঞ্জটির নাম হয়ে যায় জয়বাংলা এক্সচেঞ্জ। এই ‘জয়বাংলা এক্সচেঞ্জ’ মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত চালু রাখা সম্ভব হয়।
 
পত্রিকার নাম জয়বাংলা। চরম উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠায় ভরা সেই দিনগুলােতে মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় শ্লোগান ‘জয়বাংলা’ শিরােনামে মেহেরপুর থেকে দু’পৃষ্ঠার একটি খবরের কাগজের বেশ কয়েকটি সংখ্যা বের হয়। মহকুমা নির্বাচন অফিসের সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছেপে এটি প্রকাশ করেন আলী ওবায়দুর রহমান; মেহেরপুরের মানুষের কাছে যিনি মেরাজ মিয়া নামে অধিক পরিচিত। ক্ষীণায়ু অথচ জনপ্রিয় এ-পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন তিনি নিজেই। জয়বাংলা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১ এপ্রিল। মেরাজ মিয়া একাই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে টেনসিল কেটে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপার পর নিজেই আবার সারা শহরে বিলি করতেন। জয়বাংলা’ প্রকাশের ব্যাপারে তিনি জাতীয় পরিষদ সদস্য সহিউদ্দীন এবং মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর কাছ থেকে বিপুল সহযােগিতা ও অনুপ্রেরণা লাভ করেন।  ১ এপ্রিল প্রকাশিত প্রথম সংখ্যা ‘জয়বাংলায় প্রধানত কুষ্টিয়া-যুদ্ধের নানান খুঁটিনাটি বিবরণ তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে মেহেরপুরসহ তদানীন্তন কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রতিরােধ কর্মকাণ্ডের খবর গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়। একেবারে প্রথম সংখ্যা থেকেই ক্ষুদ্র কলেবরের এই পত্রিকাটি এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, সম্পাদক মেরাজ মিয়া এটাকে দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশের পরিকল্পনাও করেন। কিন্তু একা সবদিক সামলে উঠতে না পারায় ‘জয়বাংলা’ অনিয়মিতই থেকে যায়।

দুই-তিনদিন পরপর প্রকাশিত এ পত্রিকায় চুয়াডাঙ্গায় বিমান হামলা, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ, বিষয়খালীর যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশিত হয়। ১৫ ও ১৬ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় বিমান হামলা চালিয়ে নাপাম বােমা ছুঁড়লে ‘জয়বাংলা’য় ছাপার জন্য সে খবরও প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু ১৭ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার পতন ঘটলে মেহেরপুরেও পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের সম্ভাবনা নিশ্চিত হয়ে ওঠে। ফলে ‘জয়বাংলার সর্বশেষ সংখ্যার টেনসিল, কাগজপত্র সবকিছু নির্বাচন অফিসের টেবিলে ফেলে রেখেই সম্পাদক আলী ওবায়দুর রহমান মেহেরপুর ত্যাগ করেন। এভাবেই মাত্র এক পক্ষকালের মধ্যেই বিপুল সম্ভাবনাময় এই পত্রিকাটি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। তবে সুখের কথা, জিল্লুর রহমান এমএনএ (বর্তমান রাষ্ট্রপতি)-এর সম্পাদনায় ‘জয়বাংলা’ নামে অন্য একটি পত্রিকা প্রবাস থেকে যুদ্ধের ৯ মাস প্রকাশিত হয়। এবারের লক্ষ্য যশাের সেনানিবাস সাফল্যের সঙ্গে কুষ্টিয়া বিজয়ের ফলে এদিকে যেমন মুক্তিযযাদ্ধাদের মনােবল বেড়ে যায়, অন্যদিকে তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা জেগে ওঠে আকাশ সমান। এতদৃঞ্চলের মানুষ কুষ্টিয়া জয়ের আনন্দে অনেকে ভেবে বসে—এ বিজয় বুঝি সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে, পাকিস্তানি সেনাদের বুঝি-বা চূড়ান্ত পরাজয় হয়েছে।

 
এমতাবস্থায় দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সাময়িক বিজয়ের এ-আনন্দে গা ভাসালে চলবে না; পরিকল্পনা করা হয়—প্রথমে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যকে সংহত করতে হবে, তারপর প্রতিরক্ষা ব্যুহ সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে, সব মিলিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে—পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্গ যশাের সেনানিবাসে আঘাত হানতে হবে। এ-প্রসঙ্গে অধিনায়ক আবু ওসমান চৌধুরী বলেন : পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ী কুষ্টিয়ার সৈন্যদের তুলে নিয়ে ঝিনাইদহের দক্ষিণ-পশ্চিম ও পূর্ব-দক্ষিণের বিভিন্ন সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়ােগ করা হয়। যশাের সেনানিবাস থেকে শত্রুপক্ষ যাতে কোনােদিক দিয়ে পালিয়ে আমাদের পিছনে বা মধ্যে আসতে না পারে তার জন্য জোর পেট্রোলিং করা হচ্ছিল।
মূলত এই পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে কুষ্টিয়া-যুদ্ধের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী কুষ্টিয়া-যুদ্ধে অধিকৃত অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদ যানবাহনসহ সবকিছু ২ এপ্রিল রণাঙ্গন হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজের সৈন্যসামন্ত নিয়ে রওনা দেন যশাের অভিমুখে। যশাের থেকে সাত মাইল দূরে তিনি সদলবলে অবস্থান গ্রহণ করেন, অপেক্ষা করতে থাকেন ভারতীয় ভারী অস্ত্র পাওয়ার প্রত্যাশায়। কুষ্টিয়া-যুদ্ধের পর নতুন পরিকল্পনা সম্পর্কে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন : এ-সময় মুক্তিবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র দলকে কুষ্টিয়ায় রেখে আমরা নতুন সমর পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমরা যশাের থেকে মাত্র কয়েক মাইল উত্তরে বিশাখালীতে (বিষয়খালী) আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুলি। মাহবুব (ঝিনাইদহের এসডিপিও) এই এলাকার সামরিক নেতৃত্ব গ্রহণ করে। বিশাখালীতে আমাদের দুই কোম্পানিরও কম সৈন্য ছিল। উত্তরপূর্বে আমরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উভয়পার্শ্বে ঢাকা হতে আক্রমণ প্রতিহত করার প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করি। হার্ডিঞ্জ ব্রিজে আমাদের দুই প্লাটুনেরও কম ইপিআর জওয়ান ছিল। গােয়ালন্দ মহকুমা প্রশাসক শাহ মােহম্মদ ফরিদের অনুরােধে আমরা একটি ক্ষুদ্র ইপিআর বাহিনীকে গােয়ালন্দে শত্রু মােকাবিলার জন্য প্রেরণ করি। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল যশােরে পাকসেনাকে কোণঠাসা এবং ঢাকা হতে কোনাে রকম রি-ইনফোর্সমেন্ট বা আক্রমণ প্রতিরােধ করা।
 
দেশী-বিদেশী সাংবাদিকের পদচারণা
 
এভাবেই এপ্রিলের শুরুতে প্রতিরক্ষা বলয় সম্প্রসারণের দিকে অধিক মনােযােগ দেওয়া হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ মােকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ভারী অস্ত্র, গােলাবারুদ সংগ্রহে অধিক তৎপর হওয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এসময় দেশী-বিদেশী বহু সাংবাদিক চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরজুড়ে সামরিক প্রস্তুতির খবরা-খবর সংগ্রহের জন্য সরেজমিন পরিদর্শনে আসেন। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রবীণ সাংবাদিক গৌরকিশাের ঘােষ, পিটিআই-এর সাংবাদিক কালীপ্রসাদ বসু, গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক মার্টিন উলাকট, যুগান্তর পত্রিকার সাংবাদিক মণি চক্রবর্তী, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর সাংবাদিক পিটার আর কান, বিবিসির সাংবাদিক মার্ক টালি প্রমুখ খ্যাতিমান সাংবাদিক ছুটে আসেন মেহেরপুরচুয়াডাঙ্গার সীমান্ত অঞ্চলে, দেশত্যাগী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন, চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে কুষ্টিয়ার রণাঙ্গন থেকে প্রাপ্ত অস্ত্র, গােলাবারুদ, যানবাহন  এবং জীবিত বন্দী লে. আতাউল্লাহ শাহ-এর ছবি তােলেন, রিপাের্ট লেখেন। ২৫ মার্চ ঢাকা থেকে সব বিদেশী সাংবাদিককে বের করে দিয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা, সাংবাদিকদের কৌতূহল তখন থেকেই। তাই মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গাকে তখনাে পর্যন্ত ‘মুক্তাঞ্চল ধরে নেওয়া হয়। তাই সাংবাদিকরা দলে-দলে এই এলাকায় আসেন অবরুদ্ধ বাংলাদেশের খবর নিতে। এপ্রিলের ৩ তারিখে ফরাসি টেলিভিশন করপােরেশনের একটি ভ্রাম্যমাণ দল চুয়াডাঙ্গায় এসে ক্যামেরাবন্দী করে নিয়ে যায় অনেক সংবাদদৃশ্য। চুয়াডাঙ্গায় বিমান হামলা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি ছােট্ট শহর চুয়াডাঙ্গা। একাত্তরের যুদ্ধদিনে এই শান্ত শহরটি অগ্নিমূর্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এখান থেকেই সফলভাবে পরিচালিত হয় কুষ্টিয়া-যুদ্ধ, এখান থেকেই আক্রমণাত্মক দৃষ্টি রাখা হয় যশাের সেনানিবাসের ওপরে। তাই পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষও বিশেষ দৃষ্টি দেয় চুয়াডাঙ্গার প্রতি। স্থলপথে বিশেষ সুবিধা করতে না-পারলেও তারা আকাশপথে হামলা চালায় চুয়াডাঙ্গায়। এ-ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ড. সুকুমার বিশ্বাস লিখেছেন :
 

৩ এপ্রিল শনিবার দুটি বােমারু বিমান উড়ে এসে যথেচ্ছভাবে বােমা ফেলে আবার নিরাপদে ফিরে গেল। আমাদের ইপিআর বাহিনীর ঘাঁটিগুলাের ওপর বােমা ফেলেছিল। তাতে করে আমাদের বাহিনীর কিছু জিনিসপত্র পুড়ে গেল আর নূরনগরে কিছু বাড়িঘরসহ গবাদিপশু ধ্বংস হল।” এই বােমাবর্ষণ এবং বিমান হামলা সম্পর্কে পরদিন Hindustan Standard পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয় এভাবে : Chuadanga (Bangladesh), April 3 Pakistan jet dropped there Napam Bombs at noon today on Chuadanga in Kushtia district. A civilian has been injured by splinters. No casualty has been reported. On Friday a Pakistan Airforce plane appeared over liberated Kushtia on a reecaissance flight and presumbly to air the retreating army. There was however no bombing but air raid signal was sounded and the Muktifouj was on the alert.“

এ-দিন ফরাসি টেলিভিশন করপােরেশন চুয়াডাঙ্গা থেকে বিদায়ের মুহূর্তে এই বােমা হামলার ঘটনা ঘটতে দেখে এ-দৃশ্যও তারা ক্যামেরায় ধারণ করে। নিয়ে যান। এটাই ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হামলার প্রথম টেলিচিত্র, যা পরে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয় এবং ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টি করে। যশােরের চৌগাছায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ। যশাের সেনানিবাস থেকে চৌগাছার দূরত্ব মাইল পাঁচেকের মতাে হবে। লে, হাফিজউদ্দিন আহমদ ভেঙেপড়া বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পুনর্গঠিত করে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর কাছ থেকে অস্ত্র গােলাবারুদ নিয়ে চৌগাছায় গিয়ে গড়ে তােলেন প্রতিরক্ষা ব্যুহ। এত নিকট থেকে যশাের সেনানিবাস অবরােধ করার কারণ ছিল ৩টি; মুক্তিযােদ্ধাদেরকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দূরপাল্লার কামানের আওতার বাইরে রাখা, মুক্তিযােদ্ধাদের ভারী অস্ত্র না-থাকায় ভারী অস্ত্রের জন্যে অপেক্ষা করা এবং যশাের সেনানিবাসের ওপরে চাপ সৃষ্টি করে রাখা। যশাের সেনানিবাস থেকে পালিয়ে বেঁচে যাওয়া ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার লেফটেন্যান্ট হাফিজউদ্দিন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে ৪ এপ্রিল। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দীন আহমদ চুয়াডাঙ্গায় আসেন। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী তাকে কুষ্টিয়া-যুদ্ধ থেকে পাওয়া অস্ত্র গােলাবারুদ দেন। এবং তাদের ভেঙেপড়া রেজিমেন্টকে পুনর্গঠনের পরামর্শ দেন। তিনি যশাের সেনানিবাসে রক্ষিত অস্ত্র-গােলাবারুদ সম্পর্কেও একটি ধারণা দেন মেজর ওসমানকে। মেজর ওসমান আশ্বস্ত করে জানান, আমরাও অচিরেই ভারত থেকে কিছু ভারী অস্ত্রের সহযােগিতা পেতে যাচ্ছি। 
 
ভারী অস্ত্রের জন্য অপেক্ষায় থেকে সময় নষ্ট হচ্ছে। যশাের সেনানিবাস আক্রমণের জন্য ১১ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করেও মুক্তিযােদ্ধারা কোন সহযােগিতা না-পাওয়ায় পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। সীমান্তে আবারও তাজউদ্দিন আহমেদ : অস্ত্রের আশ্বাস ৫ এপ্রিল জীবননগর সীমান্তে এসে বাংলাদেশের প্রবাসী নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি কুষ্টিয়াযুদ্ধে সাফল্যের জন্য আবু ওসমান চৌধুরীর প্রশংসা করেন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান এবং প্রতিরােধযুদ্ধের অন্যান্য পরিকল্পনার কথা জানতে চান। দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ডের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী যশাের সেনানিবাস দখলের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে এজন্য অত্যন্ত জরুরিভিত্তিতে ভারী অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়ােজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর মাধ্যমে প্রতিদিনই কিছু হাল্কা ও মাঝারি অস্ত্র এলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভারী অস্ত্রের আক্রমণ মােকাবিলার জন্য তা মােটেই যথেষ্ট নয়। তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে আগত ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আইজির পক্ষ থেকে ৭৬ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল এইচ আর চক্রবর্তী অস্ত্র প্রদানের আশ্বাস দেন। | এই আশ্বাস এবং নিয়মিত যােগাযােগের প্রেক্ষিতে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ধরেই নেন যে, শিগগিরই তিনি ভারত থেকে প্রত্যাশিত অস্ত্রসাহায্য পাবেন। এই অস্ত্র পেলে তার পক্ষে যশাের সেনানিবাস শত্রুমুক্ত করার ক্ষেত্রে তার বাহিনী বিশাল ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু প্রস্তাবিত এবং প্রত্যাশিত এই অস্ত্র তিনি কখনাে পান নি। সে-দিনের রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক অসুবিধার কারণে ভারতের পক্ষে সে-দিন এ-রকম অস্ত্র সাহায্য দেওয়া সম্ভব হয় নি।
 
বিষয়খালীর প্রথম যুদ্ধ। ৬ এপ্রিল সকালে যশাের সেনানিবাস থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিষয়খালীতে এসে প্রতিরােধযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। কিন্তু ইপিআর এবং আনসার বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত। প্রতিরােধযােদ্ধা বা মুক্তিযােদ্ধারা ছিল অত্যন্ত সতর্ক। ফলে এক ঘণ্টা স্থায়ী এযুদ্ধে পাকবাহিনীকে পর্যদুস্ত হয়ে ফিরে যেতে হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশ ক’জন সৈন্য নিহত হয়, মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে ৪ জন আহত হয়। ভারতের সঙ্গে রেল যােগাযােগ স্থাপন ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে রেল যােগাযোেগ পুনঃস্থাপিত হয়। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নয়, স্থানীয় রেলওয়ে কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং আন্তরিক প্রচেষ্টায় দর্শনা ও গেদের মধ্যকার বন্ধ হয়ে থাকা রেললাইনটি সংস্কারের মাধ্যমে পুনরায় চালু করা সম্ভব হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ ও রাষ্ট্রীয় নানা অসুবিধার কথা বিবেচনা করে ভারতীয় পক্ষ এটা চালু রাখতে পারে নি। পিটিআই-এর বরাত দিয়ে হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় এই ট্রেন চলাচল সম্পর্কে লেখা হয় : Decorated with Bangladesh and Indian Union Flags a train from Darshana in Bangladesh reached Gede Railway station in Nadia district of West Bengal at 7.73 p.m today, says PTI. This was the first train movement on the route after the Indo-Pak conflict in 1965. আকাশ ও জলপথে পাকিস্তান বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি যশাের সেনানিবাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একরকম অবরুদ্ধ হয়েই ছিল। স্থলপথে প্রতিরােধযােদ্ধা তথা মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধ ঠেলে অস্ত্র, রসদ সৈন্য এনে যশােরে পৌছনাে প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। অথচ শক্তি-সামর্থ্য না বাড়িয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে যশাের সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে কোনাে অভিযান পরিচালনাও সম্ভব নয়। এ-রকম সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ৬ এপ্রিলের পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্ষিপ্রগতিতে আকাশ ও জলপথে ব্যাপক হারে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র যশাের সেনানিবাসে আনতে শুরু করে। কিন্তু সে-সময় আকাশপথে কিংবা জলপথে পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা দেওয়ার মতাে শক্তি-সামর্থ্য, অস্ত্র-জলযান মুক্তিবাহিনীর কাছে ছিল না। ফলে বলতে গেলে এ-সময়ে তারা বিনা বাধায় শক্তিবৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম হয়। সামরিক বাহিনীতে কমিশন প্রদান। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর চুয়াডাঙ্গাস্থ ৪র্থ উইংয়ের বাঙালি সদস্যদের সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার-মুজাহিদদের যুক্ত করে দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ড গঠনের পর এই সেনাবল দিয়েই কুষ্টিয়া-যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন।
 

প্রতিরক্ষাবলয়ের বিস্তৃতি ঘটিয়ে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন, তবু একমান্ডের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী শুরু থেকেই সেনাঅফিসারের তীব্র সংকটে ভুগছেন। তার হাতে অফিসার বলতে একমাত্র ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী। অথচ যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অফিসার তার খুবই প্রয়ােজন। মাত্র দিন দশেকের যুদ্ধতৎপরতা চলাকালে তিনজন বেসামরিক কর্মকর্তার মধ্যে অশেষ দেশপ্রেম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কঠিন সংকল্প দেখতে পাওয়ার পর মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ৭ এপ্রিল এক সেক্টর অর্ডারের মাধ্যমে ঐ তিনজন অফিসারকে সরাসরি ক্যাপ্টেন র্যাংকে কমিশন প্রদান করেন। এ-দিন তিনি মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিকই-এলাহী চৌধুরী, ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দীন আহমেদ এবং ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক শফিকউল্লাহকে নিজ হাতে র্যাংক পরিয়ে দেন। সেক্টর অর্ডারে লেখে :

On behalf of Bangladesh high command I hereby award commission to the following persons directly in the rank of captain to meet operational requirments a. Mr. Towfique-E-Elahi Chowdhury b. Mr. Mahbub Uddin Ahmed c. Mr. Md Shafiqullah.” | সাহসী এই তিন কমিশনড অফিসারই মুক্তিযুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত এই সেক্টরে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। কুড়িয়ে পাওয়া সৈন্যগুলাে ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে বিভিন্ন সেনানিবাসে কর্মরত বাঙালি সৈনিকদের কেবল নিরস্ত্র করেই ক্ষান্ত হয় নি পাকিস্তান সেনাবাহিনী, অনেক জায়গায় হত্যাও করেছে গণহারে।
 
এমনই হত্যাকাণ্ডের মুখােমুখি হন গাংনী থানার নিশিপুর গ্রামের জাকের আলীর পুত্র শাহজাহান আলী, রংপুর ক্যান্টনমেন্টে। কেউ-কেউ বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চোখে ধুলাে দিয়ে পালিয়ে আসতেও সক্ষম হয়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ হায়েনার খাঁচা থেকে পালিয়ে আসা। এ-রকম কিছু সৈনিকের সন্ধান পাওয়া যায় গাংনী ও দৌলতপুর থানায় । প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নূরুল হক ব্যক্তিগতভাবে চিঠি লিখে তাদের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। হক সাহেবের এই চিঠি নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে এ-সব ঘরেফেরা সৈনিকের সঙ্গে যােগাযােগ করেন চর গােয়াল গ্রামের ছাত্রলীগকর্মী ইছারুদ্দীন এবং আব্দুল মােত্তালেব। সৈনিকদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন। হক সাহেবের আহ্বানে তারা নতুন করে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠেন। ইছারুদ্দীন এবং আব্দুল মােত্তালেব বিভিন্ন গ্রাম থেকে ১৮ জন সৈনিককে সংগঠিত করে ৯ এপ্রিল মেহেরপুর থানা কাউন্সিলে ইপিআরদের সঙ্গে যােগাযােগ ঘটিয়ে দেন এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন। সে-দিনের এই ১৮ সদস্যের সৈন্যদলে ছিলেন সেহালার হাবিলদার আব্দুল লতিফ, প্রাগপুরের হাবিলদার আজগর আলী, গােয়ালগ্রামের সেপাই আব্দুল করিম, সেপাই সানাউল্লাহ, ধর্মদহের সেপাই রফিউদ্দিন, ঝােরাঘাটের আব্দুল বারি, গােয়াল গ্রামের সদরউদ্দীন, এজাজুল হক এবং আরাে কয়েকজন। লেবুতলার যুদ্ধ ৭ এপ্রিল সংঘটিত লেবুতলার যুদ্ধ দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের তাে বটেই,বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অত্যন্ত গৌরবময় অধ্যায় রচনা করেছে। সামরিক বিবেচনায় লেবুতলা গ্রামের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। যশাের সদরের ৮ মাইল উত্তর-পূর্ব কোণে লেবুতলা গ্রামের ওপর দিয়েই গেছে। যশাের-মাগুরা সড়ক। মাগুরার মহকুমা প্রশাসকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ইপিআর বাহিনীর একটি গ্রুপ আগে থেকেই লেবুতলায় ছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে-কোনাে মুহূর্তে যশাের সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে যশােরমাগুরা সড়ক ধরেই অভিযান চালাতে পারে—এই আশঙ্কা থেকেই ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী সেই অভিযানকে প্রতিহত করার জন্য নায়েব সুবেদার এ বি এম জিয়াউল হককে ২৫ সদস্যের আরেকটি ইপিআর দলকে সঙ্গে নিয়ে। লেবুতলায় ডিফেন্স নিতে বলেন। ৭ এপ্রিল ঝিনাইদহ থেকে রওনা হয়ে জিয়াউল হক তার বাহিনীসহ লেবুতলা গ্রামে এসে ডিফেন্স নেন এবং পূর্ব থেকেই প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে থাকা সুবেদার আব্দুল মজিদ মােল্লার বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হন।
 
ঐদিনই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় দল যশাের সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে লেবুতলার পথে পূর্বদিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করে। তারা মুক্তিবাহিনীর মেশিনগানের রেঞ্জের আওতায় আসামাত্র একইসঙ্গে গর্জে ওঠে সবক’টি গান। পাকসেনারা মােটেই অনুমান করতে পারে নি যে, মুক্তিযােদ্ধারা ওঁৎ পেতে থাকতে পারে এতটা কাছেধারে। প্রাথমিক আক্রমণেই ২০/২৫ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। পরে কয়েক ঘণ্টার সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনী প্রচুর ক্ষতিস্বীকার করে যশাের সেনানিবাসে ফিরে যায়। সত্যিকারের কথায়, কুষ্টিয়া-যুদ্ধের সাফল্যের পর এটাই মুক্তিবাহিনীর পক্ষে আরেকটি বড় । বিজয়। যদিও এ-বিজয় মাত্র কয়েকদিনের বেশি ধরে রাখা সম্ভব হয় নি। পাবনা থেকে পশ্চাদপসরণ পাবনার বাঙালি জেলা প্রশাসক সাহসী যােদ্ধা এম নুরুল কাদের রীতিমতাে । যুদ্ধ করেই দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগ্রাসন থেকে পাবনাকে মুক্ত রাখে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত। এ-দিন তিনি অস্ত্র সংগ্রহের আশায় চুয়াডাঙ্গা আসেন, পরদিন আবার পাবনার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু পাবনা তখন পাকসেনাদের দখলে চলে যাওয়ায় সে-দিনই ফিরে আসেন চুয়াডাঙ্গায়। যুক্ত হন দক্ষিণপশ্চিম রণাঙ্গণের কার্যক্রমের সঙ্গে। | দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ডের নিয়ন্ত্রণে এবং নির্দেশে প্রতিরােধযােদ্ধারা তখনাে বিভিন্ন স্থানে শক্ত প্রতিরােধ ব্যুহ তৈরি করে রেখেছে। তবু সবার চোখেমুখে তখন প্রবল প্রত্যাশা-বাংলাদেশ সরকারের ঘােষণা হােক। সৈনিকরাও  চায়—পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্য নয়, তাদের পরিচয় হােক বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর সদস্য। ৯ এপ্রিল টেলিফোনে প্রবাসী নেতা তাজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আলােচনার সময় নূরুল কাদের তাই সরকার ঘােষণার দাবি জানান। মােহাম্মদ নূরুল কাদের তার লেখা ‘একাত্তর আমার’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন : ১০ এপ্রিল রাত একটা/দেড়টার দিকে খবর পেলাম, পাকিস্তানি সৈন্যরা ঝিনাইদহ থেকে এ-দিকে এগিয়ে আসছে। চুয়াডাঙ্গায় আমরা কয়েক হাজার যােদ্ধা। এখানে অনেকের পরিবার-পরিজনও আছে। ঐ মুহূর্তে আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল। মহিলা ও শিশুদের কথা চিন্তা করে আমাদের একটু ভিন্ন রকম পরিকল্পনা করতে হল। চুয়াডাঙ্গার প্রবেশপথে শত্রুবাহিনীকে প্রতিরােধ করতে হবে। কিছু যােদ্ধাকে অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্যসহ চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে নিতে হবে। সিদ্ধান্ত হল নিরাপদ এলাকায় থেকে শত্রুকে আক্রমণ করাই হবে যুক্তিসঙ্গত  সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলােতে যােদ্ধাদের মােতায়েন করা হল। একই সাথে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থানান্তর করা হল মেহেরপুরে সকাল দশটায় মেহেরপুর যাত্রা শুরু হল। শেষ দলটি মেহেরপুর পৌছল সন্ধ্যায়।
 

তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও আবু ওসমান চৌধুরী মেহেরপুরে যােদ্ধাদের সংগঠিত করতে লাগলেন। আসলে নিরাপত্তার স্বার্থেই মেহেরপুরে সরে আসা। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা প্রতিরােধযােদ্ধাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রক্ষা করা এবং অতি প্রয়ােজনীয় দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আরাে কিছুদিন সদর দপ্তরের কাজ চলে চুয়াডাঙ্গা থেকেই। সে-প্রসঙ্গে মােহাম্মদ নূরুল কাদের লিখেছেন :

আসলে চুয়াডাঙ্গা আর মেহেরপুর আসা-যাওয়া চলছিল প্রতিদিনই। রাত কাটাতাম মেহেরপুর, দিনে থাকতাম চুয়াডাঙ্গা। অনেকটা এই রকমই ছিল দৈনন্দিন কার্যক্রম। হেবা ডাক্তার, আবু ওসমান চৌধুরা, তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী সবাই আমরা একইভবে আসা-যাওয়া করেছি। এই অবস্থা অব্যাহত ছিল কার্যত ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত।” আরাে ক’জন সেনা অফিসারের যােগ লে, হাফিজউদ্দিনের নেতৃত্বে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় শ’ তিনেক সদস্য নিরস্ত্র করার দিনেই সশস্ত্র হয়ে যুদ্ধ করে যশাের সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে যােগ দেন এবং বিভিন্ন প্রতিরােধযুদ্ধে অংশ নেন।

১০ এপ্রিল ঢাকা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে আসা সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান (পরে সেনাপ্রধান) এবং ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দীন মেহেরপুরে আসেন। ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের ভাই মতিয়ার রহমান ছিলেন মেহেরপুরের সেকেন্ড অফিসার। তারা সবাই মেহেরপুর থেকেই মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। উল্লেখ করা যেতে পারে পাবনার পতনের পর ক্যাপ্টেন হুদা এবং পরে যশাের সেনানিবাস থেকে এসে ক্যাপ্টেন ওহাবও যুক্ত হন দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে। ভারতীয় সাহায্য-সহযােগিতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একেবারে গােড়া থেকেই আমরা নানাভাবে ভারতীয় সাহায্য-সহযােগিতা পেতে থাকি। শরণার্থী সমস্যাসহ নানাবিধ সংকটে ভারতীয় জনগণ আন্তরিকভাবেই সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এর বাইরে সামরিক সাহায্য এসেছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্তক্রমে।
 
মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর ভারতীয় সাহায্য চেয়ে লেখা চিঠি ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদের চালান আসতে থাকে। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী সাক্ষাঙ্কারে জানাচ্ছেন : আমি নিজে প্রায় এক পক্ষকাল ধরে এ-সব অস্ত্রশস্ত্র ভারতীয় থেকে নিয়ে আসতাম। এসব অস্ত্রশস্ত্র চেংৰালী চেকপােস্টের বিপরীতে ভারতীয় বিওপি থেকে নিয়ে আসতাম। আমি প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যায় ভারতসীমান্ত অভিমুখে চুয়াডাঙ্গা থেকে যাত্রা করতাম। সাথে থাকত ইপিআর-দু’টি এসকর্ট পেট্রোল, কয়েকটা ট্রাক এবং কোনাে-কোনাে সময় দর্শনা চিনিকলের ট্রাক্টর এবং তার সাথে লাগানাে ঐলি। এই অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করার সময় আমি ভারতীয় কাগজপত্রে দস্তখত করে নিতাম এবং মেহেরপুরের এসডিওর সরকারি সীলমােহর ব্যবহার করতাম। মধ্যরাতের দিকে আমরা ভারতীয় বিওপিতে পৌছতাম এবং চুয়াডাঙ্গায় ফেরত আসতে-আসতে অধিকাংশ সময়ই ভাের হয়ে যেত। এ-সময়ে এক নাগাড়ে আমি দশ দিনের মতাে বিছানায় গা লাগাতে পারি নি। অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার সময় অনেক সময় কর্নেল চক্রবর্তী থাকতেন, সব সময় ক্যাপ্টেন মহাপাত্র থাকতেন। এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ থেকে আমরা অস্ত্রশস্ত্র বেতাই বিওপি (যা মেহেরপুর মহকুমার সংলগ্ন ছিল।
 
তােমাদের সরকার কোথায়?
 
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলাে যতই সামনে এগােয়, যুদ্ধরত এবং মুক্তিকামী বাংলাদেশের জন্য সর্বজনগ্রহণযােগ্য একটি সরকারের প্রয়ােজনীয়তা ততই তীব্র হয়ে দেখা দেয়। দেশের ভেতরে-বাইরে-সীমান্তে যুদ্ধরত পরস্পরবিচ্ছিন্ন এবং সমন্বয়হীন মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপগুলাের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে একক কমান্ডের অধীনে (এবং অবশ্যই সেটা বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে) এনে সরকারের সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধানে যুদ্ধ চালিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে, বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে। আর সর্বোপরি বড় কথা—দেশ থাকলেই তার বৈধ সরকারও থাকতে হবে। সরকারই দেশ চালাবে, প্রয়ােজন হলে দেশের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে সাহায্য-সহযােগিতা চাইবে সরকার, দখলদার শত্রুসেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার দরকার হলে সেটাও করবে সেই সরকার। যুদ্ধরত সৈনিকরাও সরকারের প্রয়ােজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। সেই অনুভূতিরই বিবরণ পাওয়া যায় মােহাম্মদ নূরুল কাদেরের লেখা ‘একাত্তর আমার’ গ্রন্থে : সৈনিকদের সবারই বক্তব্য, আমরা একটা দেশের সৈনিক। কিন্তু দেশমাতৃকার প্রয়ােজনে এবং বিবেকের ডাকে বিদ্রোহ করেছি। এর পিছনে আমাদের যত বড় মানসিক শক্তি এবং যুক্তিই থাকুক না কেন আমাদের শক্তি কিন্তু তেমন নেই। আমরা পাকিস্তানিদের দ্বারা প্রায় অবরুদ্ধ। যে-কোনাে মুহূর্তে ওরা আমাদের ধরে ফেলতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি এমন কোনাে পরিস্থিতি আসে তা হলে আমরা আইনানুগ অধিকার থেকে বঞ্চিত হব। কারণ এখনাে প্রচলিত আইন অনুযায়ী আমরা পাকিস্তান বাহিনীর সদস্য। ওরা আমাদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে বিচার করতে পারে। আর এই বিচারের রায় হবে। জঘন্যতম মৃত্যু। এ-প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার গঠন অপরিহার্য। আমাদের কেউ যদি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় তাহলে অন্তত প্রতিপক্ষযােদ্ধা হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারবে এবং জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সুযােগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হবে।” বস্তুতপক্ষে এপ্রিলের প্রথমার্ধ পর্যন্ত মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, ভেড়ামারা, কুমারখালী, আলমডাঙ্গা, দর্শনা, কালিগঞ্জ, বারােবাজার—মােটকথা যশাের সেনানিবাস-এর বাইরে এ-সবই ছিল মুক্ত অঞ্চল।
 

প্রতিরােধযােদ্ধাদের (মুক্তিযােদ্ধা) প্রবল প্রতিরােধের মুখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আকাশপথে এবং নৌপথে শক্তি-সামর্থ্য বৃদ্ধি ঘটানাের পূর্বপর্যন্ত

যশাের সেনানিবাসে একরকম অবরুদ্ধই থাকে। এই দিনগুলােতে ভারতীয় সীমান্ত পেরিয়ে বহু দেশের বহু সাংবাদিক আসেন বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে সংবাদ সংগ্রহের আশায়। ডা, আসহাব-উল-হক, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী—রণাঙ্গন পরিচালনার পাশাপাশি প্রতিদিনই এদের সাংবাদিকদের মুখােমুখি হতে হয়। তৌফিক-ই-এলাহী। চৌধুরী জানাচ্ছেন : এই সময় শত শত ভারতীয় এবং বিদেশী সাংবাদিক, টেলিভিশন সংস্থা আমাদের সাক্ষাৎকার নেয় এবং এই মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করে। তাদের সবার একই প্রশ্ন ছিল তােমাদের সরকার কোথায়? বাংলাদেশ সরকার গঠন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাসহ স্বাধীনতা অর্জনের পথে যে-কোনাে সংকট মােকাবিলা করার জন্য গ্রহণযােগ্য ও গণপ্রতিনিধিত্বশীল একটি সরকার গঠন এবং সে-সরকারের আত্মপ্রকাশ যে কতটা জরুরি হয়ে উঠেছে, তা প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দিন আহমদও বিশেষভাবে উপলব্ধি করেন। কেবল যুদ্ধরত প্রতিরােধযােদ্ধাদের আহ্বান কিংবা আবেদন থেকেই তার এ উপলব্ধি নয়। ৩ এপ্রিল দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে তিনি সরকারের প্রয়ােজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে তিনি সে-দিনই জানিয়ে দেন—ইতােমধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছে এবং তিনি সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। পরে ১০ এপ্রিল আগরতলায় আওয়ামী লীগের বেশকিছু নির্বাচিত এমএনএ-কে নিয়ে ৫ সদস্যের অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়।
 
ঐদিনই কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থার অফিসে তাজউদ্দিন আহমদ এ সম্পর্কে একটি বার্তা প্রেরণ করেন। সেই বার্তায় জানানাে হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ৫ সদস্যের বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে। অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে অস্থায়ী সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এক ভাষণ দিয়ে সারা দেশের যুদ্ধ প্রতিরােধের বিস্তারিত বিবরণ দেন। কোথায় শপথগ্রহণের মুক্তাঞ্চল বহু প্রত্যাশিত এবং প্রতীক্ষিত বাঙলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে। এবার প্রশ্ন—বাংলাদেশের কোনাে মুক্তাঞ্চলে অর্থাৎ কোথায় এবং কখন হবে এই নবগঠিত সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ এবং বিধি মােতাবেক শপথগ্রহণ? কোথায় হবে এ-সরকারের অস্থায়ী রাজধানী?
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের অন্যতম সংগঠক এবং প্রথম বাংলাদেশ সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র পঞ্চদশ খণ্ডে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে বলেছেন মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা প্রথমে চিন্তা করি। কিন্তু পাক হানাদার বাহিনী সেখানে বিমান থেকে বােমাবর্ষণ করে। আমরা চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, শেষপর্যন্ত তা আর গােপন থাকে নি। এ-প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুনও জানাচ্ছেন : ১৪ এপ্রিল ঠিক হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু পাকিস্তানিদের কাছে সে খবর পৌছে গেল। চুয়াডাঙ্গায় সাংঘাতিকভাবে বােমাবর্ষণ করা হল। তারপর ঠিক হয় মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। কার্যত হয়েছেও তাই। চুয়াডাঙ্গায় গড়ে ওঠা দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তরটি পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আগ্রাসী হামলার মুখে মেহেরপুরে সরিয়ে নিতে হয়। সেই বৈরী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রথম সরকারের আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণের ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটি অবশেষে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় অনুষ্ঠিত হয় এবং অখ্যাত এই গ্রামটির নাম পরিবর্তন করে মুজিবনগর রাখা হয়।
 
বস্তুতপক্ষে সে-দিন এই মুজিবনগরকেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী বলে ঘােষণা করা হয়। বাংলাদেশ সরকারেরও নাম হয়ে যায় মুজিবনগর সরকার।’ একে-একে নিভিছে দেউটি দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গাতে যখন চলছে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি এবং যশাের সেনানিবাস আক্রমণের পরিকল্পনা প্রণয়ন, সেই সময়ে এ-রণাঙ্গনের গােটা প্রতিরােধ ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রহণ করে ত্রিমুখী আক্রমণের প্রস্তুতি। আকাশপথে সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্রের বিপুল সমাবেশ ঘটিয়েছে যশােরে । ১২ এপ্রিল খবর পাওয়া যায় পাকিস্তানি। সেনাবাহিনীর একটা বিরাট অংশ আরিচা থেকে জলপথে গােয়ালন্দের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান তখনই নায়েব সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে এক প্লাটুন সৈন্য এবং তাদের সঙ্গে রাইফেল, ২টি এলএমপি, ১টি এমজি ও ১টি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ছােট কামানসহ গােয়ালন্দে পাঠালেন। মেজর ওসমান নির্দেশ দেন—কোনাে অবস্থাতেই যেন পাকবাহিনী গােয়ালন্দে অবতরণ করতে না পারে। সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে প্রতিরােধযােদ্ধারা প্রাথমিক সাফল্য লাভ করলেও পরে ছত্রীসেনার আক্রমণের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। নগরবাড়িতেও সেই একই অবস্থা। পাকবাহিনীর আরেকটি দল নগরবাড়ি ঘাটে অবতরণ করার চেষ্টা করে। এ দলটির মূল লক্ষ্য ছিল পাবনা, ঈশ্বরদী, ভেড়ামারা হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা দখল করা। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর অনুরােধে রাজশাহী থেকে মেজর নজমুল হক (শহীদ) এক প্লাটুন সৈন্য পাঠিয়ে দেন নগরবাড়িতে প্রতিরােধ করার জন্য। তারা পৌছনাের পূর্বেই পাকসৈন্যরা নগরবাড়ি ঘাটে নেমে পড়ে। অবশ্য আগে থেকেই নগরবাড়ি এলাকায় ক্যাপ্টেন খােন্দকার নজমুল হকের নেতৃত্বে এক কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা প্রতিরােধ গড়ে তােলার চেষ্টা করে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী। অস্ত্রের আক্রমণের মুখে তারা টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়। মুক্তিযােদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে নানাদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৪ এপ্রিল নগরবাড়ি দখলের পর পাকবাহিনী চলে যায় পাবনার দিকে, পাবনা থেকে পরদিন ঈশ্বরদী হয়ে চলে আসে ভেড়ামারা।
 
ভেড়ামারায় অবস্থানরত প্রতিরােধযােদ্ধারা সুবেদার মুজাফফরের নেতৃত্বে প্রথমে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে, পরে পিছিয়ে এসে ভেড়ামারায় প্রতিরােধ গড়ে তােলার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়। ভেঙে পড়ে সমস্ত প্রতিরােধ। যােদ্ধারা ছড়িয়ে পড়ে নানাদিকে। ১৬ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুনরায় প্রায় বিনাবাধায় কুষ্টিয়া পর্যন্ত দখল করে নেয়।  এ-দিকে ১৪ এপ্রিল যশাের সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি পদাতিকবাহিনী এবং বিমানবাহিনী ব্যাপকভাবে আক্রমণ চালায় বিষয়খালীর প্রতিরােধযােদ্ধাদের ওপরে। এই প্রতিরােধযােদ্ধাদের কাছে দু’মুখী আক্রমণ মােকাবিলা করার মতাে ভারী অস্ত্রশস্ত্র না-থাকায় পিছু হটতে বাধ্য হয়। তারপরও এ-যুদ্ধে বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি, এমনকি প্রাণহানিও মেনে নিতে হয়। এ-রকম সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী তার বাহিনীকে সরিয়ে কোর্টচাদপুর, ঝিনাইদহ, শৈলকূপা এবং পােড়াদহ লাইনে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করতে বলেন।  কিন্তু তারপরও ১৫ এপ্রিল বিকালেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। ঝিনাইদহের পতন ঘটে। এ-সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষিপ্র আক্রমণের মুখে সার্বিক পরিস্থিতির এত দ্রুতই অবনতি ঘটতে থাকে যে, পিছু হটে আসা প্রতিরােধযােদ্ধারা পরস্পরবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় ধরে রাখাও কঠিন হয়ে পড়ে। গােয়ালন্দ ঘাটে অবস্থানরত শামসুল হকের প্লাটুন এবং ভেড়ামারায় অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে মূল বাহিনীর যােগাযোেগই হারিয়ে যায়। অবশ্য অনেক পরে অনেক প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে এই যােদ্ধারাও মূল বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হতে সক্ষম হয়।  ভেড়ামারা-কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহের পতন ঘটার পর দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে সম্পূর্ণরূপে মেহেরপুরে স্থানান্তর করা হয়। বলা যায় এ আয়ােজন শুরু হয় এপ্রিলের ১১ তারিখ থেকেই, সম্পূর্ণ হয় ১৫ তারিখে। মেহেরপুরের নির্মাণাধীন কোর্ট বিল্ডিংয়ে এই সদর দপ্তরের কার্যক্রম চলে মাত্র ১ দিনের জন্য। চুয়াডাঙ্গায় আবারও বিমান হামলা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাছে চুয়াডাঙ্গার গুরুত্ব ছিল বিশেষ রকমের। চুয়াডাঙ্গা থেকেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বিস্তীর্ণ জনপদে শত্রু প্রতিরােধ গড়ে তােলা হয়। চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী করে বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করার প্রস্তাব হয়; কাজেই পাকিস্তানি বাহিনীরও বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে চুয়াডাঙ্গা। তাই ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা দখলের অভিযানে নামার আগে ঐ দিন সকালে তারা চুয়াডাঙ্গার আকাশে এসে বিমান হামলা চালায়। এ-প্রসঙ্গে কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় লেখা হয়। কৃষ্ণনগর ১৬ এপ্রিল (ইএনআই) পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর গােলাবর্ষণে আজ চুয়াডাঙ্গায় প্রায় ৫০ জন বেসামরিক ব্যক্তি মারা গিয়েছে।
 
আহতদের সংখ্যা এক শ’। আজ সকালে চুয়াডাঙ্গ এবং তৎসংলগ্ন প্রায় কুড়িটি গ্রামের ওপর পাক-বিমানবাহিনী গােলাবর্ষণ করে। পাক বিমানবাহিনী স্যার জেট থেকে কুড়িটি নাপাম বােমা নিক্ষেপ করে। প্রকৃতপক্ষে এ-সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে এলাকায় প্রবেশ করে সেই এলাকাতেই ব্যাপক গণহত্যা চালায়; অগ্নিসংযােগ করে, নারী ধর্ষণ করে। বেসামরিক জনসাধারণকে হত্যা করতে-করতে তারা ক্রমশ ঝিনাইদহ চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ফলে প্রাণভয়ে ভীত নিরীহ সাধারণ মানুষ অতি দ্রুত চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে শহর ছেড়ে সরে পড়ে, এমনকি সীমান্ত পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ১৬ এপ্রিল বিমান হামলা চালিয়ে চুয়াডাঙ্গা শহর ভীতসন্ত্রস্ত নিস্তব্ধ করে ফেলার পর ঝিনাইদহ থেকে পাকবাহিনী সড়কপথে চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পথিমধ্যে সরােজগঞ্জ বাজারে এলােপাতাড়ি গুলি চালিয়ে মসজিদে জুম্মার নামাজরত অবস্থায় বহুসংখ্যক মুসল্লি ও জনগণকে হতাহত করে। সরােজগঞ্জ হাটের নিরীহ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েও ৭০/৮০ জনকে হত্যা করে। সরােজগঞ্জের পর ডিজেদা বাজারেও হত্যা-অগ্নিসংযােগধর্ষণ চালায়। তারপর সন্ধ্যানাগাদ একেবারে বিনাবাধায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রাণের স্পন্দনহীন চুয়াডাঙ্গা শহর দখল করে নেয়।  এভাবেই দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের বহুদূর বিস্তৃত প্রতিরক্ষা ফ্রন্ট সংকুচিত করে আনতে হয়, এমনকি এ-রণাঙ্গনের শৌর্যময় সদর দপ্তরও চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে আনতে হয় মেহেরপুরে। অবশেষে ১৬ এপ্রিল রাতে মেহেরপুর শহর থেকেও এই সদর দপ্তরকে স্থানান্তর করতে হয় একেবারে সীমান্তসংলগ্ন ইছাখালীর ইপিআর ক্যাম্পে। বাংলাদেশের সবচেয়ে সাহসী সন্তান বীর মুক্তিযােদ্ধাদের এই যে পশ্চাদপসরণ, তা যতই বেদনাবহ হােক মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক এবং এই রণাঙ্গনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব তৌফিক-ইএলাহী চৌধুরী তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লিখেছেন :
 
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শেষদিকে যুদ্ধ একটি নতুন মােড় নেয়। এই সময় শত্রুসৈন্য সেনানিবাসে নতুনভাবে সমরপ্রস্তুতি নিতে শুরু করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোনােদিন কল্পনাও করে নি যে, বাঙালিরা তাদের সুশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দিতে পারে। কুষ্টিয়ার পরাজয়ের গ্লানি তাদের মনােবল ভেঙে দিয়েছিল। তাই ঢাকা থেকে প্রচুর রি-ইনফোর্সমেন্ট যশােরে আনা হয়। আমরা একসময় ভেবেছিলাম যে, জনতার সমুদ্র নিয়ে যশাের সেনানিবাসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। যশাের সেনানিবাস তখন আমাদের কাছে বাস্তিলের কারাগারের মতাে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটির প্রতীক মনে হচ্ছিল। কিন্তু লাখাে জনতা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার একটা ঝুঁকি ছিল। হয়তাে যশোের আমরা ঠিকই দখল করতে পারব, কিন্তু তা হবে হাজার হাজার লােকের প্রাণের বিনিময়ে। এত বড় ঝুঁকি নিতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। আমরা উপলব্ধি করি যে, শত্রুর দূরপাল্লার ভারী কামানের জবাব দেওয়ার মতাে অস্ত্র আমাদের নেই। অন্যদিকে শত্ৰুকামানের আক্রমণ দ্বারা আমাদেরকে পিনডাউন করে রেখে সেই আর্টিলারি কভারের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। প্রত্যেক আক্রমণে তারা প্রচুর সৈন্য ব্যবহার করছিল। প্রত্যেক আক্রমণের সঙ্গে আমাদের মনােবল ভেঙে যাচ্ছিল এবং আমরা কোনাে সামরিক সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলাের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করাও সম্ভব হচ্ছিল না। কোন রণাঙ্গনে অগ্রবর্তী অথবা পশ্চাদবর্তী অবস্থানগুলাের সঙ্গে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তা মনােবলের ওপর যে-বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা যারা যুদ্ধে অভিজ্ঞ তারাই বলতে পারে। এই রকম একটি অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে আমি নিজেও অসহায় অবস্থায় পশ্চাদৃপসরণ করতে বাধ্য হই। তদুপরি এ-সময় বর্ষার আগমন শুরু হয়ে যায়। আমাদের অবস্থানগুলােতে খাদ্যদ্রব্য এবং গােলাবারুদের অভাব দেখা দেয়। বিচ্ছিন্ন অবস্থানগুলােতেও এই বিরূপ পরিস্থিতিতে সৈন্যদের মনােবল ভেঙে যেতে শুরু করে। আমাদের পশ্চাদৃপসরণ অব্যাহত থাকে। এছাড়া আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসারও কোনাে সুব্যবস্থা ছিল না। ওষুধের অভাবে অনেকেই মারা যান। এটা সহজেই অনুধাবনযোেগ্য যে, গােয়ালন্দের মতাে জায়গায় ক্ষুদ্র একটি প্রতিরক্ষাব্যুহ কী রকম আত্মঘাতী ছিল! একইভাবে নগরবাড়ি ঘাট ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ শক্রর আয়ত্তে চলে যায়। আমাদের প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী জেনারেল মিঠা খান নিজে পাবনা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অ্যাক্সিস-এর অপারেশন চালান।
চতুর্দিকে শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে আমাদের সংগঠনও দুর্বল হয়ে পড়ছিল। প্রত্যেকটি ঘাঁটি থেকে পশ্চাদৃপসরণে বাধ্য হয়ে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। আস্তে আস্তে ঝিনাইদহ আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। শত্রুসৈন্য পুনরায় কুষ্টিয়া দখল করে চুয়াডাঙ্গার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আমরা শত্রুর এই আক্রমণের মুখে পুনর্গঠন এবং পুনর্বিন্যাসের সময় এবং সুযােগ পাচ্ছিলাম না। চতুর্দিকে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সাধারণ জনগণের মনােবলও ভেঙে পড়তে থাকে। চুয়াডাঙ্গা যখন শত্রুর আক্রমণের আওতায় চলে আসে, তখন আমরা চুয়াডাঙ্গা থেকে সদর দপ্তর সরিয়ে নিতে বাধ্য হই। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রথমে সরিয়ে আনা হয় মেহেরপুরে ১৬ এপ্রিল রাতে আবার স্থানান্তর করা হয় মেহেরপুরের সীমান্ত চৌকি ইছাখালি ক্যাম্পে। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পর মেজর ওসমান সদর দপ্তর নিয়ে যান বেনাপােল, ১৮ এপ্রিল। সেখানেই শুরু হয় নতুন প্রস্তুতি, সম্মুখ লড়াই। এভাবেই নিভে যায় দেউটির আলাে। আমাদের চেনাজানা চরাচরব্যাপী নেমে আসে অদ্ভুত আঁধার। এ-আঁধার যেন-বা ঢেকে দিতে চায় শৌর্যবীর্যময় আমাদের সমূহ অর্জন। স্তব্ধ করে দিতে চায় বিদ্রোহের অগ্নিমন্ত্রে জেগে ওঠা সাত কোটি প্রাণের স্পন্দন। কিন্তু বাঙালি কি তাই মানতে পারে? আঁধারের পর্দা ছিড়ে আলাের কুসুম কি তারা ফোটাবে? ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় সেই আলাের কুসুম ফোটানােরই অনবদ্য আয়ােজন হয়। ১৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয় বটে, তবু মাত্র ১৮ মাইল উত্তর-পশ্চিমের শহর মেহেরপুরে তারা হানা দেয় আরাে একদিন পরে, অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল সকালে। সেই একই দৃশ্য-গণহত্যা, অগ্নিসংযােগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ। মেহেরপুরও চলে যায় দখলদার পাকসেনাদের হাতে। এভাবেই স্বাধীনতা-নাটকের গৌরবময় প্রতিরােধ দৃশ্যের যবনিকাপাত ঘটে। এরপর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরের মুক্তমঞ্চে ঘটে এনাটকের আলােকোজ্জ্বল দৃশ্যের উদ্বোধন। ১১টি সেক্টর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আলাের দূতেরা, যেন-বা রবিঠাকুরের মতাে গেয়ে ওঠেন—সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে…।
নয় প্রতিরােধ, প্রতি ভবিষ্যতের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অব্যাহত অগ্রযাত্রার মুখে নানাবিধ প্রতিকূলতার কারণে প্রতিরােধব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুরে সরিয়ে নেওয়ার আগেই ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে মেজর ওসমানের নির্দেশে ১৫ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা ন্যাশনাল ব্যাংকে রক্ষিত বিভিন্ন ব্যাংকের কয়েক কোটি টাকা এবং সােনা ক্যাপ্টেন তৌফিক, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ডা, আসহাব-উল হক এমপিএ এবং অন্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে মেহেরপুর ট্রেজারিতে নিয়ে যাওয়া হয়। চুয়াডাঙ্গার শক্তিশালী অয়্যারলেস কেন্দ্রটিও এ-সময় মেহেরপুরের জনৈক মকসেদ পেশকারের বাড়িতে স্থাপন করা হয়। ১৬ এপ্রিল মেহেরপুর ট্রেজারি থেকে মােট সাড়ে চার কোটি টাকা এবং আধ মণ সােনা একটি তিন টনের ট্রাকে উঠিয়ে বিশেষ প্রহরায় ইছাখালী বিওপিতে এবং ১৭ এপ্রিলের পর ভারতে নিয়ে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়া হয়। ১৫ এপ্রিল মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তার অবাঙালি ড্রাইভার পিয়ারু খানকে (আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক ও পরে মুক্তিযােদ্ধা) একটি বিশেষ পরিচয়পত্র দিয়ে ইছাখালী বিওপিতে পাঠিয়ে দেয়। একটি টয়ােটা গাড়ি নিয়ে তাকে সেখানে জরুরি আহ্বানের জন্য সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। পিয়ারু খানের পরিচয়পত্রে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী লেখেন : আমার ড্রাইভার পিয়ারুকে আমার অনুমতি ছাড়া কোন অনিষ্ট করিবেন। কাহারাে কোন আপত্তি থাকিলে প্রথমে আমাকে জানাইবেন। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রয়ােজনের কথা বিবেচনা করে ১৫ ও ১৬ এপ্রিল মেহেরপুর খাদ্য গুদামে রক্ষিত গম, চাল, ময়দা, চিনি, লবণ প্রভৃতি নিত্য প্রয়ােজনীয় খাদ্যদ্রব্য কয়েকটি গাড়িতে করে ইছাখালী বিওপি হয়ে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং জনসাধারণের জন্য খাদ্য গুদাম উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এ-সময়ে চুয়াডাঙ্গায় বােমাবর্ষণ এবং পাকবাহিনীর প্রবেশের সংবাদ মেহেরপুর শহরের ভীতসন্ত্রস্ত বেসামরিক জনসাধারণের প্রধান অংশই অদ্রুিত শহর ছেড়ে নিরাপত্তার সন্ধানে নিভৃত পাড়াগাঁয়ে অথবা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যায়। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের প্রায় সবাই এ-সময় মেহেরপুর এবং গাংনী শহর ছেড়ে চলে যান। খলিশাকুণ্ডি ব্রিজের পশ্চিমে আবুল কাশেম কোরাইশীর নেতৃত্বে যে আনসার দল কুষ্টিয়া-যুদ্ধের পর থেকে অবস্থান করছিল ১৫ এপ্রিলের পর তারও মালশাদহ পর্যন্ত পিছিয়ে আসে। এদিন বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন নূরুল ইসলাম বিষয়খালী থেকে পিছু হটে এসে গাংনী ডাকবাংলোের কাছে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের লক্ষ্যে সরেজমিন ঘুরে-ঘুরে স্থান নির্ধারণ করেন।
কিন্তু মেজর ওসমান চৌধুরীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৬ এপ্রিল তিনি মেহেরপুরে চলে যান। এ-দিন রাতেই সবাই আশ্রয় নেন ইছাখালী বিওপিতে। এ-সময়ে মেহেরপুর শহরের সামান্য কিছু লােকজন উন্মুক্ত ট্রেজারি থেকে আধুলি-সিকির খুচরাে কয়েন এবং গুদাম থেকে উদ্ধৃত্ত খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করতে তৎপর হয়। ১৭ এপ্রিল এমপিএ নূরুল হক গাংনী ছেড়ে চলে যান ভারতে। সহিউদ্দীন, ইসমাঈল হােসেন, মুন্সী শাখাওয়াৎ শাহাবাজউদ্দিন নিজু, আব্দুল মান্নান প্রমুখ নেতা ইতােমধ্যেই মেহেরপুর ছেড়েছেন। ১৮ এপ্রিল সকালে মেহেরপুর শহরে প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিক্ষিপ্ত কামানের গােলার শব্দ এসে জনশূন্য শহরটিকে মুহুর্মুহ কাঁপিয়ে তােলে। প্রায় প্রতিরােধহীন অবস্থায় আম ঝুপিতে ২৫ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে মেহেরপুরে প্রবেশ করে পাকবাহিনী। সেই সঙ্গে অবসান হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত মেহেরপুরের বেসামরিক প্রশাসনের এবং প্রতিরােধ আন্দোলনের। পাকিস্তানি সামরিকবাহিনী কর্তৃক ঢাকা থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর নিউইয়র্ক টাইমস-এর বৈদেশিক সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গ ভারতীয় সীমান্ত শহর বেতাই থেকে তার পত্রিকায় এক প্রতিবেদন প্রেরণ করেন। নিউইয়র্ক টাইমসের উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় : পাকিস্তানি বাহিনী তাদের বিগত দুই সপ্তাহব্যাপী অভিযানে পশ্চিমী জেলাগুলাের সব শহর-বন্দর কার্যত দখল করে নিয়েছে। অধিকতর ভারী অস্ত্রসজ্জিত আরাে বিশাল বাহিনীর মুখখামুখি হয়ে বাঙালি সৈন্যরা পিছু হটেছে, অনেকক্ষেত্রে কোনাে লড়াই না করেই। তবে তারা তাদের অন্ত্র বিসর্জন দেন নি। বেশিরভাগ যােদ্ধাই পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের গ্রাম এলাকায় মিলিয়ে গেছেন। তিনদিন আগে উল্লেখযােগ্য বাঙালি প্রতিরােধ ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তানি শহর মেহেরপুর । সেখান থেকে প্রায় ছয় মাইলের মধ্যে অবস্থিত এই ভারতীয় সীমান্ত শহরে এখন অনেক বাঙালি সৈনিক ও অফিসার জমায়েত হয়েছেন আবার নিজেদের গুছিয়ে তুলতে। আব্দুল আজিজ, মেহেরপুরের ৪২ বছর বয়স্ক চাল ও পাট ব্যবসায়ী। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের একজন। কর্মী। ব্যবসায়ী জ্বলােক জানালেন, গত কাল রাতে তিনি যখন মেহেরপুর ছাড়েন তখনও চারপাশে লাশ ছড়িয়ে ছিল। তিনি বলেন, সৈন্যরা খুঁজছে ছাত্র, অধ্যাপক, আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য ও আওয়ামী লীগকর্মীদের। তাদের হাত-পা পিছমােড়া করে বেঁধে পিছন দিক থেকে গুলি করা হয়। ব্যবসায়ী ভদ্রলােক জানালেন, সৈন্যরা দোকানপাট লুট করে, খাদ্য মজুদ ধ্বংস করে।

আমি ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছি। যতদিন পর্যন্ত না অস্ত্র প্রশিক্ষণ পাই এবং ফিরে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়তে পারব ততদিন পর্যন্ত আমি এখানে থাকব। আধা-সামরিক বাহিনীর এক অফিসার জানালেন, মেহেরপুরে প্রতিরােধ দাঁড় করানাের কথা আমরা ভাবতেই পারি না। ওদের রয়েছে মটার ও কামান। একমাত্র যা করার ছিল তা। হল গ্রামাঞ্চলে চলে গিয়ে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ। তাদের সঙ্গে মুখােমুখি লড়ার মতাে ভারী কামান আমাদের ছিল না। ১৮ এপ্রিল মেহেরপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রবেশের পর এতদিনের সব প্রতিরােধ প্রস্তুতি ভেঙে পড়লে এ-জেলার ছাত্র-যুবক প্রতিরােধকর্মীরা অস্ত্র

প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গেরিলাযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। শুরু হয় গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব।

সূত্রঃ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর – রফিকুর রশীদ

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!