যেন অচিরেই ব্যাপক, সর্বাত্মক ও অপ্রতিরােধ্য সংগ্রামে পরিণত হয় সেই উদ্দেশ্যে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের ৬ জানুয়ারি এগার-দফা কর্মসূচি ঘােষণা করে। মূলত এই এগার-দফা কর্মসূচি ছিল আওয়ামী লীগের পূর্বঘােষিত ছয়-দফা কর্মসূচিরই সম্প্রসারিত রূপ।
আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির সঙ্গে উনসত্তরের শুরুতে ছাত্রসমাজের এগার-দফা কর্মসূচি যুক্ত হওয়ার ফলে পূর্ব পাকিস্তান তাে বটেই, সারা পাকিস্তানেরই রাজনৈতিক অবস্থা উত্তাল তরঙ্গসঙ্কুল হয়ে ওঠে। শাসকচক্রও মরিয়া হয়ে গ্রহণ করে দমননীতি। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ছাত্রনেতা আসাদ, ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক হাজতে নিহত হন সার্জেন্ট জহুরুল হক, ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক অফিসারের গুলিতে নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা। এ-সব হত্যাকাণ্ড আন্দোলনের বারুদে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং অতি দ্রুত সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। গণআন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে।
রাজবন্দী-মুক্তি ও আইয়ুব শাহীর পতন
আওয়ামী লীগের ছয়-দফা এবং ছাত্রসমাজের এগার-দফা কর্মসূচির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা গণআন্দোলন শেষপর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে এবং শেখ মুজিবসহ নিরাপত্তা আইনে আটক অন্য রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে। ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি লাভের পর বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে রেসকোর্স মাঠে গণসংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সেদিনের এই সংবর্ধনাসভাতেই উপস্থিত ছাত্রজনতার পক্ষ থেকে ডাকসু’র সহসভাপতি তােফায়েল আহমদ সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আরেক বড় অর্জন হচ্ছে, লৌহমানব’ বলে খ্যাত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট স্বঘােষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন। দেশজোড়া প্রবল গণঅভ্যুত্থানের ধাক্কায় পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নিজে চলে যান পর্দার আড়ালে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে অবসান ঘটে আইয়ুব আমলের। দ্বিতীয় সামরিক শাসন : ইয়াহিয়া খান। আইয়ুব খানের পর পাকিস্তানের ক্ষমতার মঞ্চে আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। চালু হয় দ্বিতীয়বারের মতাে সামরিক শাসন। ইয়াহিয়া প্রথমে প্রধান। সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশ শাসন করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতায় এসে ১৯৬২ সালের সংবিধান বাতিল করেন। এবং একই সঙ্গে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদও বাতিল করেন। তবে ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে এসে তিনি দেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন এবং একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচনেরও ঘােষণা দেন। এই ঘােষণা রাজনীতিবিদদের কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করে সত্তরের সাধারণ নির্বাচন অতঃপর বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ ও ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্বঘােষিত ছয়-দফা এবং ছাত্রদের এগার-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ঘােষণা করে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার পাকিস্তানি।
শাসকদের শােষণ ও বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তিলাভের আশায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের প্রতি সমর্থন জানায় এবং বিপুল পরিমাণে ভােট দেয়। এ-নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে বরাদ্দকৃত জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়। মনােনীত মহিলা আসনসহ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মােট আসন ৩১৩টি। তার মধ্যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি, জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পিপলস পার্টি পায় ৮৮টি এবং অন্য সব দল মিলিয়ে পায় ৫৮টি আসন। নির্বাচনের এই ফলাফল দেখে পাকিস্তানের শাসকদের মাথায় যেনবা আকাশ ভেঙে পড়ে। পূর্বঘােষিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আহ্বান জানাবেন পাকিস্তানের নতুন সরকার গঠন ও সংবিধান প্রণয়নের জন্য। সেটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুও সােজা কথা জানিয়ে দেন—ছয়-দফার কথা বলে তিনি জনগণের ভােট পেয়েছেন, কাজেই দেশের সংবিধান বা শাসনতন্ত্রও রচনা করবেন ছয়-দফার আলােকে এবং দেশ পরিচালিত হবে ছয়-দফার ভিত্তিতেই।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর সত্তরের নির্বাচনের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতাে বাঙালির সামনে সুযােগ আসে-পাকিস্তানের শাসনভার পরিচালনার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অচিরেই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, এটা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাঙালির এই নেতৃত্ব মেনে নিতে পারে না। মেতে ওঠে গভীর ষড়যন্ত্রে । পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো সাহেবের পরামর্শে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নিজের প্রতিশ্রুতি থেকে নিজেই সরে আসেন এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে চক্রান্তের নীলনকশা প্রস্তুত করেন—ক্ষমতা তারা ছাড়বেন না। ভিতরে-ভিতরে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। কিন্তু বাইরে থেকে সেটি বােঝার উপায় নেই। সব ষড়যন্ত্র নিপুণ হাতে ঢেকে রেখে অতিশয় সজ্জন প্রেসিডেন্টের মতাে তিনি ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে ঘােষণা দিলেন—জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে ঢাকায়, মার্চের ৩ তারিখে। এ-ঘঘাষণা শােনার পর আর কোনাে সংশয় নয়, সারা দেশ গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে প্রথম অধিবেশনের ওই দিনটির জন্য। কিন্তু দিন যতই
এগিয়ে আসে জুলফিকার আলী ভুট্টোর অগণতান্ত্রিক, একগুঁয়ে এবং ৩ তারিখের অধিবেশনবিরােধী কথাবার্তা ততই বেপরােয়া হয়ে ওঠে। অবশেষে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের মাত্র দু’দিন আগে, ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের ৩ তারিখের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করেন।
উত্তাল মার্চ : অসহযােগ আন্দোলন
দীর্ঘ ২৩ বছরের এত আন্দোলন-সংগ্রাম, এত স্বপ্ন এত আয়ােজন ষড়যন্ত্রকারী প্রেসিডেন্টের এক ঘােষণায় সব পণ্ড হয়ে গেল। স্থগিত হয়ে গেল নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের পূর্বঘােষিত অধিবেশন। বাঙালি এ-ঘােষণা মানবে কী করে? বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে হােটেল পূর্বাণীতে বৈঠকে বসেছেন—ছয়দফার ভিত্তিতে কীভাবে সংবিধান রচনা করবেন, কীভাবে দেশ চালাবেন, মাত্র দুদিন পরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে কীভাবে এ-সব উপস্থাপন করবেন—এ-সব নিয়ে জোর আলােচনা চলছে। এরই মাঝে প্রেসিডেন্টের ঘঘাষণা সবাইকে স্তম্ভিত করে। সহসাই বন্ধ হয়ে যায় স্কুল-কলেজ, অফিসআদালত, দোকানপাট, ঢাকা স্টেডিয়ামের ক্রিকেট ম্যাচ। লাখ-লাখ বিক্ষুব্ধ মানুষ নেমে আসে রাস্তায়, ফেটে পড়ে বিক্ষোভে প্রতিবাদে। শ্লোগানে-শ্লোগানে মুখরিত সারা ঢাকা ‘জয় বাংলা’, ‘তােমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্রধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’—স্বাধীনতার অবিস্মরণীয় শ্লোগানে কেঁপে ওঠে আকাশ-বাতাস। মিছিলের-পর-মিছিল ছুটে চলে হােটেল পূর্বাণী অভিমুখে। জনগণ বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী নির্দেশ জানতে চায়। জাতীয় পরিষদের পূর্বঘােষিত অধিবেশন আকস্মিকভাবে স্থগিত করাকে ২৩ বছর দাবিয়ে রাখা বাঙালিদের বঞ্চিত করার আরাে একটি ষড়যন্ত্র বলে। উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু এ-দিন আবারও ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ওপর জোর দেন এবং ওই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা পূর্ববাংলায় হরতাল আহ্বান করেন। সরকার অস্ত্রের জোরে দমন করতে চায় আন্দোলন। ২ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেন, নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানাে গণহত্যার শামিল এবং তা মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ। পাকিস্তানি শাসকচক্রকে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে যদি আগুন জ্বলে—ঐ আগুনের শিখা থেকে তারাও রেহাই পাবে না। এ-দিন ডাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রব শ্লোগানমুখর পরিবেশে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এদিকে স্বৈরশাসক সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করে। বঙ্গবন্ধু ঘােষণা দেন অসহযােগ আন্দোলনের। তার মতে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক নয়, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই কেবল বৈধ কর্তৃত্বের অধিকারী। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত গণবিচ্ছিন্ন পাকিস্তান সরকারকে কোনাে প্রকার সহযােগিতা না-করার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। ৩ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন অর্ধ দিবস হরতাল এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স মাঠে জনসভার কর্মসূচি ঘােষণা করা হয়।
বস্তুতপক্ষে, পাকিস্তান সরকারের তখন কর্তৃত্ব ছিল শুধু সেনাবাহিনীর ওপরেই, আর বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল জনগণের ওপরে, উত্তাল সেই মার্চে সারা পূর্ববাংলা চলেছে তারই আদেশে-নির্দেশে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়েছে। আবার হরতালের পর ব্যাংক খুলে সরকারি কর্মকর্তাকর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ারও ব্যবস্থা হয়েছে। এমন অহিংস অথচ সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলন নজিরবিহীন। মুজিবের নির্দেশে অচল সারা দেশ। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাধ্য হয়ে ২৫ মার্চ আবারও জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের ঘােষণা দেন। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এল ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ঢাকার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) কানায়-কানায় ভর্তি মানুষে। রাজপথে উপচেপড়া মানুষের ভিড়। কারফিউ, গুলি, সামরিক আইন উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা অনুযায়ী সব কর্মসূচি পালন করেছে মুক্তিকামী বাঙালি। এবার জানতে চায় পরবর্তী নির্দেশ।
নির্দেশ নয়, নেতার কণ্ঠে সে-দিন সােজাসুজি ঘােষণা—এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই সংগ্রাম যাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে তাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর স্পষ্ট কিছু নির্দেশ আছে ৭ মার্চের ভাষণে। অন্ততপক্ষে ৪টি নির্দেশ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সেগুলাে হল
১. অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে।
২. অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।
৩, সামরিক বাহিনী যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।
৪.জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগেই জনগণের ভােটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
এই নির্দেশ তথা দাবিগুলাে যদি অমান্য করা হয়, তা হলেই সংগ্রাম চলবে বাঙালির মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য। এই সংগ্রাম যারা চালাবে, সব ক্ষমতার উত্স যে আপামর জনগণ, সব শ্রেণী পেশার সেই সংগ্রামী জনসাধারণের করণীয় উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বেশকিছু নির্দেশ প্রদান করেন। বস্তুতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর ঘােষিত কর্মসূচি এবং আহ্বানের প্রতি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে প্রশাসনের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী তথা সর্বস্তরের জনসাধারণ নিঃশর্ত সমর্থন জানায়, স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সব অফিস আদালত, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, যানবাহন, কলকারখানা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ৯ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানীও পরিষ্কার ঘােষণা দিয়ে জানিয়ে দেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেন আলাদা করে তাদের শাসনতন্ত্র তৈরি করে, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়ে নিজেদের শাসনতন্ত্র নিজেরাই তৈরি করে নেবে।
আবার ষড়যন্ত্র : মিথ্যা সময়ক্ষেপণ
পূর্ব পাকিস্তানের ঘরে-ঘরে কালাে পতাকার সাথে উড়ছে বাংলাদেশের নতুন পতাকা। ছাত্র-জনতা মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে শুরু করেছে। পথে-পথে ব্যারিকেড দিয়ে মিলিটারির চলাফেলা বিঘ্নিত করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে অবস্থা বেসামাল দেখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানকে শায়েস্তা করার জন্য গণহত্যার সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশ্যেই বেলুচিস্তানের কসাই নামে খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে পাঠান। কিন্তু তাকে শপথগ্রহণ করাতে এ-দেশের কোনাে বিচারপতি রাজি হলেন না। অসহযােগিতা বলে কাকে! অবস্থা বেগতিক দেখে ইয়াহিয়া খান মার্চের ১৫ তারিখে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলােচনার নামে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। এদিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিদিন বিমানে করে সৈন্য আনা হয় ঢাকায়, আবার ঢাকা থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সারা পূর্ব পাকিস্তানে। যুদ্ধজাহাজ বােঝাই করে অস্ত্র গােলা-বারুদ এনে নােঙর করে চট্টগ্রাম বন্দরে। এদিকে আলােচনার অভিনয় চলছে প্রতিদিন। খুব গভীর এই ষড়যন্ত্রে ভুট্টো এসে যােগ দিলেন ২১ মার্চ। কিন্তু আলােচনার ভান আর কতদিন করা যায়! এ-দিকে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে। বাঙালি সৈনিকেরা বিদ্রোহ করে বসেছে। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে সেনানিবাস আর গভর্নর হাউজ ছাড়া কোথাও পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে না, উড়ছে বাংলাদেশের নতুন পতাকা। পরদিন ২৪ মার্চ। রাজনৈতিক উদ্বেগ আর অস্থিরতায় উত্তাল দিন। এদিন বঙ্গবন্ধু এবং ইয়াহিয়ার মধ্যে বৈঠক নেই। বৈঠক হয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ আর ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে। এ-সব বৈঠকের ভান করে আরাে একটা দিন কাটিয়ে দেওয়া এবং পরদিন যে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুষ্ঠিত হবে তারই সর্বশেষ প্রস্তুতি চূড়ান্ত খবরাখবর জেনে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দেওয়াই হচ্ছে মুখ্য উদ্দেশ্য। ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাপরিকল্পনা অপারেশন সার্চ লাইট’-এর সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পর কোনাে প্রকার ঘােষণা না-দিয়েই ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। এই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের সব দরজা-জানালা।
অপারেশন সার্চলাইট : নজিরবিহীন গণহত্যা
পৃথিবীর ইতিহাসে যতগুলাে গণহত্যার খবর পাওয়া যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা, নিষ্ঠুরতা ও ক্ষীপ্রতার মাপকাঠিতে অন্যতম প্রধান। কোনাে কোনাে যুদ্ধবিশেষজ্ঞ অন্যতম না-বলে ‘প্রধান’ বলে চিহ্নিত করতে চান। এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন বিপুলসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা আগে কখনাে ঘটে নি। মার্চ মাসের গােড়ার দিকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসনের জনসংযােগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক অবাধ্য নাগরিকদের দমন করতে
পাকবাহিনীর সম্ভাব্য ভূমিকা সম্পর্কে বিদেশী সাংবাদিকদের যে ব্রিফ দেন তার প্রেক্ষাপটে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গ ২৮ মার্চ নয়াদিল্লি থেকে লেখেন : দীর্ঘদেহী এই পাকিস্তানি অফিসার বলেছিলেন, যখন ডাকা হবে সেনাবাহিনীকে, সেটা হবে একেবারে চূড়ান্ত পদক্ষেপ। সেনাবাহিনী হত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই গুলি ছুঁড়বে।” শুধু হত্যা নয়, পঁচিশে মার্চের সেই ভয়াল রাতে ঢাকায় সংঘটিত হয় পরিকল্পিত এবং বর্বরতম গণহত্যা। এ-দিন ষড়যন্ত্রকারী ভুট্টোর সঙ্গে চূড়ান্ত আলােচনা করে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঙালি জাতির স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের আকাক্ষা চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে গণহত্যার নিখুঁত পরিকল্পনা অনেক আগে থেকে করা আছে, সেই নীলনকশার নাম অপারেশন সার্চলাইট।” এ অপারেশন শুরুর আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী সব বাঙালি অফিসারকে হয় হত্যা, না হয় গ্রেপ্তার করে, সাধারণ সৈন্যদের এবং পিলখানায় ইপিআরদেরও নিরস্ত্র করে। তারপর রাত সাড়ে ১১টায় ভুট্টোর কুপ্ররােচনায় ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া হায়েনা বাহিনী নিরীহ ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে রক্ত লােলুপতায়। ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, আরমানিটোলা, পিলখানা, পুরনাে ঢাকায় প্রত্যেক হিন্দুবাড়িতে গুলি চালায় নির্বিবাদে, আগুন জ্বালায় নির্বিচারে। ঢাকা থেকে বিদেশী সাংবাদিকদের আগেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবু সাইমন ড্রিং নামে এক দুঃসাহসী সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গােপনে এই হত্যাকাণ্ড এবং ধ্বংসলীলার সংবাদ ও চিত্র সংগ্রহ করে ওয়াশিংটন পােস্ট পত্রিকার মাধ্যমে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন। | আরও একজন মানুষ, পেশায় সাংবাদিক না-হয়েও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল এবং জগন্নাথ হলে পঁচিশের ভয়াল রাতে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটে, তার ছবি ধারণ করেন মুভি ক্যামেরায়। বুয়েটের অধ্যাপক ড. নূরুল উলার ধারণকৃত সেই ছবি এখনাে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার দলিল হয়ে আছে। শুধু হলের ছাত্র নয়, আশেপাশের বস্তিগুলােতে তারা আগুন জ্বালিয়ে দেয়, মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করে প্রাণভয়ে ভীত মানুষজনকে। এককথায়, সেই ভয়াল রাতে ঢাকা নগরীতে বিরাজ করে নারকীয় পরিবেশ। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরে দেশের প্রধান শহরগুলােতে একযােগে ঝাপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। প্রকৃতপক্ষে পঁচিশে মার্চের বিভীষিকার তুলনা হয় না।
শুধু ঢাকাতেই সে রাতে লক্ষাধিক নারী-পুরুষকে হত্যা করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়। | বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং স্বাধিকারের দাবি সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ করে দেওয়াই ছিল অপারেশন সার্চলাইটের মূল লক্ষ্য। একইসঙ্গে এই অভিযানের অন্যতম আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা। হয়তাে বঙ্গবন্ধু নিজেও সেটা জানতেন। তার আশঙ্কা ছিল জেনারেল ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া হায়েনা বাহিনী তাকে না পেলে সারা ঢাকায় আগুন জ্বালিয়ে দেবে। তাই তিনি স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘােষণা প্রচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করলেন, দলের সব নেতাকর্মীকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন, তারপর এপিকধর্মী ট্র্যাজেডির নায়কের মতাে নিয়তি নির্দিষ্ট পরিণাম ভােগ করার জন্য প্রতীক্ষায় রইলেন। অতঃপর সেদিনের সেই মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক কমান্ডাে দল এসে ইতিহাসের মহানায়ককে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। বাংলার মানুষের মুক্তির প্রত্যাশায় তিনি নিজে বন্দিত্ব বরণ করে নেন। এর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি ঘােষণা করেন, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই, বাংলাদেশের মাটিতে তখন দাবড়ে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর দানবেরা। বঙ্গবন্ধু তাই আহ্বান জানিয়ে গেলেন—এই হিংস্র দানবদের থাবা থেকে মুক্ত করতে হবে মাতৃভূমিকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা
‘স্বাধীনতা’ নামের মহাকাব্যের বীরােচিত নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি অত্যন্ত শৈল্পিক কৌশলে পাকিস্তানের মােহবন্ধন থেকে ধীরে-ধীরে বাঙালি জাতিকে বের করে এনেছেন মুক্তির পথে, যুক্তির আলােয়। বাঙালি আত্মানুসন্ধানী হয়ে পথে নামতেই বাধা পেয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির, সেই বাধা সরাতে গিয়েই তারা গড়ে তুলেছে আন্দোলন-সংগ্রাম। ‘৫২, ‘৬৬, ‘৬৯, ‘৭০ পেরিয়ে জনতার সেই আন্দোলন-সংগ্রাম এমন এক পর্যায়ে পৌছে যে, সেই শীর্ষবিন্দুতে দাড়িয়ে স্বাধীনতার ঘােষণা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। গণমানুষের নেতা শেখ মুজিব দিনে-দিনে একটু-একটু করে স্বাধীনতার এই স্বপ্নসাধই জাগিয়ে তােলেন গণমানসে। ফলে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্সরা লাখাে জনতার দিকে তাকিয়ে তিনি সরাসরি ঘােষণা দিয়েই দেন—’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ | এই ঘােষণা থেকেই গােটা জাতি ‘গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে যায়। বেসামরিক জনগণ তাে বটেই সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরাও ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে, দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে। ৭ মার্চের পর থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অসহযােগ আন্দোলন পরিচালনা করে। আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের সব পথ বন্ধ করে দিয়ে পঁচিশে মার্চের কালাে রাতে বর্বর ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যা চালায় ঢাকা নগরীতে। এরই প্রেক্ষাপটে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম’ তথা ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ অনিবার্যভাবেই মােড় পরিবর্তন করে সশস্ত্র যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করে।
স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তান কমান্ডাে বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অনিবার্য সেই সশস্ত্র যুদ্ধেরও ঘােষণা দিয়ে যান। বাংলার মানুষের উদ্দেশে তার শেষ বার্তাটি ছিল এ রকম : This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have. To resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achicved.” (এটাই হয়তাে তােমাদের জন্য আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। যে যেখানেই থাক, যে অবস্থায় থাক, হাতে যার যা আছে তাই দিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরােধ গড়ে তােল। যতদিন পর্যন্ত-না দখলদার পাকিস্তানিদের শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে।) এ ঘােষণাটি বঙ্গবন্ধু বিশেষ ব্যবস্থায় আগেই রেকর্ড করিয়ে রেখেছিলেন এবং ইপিআর-এর অয়্যারলেসযােগে যথাসময়ে প্রচারেরও দায়িত্ব দিয়ে ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনামতাে এটা প্রচারও হয়। কিন্তু সেই রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে যখন বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিলখানায় ইপিআর এবং রাজারবাগে পুলিশের দুর্গে বর্বরােচিত হামলা চালিয়েছে, তখন অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকার টিএন্ডটি (টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন) এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে তিনি আরাে একটি বার্তা প্রেরণ করেন, সেখানে বলা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পিলখানায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দপ্তর আর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ওপর আক্রমণ করেছে সমস্ত শক্তি জড়াে করে প্রতিরােধ করুন আর স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুনমাত্রা
২৬ মার্চ বাঙালির জাতীয় জীবনে সবচেয়ে উজ্জ্বল ডেটলাইন। আর পূর্ব পাকিস্তান নয়, পূর্ববাংলাও নয়; পঁচিশের কালাে রাতে পৈশাচিক গণহত্যা চালানাের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সব সম্পর্কের সুতাে অনায়াসে কেটে দিয়েছে; বাঙালির আর পিছনে তাকানাের অবকাশ নেই, যত ঝুঁকিপূর্ণই হােক তাকে সামনেই যেতে হবে—চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে। স্বাধীনতা সংগ্রাম ২৬ মার্চের পর অনিবার্যভাবেই মুখ ফিরিয়েছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকে। কিন্তু তার আগে আছে প্রতিরােধ যুদ্ধ। কেবল ঢাকা শহরে নয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে একযােগে দেশের বড় শহরগুলােতে ঝাপিয়ে পড়ে, কারফিউ জারি করে, ঘরে-ঘরে আগুন জ্বালায়, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। আক্রমণের আকস্মিকতায় ঢাকা শহরের প্রতিরােধ ব্যবস্থা বেশিক্ষণ টিকে থাকে নি বটে, চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ সহজে নিতে পারে নি তারা। চট্টগ্রামের প্রতিরােধযােদ্ধারা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আগলে রাখে বীরের মাটি চট্টলাকে। এদিকে কুষ্টিয়া এবং পাবনা শহর প্রথম আঘাতেই পাকিস্তানি সৈনিকরা দখল করে নিলেও চুয়াডাঙ্গার ইপিআরপ্রধান মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে কুষ্টিয়া এবং