You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুজিবনগর কেন অনিবার্য ছিল
১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধ যেমন হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনাে ঘটনা নয়, তেমনি ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা মেহেরপুরের অখ্যাত অজ্ঞাত গ্রাম বৈদ্যনাথতলার বিস্তৃত আম্রকাননে যা ঘটে যায়, সেটিও মােটেই অপরিকল্পিত বা আকস্মিক কোনাে ঘটনা ছিল না। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধের নেপথ্যে যেমন রয়েছে উত্থান-পতনময় বহুবর্ণিল ভিত্তিভূমি, ঠিক তেমনি মুজিবনগর দিবসের প্রেক্ষাপট রচনার নেপথ্যেও রয়েছে কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সুগভীর দূরদৃষ্টি, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাপ্রসূত সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের প্রতিফলন। বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ কালের রাজনৈতিক জীবনের সংগ্রামমুখর ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ এবং অবিস্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এবং সেই মহান যুদ্ধে বিজয় অর্জন। সমগ্র যুদ্ধ প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় এবং বিজয় অর্জনের নেপথ্যের মহামূল্যবান চাবিকাঠিটি নির্মাণ করে ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন ও কৌতূহলী বাঙালি মাত্রেরই তাই মুজিবনগর দিবসের ঐতিহাসিক এবং অপেক্ষাকৃত কম আলােচিত প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবহিত হওয়া আবশ্যক। পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের দীর্ঘ ২৩ বছরের শাসন-শােষণ অত্যাচার-নির্যাতন বাঙালিকে বাধ্য করেছিল এক রাষ্ট্রের শেকল ভেঙে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এবং কৃত্রিম জাতি পরিচয়ের ঠুনকো বাঁধন ছিড়ে সত্যিকারের জাতি পরিচয় অন্বেষণে ব্রতী হতে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির প্রাণের স্পন্দন ও প্রত্যাশা উপলব্ধি করেছিলেন বলেই গােটা জাতিকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ ধরেই স্বাধীনতার স্বপ্নে উচ্চকিত ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বাঙালির দাবি আদায়ের সব পথ রুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব প্রধান শহরে নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালালে সামরিক দিক থেকে অপ্রস্তুত অবস্থাতেও বাঙালিকে রুখে দাঁড়াতে হয়। এদিকে বঙ্গবন্ধু ঐ রাতেই, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘােষণা দেওয়ার পর পাকবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে যান। এমন কি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় অন্য নেতৃবৃন্দও পূর্বেই আত্মগােপন করেছিলেন।
 
বস্তুত ২৫ মার্চের পর থেকে মুক্তিকামী বাঙালি জাতি নেতৃত্বহীন অবস্থাতেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মােকাবিলা করে এবং কোথাও-কোথাও বিপর্যস্ত করে ফেলে। পঁচিশের কালাে রাতেই যশাের থেকে বেলুচ রেজিমেন্টের ১৪৭ জন সৈন্য কুষ্টিয়া দখল করে নিলে চুয়াডাঙ্গাস্থ ইপিআর-আর উইং কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন খােলা হয় এবং মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গা কুষ্টিয়ার হাজার-হাজার জনতা ৩০ ও ৩১ মার্চ দু’দিনব্যাপী যুদ্ধ করে কুষ্টিয়া মুক্ত করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ ভরাডুবি ঘটে এ যুদ্ধে। সারা দেশেই দখলদার পাকবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরােধ সংগ্রাম গড়ে তােলে বটে, কিন্তু সত্যিকারের কথায় তা ছিল পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমন্বয়বিহীন এবং একক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলে বিভিন্ন জায়গায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরােধ সংগ্রামও একে-একে বিপর্যস্ত হতে থাকে। এ-সময়ে রণকৌশলে পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি হয়ে ওঠে। প্রতিরােধযােদ্ধাদের মনােবল ফিরিয়ে একক কমান্ডের অধীনে এনে মুক্তিযোেদ্ধায় রূপান্তর করা এবং সেই মহান যুদ্ধ পরিচালনার জরুরি এবং জটিল কাজটির দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ তাজউদ্দিন আহমেদ।
প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদ এবং কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম—বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই দুরূপকার বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার পর ২৬ মার্চ ঢাকা থেকে বেরিয়ে বহু জনপদ ঘুরে ৩০ মার্চ ঝিনাইদহে পৌছলে এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন তাদের চুয়াডাঙ্গায় নিয়ে আসেন। তাদের পরিকল্পনা চুয়াডাঙ্গা কিংবা মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে তারা ভারতে গিয়ে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য ভারতীয় সাহায্যসহযােগিতার ব্যবস্থা করবেন। এই একই লক্ষ্যে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরী ইতােমধ্যেই নদীয়ার জেলা প্রশাসক মি, মুখার্জি এবং ৭৬-বি, এসএফ-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল চক্রবর্তীর সঙ্গে কয়েক দফা যােগাযােগ করেছেন, ভারতীয় জনগণের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে লেখা তার চিঠি অমৃতবাজার এবং যুগান্তর পত্রিকায় ২৭, ২৮, ২৯, ৩০ সংখ্যায় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে এবং বেতাই। সীমান্তে বিএসএফ কর্মকর্তার সঙ্গে তার ২৯ মার্চের বৈঠকের শর্ত অনুযায়ী তিনি ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় জীবননগরের অদূরে চেংখালী চেকপােস্টে ভারতীয় অস্ত্র আনতে যান।
 
এ-সব খবর জানার পর মাহবুব উদ্দিন বিশিষ্ট দুই অতিথিকে নিয়ে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর সঙ্গে ৩০ মার্চ রাতে ভারতীয় সীমান্ত চেংখালীতে পৌছেন। অতঃপর নেতৃবৃন্দ কলকাতা হয়ে দিল্লি দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাজউদ্দিন আহমেদকে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ দেওয়ার। কথা নয়। তবে ভারতীয় পার্লামেন্ট ৩১ মার্চ একটি প্রস্তাব পাস করে যে, বাংলাদেশে সরকার গঠিত হয়েছে জানতে পারলে পূর্ববাংলার জনগণকে সাহায্য করার কথা বিবেচনা করা হবে। বিচক্ষণ রাজনীতিক তাজউদ্দীন ৩ এপ্রিল তার উপস্থিত বুদ্ধিমত্তায় এই অস্ত্রটি কাজে লাগালেন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু এবং দুই সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও খােন্দকার মােশতাক এবং দুই সাধারণ সম্পাদক- কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কামরুজ্জামান ও প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের তাজউদ্দিন আহমেদ এই পাঁচজনকে নিয়ে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড গঠিত হয়েছিল। ৩ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমেদ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানালেন যে, ২৫/২৬ মার্চেই শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান করে একটি সরকার গঠিত হয়েছে, তিনি নিজে এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ। হাইকমান্ডের সবাই এই মন্ত্রিসভায় আছেন। তাজউদ্দীন আহমদের এই উপস্থিত ও বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অসাধারণ ভূমিকা রাখে। কারণ ভারতীয় পার্লামেন্টে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এর পর থেকে বাংলাদেশ সরকারকে সবরকমের সহায়তা প্রদান করে ভারত সরকার। এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষেও বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ আনা এবং নেতৃত্ব প্রদান সম্ভব হয়। 
 
স্বউদ্যোগে বাংলাদেশ সরকারের ঘােষণা দিয়ে তাজউদ্দিন নিজেই আটকা পড়লেন নিজের দলের লােকজনের কাছে  মুক্তিযুদ্ধে আশু করণীয় এবং কর্মসূচি তৈরি করে তিনি যখন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিলিগুড়ি অস্থায়ী বেতার থেকে ভাষণদানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখনই এলাে প্রথম আঘাত ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেতা শেখ ফজলুল হক মণি এবং আওয়ামী লীগ নেতা চিত্তরঞ্জন সুতার কলকাতায় উপস্থিত ৪২ জন আওয়ামী লীগ ও যুব নেতার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে উক্ত বেতারভাষণ বন্ধের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন। তারা জানান যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তারা তাজউদ্দিন আহমেদকে মানেন না। তখন পর্যন্ত কলকাতায় উপস্থিত আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে কামরুজ্জামানও পরােক্ষভাবে বিরােধীদের পক্ষই গ্রহণ করেন। অথচ তাজউদ্দিন জানেন, এটা গৃহবিবাদের সময় নয়। বাংলার প্রতিটি প্রান্তরে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী পৈশাচিক হত্যালীলা চালাচ্ছে, তার মােকাবিলার জন্য দেশত্যাগী ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে পাঠানাে দরকার। লক্ষ-লক্ষ ভিটেমাটি ছাড়া অসহায় শরণার্থীর আহার ও আশ্রয় দরকার ভারতসহ বহির্বিশ্বের অন্যান্য দেশে পাকিস্তানিদের চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় ও একতরফা যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচারণা দরকার। আর এসবকিছুর জন্য সরকার গঠনের প্রয়ােজনপ্রিয়তা অপরিহার্য। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই দুঃসময়েও তাজউদ্দীন আহমদ মালদহ, বালুরঘাট, শিলিগুড়ি, রূপসা, শিলচর হয়ে আগরতলা পর্যন্ত পথে-পথে ঘুরে-ঘুরে খুঁজে বের করেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আব্দুল মান্নান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খােন্দকার মােশতাক ও কর্নেল ওসমানীকে অতঃপর ১০ এপ্রিল আগরতলাতেই আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার এবং ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ দাবি করেন-বাংলাদেশকে দখলদারমুক্ত করার জন্য সারা দেশে যে যুদ্ধতৎপরতা চলছে তা এই সরকারের নিয়ন্ত্রণেই। 
 
সরকার গঠন নিয়ে তাজউদ্দিন আহমেদ নিজ ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাগুণে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রতিকূলতাও যেমন কাটিয়ে ওঠেন, তেমনি বাংলার মুক্ত মাটিতেই এ সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণ এবং সুনির্দিষ্ট ঘােষণাপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ববিবেকের কাছে স্বাধীনতা ঘােষণার আনুষ্ঠানিকতা প্রদর্শনের আয়ােজনেরও পরিকল্পনা করেন। তখনাে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু-কিছু মুক্তভূমি রয়েছে। কিন্তু এই বিশাল আয়ােজনের জন্য সব জায়গা সমান যােগ্য নয়। প্রবাসী নেতার মনে পড়ে যায়—ভারতে প্রবেশের পূর্বমুহূর্তে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সুদৃঢ় অবস্থান এবং কুষ্টিয়া যুদ্ধে অপূর্ব সাফল্যের কথা, মনে পড়ে মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর অসাধারণ কর্মনৈপুণ্য ও সাহসিকতার কথা এবং চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর সীমান্ত এলাকার নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থার কথা। সিদ্ধান্ত নেন দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এলাকাতেই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হবে। সেই অনুযায়ী চুয়াডাঙ্গাতে প্রস্তুতি চলতে থাকে কিন্তু আকাশবাণীর খবরে এ-প্রস্তুতির কথা প্রচারিত হয়ে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যশাের থেকে বেরিয়ে কালীগঞ্জ, কোর্টচাদপুর, বিষয়খালী প্রভৃতি স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান ভেঙে ক্রমশ অগ্রসর হতে শুরু করে।
এমনকি দু-একদিনের মধ্যেই চুয়াডাঙ্গায় পাক বিমানবাহিনী থেকে করা হয় বােমা হামলা যার প্রেক্ষিতে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তরই এক সময় চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে মেহেরপুরে আনতে হয়। যাহােক, এই সংকটময় মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিএসএফ)-এর সঙ্গে আলােচনাক্রমে মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথতলার বিশাল আমবাগানের ছায়াঢাকা পাখিডাকা মনােরম চত্বরকেই মন্ত্রিপরিষদের শপথগ্রহণের জন্য এবং অস্থায়ী রাজধানী (প্রতীকী অর্থে) স্থাপনের জন্য উপযুক্ত স্থান বলে নির্বাচন করেন। চুয়াডাঙ্গা এবং মেহেরপুর থেকে এ-স্থানের দূরত্ব ও সড়কপথে এ দুর্গম এলাকার সঙ্গে যােগাযােগের অসুবিধা এবং মাত্র ১০০ গজের মধ্যে ভারতীয় সীমান্ত হৃদয়পুর থেকে সড়কপথে কলকাতার যােগাযােগের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই মানচিত্রে সীমান্তসংলগ্ন আরাে অনেক জায়গা মুক্তাঞ্চলের মধ্যে থাকলেও বৈদ্যনাথতলাকেই বেছে নেওয়া হয়। এছাড়াও বৈদ্যনাথতলার ভৌগােলিক অবস্থানটি এমনই কৌশলগত সুবিধাজনক স্থানে যে, পাকবাহিনী যদি আকাশপথে এসে বিমান হামলা করতে চায়, তা হলেও ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশ করতে হবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিশ্চয় সে ঝুঁকি নেবে না।
 

শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পর্কে মেহেরপুরের তৎকালীন এসডিও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ১৪/10/৭৩ তারিখে সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, “মেহেরপুরের কোনাে এক স্থানে বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণের প্রস্তাবের কথা আমরা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দিকে জানতে পারি। আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য গভীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।” বৈদ্যনাথতলায় একটা কিছু অনুষ্ঠানের আভাস পাওয়া যায় এপ্রিল মাসের ১২ তারিখে। সে আভাস পান বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১১ মার্চ গড়ে ওঠে এই সংগ্রাম কমিটি। ১৩ সদস্যবিশিষ্ট সেদিনের ঐতিহাসিক বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটিতে ছিলেন ১. দোয়াজ উদ্দিন মাস্টার, ২. আব্দুল মােমিন চৌধুরী, ৩. আইয়ুব হােসেন, ৪. রুস্তম আলী, ৫. আব্দুর রফিক, ৬. সৈয়দ আলী, ৭. জামাত আলী মােল্লা, ৮. আবু তৈয়ব, ৯, আকবত আলী, ১০. পিন্টু বিশ্বাস, ১১. সুশীল মল্লিক, ১২. আনােয়ার হােসেন ও ১৩, সিরাজুল ইসলাম পটল।

 
সাহায্যসামগ্রী গ্রহণ করছেন। এমন সময় গ্রামের একজন সাধারণ লােক এসে জরুরি খবর দিয়ে দোয়াজ উদ্দিন মাস্টার এবং আইয়ুব হােসেনকে ডেকে বৈদ্যনাথতলা আমবাগানে নিয়ে যান। তারা সেখানে ভারতীয় বিএসএফ-এর দু’জন কর্মকর্তাকে সাদা পােশাকে দেখতে পান। কর্মকর্তা দু’জনের মধ্যে একজন দোয়াজ উদ্দিনদের পরিচয় জানার পর বাগানের বেশকিছু জায়গা (বর্তমানে সেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে) আঙুল উচিয়ে দেখিয়ে ঐ জায়গাটুকু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতে বলেন এ-কাজের জন্য তারা কিছু ভারতীয় টাকাও দিতে যান। কিন্তু বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ সে টাকা না নিয়ে পরিচ্ছন্নতার কারণ জানতে চান সাদা পােশাকের বিএসএফ কর্মকর্তাদ্বয় এরপর স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির সবাই পরিচ্ছন্নতা অভিযানে ঝাপিয়ে পড়েন। তাদের দেখাদেখি ঐ গ্রামের শারি, করম আলী, মােমিন চৌধুরীসহ আরাে অনেক যুবক কাজে লেগে যায়। এমনকি ভবেরপাড়া মিশনের ব্রাদার ফ্রান্সিসও এ-অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীও এ-অনুষ্ঠানের কথা জানতে পারেন ১২ এপ্রিল তার সাক্ষাৎকারের এ-প্রসঙ্গে তিনি জানান, ১২ এপ্রিল-দিনের-পর-দিন মরণপণ যুদ্ধের পরও আমরা যখন কোনাে স্বীকৃতি পাচ্ছি না, তখন আমাদের মনােবল ভাঙতে শুরু করে। এমন এক সংকটজনক দিনে আমি খবর পেলাম, বাংলাদেশ সরকার ১১ কিংবা ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণ করবে।২”  সে-দিনের বৈদ্যনাথতলা আমবাগানে সাদা পােশাকের ভারতীয় কর্মকর্তা দু’জন ছিলেন বিএসএফ-এর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা গােলক মজুমদার এবং ৭৬ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল চক্রবর্তী ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বিএসএফ-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে বৈদ্যনাথতলায় অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। ১৩ এপ্রিল বিকালে। লে. কর্নেল চক্রবর্তী পূর্বনির্ধারিত স্থানের পরিচ্ছন্নতা দেখতে এসে এর পরিসর আরাে বাড়ানাের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন কিন্তু সে-দিনও এ-আয়ােজনের কারণ তিনি জানালেন না।
 
বিএসএফ-এর দুই কর্মকর্তাই ১৫ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলায় এসে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দকে জানান শুভ সংবাদ, নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার ১৭ এপ্রিল এখানে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করবেন। আগামীকাল সারাদিনের মধ্যে মঞ্চ তৈরি, বাঁশের বাতা দিয়ে বেষ্টনী নির্মাণ, চেয়ার-টেবিল যােগাড়—এ-সবই সম্পন্ন করতে হবে। বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটি সানন্দে গ্রহণ করে এ-সব দায়িত্ব। সংগ্রাম কমিটির সভাপতি দোয়াজউদ্দিন মাস্টার আবেগাপ্লুত কণ্ঠে জানান, আমরা ভাবতেই পারিনি। ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনকারী এতাে বড় ঘটনা আমাদের চোখের সামনে ঘটবে এবং আমরা এমন একটি বিশাল কাজে অংশ নেওয়ার সুযোেগ পাব। ১৬ তারিখ দুপুরের মধ্যে মঞ্চসজ্জার আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি হৃদয়পুর ক্যাম্প থেকে চলে এলাে। বৈদ্যনাথতলা ইপিআর ক্যাম্পের চৌকি এনে মঞ্চ তৈরি হলাে। সারা রাত বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সমস্ত আয়ােজন সম্পন্ন হলাে।” ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রারম্ভিক পর্যায়ের বর্ণনা প্রসঙ্গে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, “সকাল ন’টার দিকে জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যদের সাথে নিয়ে সেখানে পৌছলেন। আমি তাদের নিয়ে এলাম বৈদ্যনাথতলার মঞ্চে। ওখানে আশেপাশের গ্রাম থেকে কিছু চেয়ার সংগ্রহ করে আনা হল। সংগৃহীত চেয়ারের মধ্যে সবগুলাে পূর্ণাঙ্গ নয়। কোনােটায় একটা হাতল নেই কোনােটার এক পায়া খােয়া গিয়েছে। মঞ্চ। প্রহরার জন্য নিয়ােজিত আনসারদের জন্য কিছু রান্না হয়েছিল। বেলা প্রায় এগারটা নাগাদ বহু প্রতীক্ষিত অনুষ্ঠান শুরু হল। আমি জিপে করে জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও অন্য কয়েকজনকে মঞ্চের ৫০ গজের মধ্যে তােরণের কাছে নিয়ে এলাম।” 
 
ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ইপিআর-আনসারের একটি ছােট দল নিয়ে নেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানানাের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর পৌছতে বিলম্ব হওয়ার কারণে ক্যাপ্টেন মাহবুব তার ঐ ছােট্ট দলটি নিয়েই অভিবাদন জানান। এ-দলের আনসারদের মধ্যে ছিলেন মীর ইয়াদ আলী, আরজউল্লাহ, আজিম উদ্দীন, সাহেব আলী, অস্থির মল্লিক, লিয়াকত আলী, ফকির মােহাম্মদ, হামিদুল হক, নজরুল ইসলাম, মফিজউদ্দীন, সিরাজুল ইসলাম ও আরশাদ আলী। অভিবাদন গ্রহণের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এই সঙ্গে শুরু হয় স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় জাতীয় সংগীত শাহাব উদ্দিন আহমদ সেন্টু তার সঙ্গী আসাদুল হক, মনসুর আলী, পিন্টু বিশ্বাস প্রমুখ শিল্পীর নিয়ে রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় বসে আগে থেকেই রিহার্সেল করছিলেন। আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীপ্রধান আব্দুর রাজ্জাকের নির্দেশে শিল্পীরা শুরু করে গাইতে। ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রবও জাতীয় সংগীতে অংশ নেন। এরপর ভাবগম্ভীর পরিবেশে মাইক্রোফোনে উচ্চারিত হয়। জাতীয় নেতৃবৃন্দের নাম, গুচ্ছ-গুচ্ছ পুষ্পসুরভি ছড়িয়ে পড়ে সারা প্রাঙ্গণে, মঞ্চে উঠে এসে আসগ্রহণ করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এএইচএম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খােন্দকার মােশতাক আহমদ এবং কর্নেল এম এ জি ওসমানী। স্বেচ্ছাসেবকরা প্রত্যেকের হাতে ফুলের তােড়া তুলে দিয়ে বরণ করে নেন। উপস্থিত জনতা উষ্ণ করতালিতে অভিনন্দন জানান। অতঃপর গৌরীনগরের বাকের আলী (বর্তমানে মুজিবনগর কলেজের সহকারী অধ্যাপক)-এর কণ্ঠে পবিত্র কুরআন তেলওয়াত এবং ভবেরপাড়ার পিন্টু বিশ্বাসের কণ্ঠে বাইবেল পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এরপর আওয়ামী লীগের চিফ হুইফ অধ্যাপক মােঃ ইউসুফ আলী বাংলার মুক্ত মাটিতে স্বাধীনতাকামী কয়েক হাজার জনতা এবং শতাধিক দেশী-বিদেশী সাংবাদিকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেন। ঐতিহাসিক সেই ঘােষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক ইউসুফ আলী রাষ্ট্রপ্রধানের (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শপথ বাক্য পাঠ করান।
 
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপ্রধান এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম-এর পর তার সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমেদের নাম ঘােষণা করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্যগণের নাম ঘােষণা করে উপস্থিত সুধী, দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও জনতার সামনে সবার পরিচয় করিয়ে দেন। মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে এরপর বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্নেল এম এ জি ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আব্দুর রবের নাম ঘােষণা ও পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। অত্যন্ত উফুল্ল ও আনন্দ-উদ্দীপনাময় পরিবেশে পরিচয় পর্ব শেষ হলে শুরু হয় বক্তৃতা পর্ব প্রথমেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত গণপরিষদ সদস্য সুধী, দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে ৩০ মিনিটব্যাপী উদ্দীপনাময় এক ভাষণ দেন। এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ শেষে তিনি ঘােষণা দেন—আজ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হবে এ বৈদ্যনাথতলা এবং এর নতুন নাম হবে মুজিবনগর। মুজিবনগরের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার ভাষণের শুরুতেই বলেন, আজ এই মুজিবনগরে একটি নতুন স্বাধীন জাতি জন্ম নিল। এর পর মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন এবং সবশেষে প্রত্যয়দৃপ্ত কণ্ঠে ঘােষণা করেন- আজ না জিতি কাল জিতব, কাল না জিতি পরশু জিতবই।
বক্তৃতা এবং শপথগ্রহণ পর্ব শেষে নেতৃবৃন্দ মঞ্চ থেকে নেমে এলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। সব শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব এবং বিবৃতি প্রদানের পর মিষ্টিমুখের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়। ১৭ এপ্রিলের পর মুজিবনগরের নামেই চলেছে বাংলাদেশের সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন, চলেছে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, মুজিবনগরের নামেই আন্তর্জাতিক সাহায্যসহানুভূতি সংগৃহীত হয়েছে, শেষপর্যন্ত বিজয় অর্জিত হয়েছে এই নামেই। সে-সময় সারা দেশেরই অন্যনাম হয়ে যায় মুজিবনগর। দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরােধ সংগ্রাম অনেকাংশে অসংগঠিত পারস্পরিক সম্পর্ক ও শৃঙ্খলাবিহীন এবং একক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার কারণে যখন বিপর্যস্তপ্রায়, ঠিক তেমনি সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ এবং সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ তৎপরতাকে সেই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে এনে সুপরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে সরকারের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে দেশমাতাকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে ১৭ এপ্রিলের অঙ্গীকার ঘােষণা, বাঙালি জাতির জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত ও গৌরবময় ঘটনা।
 

সেদিন মুজিবনগরে এই যুগান্তকারী ঘটনা -ঘটলে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নই হয়তাে ভূলুষ্ঠিত হতাে। এ কথা অস্বীকার করার কোনাে উপায় নেই যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বই দাঁড়িয়ে আছে মুজিবনগরের ভিত্তির ওপর। সেই অর্থে দল-মত নির্বিশেষে এই স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সব বাঙালিরই কর্তব্য মুজিবনগর দিবসকে একটি জাতীয় দিবস হিসেবে যথাযােগ্য মর্যাদায় উদযাপন করা। হায় দুর্ভাগা জাতি! মহান একুশ কিংবা স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানেই যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে পারি না, মুজিবনগর দিবসে সে আশা করি কী করে! স্বাধীনতার স্বপক্ষ-বিপক্ষ সব দলই আজ দেশের কল্যাণের চিন্তায় উদ্বিগ্ন। কোন দেশ সেটি? একাত্তরে মুজিবনগরের চাবিকাঠি দিয়ে যে দেশের দ্বারােদ্ঘাটন হয়েছিল, সেই বাংলাদেশ? তা হলে যে এই মুজিবনগর দিবসে সেই অবিস্মরণীয় মুজিবনগর সরকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হয় বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে! কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম অস্তিত্বের প্রশ্নে মুজিবনগরের উপস্থিতি যে অনিবার্য এবং অবিচ্ছেদ্য। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনােয়ার হােসেন যথার্থই বলেছেন, “বহুমাত্রিক বিচারে ‘৭১-এর ১৭ এপ্রিল এই সরকার গঠন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ত্যাগ ও রক্তের ইতিহাসে একটি বড় মাপের মাইলফলক। স্মর্তব্য, এই সরকার গঠন এবং বিশ্বব্যাপী এই সরকারের পরিচিতির কারণে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমত গড়ে উঠেছিল, যা মুক্তিযােদ্ধাদের নৈতিক সাহসের উৎস ছিল। উপরন্তু এই সরকার দ্রুত গঠিত না-হলে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হয়; এবং যা হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্যরকম হতাে। কাজেই মুজিবনগর দিবস ঐতিহাসিক বিচারে এক অনন্য দিন, অনিবার্য দিন।  নিবন্ধটি মুজিবনগর দিবস ২০০০ উপলক্ষে জেলা প্রশাসন, মেহেরপুর-এর স্মরণিকা ‘মুজিবনগর’-এ প্রকাশিত।

 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!