You dont have javascript enabled! Please enable it! ঘুম নেই | নাসির উদ্দিন ইউসুফ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৩০ মার্চ ১৯৮৪ - সংগ্রামের নোটবুক

ঘুম নেই | নাসির উদ্দিন ইউসুফ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৩০ মার্চ ১৯৮৪

ঘুম নেই ।ক্লান্ত পাতাদুটো ভারী হয়ে নেমে আসে চোখের ওপর।চারদিকে চেপে বসে অন্ধকার।রাত দুটো।চোখের দুটোর ঠিক পাতার নিচে ওদের ছায়া।নড়েচড়ে উঠে আসে। ওরা হেঁটে বেড়ায়। আমি ঘুমোতে পারি না। বারো বছর।এমনি করে নিদ্রাহীন রাত গুলো যায়। ঐতো মানিক,একগাল দাড়ি………ওই যে দৌড়ে আসছে অসংখ্য বুলেটবিদ্ধ বুক নিয়ে কিশোর টিটো,আর,আর ওইখানে সন্তর্পণে রক্তাক্ত বুকে নিঃশব্দে নৌকা চালিয়ে যায় তিতাসের মাঝি। আমি বেঁচে আছি। শুয়ে আছি ভাজহীন শুভ্র বিছানায়।আমার কষ্ট হয়। হাতের তালু ঘেমে ওঠে। পল্টনের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। বুকের ভেতরে একটা ঘুণপোকা ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে,ক্ষত তৈরি করতে থাকে।……….বেপরোয়া হয়ে ওঠে আসাদও। লাফ দিয়ে উঠে খুলে দেয় পূর্বের জানালা। দমকা হাওয়ার সাথে শাহারের রক্তের গন্ধ এসে নাকে নাকে লাগে আসাদের ১২ বছর পরও কেমন তাজা সে গন্ধ।নিদ্রাহীন আসাদ তখন জানালার বাইরে বাগানে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখে বিশাল তিনটি ক্ষত বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে শাহার হাসছে।
কেমন আছো।কেমন আছো তুমি মা’মনি।…..নিস্তব্ধ ছোট খালার বাড়িতে বসে ফতেহ তার সদ্যজাত কন্যাকে লিখে চলে,রাতের ঘড়িতে তখন দু’টো বাজার সংকেত। দূরের মহাসড়কে ট্রাক ছুটে যায়। কাঁপা কাঁপা হাতে আড়ষ্টভাবে ফটো লিখছে,আমি জানি মা’মনি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না,বড় হয়ে তুমি হয়তো নিঃশব্দে আমাকে করুণা করবে,তবুও তবুও আমি তোমাকে আমার পরাজিত পরিণতির কথা জানাবো। তুমি জানবে আমরা কেমন করে ‘৭১-এর যুদ্ধে জিতে হেরে গেলাম।জানবে……..।ফতেহা লিখতে থাকে তখন বুকের ভেতর হতে ক্রমশঃ সেইসব ছায়ারা বেরিয়ে এসে ফাতেহ’র ঘরে হেঁটে বেড়ায়,পাশে এসে বসে।সে পায়ের শব্দে পাশের ঘরে শাহাদাত উঠে বসে-বেলায়ত এলো নাকি।নয়নপুরের,মাটিতে যেখানে।যেখানে বেলায়েত গুলি খেয়েছিলো সেখানে কি কেউ শিউলি গাছ লাগিয়ে ছিল?কেন লাগালো না?
ঠিক তখন দিলু রোডে নিজের ঘরে হালকা আলোয় আলম পরিষ্কার দেখতে পায় রুমিকে। রুমি’র মাথা সামনে ঝুলে পড়েছে। বুক থেকে নিম্নগামী ক্ষিপ্ত রক্তের স্রোত। সে প্রবল স্রোতে ভেসে যায় মোজাইক করা মেঝে। রক্ত জমতে থাকে। আলম সেই রক্তবন্যার মাঝে দাঁড়িয়ে তার প্রিয় চাইনিজ এসএমজি’র জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।……. বাতাস তখন আন্দোলিত হয় গাছের পাতারা সব জীবন্ত হয়ে ওঠে। বাদল ইস্কাটনের তার তে’তলার বড় ছাদে অন্ধকারে চমকে ওঠে একটা হাসির শব্দে।সে হাসি আর কারো নয় খালেদ মোশাররফের। কপালে’র ওপর বিজয় তিলক নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে। বাদল ভাবে। বার বছরের সেই মেলাঘর কতদূর। আরও অনেক দূরে দিনাজপুরে পুনর্ভবা নদীর তীরে। ছোট চালাঘরে ফাহিম যুদ্ধাহত জমির জেগে থাকে। ঘুম নেই তার চোখে। ঘুম নেই কক্সবাজারের আফছারের চোখে, ঘুম নেই চট্টগ্রামের রফিকের চোখে, ঘুম নেই খুলনার খিজিরের চোখে, ঘুম নেই ফরিদপুরের মুরাদের চোখে,ঘুম নেই কুমিল্লার বাহারের চোখে….. ঘুম নেই… ঘুম নেই… ঘুম নেই রুমির মার আজাদের মা’র চোখে, ঘুম নেই আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওনে’র চোখে,ঘুম নেই বরিশালের নিজামের মা’র চোখে। বারটি বছর নিদ্রাহীন পাথরের মত চোখে ওরা এখনো প্রতীক্ষায় থাকে। অন্ধকারে আলগোছে দরজা খোলা রেখে সন্তানহারা জননী ঘরে একাকী জেগে থাকে ফিরে এলো বলে। জেগে থাকে স্ত্রী যদি ফিরে আসে তার শহীদ স্বামী। জেগে থাকে সন্তানেরা যদি ফিরে আসে তাদের জনক।নিদ্রাহীন চোখের পাতার নিচে সহযোদ্ধার লাশ। রক্তের রং লাল হয়ে ওঠে অন্ধকার ক্রমশ সবকিছু পরিষ্কার হয়ে ওঠে আলমের চোখে। ১৯৭১ সাল। জুলাই মাস সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা,একটি গাড়ি ছুটে যাচ্ছে দ্রুত ঢাকার রাজপথ দিয়ে। গন্তব্য ফার্মগেটে গাড়ির ভেতরে বসে আলম স্বপন,বদি,মায়া আর পুলু। আলমের হাতে প্রিয় চাইনিজ সাব-মিশন গান স্বপন আর বৌদির স্টেন,মায়া আর পুলুর হাতে গ্রেনেড।স্টিয়ারিং ধরে সতর্কতার সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছে সামাদ। রাস্তায় লোকজনের চলাচল রয়েছে। কোন কোন পথচারী হয়তোবা গাড়ি’র ভেতর ছয়জন তরুণকে চলতে দেখে একটু অবাকও হয় ঢাকায় এসময় এভাবে তো তরুণদের চলাফেরা করার কথা নয়। কিন্তু গাড়ির ভেতরের ছয়জন তরুণ অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে বসা। কোন রকম চিন্তা রেখা তাদের মুখে নেই আলম শেষবারের মতো সব হিসেব মিলিয়ে দেখা’র চেষ্টা করে। ফার্মগেটের সড়কদ্বীপ এর মাঝে পাকিস্তানি বাহিনীর তাবু। সামনে তিনজন সেন্ট্রি। আনুমানিক দশগজ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সার্বক্ষণিক প্রহরায়। আবার ভেতরে আরো নয়জন গত ক’দিন আলম স্বপন বদি ঠিক সড়কদ্বীপের পেছনে মিষ্টির দোকানে বসে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছে। তারপর মাত্র পাঁচজন গেরিলা নিয়ে স্বশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর একজন এমপি পোস্ট উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে গাড়ি ছুটছে গাড়ির ভেতর ওরা। পুনরায় যার যার দায়িত্ব বুঝে নিল আলমের দায়িত্ব তিনজন সেন্ট্রি স্বপন-বদি তাঁবুর ভেতরে পাকসেনা আর বুলু-মায়া গ্রেনেড ছুড়বে তাঁবুর ভেতরে।গাড়ির ভেতর ওরা সোজা হয়ে বসলো। ওইযে ফার্মগেট গাড়িটি সোজা এগোচ্ছে তেজগাঁও এদিকে ফার্মগেটের মরে গিয়ে ডানে ঘুরলো গাড়ি ওরা সবাই তাকাল সড়কদ্বীপে। আলম দেখল তিনজনের স্থলে দু’জন দাঁড়িয়ে ওদের চোখ পশ্চিমে।মনে মনে খুশি হল আলো দায়িত্ব কমে এলো মাত্র দু’জন!কথামতো গাড়ি থামলো হলিক্রস কলেজের সামনে। দ্রুত পায়ে হেঁটে গেল সড়কদ্বীপের দিকে,স্তম্বিত পথচারী ‘৭১-এর জুলাই।পাচঁজন তরুণ উন্মুক্ত রাজপথে অস্ত্রহাতেএকজন পৌর পথচারী চিৎকার করতে যেয়ে থেমে যায় কোনো দিকে না তাকিয়ে ওরা হে’টে যায় এদের লক্ষ্যে।সড়কদ্বীপে রেলিং-এর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ওরা।গর্জে ওঠে আলমের চাইনিজ সাব-মেশিনগান।অব্যর্থ লক্ষ্য। ঢলে পড়ে দু’জন সেন্ট্রি।ততক্ষণে স্বপন আর বদি’র স্টেনগান থেকে আবারও গুলি ছুটছে তাবুর দিকে।আলম এসে যোগ দিলে ওদের সঙ্গে কোনো রকম প্রতিরোধের সময় পেল না শত্রুবাহিনী।মাত্র নব্বই সেকেন্ডে শেষ হয়ে গেল অপারেশন।নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারল না পাচজন তরুণ একটি শত্রু ও বেঁচে নেই। ওরা পাঁচজন দ্রুতপায়ে দ্রুত গাড়িতে উঠলো ছুটে চলল হতচকিত পথচারী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল কেমন করে তাদের সন্তানেরা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। স্বাধীনতা প্রত্যাশী সেই পৌর আনন্দ অশ্রু মুছতে মুছতে বাড়ির দিকে রওনা দিলোঃ সবাইকে আজকের কথা জানাতে।এত বছর পরেও কি জীবন্ত সেই সব স্মৃতি। আলম ভুলতে পারেনা এক মুহূর্তের জন্য সাদামাটা গাড়িটি। ছুটছে গ্রীনরোড দিয়ে মাত্র একমিনিট আগে গাড়ি খতম করেছে ১১ জন পাকিস্তানী সৈন্য পেছনে ধাওয়া করেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর যে আলমের হাতি স্টীয়ারিং-এ কাঁপছে গাড়িতে বসা আর চারজন সহযোদ্ধার জীবন এখন তার হাতে যেভাবে হোক বাঁচাতে হব।ডান পাঁজরে এক্সিলেটরে চেপে ধরে আলম। স্পিড মিটার এর গতি ষাট ছাড়িয়ে যায় পেছনে সামরিক জীপ আরো প্রচন্ড গতিতে ছুটে আসছে ক্রমশ দুটো গাড়ির দূরত্ব কমে আসছে মাত্র ১০ গজের মধ্যে দু’টি গাড়ির মাজদা’র ভেতরে ওরা চারজন যুবক এবং মৃত্যুর জন্য তৈরী হয়ে নেয়।কিন্তু একজন ভাবছে অন্য কথা।সে রুমী। হঠাৎ করে তড়িৎগতিতে স্ট্রেনের বাট দিয়ে গাড়ির পেছনের ঝাচ ভেঙে ফেলে গুলি ছুড়ে পেছনের জীপটি’কে লক্ষ্য করে।অব্যর্থ গুলি সরাসরি জীপের চালকের খুলির ভেতর ঢুকে যায়। বেসামাল হয়ে যায় পেছনের জীপ।সোজা রাস্তার পাশের লাইটপোস্ট-এ গিয়ে আছড়ে পড়ে জীপ। তখন সামনের মাজদা অনায়াসে ঢুকে যায় ঢাকা শহরের হাজারো রাস্তার একটি দিয়ে।গাড়িটা আটকে গেলে ভাঙা রাস্তায়। পাঁচজন পাঁচটি স্টেনগান নিয়ে দৌড়ে গেল এলিফ্যান্ট রোডের দিকে।স্টেন ছেড়ে দিলে সমস্যা থাকে না। কিন্তু স্টেন ছাড়া চলবে না। ট্রাফিক লাইটে কয়েকটি গাড়ি দাঁড়িয়ে।রুমি দেখলো তার মায়ের গাড়ি।পাঁচজনই স্টেন ছুঁড়ে দিলো রুমির মায়ের গাড়িতে। রুমি দৌড়ে গেল একদিকে মা স্থিরভাবে বাড়ির দিকে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া আলম ভাবে-কেমন করে রুমি মরে গেলো যদিও কি নির্বিকার চলে গেলো। আমরা বেঁচে আছি ওদের জীবনের বিনিময়ে।বেঁচে থাকা কি এতই মূল্যবান? এভাবে বেঁচে থাকা ‘৮৪’র সফল ব্যবসায়ী সফল জীবনের অধিকারী আলম রাতের আধারে ক্রমশ স্মৃতির ভেতর ডুবে যায়। ডুবে যায় আসাদও।কি নিশ্চিত দিন ছিল ‘৭১-এর। স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু আজকে অনিশ্চিত দিন বসবাস আমাদের। শাহার মরে গেলে আসে। স্বাধীনতা কিন্তু কি অসহনীয় অসহনীয় মৃত্যু। শ শাহারের।ফার্মগেটের সেই ছোট্ট বাড়িতে অস্ত্র থাকতোমুক্তিযোদ্ধাদের।শাহার ছিলো সংরক্ষণের দায়িত্বে।ঢাকায় তখন একের পর এক অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিরা হন্যে হয়ে খুঁজছে মুক্তিযোদ্ধাদের।এক দিন খবর হয়ে গেল রাতের আধারে রাজাকারদের সহায়তায় সন্তর্পণে পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করল সেই বাড়িটি।শাহার আর তার চার ভাই শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করে শহীদ হলো।দুদিন পর শাহার আর তার তিন সহোদর এর লাশ।রক্তাক্ত মেঝে।
সারা শরীর গুলিতে ঝাঁঝরা আর সবার হাতে ধরা এস. এল.আর।আসাদের চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে ওঠে দ্রুত বের হয়ে আসে। ফার্মগেটের সেই বাড়ির উঠোনে চার ছেলের লাশ শুইয়ে দিয়ে তাদের জনক এখনো জেগে থাকে। বারো বছর নিদ্রাহীন পাথরের মতো চোখ কোন অভিযোগ নেই সেই চোখে।আসাদ আর কখনো সে বাড়িতে যায়নি যেতে পারেনি কারণ শাহার এর বাবা-মার কি জিজ্ঞাসা আসাদ জানে । সে জিজ্ঞাসার উত্তর আসাদের জানা নেই। আসাদ শুধু জানে শাহারের জীবনের বিনিময়ে সে বেঁচে আছে। বেঁচে-থাকাটা অলৌকিক মনে হয় একাত্তরের নভেম্বর বায়তুল মোকাররম নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও আসাদ বায়তুল মোকাররমের ব্যর্থ অপারেশন কি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করল। বায়তুল মোকাররমের সার্বক্ষণিক প্রহরায় দুটি পাকিস্তানি লড়ি মার্কেটের পশ্চিম পাশে দাঁড়িয়ে থাকে দলের সিদ্ধান্ত দিনের আলোতে সৈন্যদের হত্যা করতে হবে।এতে করে শত্রুবাহিনীর মনোবল কমবে এবং দেশবাসীর মনোবল বৃদ্ধি পাবে।যদিও এতে লোকক্ষয় সম্ভাবনা আছে তবু সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। সকাল বারটায় অপারেশন করার কথা এগারোটার দিকে জাহেদ আরিফ একটি গাড়ি হাইজ্যাক করে আনলো। গাড়িতে বসানো হলো লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ। অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হলো ফেরদৌস,আরিফ,জাহিদ,ফিরোজ আর সোহেলের ওপর।আসাদ সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে থাকবে পরিকল্পনার। আরিফ গাড়ি চালিয়ে নিয়ে নির্দিষ্ট পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীরলোরির পাশে রাখে। অন্যরা দ্রুত হাতে চার্জ বসালো গাড়িতে।ফিউজে আগুন দিলো।দেড় মিনিটের ফিউজ।দেড় মিনিট পরে প্রলয়ংকারী শব্দে চৌচির হয়ে যাবে গাড়িটি। আকস্মিক মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়বে লরিতে বসে থাকা আশপাশ ইতস্ততঃ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত্রু সৈন্য।ওরা কজন গেরিলা ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নেমে। মার্কেটের দিকে এগিয়ে গেল এক,দুই,তিন মিনিট কই প্রচন্ড বিস্ফোরণ তো হলোনা!গাড়িটি তেমনি দাঁড়িয়ে আছে ৫ জন গেরিলা যাদের বয়স ১৬ বছরের কোঠায়। সশস্ত্র হয়ে। উঠলো দ্রুত বায়তুল মোকাররম ত্যাগ করলো ব্যর্থতা নিয়ে।আর ভেতরে আলোচনায় বসলো ওরা।ক্ষুব্ধ আসাদ তার অনুজ যোদ্ধাদের তীক্ষ্ণ কন্ঠে তিরস্কার করলো। ওরা সবাই চুপ হয়ে থাকলো।সময় পেরিয়ে যাচ্ছে কি করা যায় সিদ্ধান্ত হলো অপারেশন করা হবে।গাড়ির ভেতর রাখা বিস্ফোরক কোন ভাবেই হাত ছাড়া করা যাবে না।এবার আসাদ যাবে।দ্রুত ওরা পৌঁছালো বায়তুল মোকাররমে। গাড়িটি তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে সাদা ধোঁয়া কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে।আসাদ এগোচ্ছে গাড়িটার দিকে। আসাদের মনে পড়ে যায় সুবেদার কিবরিয়া নির্দেশঃ’একবার ব্যর্থ হলে সে বিস্ফোরকে কোন অবস্থাতেই হাত দেওয়া যাবে না কারণ যেকোন মুহুর্তে অঘটন ঘটতে পারে’ কিন্তু এখন গেরিলার কাছে বিশেষ করে ঢাকা শহরে একছটাক বিস্ফোরক জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান। শেষবারের মতো আরিফ বললো-আসাদ ভাই আমরা যাই,আপনি এখানে দাঁড়ন।আসাদ না করলো ওদের শরীর টা সোজা করে দৃপ্ত পা’য়ে সে হেঁ’টে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে বসল। সব ঠিক আছে কোনো ভুল নেই। শুধু ফিউজ তার অর্ধেক জ্বলে নিভে গেছে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ফিউজ টা কেটে ছোট করলো আসাদ মেপে দেখল মাত্র ২০ সেকেন্ড লাগবে এবার বিস্ফোরণ ঘটতে।হিসেবে করলো আসাদ গাড়ি থেকে বেরিয়ে মার্কেটের ভেতর পৌঁছতে পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগতে পারে।সুতরাং কোনো অসুবিধা নেই।বাইরে তাকালো আর দেখল শত্রু সৈন্য নির্বিকার।ফিউজ এর মাথা কেটে ম্যাচের কাঠি ঢুকিয়ে ডান হাতে ম্যাচ দিয়ে ঘষতে গিয়ে দেখল গাড়ি থেকে মাত্র দশগজ দূরে ওর মা আর নানী দাঁড়িয়ে কি যেন কিনছে। আঁতকে উঠল আসাদ। কি করবে কি করবে সে কি নিশ্চিত মৃত্যু হবে তার মা এবং নানীর। সে কি বাদ দিবে অপারেশন।মুহূর্তের জন্য দ্বিধায় পড়ে যায় আসাদ। একদিকে পরমাত্মীয় অন্যদিকে স্বাধীনতা। জয় হল স্বাধীনতার আসাদ ম্যাচটি ঘষে দিলো জ্বলে উঠল আগুন। ফিউজ ধরে আসাদ বসে রইলো। নিশ্চিত হয়ে তবে গাড়ি থেকে নামবে।আর মাত্র দশসেকেন্ড।আসাদ তাকালো তার মা’র দিকে দেখলো মা কেনা শেষ করে মাএ চলে যাচ্ছে ভেতরের দিকে। দ্রুত নামলো আসাদ।আর মাএ সাত সেকেন্ড।ক্ষিপ্ত গতিতে হেঁটে ঢুকলো মার্কেটের ভেতর।প্রচন্ড শব্দে বিস্ফারণ।মানুষের চিৎকার ছুটোছুটি আর ধোঁয়ার ভেতর আসাদ স্পষ্ট দেখতে পেল ছড়িয়ে-ছিটিয়েশত্রুর লাশ।
…… ফতেহ লিখে চলে তার পরাজিত পরিণতির কথা।ক্রমশ চিঠির কালো অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে ওঠে এবং একসময় তার ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইহয়ে হয়ে যায়।ফতেহ দেখতে পায় রাস্তার কালো পিচের উপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে বুলেটবিদ্ধ মুক্তার।১৯৭৩ সাল। স্বাধীনতার মাত্র দুই বছর পর কি নিদারুণ পুরস্কার একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য। কি করুণ পরিণতি একজন মুক্তিযোদ্ধার।যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে সেদেশের নিরাপত্তারক্ষীর হাতে নিহত হতে হয় মুক্তারের মতো হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা।কি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিল মুক্তার।যাত্রাবাড়ীর সেই রক্তাক্ত যুদ্ধ।চারজন পাকিস্তানী কমান্ডোকে হত্যা করে মুক্তার ফতেজএবং তাদের সহযোদ্ধারা। তারপর পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনী আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত এক বিশাল বাহিনী বিমান বাহিনীর আক্রমণের ছত্রছায়ায় যাত্রাবাড়ীতে পাঠায়। সেদিনের লড়াই বীরত্বের সঙ্গে লড়ে মুক্তিযোদ্ধা এবং গ্রামবাসী।অকল্পনীয় সাহস নিয়ে যুদ্ধ করেছিল মুক্তার। কোন অবস্থাতেই তাকে ঠকিয়ে রাখতে পারছিল না ফতেহ ঝাকে ঝাকে গুলি ছুটে আসছে শত্রুর অস্ত্র হতে তার ভেতর দিয়ে বিচিত্র অথচ ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যাচ্ছে মুক্তার।অবলীলায় একের পর এক শত্রু খতম করছিলো সে।শত্রুসেনাবাধ্য হয় পিছু হটতে ফতেহর পরিষ্কার মনে পড়ে একবার প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে হঠাৎ আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে আপনি মরতে চান কেন?আপনি শিক্ষিত লোক ইউনিভারসিটিতে পড়েন আর আমাগো মতো অশিক্ষিত আগে মরতে দেন আপনারও তো আছেনই। মুক্তাএ যুদ্ধ করে শহীদ হতে পারেনি শত্রু সৈন্যের কোনগুলি তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।দুর্ভাগ্য স্বাধীন দেশে তাকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয় ‘৭৩ সালে। ফতেহ কিছুই করতে পারেনি। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে এসেছিল মুক্তার। হাতে দু’টি লুঙ্গি এনেছে তার জন্য। সে জানায় এই লুঙ্গি ১০টাকার বেশি দাম হয় না কিন্তু বেচতে হয় ৩০ টাকায় ৩০ টাকার লুঙ্গির জন্য দেশ স্বাধীন করেছি? পড়ে ফতেহ শুনেছিল তাঁতিদের সুতা দিত এমপিরা ঘুষের বিনিময়ে। অথবা যোগ দিতে হতো আওয়ামী লীগের ঠ্যাঙ্গারে বাহিনীতে।

প্রতিবাদী মুক্তিযোদ্ধাদের মরে যেতে হয়।স্বাধীন দেশে মুক্তার ও এর ব্যতিক্রম নয়। তাহলে স্বাধীনতা কি?স্বাধীনতা কেন? ফতেহা কাঁদে ঝাপসা হয়ে চিঠির অক্ষর। স্বাধীনতা এলে সহযোদ্ধাদের মরে যেতে হয় স্বাধীনতা পাবার জন্য বদি, রুমি,আক্তার,জুয়েলের মরে যেতে হয়।

তখন ময়মনসিংহ রোডে পলি ক্লিনিক। গভীর রাতে ডঃ আজিজের কাঁধে মাথা রেখে তার স্ত্রী ডঃ সুলতানা কি ডুকরে কেঁদে ওঠে আমরা তো মরিনি জুয়েল কেন মরে গেল?নিদ্রাহীন স্বামী-স্ত্রী ক্লিনিকের বারান্দায় বসে ঝাপসা চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এমনি এক অন্ধকার রাতে একাত্তরের আগস্টে জুয়েল এসেছিল ডঃ আজিজ-এর কাছে তখন এলিফ্যান্ট রোডে পলি-ক্লিনিক।জুয়েলেরহাতে গুলি লেগেছিল হাতের আঙ্গুল ছিড়ে বেরিয়ে গেছে গুলি।রক্তাক্ত একটা নেকড়া পেঁচানো সেই হাতে। সিদ্ধিরগঞ্জে অপারেশন করতে যে আঘাত পায় জুয়েল। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন তখন শত্রুর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি।সেখানে হামলা চালিয়েছিল জুয়েল।নৌকার গুলুইয়ের ওপর এল.এম.জি নিয়ে বসে ছিল জুয়েল মৃত্যুভয়হীন যোদ্ধার মুখ দেখে আনন্দে ফুলে উঠেছিল নদীর পানি। ডাক্তার সুলতানা ও ডাক্তার আজি স্নেহের সাথে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিল জুয়েলের হাতে।ঢাকার অনেক আহত যোদ্ধাই যেতো এলিফ্যান্ট রোডের পলি ক্লিনিকে আর ওরা স্বামী-স্ত্রী দুজন নির্ভযয়ে সেবা করে যেত সবাইকে। সাবধানে গোপনে। সবাই হয়তো বেঁচে গেছে বাঁচেনি দু-একজন।নয়ন পায়ে গুলি নিয়ে এসেছিল ছোট্ট ছেলেটি পার্টি কেটে ফেলে দিতে হল।তিন দিন পর মারা গেল ছেলেটি। আর একজন জুয়েল ঢাকার মাঠে চৌকস ক্রিকেটার জুয়েল হাতে গুলি লাগার কদিন পরে ধরা পরল শত্রুর হাতে অমানুষিক নির্যাতন মুখ বুঝে সহ্য করেছিলেন।একবারও বলেনি কে আছে,তার সঙ্গী কারা,কারা তাদের ব্যান্ডেজ করে দেয়।নির্যাতনে আসাদ মরে যায় কিন্তু একবারও মুখ খোলেনি। ওদের জীবনের বিনিময়ে বেঁচে থাকা ডাক্তার আজিজ আর সুলতানা এখনো রাতের অন্ধকারে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে শাহাদাত চৌধুরী বেলায়েতের জন্য। সুবেদার বেলায়েত পর দিন আসবে বলে আসেনি। এসেছিল তার মৃতদেহ।এখনো প্রতিটি রাত অপেক্ষায় থাকে এই বুঝি এসে বলে সাংবাদিক সাহেব এখন না লেখেন,পরে লিখবেন এখন ডাইরিতে লিখে রাখেন আমাদের কথা।
‘৭১-এর শালদা নদী।রক্তাক্ত যুদ্ধ ফ্রন্ট।শালদা নদী স্টেশন দখল করতে হবে। দুবার বড় আকারের হামলা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যর্থ হয় শালদা নদী স্টেশন দখল করতে।এখানেই কর্নেল খালেদ আহত হন কয়েকদিন পর।কিন্তু শালদা নদী থেকে যায় শত্রু দখলে।
৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন গাফফার কর্নেল খালেদের ইচ্ছে কার্যকর করতে শপথ নেয়।
‘৭১-এর অক্টোবর মাসের শেষে গাফফার সালদানদী আক্রমণ পরিকল্পনা করে সুবেদার ওয়াহাব কি দিয়ে।
সুবেদার ওয়াহাব যার নাম যুদ্ধের সময় ছিল গল্পের মত।
ছোটখাটো মানুষ মুখে দাড়ি ফোর্থ বেঙ্গলের পুরনো লোক। নয় মাস যুদ্ধে তাকে বিদেশের মাটিতে নিতে পারেনি দেশের ভেতর ঘাটি বজায় রেখে যুদ্ধ করে গেছেন।যার বর্ণনা দেয় আলমঃ মানুষটাকে এল.এম.জিটা বড় এল,এম,জির চেয়ে বড় কলিজাটা।বিশাল হৃদয়ের সুবেদার ওয়াহাবের চার্লি কোম্পানির সরকারি সুবেদার বেলায়েত চোখের।পাতা নেমে এলে চোখের সামনে দেখতে পায় ভোড় চারটায় ফায়ার ওপেন করে ডান দিক থেকে চার্লি কোম্পানি বা দিকে ব্রেভো।পেছন থেকে গোলআ নিক্ষেপ শুরু করে প্রথম মুজিব ব্যাটারি।টে টাল এ্যামাকের চেহারা। কিন্তু এরই ফাঁকে একুশজনের দল নিয়ে চার্লি কোম্পানির ব্যাংকার থেকে ধানক্ষেতে পাকিস্তানি মেশিনগানের ছাতার নিচে মাথা নামিয়ে আলের আড়ালে মাটি কামড়ে একটি আর,আর সহ নেমে যায় সুবেদার বেলায়েত।
যুদ্ধ চলছে শাহাদাত দেখতে পায় চার্লি বাঙ্কার থেকে বেলায়েত যাচ্ছে।যাচ্ছে অসীমসাহসী একুশজন এবং বেলায়েত একটু একটু করে ওরা এগুলো। ডিঙ্গিতে শালদা নদী পার হল এক ধাক্কায়। বেলা দুটোর দিকে আর,আর পৌঁছে গেল ২৫ গজের মধ্যে।স্টেশনের লাল দালানের পেছনে।
ফায়ার করল আর,আর। এগারোটা গোলা মেরেই মুক্তিযোদ্ধারা দৌড়ে গিয়ে বাংকারের ভেতর ফেলল গ্রেনেড। দখলে এল শালদানদী স্টেশন।

রাতে শাহাদাতের সঙ্গে দেখা হলো বেলায়েতের। বেলায়েত বলল কাশেম গুলি খেয়ে পড়ে গেলে বুঝলাম আমর ফেরার পথ নেই।
সুবেদার বেলায়েত বলেছিল ‘কথা আছে’ কাল রাতে দেখা হবে। এখন ঘুমান।
পরদিন দুপুরে খবর এলো বেলায়েত শহীদ হয়েছে নয়নপুরে।রেফি করতে গিয়ে।
কথা দিয়েছিল পর দিন আসবে কিন্তু বেলায়েত এলো না। এলো তার লাশ।
শাহাদায়এখনো দেখে বেলায়েতকে এগিয়ে যাচ্ছে একুশজন নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ভাঙতে।ট্রিগারে শাহাদাতের আঙ্গুল থেমে যায়। একুশজন এগিয়ে যাচ্ছে।….. এখন রাত ঘুম নেই দেখে, এগিয়ে যাচ্ছে সেই ২১জন। যার সামনে সুবেদার বেলায়েত। এদিকে বেইলি রোডে মিনু হঠাৎ চমকে ওঠে। পা’হীন খালেককে দেখে। শুকনো কাঠের মত শরীর। না খালেক নয়।ভুল ভাঙ্গে মিনুর। খালেক চতুর্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের জোয়ান সুঠাম দীর্ঘদেহী প্রথম এসেছিল গলায় গুলি নিয়ে সেক্টর-২-এর ফিল্ড হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিল আবার যুদ্ধে।পুনরায় যখন এলো তখন তার পায়ের হাড় গুড়িয়ে গেছে গুলিতে। গভীররাতে অপারেশন করল ডাঃ জাফরুল্লাহ ডঃ মোবিন। সহযোগিতা করল মিনা,লুলু,টুলু,পদ্মা,অনুপমা-সব সাধারণ মেয়েরা। পাটা কেটে ফেলতে হলো।টর্চ হারিকেন হ্যাজাক দিয়ে দক্ষতার সাথে অত্যন্ত নিম্নমানের যন্ত্রপাতি দিয়ে অপারেশন করলেন ডঃ মোবিন এবং ডঃ জাফরুল্লাহ।মিনু ভাবে কি করে সম্ভব হয়েছিল সেদিন সব জটিল অপারেশন সীমিত যন্ত্রপাতি দিয়ে। কিভাবে সম্ভব হয়েছিল তার মত পুলু, টুলু,পদ্মা, অনুপমার মত মেয়েদের ঘর ছেড়ে যুদ্ধে যোগ দেওয়া।আজ কি সম্ভব?হয়তো সম্ভব নয়।সম্ভব স্মৃতিচারণ।অপারেশনের পর ক্রমশ শুকাতে লাগলো সুঠামদেহী খালেক। এক সময়ে শুকিয়ে লতার মতো হয়ে গিয়েছিল খালেক।মিনু আর যেতে পারেনি সেই মৃত্যুমুখী মুক্তিযোদ্ধার সামনে। কে জানে খালেক বেঁচে আছে কিনা।বিশালদেহী মানুষটা পংগু নামে পরিচিত কিনা।ডাক্তার মোরশেদ জানে নিশ্চিত বেঁচে আছে মোসলেম।যার বাঁচার কথা ছিল না।বাঁচানো গেলোনা সিরাজকে যার মরে যাওয়ার কথা না।আশ্চর্য মুক্তিযোদ্ধারা।মৃত্যুর জন্য কেমন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।ফিল্ড হাসপাতালের সেইসব দিনগুলো কেমন উজ্জ্বল আজো ডঃমোরশেদের চোখে।
কি অবলীলায় ছুটে এসেছে লন্ডন থেকে ডাক্তার মোবিন, ডাক্তার জাফরুল্লাহ।ঢাকা থেকে এসেছে ডাক্তার নাজিমুদ্দিন। লুলু, টুলু, রেশমা, আসমা, পদ্মা, খুকু,অনুপমা সব কিশোর উত্তীর্ণ মেয়েরা। কেমন করে, কিসের ডাকে,কোন সে ভালোবাসায়, ঘর ছেড়ে, পিতা মাতাকে ছেড়ে এসেছে ফিল্ড হাসপাতালে।ডাক্তার মোরশেদ তখন মেডিকেলের ছাত্র।আরও এসেছিল শামসুদ্দিন মেডিকেলের ছাত্রী ডালিয়া।সবাই কেমন করে কিসের টানে একটি পরিবার হয়ে গেল।বাসের ছাপরা দিয়ে তৈরি হলো ছোট ছোট টিলার উপর হাসপাতাল।চারদিকে লিচু আর কাজু বাদামের বাগান। স্মৃতি, স্মৃতি,আরস্মৃতি,স্মৃতিভারাক্রান্ত হয়ে যায় মোরশেদ। ক’টি কুড়িয়ে পাওয়া অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি,হারিকেন টর্চ দিয়ে নিপুণভাবে একেকটি অপারেশন চালিয়েছেন ডাক্তার মোবিন, ডাক্তার জাফরুল্লাহ।আশ্চর্য, মৃত্যুপথযাত্রী মুক্তিযোদ্ধা বেচেছে আরও কতো মরেছে হিসেব নেই। মাঝে মাঝে রাতের অন্ধকারে চোখের পাতার ভেতর ওদের ছায়া নড়ে ওঠে….।
সিরাজ আর মোসলেম দুজন আহত মুক্তিযোদ্ধা এসেছিল শালদানদী থেকে। ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে এরা যুদ্ধ করছিল সিরাজের বুকের খাচা গুলিতে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল।তবে হার স্পর্শ করেনি।মোসলেমের বুকের উপরেরদিকে সরাসরি গুলি লেগেছিল।মুসলিমের অবস্থা সঙ্কটজনক।যেই ধরনের সেবা ব্যবস্থার প্রয়োজন।সে ধরনের ব্যবস্থা ফিল্ড হাসপাতাল সম্ভব নয়।সিরাজের হাড় স্পর্শ করেনি গুলিটি শুধু মাংস ছিঁড়ে গিয়েছিল।অতএব সিরাজ বিপদমুক্ত কিন্তু পরদিন ভোর বেলায় হতবাক সব ডাক্তার র মুক্তিযোদ্ধাদরা দেখলো সিরাজ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।মোসলিম বেঁচে আছে। এবং বেঁচে গেল। সিরাজের কবর হলো।কিন্তু মোসলেম যে আহত হয়ে বেঁচে গেলো সে কোথায়?জানেনা কেউ জানেনা! বেঁচে আছে কি মরে গেছে।জানেনা সে কিশোরটি নাম-না-জানা ১৪ বছরের বালকটি যার হাতে গুলি লেগেছিল সে এখন কোথায়, কেমন আছে? পরিষ্কার মনে পরে মরশেদের সেই কিশোরের মুখ।অবাক,অবাক লাগে মোর্শেদের। সেই ছেলেটি এলএমজি চালাত।এলএমজি চালাতে গিয়ে হাতে বিঁধেছিল গুলিটি।তরল রক্তে ভিজে যাচ্ছে শরীর কিন্তু ছেলেটি হাসছে- হাসছে আর হাসছে।সে হাসি এখনো মোর্শেদ রাতের অন্ধকারে শুনতে পায়। বারো বছর এখনো সেই হাসি তেমন অম্লান।
ডাক্তার জাফরুল্লাহ লন্ডন থেকে নিয়ে এসেছিলেন অনেক যন্ত্রপাতি তার জন্য সম্ভবত অনেক কঠিন অপারেশন। এ হাসপাতাল এ কত জন মুক্তিযোদ্ধার পা হাত কাটা গেছে বাদ দিয়েছেন ডাক্তার জাফরুল্লাহ এখন যখন ঢাকা শহরের রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেন অনবদ্য ঘুম নেমে আসে তন্দ্রার ঘোরে তিনি কি দেখতে পান সেইসব হাত পা?তারা কি তাকে জিজ্ঞেস করে স্বাধীনতার কথা?

কি জবাব দেন তখন ডাক্তার জাফরুল্লাহ?
ডাক্তার মোবিন তো ইংল্যান্ডের কেন্টে পালিয়ে থাকেন। ডাক্তার কামরুজ্জামান রাজনৈতিক ব্যাখ্যা করতে করতে ক্লান্ত।ক্যাপ্টেন ডাক্তার আখতার যুদ্ধের শুরুর দিকে আঙুল দিয়ে টেনে বের করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের শরীর থেকে বুলেটে।সে বুলেট কি গভীর রাতে যোদ্ধারা এসে ফেরত চায় না? একটি বুলেটই শেষ করেছিল বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর কে।ভুলতে পারেনা নায়লা।ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর পাকিস্তান থেকে এসে যোগ দিয়েছিল সেকক্টর-৭-এ।নায়লাওই সেক্টরেই নার্সিং করত।কিন্তু জাহাঙ্গীরকে নার্সিং করতে পারেননি। একটি গুলি তার জন্য নির্ধারিত হয়েছিল।লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরা আদর্শবাদী মানুষটির চোখ বুজলেই দেখতে পায় না সে।জানে পাশেই জেগে আছে আর মুক্তিযোদ্ধা স্বামী বাদল তারও চোখে ঘুম নেই।
বাদল কি করে ভুলে যায় ক্যাপ্টেন হায়দারকে?…. টেন্টের ভেতর গভীর রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে হায়দার স্কেল ফেলে ঢাকার ম্যাপ এ হিসেব করছেন।লাল পেন্সিলে চিহ্ন দিচ্ছেন।নভেম্বরের আগে ঢাকার চারদিকে তৈরি করতে হবে বেস্টনী।এখানে মানিক এখানে গাজি, এখানে সিরাজ, এখানে জাকি। জাকি ঢাকার ছেলে ঢাকাতেই করতে চেয়েছিল গেরিলা দল কিন্তু পারল না।
অম্লান জাকিরের স্মৃতি।বাদল তাকিয়ে থাকে ইস্কাটনের আকাশে তখন নিশাচর পাখির আনাগোনা সফল পিতা আর সফল জীবনের অধিকারী বাদল অস্থির হয়ে ওঠে।সব কিছুকে তুচ্ছ করে ফেলে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে মেলাঘরে বস। কসবার শালদানদী ঐতো শালদানদী ২ নং সেক্টরে ভয়াবহ যুদ্ধের স্থান। জাকিসহ কত যোদ্ধার লাশ সে মাটিতে শোয়ানো রয়েছে।জাকির ঢাকার গোপীবাগের ছেলে। এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধার নাম জাকির। সম্মুখে সময় পাকিস্তানী বাহিনীকে পর্যদুস্ত করে ফেলেছে জাকিরেরা।এমন সময় জাকিরের এক সহযোদ্ধাকে আঘাত করে বসল বুলেট।জাকিরের কয়েকগজ সামনে যন্ত্রণায় কাতর সহযোদ্ধার শরীর।জাকিরের নাম ধরে ডাকে। ওকে বাঁচাতে হবে জাকির এলএনজি ট্রিগার হাতে রেখেই দেখি বানকার থেকে উঠে এলো।সহযোদ্ধার দেহ পিঠের উপর তুলে নিয়ে ফিরে আসবে জাকির এমনসময় শএুর একটি গুলি ঘাড়ে এসে লাগলো। তবুও জাকির এগিয়ে আসছে জাকির ফিরে আসে। ফিরে আস সহযোদ্ধাকে নিয়ে।কিন্তু জাকিরের দেহ ক্রমশ নিস্তেজ হতে থাকে।তার শরীরের রক্তে সালদানদীর সবুজ ঘাস লাল হয়ে যায় জাতির নিস্তেজ হয়ে যায় নিঃসাড় হয়ে যায়। সকল সহযোদ্ধাদের করুন প্রার্থনা কে উপেক্ষা করে মৃত্যু এসে নিয়ে যায় তাকে। শালদানদীর বিদ্রোহী মাটি জাকির কে বরণ করে গর্বের সাথে।জাকিরের জীবনের বিনিময়ে বেঁচে যায় সহযোদ্ধা’।কিন্তু যাকে তুমি কি নিশ্চিত যে যাকে তুমি জীবনের বিনিময়ে বাঁচিয়েছে সে আজ এই স্বাধীন দেশে বেঁচে আছে? কারন স্বাধীনতা এসে গেলে তো মুক্তিযোদ্ধাদের মরে যেতে হয়।খালেদ তো তোমাকে বলেছিলঃস্বাধীনদেশ গেরিলাদের ভালোবাসে,মৃত গেরিলাদের।
প্রতিদিন প্রতিদিন শাওন ভাবে কেন তার বাবা ফিরে এলোনা?কেন তার বাবা বেঁচে নেই? সে জানে তার বাবা কত বড় ছিল।ওই বিশাল আকাশের মতোই। বিশাল আকাশের মত ছিল আলতাফ মাহমুদ। না, হলে কি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো….’ গান নির্মাণ করতে পারতেন? না হলে কি পাকিস্তানের বর্বর নির্যাতনের মুখে একটি কথা উচ্চারণ না করে শহীদ হতে পারতেন!!
আলতাফ মাহমুদের বাসায় তখন ঢাকায় গেরিলাদের অস্ত্রভাণ্ডার। সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলিতে আলতাফ মাহমুদ অবলীলায় সেগুলো নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রেখে রাতভর পাহারা দিতেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাকের মূলত যোগাযোগ করেছিলেন আলতাফ মাহমুদের সাথে।ছোটখাটো বাকের যে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক্সপ্লোসিভ দিয়ে আঘাত হেনেছিল আগস্ট মাসের বিশ্ববাসীর বিশ্বাস আনতে সাহায্য করেছিল সেই অপারেশনটি আমাদের যুদ্ধের উপর।সেই বাকেরও শত্রুর হাতে ধরা পড়ে নিহত হলো।হাফেজ ভাইও মরে গেলেন। শিল্পী হাফেজ ভাই- আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে এ কাজে এসেছিলেন। তাকে পাকিস্তানি বাহিনী তার ঘরে গুলি করে তাদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিল লরিতে। তুলে অত্যাচার চালায় তারা ওদের উপর। সবচেয়ে বেশি নির্যাতন চালিয়েছিল আলতাফ মাহমুদের ওপর।আলতাফ মাহামুদ সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে কারো নাম উচ্চারণ না করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।যে সুর এদেশকে করেছে প্রতিবাদী সেই প্রতিবাদের সুর চলে গেলেন জীবনের সব উপেক্ষা করে।
ঘুম নেই মাহবুবের চোখে মাহবুব এখন ডিআইটি। ডিআইটি চূড়ায় বসে আকাশ দেখে। দেখে স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাস থোকা-থোকা লোক মাহবুবকে’৭১-এ ডিআইটি আব টেলিভিশন ভেঙে দিতে চেয়েছিল সেই এখন ডিআইটির চূড়ায় বসে থাকে নিঃসঙ্গ একা
‘৭১- এর মাহবুব এরকম নিঃসঙ্গ ছিলনা। সে ছিল টগবগে তরুণ কাজ করতো ডিআইআইটিতে।তার উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় টেলিভিশন অচল করে দিতে এবং ডিআইটি গুঁড়িয়ে দিতে।পরিকল্পনা অনুযায়ী মাহবুব, বাবু আর ফেরদৌস এক আউন্স দুই আউন্স করে এক্সপ্লোসিভ ডিআইটির অভ্যন্তরের নিয়ে যেতো। মাহবুব ছিল মূল দায়িত্বে। সে সময় প্রায় কম্পানি পাক সেনা টেলিভিশনের পর্দায় নিয়োজিত ছিল। প্রায় পাঁচটি তল্লাশি অতিক্রম করে ঢুকতে হয় মাহবুবকে। কোন দিন জুতার ভেতরে পায়ের পাতার নিচে লুকিয়ে, কোনদিন মানি ব্যাগের ভেতর চ্যাপ্টা করে কোনদিন মিথ্যা। ব্যান্ডেজ করে ব্যান্ডেজ এর ভেতর লুকিয়ে ডিআইটির ভেতরে ঢোকাতে লাগল মাহবুব।কথা মতো টেলিভিশন টাওয়ারের নিচে শুয়ে ফেরদৌস নির্ভুলভাবে এঁকেছে টাওয়ারের ছবি। টেলিভিশনের জন্য ব্যবস্থা করা হলো। মূল পরিকল্পনা ছিল ডিআইটি চূড়া টিভি টাওয়ার এবং ডিআইটি এয়ার রুমে একই সাথে বিস্ফোরণ ঘটানো হবে।অকেজো হয়ে যাবে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর টেলিভিশন।বিস্ফোরণ করতে হবে।মাহবুবের পরিকল্পনা অনুযায়ী তিন তালার একটি ফাইল রেকের পেছনে পেছনে লুকিয়ে রাখছে বিস্ফোরকএতো কিছুর পরও কেমন করে জানি সন্দেহ হলো পাকিস্তানি বাহিনীর। হঠাৎ একদিন সকালে প্রতিটি মানুষকে তল্লাশি কারা শুরু করলো। সশস্ত্র মাহবুব সময় নেওয়ার অভিপ্রায়ে বিস্ফোরকদ্রব্য (প্রায় পাঁচ পাউন্ড) পাঁচতলায় নিয়ে গেল তারপর দ্রুত অফিস থেকে বেরিয়ে নয়া পল্টনে ওদের অস্থায়ী ক্যাম্পে চলে আসে দ্রুত আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো কোনো অবস্থাতেই বিস্ফোরক শত্রুর হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। বরঞ্চ যেখানে যেভাবে আছে সেখানে সে অবস্থায় বিস্ফোরণ ঘটানো হোক।পূর্ব পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেল মাহবুব দ্রুত ফিউজ এবং ডেটোনেটর নিয়ে চলে গেল। চতুরতার সঙ্গে নির্বিকার মাহবুব ঢুকে পড়ে গিয়ে ডিআইটিতে।তারপর চার্জশিট করে ফিউজ এর আগুন দিয়ে শিস দিতে দিতে বেরিয়ে এলো মাহাবুব স্টেডিয়ামে। আড়াই মিনিটে ফোতার কথা। ফুটছে না কেন?মনে হচ্ছে আড়াই বছর সময় নিচ্ছে।অস্থির হয়ে ওঠে মাহবুব।পাকিস্তানিরা তল্লাশি চালাচ্ছে দেখে এসেছে শেষ পর্যন্ত কি সফল হবেনা এক গ্লাস পানি পেলে…….হঠাৎ প্রচন্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ঢাকা শহর।ডিআইটি মনে হচ্ছে ভেঙে পড়বে এক্ষুনি!ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে আকাশ বীতশ্রদ্ধ মানুষ পালাচ্ছে যে যেদিকে চোখ যায়! কিন্তু মাহবুব নিচেরদিকে সোজা উত্তর দিকে হাঁটতে থাকে। পাশ দিয়ে লোকজন উত্তেজিত আলোচনা করতে করতে ছুটছে। মাহবুব মুচকি হাসে।কেউ জানে না জানার কথাও নয়! এখন মাহবুব ভাবে কিছুইতো ভাঙ্গা যায়নি কিছুই তো বদলায়নি সবতো তেমনি আছে। তাহলে স্বাধীনতা কোথায়? স্বাধীনতা কি? স্বাধীনতা কেন? নিদ্রাহীন মাহাবুব তার নারিন্দার ছোটবাসায় ১০ মিলিগ্রাম ঘুমের ওষুধ হাতে বসে থাকে।
বসে থাকি আমিও। ঘুমাতে পারি না। চোখ বুজলে আলো-আঁধারিতে চোখের পাতার কোলঘেঁষে নিঃশব্দে নৌকা চালিয়ে যায় তিতাসের নাম-না-জানা মাঝি
বুকে হতে তার ঝরছে রক্ত দামি তিতাসের নাম-না-জানা মাঝে জীবনের বিনিময়ে বেঁচে আছি। আমার বুকে লাগতে পারতো।আমাকে এক ধাক্কায় নৌকায় শুইয়ে দিয়ে নিরাপদ জায়গায় দ্রুত নৌকা নিয়ে যাচ্ছিল। অন্ধকারে এক ঝাক গুলি অকে পানিতে ফেলে দেয়। আমি অন্ধকারে তার রক্ত পানিতে মিশতে দেখতে পেয়েছিলাম। আমি এখনো সে রক্তের গন্ধ পাই। এখনো নদী দেখলে আমার কষ্ট হয়। আমরা বাঙালিরা ঢাকায় আসছিলাম আখাউড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত গ্রাম মনোহরদী-এ। আমাদের শিবির ট্রেনিং শেষ এখন ঢাকায় যাচ্ছি আমরা।আখাউড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল লাইনের একটি ছোট কালবাট অতিক্রম করেছে আর একটু এগোলে সায়েদাবাদ।ওটা সি এন্ড বি রোড এখানে কড়া পাহারা আছে রাজাকারের আগে যোগাযোগ করা হয়েছিল তাদের সাথে যেতে অসুবিধা নেই। ওরাই পার করে দেবে। দিলে ওরা জানে কেন পুড়িয়ে দেওয়া হবে সিএন্ডবি রোড তখনও দখলদার বাহিনীর হাতে সীমান্ত এলাকার অনেক বাঙালি রাজাকার এমনি ভাবে সাহায্য করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। দেখা যাচ্ছে সায়েদাবাদ ব্রিজ আমাদের সামনে ৭৪ জনের ফরিদপুরের দল। আমরা তাদের পেছনে। রাত কত হবে প্রায় ১ টার কাছাকাছি এই ভয়াবহ স্থানটি পার হলে আমরা নিরাপদ। কিন্তু তখন আমরা জানতাম না সেদিন দখলদার বাহিনী রাজাকারদের সরিয়ে নিজের দায়িত্ব নিয়েছে। নিয়েছে যখন বুঝতে পেরেছি তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অন্ধকার ভেদ করে প্রচন্ড শব্দে শত্রু স্বয়ংক্রিয় মেশিন রানার মাস্টারের। আমরা বিপর্যস্ত অতর্কিত আক্রমণে আমরা দিশেহারা মৃত্যুচিৎকার কান্নাকে ছাপিয়ে শত্রু গলার আওয়াজ আমরা নৌকার মাঝি তড়িত্গতিতে নৌকা ঘুরিয়ে পিছে ফেলে আসা একটি মাটির চরের আড়ালে লুকানোর জন্য। দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে লোকটা চরের দিকটা একটু পাথর। আমি নৌকা হতে দেখতে চাচ্ছি কোথায় আমাদের দলের অন্য নৌকাগুলো। মাঝি দ্রুত হাতে আমাকে ধাক্কা মেরে শুইয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠল শুয়ে পড়েন গায়ে গুলি লাগতে পারে,আমিও অকে পাল্টা বলতেযাচ্ছি এমন সময় এক ঝাক গুলি ওকে উড়িয়ে নিয়ে পানিতে ফেলে দিল! আমাদের নৌকা তাল সামলাতে সামলাতে মাটির চাতের আড়ালে চলে গেল।আমি দেখলাম পানির মাঝে তার শরীর দাপাদাপি করছে। কিছুক্ষণ পর দেহটি আর দেখা গেল না। সে মাঝির নাম জানা হয়নি। কোনদিন জানা হবে না। অথচ আমি বেঁচে আছি। সে মাঝির জীবনের বিনিময়ে বেঁচে আছি। কিন্তু অনেকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনা। পারিনা মানিকের মার সামনে যেয়ে দাঁড়াতে।মানিকের মা আমাকে বলেছিল মানিক আমার একমাত্র ছেলে ওকে একটু দেখো, আমি মানিকের মার কথা রাখতে পারিনি। মানিক চলে গেল দেখে রাখার সুযোগ পেলাম না। মানিকের মরে যাওয়ার পর আসে স্বাধীনতা। নভেম্বর ১৪ তারিখ ‘৭১-সাল ঢাকা আরিচা রোডের ঘাট ব্রিজ অপারেশন।উত্তরবঙ্গের সঙ্গে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে আমরা ঐ ব্রিজটি উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই ৫৫ জনের একটি দল নিয়ে আমরা আক্রমণ পরিকল্পনা করলাম।অপারেশনের নেতৃত্বে আমি।ব্রিজ দখল করতে দুই মিনিট সময় লেগেছিল আমাদের।অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল সেদিন সবাই। মাত্র পাঁচজন সাবু,মাজেদা,আশরাফ,হাকিম আর আমি। ব্রিজ দখলের জন্য ব্রিজের দিকে এগুলাম। রাত তখন পনে দশটা। রাস্তার ধার ধরে একনাগারে প্রায় তিনশত গজ ক্রস করে আমরা ব্রিজের দিকে চলে এলাম। পেছনে আরও ৫০ জন যোদ্ধা অপেক্ষা করছে।আমরা বিজয়ের জন্য এগোলাম। আমরা দেখলাম মাত্র ১৫ গজ দূরে দখলদার বাহিনীর প্রহরী দুজন হাঁটছে গরিয়ে। আমরা রাস্তায় উঠে এলাম বাঁধানো রাস্তার ওপর পাশাপাশি শুয়ে আমরা আক্রমণ শুরু করলাম ওয়াজেদের ২ ইঞ্চি মার্সেল অব্যর্থ। লক্ষ্য হলো শত্রুর ঝংকার আশরাফের এলএমজি সাবুর এলএমজি আমি আর আমার প্রিয় চাইনিজ রাইফেল সামনে গর্জে উঠল সময় নির্ধারণ ছিল এক মিনিট এক মিনিটের মধ্যে দখল করতে হবে ল।বৃহৎ এক মিনিট পার হয়ে গেল তখনো শত্রু দু একটি গুলি অখ্যাত।সাবু লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে তার এলেমজি হাতে নিয়ে গুলি করতে করতে ছুটে গেল ব্রিজের ওপর আমরা তাকে যন্ত্রের মতো অনুসরণ করলাম।শুনি ধ্বনি শত্রুসৈন্য পালাতে লাগল। তাদের ধাওয়া করতে করতে হত্যা করছে দ্রুত আমরা কাজ শুরু করলাম মানিকগঞ্জের দিকে ফ্লানক-১ এবং ঢাকার দিকেফ্লানক-২-এ আমি তখন ব্রীজের চার্চ বসাতে ব্যস্ত, হঠাৎ দেখলাম মানিকগঞ্জের দিক হতে ছুটে আসছে শএুর গাড়ি।আমি দৌড়ে গেলাম গিয়ে দেখি সাবু তার এলএমজি নিয়ে ট্রেস্টে বসে দ্রুত ছুটে শত্রুর গাড়িগুলি ছুড়লো সাবু এবং সঙ্গে আরও ক’জন শত্রুর গাড়ি এখন বেসামাল ওরা বুঝলো ফাঁদে পড়ে গেছে ওরা বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালিয়ে ওরা পালাতে চাচ্ছে—– ঢাকার দিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি মাঝে আমি হঠাৎ লক্ষ্য করলাম মানিক নেই আমি চিৎকার করে সাবুকে জিজ্ঞেস করলাম মানিক কোথায়।সাবু শুধু বললো পানিতে দেখ।সাবু আব্র ট্রিগার টিপলো। মানিককে পানি থেকে তুললাম তখনও তার শরীর গরম বিশ্বাস হয়নি মানিক মারা গেছে। বিশ্বাস হয় না চোখ ফেরালে দেখতে পারি হো হো করে হাসছে মানিক। মানিক মরে গেল। আমরা বেঁচে রইলাম দেশ স্বাধীনতা পেল মানিকরা মরে গেলে দেশ স্বাধীনতা পায়।
অথচ ওরা স্বাধীনতা দেখেনা না দেখে ভালই হয়েছে কারণ স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধার লাশ রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়ে থাকে স্বাধীনতা দেখতে চেয়েছিল টিটো।কিশোর টিটো। বুলেট বুকে নিয়ে সাভারের মাটিতে শুয়ে আছে টিটো।বিজয়ের মাত্র ৩ দিন আগে। ১৩ই ডিসেম্বর। টিটো নিহত হয়। ১৩ই ডিসেম্বর ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল হতে পিছু হটে আসছে।তাদের লক্ষ্য ঢাকা। ঢাকা শক্তি বৃদ্ধি করে জোগাড় করা। পূর্বের আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে। আমরা আগে থেকে খবর পেয়ে ওত পেতে বসে আছি। যদিও জানি শত্রুবাহিনীর অন্যতম দুর্ধর্ষ রেজিমেন্ট এই ৩৩ পাঞ্জাব তবুও আমরা প্রায় চারশত যোদ্ধা নিয়ে ওদের মোকাবেলা করার জন্য বসে আছি সাভারের উপকণ্ঠে প্রায় ৭০ জন প্রায় তিনশত গজ ব্যাপী এম্বুস। আমি দুটো এলএমজি এবং ৭০ জন রাইফেলধারী যোদ্ধা নিয়ে বসা। মেন বডি তে আরো ১১২ এ শতাধিক করে যোদ্ধা, রিজার্ভ রয়েছে আরও শতাধিক। ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল আমার খাওয়া ক্লান্ত শত্রুসৈন্য ধীরপায়ে এগিয়ে আসছে মাত্র ৫০ গজ দূরে পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রু আমাদের ৩১০ এর ভিতরে ঢুকলে কবে শুরু হবে। কিন্তু চোখের সামনে এত শত্রু দেখে ঠিক থাকতে পারলো না সুবেদার মোহাম্মদ আলী পুরো শত্রুবাহিনী অ্যামবুশে ঢোকার আগে গুলি চললো মোহাম্মদ আলী। গতিতে প্রতিসরণের সূত্র শুরু হয়ে গেল প্রচন্ড যুদ্ধ। আমি পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ফ্লানক-১ কে মূল বডি হিসেবে কাজ করার নির্দেশ দিয়ে মরিতে পেছনে ছুটে এলাম। এখন আমার অবস্থান ফ্লানক-১। দুর্ধর্ষ সেই রেজিমেন্টের সঙ্গে পেরে ওঠা কষ্টসাধ্য মাঝেমাঝে ওরা আমাদের অবস্থানকে দুভাগে চিড়ে বের হয়ে যেতে চাচ্ছে।আমাদের পেছনদিকে। আমি ফ্লানক-২ কে আরো কাছে এসে গুলি করার নির্দেশ দিলাম পাঞ্জাবীদের মূল এমজি পোস্ট আমরা দেখছি কিন্তু কিছুটা নিচে থাকাতে কায়দা করতে পারছিলাম না। একমাএ ফ্লানঙ্ক -2 এর পক্ষে সম্ভব. ওদেরকে আমি বললাম তুমি যে নুরুকে বল জয়েন করতে।টিটো যে আমার পাশেই যুদ্ধ করছে আমি জানিনা কাউন্টিতে এত ছোট ছিল যে তাকে আমরা অপারেশনে নিতাম না।ওকে দিয়ে অন্যান্য কাজ করাতাম।কিন্তু আমাদের সঙ্গে এসেছিল কুমিল্লার মধ্য থেকে যেদিন আমরা সায়েদাবাদে প্রচন্ড মার খাই পাকবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে সেদিন রাতে দেখতে এসেছিলাম অধিনায়ক খালেদ মোশাররফ,ক্যাপ্টেন হায়দার, ক্যাপ্টেন হালিম ও আরো অনেকে ২৭ টিলা সাজানো ছিল পাহাড়ের নিচে।খালেদ মোশাররফ এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের দিকে তাকালেন তারপর মুখ ফিরিয়ে সামনে দূরে সিএন্ডবি রোড আরো দূরে তিতাসের দিকে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ সেদিন তিনি দেখেছিলেন কে জানে। তার কিছুদিন পর খালেক কসবা অঞ্চলের প্রিন্টারের এসে তার কপালে তিলক এঁকে দিয়ে যায়। খালেদের সেটাই ছিল শেষ যুদ্ধ। সেরা তেমনি হতে খালেদ আমাদের শুনিয়েছিলেন স্বাধীনতার কথামৃত কর্তৃক কম করে কেমন করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয় তার কথা।আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত সে সব কথা ভুলে সেই সব কথা শুনেছিলাম। সেকালের স্বাধীন দেশে ‘৭৫ সালে তারিখ সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন।
স্বাধীনতা এসে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের মরে যেতে হয়, স্বাধীনতা আনতে হলে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন দিতে হয়, স্বাধীন দেশ মৃত যোদ্ধাকে ভালোবাসে।
সেই রাতে কর্নেল খালেদ ফিরে যাওয়ার সময় ক্যাপ্টেন হালিম কিশোর টিটো আর নিজামকে আমাদের সঙ্গে দিয়ে দেন।

সেদিন টিটো লাফ দ দিয়ে উঠে ওপাশে নুরুকে উদ্দেশ্য চিৎকার করে জানালো আমার নির্দেশ।যুদ্ধের নিয়ম সে কি জানত না। মৃত্যুর কথা তার অজানা শত্রুর গুলির এক ঝাঁক গুলি টিটোর বুক চিরে ফেললো পড়ে গেল টিটো মাত্র ১০ গজ সামনে টিটো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আমরা তোর কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু শত্রুর প্রচন্ড গুলিতে এগোনো অসম্ভব। হঠাৎ দেখলাম দ্রুত এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে নুরু পেছন থেকে এগিয়ে যাচ্ছে পাকবাহিনীর দিকে। অবিশ্বাস্য গতি মনে হয় মুহূর্তের মধ্যে নুরু শত্রুর দিক পেছন মাত্র ২০ গজের মধ্যে চলে এলো। এবং নির্ভুল নিশানায় হত্যা করলো টিটোর ঘাতক তিনজনকে। এই ফাঁকে আমরা টিটোকে নিরাপদে নিয়ে এলাম। নুরু তখন বেপরোয়া হয়ে সহযোদ্ধাদের নিয়ে একের পর এক সত্য হরণ করছে। কিশোরের মৃত্যু শোকে পাগল করে দিয়েছে শত্রু তখন এবং বিপর্যস্ত আরিফ এবং আরো দুজনকে নিয়ে ক্যাম্পে। তাকে চিকিৎসা করা দরকার তখন ক্যাম্পে আরো পাঁচজন আহত হয়ে ফিরে এসেছে।টিটোর রক্তে ক্যাম্প ভেসে যাচ্ছে। টিটো চিৎকার করে বলল বাচ্চু ভাই আমি স্বাধীনতা দেখতে চাই,আমাকে বাঁচান, স্বাধীনতা দেখে মরতে চাই।তাকে৷ বাঁচাতে পারিনি টিটো মরে গেল। টিটো এখন সমায়িত আছে সাভার ডেইরি ফার্মের গেটে। স্বাধীনতা মৃত যোদ্ধাকে ভালোবাসে টিটো বাঁচল কি দেখতো এই স্বাধীনতা?হয়তো দুঃখ পেতো সে। হয়তো চায়ের দোকানে কাজ করতো কিশোর-যুবক হয়ে জীবন লড়াইয়ে নাম।দেখতো তার সহযোদ্ধা সুঠাম কাল দীর্ঘদেহী দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা নিজাম স্বাধীনতার পর ‘৭৪ সালে মানিকগঞ্জের রাস্তায় পড়ে থাকল।নিজামকে রক্ষীরা গুলি করে মেরে ছিল। স্বাধীনতার জন্য মরে যেতে হয়। স্বাধীনতা পেয়ে গেলে নিজামদের মরে যেতে হয়। আর নুরু?
নুরি ৩৩ পাঞ্জাবের কে হত্যা করে তার টুপি আমাদের উপহার দিয়েছিল। সে এখন কোথায় তাও আমি জানি না। জানিনা মুন্সির কথা যে সারারাত মানিক আর টিটোর লাশ বুকে নিয়ে কোরআন খতম করেছিল। সে কোথায়? কোথায় আমাদের সেই আত্মত্যাগে যোদ্ধারা? যারা তাদের কথা রেখেছিল তারা কি বেঁচে আছে না মারা গেছে? অথবা মৃত্যুর প্রতীক্ষায় আছে। অথবা আমার মত রাতে ঘুমহীন পাতা এক হয় ঘুম আসেনা ঘুম নেই কিন্তু জেগে ও তো নেই।
স্বাধীনতা নাকি জীবিত গেরিলা চায়না।স্বাধীনত ভালবাসে মৃত যোদ্ধাদের। মানিক জুয়েল মারা গেলে স্বাধীনতা আসে। স্বাধীনতা এসে মারা যায় মুক্তার নিজামরা। তাই কি আমাদের ঘুম নেই? আবার জেগেও নেই। কবি শামসুর রহমান গেরিলা কবিতা ‘৭১ সালে লিখেছিলেন,
‘তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছ হাত ধরে, পরস্পর’
এখন তো সেই ভবিষ্যৎ ঘুম নেই আমার…. লক্ষ্য যোদ্ধার মায়ের, সন্তানের, প্রেমিকার, স্ত্রীর….. ৯ কোটি মানুষই কি ঘুমহীন?
ঘুম নেই,অথচ জেগেও তো নেই।