You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৭শে ফেব্রুয়ারী, বুধবার, ১৫ই ফাল্গুন, ১৩৮০

পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে প্রগতির সেতুবন্ধন রচিত হোক

প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বাংলাদেশে এক সংক্ষিপ্ত সফর শেষ করে গত পরশু দিনই চলে গেছেন। লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক দেশসমূহের সম্মেলন শেষ হবার পর প্রেসিডেন্ট সাদাত গত চব্বিশ তারিখে নয়া দিল্লি সফর করেছেন। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছাড়াও তাদের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে জানা গেছে। নয়া দিল্লি সফর শেষ করে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এক সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছা সফরে গত পরশুদিন দুপুরে বাংলাদেশে এসে পৌঁছান। ঢাকা বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান আমাদের রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর। এছাড়া মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, বিশিষ্ট নাগরিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যবৃন্দ বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। বিমানবন্দর থেকে বঙ্গভবন পর্যন্ত অসংখ্য জনতা পথের দু’পাশে দাঁড়িয়ে মহামান্য অতিথিকে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জানিয়েছে। সময়ের স্বল্পতা সত্ত্বেও আমাদের কতৃপক্ষ রাস্তার দু’পাশে দু’দেশের পতাকায় সজ্জিত করে তুলেছিলেন। কোন সাহায্যকারী ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত-এর মধ্যে এক ঘণ্টাকাল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ আলোচনা যতটা গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ তা নিঃসন্দেহে অনুমান করা যায়। পাকিস্তান কর্তৃক শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান এবং বাংলাদেশ পাকিস্তানকে স্বীকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ সকল ঘটনার সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিশেষে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত-এর ঢাকা সফর ও সবিশেষ অর্থবহ। প্রেসিডেন্ট সাদাতের এই সংক্ষিপ্ত সফর সম্পর্কে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেনের মন্তব্য এখানে স্মরণ করা যেতে পারে; তার মতে, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত-এর মধ্যে পশ্চিম এশিয়া ও উপমহাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে অত্যন্ত ফলপ্রসূ মত বিনিময় হয়েছে। এছাড়াও ওভার রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতা সম্পর্কে আলোচনা ও তা সম্প্রসারিত করা উচিত বলেই সম্মত হয়েছেন। ঢাকা ত্যাগের পূর্বে প্রেসিডেন্ট সাদাত সাংবাদিকদের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একপর্যায়ে জানিয়েছেন- ‘তেলের ব্যাপারে আরব রাষ্ট্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলিকে সুবিধাদানের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে এবং আফ্রিকান দেশ গুলিকে সুবিধা দানের ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট সাদাত-এর মধ্যে বঙ্গভবনে যে এক ঘণ্টা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে তার অন্যতম বিষয়বস্তু ছিল সুয়েজ খাল এলাকায় সৈন্য বিচ্ছিন্নকরণ প্রশ্ন সহ মধ্যপ্রাচ্যের সর্বশেষ পরিস্থিতি। এছাড়া সদ্য সমাপ্ত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনের সুপারিশ সমূহও পর্যালোচনা করা হয়েছে। আলোচনা অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ ও ফলপ্রসূ হয়েছে বলে প্রেসিডেন্ট সাদাত সাংবাদিকদের কাছে ব্যক্ত করেছেন। বিগত মিশর ইরাক যুদ্ধে বাংলাদেশ আরব দেশগুলোর প্রতি যে বীরোচিত সমর্থন যুগিয়েছিল প্রেসিডেন্ট তার উচ্ছসিত প্রশংসা করেন।
জানা গেছে এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট সাদাত ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের মধ্যে কোন প্রকার সাহায্যকারী ছাড়াই পঁচিশ মিনিটকালের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট সাদাত অত্যন্ত আন্তরিকতা ও আবেগ নিয়ে উল্লেখ করেছেনঃ ‘আমি বাংলাদেশের সংগ্রামী ভাইদের মাঝে আসতে পেরে অত্যন্ত খুশি হয়েছি। বাংলাদেশে আমার ভাই মুজিবের সাথে মিলিত হবার জন্য আমি অত্যন্ত ব্যাগ্ৰ ও আগ্রহী ছিলাম।’ বস্তুতঃপক্ষে, ভারত-বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের এই সফর অত্যন্ত মূল্যবান। পশ্চিম এশিয়া ও আমাদের উপমহাদেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিচার করলে বলা যাবে যে, প্রেসিডেন্ট সাদাত পশ্চিম এশিয়ার ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দায়িত্বশীল ও সুদৃঢ় নেতৃত্বের অধিকারী। শান্তি, প্রগতি ও মানবতার জয়গান এ দু’নেতাই বিশ্বের চোখে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। আমরা উভয় নেতার পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি ও উভয় দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য একাগ্রচিত্তে কামনা করি।

আর মাত্র তিন দিন বাকী

আর মাত্র তিন দিন বাকী। তিন দিন পর অর্থাৎ পহেলা মার্চ পর্যন্ত সমাপ্ত হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম আদমশুমারি গণনার কাজ। এর আগে সাবেক পাকিস্তান আমলে দেশে আরও দু’দু’বার আদমশুমারি হয়ে গেছে। তবে স্বাধীন দেশের মুক্তবাতাসের এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারি। তাছাড়া সব দিক থেকে এবারের শুমারীর উদ্দেশ্য, উদ্যম, গুরুত্ব ও যথাযর্থতা অন্যান্য যেকোন বারের চেয়ে অনেক বেশি হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
গত পয়লা ফেব্রুয়ারি সকাল ন’টায় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারি বাসভবনেও এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই লোক গণনার কাজ প্রথম সূচিত হয়ে মোট ১৯ দিন পর্যন্ত এ গণনার কাজ চলবে। পহেলা মার্চ পর্যন্ত সময়ে এই ১৯ দিনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগামী পহেলা ও ২রা মার্চে সমুদয় গণনাকে আবার পরীক্ষা করে দেখা হবে বলে কমিশন সূত্রে জানানো হয়েছে। এর আগে গত ৯ই ফেব্রুয়ারি রাতে অর্থাৎ প্রথম শুমারির আগের দিন রাতে প্রধানমন্ত্রী এ সম্পর্কে জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণও দেন। সুপারভাইজার সহ ১ লক্ষ ২০ হাজার গণনাকারী নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের পর এ জাতীয় গণনা কাজে অংশগ্রহণ করছেন। তাদের নিজস্ব কোনো ঘরদোর নেই। তাদের গণনা করা হবে আগামীকাল আটাশের রাত থেকে। এজন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক ঘণ্টার জন্য কার্ফুও জারি করা হয়েছে।
শুমারির কাজ ঠিকমতো সম্পন্ন হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে আবার ব্যাপক তল্লাশি করা হবে আগামী দু-এক মাসের মধ্যে। মোট ২৭টি সহজ প্রশ্ন ও তার উত্তর এর মাধ্যমে সারাদেশে গণনার কাজ চলছে। দেশের জনসাধারণ ঠিক যেভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, তার ওপরেই নির্ভর করছে দেশের জনশুমারি সহ আরও বিভিন্ন দিকের সঠিক মূল্যায়ন বা পরিসংখ্যান।
যতদূর সম্ভব, অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে এবারের শুমারি যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সম্পন্ন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে ঠিক কতটুকু সফলতা অর্জন হোলো, তা, পরবর্তী পর্যায়ে ছাড়া আমরা এখনো জানতে পারিনি। অবশ্য, বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে তাতে মনে হচ্ছে, বিভিন্ন বাঁধাবিপত্তি সত্ত্বেও অত্যন্ত নিটোল ও সুচারুভাবেই গণনা চলছে। এ বিষয়ে দেশের জনসাধারণ ও গণনাকারীদের মধ্যে যথেষ্ট দায়িত্ববোধ ও বিপুল প্রাণচাঞ্চল্যও পরিলক্ষিত হচ্ছে আর মাত্র তিন দিন পর আমাদের গণনার কাজ শেষ পর্যায়ে পৌঁছুবে বলেই সবাই আশা করছেন।
একথা পৃথিবীর সব সভ্য দেশে এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, যেকোন প্রকৃত জাতীয় উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আদমশুমারি একান্ত অপরিহার্য। কারণ, যথার্থ আদমশুমারি ছাড়া দেশে সত্যিকারের উন্নয়ন উপযোগী কোন পরিকল্পনা নেওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের এই প্রথম লোক গননা দেশের যে বুনিয়াদ রচনা করবে, তা আগামী দিনে দেশবাসীকে সর্বতোভাবে সংকল্পের প্রেরণা যোগাবে বলেই আমরা আশা করছি।
বিশেষ করে, পাকিস্তানি আমলে দেশে এ পর্যন্ত যে দু-দুবার আদমশুমারি করা হয় তার দৃষ্টি ও কর্মপ্রণালী ছিল বাঙালি শোষণ ভিত্তিক ও পশ্চিমাঞ্চল গঠনমুখী। সেজন্য গত ২৫ বছর ধরে পাঞ্জাবি পশুরা নির্মমভাবে আমাদের উপর নির্যাতন, শোষণ ও নিষ্পেষণের স্টিমরোলার চালাতে সক্ষম হয়েছিল। বাংলার সমৃদ্ধি এমনভাবে বছরের-পর-বছর উপেক্ষিত হয়েছে পাকিস্তানি বর্বর প্রবৃত্তির বেদীমূলে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে এসেছিল এক ধ্বংসের করাল ছায়া।
কিন্তু, এবারের গণনা সম্পূর্ণই বাংলা ও বাঙালির নিজস্ব জীবন স্বার্থেই সম্পন্ন হচ্ছে। বাংলার শাসনতন্ত্রের যে চারটি মূলমন্ত্র সংযোজিত হয়েছে, তাকে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করে সোনার বাংলা গড়ে তোলার মহান প্রচেষ্টাই এবারের লোকগণনার মুখ্য উদ্দেশ্য। গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে যে অনাবিল সম্পদ ও ঐশ্বর্য আছে তাকে খুঁজে বের করে মূল্যায়ন করা এবং তাকে আমাদের গঠনমূলক পরিকল্পনার সাথে সংযুক্ত করে জনশক্তির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা এবারের গণনার পেছনে মূল অনুপ্রেরণা। এতে জাতি বা ধর্মের কোনো বিশেষ শ্রেষ্ঠত্ব পাচ্ছে না এবং বাঙালিকে বাঙালি হিসেবেই পরিসংখ্যায়িত করা হচ্ছে। জাতি আজ একটা বিরাট যুগসন্ধিক্ষণে এসে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে এসে সে কেবলই দেখছে অভাব অনটন আর হাহাকার। এমন জাতীয় জীবনে প্রাণ সঞ্চার করে তাকে গতিশীল করতে হলে চাই নিরলস কর্মপ্রেরণা ও প্রান চঞ্চলতা। আজ শক্ত করে বুক বেঁধে দাঁড়াতে হবে আমাদের সবাইকে। আর, এবারের সঠিক পরিসংখ্যান এর উপরে নির্ভর করছে আমাদের সবারই আগামী সফল ভবিষ্যৎ।
সুতরাং আমরা সর্বদা ভাবে কামনা করছি যে এবারের শুমারি সম্পূর্ণ সঠিক, সফল ও অকলুষমন্ডিত হয়ে আমাদের জাতীয় জীবনের আগামী সুখ-স্বাচ্ছন্দ নিশ্চিত করুন। বিশ্বের দুর্দম উন্নতির ইতিহাসে বাঙালি এক অমর অক্ষর স্বাক্ষর রাখুক।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!