You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১০ই এপ্রিল, বুধবার, ২৭শে চৈত্র, ১৩৮০

আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নে যত কঠোর হবেন ততোই সুনাম বাড়বে

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কতৃপক্ষকে কোন অভিমত জানানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। গত দু’বছর ধরে বহুবার আমরা দেশের আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপারে নানা কথা বলেছি। বিভিন্ন প্রকার মতামত কর্তৃপক্ষকে জানাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি তো নয়ই বরং অবনতিই আমরা লক্ষ্য করেছি। মাঝে মাঝে সরকার জোরেসোরে ঘোষণা করেন একটা কিছু করবেন বলে-কিন্তু তা করা হয়নি। এক পা এগিয়ে দু’পা পেছানোর মত অবস্থা হয়েছে। ফলে আজ কতৃপক্ষের সামনে যে দুটো সমস্যা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো খাদ্য পরিস্থিতি ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। মানুষকে একবেলা খেতে দিতে না পারলেও তার জীবনের নিশ্চয়তা যদি দেওয়া যায় তাহলে তার হতাশ হয়ে যাবার কোনো কারণ থাকে না। বাঁচবার নিশ্চয়তা যেমন মৌলিক, তেমনি খেতে পাওয়ার নিশ্চয়তা ও মৌলিক। এই দু’টি অধিকার সকল মৌলিক অধিকারের শীর্ষে। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমবনতি লক্ষ্য করে আসছি বিভিন্ন সময়ে যখন খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে তখনও আমরা বলেছি খাদ্য সমস্যা সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শান্তিতে ঘুমানোর নিশ্চয়তা দিতে হবে। খাবার পরও যদি একটি মানুষের বাঁচবার অনিশ্চয়তা থাকে তাহলে তার পেট ভরে খাওয়ার মধ্যে কোন আনন্দে থাকে না। তাই অনেক ক্ষেত্রে খাবারের নিশ্চয়তা থেকেও বাঁচবার নিশ্চয়তা অগ্রাধিকার বলে বিবেচিত হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত দেশের বহু মানুষ আততায়ীর হাতে মৃত্যুবরণ করেছে। ব্যাংক লুট, ডাকাতি, হাইজ্যাক, থানা লুট প্রভৃতি বহুবার সংঘটিত হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। সর্বোপরি হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা আমাদের কর্তৃপক্ষ দিতে পারেননি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার কর্মীকে নিহত করা হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বহু কর্মী ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, ও যুবলীগের অসংখ্য কর্মী আততায়ীর হাতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, আজও দিচ্ছে। দেশের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেমন জাতীয় সংসদের সদস্যদের প্রতিনিধিরা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এমন যে হবে তা আমরা পূর্ব থেকেই অনুমান করেছিলাম এবং পূর্বাহ্নেই কতৃপক্ষকে সতর্ক হবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু সত্যিকার অর্থে দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। মাঝেমধ্যে ব্যবস্থা গৃহীত হবে বলে জনগণকে আশ্বাস দেয়া হলেও তা বাস্তবে করা হয়নি। ফলে সরকারি আশ্বাসের প্রতি মানুষের বিশ্বাস আজ প্রায় বিনষ্টই হয়ে গেছে। সম্প্রতি সরকার কিছুটা কঠোর হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। দুর্নীতি দমনের জন্য দুষ্কৃতিকারী এবং হত্যাকারীদের ধরার ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন আজ আমাদেরকে আকৃষ্ট করেছে। শুধু আমাদেরকেই নয়, দেশের মানুষ আজ আলোচনা করছে, সরকার বোধহয় এতদিনে একটু সচেতন হয়েছেন। বিশেষ করে ইতিপূর্বে যেটা দেশবাসীর মনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল তা হলো সরকার বা সরকারি প্রশাসনযন্ত্র কোন দুষ্কৃতিকারী ধরলে বা সত্যিকারের দোষী ব্যক্তিকে আটক করলে ক্ষমতার বিভিন্ন উৎস থেকে টেলিফোনে শেষে সকল অপরাধীদেরকে ছাড়িয়ে নেওয়া। আর এই প্রভাব খাটানোর কারণেই অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনযন্ত্র বাস্তব পদক্ষেপ নিতে ভয় পেত। ফলে সত্যিকারের দোষীরা ছাড়া পেয়ে চুনো-পুটিরা না আটকে যেত। রুই-কাতলা দের ধরা যে কত আবশ্যক তা কর্তৃপক্ষ আজ অনুধাবন করতে চলেছেন বলে মনে হচ্ছে। দেশের সাধারন মানুষও এ কারণে আশাবাদী সত্যিকারের দোষী ব্যক্তি সে যত বড় ক্ষমতাশালী হোক না কেন তাকে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করাই আইনের কাজ। আর আইন সবার জন্য সমান। ক্ষমতাসীন দল আর বিরোধী দল সবার ব্যাপারে আইন সমানভাবে প্রযোজ্য। এই দৃষ্টিকোণে যদি সরকার দেশের প্রতিটি স্তর থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদ বা দুষ্কৃতিকারীদের দমনের জন্য অগ্রসর হন তাহলে জনগণের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা অর্জন করবেন। গুপ্ত খুন বা হত্যা বন্ধ করা আজ সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। বহুদিন ধরে আমরা এই খুনের রাজনীতি দেখছি-আর নয়। এবার যে করেই হোক খুন বন্ধ করে দুষ্কৃতিকারীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে জন জীবনের নিশ্চয়তা ফিরিয়ে আনতেই হবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন দুষ্কৃতিকারীর কোন পরিচয় নেই, যে দুষ্কৃতিকারী সে দুষ্কৃতিকারীই তা সে যে দলেরই হোক। আজ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর এ বক্তব্যের বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে এবং দেশের খাদ্যদ্রব্যের অগ্নিমূল্যে হাহাকার মানুষকে অন্ততঃ গুপ্ত খুন থেকে জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করতেই হবে। আমাদের বিশ্বাস সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সময় দৃষ্টিকোণে যত বেশি কঠোর পদক্ষেপ নেবেন ততবেশি জনগণের হৃদয়ে তাদের আসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

ইকাফে সম্মেলনের রিপোর্ট

খাদ্য আর জ্বালানি বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে বড় সংকট। অন্য কথায় প্রধানতম সংকট। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। খাদ্য সংকট উত্তরণে প্রতিবছরই বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে এসব দেশের গোটা বাজেটের তিন-চতুর্থাংশ এই খাদ্য সংকট মোকাবিলায় চলে যায়। গত অক্টোবর মাসে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বে যে তেল সংকট দেখা দিয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে অনেক উন্নয়নশীল দেশকে তাদের জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচি পরিবর্তন করতে হয়েছে। খাদ্য আর জ্বালানি সংকটের তীব্রতায় অনেক ছোট ছোট গরিব দেশকেই এমনকি তাদের বাহ্যিক উন্নয়ন কর্মসূচিও শিকোয় তুলতে হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দীন আহমদ গত সোমবার বলেছেন, এ বছর খাদ্য আনতে সরকারকে ৩৬০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে এবং এটা হচ্ছে খাদ্য আমদানি খাতে মোট বাজেটের তিনগুণ এবং উন্নয়ন বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ। এমতাবস্থায় এক বাংলাদেশের হিসেবে থেকেই বিশ্বের অন্যান্য অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ধরা যেতে পারে।
গত শনিবার কলম্বোতে সমাপ্ত এশিয়া ও দূরপ্রাচ্য সংক্রান্ত অর্থনৈতিক সম্মেলনে ত্রিশ তম অধিবেশনের এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এতে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইকাফ অঞ্চলের খাদ্য, জ্বালানি, কাঁচামাল ও বৈদেশিক অর্থসাহায্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলো মীমাংসার জন্য বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। প্রণীত একটি রিপোর্টে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের পেশ করার কথা বলা হয়। এই রিপোর্টে বলা হয় যে, অধিকাংশ দেশই জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা ও তাদের সমস্যার সমাধানে জাতীয় অর্থনীতিকে সুদৃঢ়ভাবে স্থাপনের জন্য আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের নীতি গ্রহণ করেছে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, এতদঞ্চলের দেশগুলোতে খাদ্য সরবরাহের বিষয়টিকে বিশ্ব সমাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে উন্নয়ন সাহায্য ও বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে শর্ত ও সুবিধা দিতে হবে এবং প্রধান তৈল রপ্তানিকারক দেশগুলোকেও দ্বিপাক্ষিক ও বহুমুখী সাহায্য দিতে হবে।
বস্তুতঃ ইকাফে সম্মেলনে প্রণীত এই রিপোর্টে আজিকার বিশ্বে অর্থনৈতিক তথা খাদ্য সংকটে জর্জরিত দেশগুলোর বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে, একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে। এখানে কর্তব্য যে, গত অক্টোবর মাসে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা এবং তার প্রেক্ষিতে উন্নত ও ধনী দেশগুলোর আরও উদার ও মুক্তমনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন এতে সেই কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। উন্নত, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও উদ্বৃত্তের অধিকারী এবং তেল সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ গুলোকে আজ অধিকতর উদার মনে এসব কথা ভাবতে হবে। এশিয়া ও আফ্রিকার অসংখ্য ছোট ছোট অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো আজ খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের তীব্রতায় জর্জরিত হচ্ছে, তাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এড়াতে ক্ষত-বিক্ষত হবার উপক্রম হচ্ছে তখন মানবতার ডাকে-মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ প্রকৃতির ডাকে এদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। না, হয় স্বাভাবিক কারণেই তাদের নিজেদের উন্নয়ন ও সভ্যতা অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!