You dont have javascript enabled! Please enable it!
বাংলাদেশের বাঙালী জাতির সংজ্ঞা নির্ণয়
প্রথমেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সীমারেখা সম্পর্কে কিছু কথাবার্তা। ইতিহাসের পাতায় যে এলাকাকে বৃহত্তর বঙ্গ” হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তার পিছনে আদৌ কোন সুষ্ঠু যৌক্তিকতা রয়েছে কিনা, তা বিচার করা নিতান্ত অপরিহার্য মনে হয়। অতীতের পানে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, গৌড়ে বাঙালী পাল বংশের সর্বশেষ বৌদ্ধ রাজা গােবিন্দ পাল ১১৫৮ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধে পরাজিত হবার পর কর্নাটক থেকে আগত অবাঙালী হিন্দু সেন বংশের রাজা বিজয় সেনের রাজত্বকালে গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকার জনগােষ্ঠী পুনরায় পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়। তারপর বহু ঘাতপ্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে বিভিন্ন শাসকগােষ্ঠীর অধীনে পরাধীনতার সময়কাল (বঙ্গীয় পাঠান সুলতানী আমল ব্যতিক্রম) হচ্ছে ৮১৩ বছরের মতাে। শেষ অবধি ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে অত্র অঞ্চলের নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে একটা সফল স্বাধীনতা যুদ্ধের মাঝ দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। এখানে লক্ষণীয় যে, আলােচ্য ৮১৩ বছর ধরে বিদেশী শাসকগােষ্ঠী নবদ্বীপ-দিল্লী-ঢাকা-মুর্শিদাবাদ-কলকাতা এবং করাচী ও ইসলামাবাদ থেকে অত্র এলাকা শাসন ও শােষণ করেছে। এ সময় এসব শাসকগােষ্ঠী নিজেদের প্রয়ােজনে বারংবার অত্র পূর্ববঙ্গীয় অঞ্চলের সঙ্গে আরও কিছু এলাকা জুড়ে দিয়ে ‘প্রশাসনিক ইউনিট’ সৃষ্টি করেছিল। এই প্রশাসনিক ইউনিটকে এরা ‘বঙ্গদেশবঙ্গীয় এলাকা’ বঙ্গাল মুলুক’ ‘বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যা রাজ্য ‘বেঙ্গল ফোর্ট উইলিয়াম প্রভিন্স প্রভৃতি নামে চিহ্নিত করেছিল প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, পুরাে বিষয়টাই ছিল কৃত্রিম   এ ব্যাপারে আরও কিছু বিশ্লেষণ অপরিহার্য মনে হয়।
 
আসলে আর্য-পরবর্তী প্রায় সহস্রাধিক বছরের ইতিহাসে (দুই দফায় বৌদ্ধযুগীয় প্রশাসন এবং বৌদ্ধ পাল বংশ, বঙ্গীয় পাঠান ও বারাে ভূঁইয়ার রাজত্বকাল ছাড়া) অত্র এলাকার আর সবারই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের রাজত্বকাল। এদের ইতিহাস হচ্ছে, গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় শক্তির দাপটে চাপিয়ে দেয়া শাসন ও শােষণের ইতিহাস। তবে স্থানীয় জনগােষ্ঠী কোন সময়েই এসব শাসককে মেনে নেয়নি। যুগে যুগে পূর্ববঙ্গে এই অকৃত্রিম বাঙালী জাতি বহিরাগত শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। ইতিহাসে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ বিদ্যমান। এজন্যই উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, বিদেশী শাসকরা তাদের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকাকে বারংবার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করে প্রশাসনিক ইউনিট তৈরি করেছিল বিভ্রাটটা এখানেই। মােঘল আমলে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহারের অংশবিশেষ এবং উড়িষ্যা অঞ্চলকে নিয়ে গঠন করেছিল বঙ্গাল মুলুক’। মুর্শিদাবাদের অবাঙালী মুসলিম নবাব সিরাজুদ্দৌলা তাে স্বীয় নামের  আগে বসিয়ে ছিলেন বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার নবাব’। ইংরেজ আমলে ‘বেঙ্গল ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সির এলাকা ছিল চট্টগ্রাম থেকে ছােটনাগপুর পর্যন্ত। আবার ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় বরিশাল-ফরিদপুরকে সীমানা চিহ্নিত করে অবশিষ্ট পূর্ববঙ্গ নিয়ে গঠিত হয়েছিল পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর পূর্ববঙ্গকে রাঢ় বঙ্গের সঙ্গে একত্রিত করে চট্টগ্রাম থেকে মেদেনীপুর পর্যন্ত ভূখণ্ডের নামকরণ হয়েছিল ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’। কিন্তু মাত্র ৩৫ বছরের ব্যবধানে বর্ণহিন্দু বঙ্গভাষীরাই বঙ্গভঙ্গের দাবি উত্থাপন করলাে।

 
এরা অবিভক্ত বাংলায় বসবাস করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে রাঢ় বঙ্গকে ভারতের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে’ রূপান্তরিত করলাে। আর গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকা ধর্মীয় স্লোগানের ধূম্রজালে ১২শ’ মাইল দূরবর্তী ‘পাকিস্তান’ নামক এক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সীমানার অন্তর্ভুক্ত হলাে। তাহলে একথাটা স্বীকার করতে হবে যে, আবহমান কাল থেকেই পূর্ববঙ্গ এবং ‘রাঢ়বঙ্গের পৃথক রাজনৈতিক ও ভৌগােলিক সত্তা বিদ্যমান রয়েছে। ফলে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, “বৃহত্তর বঙ্গ” শব্দটা সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট। পূর্ববঙ্গ’ ও ‘রাঢ়বঙ্গের। সম্পূর্ণ পৃথক সত্তা সম্পর্কে বিশিষ্ট গবেষক ও প্রবীণ সাহিত্যিক শ্রী অন্নদা শংকর রায়ের এতদসম্পর্কিত মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয় তিনি লিখেছেন, “তা হলেও এটা মানতেই হবে যে, বাংলাদেশের (অবিভক্ত বাংলা প্রেসিডেন্সি) সত্তা দু’ভাগে বিভক্ত।
এটা ইংরেজদের চক্রান্ত নয়; প্রকৃতির চক্রান্ত। পদ্মার এপার আর ওপার আবহমানকাল ভিতরে ভিতরে বিচ্ছিন্ন। তা না হলে দেশ বিভাগ ১৯৪৭ সালে এমন আচমকা এত সহজে হতাে না।” সেক্ষেত্রে একটা পৃথক ভৌগােলিক ইউনিট এই গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকার জনগােষ্ঠীর জাতীয়তা নির্ণয় হবে কিভাবে? ভারত, পাকিস্তান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে “বহু। জাতিক” দেশ এবং বিশ্বের অন্য জাতীয়তাবাদী দেশগুলাের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, জাতীয়তাবাদের জন্য নিম্নোক্ত শর্তগুলাে অপরিহার্য।
ক, ক, নির্দিষ্ট জনগােষ্ঠরী জন্য পৃথক আবাসভূমি।
খ. এই আবাসভূমি হবে লাগােয়া ভূখণ্ড এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমারেখার অন্তর্ভুক্ত। 
গ. নির্দিষ্ট ভৌগােলিক সীমারেখার এই ভূখণ্ড হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম। ঘ, আলােচ্য স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত এবং জাতীয় পতাকা হবে পৃথক। ঙ. আলােচ্য রাষ্ট্রের জনগােষ্ঠী হবে একই ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং লােকাচারে লালিত ও পালিত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এর মূল ভিত্তি হবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জাতীয়তাবাদের আদর্শের ভিত্তিতে সৃষ্ট একটি রাষ্ট্রের বিপুল।
 
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগােষ্ঠী একই ভাষাভাষী এবং একই ধর্মাবলম্বী হলে, তা নিশ্চিতভাবে বাড়তি লাভ এবং অতিরিক্ত বন্ধন হিসাবে গণ্য হবে তবে একটা কথা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে স্মরণ রাখা প্রয়ােজন যে, শুধুমাত্র ধর্ম কিংবা ভাষা কিছুতেই জাতীয়তাবাদ আদর্শের মৌলিক ভিত্তি হতে পারে না। শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হলে ইউরােপে খ্রীস্টান জনগােষ্ঠীর এতগুলাে পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হতাে না। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাতেও এতগুলাে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হতাে না। এমনকি ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য থেকেও লড়াই করে পৃথক হয়ে ‘আইরিশ রিপাবলিকের জন্ম হতাে না। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, একই ধর্মাবলম্বী এবং একই ভাষার জনগােষ্ঠী দেশে দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। তাই বলে এদের জাতীয়তা এক এবং অভিন্ন হতে পারে না। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপুলসংখ্যক জনগােষ্ঠীর মাতৃভাষা ইংরেজী এবং এরা ধর্মবিশ্বাসে খ্রীস্টান। কিন্তু এরা কিছুতেই নিজেদের ইংরেজ’ কিংবা “ব্রিটিশ হিসাবে পরিচয় দেবে না। একইভাবে মিসর, সৌদি আরব, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক প্রভৃতি দেশের জনগােষ্ঠীর ভাষা আরবী এবং ধর্মবিশ্বাসে এরা সবাই মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও জাতীয়তা কিছুতেই এক এবং অভিন্ন নয়। আসলে ভাষার বিস্তৃতি সীমান্ত অতিক্রম করেও বিদ্যমান রয়েছে এবং ধর্মের বিস্তৃতি তাে পৃথিবীর সর্বত্র। মানব সমাজে ধর্মের স্থান অনেক উর্ধ্বে ধর্মকে কিছুতেই রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে, তা হাতের আঙ্গুলে গােনা যায়, কিন্তু জাতির সংখ্যা এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি তাহলে বর্ণিত বিষয়গুলােকে ভিত্তি করে সহজেই জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা নিরূপণ করা সম্ভব পূর্বে বর্ণিত ৫টি বিষয়ই হচ্ছে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির মৌলিক উপাদান।
 
তাই দেখা যায় যে, যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে স্বার্থান্বেষী মহলগুলাে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে ধর্মের বরাতে এবং ধর্মীয় স্লোগানের আড়ালে জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে যেসব “ষড়যন্ত্র করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে, সবই ব্যর্থ হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও ব্যর্থ হতে বাধ্য ইতিহাসের গতিধারাকে কিছুতেই ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা সম্ভব নয়। এ ধরনের এক প্রেক্ষাপট পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, ইংরেজ আমলে বিশেষ করে উনবিংশ শতাব্দীতে উপমহাদেশে শিক্ষা-দীক্ষায় সবচেয়ে অগ্রণী কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ও “বাঙালী জাতীয়তাবাদের সঠিক সংজ্ঞা নির্ণয় করতে পারেনি। কেননা শুধুমাত্র বাঙালী হিন্দুদের নিয়ে একটা “জাতি” গঠিত হতে পারে না। এর পাশাপাশি উত্তর ভারতের উর্দুভাষী মুসলিম আলেমদের দৃষ্টি থেকেও পুরাে বিষয়টাই এড়িয়ে গেছে এরাও তখন ধর্মের আবরণে জাতীয়তাবাদের নতুন সংজ্ঞা নির্ণয় করেছিলেন। এরই নামকরণ হচ্ছে “প্যানইসলামিজম”। সে ক্ষেত্রে বলতে গেলে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের। মধ্যে একাত্মতাবােধ সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তােলাই হচ্ছে “প্যানইসলামিজমের” মুখ্য উদ্দেশ্য  উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কাল পর্যন্ত বেশ কিছুসংখ্যক মুসলিম মনীষী ভারত উপমহাদেশে “প্যান-ইসলামিজমের পক্ষে জনমত গড়ে তােলার জন্য প্রচেষ্টা করেছিলেন। ইংরেজ আমলে এদেরই শব্দ চয়ন “মােছলেম বঙ্গ” এবং মােছলেম আসলে এঁরা ধর্মের প্রলেপে জাতীয়তাবাদের ভ্রমাত্মক সংজ্ঞা নির্ণয় করেছিলেন।
প্রথম মহাযুদ্ধের সমাপ্তিকালে তুরস্কে খেলাফতের অবসানের লক্ষে নব্য তুর্কীর জনক কামাল আতাতুর্কের অভ্যুদয় হলে, ভারত উপমহাদেশে মওলানা মােহাম্মদ আলী ও মওলানা শওকত আলী অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে আতাতুর্কের বিরুদ্ধে এক ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে তােলেন এর মূল উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কে খেলাফতকে রক্ষা করতে হবে এবং এই উদ্দেশ্যে খাইবার গিরিপথ দিয়ে হাজার হাজার মুসলমান স্বেচ্ছাসেবককে পর্যন্ত রওনা করে দেয়া হয়েছিল। এটাই হচ্ছে ‘খেলাফত আন্দোলন। সবচেয়ে লক্ষণীয় এই যে, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে সদ্য আগত মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধীও মুসলমানদের এই ধর্মীয় আন্দোলনের প্রতি সক্রিয় সমর্থন জানিয়েছিলেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, এটা ছিল একটা দক্ষিণপন্থী আন্দোলনের প্রতি রক্ষণশীল অথচ বিধর্মী নেতার সমর্থন। এতসব কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও ব্যর্থ হলাে খেলাফত আন্দোলন।
 
অন্যদিকে খােদ তুরস্কে তখন খেলাফতের অবসানে কামাল আতাতুর্কের বিজয় কেতন অর্থাৎ খেলাফতকে হটিয়ে। দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলাে ‘তুর্কী জাতীয়তাবাদ’। শুধুমাত্র ধর্মের বন্ধনে রাষ্ট্র গঠন সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণার অবসানের মাত্র তিন যুগের ব্যবধানে মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ্যাকাশে আবির্ভাব হলাে ভাষাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ ‘আরব জাতীয়তাবাদের জোয়ার সদম্ভে ঘােষণা করা হলাে, যারাই আরবী ভাষাভাষী, তাদের ললাটের লিখন এক এবং অভিন্ন। অচিরেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলােতে জন্ম হলাে আরব বাথ পাটির’ যুব সমাজ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের সৈন্যবাহিনীর তরুণ অফিসাররা পর্যন্ত এই নব্য আদর্শে আপুত হলাে। মিসর, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া প্রভৃতি দেশে রক্তাক্ত পথে পরিসমাপ্তি হলাে রাজতন্ত্র আর পুরােনাে ধাচের সামরিক একনায়কত্বের অত্যন্ত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ভাষাভিত্তিক আরব জাতীয়তাবাদের অবস্থান হলাে একবারে তুঙ্গে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলাের মধ্যে মিসর, সিরিয়া ও ইরাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলাে ‘বাথ পার্টি’ এসব দেশে চালু হলাে একদলীয় শাসন এদের বক্তব্য হচ্ছে, একমাত্র বাথ পার্টিই হচ্ছে আরব জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও দেশপ্রেমিক তাই অন্য সবকিছু অস্পৃশ্য ও বর্জনীয়। কিন্তু তারপর? মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বের প্রশ্নে মিসর, সিরিয়া ও ইরাকের বাথ পার্টিগুলাের মধ্যে দেখা দিল মতবিরােধ। সবাই স্ব-স্ব দেশের জাতীয় নেতাদের নেতৃত্বদানের ক্ষমতা ও ব্যক্তিত্বের বন্দনায় লিপ্ত হলাে। ফলে অচিরেই এই তিনটি দেশের ক্ষমতাশীল দলগুলাে আবার নিজেদের রাষ্ট্রের ভৌগােলিক সীমারেখার চৌহদ্দিতে ফিরে এলাে; আদি ও অকৃত্রিম জাতীয়তাবাদের অভ্যুদয় হলাে। এদের মধ্যে নতুন করে শুরু হলাে নানা তর্কবিতর্ক এবং শেষ অবধি সৃষ্টি হলাে দারুণ বৈবীভাব আজ পর্যন্ত তা অব্যাহত রয়েছে ।
 
মােদ্দাকথায় বলতে গেলে ধর্মভিত্তিক ‘প্যান-ইসলামিজম’ এবং ভাষাভিত্তিক ‘আরব ন্যাশনালিজমের’ পরিসমাপ্তিতে আবার সেই নির্দিষ্ট ভৌগােলিক সীমারেখার। জাতীয়তাবাদ; যার মৌলিক উপাদান হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা; গণতন্ত্র এবং সুনির্দিষ্ট ভৌগােলিক সীমারেখার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। সেক্ষেত্রে গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় সবার অলক্ষ্যে বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ সৃষ্টির ইতিহাস বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ইতিহাসবিদদের মতে, খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী থেকে এর প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে এ ব্যাপারে সুফী মতবাদের ভিত্তিতে অত্র এলাকায় ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে। এরাই হচ্ছেন- সুফী, পীর, ফকির, দরবেশ ও আউলিয়া এক নিরাকার আল্লাহ ও পবিত্র কোরান, তার প্রেরিত বাণী আর রসূলে করিম (সঃ) হচ্ছেন শেষ পয়গম্বর। এসবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে যারাই ইমান এনেছেন এবং নামাজ, রােজা, হজ ও যাকাতের বাধ্যবাধকতা মেনে নিয়েছিলেন এঁরা তাদেরই ধর্মান্তরিত করে পবিত্র ইসলামের ছত্রছায়া গ্রহণ করেছিলেন। তাই নব্য মুসলমানরা স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, ব্যবহার প্রভৃতি সবকিছুতেই বাঙালিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এরই পাশাপাশি মােঘল সম্রাট হুমায়ুনের নিকট পাঠান সম্রাট শেরশাহ সুরীর পরাজয়ের পর যখন উপায়ন্তবিহীন অবস্থায় পাঠানরা দলে দলে পলায়ন করে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করে, তখন তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, তাদের পক্ষে স্বীয় জন্মভূমি মধ্যপ্রাচ্যে আর প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব নয়। পথেই মােঘল সৈন্যরা তাদের নিশ্চিহ্ন করবে ফলে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে এরা নিজস্ব স্বকীয়তার সঙ্গে গাঙ্গেয় বদ্বীপ, এলাকার সংস্কৃতি, লােকাচার এবং ভাষাকে গ্রহণ করে।
 
এমনকি এরা স্থানীয়ভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসারধর্ম পালনে মনােযােগী হয় এবং কালক্রমে সগর্বে নিজেদের বাঙালী হিসাবে পরিচয় দিতে শুরু করে। তাই সামগ্রিকভাবে পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে সুফী, পীর, ফকির, দরবেশ ও আউলিয়াদের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে বিশেষ করে পূর্ববঙ্গীয় এলাকায় অত্যন্ত সন্তর্পণে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে এক নব্য দর্শনের সৃষ্টি হয়। এই জনগােষ্ঠীর মধ্যে দেখা দেয় বিরাট আস্থা। এরা সবাই উপলব্ধি করেন, এই দেশ—এই মাটি আমার; এই ভাষা—এই সাহিত্য আমার; এখানকার সংস্কৃতি ও লােকাচার সবকিছু আমার। এরই ফলশ্রুতিতে কালের বিবর্তনে আমরা চমকপ্রদ ঘটনাবলী অবলােকন করতে সক্ষম হয়েছি। জাতিগতভাবে বাঙালী এবং ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান এই বিরাট জনগােষ্ঠী দল বেঁধে নামাজ পড়ে, নিয়মিত জুমার নামাজ আদায় করে, পবিত্র ইসলামের ফরজ পালন করে, দাদি-নানির কথায় বাড়িতে মিলাদ পড়ায়, জানাজার নামাজে শরিক হয়।
এরা পীরের দরগায় মানত করে, হাতে তাবিজ লাগায়, আজান শুনলে এদের মেয়েরা মাথায় কাপড় দেয়-আরও কত কিছু  এরাই আবার একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করে, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী পালন করে, বাংলা নববর্ষ ও হালখাত কর, বসন্তের আগমনে মেয়েরা কপালে টিপ দিয়ে বাসন্তী কাপড় পরে, অবসর সময়ে কিংবা বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীত উপভােগ করে, কবিতার আসরের আয়ােজন করে, কুনজরের হাত থেকে রক্ষার জন্য শিমুদের কপালে। কালাে টিপ দেয়, উৎসব-পার্বণে বাড়ির উঠানে আলপনা আঁকে, বিয়েবাড়িতে কলাগাছ লাগায়, কুলায় ধান-দুর্বা দিয়ে আর বাড়ির আঙ্গিনায় ঘড়াভর্তি পানি ঢেলে নববধূকে। বরণ করে, ছেলেমেয়ের মুখে ভাত আর হাতেখড়ির উৎসব করে, দূর দেশে যাওয়ার আগে গুরুজনদের পা ছুঁয়ে সালাম করে- আরও কতাে কি? বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেমন লায়লী-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, ইমাম বিজয়, রসুল বিজয়, আলিফ-লায়লা, হানুফা কয়রাপরী, দাস্তান-ই-আমীর হামজা, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামান প্রভৃতি আরবী ও ফারসী কাহিনীভিত্তিক পুঁথি সাহিত্য জনপ্রিয়তা অর্জন। করেছে; ঠিক তেমনিভাবে চাঁদ সওদাগর, বেহুলা, চৌতিশা, বিদ্যাসুন্দর, মনসা মঞ্জিল, সােনাভান, জ্ঞান সাগর (আলী রাজা), জ্ঞান প্রদীপ (সারঈদ সুলতানা), যােগকলন্দর (সৈয়দ মুর্তাজা), কাফন চোর, পদ্মাবতী, মধুমালতী, সতী ময়না ও চন্দায়ন প্রভৃতি।
কাব্য কাহিনীও গণমানুষের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। বিধৌত এই বাংলাদেশের পলিমাটিতে অত্যন্ত সন্তর্পণে এসব কিছুর সমন্বয় ঘটেছে এবং কালের আবর্তে তা আরও সুদৃঢ়ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের বাঙালী জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি এক কথায় বলতে গেলে মালয়েশিয়া, ব্রুনাই এবং ইন্দোনেশিয়ার অনুরূপ গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকাতেও সুফী দরবেশদের প্রচারিত উদারপন্থী ইসলামের সঙ্গে স্থানিক কালচারের এক অপরূপ সমন্বয় সাধিত হয়েছে- সংঘাত নয়। এখানকার মুসলিম জনগােষ্ঠী ধর্মভীরু, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। এ জন্যেই জামায়াতে ইসলামীর মতাে ধর্মীয়। মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলাে আজও পর্যন্ত অত্র এলাকায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে। পারেনি। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল এরই জ্বলন্ত প্রমাণ এরই পাশাপাশি পরিচ্ছন্নভাবে মূল্যায়ন করলে দেখা যায় যে, ইংরেজ আমলে বিশেষ। করে উনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষায় উপমহাদেশের সবচেয়ে অগ্রণী কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রকৃত সংজ্ঞা। নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। এঁরা অত্র এলাকার বাঙালী মুসলিম জনগােষ্ঠীকে বাদ দিয়েই ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ সৃষ্টি করতে আগ্রহী হয়েছিলেন। এঁরা ভুলেই গিয়েছিলেন যে, প্রকৃত জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সুনির্দিষ্ট ভৌগােলিক। সীমারেখার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, ঢাকা ও মুর্শিদাবাদে বাংলার রাজধানী থাকাকালে বর্ণহিন্দুরা যেভাবে অবাঙালী মুসলমান সুলতান ও নবাবদের প্রতি সমর্থন।
প্রদানের মাধ্যমে সম্পূরক শক্তির ভূমিকা পালন করেছিল, ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বকশার যুদ্ধে নবাব মীর কাশিমের পরাজয়ের জের হিসাবে বাংলার রাজধানী লকাতায় স্থানান্তরিত হলে, এঁরা গােড়া থেকেই ইংরেজদের প্রতি সক্রিয় সমর্থনে এগিয়ে আসে। এঁদের কাছে সেদিন প্রশ্নটা ছিল, শুধুমাত্র শাসকের পরিবর্তন। অবাঙালী মুসলিম নবাবদের জায়গায় বহিরাগত ইংরেজ শাসকগােষ্ঠী । ‘কুর্নিশের জায়গায় ‘সেলুট’। পরবর্তী এক শতাব্দী পর্যন্ত নানাবিধ কর্মকাণ্ডে ইংরেজদের ছত্রছায়ায় এই বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের সমৃদ্ধি হয়েছিল অচিন্ত্যনীয়। এই সময়কালে এঁদের নেতৃবৃন্দ ‘রেনেসাঁ’ও ভ্রমাত্মক মূল্যায়ন করেছিলেন। কেননা ‘রেনেসাঁ’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানই হচ্ছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং ‘স্বাধীনতা’; এই দু’টাই ছিল তখন অনুপস্থিত। তবুও কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভ্রমাত্মক ব্যাখ্যাদান করলেন। শুধুমাত্র বাঙালী হিন্দুদের নিয়ে যে একটা “জাতি” গঠন হতে পারে না একথা এঁরা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন রাধাকান্ত ভুদেব-বঙ্কিম-বিবেকানন্দ প্রমুখ নেতার কর্মকাণ্ডের মাঝ দিয়ে অন্তত এ কথাটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কে এদের ব্যাখ্যাদান ছিল সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক। পরবর্তীকালে এর ফলাফল খুব একটা শুভ হয়নি। এজন্য এদের উত্তরসুরিদের অর্থাৎ এই সম্প্রদায়কে যে পরিমাণে “কাফফারা দিতে হয়েছে তা ইতিহাসে বিরল ইংরেজদের সমর্থক গােষ্ঠী হিসাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দীর সমাপ্তিকাল পর্যন্ত বাঙালী বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের সুবর্ণ শ্ৰেণী, জমিদার শ্রেণী এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর যে রকম সমৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ হয়েছিল ১৯৪৭ সালের পরবর্তীতে এ সব কিছুই মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে এবং তা এখন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে।
মােদ্দাকথায় বলতে গেলে ওপার বাংলায় (পশ্চিম বাংলায়) যারা বসবাস করছেন, তাদের মাতৃভাষা নিশ্চয়ই বাংলা এবং তারা বঙ্গভাষীও বটে কিন্তু তারা আর বাঙালী মন। ওঁরা হচ্ছেন বহুবর্ণ ভারতীয় নাগরিক। ওঁদের পাসপাের্টে লেখা ‘ইন্ডিয়ান পাসপাের্ট”। ১৯৪৭ সালেই এর সুরাহা হয়ে গেছে। সে সময় পূর্ব বাংলার উচ্চবর্ণের বর্ণহিন্দু এবং পশ্চিম বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে একটি মাত্র সিদ্ধান্তে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন। পূর্ব বাংলার সংখ্যাধিক্য জনগােষ্ঠী, যাদের অধিকাংশই ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান এবং খণ্ডিত ভারতের বিপুলসংখ্যাধিক্য অবাঙালী হিন্দু জনগােষ্ঠীর মধ্যে ওঁরা ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে সেদিন ভ্রমাত্মক’ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সােহরাওয়ার্দী-শরৎ-বসু’ ফর্মুলাকে সেদিন নর্দমায় নিক্ষেপ করেছিলেন। এটা উপমহাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এক চরম ট্রাজেডি’ এবং এটাই হচ্ছে বাস্তব সত্য। ওঁরা ভাবতেও পারেননি—পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ হবে আর সেই বংলাদেশই হবে বাঙালী জাতির আবাসস্থল- বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য এবং বাঙালী লােকাচার ও সংস্কৃতির পীঠস্থান।

 

সূত্রঃ   একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল

 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!