বাংলাদেশের বাঙালী মধ্যবিত্তের ইতিবৃত্ত
প্রশ্নটা হচ্ছে ইতিহাসের কোন্ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বাঙালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গােড়াপত্তন হলাে। পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধের ফলাফল থেকেই বঙ্গীয় এলাকা তথা ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের গতিধারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। আরও লক্ষণীয় যে, পলাশী ও বক্সার যুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুর্শিদাবাদের পরাজিত হবার পর থেকে প্রায় শতাধিক বছর পর্যন্ত সময়কালে বঙ্গীয়। এলাকার বিশেষ করে মুসলিম জনগােষ্ঠী নেতৃত্ববিহীন হয়। যুদ্ধে পরাজিত হবার দরুন নবাবরা ছাড়াও এঁদের সমর্থকগােষ্ঠী উচ্চশ্রেণী তখন কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে; অবাঙালী উচ্চ মধ্যবিত্ত শেণী হয় উত্তর ভারতে প্রত্যাবর্তন করেছে, আর না হয় নিশ্চিহ্ন হয়েছে। এর পাশাপাশি কৃষক ও নিম্নশ্রেণীর জনগােষ্ঠী অত্যাচারের জগদ্দল পাথরের নিচে নিষ্পেষিত অনাহার, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য এদের নিত্যসঙ্গী ইংরেজ পাদ্রী রেভারেন্ট জেমস্ লঙ-এর ভাষায় বলতে গেলে, “জীর্ণ প্রাসাদের ভগ্নস্তুপ এবং শশাচনীয় সামাজিক দূরবস্থার দিকে দেখলেই বােঝা যায় যে, এদেশের মুসলমানরা নিশ্চিত ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে।” এরই জের হিসাবে ইংরেজদের সক্রিয় পৃষ্ঠপােষকতায় বঙ্গীয় এলাকায় উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ নাগাদ যখন কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সুদৃঢ় অবস্থান, তখনকার বিরাজমান সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মার্ক্সিস্ট গবেষক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক শ্রী বিনয় ঘােষ চমৎকার মূল্যায়ন করেছেন।
তিনি লিখেছেন, কিন্তু নব্যবঙ্গের ইন্টেলিজেনশিয়াল (বাঙালি বর্ণহিন্দু) এই বিকাশের ধারাটা সুখের নয়। তার মধ্যে ট্রাজেডি’র উপকরণও ছিল। যথেষ্ট। কিন্তু কিসের ট্রাজেডি’? প্রথম ও প্রধান ট্রাজেডি’ হলাে, বাংলার এই বিদ্বৎসমাজ প্রায় সম্পূর্ণ মুসলমানবর্জিত’ রূপ ধারণ করল এবং সেই জন্য একে। সাধারণভাবে বাঙালী হিন্দু বিদ্বৎসমাজ’ বলাই যুক্তিসঙ্গত। আমরা যখন নব্যবঙ্গের বা নবযুগের বাংলার ইতিহাস আলােচনা করি, তখন কতকটা সচেতনভাবেই বাঙালী মুসলমান সমাজের এই প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাই। কিন্তু কোন সমস্যাকে এড়িয়ে গিয়ে। ইতিহাস লেখা যায় না; সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস তাে নয়ই। বাংলার বিদ্বৎসমাজের বিকাশের ইতিহাস আলােচনা প্রসঙ্গে তাই বাঙালী মুসলমান সমাজের কথা বললে আলােচনা সম্পূর্ণ হয় না।” “উনবিংশ শতাব্দীতে যখন বাংলার পুরানাে সমাজ বিন্যাসের ভাঙ্গাগড়া চলছে এবং ইংরেজ আমলের নতুন সম্ভ্রান্ত বণিক সমাজ গড়ে উঠছে, তখন মুসলমান সমাজের অবস্থা কি? বাঙালী সম্রান্ত মুসলমান পরিবার সেই সময়ের মধ্যে ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। ইংরেজ নয়, তাঁদের ঐশ্বর্য ও আভিজাত্য ছিল মুসলমান আমলের। সেই ঐশ্বর্য ও আভিজাত্য দুই-ই যখন তাদের লুপ্ত হয়ে গেল, তখন ইংরেজ আমলের নতুন সম্ভান্ত হিন্দু সমাজ গড়ে উঠল।”
অর্থাৎ শােভাবাজার, জোড়াসাঁকো, পাথুরিয়া, বাগবাজার, শ্যামবাজার, কলুটোলা প্রভৃতি অঞ্চলে, নতুন রাজধানী কলকাতায় যখন ইংরেজ তা.”লের সম্রান্ত হিন্দু পরিবার-প্রতিষ্ঠাতারা ধনসমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন মুর্শিদাবাদ, গলি প্রভৃতি পুরানাে মুসলমান শাসন কেন্দ্রে সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের ক্রমবিলুপ্তি ঘটছিল। বাঙালী দেওয়ান বেনিয়ান মুদ্দিদের মধ্যে মুসলমানদের নাম একরকম পাওয়াই যায় না বলা চলে। তার প্রধান কারণ বাঙালী মুসলমানদের ইংরেজ বিদ্বেষ সেই সময় অনেক বেশি তীব্র ছিল। মুসলমান সমাজ তাই সর্বক্ষেত্রে, রাজ্যচ্যুতি ও মর্যাদাহানির বিক্ষোভ থেকে ইংরেজদের সঙ্গে অসহযােগিতা করছেন। শিক্ষা, রাজসম্মান ইত্যাদির কোন ক্ষেত্রেই তারা কোন সুযােগ গ্রহণ করতে চাননি, বরং তাদের অসহযােগ নীতির পূর্ণ। সুযােগ ইংরেজরা তাদের শাসনস্বার্থে গ্রহণ করেছিলেন। ইংরেজরা সেই সুযােগে শিক্ষা ও অর্থ উভয় ক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভে হিন্দু সমাজকে সাহায্য করেছেন এবং সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির বীজ বপন করে ভবিষ্যতের জন্য তাদের সিংহাসনটিকে অটল রাখার চেষ্টা করেছেন। মুসলমান সমাজে নতুন মধ্যশ্রেণীর বিকাশ তাে একেবারেই হয়নি, পুরানাে অভিজাত সমাজ ধীরে ধীরে লােপ পেয়েছে এবং দরিদ্র ও নিঃস্ব শ্রেণীর সংখ্যা বেড়েছে। নতুন কোন বিদ্বৎসমাজেরও বিকাশ হয়নি।”(‘বাংলার বিদ্বৎসমাজ’ ২য় সং প্রকাশ ভবন, কলিকাতা ১৯৭৮ খ্রিঃ। তা’হলে একথা বলতেই হচ্ছে যে, এদেশের ইংরেজদের আগমনের পর প্রথম দেড়শ বছর পর্যন্ত ইংরেজ নীতিতে মুসলিম বিদ্বেষ এবং বাঙালী হিন্দুদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব উলঙ্গভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের চাপে ইংরেজ সরকার অফিস-আদালতে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজী ভাষা চালু করার নির্দেশ প্রদান করলে স্বাভাবিকভাবেই বাঙালী মুসলিম সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অতঃপর মাত্র বছর সাতেকের মধ্যে জারিকৃত অপর এক নির্দেশে বঙ্গীয় সমাজের চেহারাটাই পাল্টে যায়। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ অক্টোবর তারিখে জারিকৃত এই নির্দেশে বলা হলাে যে, অতঃপর সরকারের সমস্ত বিভাগে শুধুমাত্র ইংরেজী শিক্ষিত যুবকরা নিয়ােগ লাভ করবে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও গবেষক ডঃ এ আর মল্লিক এ সম্পর্কে চমৎকার মূল্যায়ন করেছেন। তিনি লিখেছেন, এতে মুসলমানদের ভাগ্য চিরতরে মুদ্রিত হয়ে গেলাে।
১৮৫১-৫২-এর তালিকায় ৭৭টি নামের মধ্যে মুসলমানদের নাম ছিল মাত্র একজনের । সে বছর হুগলী কলেজের তালিকাতে কোন মুসলমানের নাম দৃষ্ট হয় না। মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনের চাকরিতে অথবা রাজস্ব বিভাগের চাকরিতে ১৮৫৬-৫৭ সালে ৩৩৬ জন লােককে নিয়ােগ করা হয়েছিল। তার মধ্যে মুসলমান ছিলেন মাত্র ৫৪ জন, ৯জন খ্রিষ্টান, বাকি সব হিন্দু। অন্যান্য বিভাগেও মুসলমানদের অবস্থা খুব ভাল ছিল না। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গভর্নমেন্ট নিয়ােজিত মেডিক্যাল কলেজের ৪৯ জন সহকারী সার্জনের মধ্যে মাত্র ৫ জন ছিল মুসলমান। শিক্ষা বিভাগের দ্বারও রুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য। “(ব্রিটিশ নীতি ও বাংলার মুসলমান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা ১৯৮২খ্রিঃ)। প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা যায় যে, ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় এলাকায় সরকারী মঞ্জুরির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে অধ্যয়নরত মােট ৪,৫৪১ জন ছাত্রের মধ্যে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা মাত্র ৬০৮ জন এবং ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে ৭,২১৬ জন ছাত্রের মধ্যে মাত্র ৯৩১ জন। আর সিপাহী বিদ্রোহের বছরে অর্থাৎ ১৮৫৬-৫৭ খ্রিস্টাব্দে এ ধরনের বিদ্যালয়গুলােতে অধ্যয়নরত ২০,৬৪৭ জন ছাত্রের মধ্যে বাঙালী মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা ছিল মাত্র ১,৫৮৬ জন। অবশিষ্ট সবাই বাঙালী হিন্দু। এখানে উল্লেখ্য যে, কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সিপাহী বিদ্রোহের (বিপ্লব) সময় ইংরেজদের সমর্থন দেয়ায় পুরস্কার” হিসাবে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দেই ইংরেজ ভারতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলাে এই কলকাতাতেই। এই সম্প্রদায় তখন পূর্ণ বিকাশের পথে। এরপরই বঙ্কিম-বিবেকানন্দের আবির্ভাবে একটা ভ্রমাত্মক দর্শনের ভিত্তিতে তা পরিপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করলাে।
সেক্ষেত্রে বিরাজমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন করলে দেখা যায় যে, উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কালে সংখ্যাগুরু বঙ্গীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থা আরও শােচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমনটি হলাে? সংক্ষেপে বলতে গেলে এটা এমন একটা সময়, যখন অন্যান্য নানাবিধ কারণের মধ্যে ‘লাখেরাজ’ অর্থাৎ নিষ্কর জমি বাজেয়াফতকরণের ফলে বাঙালী মুসলিম জনগােষ্ঠীর মধ্যশ্রেণী প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। উপরন্তু এরা বহু সংখ্যক কৃষক বিদ্রোহ করা ছাড়াও ইংরেজ ও শিখবিরােধী রক্তাক্ত “ওহাবী’ ও ‘ফারাইজী’ আন্দোলন এবং সিপাহী বিদ্রোহে (বিপ্লব) জড়িয়ে পড়েছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রের ফলাফল ব্যর্থতায় ভরপুর। ফলে দারুণ অভিমান এবং প্রচণ্ড ক্রোধবশত বাঙালী মুসলমানরা বরাবরই ইংরেজদের প্রতি বৈরীভাব পােষণ করেছে। এঁরা প্রায় শতাধিক বছর পর্যন্ত ইংরেজী ভাষা ও ‘কালচার’ বয়কট করে বসে ছিল। প্রসঙ্গত সিপাহী বিদ্রোহ (বিপ্লব) ব্যর্থ হওয়ার পরবর্তী সময়কালের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলােকপাত সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এ সম্পর্কে সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মােহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ লিখেছেন, বিদ্রোহ সম্পূর্ণভাবে প্রশমিত হওয়ার পূর্বেই ১৮৫৮ সালের ১ নবেম্বর ইংল্যান্ডের মহারানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। বড়লাট ক্যানিং উক্ত দিবস এলাহাবাদে এক দরবার অনুষ্ঠান করিয়া মহারানী ভিক্টোরিয়ার ঘােষণা পাঠ এবং ভারতবর্ষের প্রথম ভাইসরয় হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। মহারানী ভিক্টোরিয়ার প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করিয়া সেই অর্ধ লক্ষাধিক নর-নারী মধ্য ভারত ও নেপালের জঙ্গল হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া বৃটিশের নিকট আত্মসমর্পণ করে, বিদ্রোহােত্তরকালে প্রথম আঘাত পড়িয়াছিল তাহাদেরই উপর বিদ্রোহ, ইংরেজ হত্যা, ট্রেজারি ও অস্ত্রাগার লুণ্ঠন প্রভৃতি অভিযােগে ইহারা অভিযুক্ত হয়। কতজনের যে ফাসি হইল কত হাজার হাজার লােকের প্রতি যে স্বল্পমেয়াদী কারাবাসের আদেশ হইল তাহার হিসাব এক্ষণে পাওয়া দুষ্কর।
যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরবাসে যাহারা দণ্ডিত হইয়াছিল, শুধু তাহাদেরই সংখ্যা ছিল দশ হাজারের উর্ধ্বে। বিদ্রোহে উস্কানি, ইংরেজ নর-নারী হত্যায় প্ররােচনা, পলাতকদের আশ্রয় এবং আর্থিক সাহায্য দান, বিদ্রোহীদের গতিবিধি সংক্রান্ত তথ্যাদি ও সংবাদ গােপন প্রভৃতি নানা কাল্পনিক অভিযােগে হাজার হাজার মুসলমান তাহাদের জোত-জমি, তালুকদারী, জমিদারী, নগদ টাকা-পয়সা ব্রিটিশের হাতে তুলিয়া দিতে বাধ্য হয়।” (আমাদের মুক্তি সংগ্রাম ও পৃষ্ঠা ১২-১২৭, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৮) এ ধরনের বিরাজমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রখ্যাত গবেষক ও অধ্যাপক ডঃ আনিসুজ্জামানের মন্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তিনি লিখেছেন, সিপাহী অভ্যুত্থানের সমস্ত দায়িত্বই কিন্তু ভারতীয় মুসলমানদের ঘাড়ে এসে পড়েছিল। দেশে ও বিলেতে শাসক মহলে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে, মুঘল শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানরা এই বিদ্রোহ ঘটিয়েছিলেন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মােটা অংশটাই তাদের ভাগ্যে জুটেছিল।” (মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, ১৯৬৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) | তা’হলে দেখা যাচ্ছে যে, একদিকে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। মুসলিম ধর্মীয় মৌলবাদীদের দীর্ঘস্থায়ী ‘ওহাবী আন্দোলন’ এবং ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ (বিপ্লব), এই দুটো অভ্যুত্থানই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ায় উত্তর ভারত ও বঙ্গীয় এলাকার মুসলিম জনগােষ্ঠী ভয়াবহ বিপদে নিমজ্জিত হয়েছিল। এদেশের শাসনক্ষমতা ইংরেজদের দখলে থাকায় যেখানে সমসাময়িককালে বঙ্কিমচন্দ্রের সরাসরি বক্তব্য হচ্ছে, এক্ষণে সনাতন হিন্দুধর্ম সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ হয়েছে’; সেখানে ওহাবীদের এ মর্মে ঘঘাষিত নীতি ছিল যে, ইংরেজ রাজত্ব হচ্ছে ‘দারুল হরব’ । অর্থাৎ যতদিন পর্যন্ত ইংরেজ রাজত্ব বজায় থাকবে, ততদিন পর্যন্ত শরিয়ত মােতাবেক প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্ম। পালন সম্ভব নয়। ফলে দুই দফায় ওহাবী আন্দোলন মােট ৪০ বছরকাল স্থায়ী হয়েছিল।
এরই একেবারে শেষ পর্যায়ে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি সুদূর আন্দামানে বড়লাট লর্ড মেয়েকে এবং ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর দুপুরে কলকাতার হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে প্রধান বিচারপতি জাস্টিস নর্মানকে দু’জন ওহাবী হত্যা করে। বিচারে দু’জনেরই ফাঁসি হয়। প্রাপ্ত রেকর্ডপত্রের ভিত্তিতে একথা বলা যায় যে, ১৮৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ একদিকে নেতৃত্বের অভাব এবং অন্যদিকে ইংরেজ শাসকগােষ্ঠীর ভয়াবহ দমন নীতির ফলে উপমহাদেশে ওহাবী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। আর ঠিক এমনি সময়ে দিল্লী। ও উত্তর ভারতীয় এলাকায় স্যার সৈয়দ আহম্মদ এবং বঙ্গীয় এলাকায় ফরিদপুরের নবাব। আব্দুল লতিফ এবং কলকাতার সৈয়দ আমীর আলী প্রমুখের ভিন্নধর্মী কর্মকাণ্ড একটা পূর্ণ। অবয়ব গ্রহণ করতে শুরু করে। এটা বিশেষভাবে লক্ষনীয় যে, সিপাহী বিদ্রোহ (বিপ্লব) ব্যর্থ হওয়ার পর দিল্লী ও আলিগড় অঞ্চলে স্যার সৈয়দ আহম্মদের (জ. ১৮১৭ মৃ. ১৮৯৮ খ্রিঃ) কর্মকাণ্ডের ব্যাপক। বিস্তৃতি লাভ করে। শত বাধাবিপত্তির মধ্যেও স্যার সৈয়দের বক্তব্য হচ্ছে, ইংরেজ শাসক শ্রেণীর সঙ্গে সক্রিয় সহযােগিতার মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষার আলােক লাভ এবং দেশের শাসন ব্যবস্থায় অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এক্ষণে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তিনি ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে “সিহাপী বিদ্রোহের কারণ” শিরােনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক প্রকাশ করেন। অতঃপর ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি “রাজভক্ত ভারতীয় মুসলমান” শীর্ষক আরও একটি পুস্তক রচনা করেন। উর্দু ভাষায় রচিত এই দু’টি পুস্তকে সৈয়দ আহম্মদ এ মর্মে লিখলেন যে, “বিদ্রোহের সময় মুসলমানরাই সব চাইতে রাজভক্তির পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় যেভাবে গােটা মুসলমান জাতটাকেই (?) এই ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারী বলে চিত্রিত করা হচ্ছে, সেটা খুবই শােচনীয়।”
প্রসঙ্গত সিপাহী অভ্যুত্থানের সময় সৈয়দ আহম্মদের ভূমিকা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলােচনা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। সাব-জজ হিসাবে সৈয়দ আহম্মদ যখন বীজানুর নামক স্থানে চাকরিরত তখনই সিপাহী বিপ্লবের সূচনা হয়েছে। গবেষকদের মতে এসময় তার এ মর্মে স্থির বিশ্বাস জন্মে যে, দেশীয় সিপাহীদের এই অভ্যুত্থান সফল হবে এবং এর জের হিসাবে মুসলমানদের জন্য মহা দুর্যোগের সৃষ্টি হবে। এজন্য সৈয়দ আহম্মদ প্রকাশ্যেই এ ধরনের বিদ্রোহের বিরােধিতা করেন। ফলে তার ভূমিকা দারুণভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়ে। এ সময় সামগ্রিকভাবে কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় যেভাবে ইংরেজদের সহযােগিতা প্রদান করেছিল, ঠিক একইভাবে দিল্লী এলাকায় সৈয়দ আহম্মদের একমাত্র পরিবার ইংরেজদের সমর্থনে সােচ্চার হয়েছিল। এজন্য সৈয়দ পরিবারকে দারুণভাবে ‘কাফফারা দিতে হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহীগণ কর্তৃক স্বল্প সময়ের জন্য দিল্লী অবরােধ কালে তার চাচা সপুত্র নিহত হন। উপরন্তু মানসিক দুশ্চিন্তায় এসময় সৈয়দ আহম্মদের মাতার মৃত্যু হয়।
শেষ অবধি স্যার সৈয়দের প্রাণ রক্ষার জন্য ইংরেজরা সামরিক প্রহরার ব্যবস্থা করা ছাড়াও মাসিক ২০০ টাকা অতিরিক্ত ভাতার ব্যবস্থা করেছিল। মােদ্দা কথায় বলতে গেলে সে আমলে ইংরেজ শাসক কর্তৃপক্ষ সৈয়দ আহম্মদের ভূমিকা সম্পর্কে বিশেষভাবে সন্তুষ্ট ছিলেন। স্যার জন স্ট্রাচির মন্তব্য হচ্ছে, “১৮৫৭ সালে তিনি (সৈয়দ আহম্মদ) যেভাবে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সমর্থনে অদম্য সাহসিকতার ও আনুগত্যের পরিচয় দিয়েছেন, অন্য কারও পক্ষে এর চেয়ে মহৎপ্রমাণ। দেয়া সম্ভব হয়নি। তিনি যে নিষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন, আমার পক্ষে যে ভাষায়ই তার বর্ণনা দেই না কেন তা সম্পূর্ণ হবে না। পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, স্যার সৈয়দ আহম্মদের নিরলস প্রচেষ্টার দরুন উত্তর ভারতীয় উর্দুভাষী মুসলমানদের প্রতি ইংরেজ সরকারের বৈরীভাব অচিরেই প্রশমিত হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে সৃষ্টি হয় দারুণ হৃদ্যতা। এই হৃদ্যতা ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের দেশত্যাগ পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। এ সময়কালের মধ্যে উত্তর ভারতীয় এলাকায় ইংরেজবিরােধী আর কোন উল্লেখযােগ্য আন্দোলন পর্যন্ত হয়নি। এদিকে স্যার সৈয়দ আহম্মদ ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড পরিভ্রমণ করেন এবং দেশে প্রত্যাবর্তনের পর ‘মহামেডান সােশ্যাল রিফরমার’ নামে একটি পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। পত্রিকাটির একটি মাত্র লক্ষ্য ছিল এবং তা হচ্ছে ভারতীয় মুসলমানদের ইউরােপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে শিক্ষালাভ ও ইংরেজদের প্রতি সহযােগিতা প্রদান করা। ফলে মুসলিম মৌলবাদী নেতৃবৃন্দ সৈয়দের কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালােচনা করেন এমনকি এসময় তাঁকে ধর্মত্যাগী হিসাবে আখ্যায়িত করা হয় । কিন্তু সৈয়দ আহম্মদ স্বীয় আদর্শ প্রচার অব্যাহত রাখেন এবং ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে আলিগড়ে মুসলিম এংলাে ওরিয়েন্টাল কলেজ স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে এটাই আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আলিগড়ের স্যার সৈয়দ আহম্মদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন সম্পর্কে সর্বত্র মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন চিন্তা-ভাবনার সৃষ্টি হয় ।
এর দু’টি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমত বিরাজমান পরিস্থিতিতে ইংরেজ শাসনকে মেনে নেয়া সমীচীন হবে এবং দ্বিতীয়ত ইংরেজ ভারতে পবিত্র ইসলাম ধর্ম পালনে অসুবিধা নেই অর্থাৎ ইংরেজ ভারত ‘দারুল হরব’ নয় । ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নবাব আমীর হােসেন খান বাহাদুর স্বীয় রচিত গ্রন্থে এ মর্মে মত প্রকাশ করলেন যে, শিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ অসিদ্ধ।’ এ সময় মক্কার হানাফী, শাফায়ী এবং মালেকী সম্প্রদায়ের তিনজন মুফতী ইংরেজ ভারতকে ‘দারুল ইসলাম’ আখ্যায়িত করলেন। অর্থাৎ ইংরেজ ভারতে পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিধানসমূহ পালন করা সম্ভবপর। ঠিক এমনি এক সময়ে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে সংস্কারপন্থী নবাব আব্দুল লতিফ এবং সৈয়দ আমীর আলীর উদ্যোগে কলকাতায় স্থাপিত হলাে ‘মহামেডান লিটারারি সােসাইটি।’ এ বছরেই কলকাতায় আহূত হলাে এর বিশেষ অধিবেশন। এতে সুদূর দিল্লী থেকে স্যার সৈয়দ আহম্মদও যােগ দিয়েছিলেন। তবে এই অধিবেশনে সুফী মতাবলম্বী মওলানা কেরামত আলী জৈনপুরীর বক্তব্য সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মওলানা জৈনপুরীর জোরালাে ও সারগর্ভ বক্তব্যের আলােকে অধিবেশনে ধর্মীয় বিধানসমূহ আলােচনার পর এ মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, “ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষ হচ্ছে দার-উল ইসলাম’- দারুল হরব নহে এবং এখানে শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা ধর্মীয় নির্দেশের পরিপন্থী।” (ডঃ আনিসুজ্জামানকৃত মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, পৃষ্ঠা ৮৬)। | প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় যে, মওলানা কেরামত আলী জৈনপুরীর উল্লিখিত বক্তব্য ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ফতােয়া আকারে ব্যাপকভাবে বঙ্গীয় এলাকায় প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে একথা বলা যায় যে, ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হবার ১১৩ বছর পর এই প্রথমবারের মতাে বঙ্গীয় এলাকার মুসলিম সম্প্রদায় ইংরেজ শাসকদের বিরােধিতার পথ পরিহার করলাে। যেখানে ইংরেজ রাজত্বের শুরু থেকেই কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু সম্প্রদায় নিজেদের গােষ্ঠীস্বার্থে ইংরেজদের সমর্থক শক্তি হিসাবে সহযােগিতা প্রদান করেছিল, সেখানে শতাধিক বছর পর ১৮৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাঙালী মুসলমানরা ইংরেজ শাসন মেনে নিয়ে ইংরেজী শিখতে শুরু করলাে। বাঙালী মুসলিম মধ্যশ্রেণীর গােড়াপত্তন হলাে। তৎকালীন বাঙালী মুসলিম সম্প্রদায়ের মনমানসিকতা এবং চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন সম্পর্কে প্রখ্যাত গবেষক কাজী আব্দুল ওদুদের বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন,ওহাবীদের দমন করতে ইংরেজ গভর্নমেন্টের লােকবল ও অর্থবল।
দুইয়েরই অপচয় হয়েছিল। পরিশেষে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে বহু ওহাবীকে নির্বাসনে পাঠিয়ে। শাসকবর্গ কিঞ্চিৎ স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন । সিপাহী বিদ্রোহ দমন ও ওহাবী বিদ্রোহ দমন, এই দুইয়ের প্রভাবে মুসলমান সম্প্রদায় অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ল অথবা তাদের দুর্বলতা অত্যন্ত প্রকট হলাে এবং শাসকবর্গের কৃপাভিক্ষা ভিন্ন তাদের আর গত্যন্তর রইল না। বিফল বিদ্রোহের এমন বিনতি স্বাভাবিক সন্দেহ নেই, কিন্তু বড় করুণ। এই দুর্দিনে তাদের চলল ধর্ম সম্বন্ধে নতুন চিন্তা। ভারতবর্ষ প্রকৃত প্রস্তাবে অমুসলমান রাজ্য “দারুল হরব” নয়। কেননা মুসলমানদের দৈনন্দিন ধর্মকর্মে এদেশের শাসকবর্গ বাধা দেয় না। এই মত প্রসার লাভের দিন এলাে।” (শাশ্বত বঙ্গ ২য় সংস্করণ, ব্র্যাক প্রকাশনী, ঢাকা ১৯৮৩)। আসলে মওলানা কেরামত আলীর এই একটিমাত্র ঘােষণায় বঙ্গীয় এলাকায় ইতিহাসের গতিধারা সঠিক পথে পরিবর্তিত হয়ে গেল। এজন্যই কোন কোন গবেষকের মতে মওলানা জৈনপুরীর আলােচ্য ফতােয়া হচ্ছে বাঙালী মুসলমানদের জন্য ম্যাগনা কার্টা’। কেননা শরিয়তপন্থী ওহাবী আন্দোলনের সমাপ্তিতে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে সুফীপন্থী মওলানা জৈনপুরী ইংরেজ শাসিত এলাকাকে ‘দারুল ইসলাম’ বলে ঘােষণা করলে, সত্যিকার অর্থেই বাঙালী মুসলমানরা ইংরেজী শিখতে শুরু করল এবং এখান থেকেই নতুনভাবে মুসলিম মধ্যবিত্তের যাত্রা শুরু ওপার বাংলায় (পশ্চিম বাংলায়) যারা বসবাস করেছেন, তাদের মাতৃভাষা নিশ্চয়ই বাংলা এবং তারা বঙ্গভাষীও বটে। কিন্তু তারা কিছুতেই বাঙালী’ নন। ওঁরা হচ্ছে বহুবর্ণ ভারতীয় নাগরিক। ওদের পাসপাের্ট পর্যন্ত ‘ইন্ডিয়ান পাসপাের্ট’। ১৯৪৭ সালেই এর সুরাহা হয়ে গেছে। এ সময় পূর্ব বাংলার উচ্চবর্ণের বর্ণহিন্দু এবং পশ্চিম বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে একটি মাত্র সিদ্ধান্তে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে। পূর্ব বাংলার সংখ্যাধিক্য জনগােষ্ঠী, যাদের অধিকাংশই ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান এবং খণ্ডিত ভারতের বিপুল সংখ্যাধিক্য অবাঙালী হিন্দু জনগােষ্ঠীর মধ্যে ওরা ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে সেদিন ‘ভ্রমাত্মক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
এটা উপমহাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এক চরম ট্রাজেডি’ এবং এটাই হচ্ছে বাস্তব সত্য। তারা ভাবতেও পারেনি। পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ’ হবে। আর সেই বাংলাদেশই হবে বাঙালী জাতির আবাসস্থল- বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। এজন্য একথাটা বলা যায় যে, শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তানকে যেমন অখণ্ড রাখা সম্ভব হয়নি এবং মুসলিম বঙ্গ’ও গঠিত হয়নি; ঠিক তেমনিভাবে রাধাকান্তভূদেব- বঙ্কিমের প্রদর্শিত পথে শুধুমাত্র বাঙালী হিন্দুদের নিয়েও বাঙালী জাতির সৃষ্টি সম্ভব হয়নি। উপরন্তু রাষ্ট্র গঠনের জরুরি উপাদানগুলাে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র ভাষার ভিত্তিতেও একটা জাতি গঠন এবং একটা রাষ্ট্র সৃষ্টি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই “বিভ্রান্তিগুলাে সঠিকভাবে অনুধাবন। করে লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় বসবাসকারী জনগােষ্ঠী হচ্ছে আদিতে বাঙালী এবং ধর্মবিশ্বাসে এঁদের অধিকাংশই মুসলমান। এই বিশাল জনগােষ্ঠীকে প্রায় দু’শ’ বছর ধরে ইংরেজরা শাসন ও শােষণ করেছে; কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী ও জমিদাররাও শােষণের পাশাপাশি ঘৃণা ও অবহেলা করেছে আর সব শেষে উত্তর ভারতীয় অবাঙালী মুসলিম খান্দানী শ্রেণী ধর্মের নামে এদের “প্রতারিত” ও “ধােকা দিয়েছে। কিন্তু এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার যে, ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে মওলানা জৈনপুরীর ঐতিহাসিক ফতােয়া জারির পর হিসাব করলে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান ঠিক ১০০ বছর। এই সময়কালের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালী মুসলমান মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বাল্য ও কৈশাের অতিক্রমের পর যৌবনে পদার্পণ করেছে। এরই প্রেক্ষিতে ইংরেজ রাজত্বের অন্তিম পর্বে চাকরিতে মুসলমানদের পৃথক ‘কোটা’র রাজনীতির অবতারণা হয়েছিল। এতেও এরা সন্তুষ্ট হলেন; এঁরা পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়লাে।
কিন্তু সেই পাকিস্তানেও ধর্মের নামে ষড়যন্ত্রে পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত তথা জনগােষ্ঠীর স্বার্থ কোরবানী হলে এঁরা বঙ্গবন্ধুর বাঙালী জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হলাে। সংঘটিত হলাে একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ আলােচ্য এক শ’ বছরের সমাপ্তিতে পৃথিবীর বৃহত্তম গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকার বঞ্চিত ও অবহেলিত বিশাল জনগােষ্ঠী বাংলাদেশের বাঙালী জাতীয়তাবাদের দর্শনের ভিত্তিতে সৃষ্ট স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিকে পরিণত হয়েছে। একটা নির্দিষ্ট ভৌগােলিক সীমারেখায় এরা শুধু স্বাধীন ও সার্বভৌম হয়েছে, তাই-ই নয়, এদের রাষ্ট্রভাষা হচ্ছে সহস্রাধিক বছরের ঐতিহ্য বহনকারী বাংলা ভাষা সমগ্র বিশ্বে একমাত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হচ্ছে বাংলা সেক্ষেত্রে এঁরাই হচ্ছে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, লােকাচার ও কৃষ্টির ‘গার্জিয়ান’ তবে যার সঠিক নেতৃত্বে এসব কিছু সম্ভব হয়েছে, তিনিই হচ্ছেন বাংলাদেশের বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তবে প্রসঙ্গত একটা কথা বলতেই হচ্ছে যে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন শ্রেণীগতভাবে মধ্যবিত্ত পরিবারের এক ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব তিনি ছিলেন গ্রামের সন্তান শহরের প্রগতিশীল মধ্যশ্রেণীর নেতৃত্বে চিন্তার সঙ্গে ছিল তাঁর বিরাট ফারাক যেখানে শহুরে মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব হচ্ছে ভয়ঙ্করভাবে শ্রেণীসচেতন; সেখানে বঙ্গবন্ধু ছিলেন দুখী মানুষের জন্য। নিবেদিতপ্রাণ। উপমহাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটা এক অভূতপূর্ব ঘটনা।
সূত্রঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল