You dont have javascript enabled! Please enable it!
অসম্পূর্ণ নজরুল
১৯২০ সাল থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত। ঠিক ২২ বছর। এটুকুই হচ্ছে নজরুলের কর্মময় জীবন। সঠিকভাবে পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, এই স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলা সঙ্গীত ও সাহিত্যের প্রাঙ্গণে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম পিচকারি হাতে হােলি খেলে গেলেন কি দারুণ তার রঙের বাহার! কখনও পালাগান লিখেছেন, কখনও ছােট গল্প; কখনও প্রবন্ধ আবার কখনও বা উপন্যাস কখনও নাটক রচনা করেছেন, কখনও বা কবিতা আর গান। সর্বত্র অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর এই চারণ কবি দারিদ্রের কষাঘাতে কখনও সাংবাদিকতা করেছেন, কখনও বা অভিনয় কখনও বই-এর স্বত্ত্ব বিক্রি করেছেন। আবার কখনও বিক্রি করেছেন গানের রেকর্ডের ‘রয়ালটি’ দুর্লভ চরিত্রের এই খেয়ালি মানুষটি যতদিন সুস্থ ছিলেন ততদিন একইভাবে বাউণ্ডেলে  জীবনযাপন করেছেন কোন কিছুর তােয়াক্কা পর্যন্ত করেননি। কবিতার ক্ষেত্রে বিদ্রোহের বহ্নিশিখায় আপুত কবি নজরুল কখনও ‘হামামদিস্তা’ দিয়ে বাংলা কবিতার ছন্দ ভাঙচুর করে আবার নবরূপে সাজিয়েছেন; আবার কখনও আরবী, ফার্সী আর সংস্কৃত ভাষা থেকে ইচ্ছামত শব্দসম্ভার হেচকা টানে উঠিয়ে এনে তার কবিতা ও গানে অপরূপভাবে প্রয়ােগ করেছেন।
কোথাও সৌন্দর্য বৃদ্ধি ছাড়া কমতি হয়নি। কবি নজরুল নিজে সঙ্গীত রচনা করেছেন, নিজেই সুর সংযােজন করেছেন। আবার সবশেষে সুললিত কণ্ঠে নিজেই পরিবেশন করেছেন। এমনটি ইতিহাসে বিরল বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম গজল লেখা ছাড়াও বিপুল সংখ্যক ইসলামী গান রচনার কৃতিত্ব যেমন নজরুলের ঠিক তেমনিভাবে তাঁর লেখনীতে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য শ্যামাসঙ্গীতের এসবই বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীত জগতের এক অমূল্য সম্পদ তবুও অবিভক্ত বাংলায় এক শ্রেণীর হিন্দু রক্ষণশীল এবং মুসলিম ধর্মীয় মৌলবাদী গােষ্ঠী কবি নজরুলকে ‘অচ্ছুৎ” ও “কাফের” হিসাবে চিহ্নিত করে বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন বাংলার আপামর জনগােষ্ঠী, বিশেষ করে তরুণ সমাজ এসব আহ্বানে সাড়া পর্যন্ত দেয়নি। কেননা নজরুলের লেখনীতে তখন অন্যায় ও অবিচার এবং শশাষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সােচ্চার প্রতিবাদ ধ্বনি প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় যে, বিশ দশকের গােড়ার দিকে তারেকেশ্বর মন্দিরের।
 
মােহান্তের নারীঘটিত কেলেঙ্কারি প্রকাশ পেলে তাকে বিতাড়নের আন্দোলন শুরু হয় এবং কবি নজরুল এই আন্দোলনকে দারুণভাবে সমর্থন প্রদান করেন। তিনি পূজারী। মােহান্তকে নিয়ে নির্মম ব্যঙ্গের গান লিখলেন : “এই সব ধর্ম-ঘাগী দেবতায় করেছে দাগী মুখে কয় সর্বত্যাগী, ভােগ-নরকে বসে। সে যে পাপের ঘণ্টা বাজায় পাপী দেবদেউলে পশে। আর ভক্ত তােরা পূজিস তারেই, যােগাস খােরাক সেবাদাসী । জাগাে বঙ্গবাসী।” (ভাঙ্গার গান ২য় মুদ্রণ ১৯৪৯) নজরুলের এসব তাে শুধু গান নয়- এসব হচ্ছে এক শ্রেণীর হিন্দু ধর্ম ব্যবসায়ীদের। মুখােশ উন্মোচন। ফলে কলকাতার হিন্দু রক্ষণশীল মহলের টনক নড়লাে। হিন্দু মালিকানাধীন পত্রপত্রিকাগুলাে, বিশেষ করে ‘শনিবারের চিঠি’ নজরুল বিরােধিতায় মেতে উঠল। তবুও নজরুল সাহিত্যের জনপ্রিয়তার গতি রােধ করা সম্ভব হলাে না। এটা এমন এক সময় যখন নজরুলের বিদ্রোহী’ কবিতা প্রায় সবার মুখে মুখে।
যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। এই কবিতাটি ‘মােসলেম ভারত’ ও ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হবার পর পাঠকদের মধ্যে প্রচুর কৌতূহল ও আগ্রহ লক্ষ্য করে রক্ষণশীল ‘প্রবাসী’ পত্রিকার কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত ১৩২৮ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পুনঃমুদ্রিত করতে বাধ্য হয়। ছন্দ, শব্দচরণ, মৌলিকত্ব- সবদিক দিয়ে বিচার করলে নির্দ্বিধায় এ কথা বলা যায় যে, নজরুলের ‘বিদ্রোহী কবিতা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ; এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। নজরুলের ‘বিদ্রোহী কবিতা হচ্ছে নিপীড়িত গণমানুষের হাতিয়ার। এজন্যই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা অবিনশ্বর। তবুও শনিবারের চিঠি’তে শুরু হলাে বিরামহীন বিরােধিতা। এসব সমালােচকদের অন্যতম ছিলেন সর্বশ্রী সজনীকান্ত দাস, মােহিতলাল মজুমদার, যােগানন্দ দাস, অশােক চট্টোপাধ্যায় (‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কনিষ্ঠ পুত্র) এবং হৈমন্ত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। ১৯২৪ সালের ৪ অক্টোবর ‘শনিবারের চিঠি’র পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত হলাে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বিদ্রুপাত্মক কবিতা। শিরােনাম হচ্ছে ‘ব্যাঙ’। আসলে মােহিতলাল মজুমদারের যােগসাজশে সজনীকান্ত দাস স্বয়ং এই কবিতার রচয়িতা ছিলেন। এর একটি প্যারা ছিল নিম্নরূপ :

“আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই,
আমি বুক দিয়া হাঁটি, ইদুর-ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।
আমি ভীম ভুজঙ্গ ফণিনী দলিত ফণা,
আমি ছােবল মারিলে নরের আয়ুর মিনিট যে যায় গণা
আমি নাগশিশু, আমি ফণিমনসার জঙ্গলে বাসা বাঁধি;
আমি ‘বে অব বিস্কে’ সাইক্লোন আমি, মরু সাহারা আঁধি।”
বিদ্রোহী কবি নজরুল এর জবাবে লিখলেন, সর্বনাশের ঘণ্টা’। ছাপা হলাে কল্লোল পত্রিকার কার্তিক (১৩৩১) সংখ্যায়। বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে তখন এক তুলকালাম ব্যাপার। যাদের সমালােচনার ভয়ে সমস্ত লেখককুল-এমনকি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ‘অস্বস্তি বােধ করতেন, সেই সজনীকান্ত-মমাহিতলালকে তীব্র কটাক্ষের কবিতা সর্বনাশের ঘণ্টা’? সত্যিই একমাত্র নজরুলের পক্ষেই সম্ভব এ ধরনের পাল্টা জবাব দেয়া। হিসাব করলে দেখা যায় যে, শনিবারে চিঠি’র মােট ৩৫টি সংখ্যায় নজরুলের সমালােচনামূলক নিবন্ধ, প্যারােডি কবিতা, নাটিকা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছিল। এ ধরনের এক প্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে, কলকাতার শিক্ষিত হিন্দু রক্ষণশীল গােষ্ঠী। কোন সময়েই নজরুলকে সহ্য করতে পারেনি। অবশ্য এদের পরিধি ছিল সীমিত।
অন্যদিকে সাম্যবাদী আদর্শের প্রশস্তি ছাড়াও কামাল আতাতুর্ক ও নব্য তুরস্কের প্রশংসা এবং জনসাধারণের বােধগম্য বাংলায় মিলাদশরীফসহ বহু গান রচনা করায় এক শ্রেণীর মুসলিম মৌলবাদী গােষ্ঠী ভয়ঙ্করভাবে নজরুল-বিরােধিতার জন্য এগিয়ে এলাে। এঁরা ছিল ইসলাম দর্শন’, ‘মােসলেম দর্পণ’, মােসলেম জগৎ’, মােহাম্মদী’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকার আশ্রয়পুষ্ট এঁরাই কবি নজরুলকে নাস্তিক’ ও ‘বিধর্মী’ হিসাবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হলাে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত মােসলেম দর্পণ’ পত্রিকায়। ১৯২৫ সালের আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়ের অংশবিশেষ ছিল নিম্নরূপঃ ইসলামের অবমাননাকর কোন বিষয়ের উল্লেখ না করে তজ্জন্য তাহাকে (কবি নজরুল ইসলামকে) এক্ষণে যথাচিত শাসিত করা সমাজের পক্ষে কর্তব্য হইয়া পড়িয়াছে। বিচারালয়ের আইনের সাহায্যেও তাহাতে শাসিত করিতে হইবে।” এর। চেয়েও ভয়ঙ্কর ধরনের সমালােচনা প্রকাশিত হলাে ইসলাম দর্শন’ পত্রিকার ৩য় বর্ষ ২য়। সংখ্যা (কার্তিক ১৩২৯)। মুন্সী রেয়াজদ্দীন রচিত নিবন্ধের শিরােনাম “লােকটা মুসলমান না শয়তান”। এতে মুন্সী সাহেব যে কদর্য ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং জঘন্য মন্তব্য প্রকাশ করেছেন তা বিশেষভাবে লক্ষণীয় : 
 
এই উদ্দাম যুবক (কাজী। নজরুল ইসলাম) যে ইসলামী শিক্ষা আদৌ পায় নাই তাহা ইহার লেখার প্রতি ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পাইতেছে। হতভাগ্য যুবকটি ধর্মজ্ঞানসম্পন্ন মুসলমানের সংস্পর্শ কখনও লাভ। করে নাই। থাকুক তাহার লেখার যথেষ্ট শক্তি, হউক সে বিখ্যাত, তজ্জন্য মুসলমানদের। গৌরব করিবার কিছুই নাই”। “নরাধম ধর্মের মানে জানে কি? লােকটা শয়তানের পূর্ণাবতার। ইহার কথা। আলােচনা করিতে ঘৃণাবােধ হয়। খাঁটি ইসলামী আমলাদারী থাকিলে এই ফেরাউন বা নমরুদকে গুলিবিদ্ধ করা হইত বা উহার মুণ্ডপাত করা হইত নিশ্চয়ই। ধর্মদ্রোহী অভিশপ্ত। ইবলিশ অপেক্ষাও পামরতার পরিচয় দিয়াছে। অথচ এ কথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে, বাংলা ভাষায় প্রথম গজল গান রচনা করেছিলেন কবি নজরুল ইসলাম এবং শ্যামাসঙ্গীতের পাশাপাশি তিনি যত ইসলামী। সঙ্গীত রচনা ও সুর সংযােজন করেছেন তা আজও পর্যন্ত অন্য কোন কবি ও। গীতিকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কৈশােরে (আসানসােলে থাকার সময়েই) ফার্সী ভাষায় নজরুলের ব্যুৎপত্তি হয়। পরবর্তীকালে করাচীতে বাঙালী পল্টনে। অবস্থানকালে (১৯১৭-১৯১৯ ইং) জনৈক পাঞ্জাবী মৌলবীর মুখে দেওয়ান-ই-হাফিজ’এর কবিতা আবৃত্তি শুনে তিনি বিমুগ্ধ হন এবং কিছু কিছু অনুবাদ করেন। ১৯৩০ সালে নজরুল তার প্রাণপ্রিয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যু-শিয়রে বসে রুবাইৎ-ই-হাফিজের অনুবাদ সমাপ্ত করেন। এটি প্রকাশ করেছিল কলকাতার শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী এ্যান্ড সন্স বইটির মুখবন্ধে নজরুল লিখেছিলেন, “সত্যিকার হাফিজকে চিনতে হলে গজল গান । পঞ্চশতাধিক পড়তে হয়। তার রুবাইৎ বা চতুর্পদী কবিতাগুলাে পড়ে মনে হয়, এ যেন। তার অবসর সময় কাটানাের জন্যই লেখা। অবশ্য এতেও তাঁর সেই দর্শন, সেই প্রেম, সেই শরাব-সাকী তেমনিভাবেই জড়িয়ে আছে।
 
এখানেই শেষ নয়। অতঃপর কবি নজরুল ইসলাম পবিত্র কোরান শরীফের বঙ্গানুবাদের কাজে হাত দেন। তবে কবিতায় এবং ছন্দ মিলিয়ে। ১৯৩৩ সালে নজরুলকৃত কাব্যে আমপারা’ প্রকাশিত হয়। এতে ৩৮টি সূরার অনুবাদ রয়েছে। ভূমিকায় নজরুলের বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয় : “….আমার বিশ্বাস পবিত্র কোরান শরীফ যদি সরল বাংলা পদ্যে অনূদিত হয় তাহলে অধিকাংশ মুসলমানই সহজে কণ্ঠস্থ করতে পারবেন- অনেক বালক-বালিকাও সমস্ত কোরান হয়ত মুখস্থ করে ফেলবে। কোরান পাকের একটি শব্দও এধার ওধার না করে তার ভাব অক্ষুন্ন রেখে কবিতায় সঠিক অনুবাদ করার মতাে দুরূহ কাজ আর দ্বিতীয় আছে কিনা জানি না। কেননা আমার কলম, আমার ভাষা, আমার ছন্দ এখানে আমার আয়ত্তাধীন নয়। প্রাপ্ত তথ্যে। দেখা যায় যে, সমগ্র কোরান শরীফের বাংলা পদ্যে অনুবাদ করার ইচ্ছা ছিল কবি। নজরুলের। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, কবি তা সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি।
গবেষকদের মতে নজরুল গীতিকে মােটামুটি ৫ ভাগে শ্রেণীবিন্যাস করা সম্ভব। এগুলাে হচ্ছে ।
ক. মানবিক প্রেমগীতি
খ, স্বদেশ প্রেমভিত্তিক
গ, ভক্তিমূলক গজল ও শ্যামাসঙ্গীত
ঘ, প্রকৃতি বন্দনা এবং
ঙ. হাসির গান।
হিসাব করে দেখা গেছে যে, স্বল্প পরিসর সময়ের মধ্যে নজরুল ইসলাম প্রায় ৪ হাজারের মতাে গান রচনা করেছেন। কিন্তু আফসােস, এখনও পর্যন্ত প্রায় এক হাজারের মতাে গানের হদিস করা সম্ভব হয়নি। এরপর রয়েছে নজরুলগীতির অবিকৃত স্বরলিপি সংগ্রহের দুরূহ কাজ। এই দুটি ক্ষেত্রে গবেষণার অগ্রগতি মােটেই সন্তোষজনক নয় বলা যায়। এছাড়া বাংলাদেশে নজরুলের রচিত শ্যামাসঙ্গীতের সংগ্রহশালা তাে একেবারেই শূন্যের কোটায় এবং দুঃখজনকভাবে গজলের সংগ্রহও সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি।  একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশ বেতার ও টিভিতে যেমন নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত পরিবেশিত হয় না; ঠিক তেমনিভাবে আকাশবাণী ও দূরদর্শনের কলকাতা কেন্দ্র থেকে নজরুলের ইসলামী সঙ্গীতও প্রচারিত হয় না বললেই চলে। সে ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় নজরুল সাহিত্য ও সঙ্গীত খণ্ডিত হয়ে রয়েছে। এটা কিছুতেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য কাম্য হতে পারে না। কবি নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি বিধায় ‘খণ্ডিত নজরুলের প্রশ্নই উঠতে পারে । আমরা নজরুলকে পূর্ণ অবয়বে গ্রহণ করতে চাই। ভারতের পশ্চিম বাংলায় যদি সরকারী পর্যায়ে নজরুল সাহিত্য ও সঙ্গীতের সবটুকু গ্রহণ করার মতাে সৎসাহস না থাকে সেটা তাদের সঙ্কীর্ণ মনমানসিকতার বহিঃপ্রকাশ এবং হীন্মন্যতা।
এক্ষণে নজরুল সাহিত্যের মূলধারা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলােকপাত করা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এ সম্পর্কে কবি নিজেই তার ব্যাখ্যা দান করে গেছেন। আসলে তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালী মুসলমানদের খেদমতের জন্য অনুরােধ জানিয়ে ১৯২৫ সালে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খা একটা লম্বা চিঠি লিখেছিলেন কবি নজরুল ইসলামকে। দীর্ঘ দু’বছর পর ১৯২৭ সালে কবি সেই চিঠির এক অসাধারণ জবাব দিয়েছিলেন । যারা মনে করেন, আমি ইসলামের বিরুদ্ধবাদী বা তার সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছি- তারা অনর্থক এ ভুল করেন। ইসলামের নামে যেসব কুসংস্কার মিথ্যা আবর্জনা ঝুপীকৃত হয়ে উঠেছে; তাকে ইসলাম বলে না-মানা কি ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযান? এ ভুল যারা করেন তারা যেন আমার লেখাগুলাে মন দিয়ে পড়েন দয়া করে। এছাড়া আমার আর কি বলবার থাকতে পারে? “আমার বিদ্রোহী’ পড়ে যারা আমার উপর বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন তারা যে হাফেজ রুমীকে শ্রদ্ধা করেন এও আমার মনে হয় না। আমি ত আমার চেয়েও বিদ্রোহী মনে করি তাদের। এঁরা কি মনে করেন, হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিলেই সে কাফের হয়ে যাবে? তাহলে মুসলমান কবি দিয়ে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি কোন কালেই সম্ভব হবে না- জৈগুণ বিবির পুঁথি ছাড়া । বাংলা সাহিত্য হিন্দু-মুসলমানের উভয়ের সাহিত্য এতে হিন্দু দেব-দেবীর নাম দেখলে মুসলমানদের রাগ করা যেমন অন্যায়, হিন্দুরও তেমনি মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে নিত্যপ্রচলিত মুসলমানী শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্যে দেখে ভুরু কোচকানাে অন্যায়। আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের এ সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি বা হিন্দু দেবদেবীর নাম নিই। অবশ্য এ জন্য অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্য হানি হয়েছে। তবু আমি জেনেশুনেই তা করেছি। সবশেষে কবি নজরুলের জীবনাদর্শ। এ সম্পর্কে কবি নিজেই তার ব্যাখ্যাদান করে গেছেন। এসবই করেছেন তার সম্মানে প্রদত্ত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, বেসরকারী পর্যায়ে অসংখ্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মধ্যে তিনটি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
প্রথমটি ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার এ্যালবার্ট হলে। সংগঠনের নাম ছিল ‘নজরুল সংবর্ধনা সমিতি সভাপতি প্রখ্যাত সাহিত্যিক এস ওয়াজেদ আলী। দু’জন সম্পাদকের পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এঁরা ছিলেন যথাক্রমে এম নাসিরউদ্দীন (সওগাত) এবং দীনেশ রঞ্জন দাস (কল্লোল)।  আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পৌরহিত্যে অনুষ্ঠিত এই সভায় অন্যদের মধ্যে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, জলধর সেন, শৈলজানন্দ মুখােপাধ্যায়, অপূর্বকুমার চন্দ্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অভিনন্দনপত্রের জবাবে কবি নজরুল তাঁর জীবনাদর্শের রূপরেখা উপস্থাপন করলেন ?  আমি যেটুকু দান করেছি, তাতে আর কতটুকু ক্ষুধা মিটেছে জানিনে; কিন্তু | আমি জানি, আমাকে পরিপূর্ণরূপে আজও দিতে পারিনি; আমার দেবার ক্ষুধা আজও  মেটেনি। আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে গােরস্থানের পথে, তাঁকে ক্ষুধাদীর্ণ মূর্তিতে, ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকারে তাকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি । আমার গান সেই সুন্দরকে রূপে রূপে অপরূপ করে দেয়ার  স্তব স্তুতি।
দ্বিতীয় নজরুল-সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হলাে সিরাজগঞ্জে ১৯৩২ সালের ৫ এবং ৬ ডিসেম্বর আয়ােজন করা হলাে ‘বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলন। উদ্যোক্তাদের অন্যতম সিরাজগঞ্জের কৃতী সন্তান আসাদুল্লাহ সিরাজী। সভাপতিত্ব এবং প্রধান অতিথির ভাষণ দেয়ার জন্য কবি নজরুল ইসলাম এলেন কলকাতা থেকে সঙ্গে গায়ক আব্বাসউদ্দীন আহম্মদ দরাজকণ্ঠে কবি নজরুল তার অভিভাষণ পাঠ করলেন। আমার শেষ কথাআমার যৌবনের পূজারী, নৰ নৰ সম্ভাবনার অগ্রদূত, নব নবীনের নিশানবরদার। আমরা বিম্বে সর্বাগ্রে চলমান জাতির সহিত পা মিলাইয়া চলিব। ইহার প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়াইবে যে, বিরােধ আমাদের শুধু তাহার সাথেই ঝঞার নূপুর পরিয়া নৃত্যায়মান তুফানের মত আমরা বহিয়া যাইব। যাহা থাকিবার তাহা থাকিবে, যাহা ভাঙিবার তাহা আমাদের চরণাঘাতে ভাঙিয়া পড়িবেই। কাজী নজরুল ইসলাম তার জীবনের শেষ অভিভাষণ দেন ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল। এদিন কলকাতায় অনুষ্ঠিত হলাে ‘বঙ্গীয় মুসলিম সমিতির’ রজতজয়ন্তী উৎসব কবি নজরুল হলেন সম্মেলনের মূল সভাপতি। দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পরবর্তী। ৩৪ বছরকাল বাকরুদ্ধ হবার পূর্ব মুহূর্তে এটাই হচ্ছে তাঁর সর্বশেষ বক্তৃতা। দীর্ঘ নিঃশ্বাস, চাপা ক্রন্দন আর অভিমানে ভরপুর এই বক্তব্য যদি আর বাঁশি না বাজে- আমি কবি বলে বলছিনে; আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি; আপনারা আমায় ক্ষমা করবেন আমায় ভুলে যাবেন।
বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম- সে প্রেম পেলাম না বলে, আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরবে অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।” কবি নজরুল সম্ভবত তার ভাগ্যের লিখন নিজেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তারই বহিঃপ্রকাশ হয়েছে দোলনচাঁপা’ বই-এর ‘অভিশাপ’ শীর্ষক কবিতায় ঃ
“যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যা তারায় আমার খবর পুছবেবুঝবে সেদিন বুঝবে।  গাইতে বসে কণ্ঠ ছিড়ে আসবে যখন কান্না, বলবে সবাই- “সেই যে পথিক, তার শেখানাে গান না?” আসবে ভেঙে কান্না।” এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে আজ এ কথা বলতেই হচ্ছে যে, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম অসম্পূর্ণই থেকে গেলেন। অবশ্য তাঁর ২২ বছরের সাহিত্য জীবনের সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যের এক বিরাট ও বিশাল পরিচ্ছদ হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে পরবর্তী ৩৪ বছর যদি কবি সুস্থ অবস্থায় সাহিত্য সেবা করতে সক্ষম হতেন তাহলে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার যে একেবারে উপচে পড়তাে সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু আমাদের অসম্পূর্ণ নজরুলকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। উপরন্তু বিশেষ করে লক্ষণীয় যে, মুসলিম মৌলবাদী গােষ্ঠী কবি নজরুলের সাহিত্যকর্ম এবং জীবনাদর্শকে খণ্ডিতভাবে প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। অথচ এদেরই পূর্বসূরিরা নজরুলকে “কাফের” ও “শয়তান” হিসাবে আখ্যায়িত করেছিল। সে ক্ষেত্রে এই মৌলবাদী গােষ্ঠীকে বলিষ্ঠভাবে মােকাবিলা করে নিশ্চিহ্ন করতেই হবে। তাহলেই বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুলের বিদেহী আত্মা শান্তি লাভ করবে।

সূত্রঃ   একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল

 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!