You dont have javascript enabled! Please enable it!
রজতজয়ন্তীর দিনগুলাে
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের রজতজয়ন্তী। ভাবতেও পারিনি এতদিন বেঁচে থাকব। চিন্তাও করতে পারিনি, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর “খন্দকার থেকে। খালেদা”র ভয়ঙ্কর দিনগুলাে অতিক্রম করতে পারব। কিন্তু বাস্তবে তাই-ই হয়েছে। শেষ অবধি স্বাধীনতাযুদ্ধের রজতজয়ন্তী পালন করলাম। অবশ্য এর মাঝে বাংলাদেশে বহু ঘটনা ঘটে গেছে।
১. দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা এখন আসামীর কাঠগড়ায় ।
২.এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াবকে এক বস্ত্রে ঢাকা ত্যাগ করতে হলাে।
৩. প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেলেন।
৪. রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হলেন; রেখে গেলেন “ছেড়া গেঞ্জি”।
৫. প্রেসিডেন্ট সাত্তার পদত্যাগের মুহূর্তে ভাষণ দিলেন, “বিএনপি। দুনীতিবাজ”।
৭..খন্দকার মােশতাকের জানাজার নামাজ পর্যন্ত ঢাকায় হলাে না।
৮. রাষ্ট্রপতি এরশাদ ৬ বছর কারাভােগ করলেন; এখনও তার বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা ঝুলছে।
নিরপেক্ষ নির্বাচনের ফলাফল দেখে গােলাম আযম এখন “খামুশ”। ১০. বেগম জিয়া এখন ‘হ্যারিকেন দিয়ে ইস্যু খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ১১. শেখ হাসিনা পানি চুক্তির পাবলিসিটি’র ফায়দা নিতে পারলেন না আর ১২. থলির বিড়াল সৈয়দ আলী আহসান এখন ময়দানে। ঠিক এমনি এক সময়ে অন্তত একটা বিষয়ে আমার হৃদয়ে অনাবিল প্রশান্তি। দীর্ঘ ২১ বছর পর এই প্রথমবারের মতাে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষের শক্তি এখন ক্ষমতায়। তাই রজতজয়ন্তীর দিনগুলাে কিভাবে কাটালাম, তারই একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণী অত্র নিবন্ধে উপস্থাপন করলাম। ভদ্রলােকের নাম ডেনিশ ডি দত্ত। বাঙালী খ্রিস্টান। ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসের গােড়ার দিকে এই ভদ্রলােক সর্বপ্রথম আমার সঙ্গে যােগাযােগ করেছিলেন। তিনি এ মর্মে অনুরােধ করেছিলেন যে, ২১-২৩ নভেম্বর ঢাকা মােহাম্মদপুরের সেন্ট যােসেফ স্কুল প্রাঙ্গণে আয়ােজিত স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করতে হবে। আমি এই অনুরােধ রক্ষা করেছিলাম। কলকাতা থেকে মাদাম তেরেসাও এই অনুষ্ঠানে যােগদানের জন্য সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য তিনি ঢাকায় আসতে পারেননি। ডাক্তাররা তাঁকে অনুমতি দেননি। 
 
এই অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর লিখিত ভাষণ আমাকে বিমুগ্ধ করেছিল। অনুষ্ঠানের দিন কয়েক পর ঢাকার আর্চবিশপ মাইকেল রােজারিও একটা চমৎকার ধন্যবাদসূচক পত্র পাঠিয়েছিলেন। তিনি অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখেছেন, “আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানানাে, মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করা, যারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের চিরশান্তি কামনা করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা | জানানাে এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে অধিকতর নিষ্ঠার সাথে আত্মনিয়ােগ করার প্রেরণা লাভ করা। এই অনুষ্ঠানেই আমি সর্বপ্রথম জানতে পেরেছি যে, মূলত বাঙালী  খ্রিস্টানদের নিয়ে গঠিত “জর্জ বাহিনী’ একাত্তরের যুদ্ধের সময় দিনাজপুরের বিরল অঞ্চলে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মঞ্চে’ ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে পর্যালােচনা করলাম । আমি আনন্দিত যে, ঘণ্টাধিককাল এই বক্তৃতায় ইতিহাসের সােপান বেয়ে কিভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান হয়েছিল, সেই বিষয়টি অত্যন্ত গুছিয়ে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী ও বাংলা নাটকের দু’শ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখলাম ঢাকার কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা মিলনায়তনে। প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান কবি শামসুর রাহমান। অনুষ্ঠানের আয়ােজক ছিল ‘কথকৃতি থিয়েটার’। এদিকে ৫ ডিসেম্বর জাতীয় যাদুঘরে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ শীর্ষক আলােচনায় অংশগ্রহণে অপারগতা জানালাম। কেননা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অংশগ্রহণ করেননি, এমন বক্তার নামও ছাপানাে প্রােগ্রামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অবশ্য এদিন অন্যত্র ব্যস্ত ছিলাম। বাংলাদেশ টিভি’র স্টুডিওতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা এবং ‘চরমপত্র’ সম্পর্কে এক সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ রেকর্ডিং করলাম। উপস্থাপক ছিলেন তারানা হালিম। এটা ছিল ছােটদের জন্য অনুষ্ঠান। 
 
ইতিহাসের সােপান বেয়ে কিভাবে একটার পর একটা সংগ্রামের মাঝ দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমানের অভ্যুদয় হলাে, ৭ ডিসেম্বর  তার বিশদ বিবরণ দিলাম রমনা গার্ডেনে ‘জয় বাংলা সাংস্কৃতিক গােষ্ঠী’র মঞ্চ থেকে। | ৮ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার ‘এসবিএস রেডিও’র বাংলা অনুষ্ঠানের জন্য VOICE CAST করলাম। পুরাে ৬ মিনিটই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের রজতজয়ন্তী পালন সম্পর্কিত। ৯ ডিসেম্বর টিএসসি চত্বরের চেতনা মঞ্চে’ দ্বিতীয়বারের মতাে বক্তব্য | রাখলাম। এবারের আলােচ্য বিষয় ছিল ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার  কেন্দ্রের ভূমিকা।’ মঞ্চে উপবিষ্ট আলােচকবৃন্দের সবাই সেই ঐতিহাসিক বেতার কেন্দ্রের কর্মী । ফলে হৃদয়গ্রাহী স্মৃতিচারণ আর মনােজ্ঞ আলােচনায় উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলী বিমুগ্ধ। হলেন। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মঞ্চের সমন্বয়কারী সামসুল আরেফিনকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। সত্যি কথা বলতে কি বছর কয়েক ধরে আমার সঙ্গে রেলওয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের এক নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলােতে ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশনের চত্বরে আয়ােজিত অনুষ্ঠানগুলােতে আমি নিয়মিতভাবে বক্তৃতা করেছি। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এর পিছনে কৃতিত্ব হচ্ছে বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধা সংসদের ঢাকা বিভাগ রেলপথ (প্রাতিষ্ঠানিক) থানা কমান্ডের কমান্ডার কাজী আবদুর রশিদ, ডেপুটি কমান্ডার মােঃ আলী হােসেন এবং এদের সহকর্মীদের।
গেল নভেম্বর মাসেই এরা আমার সঙ্গে যােগাযোেগ করে ১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ৭ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানসূচী চূড়ান্ত করেছিলেন। রেলওয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি আমার দুর্বলতার কারণ এই যে, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে রেলওয়ে শ্রমিক ও কর্মচারীরা যেভাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এদের সহযােগী রাজাকার, আলবদর ও অবাঙালীদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে, তা আজও পর্যন্ত সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, একাত্তরের যুদ্ধে মােট ১১৪ কিলােমিটার রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছিল, উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল ৩০০টি সেতু, মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ৭২২টি যাত্রীবাহী বগি, ১০৮৪টি মালবাহী বগি, ১৪০টি ইঞ্জিন, ২০টি মেরিন ক্রাফট এবং ৩টি যাত্রীবাহী ফেরি জাহাজ। এ ছাড়া রেলওয়ে ট্রাক, স্টেশন ভবন, সিগন্যালিং ব্যবস্থা, লােকো শেড, অফিস ভবন, ওয়ার্কশপ।

 
এবং বিপুল সংখ্যক স্টাফ কোয়ার্টার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। চট্টগ্রামের সিআরবি’ এলাকা আর ‘ফয়’স লেকের’ বধ্যভূমিতে যে কত রেলওয়ে কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, তার সঠিক তালিকা, আজও পর্যন্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এ পর্যন্ত শহীদ রেল কর্মীদের অসম্পূর্ণ তালিকায় প্রায় ১,১০০ লাশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১০ ডিসেম্বর কমলাপুর স্টেশনের চত্বরে রেলওয়ে মুক্তিযােদ্ধা সংসদ আয়ােজিত রজতজয়ন্তি অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করলেন জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী । বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সাবের হােসেন চৌধুরী এমপি, প্রখ্যাত মঞ্চাভিনেতা আলী যাকের এবং আমি । সেদিন সাবের চৌধুরীর বক্তব্য আমাকে বিমােহিত করেছিল। ১১ ডিসেম্বর আমার প্রােগ্রাম রাজশাহীতে  আগেই বিমানের টিকিট পাঠিয়েছিল। সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের আয়ােজিত মহান বিজয় দিবস ও বিজয় মেলার আলােচনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করলাম। আলােচ্য বিষয় ছিল ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও বিভেদ ও বিভ্রান্তি। প্রায় দুই ঘণ্টাধিককাল বক্তৃতায় প্রথমে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত বাঙালী জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞার ব্যাখ্যা দান করে একথাটাই বললাম যে, একমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশেই বাঙালী জাতির বসবাস রয়েছে। অন্যত্র যারা রয়েছেন, তারা বঙ্গভাষী নিশ্চয়ই; তবে ভিন্ন দেশের নাগরিক এবং জাতীয়তাও ভিন্ন; কেউ ভারতীয় কেউবা ব্রিটিশ ।
এরই প্রেক্ষাপটে আমি বঙ্গবন্ধুর অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও মুজিবনগরে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের মােকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বলিষ্ঠ। ভূমিকা সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর তথ্য উপস্থাপন করলাম। তবে একটা কথা বলতেই হচ্ছে যে, রাজশাহীর জেলা প্রশাসক তার তরুণ সহকর্মীদের নিয়ে যেভাবে বিজয় মেলা এবং আলােচনা অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিলেন, তা ছিল অপূর্ব আর নিখুঁত এজন্য জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পরদিন সকালে একটা জীপে রওনা হলাম যশাের। রাজশাহীর জেলা প্রশাসকই সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন জীপটা। সঙ্গে একজন লােকও যাতে পথে কোন কষ্ট না হয়। যশােরে পৌছতে প্রায় ৫ ঘণ্টা সময় লেগেছিল যখন পাকশীতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মা নদীতে ফেরি পার হচ্ছিলাম, তখন বিশাল বালুচরের দিকে তাকিয়ে আমার মনে দারুণ শিহরণ আজ নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী পানি চুক্তি স্বাক্ষর করার কথা। এই পরিকল্পনা অক্ষুন্ন থাকলে আগামী ১ জানুয়ারি থেকে এইসব চর পানির নিচে তলিয়ে যাবে আর উত্তরাঞ্চলের চাষীর মুখে ফুটে উঠবে অনাবিল হাসি। অথচ এর আগে ৫ বছরে খালেদা জিয়ার বিএনপি এক ফোঁটা পানিও আনতে পারেনি। এটাই হচ্ছে বাস্তব সত্য। বিএনপি’র কি অদ্ভুত নীতি! মুখে ভারত বিরােধী স্লোগান, কিন্তু কামের বেলায় হগ্গল। টাইমে ভারতের দালালী। সন্ধ্যায় যশাের বিডি হলে প্রায় দেড় ঘন্টা বক্তৃতা করলাম।

 
বিষয়বস্তু ছিল ধাপে ধাপে আন্দোলনের মাঝ দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, বঙ্গবন্ধুর জীবনী এবং প্রবাসী সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু আদর্শ বিকাশ কেন্দ্রে’র আয়ােজিত এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি মহাদেব সাহা চমৎকার বক্তব্য রেখেছিলেন। রাতে একই হলে স্বাধীনতাযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হলাে। এ ধরনের চমৎকার অনুষ্ঠানের আয়ােজনের জন্য তরুণ সমন্বয়কারী আসাদুজ্জামান মিঠুকে ধন্যবাদ। যশাের থেকে বিমানে ঢাকায় ফিরে এলাম ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকা বিমানবন্দরে আগে থেকেই বড় ছেলে সপরিবারে গাড়িতে বসে ঢাকায় পৌছানাে মাত্র বিমানবন্দর থেকে রওনা হলাম টাঙ্গাইল অভিমুখে  সেদিন সন্ধ্যায় টাঙ্গাইলে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এমপি’র আয়ােজিত অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে হবে। সার্কিট হাউসে উঠলাম। দুপুরে এবং রাতে জেলা প্রশাসকের বাংলােতেই আহারের চমৎকার ব্যবস্থা। সন্ধ্যায় প্রায় আড়াই ঘণ্টার মতাে বক্তৃতা করলাম। বিষয়বস্তু ছিল। অকুতােভয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রাম বহুল জীবনের অজানা তথ্য ও একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিভিন্ন সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ লড়াই এবং কাদেরিয়া বাহিনীর শৌর্যবীর্য আর ১৬ ডিসেম্বর সকালে মিত্রবাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনীর একই সঙ্গে ঢাকায় প্রবেশের ইতিহাস। নিজেদের গাড়িতে রাতেই ঢাকায় ফিরে এলাম। তখন ইংরেজী ক্যালেন্ডারে তারিখের পরিবর্তন হয়ে গেছে। হিসাবমতাে ১৪ ডিসেম্বর ভোের রাত আড়াইটায় বাসায় ফিরলাম।
 
এদিন ঢাকায় পর পর দুটো রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করলাম। প্রথমটি সােনালী ব্যাংক কর্মচারীদের এবং দ্বিতীয়টি অগ্রণী ব্যাংকের কর্মচারীদের আয়ােজিত অনুষ্ঠান। সােনালী ব্যাংকের অনুষ্ঠানে মাননীয় অর্থমন্ত্রী এসএএমএস কিবরিয়া, ব্যাংকের চেয়ারম্যান আসাফউদ্দৌলা এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর এ কিউ সিদ্দিকী প্রত্যেকেই চমৎকার ভাষণদান করলেন। অগ্রণী ব্যাংকের অনুষ্ঠানে ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের ক্যাবিনেট সেক্রেটারী জনাব হােসেন তৌফিক ইমামের বক্তব্য ছিল বেশ তথ্যবহুল। ১৫ ডিসেম্বর বিকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটা ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠানে যােগ দিলাম। উদ্যোক্তা ছিল ‘ঢাকা রিপাের্টার্স ইউনিটি’। দীর্ঘ ২৫ বছর পর তরুণ রিপাের্টাররা তাদের পূর্বসূরিদের স্মরণ করেছেন। ১৯৭১ সালে যেসব সাংবাদিক সরাসরি যুদ্ধে জড়িত ছিলেন, তাঁদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। সেদিন বেশ কিছু প্রবীণ সাংবাদিকের। সঙ্গে দেখা হলাে। পদক এবং সনদপত্র দিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রীর নাতিদীর্ঘ বক্তব্য ছিল অত্যন্ত সময়ােপযােগী । এরপর স্বাধীন বাংলা বেতার। কেন্দ্রের শিল্পীদের এক মনােজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ফলে এক আনন্দঘন পরিবেশে বার বার শুধু সুদূর অতীতের কথাই মনে হচ্ছিল। সবার মধ্যেই তখন ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধাবােধ। আমরা সাংবাদিকরা ছিলাম একটা পরিবারের মতাে। আর এখন? মৌখিক ভাল ব্যবহার এবং সৌজন্যবোেধ পর্যন্ত দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর। স্বাধীনতাযুদ্ধের বিজয় দিবসের রজতজয়ন্তী। দীর্ঘ ২১ বছর পর স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এখন ক্ষমতায় হৃদয়ে আমার দারুণ প্রশান্তি। সকাল ৭টায় নিউ বেইলী রােডের প্রােপার্টি ম্যানশনের ছাদের ২০টি ফ্ল্যাটের পরিবারের সদস্য হিসেবে এক নাতিদীর্ঘ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মিলিত হলাম। বয়ােজ্যেষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনিসুর রহমান জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন এবং আমার ছিল বক্ততার পালা। কি আশ্চর্য, যখন এই প্রতিবেদন লিখছি তখন দুঃসংবাদ পেলাম। অধ্যাপক সাহেব আর ইহজগতে নেই।
 
মাত্র তিন সপ্তাহের ব্যবধানে তিনি ইন্তেকাল করেছেন।  ১৬ই ডিসেম্বর সকাল ১১টায় শিশু একাডেমীর চত্বরে আয়ােজিত শিশুদের অনুষ্ঠানে খুব সহজ ভাষায় স্বাধীনতাযুদ্ধের কথা বললাম, মুক্তিযােদ্ধাদের শৌর্যবীর্যের কাহিনী উপস্থাপন করলাম আর মুজিবনগরের ষড়যন্ত্রের ঘটনা বয়ান করলাম। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখলেন প্রবাসী সরকারের উপ-প্রধান সেনাপতি অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার এবং জনপ্রিয় মঞ্চাভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। এরপর রওনা হলাম সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এই উদ্যানের (রেসকোর্স ময়দান) যে জায়গায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লেঃ জেনারেল। নিয়াজী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিল, আজ ঠিক সেই জায়গায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতাস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। উল্লেখ্য যে, ২৫ বছর আগে এ ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে ঘটনা পরম্পরায় প্রধান সেনাপতি অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ওসমানী অনুপস্থিত ছিলেন। আর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নির্দেশে শেষ মুহূর্তে সেদিন এই খন্দকার সাহেবই আলােচ্য অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন।  প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝ দিয়ে দু’জনে মঞ্চের সামনে হাজির হলাম। এবারের অনুষ্ঠানের একটা উল্লেখযােগ্য দিক হচ্ছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যেসব , মার্কিনী, জাপানী এবং ভারতীয় বুদ্ধিজীবী সমর্থন দিয়েছিলেন তাঁদের জনাকয়েককে সরকারী অতিথি হিসাবে বাংলাদেশ সফরে আনা হয়েছে। ভারতীয় অতিথিদের মধ্যে সর্বশ্রী অন্নদাশংকর রায়, দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার পূর্ব পরিচিত। ১৯৭১ সালে দেবদুলাল আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্র থেকে নিয়মিতভাবে।
 
সংবাদ সমীক্ষা পাঠ করতেন। আর আমি যুদ্ধের দিনগুলােতে প্রতিদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠান উপস্থাপন করতাম। এ সময় দুটো অনুষ্ঠান দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। অবশ্য যুদ্ধের পর ভারত সরকার সংবাদ সমীক্ষা’ পাঠ করার পুরস্কার হিসাবে দেবদুলালকে “পদ্মশ্রী” উপাধিতে ভূষিত করেছে একজন বেতার কথকের জন্য এটা এক বিরল সম্মান বছর দশেক হয় দেবদুলাল ‘আকাশবাণী’ থেকে অবসর পেয়েছেন। আজকাল চোখে খুব কম দেখেন। অনেক চিকিৎসার পর সামান্য দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করতে পেরেছেন। তাই একমাত্র কিশাের পুত্র শ্রী দেবরাজকে সঙ্গে এনেছেন বহুদিন পরে এবার ঢাকায় দেবদুলালের সঙ্গে দেখা হলাে। দুটো সন্ধ্যা কাটালাম ওর সঙ্গে । চুটিয়ে আড্ডা। মারলাম ঢাকা ক্লাবে। তবে কথাবার্তা সবই একাত্তরের যুদ্ধকে নিয়ে। হঠাৎ দেবদুলালের একটা প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাবই দিতে পারলাম না। শুধু বললাম, “তাতে হয়েছে। কি? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠান করে জনগণের অকৃত্রিম। ভালবাসা পেয়েছি; এটুকুই তাে যথেষ্ট বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি একদিন হয়তাে পাব; কিন্তু সেটা হবে মরণােত্তর।” দেবদুলাল হতভম্বের মতাে তাকিয়ে রইলেন। দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ পরে ১৬ই ডিসেম্বর বিকালে বঙ্গভবনে মাননীয় রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনায় যােগ দিলাম। বঙ্গভবনের বিশাল সবুজ চত্বর এবং ফুলের বাগান এখন অনেকটা। সংকুচিত আগের সেই বিশালতাকে আর খুঁজেই পেলাম না। বিভিন্ন পেশার কয়েক হাজার অতিথি এঁদের মধ্যে জনাকয়েক ১৯৭১ সালের বিতর্কিত চরিত্রের মনের গহনে বেশ বেদনা অনুভব করলাম। বিকালের বেশ পড়ন্ত সূর্যের আলােকে দাড়িয়ে হঠাৎ অতীতের স্মৃতি রােমন্থন করলাম। ঠিক তেইশ বছর আগেকার কথা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আমি ছিলাম বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক সেদিনের তারিখটা ছিল ১৯৭৩ সালের ১৪ই ডিসেম্বর।
 
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জরুরি খবর পাঠিয়েছেন দৈনিক জনপদ-এর সম্পাদক আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে নিয়ে দেখা করার জন্য বিষয়টা গুরুতর বিচারপতি চৌধুরী রাষ্ট্রপতির পদ থেকে আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর কথা হচ্ছে। যে, আপাতত জজ সাহেব (বঙ্গবন্ধু এই বিশেষণ ব্যবহার করতেন) যেন পদত্যাগপত্র  গ্রহণের জন্য চাপাচাপি না করেন। আর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগে যেন এই খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত না হয়। রাষ্ট্রপতি চৌধুরী কিছুদিন থেকেই অস্বস্তিবােধ করছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধান। অনুসারে তখন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ছিল খুবই সীমাবদ্ধ। এছাড়া মনে হয় আসলে তার । বাসনা ছিল বঙ্গবন্ধুর অধীনে পররাষ্ট্র মন্ত্রিত্ব। কিন্তু কথাটা তিনি সরাসরি বলতে পারেননি। তার চরিত্র ছিল খুবই নম্র এবং লাজুক প্রকৃতির। অপারগ অবস্থায় তিনি বঙ্গবন্ধুর বিরাগভাজন না হয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির সুযােগের সন্ধান করছিলেন। এদিকে, ব্যুরােক্রেসির পরামর্শে সাধারণ ক্ষমা প্রদানের ফাইলটা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানাের প্রশ্নে এক বিভ্রাটের সৃষ্টি হলাে। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বঙ্গবন্ধু ফাইলটা দস্তখত করলেন। এতে বলা হলাে যে, নরহত্যা, অগ্নিসংযােগ, নারীর উপর পাশবিক অত্যাচার, লুণ্ঠন প্রভৃতি ছয় ধরনের অপরাধ সাধারণ ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত হবে না। ফাইলটা দস্তখত হওয়ার সময় ব্যুরােক্রেসি থেকে এ মর্মে পরামর্শ দেয়া হলাে যে, আপনি তাে শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, আপনি হচ্ছেন জাতির পিতা। সেক্ষেত্রে মনে হয় আপনার দস্তখতের পর ফাইলে আর কারও অনুমােদনের প্রয়ােজন হয় না। তখনও মনে আছে, সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়েছিল এবং তিনি নিচের ঠোটে কামড়াচ্ছিলেন। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে এ সময় আমরা বেশ ক’জন গণভবনে উপস্থিত ছিলাম।  বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতাে গাফফার চৌধুরী আর আমি দুজনেই বঙ্গভবনে গেলাম। গাড়িতেই আলাপ করলাম, কিভাবে কথাগুলাে বলতে হবে। বঙ্গভবনে পৌছানাের পর চৌধুরী সাহেবকে বললাম, পুরাে ব্যপারটা আপনাকে একাই সামালতে হবে। আমি একজন সরকারী কর্মচারী; তাই আলােচনায় থাকা সমীচীন হবে না। আমি বরং মিলিটারি সেক্রেটারির রুমে অপেক্ষা করবাে।
 
প্রায় মিনিট বিশেক পরে চৌধুরী সাহেব হাসিমুখে ফিরে এলেন ‘হ’ কাম হইছে পদত্যাগের খবর গােপন থাকবাে বইল্যা কথা দিছে’। দু’জনে আবার গেলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। সবকিছু শুনে তিনি বেশ খুশি হলেন। পরদিন দৈনিক জনপদে বিরাট সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হলাে। পুরােটাই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর প্রশস্তি এবং একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে তার বিস্ময়কর অবদানের খতিয়ান। তবে সুখের কথা এই যে, ঢাকায় দৈনিক পত্রিকাগুলাে আলােচ্য পদত্যাগের খবর জানতে পারেনি। এরও দিন কয়েক পরে ১৯৭৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার থেকে এ মর্মে ঘােষণা করা হলাে যে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার ত্যাগ করেছেন এবং তিনি জেনেভায় রাষ্ট্রদূত ও জাতসিংঘের মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নিযুক্ত হয়েছেন। নতুন রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নিলেন মােহাম্মদুল্লাহ। আবার প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। দীর্ঘ ২৩ বছর পর এবারের ১৬ই ডিসেম্বর বঙ্গভবনের সংবর্ধনা থেকে যুগ্মসচিব কারার মাহমুদুল হাসানের গাড়িতে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু তখন ঢাকা নগরীর সর্বত্র যানজটের এক অকল্পনীয় চেহারা। রজতজয়ন্তীর উৎসব মুখরিত রাজধানীর প্রতিটি রাস্তায় শুধু মানুষ আর মানুষ। বঙ্গভবন থেকে পিজি পর্যন্ত পৌছতে আমাদের এক ঘণ্টার বেশি সময় অতিক্রান্ত হলাে। শেষ পর্যন্ত পুরােনাে গণভবনের পাশ দিয়ে অফিসার্স ক্লাব পর্যন্ত এসে আর এগুতে পারলাম না। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটেই এলাম নিউ বেইলী রােডের প্রােপার্টি ম্যানশনে।
 
রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নৈশভােজের আমন্ত্রণ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে যেসব বিদেশী ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে আগমন করেছেন, তাদেরই সম্মানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নৈশভােজের আয়ােজন করেছেন। অতিথিদের সঙ্গে বেসরকারী পর্যায়ে খােলামেলা আলােচনার জন্য এ ধরনের নৈশভােজ এদিকে সবার অলক্ষ্যে একটা ঘটনার অবতারণা হলাে। সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৬ই ডিসেম্বর সকালে প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র কন্যা পুলীর ঢাকায় পৌছানাের কথা। কিন্তু প্লেন প্রায় ১১/১২ ঘণ্টা লেটু। মা হিসাবে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা দিনভর এত কর্মব্যস্ততার মাঝেও বেশ চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু চেহারা থেকে তা বুঝবার উপায় ছিল না। তখন নৈশভােজে সবেমাত্র অতিথিরা আসতে শুরু করেছেন। এমন সময় এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হলাে। আমরা মা-মেয়ের মিলনের অপরূপ দৃশ্য অবলােকন করলাম। দুজনের চোখেই আনন্দাশ্রু। নৈশভােজের আয়ােজন বিরাট ধরনের কিছু ছিল না। কিন্তু ঘরােয়া পরিবেশ এবং আন্তরিকতার ছোঁয়ায় বিমুগ্ধ হলাম। অতিথিদের খাদ্য পরিবেশনের সময় প্রধানমন্ত্রী হাসিনা স্বয়ং তদারকী করলেন। অবসরপ্রাপ্ত মার্কিণী কূটনীতিবিদ মিঃ আর্থার ব্লাড থেকে শুরু করে ৯১ বছর বয়স্ক সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায় পর্যন্ত সবারই কাছে দাড়িয়ে শেখ হাসিনা বিভিন্ন আইটেম’ খাওয়ার অনুরােধ জানালেন। বেতার কথক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আর কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বললেন, পাংগাশ মাছ কিন্তু খেতেই হবে একেবারেই বাঙালী রান্না।
 
গণভবন থেকে বিদায় নিয়ে রাত দশটা নাগাদ আমরা জনাকয়েক দল বেঁধে গেলাম প্রখ্যাত মঞ্চাভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর-এর ফ্ল্যাটে আড্ডা মারতে। ইতােমধ্যেই সেখানে হাজির হয়েছেন বিশিষ্ট ছড়াকার ফয়েজ আহমদ। এরপর বুঝতেই পারছেন। ঘণ্টা কয়েক চুটিয়ে আড্ডা। বহুদিন পরে রীতিমতাে আড্ডায় আমরা সবাই অতীত স্মৃতির হাস্যোজ্জ্বল ঘটনাগুলাের রােমন্থন করলাম। আসলে আড্ডার নানাবিধ উপকারিতা রয়েছে। অথচ আজকাল ঢাকায় আডডার পরিবেশ দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের জীবনটা এখন বলতে গেলে পুরােপুরিভাবে যন্ত্রচালিত।  ১৭ই ডিসেম্বর বিকালে ছেলের গাড়িতে রওনা হলাম চাঁদপুরে। সেখানে প্রতি বছরের মতাে এবারও পক্ষকালব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার আয়ােজন করা হয়েছে। মূলত জেলা প্রশাসনের সক্রিয় সমর্থনে মুক্তিযােদ্ধারাই এই মেলার আয়ােজন করে  থাকেন। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। চাঁদপুরের এই বিজয় মেলা সম্পর্কে আমার দুর্বলতা রয়েছে। কেননা এর আগে আরও দু’বার এই মেলার আলােচনা সভায় বক্তৃতা করেছি। তাই এবার মেলার আহবায়ক এম এ ওয়াদুদ এবং কমান্ডার মােঃ হারুন চৌধুরীর আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে পারিনি।
১৭ই ডিসেম্বর আলােচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর অবদান।’ জেলার বিভিন্ন থানা থেকে মুক্তিযােদ্ধা পুলিশ অফিসাররা এসেছেন স্মৃতিচারণ করার জন্য। একের পর এক বক্তব্য রাখলেন। আমি তন্ময় হয়ে শুনলাম এসব মুক্তিযােদ্ধা পুলিশের বীরত্বগাঁথা। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে আমি আলােচনা সভায় বক্তব্য রাখলাম। বললাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কথা, উল্লেখ করলাম প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের সাফল্যের কথা আর বর্ণনা করলাম মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কথা। এরপর মেলার উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাত আড়াইটায় ঢাকায় ফিরে এলাম। ঢাকার কাছেই ডেমরা। ১৮ ডিসেম্বর বিকালে ডেমরার অন্তর্গত সারুলিয়ায় বিজয় দিবস। উপলক্ষে আয়ােজিত গুণীজন সংবর্ধনা, আলােচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যােগ দিলাম বিশেষ অতিথি হিসাবে। প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপি হাবিবুর রহমান মােল্লা। চমৎকার আয়ােজন করেছিল ডেমরা ছাত্র-যুব উন্নয়ন সংস্থা-এর সভাপতি ও সম্পাদক যথাক্রমে নাঈম খন্দকার আর হিলটন মাহমুদ।
নতুন প্রজন্মের একগুচ্ছ কিশাের তরুণ-তরুণীর কর্মতৎপরতায় বিমুগ্ধ হলাম। সেদিনের অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে আরও যােগ দিয়েছিলেন প্রখ্যাত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন। একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। তার উল্লেখ করতেই হচ্ছে সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর লুৎফর রহমান রিটন যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেল। মাত্র মিনিট পনেরাের জন্য বিরতি। আবার বিদ্যুৎ এলাে। মাইকে ছড়াকারকে তার অসমাপ্ত বক্তব্য শেষ করে স্বরচিত ছড়াপাঠের অনুরােধ জানানাে হলাে। বার কয়েক নাম ধরে ডাকাডাকির পরও তাকে পাওয়া গেল না। সভার আশপাশে স্বেচ্ছাসেবকরা খোজাখুঁজি করলাে। কিন্তু বক্তার সন্ধান নেই। এমন সময় জানা গেল যে, অন্ধকারের মধ্যেই ছড়াকার লুত্যর রহমান রিটন ঢাকায় ফিরে গেছেন। অগত্যা আমি মঞ্চে দাঁড়ালাম। খুবই গুছিয়ে ঘণ্টাখানেক বক্তৃতা দিলাম। এরপর ছেলেদের বিশেষ অনুরােধে চরমপত্র’ থেকে অংশ বিশেষ শােনালাম। সত্যি কথা বলতে কি সারুলিয়ায় প্রবীণ ও নবীন প্রজন্মের মধ্যে বিরাজমান একটা চমৎকার সম্পর্ক আমাকে বিমুগ্ধ করেছে। রাতেই ঢাকায় ফিরে এলাম । দিন কয়েকের জন্য বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নিলাম অবশ্য।
বাসায় বসে কিছু জরুরি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। আগামী ফেব্রুয়ারির বইমেলায় আমার যে পাঁচটা বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, সেসবের ভূমিকা লেখা থেকে শুরু করে ফাইনাল প্রুফ পর্যন্ত দেখতে হবে। তবুও অনুরােধ এড়াতে পারলাম না। ২১ ডিসেম্বর। ঢাকার শিশু একাডেমী মিলনায়তনে ‘বাঙালীর মঞ্চ’ কর্তৃক আয়ােজিত সম্বর্ধনায় ‘ক্রেস্ট গ্রহণ ও শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখতে হলাে। প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় কবি শামসুর রাহমান। ২৮ ডিসেম্বর ঢাকার পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমীতে মুক্তিযােদ্ধা বিসিএস অফিসার কল্যাণ সমিতি’ আয়ােজিত রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসাবে যােগ দিলাম এই অনুষ্ঠানে আয়ােজনের কোথাও ক্রটি ছিল না। আমার বক্তৃতায় পাকিস্তান আমলে ধাপে ধাপে রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস ও একজন নির্ভীক ও সফল নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অভ্যুদয়ের চাঞ্চল্যকর ঘটনাবলী উপস্থাপন করলাম। এরপর সৈয়দ নজরুল-তাজউদ্দিন জুটি কিভাবে মুজিবনগরে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের মােকাবিলা করেছিল তারই ইতিহাস বর্ণনা করলাম। এই বক্তৃতায় সময় লেগেছিল প্রায় দেড় ঘন্টার মতাে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন এককালের তুখােড় ছাত্রনেতা ও বর্তমানে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।
সেদিন জনাব রাজ্জাকের নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা তন্ময় হয়ে শুনলাম। সবচেয়ে ভাল লাগল যে, তিনি বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ-ভারত পানি চুক্তি সম্পর্কেও চমৎকার মূল্যায়ন করলেন। মুক্তিযুদ্ধের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে বছরের শেষ দিন ১৯৯৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার ‘রাইটার্স’ নামক সংস্থার অনুষ্ঠান। সেদিন এরা মুক্তিযােদ্ধা তরুণ কবি সাহিত্যিকদের সম্বর্ধনা জানালাে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ কথাশিল্পী শওকত ওসমান। বিশেষ অতিথি হিসাবে বয়ােজ্যষ্ঠ সাংবাদিক ওবায়দুল হক, বিশিষ্ট নাট্যকার অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমদ আর আমি। ‘রাইটার্স’ কর্তৃপক্ষ সমস্ত মুক্তিযােদ্ধা লেখককে একত্র করতে অপারগ হওয়ায় বার কয়েক দুঃখ প্রকাশ করলাে। এদিন যেসব তরুণ মুক্তিযােদ্ধা কবি-সাহিত্যিক সংবর্ধিত হলেন, তারা হচ্ছেন, সর্বজনাব রফিক আজাদ, হারুণ হাবিব, আবু কায়সার, মাহবুব সাদিক ও আবিদ আনােয়ার এদিন আমার বক্তব্য ছিল কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সম্পর্কে আমি চুলচেরা বিশ্লেষণ করলাম। খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। উপরন্তু আরও উল্লেখ করলাম যে, একাত্তরে যারাই সীমান্ত অতিক্রম করেছেন, তাদের সবাইকে ঢালাওভাবে মুক্তিযােদ্ধা বলা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়। রাজনীতিবিদদের মধ্যে যেমন খন্দকার মােশতাক আহম্মদ, তাহের উদ্দীন ঠাকুর গয়রহ রয়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও তাঁদের প্রেতাত্মা’ রয়েছে। সবশেষে একটা কথা বলতেই হচ্ছে যে, ১৯৭১ সালে যখন আমার বয়স ৪২ বছর, তখন স্বাধীনতাযুদ্ধে শব্দ সৈনিক হিসাবে সস্ত্রীক অংশ নিয়েছি এবং ১৯৯৬ সালে এসে যখন আমি ৬৭ বছরে পদার্পণ করেছি, তখন স্বাধীনতাযুদ্ধের রজতজয়ন্তী পালন  করলাম। কিন্তু ২০২১ সালে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বর্ণজয়ন্তী পালিত হবে, তখন আমার বয়স হবে ৯২ বছর ততদিন বেঁচে থাকবাে কি?

সূত্রঃ   একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল

 
 
 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!