You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৭শে জুন, শুক্রবার, ১৩ই আষাঢ়, ১৩৮১

সাহায্য এবং সহযোগিতার প্রদানের প্রতিশ্রুতি

বাংলাদেশের উন্নয়নে বৈদেশিক সাহায্য প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবার অবকাশ নেই। আমাদের মতো একটা অনুন্নত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে যারা সম্যক অবহিত আছেন তারাই জানেন এর উন্নয়নে বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সাহায্য এবং সহযোগিতার কত বেশি প্রয়োজন। এ ব্যাপারে উন্নত রাষ্ট্র সমূহের ভূমিকা স্বাভাবিকভাবেই অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এই সাহায্য এবং সহযোগিতা যে পাওয়া যায়নি তা নয়। তবে তা প্রয়োজন পূরণে সম্পূর্ণভাবে সফল হয়নি। তেয়াত্তুর সাল থেকে শুরু হয়েছে আমাদের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। সে পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রথম বছরের জন্য যে পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্যের সংকলন ব্যাখ্যা হয়েছিল তা শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অথচ পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাসের ওপরই নির্ভর করা হয়েছিল। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চলতি বৎসরের উন্নয়ন কার্যক্রমের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। চুয়াত্তুর-পঁচাত্তুর আর্থিক বৎসর অর্থাৎ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দ্বিতীয় বৎসরের উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ যেভাবে নির্ধারিত করা হয়েছে তাতেও বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। এবার এই বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ শতকরা চুয়াত্তর ভাগ। উন্নয়ন বাজেট সংসদে পেশ করার আগে অর্থমন্ত্রী স্বয়ং বিদেশ ঘুরে এসেছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষ কমিটির সঙ্গেও তিনি কথা বলেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পারস্য উপসাগরীয় রাষ্ট্রসমূহ ঘুরে এসেছেন। আরো ক’টি প্রতিনিধিদল বিদেশে ঋণ এবং সাহায্য লাভের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করে দেখেছেন। অর্থমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ থেকে সাহায্য এবং সহযোগিতা পাওয়ার আভাস দিয়েছেন।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান জনাব নুরুল ইসলাম চেকোশ্লোভাকিয়া, ব্রাসেলস এবং যুক্তরাজ্যে দশদিন সফর করে দেশে ফিরে এসেছেন। বাংলাদেশের যে সকল প্রকল্পে চেকোশ্লোভাকিয়া ঋণ সাহায্য দিচ্ছে সে সকল প্রকল্পের বর্ধিত খরচ পোষানোর জন্য অতিরিক্ত ঋণ সংগ্রহ এবং সেই ঋণ দ্রুত কাজে লাগানোর বিষয়টি আলোচনা করেন। ব্রাসেলস এ ডঃ ইসলাম উপ ইউরোপীয় অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর উন্নয়ন সংস্থার কমিশনার ইনচার্জ মিঃ ফ্লও বেসন এর সাথে দেখা করেন। ব্রিটিশ বৈদেশিক বাণিজ্য মন্ত্রী এবং বৈদেশিক উন্নয়ন দপ্তরের সঙ্গেও তার সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা হয়।
আশা আশ্বাস মোটামুটি সকল মহল থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এবং তৎপরবর্তী কালে যে সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে এসেছে চুয়াত্তুর-পঁচাত্তুর আর্থিক বছরের তা অব্যাহত থাকবে বলে অর্থমন্ত্রী সংসদে উল্লেখ করেছেন। এসব থেকে মনে হয় আমাদের আগামী বৎসরের উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দে বৈদেশিক সাহায্যের অংশটা কোথায় পাওয়া যাবে। অর্থমন্ত্রী নিজেও দৃঢ়তার সাথে সেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
এখন আমাদের সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে তা হলো প্রাপ্ত সাহায্যের সুষ্ঠু ব্যবহার। সাহায্য দানকারী দেশগুলোর উচিত সাহায্যের প্রতিশ্রুতি এবং সাহায্যদানের মধ্যে যে বিরাট সময় পার্থক্য সাধারণতঃ দেখা দেয় তা যথাসম্ভব হ্রাস করা। আমাদের শুধু নয় তাবৎ দুনিয়ার উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোকে তাদের উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। সেই নির্ভরতাকে যদি কেউ নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চায় তবে তাদের সে সাহায্যে দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া ছাড়া স্বাধীন মর্যাদাসম্পন্ন দেশে গত্যন্তর থাকেনা। সেই বাস্তবতার দিকে সাহায্য দানকারী দেশেরও উচিত নজর রাখা।

থেকেও নেই

ধন ধান্য পুষ্প শুধু নয়, ফলমূলেও সমৃদ্ধ এই বাংলাদেশ। সারা বছরই প্রায় বিভিন্ন রকম ফলমূলে বাজার শোভিত থাকে। আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, জামরুল, কলা, পেঁপে, ডাব, নারকেল, বাতাবি লেবু, খেজুর ইত্যাদি বাংলাদেশের সব অঞ্চলে কমবেশি পেয়ে থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ফলের মৌসুম হল গ্রীস্ম ও বর্ষা কাল। তখন একযোগে আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, খেজুর ফল বাজারজাত হয়। কলা ও পেঁপে তো সব ঋতুতেই পাওয়া যায়। পাহাড়ি অঞ্চলে কিছু কমলালেবু হয়, তবে সেগুলো প্রধানত শীতকালেরই ফল।
গ্রীষ্মকালের সূচনা থেকেই গাছে গাছে আম পাকে। আর যেসব অঞ্চলে আম বেশি হয়, যেমন রাজশাহী ও দিনাজপুরের কিছু অঞ্চল যেখানে তখন উৎকৃষ্ট আমের খুবই প্রাচুর্য থাকে। মৌসুমি ফলের বৈশিষ্ট্য হলো-তা পাকলে বেশিদিন রক্ষা করা যায় না। ফলে বাইরে পাঠাতে হয়। এর উদ্দেশ্য অবশ্যই ব্যবসা করা। তার ফলে বাংলাদেশের উৎকৃষ্ট আম সব অঞ্চলের লোকের ভোগেই আসে। এ ফল রসালো পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু। কিন্তু এত সহজে এদেশে একটা ভোগ্যপণ্য সবারই দুয়ারে সুলভে পৌঁছাবে- তার যেকোনো ঐতিহ্য নেই! তাই দেশে পর্যাপ্ত উৎপাদিত হলেও শুধুমাত্র যথাযথ ও দ্রুত পরিবহনের অভাবে পচে নষ্ট হয়। ফলে বাজারজাত আমের মূল্য যায় বেড়ে। আর বুভুক্ষ মানুষ বাংলাদেশের এই অকৃপণ ফল সম্ভার ভোগ করতে না পেরে শুধু আফসোস করে। পত্রিকান্তরে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে যে, শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রতিদিন প্রায় দশ হাজার টাকার আম পচে যাচ্ছে কারণ পরিবহনের চূড়ান্ত অভাব।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আম দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাবার পথ হল তিনটি। রেলপথ সড়ক পথ এবং নদীপথ। গোদাগাড়ীর কাছে ভারত কর্তৃক নদী পথ বন্ধ করে দেয়ায় বর্তমানে নদীপথে আম পরিবহন বন্ধ আছে। সড়কপথের ট্রাকের অস্বাভাবিক ভাড়ার প্রশ্ন তো আছেই। তার ওপর আছে ফেরিঘাটের পারাপার ব্যবস্থার অকথিত নৈরাজ্য। আম ভর্তি ট্রাক নদীর ঘাটে পড়ে থাকার ফলে বহু আম পচে যায় এবং ব্যবসায়িক ক্ষতি দেখা দেয়। সেই ক্ষতিপূরণের জন্য অতএব অবশিষ্ট ভালো আমের দামও বেড়ে যায়। রেলপথে পর্যাপ্ত ওয়াগণ পাওয়া যায় না। প্রতিবেদন সূত্র জানাচ্ছে প্রতিদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে মাত্র ৫ শত এবং রংপুর থেকে ১ হাজার ঝুড়ি আম পাঠানোর নিয়ম করে দিয়েছেন রেল কর্তৃপক্ষ। অথচ প্রতিদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৫ হাজার এবং রংপুর থেকে কমপক্ষে ১০ হাজার ঝুড়ি আম বাইরে পাঠানোর প্রয়োজন। ফলে স্টেশনে অনেক আম পচে যাচ্ছে। এবং এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা কেউ কেউ পয়সা ঢেলে তাদের চাহিদা অনুযায়ী ওয়াগন জোগাড় করছে। ফলে এক শ্রেণীর রেল কর্মচারীর হাতে কিছু কালো পয়সা আসছে। অথচ বাজারে আমের চাহিদা থেকেই যাচ্ছে এবং দাম অস্বাভাবিক চড়া সাধারণের ক্ষমতার বাইরেই থাকে তা।
আনারসের ক্ষেত্রেও তাই। বর্ষার সূচনা থেকে বাজারে প্রচুর আনারস নামতে থাকে। দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলের কোন কোন অংশে প্রচুর আনারস উৎপাদিত হয়। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা এসব অঞ্চলের পর্যাপ্ত আনারস স্বাদে ও পুষ্টিতে অতুলনীয়। আনারস সর্দি-কাশি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধকও বটে। এই ফলে প্রচুর ভিটামিন সি আছে এবং সামান্য অসুস্থ মানুষের রুচি বৃদ্ধির জন্য আনারস একটা উৎকৃষ্ট পথ্য। কিন্তু তার দাম এত বেশি যে ক্রেতাসাধারণের পক্ষে সুষম খাদ্যের তালিকায় নয়-শখের খাদ্য হিসেবে জোটানো মুশকিল।
এখানেও আনারস ব্যবসায়ীদের সেই একই কথা-পরিবহনের অভাব। চট্টগ্রামে যে আনারস ৫০ পয়সা দাম, ঢাকায় সেই আনারসের দাম দুই টাকা। কারণ চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ঢাকায় বাস, গাড়ি ও অন্যান্য যানবাহন চলাচল করে। ব্যতিক্রম শুধু ট্রাকের বেলায়। রাঙ্গামাটি থেকে আনারস ট্রাকে তোলা হয়, তা দাউদকান্দিতে এসে দু’তিন দিন বসে থাকতে বাধ্য হয় ফেরীর অভাবে। ফলে স্তুপকৃত ট্রাকবন্দী আনারসের অধিকাংশই পচে যায়। অতঃপর ঐ অবশিষ্ট ভালো আনারস গুলো যখন ঢাকায় বাজারজাত হয় তখন তার দাম সব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চায়। দরিদ্র ক্রেতাসাধারণ কেবল পারেনা, তাদের রসনার বুভুক্ষাকে পুষিয়ে নিতে।
ফলমূলের মৌসুমে পরিবহনের অভাবে হাজার হাজার টাকার ফলমূল পচে যাবার দৃষ্টান্ত এদেশের নতুন কিছু নয়। তবে স্বাধীন দেশের নিয়ম নীতি ও ব্যবস্থাপনার বিন্যাস অন্যরকম হবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। মৌসুমী ফলগুলি দেশের সর্বত্র বিতরণ করার জন্য যদি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পরিবহনের দিক দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলে অনেক লাভ। প্রথমঃ আমের অঞ্চলের অধিবাসী আনারস খেতে পায় এবং আনারসের অঞ্চলের লোক আম খেতে পায়। দ্বিতীয়ঃ ফলের একটা সুলভ মূল্য ধার্য করা যায়। এতে করে সাধারণ মানুষও পর্যাপ্ত মৌসুমী ফলের পুষ্টি ও সাধের সাময়িকভাবে তৃপ্ত ও খুশি হতে পারে। তৃতীয়তঃ এতে ব্যবসায়িক সাফল্য আসবে। যার প্রত্যক্ষ সুফলে দেশের অর্থনীতি বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ পাবে।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়-সেদিকে কারোর লক্ষ নেই। জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ পরিমাণ ভোগের কোনো পরিকল্পনাও যেন নেই। আমাদের বক্তব্য হলো-সব ব্যাপারে এরকম ঔদাসীন্য অচল। মৌসুমী ফলের সময় অঞ্চল বিশেষকে পরিবহনের বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। ফল থেকেও পাওয়া যাবেনা, মুখের আহার পচে যাবে, পচার জন্য দাম বেশি এবং জনগণের রসনা অন্যায়ভাবে বঞ্চিত হবে-এর কোনোটাই সংশ্লিষ্ট মহলের জন্য সুখের কথা নয়। কাজেই সে দিকে একটু নেক নজর পড়ুক না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!