You dont have javascript enabled! Please enable it!
এক নজরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনী
১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গােপালগঞ্জ জেলার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক অবস্থাপন্ন পরিবারে রােজ মঙ্গলবার ৩রা চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দ এবং ইংরেজী ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই মার্চ বাদ মাগরেব (রাত ৮টা) যে শিশুর জন্ম হয়, পরবর্তীকালে তিনিই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্রষ্টা এবং বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা মােসাম্মৎ সায়েরা বেগম। শেখ মুজিব পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান; তবে প্রথম পুত্র ৪ বােন এবং ২ ভাই। শেখ মুজিবের ডাক নাম “খােকা”। বাবা-মা দু’জনেই তাদের বড় ছেলেকে এই আদুরে ‘খােকা’ নামে ডাকতেন। বাড়ীতেই তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। গৃহশিক্ষকের নাম পণ্ডিত সাখাওয়াৎ উল্লাহ। ১৯২৭-১৯২৯ সাত বছর বয়সে শেখ মুজিবের স্কুল শিক্ষার সূচনা হয়। গমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরে তিনি গােপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন ১৯২৯ সালে। ১৯৩১ এ সময় শেখ লুৎফর রহমান সরকারি চাকুরীজীবী। মাদারীপুর দেওয়ানী আদালতে তিনি ছিলেন সেরেস্তাদার। প্রায়ই গ্রামের বাড়ী টুঙ্গিপাড়ায় যাতায়াত করতেন। ১৯৩১ তিনি দুরন্ত স্বভাবের পুত্র শেখ মুজিবুরকে সঙ্গে করে কর্ম ক্ষেত্রে নিয়ে এলেন এবং ভর্তি করে দিলেন মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে কিন্তু বছর দেড়েকের মধ্যে হ্যাংলা ও ছিপছিপে শেখ মুজিব আক্রান্ত হলেন ‘বেরিবেরি রােগে এবং এই রােগ থেকেই তাঁর চোখে দারুণ অসুখ দেখা দিলাে। ডাক্তারী ভাষায় রােগের নাম “গ্লোকুমা” বছর কয়েকের জন্য মুজিবের লেখাপড়া একেবারে বন্ধ। ১৯৩৬ বন্ধু-বান্ধব এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে সুচিকিৎসার জন্য পুত্রকে সঙ্গে করে লুৎফর রহমান কোলকাতায় গেলেন। বিখ্যাত চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডাঃ পি আহমদ কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেখ মুজিবের চোখে অস্ত্রোপচার করলেন। সফল অপারেশনের পর ডাঃ আহমদের পরামর্শেই কিশাের মুজিব চশমা ব্যবহার করতে শুরু করলেন। গােপালগঞ্জে ফিরে এসে তিনি ভর্তি হলেন খ্রীষ্টানদের পরিচালিত মিশন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে।
 

১৯৩৮ মাত্র ১৮ বছর বয়সে শেখ মুজিবের বিয়ে হয় ফজিলাতুন্নেসা ওরফে রেনুর সঙ্গে। এদের ৫টি পুত্র-কন্যা যথাক্রমে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। ১৯৩৯ শেখ মুজিব পরিণত হলেন একজন উন্নতমানের স্পাের্টসম্যান হিসেবে। তাঁর প্রিয়খেলা ফুটবল ও ভলিবল তবে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন গুরু সদয় দত্তের প্রবর্তিত ব্রতচারী নৃত্য’। এই ব্রতচারী থেকেই তাঁর মন মানসিকতায় বাঙালি চরিত্রের উন্মেষ ঘটে। ইতিমধ্যে শেখ মুজিব তার চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য ছাত্রদের নেতৃত্ব লাভ করেন। এবং স্থানীয় রাজনীতির চক্রান্তে দু’দফায় কারাবাস করেন। প্রথমবার ঘণ্টা কয়েক এবং দ্বিতীয়বার দিন সাতেকের জন্য। ১৯৪০ অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং সরবরাহ বিভাগের মন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী একত্রে গােপালঞ্জ মিশন স্কুল পরিদর্শনে আগমন করলে ছাত্রদের দাবি দাওয়া নিয়ে শেখ মুজিব একাই তাঁদের মােকাবেলা করেন। অন্যতম দাবি ছিলাে অবিলম্বে ছাত্রাবাসের ছাদ মেরামত। মুজিবের একগুয়েমীর জন্য প্রধামন্ত্রী ফজলুল হক তাৎক্ষণিকভাবে ১২শ’ টাকা মঞ্জুর করেন। সে বছর তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যােগদান করেন এবং অঙ্গদল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিলার নির্বাচিত হন।

১৯৪২
গােপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কোলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) আই, এ, ক্লাসে ভর্তি হন এবং মুসলিম লীগ রাজনীতিতে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৩ এ বছর শেখ মুজিব বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিলার নির্বাচিত হন। এর পরেই সমগ্র বাংলায় শুরু হয় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ’। নিরন্ন মানুষের সেবায় তিনি ঝাপিয়ে পড়লেন। অন্য ছাত্রদের সঙ্গে দল বেঁধে তিনিও লঙ্গড় খানায় স্বেচ্ছাসেবকের কাজে অংশগ্রহণ করলেন। উল্লেখ্য যে, তেতাল্লিশ-এর দুর্ভিক্ষে প্রায় ৫০ লক্ষ লােকের মৃত্যু হয়েছিল। ১৯৪৪ কুষ্টিয়ায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিব দুইটি  উপদলের মধ্যে প্রগতিশীল অংশের নেতৃত্ব গ্রহণে এগিয়ে আসেন। তিনি কোলকাতায়। অবস্থিত ফরিদপুর জেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদে নির্বাচিত হন।
 
১৯৪৫ 
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরিসমাপ্তি। ইংরেজ-ভারতের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা। সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে কেন্দ্র এবং প্রদেশগুলােতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। ১৯৪৬ শেখ মুজিব কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। এ বছর সাধারণ নির্বাচনে বেঙ্গল এসেমব্লীতে সােহরাওয়ার্দী হাশিমের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের দারুণ সাফল্য। ১১৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ১১৪টি – তে মুসলিম বিজয়ী ।  অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রীর পদে মুজিবের ‘রাজনৈতিক গুরু’ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৬ই আগস্ট কোলকাতা মহানগরীতে শুরু হলাে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মুসলিম মহল্লাগুলােতে রাতে পাহারা দেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন ক্যাম্পে ত্রাণ-সাহায্য বিতরণে অন্যদের সঙ্গে শেখ মুজিবও অমানুষিক পরিশ্রম করলেন। ফলে এ বছর তিনি  বি, এ, পরীক্ষা পর্যন্ত দিতে পারলেন না।
 
১৯৪৭ কোলতাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেন। ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে কোলকাতায় দাঙ্গা প্রতিরােধ তৎপরতায় নির্যাতিত মুসলমানদের পাশে থেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ঠা জানুয়ারি মুসলিম ছাত্র লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ২৩ শে ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন আইন পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে’ বলে ঘােষণা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে শেখ মুজিব এর প্রতিবাদ জানান। খাজা নাজিমউদ্দীনের বক্তব্যে সারাদেশে প্রতিবাদের, ঝড় ওঠে। শেখ মুজিব মুসলিম লীগের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যে কর্মতৎপরতা শুরু করেন এবং ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যােগাযােগ করেন। ২রা মার্চ ভাষার প্রশ্নে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের এক বৈঠকে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ বাংলা ভাষা নিয়ে মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান। করে। ১১ মার্চ বাংলা ভাষার দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে সহকর্মীদের সাথে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় প্রেফতার হন। তাঁর গ্রেফতারে সারা দেশে। ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রদের আন্দোলনের চাপে গ্রেফতারকৃত ছাত্রনেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্তিলাভের পর ১৬ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ছাত্র জনতার সভার আয়ােজন করা হয়।
এই সভায় শেখ মুজিব সভাপতিত্ব করেন। পুলিশ সভায় হামলা চালায়। পুলিশ হামলার প্রতিবাদে সভা থেকে ১৭ই মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানান। ২১ শে মার্চ ঢাকার রেলগেট ময়দানে আয়ােজিত বিশাল জনসভায় যখন গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ্ উর্দুর পক্ষে বক্তব্য দেন তখন সভাস্থলে যেসব ছাত্রনেতা একযােগে ‘নাে’ ‘নাে’ ধ্বনি করেছিলেন, শেখ মুজিব তাদের অন্যতম ছিলেন। এর পর ১৯শে মে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য ছাত্রনেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানান। ফলে। ১১ই সেপ্টেম্বর তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়।
 
১৯৪৯ ২১ শে জানুয়ারি শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করলেন। কিন্তু বছরটা ছিল। তার জন্য খুবই কর্মবহুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ১৫ জন ছাত্রনেতা ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘটে নেতৃত্ব করেছিলেন, তাঁদের প্রতি শাস্তির ব্যবস্থা হয়েছে। এই শান্তি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার। তবে তাদের জানিয়ে দেয়া হলাে যে, “দুঃখ” প্রকাশ করে কৈফিয়ত দিলে নামকাওয়াস্তে অর্থাৎ লঘু শাস্তি দেয়া হবে। আলচ্য ১৫ জনের মধ্যে ১৪ জন “মুচলেকা” প্রদান করলে তাদের ১০/১৫ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। এবং হুশিয়ারী’ জানানাে হলাে।  কিন্তু শেখ মুজিব “মুচলেকা দিতে অস্বীকার করলেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, চতুর্থ। শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন জানানাের বিয়ষটা কিছুতেই অপরাধ হিসাবে গণ্য হতে পারে না। ফলে মুজিবের ছাত্রজীবনের অবসান হলাে। আইন ক্লাসের ছাত্র শেখ মুজিব বহিস্কৃত হলেন তিনি শুধু বললেন যে, সসম্মানে ছাড়া আর কোন দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্দাপণ করবেন না। এরপর তিনি সােজা চলে গেলেন টাঙ্গাইলে। সেখানে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে। একযােগে উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগ বিরােধী প্রার্থী সামসুল হকের পক্ষে অমানুষিক পরিশ্রম করলেন। পাকিস্তান অর্জিত হবার পর ২৬শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত এই প্রথম উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী পন্নীসাহেব সােচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন। ঢাকায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে মুজিব গ্রেফতার হলেন। 
১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন পুরানাে ঢাকার রােজ গার্ডেনে এক গােপন বৈঠকে ‘পূর্ব। পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হলাে। কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমান। নির্বাচিত হলেন অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক পদে। ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে জেল থেকে বেরিয়েই শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে। আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। অক্টোবর মাসে আর্মানীটোলা থেকে এক বিশাল ভুখা। মিছিল রওয়ানা হলাে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীনের বাসভবন ঘেরাও-এর জন্য কিন্তু নাজিরা বাজারে পুলিশের বাধাদান ও ব্যাপক লাঠিচার্জ হলাে। মিছিল থেকেই গ্রেফতার হলেন মওলানা ভাসানী, শামসুল হক আর শেখ মুজিব কিছু দিন পরে আর সবাইকে ছেড়ে দিলেও শেখ মুজিবকে সরকার বিনা বিচারে। আটকে রাখলাে প্রায় আড়াই বছরকাল এর মধ্যে ১৯৫১ সালের ১৬ই অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী নিহত হয়েছেন। এবার নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজ নাজিম উদ্দীন।
 
১৯৫২ শেখ মুজিব তখনও জেলে। ২৬শে জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন ঢাকার পল্টন ময়দানে আয়ােজিত এক জনসভায় উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘােষণা দিলে সমগ্র পূর্ববঙ্গে শুরু হলাে দ্বিতীয় দফার ভাষা আন্দোলন। ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট বিধায় এই দিনটিকে ঘােষণা করা হলাে “ভাষা দিবস  হিসেবে। নুরুল আমীন সরকার আকস্মিকভাবে ১৪৪ ধারা জারী করলে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে সর্বদলীয় কর্মপরিষদ হরতাল প্রত্যাহার করলাে। কিন্তু গভীর রাতে ১১ জন ছাত্রনেতার সিদ্ধান্ত হচ্ছে ১৪৪ ধারা ভাংতে হবে। পরদিন ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন ছাত্র নিহত হলেন। শেখ মুজিব কারাগার থেকে এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানান এবং মহিউদ্দীন আহম্মদকে সঙ্গে নিয়ে অনশন অব্যাহত রাখেন।
কারাগারে আটক অন্যান্য ক্যুনিস্ট রাজবন্দী অনশনে অস্বীকার করেন। শেখ মুজিবকে অবিলম্বে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হওয়ার ২৭শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। তিনি চিকিৎসা ও বিশ্রাম লাভের জন্য টঙ্গিপাড়ায় চলে যান। কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে তিনি ঢাকায় আসেন। এ সময় খােদ আওয়ামী লীগ পার্টিতেই এক সংকটের সৃষ্টি হয়। তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হকের মস্তিষ্কের ভারসাম্য বিনষ্টের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। পার্টির সভাপতি মওলানা ভাসানী সভাপতি হিসাবে স্বীয় ক্ষমতাবলে শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করলেন।  ১৯৫২ সালের শেষ নাগাদ প্রতিনিধিদল মহাচীনের রাজধানী বেজিং নগরীতে আয়ােজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যােগদান করে। শেখ মুজিবও এই প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভূক্ত হন। এসময় এই প্রতিনিধি দলেন সঙ্গে চেয়ারম্যান মাও সে তুং এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই – এর পৃথক বৈঠকের মাধ্যমে যােগাযােগ স্থাপিত হয়। ১৯৫৩ ৯ই জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে ২১ দফার ভিত্তিতে মওলানা ভাসানী, একে ফজলুল হক ও শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মধ্যে ঐক্যের চেষ্টা। হয়। এই লক্ষ্যে ১৪ নভেম্বর দলের বিশেষ কাউন্সিল ডাকা হয় এবং এতে যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়।
 
৪ঠা ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠিত হয়। ১৯৫৪ ১০ই মার্চ প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট লাভ করে ২২৭টি আসন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৫২টি আসন ১৫ই মে শেখ মুজিব প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯শে মে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৩০শে মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। ৩০শে  মে শেখ মুজিব করাচী থেকে ঢাকায় ফিরে গ্রেফতার হন। ২৩শে ডিসেম্বর তিনি মুক্তি। লাভ করেন। ১৯৫৫ ২৩শে জুন আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত শাসন প্রদান করা না হলে দলীয় সদস্যরা আইনসভা থেকে পদত্যাগ করবেন। ২১শে অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিলে দলের নাম থেকে মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করা হয় এবং শেখ মুজিব পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ ১৯শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে শেরে বাংলা ফজলুল হকের কে এস পি এবং দলছুট আওয়ামী লীগারদের সমর্থনে সংখ্যাসাম্য ও এক ইউনিট -এর ভিত্তিতে সংবিধান বিল পাস এই বিল-এ পূর্ববঙ্গের নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করা হয়। ২১ দফা এবং পূর্ববঙ্গের স্বার্থবিরােধী এই সংবিধানে আওয়ামী লীগের ১৩ জন। সদস্যের স্বাক্ষরদানে অস্বীকৃতি। নেতৃত্বে শেখ মুজিবুর রহমান। ৫ই সেপ্টেম্বর ঢাকার চকবাজারে ভুখা মিছিলে পুলিশের গুলি বর্ষণে ৩জন নিহত হলে আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রিসভায় পদত্যাগ এবং আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠন। শেখ মুজিবের শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের দায়িত্ব লাভ। কেন্দ্রে নতুন কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী।
 
১৯৫৭
৭ই এবং ৮ই ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বামপন্থী মতাদর্শের তীব্র বিরােধ। মন্ত্রিসভা থেকে সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের এবং আওয়ামী লীগ থেকে। সভাপতি মওলানা ভাসানীর পদত্যাগের ঘােষণা। ১৩ই ও ১৪ই জুন ঢাকার পিকচার প্যালেস হলে আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন পার্টির সভাপতি মওলানা ভাসানী এবং ৯ জন ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যের পদত্যাগপত্র গৃহীত। জাতীয়তবাদী আওয়ামী লীগ থেকে বামপন্থীদের বিদায় মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ পার্টির নয়া অস্থায়ী সভাপতি। ২৬শে জুলাই ঢাকার রূপমহল’ সিনেমা হলে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন। কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর পদত্যাগ। এরপর আই আই চুন্দ্রীগড়ের নেতৃত্বে ক্ষণস্থায়ী কোয়ালিশন সরকার এবং সবশেষে কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ফিরােজ খান নুন। ১৯৫৮ সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। ১৮ই জুন আতাউর রহমান খানের আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পতন। ২০শে জুন আবু হােসেন সরকার মন্ত্রিসভার শপথ মে শেখ মুজিব করাচী থেকে ঢাকায় ফিরে গ্রেফতার হন। ২৩শে ডিসেম্বর তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৯৫৫
২৩শে জুন আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের। স্বায়ত্ত শাসন প্রদান করা না হলে দলীয় সদস্যরা আইনসভা থেকে পদত্যাগ করবেন।  ২১শে অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিলে দলের নাম থেকে মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করা হয় এবং শেখ মুজিব পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ ১৯শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে শেরে বাংলা ফজলুল হকের কে এস পি এবং দলছুট আওয়ামী লীগারদের সমর্থনে সংখ্যাসাম্য ও এক ইউনিট -এর ভিত্তিতে সংবিধান বিল পাস। এই বিল-এ পূর্ববঙ্গের নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করা হয়। ২১ দফা এবং পূর্ববঙ্গের স্বার্থবিরােধী এই সংবিধানে আওয়ামী লীগের ১৩ জন সদস্যের স্বাক্ষরদানে অস্বীকৃতি। নেতৃত্বে শেখ মুজিবুর রহমান। ৫ই সেপ্টেম্বর ঢাকার চকবাজারে ভুখা মিছিলে পুলিশের গুলি বর্ষণে ৩জন নিহত হলে আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রিসভায় পদত্যাগ এবং আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠন। শেখ মুজিবের শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের দায়িত্ব লাভ। কেন্দ্রে নতুন কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী।

১৯৫৭

৭ই এবং ৮ই ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বামপন্থী মতাদর্শের তীব্র বিরােধ। মন্ত্রিসভা থেকে সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের এবং আওয়ামী লীগ থেকে। সভাপতি মওলানা ভাসানীর পদত্যাগের ঘােষণা। ১৩ই ও ১৪ই জুন ঢাকার পিকচার প্যালেস হলে আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন। পার্টির সভাপতি মওলানা ভাসানী এবং ৯ জন ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যের পদত্যাগপত্র গৃহীত। জাতীয়তবাদী আওয়ামী লীগ থেকে বামপন্থীদের বিদায়। মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ পার্টির নয়া অস্থায়ী সভাপতি ২৬শে জুলাই ঢাকার রূপমহল’ সিনেমা হলে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন। কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর পদত্যাগ এরপর আই আই চুন্দ্রীগড়ের নেতৃত্বে ক্ষণস্থায়ী কোয়ালিশন সরকার এবং সবশেষে কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ফিরােজ খান নুন। ১৯৫৮ সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। ১৮ই জুন আতাউর রহমান খানের আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পতন। ২০শে জুন আবু হােসেন সরকার মন্ত্রিসভার শপথ  গ্রহণ এবং মাত্র ৭২ ঘণ্টার ব্যবধানে পদত্যাগ। ২৩ শে জুন পুনরায় মুখ্য মন্ত্রী পদে  আতাউর রহমান খান। এইদিন বিকালে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশনে বিরােধী দলীয় সদস্যদের আক্রমণে ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী প্রহৃত ও নিহত  ২৪শে জুন পূর্ববঙ্গের গভর্নরের পদ থেকে শেরে বাংলা ফজলুল হককে অব্যাহতি দান। নতুন গভর্নর হিসাবে প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত সুলতানউদ্দীন আহম্মদের  নিযুক্তি। ৭ই অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা কর্তৃক দেশব্যাপী সামরিক আইন জারী। সংবিধান বাতিল, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ এবং বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী গ্রেফতার। এদের মধ্যে শেখ মুজিবকে বিনা বিচারে আটক করা হয় ১১ই অক্টোবর ২৮শে অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মির্জার পদত্যাগ এবং একবস্ত্রে দেশত্যাগ প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা গ্রহণ।

১৯৫৯
কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমান। সামরিক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামক এক উদ্ভট পদ্ধতির প্রবর্তন। ১৪ মাস পরে মুজিবের মুক্তিলাভ এবং পুনরায় জেলা গেটেই গ্রেফতার। হাইকোর্টে রীট আবেদনে মুজিবের মুক্তি লাভ ।
১৯৬০
প্রহসন মূলক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রশ্নে গণভােট। একমাত্র প্রার্থী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর মধ্যে ৭৫.২৮৩ জনের সম্মতিসূচক ভােট প্রদান। নিজেকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসাবে আইয়ুব খানের দাবি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বিক্ষোভ।
১৯৬১
২৭শে এপ্রিল শেরে বাংলা ফজলুল হকের ইন্তেকাল। পূর্ববঙ্গে শােকের ছায়া। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর।

১৯৬২

৬ই ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। ২রা জুন চার বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটলে ১৮ই জুন শেখ মুজিব মুক্তি লাভ করেন। ২৫  শে জুন শেখ মুজিবসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতি দেন। ৫ই জুলাই পল্টনের জনসভায় শেখ মুজিব আইয়ুব। সরকারের কঠোর সমালােচনা করেন। আইয়ুব খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ঢাকায় প্রচণ্ড ছাত্রবিক্ষোভ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ। ২৪ শে সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবের লাহাের গমন। এখানে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বিরােধী দলীয় মাের্চা ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ গঠিত হয়। অক্টোবর মাসে এই ফ্রন্টের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সাথে শেখ মুজিব সারা বাংলা সফর করেন।

১৯৬৩
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক গােপনে মওলানা ভাসানীর বিতর্কিত চীন সফরের  ব্যবস্থা। ভারত-বিরােধী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর অনুরােধে মওলানা ভাসানী কর্তৃক ‘ডােন্ট ডিসটার্ব আইয়ুব’ (আইয়ুবকে বিরক্ত করাে না) নীতি গ্রহণ।  লেবাননের বৈরুত নগরীর এক হােটেলকক্ষে অসুস্থ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ইন্তেকাল শেখ মুজিব কর্তৃক দলবলসহ “অকেজো এনডি এফ” ত্যাগ করার ঘােষণা।
১৯৬৪
২৫ শে জানুয়ারি শেখ মুজিবের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এই সভায় দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভােটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় সম্বলিত প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় মাওলানা তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিব যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।  ১৯৬৫ সালে অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে ৯ দফা ভিত্তিক আইয়ুব বিরােধী দল গঠন এবং ফাতেমা জিন্নাহকে মনােনয়ন দান। নয়া প্রেস অ্যাক্টের বিরুদ্ধে সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী সাংবাদিকদের ব্যাপক বিক্ষোভ। ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। শেখ মুজিবের উদ্যোগে “পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাড়াও” শীর্ষক ঐতিহাসিক দাঙ্গাবিরােধী প্রচারপত্র বিলি। পরােক্ষ ভােটে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত।
১৯৬৫
শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আপত্তিকর বক্তব্য রাখার অভিযােগে সরকারের মামলা দায়ের ও এক বছরের কারাদণ্ড। পরবর্তীতে হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তি লাভ। পাকিস্তানের উভয় অংশে ক্রমর্ধমান আইয়ুব বিরােধী বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে এবং জনমত বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে ১৭ দিন স্থায়ী পাক-ভারত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই যুদ্ধকালীন সময়ে পূর্ববঙ্গ সম্পূর্ণ  অরক্ষিত থাকায় বাঙালিদের মধ্যে ধূমায়িত অসন্তোষ।
১৯৬৬ 
সােভিয়েট রাশিয়ার মধ্যস্থতায় তাসখন্দ নগরে আইয়ুব-শাস্ত্রী যুদ্ধ-বিরতি চুক্তি স্বাক্ষর। ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহােরে বিরােধীদলসমূহের জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ। প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ। ১লা মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহম্মদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। শেখ মুজিব ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা বাংলায় গণসংযােগ সফর শুরু করেন। এ সময় তাঁকে খুলনা, যশাের, সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বার বার গ্রেফতার করা হয়। এ বছর প্রথম তিন মাসে তিনি আটবার গ্রেফতার হন। ৮ই মে নারায়নগঞ্জে পাটকল শ্রমিকদের জনসভায় বক্তৃতা শেষে তাকে পুনরায় ।
গ্রেফতার করা হয়। ৭ই জুন শেখ মুজিব ও আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে সারাদেশে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের সময় ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও টঙ্গীতে পুলিশের গুলীতে শ্রমিকনেতা মনু মিয়াসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয়। এর পরেই দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্দ ও “নিউনেশন প্রেস’ বাজেয়াপ্ত করা হয়। বামপন্থীরা ৬ দফা। আন্দোলনের বিরােধিতা করে।
১৯৬৭ তাসখন্দ যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রতিবাদে পররাষ্ট্র মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর পদত্যাগ। করাচীতে ফাতেমা জিন্নার পরলােকগমন। ৩০শে নভেম্বর রংপুরে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল। অধিবেশনে ন্যাপ দ্বিখণ্ডিত; পিকিংপন্থী ন্যাপ ও মস্কোপন্থী ন্যাপ গঠিত।
১৯৬৮
৬ই জানুয়ারি : পাকিস্তান সরকার কর্তৃক জারীকৃত এক প্রেসনােটে পূর্ব পাকিস্তানকে বিছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সশস্ত্র বাহিনীর ২৮ জন সদস্যকে (বাঙালি) গ্রেফতারের কথা ঘােষণা। ১৮ই জানুয়ারি : ইসলামাবাদ থেকে জারীকৃত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক  প্রেসনােটে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১নং বিবাদী হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে গ্রেফতারের কথা  ঘােষণা উল্লেখ্য যে, ১৯৬৬ সালের ৮ই মে থেকে একনাগাড়ে ২০ মাস শেখ মুজিব ঢাকা জেলে আটক ছিলেন। ১৮ই জানুয়ারি ভাের রাত সাড়ে  তিনটায় শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হয় এবং জেল গেট থেকেই তাকে  সামরিক হেফাজতে নেয়া হয়।
গ. ১১ই এপ্রিল : তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারের জন্য পাঞ্জাবের জাস্টিস এস এ রহমানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। গঠন ১৯শে জুন : ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে বিশেষভাবে নির্মিত আদালত। কক্ষে সামরিক প্রহরায় তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরু ঙ. ৪ঠা নভেম্বর : রাওয়ালপিণ্ডিতে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ এবং পুলিশের গুলিতে একজন ছাত্র নিহত। ১০ই নভেম্বর ও প্রকাশ্য জনসভায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে পিস্তলের। গুলিতে হত্যার প্রচেষ্টা ব্যর্থ।  ১৩ই নভেম্বর: লাহােরে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খানকে গ্রেফতার। ৫ই ডিসেম্বর : মওলানা ভাসানী কর্তৃক ডােন্ট ডিসটার্ব আইয়ুব নীতি বাতিল এবং পল্টন ময়দানে আয়ােজিত জনসভায় তীব্র ভাষায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের
সমালােচনা ও অবসর গ্রহণের পরামর্শ দান।

ঝ. ৭ই ডিসেম্বর : ঢাকায় মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে বিরােধী দলগুলাের প্রতি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের হুশিয়ারী। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে একের পর এক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সরকারকে টলানাে যাবে না।” ১৩ই ডিসেম্বর ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে সরকার বিরােধী সর্বাত্মক হরতাল। ডাকসু’র ১১ দফা দাবির ভিত্তিতে ছাত্র আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ ।

১৯৬৯
তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানী সমাপ্ত। পূর্ববঙ্গে সর্বত্র প্রচণ্ড আইয়ুব বিরােধী বিক্ষোভ। সেনাবাহিনী মােতায়েন এবং বিক্ষোভকারীদের উপর গুলিবর্ষণ। জনতা কর্তৃক কারফিউ অগ্রাহ্য এবং ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে সমগ্র পূর্ববঙ্গ প্রকম্পিত। সংক্ষিপ্ত ঘটনাপঞ্জী নিম্নরূপ- ক. ১৭ই জানুয়ারি: ডাকসুর ভিপি তােফায়েল আহম্মেদের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসভা এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শােভাযাত্রা। পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ। জনাকয়েক ছাত্র আহত ও গ্রেফতার। ২০শে জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শােভাযাত্রা। সমস্ত দিনব্যাপী স্থানে স্থানে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ অব্যাহত। জনৈক পুলিশ অফিসার কর্তৃক পেট্রোল পাম্পে দণ্ডায়মান প্রগতিশীল ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানকে রিভলবারের গুলিতে নৃশংসভাবে হত্যা। আইয়ুব-বিরােধী বিক্ষোভের ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ। চট্টগ্রামে ছাত্র-পুলিশের কয়েক দফায় সংঘর্ষ এবং ইপিআর বাহিনী তলব ২৫ শে জানুয়ারি ঢাকায় সেনাবাহিনী তলব এবং লাগাতার সান্ধ্য আইনের মেয়াদ আরাে ১২৪ ঘণ্টা বৃদ্ধি। রাতের অন্ধকারে ঢাকার প্রতিটি বাড়ির ছাদ থেকে গগনবিদারী “জয় বাংলা” শ্লোগান। পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় টঙ্গী। থেকে নারায়নগঞ্জ পর্যন্ত সর্বত্র লাগাতার কারফিউ জারী। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনাবাহিনীর টহল। রাজশাহী, সিলেট ও ময়মনসিংহেও কারফিউ জারী  ২৬ শে জানুয়ারি থেকে ৫ই ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনের বিস্তৃতি লাভ।
 
বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার দফায় দফায় সংঘর্ষ এবং বহু লােক হতাহত। ১লা ফেব্রুয়ারি ও পরিস্থিতির দ্রুত অবনতির প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব কর্তৃক গােল টেবিল বৈঠক আহ্বান। দৈনিক ইত্তেফাকের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। ৬ই ফেব্রুয়ারি : নারায়নগঞ্জের শিল্প এলাকা থেকে ১০ সহস্রাধিক বিক্ষুদ্ধ। শ্রমিকজনতার ঢাকা নগরীতে প্রবেশ এবং পুলিশ ইপিআর বাহিনীর গুলি অগ্রাহ্য করে মর্নিং নিউজ’ ও দৈনিক পাকিস্তানের (বর্তমানে দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ টাইমস -এর অফিস) অফিস আক্রমণ ও অগ্নিসংযােগ। গুলিতে ৪ জন নিহত। আব্দুল গণি রােডে দু’জন মন্ত্রীর সরকারী বাসভবন এবং রমনা গেটের নিকটে সরকারী গেস্ট হাউস ভস্মীভূত। এই গেস্ট হাউসে  অবস্থানরত তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান বিচারপতি বাবুর্চির লুঙ্গি পরে অতি কষ্টে লাহােরে পলায়ন। রাতে ২৪ ঘণ্টার জন্য লাগাতার কারফিউ জারী এবং সামরিক বাহিনী তলব।
১লা থেকে ১৫ই ফেব্রুয়ারি: আইয়ুব-বিরােধী অভ্যুত্থানের গ্রামীণ এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ। ১৫ই ফেব্রুয়ারি কুর্মিটোলায় সামরিক হেফাজতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হলে পরিস্থিতি ভয়ংকর আকার ধারণ করে। ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে প্রবেশ করে সামরিক বাহিনীর জনৈক লেফটেন্যান্ট প্রােক্টর ডঃ সামসুজ্জোহাকে হত্যা করলে দেশের সামগ্রিক অবস্থা ভয়াল হয়ে দাঁড়ায় এবং প্রশাসন প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। ১৯শে থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি: শেখ মুজিব কর্তৃক প্যারােলে মুক্তি নিয়ে গােল টেবিল আলােচনায় যােগদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। এদিকে ১৯শে ও ২০শে ফেব্রুয়ারি সমস্ত দিন ধরে ঢাকায় খণ্ড খণ্ড মিছিল। ২টি মাত্র শ্লোগান, ‘জয় বাংলা’ এবং ‘জেলের তালা ভাংবাে, শেখ মুজিবকে আনবাে ঢাকায় জোর গুজব পরদিন পাঁচ লাখ লােকের জনতা তাদের প্রিয় মুজিব ভাইকে ছাড়িয়ে আনার জন্য কুর্মিটোলায় অভিযান করবে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক আগড়তলা ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স বাতিল। সব বিবাদের মুক্তিলাভ।
 
২৩শে ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়ােজিত বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবের গণসম্বর্ধনা। ছাত্রজনতার পক্ষে সভার সভাপতি তােফায়েল আহম্মেদ কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু’ উপাধি। স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সঙ্গে কোনাে আলােচনা হতে পারে না বলে যেখানে ভাষানী-ভুট্টো তাদের জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন রেখেছিলেন, সেখানে ‘আইয়ুবের দালাল বিসাবে চিহ্নিত হওয়ার আশংকা থাকা সত্ত্বেও গােল টেবিল বৈঠকে যােগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর ১০ই মার্চ পিণ্ডি গিয়ে হাজির হলেন। ৪ দিন ব্যাপী এই বৈঠকে সিংহপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেউই তার ৬ দফা দাবি থেকে সামান্যতম টলাতে পারলাে না। বঙ্গবন্ধুর কথা একটাই এবং তা হলাে ৬ দফার সামান্যতম হেরফের করা সম্ভব নয়। দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে ১৯৬৯ সালের ২৪ শে মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব পদত্যাগ করলেন। সমস্ত কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের  এবার শুরু হলাে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন।
১৯৭০
৬ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহম্মদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১লা এপ্রিল আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের সভায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় জুন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ১৭ই অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তার দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে ‘নৌকা প্রতীক পছন্দ করেন এবং ঢাকার ধােলাইখালে প্রথম নির্বাচনী জনসভার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। ২৮ শে অক্টোবর তিনি জাতির উদ্দেশ্যে বেতার-টিভি ভাষণে ৬ দফা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়যুক্ত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানান। ১২ই নভেম্বরের গাের্কিতে উপকূলীয় এলাকায় ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটলে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণা বাতিল করে দুর্গত এলাকায় চলে যান এবং আর্তমানবতার প্রতি পাকিস্তানী শাসকদের ঔদাসীন্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তিনি গাের্কি উপদ্রত মানুষের ত্রাণের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ৭ই ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে। ১৬৭ টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৯ টি আসন লাভ করে।
 
১৯৭১
৩রা জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যরা ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন। ২৮শে জানুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে আলােচনার জন্য ঢাকায় আসেন। তিনদিন বৈঠকের পর আলােচনা ব্যর্থ হয়ে যায় ১৩ই ফেব্রুয়ারি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘােষণা দিয়ে দুই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দু’দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানান।  ১৬ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে জনাব ভুট্টোর দাবির তীব্র সমালােচনা করে বলেন, ভুট্টো সাহেবের দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ক্ষমতা একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। ক্ষমতার মালিক এখন পূর্ব বাংলার জনগণ।  ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্ট কালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘােষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরী বৈঠকে ২রা মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। ৩রা মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালিত হবার পর বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি দাবি জানান। ৭ই মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’ ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃংখল মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘােষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরাে দেবাে এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে ইনশাল্লাহ।  প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তােলে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে মােকাবেলা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু সারাদেশে শান্তিপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দিলেন শুরু হলাে অসহযােগ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জারী হলাে ৩৫ দফা নির্দেশ।
 
১৬ই মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়।  আলােচনার জন্য জনাব ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। ২৪শে মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-মুজিব ভুট্টো আলােচনা হয়। ২৫শে মার্চ আলােচনা অসমাপ্ত রেখেই সন্ধ্যায় ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগ। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে। এটাই হচ্ছে গণহত্যা। ফলে বঙ্গবন্ধু মধ্যরাতের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক যােদ্ধা, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু কিভাবে? তিনি টেলিফোনে নিজের পরিচয় জানিয়ে ঢাকার সেন্ট্রাল টেলিগ্রাম অফিসে একটা মেসেজ’ ডিকটেশনঃ অনুরােধে করলেন এই বাণী চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব এম এ হান্নানের কাছে অবিলম্বে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য। স্বাধীনতার ঘােষণার বাণীটি নিম্নরূপঃ The Pakistan army has attacked Ploice Lines at Rajarbag and East Pakistan Rifles Headquarters at Pilkhana at Midnight. Gather streagnth to resist and prepare for a war of Independence. Massacre by Robert Payne. The Macmillan Cokpany, Newyork. Page 24. (পাকিস্তান সৈন্য বাহিনী মাঝরাতে রাজারবাগে পুলিশ লাইন এবং পিলখানায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস -এর হেডকোয়ার্টার্স আক্রমণ করেছে। প্রতিরােধের জন্য শক্তি সঞ্চয় করাে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।)
 
এই বাণী যখন চট্টগ্রামে এম এ হান্নানের কাছে পাঠানাে হলাে, তখন ইংরেজী ক্যালেণ্ডারের তারিখ পরিবর্তন হয়ে গেছে। অর্থাৎ তখন ২৬শে মার্চ। এজন্য ২৬শে মার্চ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিবস। বঙ্গবন্ধুর এই প্রেরিত বাণী হান্নান সাহেবের কণ্ঠে। চট্টগ্রাম বেতারের আগ্রাবাদ স্টেশন থেকে প্রচারিত হয়েছিলাে। পরদিন ২৭শে মার্চ মেজর জিয়া কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র থেকে নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধুর বরাতে স্বাধীনতার বাণী পাঠ করেন। এদিকে ২৬শে মার্চ ভাের রাত ১.১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমণ্ডির ৩২ নং রােডের বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে এবং ২৬শে মার্চে বন্দী অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা পত্রটি পাঠ করেন। সারা বাংলায় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।  ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী প্রবাসী সরকারের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ই ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশ লাভ করে স্বাধীনতা।
তার আগে ৭ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের লায়লপুর সামরিক জেলে বঙ্গবন্ধুর  গােপন বিচার শুরু হয় এবং বিচারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহীতার দায়ে প্রাণদণ্ড প্রদান করা হয়। ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানায় ফলে বিচারের রায় কার্যকরী করা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু যুদ্ধের ডামাডােলে ঘটনা প্রবাহের দ্রুত পরিবর্তন হয় ১৯৭২। ৮ই জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেদিনই বঙ্গবন্ধু ঢাকার উদ্দেশ্যে লণ্ডন যাত্রা করেন। লণ্ডনে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সাথে সাক্ষাৎ হয়।

লণ্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লীতে যাত্রা বিরতি করেন। বিমান বন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি ও প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১০ই জানুয়ারি ঢাকায় পৌছিলে তাকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু বিমান বন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে লক্ষ্য জনতার সমাবেশ থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ১১ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ৬ই ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি ভারত যান। ২৪ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাকে ডাকসু’র আজীবন সদস্যপদ প্রদান করেন। ১লা মার্চ তিনি সােভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান। ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর অনুরােধে ভারতীয় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ৩০শে জুলাই লণ্ডনে বঙ্গবন্ধুর পিত্তকোষে অস্ত্রোপচার করানাে হয়। অস্ত্রোপচারের পর লণ্ডন থেকে তিনি জেনেভা যান। ১০ই অক্টোবর বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরী’ পুরস্কারে ভূষিত করে। ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। ১৯৭৩ জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৯৩ আসন লাভ। ৩রা সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপের সমন্বয়ে গণঐক্য জোট গঠিত। ৬ই সেপ্টেম্বর জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে যােগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়া যান। ১৭ অক্টোবর তিনি জাপান সফর করেন। ১৯৭৪ ১৯শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সরকার ঢাকা পৌরসভাকে কর্পোরেশনে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ২৩শ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাহােরে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে যােগদান করেন। ১৮ই সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত অনুমােদনে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে এবং ২৫শে।

সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন। ১৯৭৫ ২৫শে জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং ২৪শে ফেব্রুয়ারি। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় দল ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ গঠন। বঙ্গবন্ধু ২৫শে ফেব্রুয়ারি এই দলে যােগদানের জন্য দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান।  ইতিমধ্যে নিরলস প্রচেষ্টার ফলে গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের কৃষিজাত দ্রব্যের ফলন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সবার অজান্তে পাকিস্তান সমর্থক এবং সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। ১৫ই আগস্ট ভােরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কতিপয়  অফিসারের হাতে নিহত হন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী মহিয়সী নারী বেগম। ফজিলাতুন্নেসা, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযােদ্ধা শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রােজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা। ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি বঙ্গবন্ধুর। নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিলসহ পরিবারে ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনকে। ঘাতকরা হত্যা করে ৩রা নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের চারজন মহান নেতাকে। বাংলাদেশে শুরু হয় অন্ধকার যুগ’। ক্রমাগত সামরিক । অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান ও সরকার পরিবর্তন।

সূত্রঃ   একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!