You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২০শে জুন, শুক্রবার, ৬ই আষাঢ়, ১৩৮১

১৯৭৪-৭৫ সালের প্রস্তাবিত বাজেট

অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেব গত বুধবার জাতীয় সংসদে ১৯৭৪-৭৫ আর্থিক বছরের জন্য বাজেট পেশ করেন। তাঁর বাজেট প্রস্তাবনায় প্রচলিত আইনের উৎসগুলি থেকে রাজস্ব খাতে উপার্জন দেখানো হয় ৪৭০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এই খাতে ব্যয়ের পরিমাণও সমান। উন্নয়ন খাতে মোট ব্যয় বরাদ্দ করা হয় ৫২৫ কোটি টাকা। মন্ত্রী জানান, এর মধ্যে ৩৯৪ কোটি টাকা আসবে বিদেশ থেকে ঋণ কিংবা মঞ্জুরি হিসেবে। আভ্যন্তরীণ সম্পদের লাগবে ১৩১ কোটি টাকা। এই ১৩১ কোটি টাকা সংগ্রহ করার জন্য তিনি ৮৯ কোটি ১৪ লাখ টাকার নতুন কর ও পুরাতন কর বারাবার প্রস্তাব রাখেন। নতুন কর প্রস্তাব থেকে রাজস্ব খাতে এই পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্জন করে তিনি উন্নয়ন খাতে এর বরাদ্দ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। এই খাতের রাজস্ব উদ্বৃত্ত কোন মূলধন থেকে অতিরিক্ত প্রাপ্ত ১০ কোটি টাকা যোগান দেওয়া হবে। খাদ্যে ভর্তুকির জন্য ৬০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচায় ঝক্কি না পোহাতে হলে তিনি এই টাকাটাও এখানে আনতে পারতেন। এরপরেও অর্থমন্ত্রীর তহবিলে ৩১ কোটি ৮৬ লাখ টাকার টান থেকে যায়। আভ্যন্তরীণ ব্যাংক থেকে কর্জ করে এই টাকাটা সংগ্রহ করা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বস্তুতঃ রাজস্ব খাতে অতিরিক্ত কর ধার্য করে সরকার উদ্বৃত্ত বাজেট পেশ করেছেন। এবং এই উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ কোটি ১৪ লাখ+১০ কোটি= ৯৯ কোটি ১৪ লাখের মতো। উন্নয়ন খাতে সরকারের প্রস্তাবিত বরাদ্দের জোগান দেওয়ার কোনো বিকল্প অর্থ সংস্থাপন না থাকায় নতুন কর আরোপ ও কর বৃদ্ধির প্রচলিত রীতি অবলম্বন করা হয়।
বাজেট প্রণয়নে অর্থমন্ত্রীকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে বলে অনুমান করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। রাজস্ব খাতে আয় ব্যয়ের সমতা বিধানের পরও তাকে প্রস্তাবিত উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ সংগ্রহের জন্য অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে কতকগুলি কঠিন ব্যায়াম এর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়।
কারণ উন্নয়ন খাতে আমরা যে ৩৯৪ কোটি টাকা বৈদেশিক সাহায্য পাচ্ছি এটি কোন ক্রমেই আমাদের নিজস্ব সম্পদ নয়। এই পরিমাণ টাকা যে পাবে সে সম্পর্কেও কোন নিশ্চয়তা নেই। তবে যদি সাহায্যটা পেয়ে যায় তাকে কাজে লাগানোর জন্য দেশের ভেতর থেকে সম্পূরক সম্পদ বা সাপোর্টিং অ্যাসিড জোগান দেওয়ার দরকার রয়েছে। কারণ বিদেশীরা আমাদের সাহায্য করতে চাইবেন না যদি তারা দেখেন যে তাদের সাহায্যটাকে সদ্ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় লোকাল সাপোর্ট আমরা দিতে সমর্থন নই। এই বাস্তবিকতার কথা অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় অনুল্লেখ রেখেছেন। কারণ এটি বলা হলে আমরা ক্রমাগত পরনির্ভর হয়ে পড়ছি তার স্বীকৃতি দান করা হত। ওটি লজ্জার কথা। বাৎসরিক উন্নয়ন বরাদ্দ শতকরা ৭৬ ভাগ এর বেশি বিদেশ থেকে দাঁতন হিসেবে আসছে আর মাত্র ২৪ ভাগও আমরা সংস্থান করতে পারছিনা এ খবরটি অকপটে বলা যায়না।
নতুন কর প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী কতকগুলি পরোক্ষ কর ধার্যের প্রস্তাব এনেছেন। এই ধরনের কর ধার্য রেওয়াজের মারাত্মক কুফল হচ্ছে এগুলো ঘাড় পরিবর্তন করে পরিণতিতে গরিব মানুষগুলো গর্দান মটকিয়ে দেয়। বাড়ি ভাড়ার ওপর যে করটি ধার্য করার কথা তিনি তুলেছেন ওগুলো ভাড়াটের ওপর গিয়ে বর্তাতে পারে। ঢেউটিন ও সিমেন্টের ওপর নতুন করে ধার উঁচু করে তিনি গৃহনির্মাণ কর্মসূচিকে পরাস্ত করবেন। কার্যতঃ বাড়িভাড়া ঢেউটিন ও সিমেন্টের ওপর একটি মাত্র খাতের ওপর বর্তিয়েছে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ যেখানে পুর্নবাসন ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া এখনো চলছে সেখানে বাসগৃহ নির্মাণকার্য সরঞ্জাম এর উপর কর আরোপ করার পেছনে কোন সুযুক্তি কাজ করার কথা নয়। অথচ আমরা তাই করতে চলেছি।
চিনি ও জ্বালানি গ্যাসের উপর ধার্যকৃত কর প্রস্তাব পদ্ধতিগতভাবে একটি ত্রুটিপূর্ণ বিষয়। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে উৎপাদিত দ্রব্যের উপর এভাবে সরাসরি কর ধার্য করে মূল্য বৃদ্ধি করার পশ্চাতের মানসিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে পারে। এ সকল ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী বিক্রয় মূল্য পুনঃবিন্যাস করে লভ্যাংশের বৃদ্ধি দেখিয়ে টাকা সংস্থান করা চলতে পারতো। বাজেটে কর ধার্য করে এ ধরনের টাকা তুলে নেয়ার বিধান সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় কোথাও নেই। তাছাড়া এই খাতের প্রস্তাবিত কর এর মাশুল পরিণতিতে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের অসন্তোষ বাড়াবে।
বিক্রয় কর আবগারি শুল্ক ও আমদানি রপ্তানি শুল্কের বৃদ্ধি বস্তুত জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি করবে এবং বর্তমান দ্রব্যমূল্য আরো বাড়িয়ে তুলবে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় যেখানে উল্লেখ করেছেন চলতি বছরেও দ্রব্যমূল্য শতকরা ৪০ ভাগ বেড়ে রয়েছে সেখানে নতুন করে প্রস্তাবের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে তোলার প্রয়াস সুফল আনবে কি? বস্তুতঃ কর প্রস্তাবের বিন্যাস দেখলে একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রকট হয়ে পড়ে। সেটি হল বর্তমান বাজেটে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির ওদের চাইতে সরকারের মনোযোগ এমন কতকগুলি দিকে পরিচালিত সেগুলি ভবিষ্যতে সুফল দিতে পারবে কিনা, সে সম্পর্কে সরকার নিজেও নিশ্চিত নন।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাব এ কতগুলি ধাঁধা রয়েছে। তার মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ধাঁধাটি হচ্ছে খাদ্য সংক্রান্ত। এখানে অর্থমন্ত্রী আমন আউশ ফসলের যে বর্ধিত ফলন দেখিয়েছেন এবং লক্ষ্যমাত্রা যেখানে নিয়ে ঠিক করেছেন তাতে করে আমাদের খাদ্য আমদানির দরকার পড়ার কথা নয়। উপরন্ত কিছু রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করার কথা। এই হিসেবে গড়মিল টা দূর হওয়া দরকার।
উন্নয়ন খাতে অর্থমন্ত্রী বরাদ্দের প্রস্তাব সম্পর্কে আমরা এতটুকু মন্তব্য রাখবো যে, ওগুলি খুবই গতানুগতিক। পক্ষান্তরে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বা বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোটেই গতানুগতিক নয়। এ দিকটায় একটু লক্ষ্য দেওয়া উচিত ছিল। মনে রাখা দরকার ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলির বিশেষ অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা প্রশ্নটির কথা। মানুষের দুঃখ কষ্ট লাঘবের জন্য অনিবার্য ব্যয় গুলির প্রতি একটু সুনজর দিয়ে প্রথম পরিকল্পনার দ্বিতীয় বছরটি, যে বছরটি জাতীয় অর্থনৈতিক পূর্ণ গঠনের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত, সেই বছরের বাজেট সয়ম্ভর হওয়ার পথে সম্পূরক শক্তি সংগ্রহ করতে পারলে তার পরিণতিতে দেশের কল্যাণে আসতে পারতো। আমাদের বিশ্বাস, অর্থমন্ত্রী সে দিকটা বিবেচনা করবেন। ঋণের টাকাগুলি আর ট্যাক্সের আয় গুলি যেন পানিতে ঢালা না হয়। কারণ ওগুলো জনগণেরই রক্তচোষা টাকা।

প্রদীপের নিচে অন্ধকার!

নতুন শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পূর্বে দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। বিশেষ করে প্রাথমিক স্কুল গুলোর অধিকাংশ সরকারি নিয়ন্ত্রণে এনে সরাসরি সরকার তার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বস্তুতঃ পক্ষে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের সমস্যাটি বহুকালের। অতীতে এই বিভাগটি ছিল সবচেয়ে অবহেলিত। দশ টাকা থেকে বাইশ অথবা পঞ্চাশ টাকা বেতন পেয়ে শিক্ষকরা চাকরি করতেন। তাদের সেই দুঃসহ অবস্থা নিরসনের দাবি নিয়ে অতীতে বহু সংগ্রাম হয়েছে। রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর বিভিন্ন দাবি-দাওয়া মাঝে শিক্ষাক্ষেত্রে দাবি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি। কিন্তু অতীতের শাসকগোষ্ঠী কোনদিনও তাদের সেই দাবির প্রতি নজর দেননি। এমনকি কঠোর হাতে সেই দাবির মুখে পদঘাতও করেছিলেন। সেদিনের স্বাধীনতাকামী মানুষ যারা ছিল তারা শিক্ষকদের বিশেষ করে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে সরকারের সঙ্গে সংগ্রাম করেছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি পূরণের আশ্বাস সেইদিনই আজকের ক্ষমতাসীন নেতারা দিয়েছিলেন। এবং স্বাধীনতার পরপরই তাদের দাবি-দাওয়া পূরণের জন্য যতদূর সম্ভব তৎপর হয়েছেন। প্রাথমিক স্কুলগুলো পরিচালনার জন্য সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করায় দেশের আপামর মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠেছে। আমরাও সেদিন সরকারের এই শুভ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছি। প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি নিয়ন্ত্রণে আসার পরও কিছু কিছু সমস্যা বর্তমান রয়ে গেছে। এর জন্য কর্তৃপক্ষকে আরো বাস্তবমুখী হতে হবে। ইতিপূর্বে দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রায় দশ হাজার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক বেতন পাচ্ছেন না বলে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। স্কুলগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হলেও বেতন প্রার্থীর ব্যাপারে কিছু কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বলে অনেকেই বিশ্বাস। অতীতে যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অত্যন্ত স্বল্প বেতন পেতেন তখনও তাদের বেতন তারা নিয়মিত পেতেন না। সম্প্রতি প্রকাশিত চাঁদপুরের একটি সংবাদে আমরা লক্ষ্য করেছি-চাঁদপুর পৌর এলাকার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ ১৯৭৩ সালের জুলাই মাস থেকে বেতন পাচ্ছেন না। চাঁদপুর পৌর এলাকার দশটি স্কুলের শিক্ষকগণ এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। বস্তুত এ ধরনের সমস্যা প্রতিনিয়তই লক্ষ করা যাচ্ছে। একেতো স্কুলের শিক্ষকরা বেতন পান অত্যন্ত কম। যদিও এর পরিমাণ অতীত দিনের তুলনায় অনেক বেশি তবু দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির দরুন এ বেতন তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। সে ক্ষেত্রে যদি আবার তারা সময় মতো বেতন না পান তাহলে তাদের যে মুমূর্ষ অবস্থায় খাবি খেতে হয় তা অনুমান সাপেক্ষ। আমরা সরকারের প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ তাদের নিয়ন্ত্রণে বার করুন যেমন স্বাগত জানিয়ে ছিলাম তেমনি এই বিভাগে বিরাজিত বিভিন্ন প্রতিকুলতার দূরীকরণের জন্য আজ আমরা সরকারকে অনুরোধ জানাবো। প্রদীপের নিচে অন্ধকার থাকাটা কিন্তু সুষ্ঠু অগ্রগতির সহায়ক নয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!