স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ভারত সরকারকে মােশতাক গ্রুপের কর্মকাণ্ডের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা এবং প্রতিনিয়ত এতসম্পর্কিত রিপাের্ট দেয়ার জন্য অনুরােধ জানালেন। অচিরেই প্রাপ্ত রিপাের্টে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া সম্ভব হলাে। এতে দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগের জনাকয়েক নেতা ছাড়াও উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী এবং জনৈক সামরিক কর্মকর্তা পর্যন্ত জড়িত রয়েছেন। উপরন্তু মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা এবং ভারতের একটা দক্ষিণপন্থী গােষ্ঠী এতে মদদ দান করছে। তবে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য যে, ভারতে এবং বিদেশে সব মহলের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করছেন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র সচিব চাষী মাহবুব আলম এ সময় জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘বি’ করার জন্য বাংলাদেশের পক্ষে ১৭ সদস্যের একটা উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের নিউইয়র্ক যাওয়ার ব্যবস্থা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। নেতৃত্বে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ। বিদেশ ভ্রমণের লক্ষ্যে আলােচ্য প্রতিনিধি দলের সদস্যদের জন্য ভারতীয় পাসপাের্টের ব্যবস্থা পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়েছে। ঠিক এমনি এক সময়ে গােয়েন্দা রিপাের্টে জানা গেল যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ তার অতীব বিশ্বাসভাজন জনাকয়েককে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে মুজিবনগরে প্রত্যাবর্তনকালে তেহরানে যাত্রাবিরতি করবেন। সম্ভবপর হলে মুজিবনগর থেকে আরও ক’জনা এ সময়ে তেহরানে উপস্থিত হবেন। এই তেহরান নগরীতেই ইরানের শাহেন শাহ’র মধ্যস্থতায় ইসলামাবাদ থেকে আগত উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং যুদ্ধবিরতি ও পাকিস্তান কনফেডারেশন গঠন সম্পর্কিত যৌথ ঘােষণা হবে। কিন্তু বিধিবাম! গােয়েন্দা রিপাের্টের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। প্রতিনিধি দলের নেতা হিসাবে খন্দকার মােশতাক আহমদ এবং দলের অন্যতম সদস্য চাষী মাহবুব আলমের নাম বাদ দেয়া ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী কলমের এক খোচায় পররাষ্ট্র সচিব চাষী মাহবুবকে মুজিবনগর সরকারের চাকরি থেকে বরখাস্ত করে ‘ডিফেক্ট’ করা রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহকে নতুন পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে নিয়ােগ করলেন। এর পাশাপাশি প্রতিনিধি দলের নতুন নেতা হিসাবে লন্ডনে অবস্থানরত বিচারপতি আবু সাঈদকে দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ দিলেন।
তেহরানে গােপন বৈঠক আর অনুষ্ঠিত হলাে না। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের কর্মতৎপরতায় আপাতত মােশতাক ষড়যন্ত্রকে পাশ কাটানাে সম্ভব হলাে। আর এরই প্রেক্ষাপটে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭১ সলের ২৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর মন্ত্রিসভায় রদবদল করলেন এবং খন্দকার মােশতাককে পররাষ্ট্র থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দিলেন। এজন্য বারবার আমি একটা কথাই উচ্চারণ করেছি যে, মুজিবনগরের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ ও ইতিহাস অজানা থাকলে কোন গবেষক কিংবা রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিত্বের পক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা অনুধাবন করা খুবই দুষ্কর। আসলে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে মুজিবনগর রাজনীতির প্রতিচ্ছবি দারুণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে একটা বিষয় সুস্পষ্ট যে, স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে যে ৭টি উপদল ও গােষ্ঠী মূলত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কর্মতৎপরতার দরুন নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যর্থ হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশে তারা সবাই তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে চলে গেল। এদের সঙ্গে যুক্ত হলাে উঠতি বাঙালী শিল্পপতি, ক্ষমাপ্রাপ্ত অফিসার মহল আর এক শ্রেণীর সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের মালিক গােষ্ঠী। প্রথম পর্যায়ে এদের উদ্দেশ্য ছিল যেভাবেই হােক না কেন বঙ্গবন্ধু আর তাজউদ্দিনের মধ্যে ফারাক সৃষ্টি করতে হবে।
তাজউদ্দিন আহমদ তখন প্রায় নিঃসঙ্গ ও একাকী, তার হৃদয় অভিমানে ভরপুর। একমাত্র এ্যাটর্নি জেনারেল ফকির শাহাবুদ্দিন। (মরহুম) ছাড়া আর কোন সুহৃদ বন্ধু পর্যন্ত নেই। মনে পড়ে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবেমাত্র দেশে ফিরে এসেছেন। বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান, আজ থেকে বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। তাজউদ্দিন আহমদ এ অনুষ্ঠানে সপরিবারে এসেছেন। তিনি সবার সঙ্গে প্রাণখােলা হাসি দিয়ে কথা বলছেন। আমরা অবাক হয়ে তাকে লক্ষ্য করছি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর তিনি সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানালেন । তিনি এ মর্মে বললেন, “আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। নেতার নির্দেশে আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছি। আবার মৃত্যুর গুহা থেকে ফিরে আসার পর নেতার হাতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার উঠিয়ে দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। অন্তত ইতিহাসের পাতার এক কোনায় বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হিসাবে আমার নামের উল্লেখ থাকবে।” মাত্র দু’বছর দশ মাসের ব্যবধানে বিশেষ বিশেষ মহলের কারসাজিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর তার ছায়াসঙ্গী তাজউদ্দিন এই দুই অভিন্ন হৃদয়ের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের সূচনা হলাে।
সৃষ্টি হলাে মতনৈক্য। অটোয়া, ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক সফর শেষ করে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর এবং বাংলাদেশে মার্কিনী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের আগমনের প্রাক্কালে মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দিনের বিদায় কি একটা ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করছে? মনের গহনে বিরাট একটা খটকা লেগে রইলাে। শুধু মনে হলাে বঙ্গবন্ধুর কোমর থেকে কারা যেন শাণিত তরবারিটা সরিয়ে নিল। শুধু পড়ে রইল শূন্য খাপ । সেদিনের তারিখটা ছিল ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর দুপুরে নতুন গণভবনে প্রেসিডেন্টের সাংবাদিক সম্মেলন। ইতােমধ্যে অনেকেই এসে গেছেন। প্রেসিডেন্টের অফিস কক্ষে বঙ্গবন্ধু স্বীয় চেয়ারে উপবিষ্ট। এমন সময় গােয়েন্দা বিভাগের প্রধান এগিয়ে এলেন নিচু স্বরে জানালেন, অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ অর্থ মন্ত্রণালয়ে নিজের অফিসেই রয়েছেন। কিন্তু পদত্যাগপত্রে দস্তখত করেননি। এখনও গড়িমসি করছেন। বঙ্গবন্ধু রাগত কণ্ঠে বলে উঠলেন, তাজউদ্দিন যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করে আমি। তাকে বরখাস্ত করবাে কথা ক’টা বলেই তাকিয়ে দেখেন, সামনেই ক্যাবিনেট সেক্রেটারি দাড়িয়ে। জিজ্ঞাসা করলেন, তােমার হাতে কিসের ফাইল জবাব এলাে, স্যার আমি উনার কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগপত্রে দস্তখত করে দিয়েছেন। সেটা দেখাবার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। গােয়েন্দা প্রধান সরে গেলেন একেবারে দেয়ালের ধারে।
অল্পক্ষণ পরেই প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করলেন তার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের পদত্যাগের কথা । মুজিবনগরের সেই ৭টি উপদল ও রাজনৈতিক গােষ্ঠী ছাড়াও এক শ্রেণীর উঠতি বাঙালী শিল্পপতি, ক্ষমাপ্রাপ্ত অফিসার গােষ্ঠী, উগ্র বাম ও দক্ষিণপন্থী সাংবাদিক আর ঘাপটি মেরে থাকা পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয় মৌলবাদী সম্প্রদায়, সবারই হৃদয়ে তখন অনাবিল প্রশান্তি। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একাকী করা সম্ভব হয়েছে। মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দিনের বিদায় বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলাে। পরবর্তী অধ্যায়ে শুরু হলাে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ইতিহাসের জঘন্যতম ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটা আশঙ্কা ছিল যে, মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের পর তাজউদ্দিন আহমদ হয়তাে বা বিরােধী দলীয় রাজনীতিতে যােগ দেবেন। ফলে তিনি গােপনে দূত পাঠিয়েছিলেন তাজউদ্দিনের কাছে। অনুরােধ ছিল যাতে তাজউদ্দিন কোন বামপন্থী দল কিংবা নবগঠিত দল ‘জাসদ’-এ যােগ না দেন। তাজউদ্দিন কথা দিয়েছিলেন, তিনি কোন বিরােধী দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়াবেন না। বঙ্গবন্ধুর স্থির বিশ্বাস ছিল যে, তাঁরই ভাবশিষ্য তাজউদ্দিন একবার কথা দিলে তার বরখেলাপ করবে না।
তাজউদ্দিন আহমদের কন্যা সিমিন হােসেন রিমি পিতার স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে যথার্থই লিখেছেন যে, “আব্বুকে প্রায় বলতে শুনতাম, কোন বড় কাজ নাকি একটা মানুষ তার জীবনে একবারই করতে পারে- আব্বুর জন্য তেমনি বড় কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের হাল ধরা। আব্বু তার কাজে সফল হয়েছেন। তাই এখন যদি মৃত্যুও আসে আব্দুর তাতে কোন আক্ষেপ নেই। ‘৭১-এর বিজয়ের পর আব্বুর জন্য বেঁচে থাকাটাই নাকি বাড়তি পাওনা।”
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার সচিবালয়ে একদিন কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এক ভয়াবহ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন। তিনি বলেছিলেন, “বুঝেছে, আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দান করেছি, তাদের জন্য হচ্ছে উভয় সঙ্কট। যুদ্ধে পরাজিত হলে আমাদের জন্য অবধারিত ছিল হয় পলাতকের জীবন আর না হয় ফায়ারিং স্কোয়াড। অন্যদিকে বিজয়ী হলে প্রতিবিপ্লবীদের হাতে খুন। তাই মরতে আমাদের হবেই- এ থেকে রেহাই নেই।” তার এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দিনের পদত্যাগের মাত্র ১০ মাসের ব্যবধানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। আবার তাজউদ্দিনের কন্যা সিমির স্মৃতিচারণ থেকে উল্লেখ করতে হচ্ছে। আব্বু রেডিও ছাড়তেই মর্মান্তিক হৃদয় বিদারক সংবাদে আমরা শিউরে উঠলাম। রেডিও থেকে যখন খন্দকার মােশতাকের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের সংবাদ প্রচারিত হলাে, তখন আব্বু বেদনাঝরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, “মুজিব ভাই জেনেও গেলেন না কে তার বন্ধু ছিল, আর কে শত্রু।” এজন্য এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় যে, তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাণিত তরবারি। এর পরের ইতিহাস একই ধরনের মর্মান্তিক ও শিহরণমূলক ১৫ আগস্ট থেকেই তাজউদ্দিন আহমদ গৃহবন্দী হয়ে রইলেন। ২২ আগস্ট তাকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলাে। মিসেস তাজউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, “কি মনে হয়, ছাড়বে টাড়বে তাে?” জবাবে তাজউদ্দিন বলেছিলেন, “মনে কর চিরজীবনের জন্য যাচ্ছি।” আবার তার ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র ৮১ দিনের ব্যবধানে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ভাের রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে স্বঘােষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাক আহমদের নির্দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধের ৪ জন জাতীয় নেতা যথাক্রমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান নৃশংসভাবে খুন হয়ে গেলেন।