You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুজিবনগরের ষড়যন্ত্র : বাংলাদেশে প্রতিচ্ছবি
আঙ্গুলে গুনলে ঠিক ৫১ বছর। ১৯৪৬ সালে আমি যখন দিনাজপুর রিপন কলেজের (শাখা) ছাত্র, তখন কলকাতায় কারমাইকেল হােস্টেলে তুখােড় ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। এই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন দিনাজপুরের ছাত্রনেতা মরহুম দবিরুল ইসলাম। আমরা ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ রাজনীতিতে ছিলাম নুরুদ্দীন-মুজিবের অনুসারী। সেই হিসাবে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদরি কট্টর সমর্থক। আমাদের বলা হতাে ‘হাশেমাইট’। সেই সুবাদে পাকিস্তান হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে মুজিব ভাই যখন ঢাকার ১৫০ মােগলটুলীতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করলেন, তখন আমি এই ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলাম। সেই থেকে কখনও ছাত্র হিসাবে, কখনও সাংবাদিক (১৯৫১-১৯৭১ সাল) হিসাবে, আবার স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারী কর্মচারী হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অন্তরঙ্গ আলােকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। পাকিস্তান আমলে সাংবাদিক হিসাবে পেশাগত কারণে বরাবরই মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করেছি। সামরিক ডিক্টেটর আইয়ুব খানের রাজত্বেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এ সময় মুজিব ভাই কারাগারের বাইরে থাকলে আমরা সংবাদ সংগ্রহের জন্য তারই কাছে ধরনা দিতাম। অথচ পার্টির রাশভারি মেজাজের জেনারেল সেক্রেটারি তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে খুব একটা যােগাযােগ করতাম না। অথচ তাজউদ্দিন ছিলেন মুজিব ভাইয়ের ছায়াসঙ্গী। প্রসঙ্গত একটা বিষয়ের উল্লেখ সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানী জামানায় পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশ দশকের রাজনীতিতে যেমন মধ্যমণি ছিল ‘ভাসানী-মুজিব জুটি’, তেমনি ষাট দশকে বিরােধীদলীয় রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি ছিল ‘মুজিব-তাজউদ্দিন জুটি’। প্রথম জুটির পরিসমাপ্তি হয় ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে বামপন্থীদের কর্মকাণ্ডে। আর দ্বিতীয় জুটির ভাঙ্গন হলাে মুজিবনগরের রাজনীতির প্রতিক্রিয়া এবং মার্কিনী কারসাজিতে। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগে বাধ্য হলেন। ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর। 
 

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় প্রথমবারের মতাে ইস্পাতকঠিন চরিত্রের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সংস্পর্শে যাওয়ার সুযােগ আমার হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন স্বকণ্ঠে ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠান প্রচার করা ছাড়াও আমার একটা সার্বক্ষণিক চাকরি ছিল। আমি ছিলাম মুজিবনগর সরকারের প্রচার অধিকর্তা ফলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কর্মতৎপরতা আমি প্রতিনিয়তই কাছে থেকে দেখেছি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ মাঝে মাঝে ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানের প্রশংসা করা ছাড়াও আমাকে ব্রিফিং পর্যন্ত দিতেন সত্যি কথা বলতে কি, এ ধরনের এক ব্রিফিংয়ের জের হিসাবেই আমি ডঃ কামাল হােসেন সম্পর্কে ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানে বিরূপ মন্তব্য করেছিলাম। এক্ষণে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকার কর্তৃক বাঙালী সশস্ত্রবাহিনীকে সুশৃঙ্খল করা, বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনা, মুক্তিযােদ্ধাদের রিক্রুটমেন্ট ও ট্রেনিং দান, এক কোটি বাঙালী শরণার্থীর খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা, দেশ-বিদেশে প্রচার ও প্রােপাগালাণ্ডা এবং কূটনৈতিক লড়াই, ভারত সরকারের সঙ্গে বােঝাপড়া, অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ এবং যুদ্ধের নীতি নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়গুলাে যেভাবে কার্যকর করা হয়েছে, অত্র নিবন্ধে তার উল্লেখ না করে, শুধুমাত্র মুজিবনগরের রাজনীতি ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলােকপাত অপরিহার্য মনে হয়। সে ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত এবং ভয়ঙ্কর দিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে কিছুটা মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে।  হিসাব করলে দেখা যায় যে, এ সময় প্রবাসী সরকারের উপর কয়েকটি রাজনৈতিক গােষ্ঠীর চাপ সৃষ্টি ছাড়াও সরকারের ভিতর ও বাইরে থেকে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র পর্যন্ত হয়েছিল। এগুলাে নিম্নরূপ:

প্রথমত তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক ‘ওয়ার কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাব।

 
এই প্রস্তাব মেনে নেয়ার অর্থই ছিল নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মনােনীত মুজিবনগর সরকারের সর্বময় কর্তৃত্বের অবসান এবং সামরিক কর্তৃত্বের অভ্যুদয় ও স্বীকৃতি। সৌভাগ্যক্রমে তৎকালীন মেজর এবং দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মােশাররফ এই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনে অস্বীকার করেন। ফলে এ ধরনের উদ্যোগকে পাশ কাটানাে সম্ভব হয়। দ্বিতীয়ত স্বাধীনতাযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টি, মস্কোপন্থী ন্যাপ, পূর্ববঙ্গ কংগ্রেস এবং তফসিলী ফেডারেশন কর্তৃক “সর্বদলীয় সরকার” গঠনের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ওপর মারাত্মক চাপের সৃষ্টি।
এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আলােচ্য পার্টিগুলাের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং একমাত্র সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (পূর্ববঙ্গ পরিষদ) ছাড়া আর সবাই পরাজিত হয়েছিলেন। ফলে পরাজিত প্রার্থীদের মাঝ থেকে কোন নেতাকে মুজিবনগর মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তির অর্থই হতাে সুস্পষ্টভাবে গণতন্ত্র-বিরােধী কর্মকাণ্ড। নীতির প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বামপন্থীদের এ ধরনের চাপের মােকাবিলায় নতিস্বীকার করেননি। বরং আলােচ্য প্রস্তাবের তীব্র বিরােধিতা করেছেন। অবশ্য এ সময় মওলানা ভাসানী এগিয়ে এসেছিলেন তাজউদ্দিন আহমদের সমর্থনে। মওলানা সাহেবের উদ্যোগে আলােচ্য পার্টিগুলাের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল “সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি’। তৃতীয়ত পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, ১৯৭০ সালে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে যারা পূর্ববঙ্গ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তাঁদের প্রায় সবাই সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন; এঁরা সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয়  এঁদের পক্ষ থেকে এ মর্মে দাবি করা হলাে যে, মুজিবনগর মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করে এঁদের মাঝ থেকে জনাকয়েক মন্ত্রী নিতে হবে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে প্রথম দফায় নেতৃত্বে এলেন জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং দ্বিতীয় দফায় মরহুম আব্দুর রব সেরনিয়াবত। কিন্তু তাজউদ্দিন সাহেবের কথা একটাই এবং তা’হচ্ছে PANDORA BOX- এর ঢাকনা কিছুতেই খোলা সম্ভব নয়। অর্থাৎ মন্ত্রিসভা আর সম্প্রসারিত করা হবে না। ফলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে অক্টোবর মাসে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এবং পার্লামেন্টারি পার্টির তলবী বৈঠক আহ্বান করা হলাে।
 
উভয় পক্ষে জোর লবি করা হলাে। শেষ পর্যন্ত বিশেষ করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক সৈয়দ নজরুলের জোরালাে বক্তব্যের পর অধিকাংশ সদস্যের দাবি মােতাবেক আলােচ্য অনাস্থা প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হয়। চতুর্থত মুজিবনগর সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে মুক্তিবাহিনী দ্রুত সম্প্রসারিত হওয়া সত্ত্বেও ভারত সরকারের একটা বিশেষ লবি’র সক্রিয় সহযােগিতায় চারজন যুবনেতার যৌথ উদ্যোগে পৃথকভাবে ‘মুজিববাহিনী’ গঠন। এখানে লক্ষণীয় যে, ভারত সরকার কোন সময়েই মুক্তিবাহিনীর অতিরিক্ত ‘মুজিববাহিনী’ গঠন সম্পর্কে প্রবাসী সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করেনি। এ সম্পর্কে কুষ্টিয়া থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় তত্ত্বালীন এমএনএ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। “ভারতের দুটি স্থানে মুজিববাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। জেনারেল ওভান এই প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। আজ পর্যন্ত আমি বুঝে উঠতে পারছি না মুজিববাহিনী নামে এই আলাদা বাহিনীর কোন প্রয়ােজন ছিল কিনা। (ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে) বুঝানাে হয়, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সে সময় নেতৃত্ব দিতে অসমর্থ হবে।  প্রয়ােজনে এই নেতৃত্ব (মুজিববাহিনী) আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসাবে কাজ করতে পারবে। পরে আরও জেনেছি ভারত সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়, যার অর্থ হলাে ‘এক বাক্সে সব ডিম না রাখা’। তা’হলে দেখা যাচ্ছে যে, ‘মুজিববাহিনী’র সৃষ্টিই ছিল বিতর্কিত। শুধু তাই-ই নয়, স্বাধীনতার পর মুজিববাহিনীর ক্যাডারদের অধিকাংশই কিন্তু শেখ মণি ও তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বের বাইরে চলে যায় এবং আওয়ামী লীগ বিরােধী নবগঠিত ‘জাসদ’এর সদস্যভুক্ত হয়। মহল বিশেষের মতে জন্মাবধি জাসদ-এর রাজনীতি ছিল “রহস্যময়”। এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের মাটিতে বহু রক্তপাত ঘটেছে এবং আমরা  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও চার জাতীয় নেতা থেকে শুরু করে স্বাধীনতাযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারিয়েছি। 
 
আমরা যেমন বারংবার এই প্রশ্নটাই উত্থাপন করবাে যে, ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর ব্যর্থ কু’র জের হিসাবে আত্মসমর্পণ করার পরও কর্নেল তাহেরের ইঙ্গিতে কোনরকম বিচার ছাড়াই মুক্তিযােদ্ধা খালেদ মােশাররফ-হুদা-হায়দারকে কেন নৃশংসভাবে হত্যা করা হলাে; আমরা তেমনি জেনারেল জিয়ার কথিত নির্দেশে ঢাকার কারাগারে গােপনে অনুষ্ঠিত প্রহসনমূলক বিচারে জাসদ নেতা মুক্তিযােদ্ধা কর্নেল তাহেরের ফাসির বিরুদ্ধেও দ্বিধাহীনচিত্তে প্রতিবাদ জানাব। এজন্যই প্রথমে ‘মুজিববাহিনী’র জন্ম এবং স্বধীনতার পর রাজনৈতিক দল হিসাবে ‘জাসদ’-এর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে গবেষণা হওয়া অপরিহার্য মনে হয়। অন্যথায় ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তবে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অজান্তে ভারত সরকারের পৃষ্ঠপােষকতায় ; ‘মুজিববাহিনী’ গঠিত হওয়ায় এ মর্মে প্রশ্ন উত্থাপন হওয়া স্বাভাবিক। যে, তাহলে কি ভারত সরকার পুরােপুরিভাবে মুজিবনগর সরকারের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনি? তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ব্যক্তিত্ব, স্বকীয়তা এবং কর্মদক্ষতায় ভারত সরকার বেশ কিছুটা “বিব্রত” হয়ে উঠেছিল? পঞ্চমত উত্তরবঙ্গ এলাকা থেকে নির্বাচিত কিছুসংখ্যক পরিষদ সদস্য এ সময় আঞ্চলিকতার ধুয়া উত্থাপন করেন। এঁদের বক্তব্য ছিল যে, মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী এই দু’টি পদের মধ্যে অন্ততপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পদটি উত্তরবঙ্গের কোটায় নির্ধারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই দাবির ভিত্তিতে এঁরা গুটিকয়েক বৈঠকেও মিলিত হয়েছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে এই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। প্রকাশ, এই গ্রুপের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের চীনাপন্থী কমিউনিস্টদের একটা যােগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী হিসাবে এঁরা রাজশাহীর কামরুজ্জামানের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু স্বয়ং কামরুজ্জামান এ ব্যাপারে দৃঢ়তার সঙ্গে অনীহা প্রকাশ করলে এই গ্রুপের উদ্যোক্তারা নেতিয়ে পড়েন।
 
ষষ্ঠত স্বাধীনতাযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মুজিবনগরে অবস্থানরত ১৪টি চীন সমর্থক কমিউনিস্ট পাটি একটা সমন্বয় কমিটি গঠন করে। মওলানা ভাসানীর অস্বীকৃতির দরুন দিনাজপুরের কমরেড বরদা চক্রবর্তী সমন্বয় কমিটির নেতা নির্বাচিত হন। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরু থেকেই কমিউনিস্ট চীন হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর প্রতি সক্রিয় সমর্থন দেয়ায় মওলানা সাহেব দারুণভাবে ক্ষিপ্ত হন এবং বাংলাদেশের চীনপন্থী পার্টিগুলাের সঙ্গে পুরােপুরিভাবে সম্পর্কোচ্ছেদ ও মুজিবনগর সরকারের ‘গার্জিয়ান’-এর ভূমিকা গ্রহণ করেন । ঠিক এমনি এক সময়ে কমরেড বরদা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে আলােচ্য কমিউনিস্ট সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি দল মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটি স্মারকলিপি দাখিল করে। দাবিগুলাের মধ্যে অন্যতম ছিল, স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দিতে হবে এবং চীনপন্থী কমিউনিস্ট ক্যাডারদের মস্কোপন্থীদের অনুরূপ ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা এবং অস্ত্র দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ চমৎকার জবাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, কোন দল বা গােষ্ঠীর স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কোনরকম অনুমতির প্রয়ােজন হয় না। কাদেরিয়া বাহিনী, হালিম বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, আফসার বাহিনীসহ যেসব বাহিনী এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী  হানাদার সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তারা কোন অনুমতির তােয়াক্কা করেনি। তাই যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে আপনাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। তিনি আরও বললেন, এর পরেই হচ্ছে ট্রেনিং ও অস্ত্র প্রদানের প্রশ্ন। দেখুন কমরেডরা, মার্কসিজম সম্পর্কে আমরাও কিছু কিছু পড়াশােনা করেছি। এতে স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে যে, শত্রুর অস্ত্রই হচ্ছে মার্কসিস্ট গেরিলাদের অস্ত্র। সাচ্চা কমিউনিস্ট গেরিলারা শত্রুর অস্ত্র দখল করে মুক্তিযুদ্ধ করে থাকে। কিন্তু এখন দেখছি, দুনিয়ার ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতাে চীনপন্থী মার্কসিস্টরা অস্ত্রের জন্য মুজিবনগরের পেটিবুর্জোয়া সরকারের কাছে দরখাস্ত করেছে। এটা কেমন করে সম্ভব? আমি পেটিবুর্জোয়া আওয়ামী লীগ সরকারের এমন “আহাম্মক প্রধানমন্ত্রী” নই যে, আপনাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেব; আপনারা কিছুদিন পরে সেই অস্ত্র আমাদেরই বুকে চেপে ধরবেন। কেমন ঠিক কিনা! সত্যি কথা বলতে কি, আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে, আমাদের অস্ত্র কোথা থেকে সরবরাহ হচ্ছে সেক্ষেত্রে যেসব শর্ত রয়েছে তার এক নম্বরই হচ্ছে এসব অস্ত্র যেন আপনাদের হাতে না যায়। কেননা আপনাদের মাধ্যমে এসব অস্ত্র দিব্বি পশ্চিমবাংলা ও বিহারের নকশালদের হাতে চলে যাবে। আপনাদের মতবাদ সম্পর্কে আমি ওয়াকিফহাল রয়েছি। কেননা বাংলাদেশের যুদ্ধ সম্পর্কে আপনাদের থিসিসগুলাে ইতােমধ্যেই আমি পড়ে দেখেছি। শেষ অবধি তাজউদ্দিন আহমদ চীনপন্থী কমিউনিস্ট সমন্বয় কমিটিকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হলেন।
সবশেষে মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরে মােশতাক গ্রুপের ষড়যন্ত্র। মার্কিনী যােগসাজশে এই ষড়যন্ত্রের মােদ্দা কথাটা ছিল এই যে, পাকিস্তানকে ভাঙতে দেয়া হবে না। পাকিস্তানী পতাকা মেনে নিয়ে পূর্ববঙ্গের অবস্থান হবে একটা কনফেডারেশনের আওতায়। সেক্ষেত্রে একদিকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্তি দেবে এবং অন্যদিকে প্রবাসী সরকার স্বাধীনতার লড়াই বন্ধ ঘােষণা করবে। এটাই ছিল স্বাধীনতার প্রশ্নে “মােশতাক ফর্মুলা’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মােশতাক আহমদ এ সময় ব্যারিস্টার আমিরুলইসলাম এমএনএ’কে সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, “YOU MUST DECIDE. WHETHER YOU WANT SHEIKH MUJIB OR INDEPENDENCE. YOU CAN’T HAVE BOTH.” জবাবে ব্যারিস্টার ইসলাম বলেছিলেন, “WE WANT BOTH, SHEIKH WITHOUT INDEP-ENDENCE OR INDEPENDENCE WITHOUT SHEIKH, BOTH ARE INCOMPLETE. (স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র ও ১৫তম খণ্ড) এ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য রয়েছে পাশ্চাত্যের সাংবাদিক লুই লিফসুজ-এর AN UNFINISHED REVOLUTION গ্রন্থে।
স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ভারত সরকারকে মােশতাক গ্রুপের কর্মকাণ্ডের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা এবং প্রতিনিয়ত এতসম্পর্কিত রিপাের্ট দেয়ার জন্য অনুরােধ জানালেন। অচিরেই প্রাপ্ত রিপাের্টে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া সম্ভব হলাে। এতে দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগের জনাকয়েক নেতা ছাড়াও উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী এবং জনৈক সামরিক কর্মকর্তা পর্যন্ত জড়িত রয়েছেন। উপরন্তু মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা এবং ভারতের একটা দক্ষিণপন্থী গােষ্ঠী এতে মদদ দান করছে। তবে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য যে, ভারতে এবং বিদেশে সব মহলের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করছেন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র সচিব চাষী মাহবুব আলম এ সময় জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘বি’ করার জন্য বাংলাদেশের পক্ষে ১৭ সদস্যের একটা উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের নিউইয়র্ক যাওয়ার ব্যবস্থা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। নেতৃত্বে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ। বিদেশ ভ্রমণের লক্ষ্যে আলােচ্য প্রতিনিধি দলের সদস্যদের জন্য ভারতীয় পাসপাের্টের ব্যবস্থা পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়েছে। ঠিক এমনি এক সময়ে গােয়েন্দা রিপাের্টে জানা গেল যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ তার অতীব বিশ্বাসভাজন জনাকয়েককে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে মুজিবনগরে প্রত্যাবর্তনকালে তেহরানে যাত্রাবিরতি করবেন। সম্ভবপর হলে মুজিবনগর থেকে আরও ক’জনা এ সময়ে তেহরানে উপস্থিত হবেন। এই তেহরান নগরীতেই ইরানের শাহেন শাহ’র মধ্যস্থতায় ইসলামাবাদ থেকে আগত উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং যুদ্ধবিরতি ও পাকিস্তান কনফেডারেশন গঠন সম্পর্কিত যৌথ ঘােষণা হবে।  কিন্তু বিধিবাম! গােয়েন্দা রিপাের্টের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। প্রতিনিধি দলের নেতা হিসাবে খন্দকার মােশতাক আহমদ এবং দলের অন্যতম সদস্য চাষী মাহবুব আলমের নাম বাদ দেয়া ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী কলমের এক খোচায় পররাষ্ট্র সচিব চাষী মাহবুবকে মুজিবনগর সরকারের চাকরি থেকে বরখাস্ত করে ‘ডিফেক্ট’ করা রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহকে নতুন পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে নিয়ােগ করলেন। এর পাশাপাশি প্রতিনিধি দলের নতুন নেতা হিসাবে লন্ডনে অবস্থানরত বিচারপতি আবু সাঈদকে দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ দিলেন।
তেহরানে গােপন বৈঠক আর অনুষ্ঠিত হলাে না। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের কর্মতৎপরতায় আপাতত মােশতাক ষড়যন্ত্রকে পাশ কাটানাে সম্ভব হলাে। আর এরই প্রেক্ষাপটে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭১ সলের ২৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর মন্ত্রিসভায় রদবদল করলেন এবং খন্দকার মােশতাককে পররাষ্ট্র থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দিলেন। এজন্য বারবার আমি একটা কথাই উচ্চারণ করেছি যে, মুজিবনগরের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ ও ইতিহাস অজানা থাকলে কোন গবেষক কিংবা রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিত্বের পক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা অনুধাবন করা খুবই দুষ্কর। আসলে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে মুজিবনগর রাজনীতির প্রতিচ্ছবি দারুণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে একটা বিষয় সুস্পষ্ট যে, স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে যে ৭টি উপদল ও গােষ্ঠী মূলত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কর্মতৎপরতার দরুন নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যর্থ হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশে তারা সবাই তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে চলে গেল। এদের সঙ্গে যুক্ত হলাে উঠতি বাঙালী শিল্পপতি, ক্ষমাপ্রাপ্ত অফিসার মহল আর এক শ্রেণীর সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের মালিক গােষ্ঠী। প্রথম পর্যায়ে এদের উদ্দেশ্য ছিল যেভাবেই হােক না কেন বঙ্গবন্ধু আর তাজউদ্দিনের মধ্যে ফারাক সৃষ্টি করতে হবে।
তাজউদ্দিন আহমদ তখন প্রায় নিঃসঙ্গ ও একাকী, তার হৃদয় অভিমানে ভরপুর। একমাত্র এ্যাটর্নি জেনারেল ফকির শাহাবুদ্দিন। (মরহুম) ছাড়া আর কোন সুহৃদ বন্ধু পর্যন্ত নেই। মনে পড়ে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবেমাত্র দেশে ফিরে এসেছেন। বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান, আজ থেকে বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। তাজউদ্দিন আহমদ এ অনুষ্ঠানে সপরিবারে এসেছেন। তিনি সবার সঙ্গে প্রাণখােলা হাসি দিয়ে কথা বলছেন। আমরা অবাক হয়ে তাকে লক্ষ্য করছি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর তিনি সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানালেন । তিনি এ মর্মে বললেন, “আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। নেতার নির্দেশে আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছি। আবার মৃত্যুর গুহা থেকে ফিরে আসার পর নেতার হাতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার উঠিয়ে দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। অন্তত ইতিহাসের পাতার এক কোনায় বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হিসাবে আমার নামের উল্লেখ থাকবে।” মাত্র দু’বছর দশ মাসের ব্যবধানে বিশেষ বিশেষ মহলের কারসাজিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর তার ছায়াসঙ্গী তাজউদ্দিন এই দুই অভিন্ন হৃদয়ের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের সূচনা হলাে।
সৃষ্টি হলাে মতনৈক্য। অটোয়া, ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক সফর শেষ করে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর এবং বাংলাদেশে মার্কিনী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের আগমনের প্রাক্কালে মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দিনের বিদায় কি একটা ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করছে? মনের গহনে বিরাট একটা খটকা লেগে রইলাে। শুধু মনে হলাে বঙ্গবন্ধুর কোমর থেকে কারা যেন শাণিত তরবারিটা সরিয়ে নিল। শুধু পড়ে রইল শূন্য খাপ । সেদিনের তারিখটা ছিল ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর দুপুরে নতুন গণভবনে প্রেসিডেন্টের সাংবাদিক সম্মেলন। ইতােমধ্যে অনেকেই এসে গেছেন। প্রেসিডেন্টের অফিস কক্ষে বঙ্গবন্ধু স্বীয় চেয়ারে উপবিষ্ট। এমন সময় গােয়েন্দা বিভাগের প্রধান এগিয়ে এলেন  নিচু স্বরে জানালেন, অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ অর্থ মন্ত্রণালয়ে নিজের অফিসেই রয়েছেন। কিন্তু পদত্যাগপত্রে দস্তখত করেননি। এখনও গড়িমসি করছেন। বঙ্গবন্ধু রাগত কণ্ঠে বলে উঠলেন, তাজউদ্দিন যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করে আমি। তাকে বরখাস্ত করবাে কথা ক’টা বলেই তাকিয়ে দেখেন, সামনেই ক্যাবিনেট সেক্রেটারি দাড়িয়ে। জিজ্ঞাসা করলেন, তােমার হাতে কিসের ফাইল জবাব এলাে, স্যার আমি উনার কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগপত্রে দস্তখত করে দিয়েছেন। সেটা দেখাবার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। গােয়েন্দা প্রধান সরে গেলেন একেবারে দেয়ালের ধারে। 
অল্পক্ষণ পরেই প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করলেন তার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের পদত্যাগের কথা । মুজিবনগরের সেই ৭টি উপদল ও রাজনৈতিক গােষ্ঠী ছাড়াও এক শ্রেণীর উঠতি বাঙালী শিল্পপতি, ক্ষমাপ্রাপ্ত অফিসার গােষ্ঠী, উগ্র বাম ও দক্ষিণপন্থী সাংবাদিক আর ঘাপটি মেরে থাকা পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয় মৌলবাদী সম্প্রদায়, সবারই হৃদয়ে তখন অনাবিল প্রশান্তি। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একাকী করা সম্ভব হয়েছে। মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দিনের বিদায় বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলাে। পরবর্তী অধ্যায়ে শুরু হলাে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ইতিহাসের জঘন্যতম ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটা আশঙ্কা ছিল যে, মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের পর তাজউদ্দিন আহমদ হয়তাে বা বিরােধী দলীয় রাজনীতিতে যােগ দেবেন। ফলে তিনি গােপনে দূত পাঠিয়েছিলেন তাজউদ্দিনের কাছে। অনুরােধ ছিল যাতে তাজউদ্দিন কোন বামপন্থী দল কিংবা নবগঠিত দল ‘জাসদ’-এ যােগ না দেন। তাজউদ্দিন কথা দিয়েছিলেন, তিনি কোন বিরােধী দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়াবেন না। বঙ্গবন্ধুর স্থির বিশ্বাস ছিল যে, তাঁরই ভাবশিষ্য তাজউদ্দিন একবার কথা দিলে তার বরখেলাপ করবে না।
তাজউদ্দিন আহমদের কন্যা সিমিন হােসেন রিমি পিতার স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে যথার্থই লিখেছেন যে, “আব্বুকে প্রায় বলতে শুনতাম, কোন বড় কাজ নাকি একটা মানুষ তার জীবনে একবারই করতে পারে- আব্বুর জন্য তেমনি বড় কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের হাল ধরা। আব্বু তার কাজে সফল হয়েছেন। তাই এখন যদি মৃত্যুও আসে আব্দুর তাতে কোন আক্ষেপ নেই। ‘৭১-এর বিজয়ের পর আব্বুর জন্য বেঁচে থাকাটাই নাকি বাড়তি পাওনা।”
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার সচিবালয়ে একদিন কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এক ভয়াবহ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন। তিনি বলেছিলেন, “বুঝেছে, আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দান করেছি, তাদের জন্য হচ্ছে উভয় সঙ্কট। যুদ্ধে পরাজিত হলে আমাদের জন্য অবধারিত ছিল হয় পলাতকের জীবন আর না হয় ফায়ারিং স্কোয়াড। অন্যদিকে বিজয়ী হলে প্রতিবিপ্লবীদের হাতে খুন। তাই মরতে আমাদের হবেই- এ থেকে রেহাই নেই।” তার এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দিনের পদত্যাগের মাত্র ১০ মাসের ব্যবধানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। আবার তাজউদ্দিনের কন্যা সিমির স্মৃতিচারণ থেকে উল্লেখ করতে হচ্ছে। আব্বু রেডিও ছাড়তেই মর্মান্তিক হৃদয় বিদারক সংবাদে আমরা শিউরে উঠলাম। রেডিও থেকে যখন খন্দকার মােশতাকের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের সংবাদ প্রচারিত হলাে, তখন আব্বু বেদনাঝরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, “মুজিব ভাই জেনেও গেলেন না কে তার বন্ধু ছিল, আর কে শত্রু।” এজন্য এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় যে, তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাণিত তরবারি। এর পরের ইতিহাস একই ধরনের মর্মান্তিক ও শিহরণমূলক ১৫ আগস্ট থেকেই তাজউদ্দিন আহমদ গৃহবন্দী হয়ে রইলেন। ২২ আগস্ট তাকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলাে। মিসেস তাজউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, “কি মনে হয়, ছাড়বে টাড়বে তাে?” জবাবে তাজউদ্দিন বলেছিলেন, “মনে কর চিরজীবনের জন্য যাচ্ছি।” আবার তার ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র ৮১ দিনের ব্যবধানে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ভাের রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে স্বঘােষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাক আহমদের নির্দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধের ৪ জন জাতীয় নেতা যথাক্রমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান নৃশংসভাবে খুন হয়ে গেলেন।

সূত্রঃ   একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল

 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!