You dont have javascript enabled! Please enable it!
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান
বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আমাদের প্রথম অধিবেশন শুরু করছি। অনুষ্ঠানপ্রচারিত হচ্ছে মিডিয়াম ওয়েভ ৩৬১.৪৪ মিটার ব্যান্ডে প্রতি সেকেন্ডে ৮৩০ কিলাে সাইকেলে। অধিবেশনের প্রথমেই শুনুন তেলাওয়াতে কালামে পাক ও তার বাংলা তর্জমা। প্রথম দিনের অনুষ্ঠানসূচী ছিলাে নিম্নরূপঃ ০৬৫৯ ঃ সূচক বাণী ও উদ্বোধনী ঘােষণা : আশফাকুর রহমান খান ০৭০০ পবিত্র কোরান তেলাওয়াত ও মােহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী। ০৭১০ঃ অনুষ্ঠান সম্পর্কিত ঘােষণা : আশফাকুর রহমান খান। ০৭১৫ঃ বাংলা খবর (গ্রন্থনা কামাল লােহানী) ঃ সৈয়দ হাসান ইমাম ০৭২৫ ঃ ইংরেজী খবর (গ্রন্থনা আলী যাকের) ঃ মিসেস টি হােসেন। ০৭৩৫ঃ ‘চরমপত্র’, রচনা ও পাঠ ঃ এম আর আখতার মুকুল ০৭৪৫ঃ বঙ্গবন্ধুর বাণী থেকে পাঠ ও আশফাকুর রহমান খান। ০৭৫০ঃ জাগরণী দেশাত্মবােধক গান ও পরিচালনা, তাহের সুলতান ও শিকদার রাতে একই অনুষ্ঠান পুনপ্রচার করা হতাে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধনী দিন ১৯৭১ সালের ২৫ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানী দখলদার সৈন্যদের আত্মসমর্পণের দিন পর্যন্ত রােজ এই চরমপত্র’ অনুষ্ঠান প্রচার করেছি। সেদিন এই অনুষ্ঠান মুক্তিযােদ্ধা ও রাজনীতিবিদ ছাড়াও লাখ লাখ শরণার্থী আর শত্রু অধিকৃত এলাকার আপামর জনগােষ্ঠীর মনােবল দারুণভাবে বৃদ্ধি করেছিল; তা বলাই বাহুল্য। রাজনৈতিক মহলের মতে, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলাের মধ্যে মূল আকর্ষণই ছিল ‘চরমপত্র’। এই একটি মাত্র অনুষ্ঠানের মােকাবিলায় তকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ৬টি বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত সমস্ত প্রােপাগাণ্ডা ম্লান হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল জল্লাদের দরবার’ ধারাবাহিক নাটক এবং বাংলা ও ইংরেজী সংবাদ।  গুরুজনদের কাছে শুনেছি, অত্যাচার চিরকালই মানুষের সুপ্ত শক্তি ও প্রতিভার বহিপ্রকাশ ঘটায়। সম্ভবত আমার ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছিল। তা না হলে দীর্ঘ পৌনে ৭ মাস ধরে প্রতিদিন ভাের রাত চারটায় ঘুম থেকে উঠে নিত্যনতুন তথ্য সংবলিত। ঢাকাইয়া ভাষায় ‘চরমপত্রের স্ক্রীপ্ট লেখা এবং সকাল ১০টার মধ্যে তা রেকর্ডিং করা কেমন করে সম্ভব হয়েছিল?
 
অথচ প্রতিটি ‘চরমপত্র’ রচনা ও কণ্ঠদানের জন্য আমার পারিশ্রমিক ধার্য হয়েছিল ভারতীয় মুদ্রায় মাত্র ৭ টাকা ২৫ পয়সা। অর্থাৎ মাসিক ৩০টি স্ক্রীণ্টের জন্য ২২৫ টাকা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অভ্যন্তরের একটা মহল থেকে এই পারিশ্রমিকের ব্যাপারেও আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছিল। চেষ্টা হয়েছিল পারিশ্রমিকের টাকা আরও কমাবার। এদের হিসাব ছিল ভিন্ন রকমের। টাকার অঙ্ক আরও হ্রাস পেলে ‘চরমপত্র’ প্রচার বন্ধ হয়ে যাবে। এরা ভাবতেও পারেনি যে, এত অল্প টাকায় এই অনুষ্ঠান চালু থাকবে। এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার যে, এদেরই গােপন তৎপরতায় সেপ্টেম্বর মাসে দিন তিনেকের জন্য বেতার কেন্দ্রে ধর্মঘট পর্যন্ত হয়েছিল। ‘চরমপত্র’ পর্যন্ত ব্রডকাস্ট’ করতে দেয়নি শুধু সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। অজিত দাশ সম্পর্কে লিখতে যেয়ে এসব প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উল্লেখ করার কারণ রয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠান শুরু করার মাত্র দিন দশেকের মধ্যেই টোকিওর ইউপিআই অফিস থেকে টেলিগ্রাম এলাে। ইউপিআই-এর স্টাফ হিসাবে একটা বিপ্লবী রেডিও স্টেশন থেকে কোনরকম প্রােপাগাণ্ডা অনুষ্ঠান করা যাবে না। সেক্ষেত্রে চাকরি থেকে “ ডিসমিস’ করা হবে। অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠলাে। বুঝলাম, ঢাকায় হামিদুল হক চৌধুরী উদ্যোগ গ্রহণ করায় পাকিস্তানের জঙ্গী সরকার পাকিস্তানে ইউপিআইয়ের ব্যবসা বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে এধরনের টেলিগ্রাম এসেছে। অজিতদা শুধু বললেন, আখতার সাহেব এই দুর্দিনে এত ভাল একটা চাকরি নষ্ট করা কি ঠিক হবে? আমি সিদ্ধান্তে অটল রইলাম।
জবাবে বললাম, “আমার পক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার  কেন্দ্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠান বন্ধ করা সম্ভব হবে না। তাহলে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে চিরদিনের জন্য ধিকৃত হব।” সিদ্ধান্ত মােতাবেক ইউপিআইয়ের টোকিও অফিসে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিলাম। এদিকে রান্নার অসুবিধার জন্য পাম এ্যাভিনিউতে নতুন বাসা ভাড়া করে চলে এলাম। সেদিনের তারিখটা ছিল ১১ জুন। আমার টেলিগ্রামের জবাব এলাে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠান করার জন্য আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অজিতদা’র অফিসে বসেই টেলিগ্রামটা বারদুয়েক পড়ে পকেটে রাখলাম। নিয়তির পরিহাসই বলতে হয়। ‘চরমপত্রের জন্য আমি ইউপিআইয়ের চাকরি হারালাম । এখন উপায়? বাসায় চারটা ক্ষুধার্ত মুখ আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এছাড়া নিজের হাত খরচ ছাড়াও রয়েছে মাসিক আড়াই শ’ টাকা বাসা ভাড়া। অজিতদা আমাকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেন। এমনকি কলকাতার একটা পত্রিকায় রিপাের্টারের চাকরি যােগাড় করে দেয়ার আশ্বাস দিলেন। আমি কোন জবাবই দিলাম না।
 
এমন সময় লক্ষ্য করলাম, আমার নামে ডাকে একটা চিঠি এসেছে। প্রেরক হচ্ছে ম্যানচেষ্টার থেকে আমার শ্যালক ডাঃ মােশাররফ হােসেন খান। ছােট্ট চিঠি। তবে বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঠিক এক মাস পূর্বে ১২ মে তারিখে বগুড়ার এক নিভৃত গ্রামে আমার পিতা ইন্তেকাল করেছেন। বিদেশের মাটিতে একই দিনে এবং একই সঙ্গে দুটা দুঃসংবাদ চাকরিচ্যুতি এবং পিতার মৃত্যু তবুও মন শক্ত করলাম। ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।  দিনকয়েকের মধ্যে একটা সুযােগ এসে গেল। ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানের ‘ব্রিফিংয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ডেকে পাঠালেন। নানা বিষয়ে কথা বললেন। আলাপের শেষ পর্যায়ে নিজেদের দুরবস্থার কথা উল্লেখ করলাম এমর্মে বললাম যে, তথ্য ও প্রচার দফতর স্থাপন করে আমাকে কাজে লাগাতে পারেন। আমার বক্তব্য তিনি মনােযােগের সঙ্গে শুনলেন। পরে পরামর্শ দিলেন যে, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছ থেকে এধরনের প্রস্তাব এলে তিনি তা কার্যকর করবেন।
সন্ধ্যার পর মান্নান ভাইকে সঙ্গে করে দৌড়ালাম সিআইটি এভিনিউতে সৈয়দ নজরুলের বাসায়। তখন তিনি একটা ট্রানজিস্টার রেডিও সেটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনছিলেন। সেদিনের চরমপত্র’ শুনে খুবই হাসলেন। এরপর মান্নান ভাই আমার কথা উঠালেন। বিস্তারিত আলােচনা হলাে তিনি স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে আমার চাকরির ব্যবস্থা করবেন বলে কথা দিলেন। তিনি এবং তাজউদ্দিন আহমদ  দুজনেই প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতরের ডিরেক্টর হিসাবে ১৯৭১ সালের ১ জুলাই চাকরিতে যােগদান করলাম। বেতন সর্বসাকুল্যে ৫০০ টাকা। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত মােতাবেক একই সঙ্গে নিয়ােগপত্র পেলেন আর্টস ও ডিজাইন দফতরের ডিরেক্টর হিসাবে শিল্পী কামরুল হাসান এবং চলচ্চিত্র দফতরের ডিরেক্টরের পদে আবদুল জব্বার খান। কোন যোেগ্য প্রার্থী না থাকায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ডিরেক্টরের পদ শূন্য রইল। প্রধানমন্ত্রীর অধীনে এসব কিছুর সার্বিক দায়িত্বে রইলেন টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত এমএনএ আবদুল মান্নান দিন কয়েকের মধ্যে বালুহক্কাক লেনে ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার অফিসের একটা রুমে অফিস স্থাপন করলাম। পরে ১নং বালীগঞ্জ সার্কুলার রােডে উঠে গেলাম। ইতােমধ্যে তথ্য ও প্রচার দফতরে যােগ দিলেন সর্বজনাব সন্তোষ গুপ্ত, আবুল মঞ্জুর, মােহাম্মদ ফারুক, মাহবুব তালুকদার, জালালউদ্দীন, মহাদেব সাহা, মঈনুদ্দীন চৌধুরী, হারুনুর রশীদ এবং ফটোগ্রাফার মােহাম্মদ আলম ও মােহাম্মদ মুসা এছাড়া হিসাবরক্ষক হিসাবে অজিত দত্ত। দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের জন্য প্রতিদিন প্রেস রিলিজ তৈরি ও নিউজ ফটো সরবরাহ করা ছাড়াও তিনটি ভাষায় যথাক্রমে বাংলা, ইংরেজী ও ফরাসী ভাষায় নানা  ধরনের পােস্টার, ফোল্ডার, পুস্তিকা ও নিউজ বুলেটিন ছাপা এবং এসব জোনাল অফিস ও দখলীকৃত এলাকায় বিতরণের ব্যবস্থা করা হলাে। উপরন্তু বিদেশে আমাদের ৬টি মিশনে নিয়মিতভাবে এসবের প্যাকেট পাঠানাে শুরু হলাে ফলে প্রতিদিন স্বাধীন।
 
বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য চরমপত্র’ লেখা ও রেকর্ডিং করা এবং তথ্য ও প্রচার দফতরের কাজে দারুণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। মাস কয়েকের মধ্যে ইউপিআই অফিসে যাওয়ার ফুরসতই হলাে না। দুজনের মধ্যে বেশ দূরত্ব হয়ে গেল। তবে অজিতদা’র খবর ঠিকই রাখতাম। লক্ষ্য করলাম বাংলাদেশ মিশনে তার যাতায়াত বেড়ে গেছে। এই মিশনেই ছিল আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এখানেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ ও পররাষ্ট্র সচিব চাষী মাহবুবুল আলম নিয়মিত অফিস করতেন।  মুজিবনগরে সংগঠিত বেশ ক’টি ঘটনা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথম মওলানা ভাসানী কর্তৃক ন্যাপ-ভাসানীর সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে পার্টি থেকে বহিষ্কার দ্বিতীয়ত ব্যক্তিগতভাবে পূর্ব পরিচয়ের জের ধরে চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং ও প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের কাছে মওলানা ভাসানী কর্তৃক পর পর লম্বা  টেলিগ্রাম পাঠিয়ে কোনরকম জবাব না পাওয়া। তৃতীয়ত মুজিবনগরে ১৪টি চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির গঠিত সমন্বয় কমিটির (আহ্বায়ক কমরেড বরদা চক্রবর্তী) সঙ্গে। কোনরকম যােগসূত্র স্থাপনে মওলানা ভাসানীর অস্বীকৃতি। চতুর্থত মুজিবনগর সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে একদিকে ১১টি সেক্টরে লড়াই পরিচালনা করা এবং অন্যদিকে বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে প্রায় লক্ষাধিক মুক্তিযােদ্ধার ট্রেনিং গ্রহণ পঞ্চমত আশ্চর্যজনকভাবে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ প্রভৃতি ধর্মীয় মৌলবাদী দলের অনুরূপ ভারতের হিন্দু মহাসভা, শিবসেনা ও বিজেপি’র মতাে ধর্মীয় মৌলবাদী দলগুলাে কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরােধিতা করা। ষষ্ঠত সৈয়দ বদরুদ্দোজাসহ (রাজিয়া ফয়েজের পিতা) পশ্চিম বাংলার জনাকয়েক দক্ষিণপন্থী নেতাকে গ্রেফতার, পুলিশ কর্তৃক আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক শ্রী অভীক সরকারের বাসভবন সার্চ ও শ্রী অমিতাভ গুপ্ত প্রমুখকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং সবশেষে ভারতের দক্ষিণপন্থী মহল ও মার্কিনী যােগসাজশে মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরে খন্দকার। মােশতাক আহমদ ও চাষী মাহবুবুল আলমের নেতৃত্বে স্বাধীনতাযুদ্ধ বন্ধ করার লক্ষ্যে। ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড অন্যতম।
অবশ্য গােপন রিপাের্টের ভিত্তিতে এসময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ইস্পাতকঠিন মনােবলের পরিচয় দিলেন। প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে যে প্রতিনিধি দলের যাওয়ার কথা ছিল এবং সেখানে দলের নেতা হিসাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদের নাম নির্দিষ্ট ছিল, তা বাতিল হয়ে গেল এবং তালিকার বেশ কিছুটা রদবদল হলাে। এখানেই শেষ নয়। বিশেষ ব্যবস্থাধীনে এঁদের যেসব ভারতীয় পাসপাের্ট ইস্যু করা হয়েছিল, সেসব সীজ’ করা হলাে এবং সেই মােতাবেক প্রতিটি এয়ারপাের্ট ও সামুদ্রিক বন্দরে জানিয়ে দেয়া হলাে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ফোন করে লন্ডনে অবস্থানরত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে আলােচ্য প্রতিনিধি দলের নেতার দায়িত্ব পালনের অনুরােধ জানালেন। উপরন্তু অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুলকে সঙ্গে করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিওতে এসে হাজির হলেন। নিজেরাই ডিকটেশন দিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ তৈরি এবং তা রেকর্ডিং করালেন। সেদিন রাতেই বেতারে এই দুটো ভাষণ প্রচারিত হলাে মােদ্দাকথাটা হচ্ছে, বাংলাদেশের এক ইঞ্চি মাটি পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর পদানত থাকা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ অব্যাহত থাকবে এবং এটাই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর শেষ নির্দেশ শেষ অবধি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের নির্দেশে পররাষ্ট্র সচিব চাষী মাহবুবুল আলম প্রবাসী সরকারের চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেন। সত্যি কথা বলতে কি এ ধরনের এক চাঞ্চল্যকর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা হওয়া পর্যন্ত আমি অজিতদাকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলেছি। এমনকি বৌদির সঙ্গে। পর্যন্ত দেখা করিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের প্রথম সপ্তাহে আমি ছিলাম তথ্য প্রচার দফতরের মহাপরিচালক তখন অজিত দাশ ঢাকায় এসে সচিবালয়ে আমার সঙ্গে। দেখা করলেন। অদ্ভুত এক অনুরােধ। ইউপিআইয়ের প্যাডে দরখাস্ত এনেছেন। বাংলাদেশে ইউপিআই চালু করার অনুমতি প্রার্থনা করেছেন।

আমার চোখের সামনে একাত্তরের ১২ জুনের সেই টেলিগ্রামটা ভেসে উঠলাে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে আলাপ অন্তে ফাইলে নির্দেশ নিলাম এবং ইউপিআইয়ের জন্য পারমিশন ইস্যু করলাম। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে লণ্ডন হাইকমিশনে আমার পােস্টিং হলাে। এরপর বাংলাদেশের রক্তাক্ত রাজনীতিতে নানা উত্থানপতন। ঘটনা পরম্পরায় প্রায় দুই যুগের মধ্যে আর দেখা হয়নি। ১৯৮৭ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর কার্যোপলক্ষে বেশ কয়েকবার কলকাতায় গিয়েছি। কিন্তু অজিতদার সঙ্গে দেখা হয়নি বা দেখা করিনি। শুনেছি অজিতদা’ও বেশ ক’বার বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি তিনি শেষবারের মতাে ঢাকায় এলেন। তখন বয়স ৮০ প্লাস। চোখে মােটা কাচের চশমা এবং শ্রবণশক্তি প্রায় রহিত হয়ে গেছে। বারবার বললেন, কলকাতায় এলে দেখা করবেন। কেন হােটেলে উঠে পয়সা খরচ করেন? ট্রিভলী কোর্টে আমার ফ্ল্যাটে উঠলেই তাে পারেন? ওখানে গেস্টদের থাকার ব্যবস্থা করেছি। জবাবে বললাম, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় অনেক অত্যাচার সহ্য করেছেন। আপনাদের আন্তরিকতা। তুলনাহীন। এখন শুধু আশীর্বাদপ্রার্থী। ১৯৯৭ সালে দৈনিক জনকণ্ঠে খবরটা পড়লাম। ৮২ বছর বয়সে ২১ জুন কলকাতায় নিজ বাসভবনে সাংবাদিক অজিত দাশ পরলােকগমন করেছেন। খবরটা। পড়ে চোখের সামনে মুজিবনগরের স্মৃতি ভেসে উঠলাে। কিন্তু কিছুতেই নানাধরনের ষড়যন্ত্রের কথা ভুলতে পারলাম না। তবে একটা কথা বলতেই হচ্ছে যে, মুজিবনগরের রাজনীতি বুঝতে না পারলে পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি বােঝা মুশকিল  হিসাব মেলানাে বড় কঠিন। সবই ঝাপসা মনে হবে। আর স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস হবে অসম্পূর্ণ।

সূত্রঃ   একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল

 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!