প্রবাসী সরকার নৌ বিমান ও সেনাবাহিনীর জন্মকথা
আজ ১৭ এপ্রিল। আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৭১ সালের এই দিনে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথপুরের ‘ভবেরপাড়া গ্রামে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাঝ দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম আত্মপ্রকাশ হয়েছিল। আসলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ১০ এপ্রিল এক বিবৃতির মাধ্যমে প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘােষণা দিয়েছিলেন। এতে বলা হয়েছিল যে, নির্বাচিত সংখ্যাগুরু দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরা ছাড়াও ভারতের ধর্মীয় দক্ষিণপন্থী মহল এ ব্যাপারে দারুণ সন্দেহ প্রকাশ করে। ফলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের বিশ্বাসযােগ্যতা স্থাপনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের মাটিতেই আলােচ্য। অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৭ এপ্রিল তারিখে কাকডাকা ভােরে কলকাতার প্রেসক্লাব এবং গ্র্যান্ড হােটেলের পাদদেশ থেকে প্রায় শতাধিক বিদেশী সাংবাদিক এবং বেতার ও টিভির প্রতিনিধিদের গাড়ি করে সরাসরি মেহেরপুরের ‘ভবেরপাড়া গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুসংখ্যক নির্বাচিত সংসদ সদস্যও এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আর ছিলেন হাজার কয়েক গ্রামবাসী। অনুষ্ঠানের শুরুতেই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক ইপিআর এবং আনসার বাহিনীর দুটো প্লাটুনের কাছ থেকে গার্ড অব অনারের অভিবাদন গ্রহণ করেন এই দুটো।
প্লাটুনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাহবুব উদ্দিন আহমদ এবং তওফিক এলাহী চৌধুরী। তখন বিদেশী সাংবাদিকরা গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমে যাচাই করে নিচ্ছিলেন ভবেরপাড়া গ্রামটা সত্যিই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিনা। মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় পবিত্র কোরান তেলাওয়াতের পর। প্রথমেই দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী কর্তৃক স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ। উল্লেখ্য যে, ২৫ মার্চ দিবাগত রাত্রে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর গণহত্যার মােকাবিলায় নির্বাচিত সংখ্যাগুরু দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘােষণার ধারাবাহিকতায় আলােচ্য স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র। পাঠের দরুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বৈধতা লাভ করে। (পরবর্তীকালে এই ঘােষণাপত্র বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে)।
এ সময় চারদিকে শুধু মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার ৪ জন সদস্যের শপথ গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ‘ভবেরপাড়া’র নাম পরিবর্তন করে। ‘মুজিবনগর’ করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। তিনি এ মর্মে সাংবাদিকদের জানান যে, সিলেট থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য কর্নেল (অব) এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিয়ােগ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত একটা কথা স্মরণ রাখা প্রয়ােজন যে, প্রবাসী সরকার কর্তৃক ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং এসব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এটা ছিল প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার। কিন্তু সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিন আহমদের মধ্যে চমক্কার সমঝােতার ফলশ্রুতিতে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাজউদ্দিন আহমদই সরকারের সমস্ত ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন কখনও মতবিরােধ হয়নি।
এ জন্যই আমরা দেখতে পেয়েছি যে, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মুজিবনগরে কয়েক দফা ষড়যন্ত্র ও নানাবিধ চাপের মুখেও নজরুল-তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত প্রবাসী সরকার তাদের লক্ষ্য- বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার পথ থেকে কখনও বিচ্যুত হয়নি। নজরুল-তাজউদ্দিন-মনসুর-কামরুজ্জামান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত মহপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। এঁদেরই নেতৃত্বে ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়েছে রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধ তাহলে এটাই হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্য যে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের। আম্রকাননে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে যে সরকারের জন্ম হয়েছিল, সেটাই হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সূচনা। এটাকে অস্বীকার অর্থই হচ্ছে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে অস্বীকার করা। এঁদের। নেতৃত্ব এবং সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশ্বের মানচিত্রে। অভ্যুদয় হয়েছে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের এক্ষণে একনজরে প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও স্থাপিত
ঃ ১০ এপ্রিল ১৯৭১ শপথ গ্রহণ
ঃ ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ অস্থায়ী সচিবালয়।
ও মুজিবনগর সচিবালয়ের ক্যাম্প অফিস ঃ ৮ থিয়েটার রােড, কলকাতা রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক। ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানের
কারাগারে বন্দী)। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম (উপ-রাষ্ট্রপতি) প্রধানমন্ত্রী
ও তাজউদ্দিন আহমদ। অর্থমন্ত্রী
ঃ এম মনসুর আলী। স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী।
এ এইচ এম কামরুজ্জামান পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী
: খন্দকার মােশতাক আহমদ প্রধান সেনাপতি
ঃ কর্নেল (অব) এম এ জি ওসমানী এম এন এ চীফ অব স্টাফ
ও কর্নেল (অব) আব্দুর রব এম এন এ বিমানবাহিনী প্রধান
৪ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি। ও মওলানা ভাসানী (চেয়ারম্যান)
ঃ তাজউদ্দিন আহমদ (আহ্বায়ক) : কমরেড মনি সিং (সদস্য) ঃ অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ (ঐ) ঃ মনােরঞ্জন ধর (ঐ)।
ঃ খন্দকার মােশতাক আহমদ (ঐ)। বিশেষ দায়িত্বে নিযুক্ত : আব্দুল মান্নান এম এন এ (তথ্য ও বেতার)
ঃ অধ্যাপক ইউসুফ আলী এম এন এ(পুনর্বাসন) ঃ আমিরুল ইসলাম এম এন এ (ভলান্টিয়ার কোর)
ঃ মতিউর রহমান (বাণিজ্য) প্রবাসী সরকারের সচিবালয় মুখ্যসচিব।
: খন্দকার আসাদুজ্জামান ক্যাবিনেট সচিব
ঃ তওফিক ইমাম প্রতিরক্ষা সচিব
ঃ আবদুস সামাদ সংস্থাপন সচিব
ঃ নুরুল কাদের খান কৃষিসচিব
ঃ নুরুদ্দীন আহম্মদ। তথ্যসচিব।
ঃ আনােয়ারুল হক খান । পররাষ্ট্র সচিব।
ও চাষী মাহবুবুল আলম (বরখাস্ত) এ ফতেহ বহির্বিশ্বে বিশেষ দূত
ও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। পুলিশ প্রধান।
ঃ আব্দুল খালেক নয়াদিল্লিতে মিশন প্রধান
ঃ হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী কলকাতায় মিশন প্রধান ৪ হােসেন আলী পরিকল্পনা কমিশন।
ঃ ডঃ মােজাফফর আহমদ (চেয়ারম্যান) ঃ ডঃ আনিসুজ্জামান (সদস্য) ঃ ডঃ সারােয়ার মুর্শেদ (ঐ) ঃ ডঃ স্বদেশ রঞ্জন (ঐ)| ডঃ মােশারফ হােসেন (ঐ) বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির প্রধান ঃ ডঃ এ আর মল্লিক ইয়ুথ ক্যাম্প পরিচালক : উইং কমাঃ (অব) এম আর মির্জা পরিচালক আর্টস ও ডিজাইন ঃ কামরুল হাসান। পরিচালক, চলচ্চিত্র বিভাগ ঃ আব্দুল জব্বার খান। পরিচালক, তথ্য ও প্রচার দফতর ঃ এম আর আখতার মুকুল পরিচালক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও শূন্য পরিচালক, স্বাস্থ্য দফতর ও ডাক্তার টি হােসেন সহকারী পরিচালক, স্বাস্থ্য দফতর ও ডাক্তার আহমদ আলী রিলিফ কমিশনার ঃ শ্রী জে জি ভৌমিক। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব কাজী লুৎফুল হক। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব ঃ ডঃ ফারুক আজিজ খান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব ঃ মামুনুর রশিদ। অর্থমন্ত্রীর একান্ত সচিব ঃ সাদত হােসেন পররাষ্ট্র মন্ত্রীর একান্ত সচিব ঃ কামাল সিদ্দিকী। উপ-সচিব, দেশরক্ষা : আকবর আলী খান উপ-সচিব, সংস্থাপন ঃ ওয়ালিউল ইসলাম উপ-সচিব, স্বরাষ্ট্র
ঃ খােরশেদুজ্জামান চৌধুরী ট্রান্সপাের্ট অফিসার
ঃ এম এইচ সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রীর পিআরও
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিআরও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পিআরও প্রধানমন্ত্রীর স্টাফ অফিসার প্রধান সেনাপতির পিআরও প্রধান সেনাপতির এডিসি
ও রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ৪ কুমার শংকর হাজরা ঃ মেজর নুরুল ইসলাম ঃ মােস্তফা আল্লামা ও ক্যাপ্টেন নূর, লেঃ শেখ কামাল
৪.বেসামরিক আঞ্চলিক প্রশাসন কাঠামাে ঃ ১১টি সেক্টরের অনুরূপ ১. নুরুল ইসলাম চৌধুরী (চেয়ারম্যান) ঃ দঃ -পূর্ব অঞ্চল-১ (সাবরুম)এস এম সামাদ (প্রশাসক) ঃ ঐ ২. জহুর আহমদ চৌধুরী (চেয়ারম্যান) : দঃ -পূর্ব অঞ্চল-২ (আগরতলা)
কাজী রকিবউদ্দীন (প্রশাসক) ঃ ঐ কর্নেল (অব) এম এ রব (চেয়ারম্যান) ঃ পূর্ব অঞ্চল (ধর্মনগর) ডাঃ কে এ হাসান (প্রশাসক) ঃ ঐ। দেওয়ান ফরিদ গাজী (চেয়ারম্যান) : উত্তর-পূর্ব অঞ্চল-১ (ডাউকি) এস এইচ চৌধুরী (প্রশাসক) ঃ ঐ সামসুর রহমান খান (চেয়ারম্যান) উত্তর-পূর্ব অঞ্চল-২ (তুরা) লুর রহমান (প্রশাসক) ও ঐ। মতিউর রহমান (চেয়ারম্যান) : উত্তর অঞ্চল (কুচবিহার) ফয়েজউদ্দীন আহম্মদ (প্রশাসক) ঐ ৭. মােঃ আব্দুর রহিম (চেয়ারম্যান ও পশ্চিম অঞ্চল-১ (বালুরঘাট)
এম এ কাশেম খান (প্রশাসক) ও ঐ ৮, আশরাফুল ইসলাম মিয়া (চেয়ারম্যান) পশ্চিম অঞ্চল-২ (মালদহ)
জহুরুল ইসলাম ভূঁইয়া (প্রশাসক) ও ঐ ৯. আব্দুর রউফ চৌধুরী (চেয়ারম্যান) ঃ দঃ -পশ্চিম অঞ্চল-১ (কৃষ্ণনগর)
শামসুল হক (প্রশাসক) ১০. ফণিভূষণ মজুমদার (চেয়ারম্যান) ঃ দঃ -পশ্চিম অঞ্চল-২ (বনগাঁ)
বি বি বিশ্বাস (প্রশাসক) : ঐ। ১১, আব্দুর রব সেরনিয়াবত (চেয়ারম্যান) ও দক্ষিণ অঞ্চল (বারাসাত) এ মােমিন (প্রশাসক)।
সেনাবাহিনীর জন্মকথা এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে, কোন্ দিনটিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম তারিখ হিসাবে গণ্য করা বাঞ্ছনীয় হবে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা দেখতে পাই যে, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠনের পরদিন অর্থাৎ ১১ এপ্রিল তারিখে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের রেকর্ডকৃত যে ভাষণ এক কিলােওয়াট বেতার। থেকে প্রচারিত হয়েছে (পরে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে পুনপ্রচারিত হয়), সেই ভাষণেই তিনি রণাঙ্গনকে ৭টি ভাগে বিভক্ত করে প্রাথমিকভাবে মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর ওসমান, মেজর জলিল, মেজর আহম্মদ এবং মেজর নজরুলকে এসব সেক্টরে দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেন। ১৯৭১ সালের জুন মাস নাগাদ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে যুদ্ধ পরিস্থিতির পর্যালােচনা করা হয়।
এই বৈঠকেই সমগ্র রণাঙ্গনকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সিদ্ধান্ত ১২ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়। নিম্নে সেক্টরগুলাে দেয়া হলাে। সেক্টর সেক্টর কমান্ডার এলাকা। ১নং রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ২নং খালেদ মােশাররফ নােয়াখালী এবং কুমিল্লা ও ঢাকা জেলার অংশ ৩নং কে এম শফিউল্লাহ কিশােরগঞ্জ এবং সিলেট ও ঢাকা জেলার অংশ। ৪নং চিত্তরঞ্জন দত্ত সিলেট জেলার অংশ ৫নং মীর শওকত আলী। সিলেট জেলার লাখরাই এলাকা ৬নং এম কে বাশার রংপুর ও ঠাকুরগাঁও। ৭নং নাজমুল হক (‘৭১-এর আগস্টে শহীদ), কাজী নুরুজ্জামান (অস্থায়ী) রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া ৮নং আবু ওসমান চৌধুরী (আগস্ট পর্যন্ত), মেজর মঞ্জুর যশাের, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর ৯নং মােঃ জলিল মিয়া বৃহত্তর বরিশাল ও খুলনা ১০নং নৌকমান্ডােদের সেক্টর নির্দিষ্ট সীমানা নেই। ১১নং আবু তাহের ১৪-১১-৭১পর্যন্ত (আব্দুল আজিজ এবং পরে হামিদুল্লাহ খান)স টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ (কিশােরগঞ্জ ছাড়া)। ইতােমধ্যে স্বাধীনতাযুদ্ধ আরও জোরদার করার লক্ষ্যে মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে শুধুমাত্র ‘ডিফেক্ট’ করা সৈন্যদের নিয়ে পৃথকভাবে ৩টি ফোর্স গঠন করা হয় । এগুলাে হচ্ছে, লেঃ কর্নেল জিয়াউর রহমানের অধীনে ১ম, ৩য় এবং ৮ম ইস্টবেঙ্গল ও ২য় ফিল্ড আর্টিলারি নিয়ে গঠিত “জেড ফোর্স”, লেঃ কর্নেল খালেদ মােশাররফের অধীনে ৪র্থ, ৯ম এবং ১০ম ইস্টবেঙ্গল ও ১ম মুজিব ব্যাটারি নিয়ে গঠিত “কে ফোর্স” এবং লেঃ কর্নেল কে এম শফিউল্লাহর অধীনে ২য় এবং ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত “এস ফোর্স”।
এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের হিসাবমতাে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে ১ লাখ ৫০ হাজারের মতাে সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করে। এরমধ্যে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ৩৫টি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার। এসবের মধ্যে গুটিকয়েক গেরিলা পাটুনও তৈরি করা। হয়েছিল। এর পাশাপাশি আরও ক’টি বাহিনী তৈরি হয়েছিল এগুলাে হচ্ছে ? ১. মুজিব বাহিনী (বিএলএফ)। ২. কাদেরিয়া বাহিনী (টাঙ্গাইল ও ঢাকা) ৩. আফসার বাহিনী (ভালুকা-জয়দেবপুর)
৪, হালিম বাহিনী (মানিকগঞ্জ) ৫. হেমায়েত বাহিনী (বরিশাল এলাকা) এবং ৬. মােতালেব বাহিনী (সুনামগঞ্জ এলাকা) মমাদ্দাকথায় বলতে গেলে সংক্ষেপে এসবই হচ্ছে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কর্মতৎপরতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সহযােগী বাহিনীগুলাের জন্ম ইতিহাস। মনে রাখা প্রয়ােজন, যেখানে শুধুমাত্র আলােচনার মাধ্যমে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের “রয়াল ইন্ডিয়ান আর্মিকে” বিভক্ত করে ভারতীয় ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সৃষ্টি হয়েছিল, সেখানে একাত্তরের রক্তাক্ত লড়াইএর মাধ্যমে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এর মূল কৃতিত্বই হচ্ছে মুজিবনগর সরকারের; তাই একথা আজ সুস্পষ্টভাবে বলতে হচ্ছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্মের গৌরবােজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে । এই ঐতিহ্য আর ইতিহাস কখনও ভুলবার নয়।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ইতিহাস বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্মের ইতিহাস খুবই চাঞ্চল্যকর। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কর্মরত বাঙালী সদস্যদের মধ্যে দারুণ অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এদের মনে তখন উদগ্র বাসনা, যেভাবেই হােক না কেন স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেই হবে। কিন্তু কিভাবে? এ সময় পাকিস্তান নেভির পিএনএস ‘ম্যাংগ্রো” নামের একটা সাবমেরিন ফ্রান্সের ছুঁলাে নৌঘাটিতে নােঙর করে দিন কয়েকের জন্য অবস্থান করছিল। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ এই সাবমেরিন থেকেই ৮ জন বাঙালী নৌসেনা। সর্বপ্রথম ডিফেক্ট’ করলেন। এঁরা হচ্ছেন মােহাম্মদ রহমত উল্লাহ সিপি, মােশারফ হােসেন পিও, শেখ আমান উল্লাহ পিও, আহসান উল্লাহ এমই-১,ওয়াহেদ চৌধুরী আরও-১, আব্দুর রকিব ইতন-১, বদিউল আলম এমই-১ এবং আবেদুর রহমান স্টুয়ার্ড১। এঁদের স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল সেখান থেকে দিল্লী হয়ে মুজিবনগর এসময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার নৌ-কমান্ডাে বাহিনী গঠন করার লক্ষ্যে দারুণভাবে তৎপর হয়ে ওঠে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হওয়ার মাত্র দুদিনের মধ্যেই ২৭ মে তারিখে বাংলাদেশের নৌ-কমাণ্ডোদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর ট্রেনারদের অধীনে পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত পলাশীর পার্শ্ববর্তী ভাগিরথী নদীতে সেই ‘ডিফেক্ট’ করা ৮ জন নাবিকসহ মােট ৩৫৭ জনের একটা বিরাট গ্রুপের কমান্ডাে ট্রেনিং শুরু হয়। জুলাই মাসের শেষ নাগাদ প্রথম ২টি ব্যাচের ট্রেনিং সমাপ্ত হয়। পরবর্তীতে ট্রেনিং প্রাপ্ত নৌকমান্ডােদের সংখ্যা ৬০০ জনে উন্নীত হয়েছিল। এদের রিক্রুট করা হয়েছিল বিভিন্ন যুব শিবির থেকে।
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব নৌবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার লক্ষ্যে ভারত সরকারের কাছ থেকে দুটো টাগবােট সংগ্রহ করে গানবােটে’ রূপান্তরিত করা হয়। এরপর ‘৪০ এম এম বফরস’ বসিয়ে গানবােট দুটোকে নদীর মােহনা অঞ্চলে যুদ্ধের উপযােগী করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বয়ং দুটো গানবােটের নামকরণ করেছিলেন ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’। এ দুটো হচ্ছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম গানবােট এবং এখান থেকেই যাত্রা শুরু। উল্লেখ্য যে, ‘পদ্ম’ গানবােটের আর্টিফিসার ১০ ডিসেম্বর যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁকে বীর শ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এদিকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর সরবরাহ বিচ্ছিন্ন এবং মনােবল বিনষ্ট করার লক্ষ্যে মুজিবনগর সরকার বর্ষাকালে (আগস্ট-সেপ্টেম্বর) নৌকমান্ডােদের কাজে লাগাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এতে বলা হয় যে, শত্রু দখলীকৃত বাংলাদেশের সামুদ্রিক ও নদীবন্দরগুলােকে অকেজো করা ছাড়াও নােঙর করা পাকিস্তানী ও বিদেশী জাহাজ, স্টীমার ও বার্জ ডুবিয়ে দিতে হবে। সরকারী নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গােপনে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হলাে। বাছাই করা হলাে ১৭৮ জন দুর্ধর্ষ নৌকমান্ডােকে। নিম্নোক্তভাবে ৪টি গ্রুপে বিভক্ত করে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হলাে। ১ম গ্রুপ ঃ ওয়াহেদ চৌধুরীর অধীনে ৬১ জন ১ আগস্ট রওনা হলাে চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে। ২য় গ্রুপ ঃ বদিউল আলমের অধীনে ২৮ জন ২ আগস্ট রওনা হলাে চাঁদপুর অভিমুখে। ৩য় গ্রুপ ঃ আব্দুর রহমানের অধীনে ২৮ জন ২ আগস্ট রওনা হলাে নারায়ণগঞ্জ অভিমুখে। ৪র্থ গ্রুপ ঃ মােঃ আহসান উল্লাহর অধীনে ৬১ জন ৪ আগস্ট রওনা হলাে মংলা বন্দর অভিমুখে। প্রত্যেক গ্রুপকে এ মর্মে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, পাকিস্তানী সৈন্য এবং রাজাকারদের হাতে গ্রেফতার এড়াবার জন্য তাদের হেঁটে এবং দেশী নৌকায় গন্তব্যস্থলে পৌছতে হবে। আবার এ্যাকশন করার পর একইভাবে পলাশীর বেসক্যাম্পে ফিরে আসতে হবে। সব এ্যাকশনের সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছিল ১৬ই আগস্ট ঠিক মধ্যরাতে। | স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী এবং বিবিসি লন্ডন থেকে নৌকমান্ডােদের প্রথম এ্যাকশনের খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল। বিবিসির খবরে এ মর্মে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের নৌকমান্ডােরা চট্টগ্রাম বন্দরে ৬টি জাহাজ ও বার্জ, মংলা। পােটে ৫টি জাহাজ ও বার্জ, নারায়ণগঞ্জে ৩টি কোস্টার এবং চাদপুরে ১টি জাহাজ বিনষ্ট করেছে।
এ নৌকমান্ডােরা ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিন্ন করে দিয়েছে। এধরনের সাফল্যের পর আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে দখলীকৃত এলাকায় শুরু হয় নৌকমান্ডােদের একটার পর একটা গেরিলা অপারেশন। তবে কাজের সুবিধার জন্য এসময় ৪ থেকে ২০ জনকে নিয়ে নৌকমান্ডাে গ্রুপ বানানাে হয়েছিল। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে আরও কয়েক দফা হামলা ছাড়াও নদীবন্দরগুলাের মধ্যে বরিশাল, আরিচা, নগরবাড়ি, চরমুগুরিয়া, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, দাউদকান্দি, ফুলছড়ি, সিলেট, রাজশাহী, মাগুরা, ভােলা, নরসিংদী, রাজবাড়ি ও অষ্টগ্রামের অপারেশন বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তবে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ছিল মংলা বন্দরে ২য় দফা গেরিলা অপারেশন। ৩০ জন কমান্ডাে নিয়ে গঠিত এই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রান্সে অবস্থানরত পাকিস্তানী সাবমেরিন ‘ম্যাংগ্রো থেকে ডিফেক্ট করা নৌসেনা বদিউল আলম (এমই-১)। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় যে, ৯ নভেম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল এ সময় বদিউলের নৌকমান্ডাে গ্রুপকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য প্রদান করেছিলেন। তিনি লেঃ শামসুল আরেফিনের নেতৃত্বে ২০০ জন মুক্তিযােদ্ধাকে মংলা এলাকার স্থলভাগে স্পেশাল ডিউটি প্রদান করান। উপরন্তু সুন্দরবন সাব সেক্টরের কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিনকেও দলবলসহ মংলা এলাকায় নৌকমান্ডােদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ প্রদান করেন। মংলা বন্দরে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে সাফল্যজনকভাবে অপারেশন করার লক্ষ্যে এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত মংলা পাের্টে দু’বার গেরিলা হামলায় মােট এগারােটি সমুদ্রগামী জাহাজ ডুবে গিয়েছিল এবং মংলা বন্দর অকেজো হয়ে যায়। অগভীর সমুদ্রে এতগুলাে জাহাজ ডুবে থাকায় অন্য কোন জাহাজের পক্ষে এই বন্দরে যাতায়াত সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তঙ্কালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ অনুরােধে যুগােস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো সহযােগিতার হস্ত সম্প্রসারণ করেন। ফলে। যুগােস্লাভিয়ার বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়াররা অক্লান্ত পরিশ্রম করে মংলা পাের্ট চালু করতে সক্ষম হন। তবুও বছর কয়েক সময়ের প্রয়ােজন হয়েছিল। সংক্ষেপে এই হচ্ছে বাংলাদেশের নৌবাহিনী গঠনের সূচনা পূর্বের ইতিহাস এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে নৌসেনাদের সাহসিকতাপূর্ণ কর্মকাণ্ডের খতিয়ান। বিমানবাহিনীর চাঞ্চল্যকর ইতিহাস ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্মের ইতিহাস রােমাঞ্চকর ও লােমহর্ষক বলা যায়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে যখন দেশব্যাপী অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে ঢাকায় অবস্থানকারী বিমানবাহিনীর বাঙালী পাইলটরা গােপনে এ মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, প্রয়ােজন দেখা দিলে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এ কে খন্দকারের, পােস্টিং ছিল তেজগাঁও এয়ারবেস-এ। এ সময় বেশ কিছুসংখ্যক বাঙালী পাইলট অফিসার বার্ষিক ছুটি কাটাবার জন্য বাংলাদেশেই অবস্থান করছিলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসব পাইলটের সঙ্গে যােগাযােগ করার দায়িত্ব অর্পিত হয় ফ্লাঃ লেঃ মতিউর রহমানের ওপর তিনি এই কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন। ফলে পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের মােট ১৮ জন। দক্ষ পাইলট এবং ৫০ জন টেকনিশিয়ান ও একজন কুক স্বাধীনতাযুদ্ধে সম্মতি দান করেন। এরপর একটা নির্দিষ্ট দিনে ডিফেক্ট করে সীমান্তবর্তী একটা নির্দিষ্ট জায়গায় জমায়েত হওয়ার জন্য এদের খবর দেয়া হয়। এই ১৮ জন পাইলট অফিসার হচ্ছেন :
১. গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার ২. উইং কমান্ডার এম কে বাশার। ৩. স্কোয়াড্রন লিডার এম সদরুদ্দীন ৪. ফ্লাঃ লেঃ সুলতান মাহমুদ ৫. ফ্লাঃ লেঃ এম লিয়াকত। ৬, ফ্লাঃ লেঃ এম হামিদুল্লাহ। ৭. ফ্লাঃ লেঃ মতিউর রহমান ৮. ফ্লাঃ লেঃ সাখাওয়াত হােসেন ৯, ফ্লাঃ লেঃ ইকবাল রশিদ ১০. ফ্লাঃ লেঃ আশরাফুল ইসলাম ১১. ফ্লাঃ লেঃ আতাউর রহমান ১২. ফ্লাঃ লেঃ ওয়ালিউল্লাহ ১৩, ফ্লাঃ লেঃ এম রউফ। ১৪. ফ্লাঃ লেঃ এম কামাল ১৫. ফ্লাঃ লেঃ মীর ফজলুর রহমান ১৬. ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলম। ১৭. ফ্লাঃ লেঃ বদরুল আলম এবং ১৮, ফ্লাঃ লেঃ মােঃ কামাল কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানে একজন অনুপস্থিত ছিলেন। অথচ এঁর উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি। ইনিই হচ্ছেন ফ্লাঃ লেঃ মতিউর রহমান পরে জানা যায়, গ্রামের শ্বশুর। বাড়িতে তিনি স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে বিদায় নিতে গেলে কথাটা ফাস হয়ে যায় এবং আত্মীয়-স্বজনরা তাকে আটক করে কর্মস্থল করাচীতে পাঠিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট তারিখে ইনস্টাক্টর হিসাবে একটি জঙ্গী বিমানে জনৈক পাঞ্জাবী ক্যাডেটকে শিক্ষা প্রদানকালে দুঃসাহসিক দক্ষতা প্রদর্শন করে রাডারের দৃষ্টি এড়িয়ে সীমান্ত অতিক্রমের প্রচেষ্টা করেন।
কিন্তু উক্ত ক্যাডেট পরিস্থিতি উপলব্ধি করে বাধা দান করে। ফলে ভারত সীমানার মাত্র কয়েক মিনিটের ফ্লাইং সময়ের মধ্যে এসেও বিমানটি বিধ্বস্ত হলে উভয়ে নিহত হয়। শহীদ ফ্লাঃ লেঃ মতিউর রহমানই হচ্ছে, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ।এদিকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারের নেতৃত্বে ডিফেক্ট করা ১৭ জন পাইলট ও ৫০ জন টেকনিশিয়ান প্রবাসী সরকারের কাছে রিপাের্ট করেন। কিন্তু প্রয়ােজনীয় বিমান। ও রানওয়ের অভাবে এদের আপাতত স্থলবাহিনীর সাথে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এসময় আরও কয়েকজন বৈমানিক মুজিবনগরে এসে হাজির হন। এঁরা। হচ্ছেন, ফ্লাঃ লেঃ এম কাদের, ফ্লাঃ লেঃ ইকবাল, ফ্লাঃ লেঃ জামাল উদ্দিন চৌধুরী, ফ্লাঃ সার্জেন্ট ফজলুল হক, ক্যাডেট অফিসার এম এ কুদুস এবং ক্যাডেট অফিসার এম মাহমুদ প্রমুখ। | স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমরা দেখতে পাই যে, ৬ নং সেক্টর কমান্ডার হিসাবে উইং । কমান্ডার এম কে বাশার এবং ১১ নং সেক্টরের (নবেম্বরে মেজর আবু তাহের গুরুতররূপে আহত হওয়ার পর) অস্থায়ী প্রধান হিসাবে ফ্লাঃ লেঃ হামিদুল্লাহ অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন করেছেন। এছাড়া এক নম্বর সেক্টর ফ্লাঃ লেঃ সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাঃ লেঃ সাখাওয়াত হােসেন, ৪ নং সেক্টরে ফ্লাঃ লেঃ এম কাদের, ছয় নম্বর সেক্টরে স্কোয়াড্রন লিডার এম সদরুদ্দীন ও ফ্লাঃ লেঃ এফ ইকবাল আট নম্বর সেক্টরে ফ্লাঃ লেঃ ইকবাল রশীদ ও ফ্লাঃ লেঃ জামালউদ্দিন চৌধুরী, নয় নম্বর সেক্টর ফ্লাইট সার্জেন ফজলুল হক।
এবং জেড ফোর্সের ফ্লাঃ লেঃ এম লিয়াকত বিভিন্ন লড়াই-এ অবিস্মরণীয় অবদান। রেখেছেন। উপরন্তু প্রবাসী সরকারের সচিবালয়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার, ফ্লাঃ । লেঃ শামসুল আলম, ফ্লাঃ লেঃ বদরুল আলম এবং অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার মির্জা। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের একটা নিজস্ব বিমান বাহিনী। গড়ে তােলার লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। | ফলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বয়ং উদ্যোগ গ্রহণ করে ভারত সরকারের কাছ থেকে আসামে ডিমাপুরে জঙ্গলাকীর্ণ ও দুর্গম এলাকায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আমলের একটা পরিত্যক্ত রানওয়ের কর্তৃত্ব লাভ করেন। এরপর গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বৈমানিকরা এই রানওয়ের প্রয়ােজনীয় সংস্কার সাধন করে। এরপর ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শুরু করে নিজেদের প্রশিক্ষণ। এজন্যই প্রবাসী। গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের অধীনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্ম তারিখ হচ্ছে ২৮ সেপ্টেম্বর। বিমানবাহিনীর নিজস্ব প্রশিক্ষণ শুরু হবার সময় পিআইএ থেকে ‘ডিফেক্ট’। করা ৬ জন বাঙালী পাইলট এসে এই প্রশিক্ষণে যােগদান করেন। এঁরা হচ্ছেন, যথাক্রমে—ক্যাপ্টেন শরফুদ্দীন, ক্যাপ্টেন খালেদ, ক্যাপ্টেন শাহাব, ক্যাপ্টেন আকরাম, ক্যাপ্টেন মুকিত এবং ক্যাপ্টেন সাত্তার মাত্র ৮ সপ্তাহকাল দুরূহ প্রশিক্ষণের পর । বাংলাদেশ বিমানবাহিনী শক্র দখলীকৃত এলাকায় অ্যাকশনের জন্য প্রস্তুত হলাে তখন এঁদের হাতে মুজিবনগর সরকারের সংগ্রহ করা একটা অটার প্লেন, একটা ডাকোটা। বিমান আর একটা এ্যালুয়েট হেলিকপ্টার এ সব বসানাে হলাে ৩০৩ ব্রাউনিং মেশিনগান আর বােঝাই করা হলাে কিছু সংখ্যক রকেট ও ২৫ পাউন্ডের বােমা। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলাে। এরা মােট ৪টি জায়গায় এ্যাকশন করেছিল এগুলাে হচ্ছে,
(১) চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা, (২) চট্টগ্রাম তেল শােধনাগার, (৩) ভৈরববাজারে পাকিস্তানী ১৪ ডিভিশনের ট্যাকটিক্যাল হেড কোয়ার্টার এবং (৪) নারায়ণগঞ্জ বন্দর এলাকা। এ সময় সমর বিশারদরা বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের নৈপুণ্য ও দক্ষতায় স্তম্ভিত হয়েছিল। এর মধ্যে ভৈরবের এ্যাকশন ছিল সবচেয়ে বেপরােয়া ও দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। এ সময় পলায়নপর পাকিস্তানী ১৪ ডিভিশন ভৈরব ব্রিজের একাংশ ডিনামাইট দিয়ে বিধ্বস্ত করে মেঘনা নদীর পশ্চিম পারে সবেমাত্র সুদৃঢ় ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কয়েক দফা হামলায় পাকিস্তানী বাহিনী আত্মরক্ষার জন্য এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, সেই সুযােগে মাত্র মাইল দশেক দক্ষিণে মিত্রবাহিনীর পক্ষে মেঘনা নদী অতিক্রম করে হেলিকপ্টারে রায়পুর ও নরসিংদী এলাকায় ছত্রীসেনা নামানাে সম্ভব হয়েছিল। সংক্ষেপে এই হচ্ছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্মের গােড়ার কথা।
দেশ স্বাধীন হবার পর স্বাধীনতাযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান রাখার জন্য বিমান বাহিনীর মােট ১৫ জন পাইলটকে বাংলাদেশ সরকার খেতাব প্রদান করে। এরমধ্যে ৬ জনই বাংলাদেশ বিমানের। এঁরা হচ্ছেন ঃ ১. ফ্লাঃ লেঃ মতিউর রহমান বীর শ্রেষ্ঠ (শহীদ) ২. এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) এ কে খন্দকার বীরােত্তম ৩. এয়ার ভাইস মার্শাল এম কে বাশার বীরােত্তম ৪. এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) সদরুদ্দীন বীর প্রতীক ৫. এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ বীরােত্তম। ৬. গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলম বীরােত্তম ৭. উইং কমান্ডার (অব) হামিদুল্লাহ খান বীর প্রতীক ৮, স্কোয়াড্রন লিডার (অব) লিয়াকত বীরােত্তম। ৯. স্কোয়াড্রন লিডার (অব) বদরুল আলম বীরােত্তম বাংলাদেশ বিমানের খেতাবপ্রাপ্ত পাইলটদের তালিকা হচ্ছে (১) ক্যাপ্টেন শরফুদ্দীন বীরােত্তম, (২) ক্যাপ্টেন খালেক বীর প্রতীক, (৩) ক্যাপ্টেন শাহাব বীরােত্তম, (৪) ক্যাপ্টেন আকরাম বীরােত্তর, (৫) ক্যাপ্টেন মুকিত বীর প্রতীক এবং (৬) ক্যাপ্টেন সাত্তার বীর প্রতীক ১৯৭১ সালের আর একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যখন ৯১,৫৪৯ পরাজিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পক্ষে ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লেঃ জেনারেল এ একে নিয়াজী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে দস্তখত করছিলাে, সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তৎকালীন বিমান বাহিনী প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। এটা ইতিহাসের বিরল সম্মান।
সূত্রঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল