You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের প্রেরণা - সংগ্রামের নোটবুক
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের প্রেরণা
আমরা প্রায়শই ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’ এবং মুক্তিযুদ্ধ’ এই দু’টি শব্দ একই অর্থে ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু সত্যিকারভাবে বলতে গেলে এ দুটির মধ্যে অর্থের কিছুটা ‘ফারাক’ বিদ্যমান। অবশ্য স্বাধীনতাযুদ্ধ’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দ দুটি হচ্ছে একে অপরের সম্পূরক । গবেষকদের মতে মুক্তিযুদ্ধের শুরুটা হয়েছে ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ প্রথম ভাষা আন্দোলন থেকে। এরপর কয়েক দশক ধরে অত্র ভূখণ্ডের শােষিত জনগােষ্ঠীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে একটার পর একটা যেসব বিক্ষোভ, আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও রক্তাক্ত যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে— সবই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের এক বিরাট ও বিশাল প্রক্রিয়ার অংশ বিশেষ। আজও পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। উপরন্তু গত অর্ধশতাব্দী ধরে অত্র ভূখণ্ডে সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্নভাবে যে সর্বাত্মক আন্দোলন চলছে, সেটাও এই মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্ভুক্ত মােদ্দা কথায় বলতে গেলে বাংলাদেশের আপামর জনগােষ্ঠীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক মুক্তিই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আর এই মুক্তিযুদ্ধের একটা উজ্জ্বল অধ্যায় হচ্ছে ১৯৭১ সালের ৯ মাসব্যাপী স্বাধীনতাযুদ্ধ এজন্যই বলতে হয় যে, বাংলাদেশের বাঙালী জাতির মুক্তিযুদ্ধ এখনাে অসমাপ্ত  ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে আমরা ভৌগােলিক স্বাধীনতা লাভ করেছি; কিন্তু আজও পর্যন্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে একথা বলতে হয় যে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রায় ২১ বছর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়ে ছিলাে। এখানেই শেষ নয়। খন্দকার থেকে খালেদা পর্যন্ত ২১ বছর সময়কালে ক্রমাগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরােধী প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের বাঙালী জাতিসত্তার পরিচয়কে ‘বাংলাদেশী করার ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি এবং রাজাকার আলবদর ও আশামসূদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছে।
 
সর্বোপরি এরই জের হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মৌলিক আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা’কে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। আর পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতা-বিরােধী শক্তি পুনরায় রাজনীতি করার অনুমতি লাভ করেছে। ফলে জাতি হিসেবে আমরা পিছিয়ে পড়েছি এবং সাম্প্রদায়িক গােষ্ঠী ও ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী রাজনৈতিক দলগুলাের বিরুদ্ধে নতুন করে আন্দোলন শুরু করতে হয়েছে। এদিক থেকে পর্যালােচনা করলে একথা বলতেই হয় যে, দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ই জুনের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল হচ্ছে ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের সূচনা। কেননা এই নির্বাচনের মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি আবার ক্ষমতাসীন হয়েছে। ফলে বন্ধুত্বের অবসানে পুনরায় শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মােদ্দা কথাটা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশিত পথে  সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে। সর্বাত্মক লড়াই আর এসব লড়াই-এ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রেরণা এবং শাণিত তরবারি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি নজরুলের কবিতা ও গান কি ধরনের এবং কতটুকু প্রেরণা যােগাতে সক্ষম হয়েছে? একথা স্মরণ রাখা প্রয়ােজন যে, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কর্মকাণ্ড এবং প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিলাে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের আমলে উপরন্তু ধর্মের ভিত্তিতে ‘পাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টি হবার বছর পাঁচেক আগেই ১৯৪২ সালের ১০ই জুলাই তারিখে তিনি দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। অথচ এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার যে, তাঁর রচিত কবিতা ও গান সে আমলে সাধারণ মানুষকে যেভাবে। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শরিক হতে উৎসাহিত করেছিলাে; ঠিক একইভাবে পাকিস্তান ঔপনিবেশবাদের আমলেও নজরুলের কবিতা ও গান পূর্ব বাংলার। আপামর জনগােষ্ঠীকে পাকিস্তানের শােষক ও শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধেও একটার পর। একটা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিলাে। ইংরেজ আমলে নজরুলের লেখনীতে যেভাবে ধর্ম ব্যবসায়ীদের মুখােশ উন্মােচিত হয়েছিলাে; ঠিক একইভাবে পাকিস্তান আমলেও নজরুলের কবিতা ও গানের মাধ্যমে ধর্মীয় মৌলবাদীদের জনগণ। থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়েছিলাে। অবশ্য এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর উচ্চারিত বাঙালী জাতীয়তাবাদের স্নােগান মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলাে।
 
নজরুলের কবিতা ও গান ছিলাে সহায়ক শক্তি সর্বোপরি একথাটা বলতেই হয় যে, সামাজিক অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন লড়াই-এ যুগে যুগে নজরুল সাহিত্য হচ্ছে মােক্ষম হাতিয়ার। আগেই উল্লেখ করেছি যে, ১৯৭১ সালের ৯ মাসে স্বাধীনতাযুদ্ধ সমাপ্ত হলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে নজরুল সাহিত্যের উপাদানগুলােই হচ্ছে আমাদের প্রেরণার উৎস কিন্তু কিভাবে? প্রথমেই অবিভক্ত বাংলার দু’জন মনীষীর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিতে হচ্ছে। এঁদের একজন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। প্রায় সাত দশক আগেকার কথা। ১৯২৯ সালে প্রখ্যাত। সাহিত্যিক এস ওয়াজেদ আলীকে সভাপতি করে কোলকাতায় গঠিত হয়েছিলাে। ‘নজরুল সম্বর্ধনা সমিতি’। এর যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে ‘সওগাতের’ মােহাম্মদ নাসিরউদ্দিন এবং ‘কল্লোল’ পত্রিকার সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাস। এ বছরের ১৫ই ডিসেম্বর কোলকাতার ‘অ্যালবার্ট হলে এই সম্বর্ধনার আয়ােজন করা হয়েছিলাে। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনি সভাপতির ভাষণে বললেন, আজ আমি এই ভেবে আনন্দ অনুভব করছি যে, নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানের। কবি নন, তিনি বাঙলার কবি-বাঙালীর কবি। কবি মাইকেল মধুসূদন খৃষ্টান ছিলেন।  কিন্তু বাঙালী জাতি তাকে শুধু বাঙালী রূপেই পেয়েছিল। আজ নজরুল ইসলামকেও জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। কবিরা সাধারণতঃ কোমল ও ভীরু; কিন্তু নজরুল তা’ নন। কারাগারের শৃংখল পরে বুকের রক্ত দিয়ে তিনি যা লিখেছেন, তা বাঙালীর প্রাণে এক নতুন স্পন্দন জাগিয়ে তুলেছে।” এরপর অভিনন্দনপত্র পাঠ করলেন এস ওয়াজেদ আলী।
এই অভিনন্দনপত্রে অত্যন্ত সংক্ষেপে নজরুল প্রতিভার মূল্যায়ন করা হলাে। এতে বলা হলাে যে, ধুলার আসনে বসিয়া মাটির মানুষের গান গাহিয়াছ তুমি। সে গান অনাগত ভবিষ্যতের। তােমার নয়নসায়রে তাহার ছায়াপাত হইয়াছে। মানুষের ব্যথা বিষে নীল হইয়া সে তােমার কণ্ঠে দেখা দিয়াছে। ভবিষ্যতের ঋষি তুমি, চিরঞ্জীব মনীষী তুমি, তােমাকে আজ আমাদের সবাকার মানুষের নমস্কার।” সেদিন এই অনুষ্ঠনে অনির্ধারিত বক্তা হিসেবে ভাষণ দিয়েছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু নজরুল সাহিত্যের প্রেরণা সম্পর্কে সেদিন শ্রীবসুর মূল্যায়ন ছিলাে সঠিক ও যথার্থ। তিনি বললেন, কারাগারে আমরা অনেকেই যাই, কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে সেই জেল-জীবনের প্রভাব কমই দেখতে পাই। তার কারণ অনুভূতি কম কিন্তু নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ তার লেখার মধ্যে অনেক স্থানে পাওয়া যায়। এতেও বােঝা যায় যে, তিনি একজন প্রাণবন্ত মানুষ তার লেখার প্রভাব অসাধারণ তার গান পড়ে আমার মত বেরসিক লােকেরও জেলে বসে গাইবার ইচ্ছা। হত। আমাদের প্রাণ নেই, তাই আমরা এমন প্রাণময় কবিতা লিখতে পারি না।
 

নজরুলকে ‘বিদ্রোহী’ কবি বলা হয়- এটা সত্য কথা। তার অন্তরটা যে বিদ্রোহী তা স্পষ্টই বােঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব তখন সেখানে নজরুলের গান গাওয়া হবে আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তার গান গাইব। আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই বিভিন্ন প্রদেশের ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু নজরুলের “দুর্গম গিরি কান্তার মরুর” মত প্রাণমাতানাে গান শুনেছি বলে মনে হয় না। কবি নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেটা শুধু তাঁর নিজের স্বপ্ন নয়- সমগ্র বাঙালী জাতির।” নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর বক্তব্যের সবটুকু নয়- আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে বলা যায়। কেননা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ঘটনা পরম্পরায় ইংরেজরা চলে যাওয়ার সময় রাঢ়বঙ্গের বঙ্গভাষীরা নিজেদের পৃথক সিদ্ধান্তে অবাঙালী হিন্দু অধ্যুষিত ভারতীয় ইউনিয়নে যােগদান করেছে এবং তাদের নতুন পরিচয় হয়েছে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে। তাদের জাতীয়তা হচ্ছে ভারতীয়। অন্যদিকে অবিভক্ত বাংলার বৃহৎ অংশ অর্থাৎ গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকার আদি বাঙালী জনগােষ্ঠীর জন্মভূমির নামকরণ হলাে “পূর্ববাংলা’ এবং এই অঞ্চল পাকিস্তান নামক দেশের অন্তর্ভুক্ত হলাে। অবশ্য এই নতুন রাষ্ট্রে বাঙালী জনগােষ্ঠীই হলাে সংখ্যাধিক্য। এরপরেও একটা “কিন্তু রয়ে গেলাে। ইংরেজ রাজত্বের অবসানে নবগঠিত ‘পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে পূর্ববাংলায় বসবাসকারী সংখ্যাগুরু বাঙালী জনগােষ্ঠী যেটাকে  সােবেহ সাদেক” অর্থাৎ ভােরের আলাে মনে করেছিলাে, আসলে তা’ সােবেহ সাদেক ছিলাে না- সেটা ছিলাে ‘সােবেহ কাজের’, অর্থাৎ অন্ধকারের সূচনা। অচিরেই বাঙালীরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাে যে, তারা উপনিবেশবাদের শৃংখলে আবদ্ধ হয়েছে।

 
কিছুসংখ্যক বিশ্বাসঘাতক’ রাজনীতিবিদের সক্রিয় সহযােগিতায় পাকিস্তানের শাসকবর্গ ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বাঙালী জনগােষ্ঠীর উপর রাজনৈতিক বশ্যতা ও অর্থনৈতিক শােষণের জগদ্দল পাথরকে চাপিয়ে দিতে শুরু করেছে। এরই অংশ হিসেবে প্রথমেই বাঙালীদের ভাষার অধিকার হরণের ষড়যন্ত্র । ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে বাঙালী শিক্ষামন্ত্রী জনাব ফজলুর রহমান উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা দেয়ার প্রস্তাব উথাপন করলেন। প্রতিবাদ জানালেন কুমিল্লার সন্তান শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ঢাকায় ছাত্র সমাজ তখন দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ। সমগ্র পূর্ববঙ্গে ১১ই মার্চ পালিত হলাে প্রতিবাদ দিবস’ হিসেবে। এটাই হচ্ছে বাংলাভাষা আন্দোলনের প্রথম দফা। সেদিন বাংলা ভাষার দাবিতে ঢাকার রাজপথে বিক্ষুব্ধ ছাত্র মিছিলে যারা নেতৃত্বদান করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ক্লাসের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন তিনি দিন কয়েকের জন্য কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। এটাই ছিলাে পাকিস্তানী জামানায় তার প্রথম কারাজীবন। তিনি দমবার পাত্র নন। মুক্তিলাভ করেই তিনি ২১শে মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানালেন। আসলে মুক্তিযুদ্ধের শুরুটা এখান থেকেই। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন দেয়ায় শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হলেন। তার ছাত্রজীবনের পরিসমাপ্তি হলাে।
 

এবছরই ঢাকায় একটা ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার সময় মিছিল থেকেই তিনি গ্রেফতার হলেন। এরপর পাকিস্তানের ২৩ বছরে যতগুলাে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে, শেখ মুজিব বারবার সেসব আন্দোলনে গ্রেফতার ও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তার মােট কারাজীবন হচ্ছে প্রায় ১২ বছর ১১ মাসের মতাে এমনকি তিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে দুই দুইবার ফাঁসির আসামী পর্যন্ত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন এক অকুতােভয় ও নির্লোভ ব্যক্তিত্ব কারাগারের সমস্ত রকমের দুঃখকষ্ট তিনি হাসিমুখে বরণ করেছেন। সেক্ষেত্রে শেখ মুজিব তাঁর ইস্পাতকঠিন মনোেবলের অধিকারী হলেন কিভাবে? শুধুই কি হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দীর প্রভাব? পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, মনের প্রশান্তির জন্য রবীন্দ্রকাব্য ও সঙ্গীত ছিলাে শেখ মুজিবের সম্বল। আর স্বীয় মনােবল বৃদ্ধি এবং অনুপ্রেরণার উৎস ছিলাে নজরুল কাব্যসম্ভার। কারাগারের নির্জন কক্ষে তিনি স্বৈরাচারের অত্যাচারকে হাসিমুখে বরণ করার সাহস সঞ্চয় করলেন। রবীন্দ্রকাব্যে তিনি পাঠ করলেন মৃত্যুঞ্জয়ের অভয়বাণী। এরই পাশাপাশি নজরুলের কাব্য পাঠ করে শেখ মুজিবের মনমানস দেশপ্রেমের ফরুধারায় আপুত হলাে। তিনি উজ্জীবিত হলেন বহ্নিশিখায় কারাগারে বসেই তিনি প্রতিনিয়ত একাকী গাইলেন ‘বিষের বাঁশী’ আর ‘ভাঙ্গার গান’।- এই শিকল পরা ছল গাে মােদের, শিকল পরা ছল’ আর কারার ঐ লৌহ কপাট’। তিনি নিয়মিতভাবে পাঠ। করলেন ‘সর্বহারা’ এবং ‘অগ্নিবীণা’র কবিতা।- ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার/লঙ্েিত হবে রাত্রি-নিশিথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার। আর সেই অমর বাণী ;

“মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত,
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রােল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে নাবিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত,
আমি সেই দিন হব শান্ত।”
এই কথাগুলাে বলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পাকিস্তানের তেইশ বছরের রাজনীতিতে শেরে বাংলা ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানী যেখানে বাঙালীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ছিলেন অসমাপ্ত; সেখানে সফল নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অকুতােভয় ও নির্লোভ চরিত্র কিভাবে পূর্ণতা লাভ করলাে, সেটা বােঝাবার জন্যই আলােচ্য বিষয়গুলাের অবতারণা করতে হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ডিক্টেটর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের আমলেই ১৯৬১ সালে শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং ১৯৬৩ সালে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ইন্তেকাল করেন। অন্যদিকে ভাসানী-মুজিব জুটির নেতৃত্বে ১৯৪৮ সাল থেকেই গণমানুষের রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াই অর্থাৎ সার্বিক অর্থে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের পর থেকে বছর কয়েকের জন্য মওলানা সাহেব প্রগতিশীলদের ভিন্ন মঞ্চে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং ছেষট্টির ৬-দফা আন্দোলনে শরিক হতে পারেননি। কিন্তু ঊনসত্তরের আইয়ুব বিরােধী গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে মওলানা ভাষাণী বাঙালী জাতীয়তাবাদ শক্তির গার্জিয়ানের  ভূমিকা পালন করে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন কারাগারে ফাঁসির আসামী। 
তবে এর পাশাপাশি একটা কথা বলতেই হয় যে, পাকিস্তানের তেইশ বছরে অর্থাৎ যে সময়কালকে মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সে সময় সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মতাে একটার পর একটা যেসব আন্দোলন, সংগ্রাম ও গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, তাতে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে এদেশের ছাত্র ও যুব সমাজ। ভাসানীমুজিব ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এঁরাও প্রতিটি আন্দোলনে স্বৈরাচারী পুলিশের হাতে নিগৃহীত হয়েছে এবং লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস ও গুলির মােকাবিলা করা | ছাড়াও হাজারে হাজার কাবাবরণ করেছে। ১৯৪৮ সালের প্রথম ভাষা আন্দোলন থেকে  শুরু করে ১৯৭১-এর অসহযােগ আন্দোলন পর্যন্ত কোথাও এর সামান্যতম ছন্দপতন পর্যন্ত হয়নি। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই ছাত্র ও যুব সমাজের মধ্যে এ ধরনের কঠোর ও আপােসহীন মনােবল সৃষ্টি হলাে কিভাবে? গবেষণা করলে দেখা যায় যে, আলােচ্য। সময়কালে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং জাতীয়তাবাদী, প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের ব্যাপক প্রচারের পাশাপাশি এতদাঞ্চলে এই বছরগুলােতে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিলাে মূলতঃ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কাব্য ও সঙ্গীতকে ভিত্তি করে। রবীন্দ্র দর্শনের ভাবধারা যেমন সে আমলে আমাদের ছাত্র ও যুব সমাজকে মানব প্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিলাে; তেমনি বিদ্রোহী কবি নজরুলের কাব্য ও সঙ্গীত আমাদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করা ছাড়াও আপােসহীন সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিলাে। নজরুল জীবনের প্রেমও তাে’ উদ্দাম, উচ্ছল ও বাঁধনহারা! উপরন্তু তাঁর লেখনীতে সর্বহারার জয়গাঁথা।
“জয় নিপীড়িত প্রাণ!
জয় নব অভিযান!
জয় নব উত্থান!”
এসব কিছু সেদিন আমাদের ছাত্র ও যুব সমাজকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিলাে। এঁদের কাছে অকুতােভয় শেখ মুজিব ছিলেন তারুণ্যের প্রতীক আর প্রতিবাদের সােচ্চার কণ্ঠস্বর । গবেষকদের মতে পাকিস্তানের তেইশ বছরে স্বৈরাচারী শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে যখন ভাসানী-মুজিবের নেতৃত্বে ছাত্র ও যুব সমাজ পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাে, তখন তাদের মােকাবিলায় সরকারী ছত্রছায়ায় ধর্মীয় মৌলবাদী নেতৃবৃন্দ শশাচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ একটাই এবং তা’ হচ্ছে পূর্ব বাংলার জনগােষ্ঠী। ধর্মভীরু নিশ্চয়ই কিন্তু তারা ধর্মান্ধ নয়। এই নিপীড়িত জনগােষ্ঠী ভয়াবহ অর্থনৈতিক বৈষম্যের অভিজ্ঞতার জের হিসেবে ধর্মীয় রাজনীতিবিদদের বিপরীতে জাতীয়তাবাদী ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দের বক্তব্যকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলাে। অত্র ভূখণ্ডে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনী ফলাফল এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এক্ষণে পাকিস্তানের মতাে একটা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে কোন্ প্রেক্ষাপটে এবং কিভাবে অত্যন্ত সন্তর্পণে পূর্ব বাংলা বাঙালী জাতীয়তাবাদের দর্শনের বিস্তৃতি লাভ করলাে, তা’। পর্যালােচনা করা অপরিহার্য মনে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইংরেজ আমলে গবেষকরা যে পরিধি নির্ণয় পূর্বক বাঙালী জাতীয়তাবাদের সংঙ্গা দান করেছিলাে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালী জাতীয়তাবাদ সেটা থেকে বেশ কিছুটা ভিন্নতর। আগেই উল্লেখ করেছি যে, রাঢ়বঙ্গের বঙ্গভাষীরা ১৯৪৭ সালে স্বীয় সিদ্ধান্তে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে। পূর্ব বাংলার সংখ্যাধিক্য বাঙালী মুসলমানদের তুলনায় ওঁরা ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে অবাঙালী হিন্দুদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বহু বর্ণের ভারতীয় জাতীয়তাকে। বরণ করে নিয়েছে। ওঁরা বঙ্গভাষী নিশ্চয়ই-কিন্তু বাঙালী নন। ওঁদের জাতীয়তা ভারতীয় । যেমন নিউজিল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের মাতৃভাষা ইংরেজী হওয়া সত্ত্বেও ওঁরা ইংরেজ নয়- ঠিক তেমনিভাবে ওপার বাংলার জনগােষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা।
হওয়া সত্ত্বেও ওঁরা ভারতীয়। এটাই হচ্ছে বর্তমান শতাব্দীর এক চরম ট্র্যাজেডি’  ওঁরা চিন্তাও করতে পারেন নি যে, প্রথমে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান এবং মাত্র ২৩ বছরের ফারাকে একটা রক্তাক্ত যুদ্ধে পাকিস্তান’ খণ্ডিত হয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম। বাংলাদেশের অভ্যুদয় হবে। এটা কেমন করে সম্ভব হলাে? এক কথায় বলতে গেলে বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষা এবং আন্দোলন ও আত্মদানের ফসল হচ্ছে এই বাংলাদেশ। হিসাব করলে দেখা যায় যে, ‘পাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্রে বাঙালীরা সংখ্যাধিক্য হওয়া সত্ত্বেও ১৯৪৮ সালে যখন। কেবলমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র প্রকাশ পেলাে, তখন প্রথম ভাষা আন্দোলনের মাঝ দিয়ে পূর্ববাংলার জনগােষ্ঠীর মধ্যে স্বাতন্ত্র্যবােধের সঞ্চয় হলাে। ১৯৫২ যখন পুনরায় শুধুমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার সরকারী সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা। হলাে, তখন বায়ান্নর রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলনের দরুন সেই স্বাতন্ত্র্যবােধ আরাে জোরদার হলাে। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটলাে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে। ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক দল মুসলিম লীগ কার্যতঃ পূর্ববঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলাে। এরই জের হিসেবে। যখন ১৯৫৫ সালে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম পরিবর্তন। অন্তে ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ’ করা হলাে, তখন পূর্ব বাংলায় বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষের সূচনা পর্ব কেননা ধর্মনিরপেক্ষতাই হচ্ছে, জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্ব শর্ত। এরই পাশাপাশি পঞ্চাশ দশকে আওয়ামী লীগের মঞ্চ থেকে যখন কেন্দ্রীয় পাকিস্তানী শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপিত হলাে, তখন জাতীয়তাবাদের দাবি হলাে সুপ্রতিষ্ঠিত। এরই মােকাবেলায় আইয়ুব খানের সামরিক শাসন যেটুকু গণতন্ত্র অবশিষ্ট ছিলাে; তার সমাধি রচিত হলাে।
তখন চারদিকে ভয়াবহ দমননীতির স্টীমরােলার। ফলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রক্রিয়া। সাময়িকভাবে স্তব্ধ হলাে। কিন্তু তথাকথিত গণতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে দীর্ঘ ৪৪ মাস পরে ১৯৬২ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে পূর্ববঙ্গে জাতীয়তাবাদী শক্তি আবার প্রতিবাদ মুখর হলাে। ১৯৬৫ সালে ১৭ দিনব্যাপী পাক-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষিতে পূর্ববাংলার রাজনীতির  পুরা চেহারাটাই বদলে গেলাে। ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহােরে অনুষ্ঠিত বিরােধী। দলীয় বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে আরাে একধাপ এগিয়ে ঘােষণা করলেন বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ৬-দফা। তার হৃদয়ে তখন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অভয় বাণী “বাংলার জয় হােক। বাংলা বাঙালীর হােক।” এরই প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিব গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকার বাঙালী জনগােষ্ঠীর জন্য । উচ্চারণ করলেন নতুন স্লোগান- “জয় বাংলা!” অচিরেই পূর্ব বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিধ্বনিত হলাে এই স্লোগান। “জয় বাংলা” স্লোগানে মুখরিত পূর্ব বাংলার প্রান্তর। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের একাকী নেতৃত্বে পরিচালিত হলাে ৬-দফা আন্দোলন।
১৯৪৮ সালের প্রথম ভাষা আন্দোলনে যার জন্ম হয়েছিলাে, মাত্র দুই দশক সময়কালের মধ্যে সেই বাঙালী জাতীয়তাবাদ বিরাট মহীরুহতে পরিণত হলাে।  এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। বাঙালী জাতীয়তাবাদ শক্তির প্রক্রিয়াকে বন্ধ করার লক্ষ্যে দায়ের করা হলাে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। কিন্তু পুরাে ব্যাপারটাই হলাে বুমেরাং। পূর্ব বাংলার বাঙালী জনগােষ্ঠির হৃদয়পটে তখন স্বাধীনতার হাতছানি তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন’-কথাটা পূর্ব বাংলায় তেমন কোনাে জনমত গঠন করতে ব্যর্থ হলাে । বরং শুরু হলাে আইয়ুব বিরােধী রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থান। তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং রাওয়ালপিণ্ডিতে গােলটেবিল বৈঠক করেও আর কোনাে ফায়দা হলাে না। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৬-দফা দাবিতে অটল রইলেন। ফলে ১৯৬৯ সালের ২৪শে মার্চ ডিক্টেটর আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হলেন।
এবার ক্ষমতায় এলেন আরেক সামরিক ডিক্টেটর জেনারেল ইয়াহিয়া খান। পশ্চিম পাকিস্তানকে শান্ত করার জন্য তিনি এক ইউনিট ব্যবস্থাকে ভেঙে দিলেন। আর পুর্ব। বাংলার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে এক মাথা এক ভােট’-এর ভিত্তিতে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের গােষণা দিলেন। ফলে প্রস্তাবিত ৩১৩ জন সদস্য বিশিষ্ট গণপরিষদের পূর্ববাংলার হিস্যা দাঁড়ালাে ১৬২ + ৭ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ১৩৮ + ৬ জন সদস্য। আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে কোনাে আসনে প্রতিদ্বন্দিতা না করায় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের জন্য প্রয়ােজন হলাে ১৫৭টি আসনের সত্তরের নির্বাচনে প্রতিটি জনসভায় বঙ্গবন্ধু উপস্থাপিত করলেন তাঁর ৬-দফা দাবি আর ব্যাখ্যা করলেন গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকার বাঙালী জাতীয়তাবাদের মর্মবাণী। তিনি জোর দিয়ে ঘােষণা করলেন, “ধর্ম-নিরপেক্ষতা মানে ‘ধর্মহীনতা’ নয়। ফলে ধর্মীয় দলগুলাের ফতােয়া আর বামপন্থীদের নানা তত্ত্বকথা- কিছুই কাজে আসলাে না। জনগণের রায় বাঙালী জাতীয়তাবাদের পক্ষে। আওয়ামী লীগ ১৬০ + ৭ একুনে ১৬৭টি আসন লাভ করলাে।  সামরিকজান্তা প্রমাদ গুনলাে। নানা বাহানায় ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে জঙ্গী। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ববাংলায় গণহত্যা শুরু হলে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করলেন। সেদিনের তারিখটা ছিলাে ২৬শে মার্চ। নির্বাসিত মুজিবনগর সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে। বাংলাদেশ হলাে স্বাধীন ও সার্বভৌম এবং ৯১ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য তখন যুদ্ধবন্দী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৩ বছরের স্বপ্ন হলাে সার্থক। 
তা’হলে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বে পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালী জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে আমরা নজরুলের কবিতা ও গান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছি। এই পর্বে সময়ের প্রয়ােজন হয়েছিলাে প্রায় তেইশ বছর। এরপর মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বে অর্থাৎ ৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়েও আমরা নজরুল সঙ্গীতের কথা ও সুরের মূর্হনায় দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছি এবং অকুতােভয়ে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। এজন্যই বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, মুজিবনগর সরকারের তত্ত্বাবধায়নে স্বাধীন বাংলা। বেতারকেন্দ্রের শুরুটা হয়েছিলাে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের ৭৩ তম। জন্মবার্ষিকীতে। বাংলা ১৩৭৮ সনের ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ইংরেজী ১৯৭১ সালের ২৫শে মে  রােজ মঙ্গলবারে এদিন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে টেপে ধারণকৃত প্রথম যে | সঙ্গীত প্রচারিত হয়েছিলাে সেটাই হচ্ছে নজরুলের অমর সঙ্গীত “দুর্গম গিরি কান্তার মরু এরপর আরাে যেসব নজরুল গীতি প্রচারিত হলাে সেগুলাে হচ্ছে, “আজ সৃষ্টি। সুখের উল্লাসে”, “একি অপরূপ রূপে মা তােমায়, হেরিনু পল্লীজননী”, “ও ভাই খাঁটি | সােনার চেয়ে খাঁটি, আমার দেশের মাটি”, কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল করে।  লােপাট” ইত্যাদি। শেষ অবধি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় হলাে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। গণতান্ত্রিক বিশ্বের ক্রমাগত চাপে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি তিনি ফিরে এলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে এবং ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে নতুন সরকারের দায়িত্ব। গ্রহণ করলেন। কেননা বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে তখন পর্বত প্রমাণসমস্যা বঙ্গবন্ধুর সরকার সমস্ত সাফল্যের সঙ্গে পরিস্থিতির মােকাবিলা করলাে।  দেশকে পুনর্গঠনের পাশাপাশি দ্রুত সংবিধান প্রণয়ন ছাড়াও বঙ্গবন্ধু সরকার জাতীয় পতকা, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় ফল-ফুল ইত্যাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাে। বঙ্গবন্ধু স্বয়ং উদ্যোগ গ্রহণ করে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘােষণা করা ছাড়াও কবির রচিত “চল্ চল্। চল, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল” গানটিকে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর মার্চিং সঙ্গীত হিসেবে মর্যাদা দান করলেন। এখানে শেষ নয়। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থ কবির প্রয়ােজনীয় চিকিৎসা ও শুশ্রুষার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলেন। ১৯৭২ সালের ২৪শে মে তারিখে দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় এসে পৌছালেন বাংলাদেশ সরকার জাতীয় কবির সেবাশুশ্রুষা এবং আহার-বাসস্থান সবকিছুর দায়িত্ব গ্রহণ করলাে।  নিয়তির পরিহাসই বলতে হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভাের রাতে।
ষড়যন্ত্রকারীদের হামলায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সময়  বিদ্রোহী কবি ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু তিনি আর বাসায় ফিরে যেতে পারেননি। ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট তিনিও ইন্তেকাল করলেন।  কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এখনাে অসম্পূর্ণ তৃতীয় ও চূড়ান্ত পর্বের কর্মকাণ্ড ২১ বছরের ব্যবধানে সবেমাত্র শুরু হয়েছে। এই কর্মকাণ্ড হচ্ছে বাংলাদেশের আপামর জনগােষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার লড়াই কেবলমাত্র সেক্ষেত্রেই নজরুলের প্রেরণায় বঙ্গবন্ধুর সােনার বাংলা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে।
 
 

সূত্রঃ   একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল