You dont have javascript enabled! Please enable it! 1956 | ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের মােকাবিলায় শেখ মুজিব - সংগ্রামের নোটবুক
ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের মােকাবিলায় শেখ মুজিব
Ayub Khan engulfed the power and declared that he would submit files for corruption against the political figures and whoever acknowledges that can not participate in election for five years and have to resign from politics. 43 politicians were listed and surprisingly Sheikh Mujib’s name was not in that list! Why? Because he didn’t acknowledge. He dared to face the court. Eight years later, Ayub Khan took another action filing a case against 35 persons where Sheikh Mujib’s name came on top! What was to role of Bhashani? Why did he asked China not to disturb Ayub? Please read this article written in Bangla for the details.
সত্যি কথা বলতে কি অখণ্ড পাকিস্তানের ২৪ বছরের (১৯৪৭-১৯৭১) রাজনৈতিক ইতিহাস আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী এমন ওতপ্রােতভাবে জড়িত যে, তা পৃথক করা সম্ভব নয়। পাকিস্তানের এই ইতিহাস যেমন বিরাট, ঠিক তেমনিভাবে শেখ মুজিবের কর্মময় জীবনও বিশাল। সবটুকু বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আজকের প্রতিবেদন এর অংশবিশেষ মাত্র। এই অধ্যায় হচ্ছে, ষাট দশকে পাকিস্তানের “লৌহমানব’ হিসাবে কথিত ফিল্ড মার্শাল মােহাম্মদ আইয়ুব খানকে পূর্ব বাংলার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিভাবে মােকাবিলা করেছিলেন, তারই চাঞ্চল্যকর ইতিহাস। আমি ১৯৫৮ সালের কথা বলছি। তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রীম কমান্ডার ছিলেন অনারারী মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা। ইনি ছিলেন আদিতে মুর্শিদাবাদের নবাব মীরজাফরের বংশধর এবং শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এহেন প্রেসিডেন্ট মির্জা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করলেন। ঘােষণায় বলা হলাে যে, (ক) ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল (খ) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলাে বরখাস্ত (গ) সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলাে বেআইনী এবং (ঘ) জাতীয় পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক পরিষদগুলাে খারিজ করা হলাে। এখানেই শেষ নয়। তিনি সুপ্রীম কমাণ্ডারের দায়িত্ব প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খানের উপর ন্যস্ত করে তাকেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে ঘােষণা দিলেন। এতেই কাল হলাে। মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর গভীর রাতে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হলেন। তাকে এক বস্ত্রে সস্ত্রীক করাচী বিমানবন্দরে একটা লন্ডনগামী প্লেনে উঠিয়ে দেয়া হয়।
এরপর তিনি আর পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করতে পারেননি। লন্ডনেই তার ইন্তেকাল এবং তেহরানের উপকণ্ঠে একটা গােরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।  এদিকে আইয়ুব খান পুরােপুরিভাবে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বেশ কটি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। এসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজনীতিবিদদের শায়েস্তা করার লক্ষ্যে “দি ইলেকটিভ বডি ডিস্কোয়ালিফিকেশন অর্ডার’ জারি করলেন। সংক্ষেপে এই নাম “এবডাে”। এটাই ছিল প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার ১৩। এতে এ মর্মে বলা হয়েছিল যে, তদন্তের পর বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কথিত দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার সংক্রান্ত অভিযােগ উত্থাপনপূর্বক চিঠি দেয়া হবে। যারা অভিযােগ স্বীকার করবেন, তাদের পরবর্তী ৫ বছর কোন রকম নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে দেয়া হবে না। অর্থাৎ ৫ বছরের জন্য এঁরা স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন বলে প্রদত্ত জবাবকে “মুচলেকা” হিসাবে গ্রহণ করা হবে অন্যথায় উক্ত রাজনীতিবিদদের বিচারের জন্য সােপর্দ করা হবে।
 
এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার যে, পূর্ববঙ্গের রাজনীতিবিদদের মধ্যে সর্বজনাব আতাউর রহমান খান, আবু হােসেন সরকার ও কফিলউদ্দীন চৌধুরী (ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পিতা) থেকে শুরু করে কমরেড মােহাম্মদ তােয়াহা এবং সৈয়দ আলতাফ হােসেন (কুষ্টিয়া) পর্যন্ত মােট ৪৩ জন রাজনীতিবিদকে এবভাে’ করলেও একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের নাম এই তালিকায় অনুপস্থিত। কারণ একটাই এবং তা হচ্ছে, শেখ মুজিব কোনাে অপরাধ স্বীকার করেন নি। তিনি কোর্টে বিচারের মােকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সে এক অদ্ভুত মামলা। ১৯৫৬-৫৭ সালে পূর্ববঙ্গে আতাউর রহমান মন্ত্রিসভায় শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীন শেখ মুজিব গােটা কয়েক বস্ত্রমিলের সরকারী অনুমতি ‘ইস্যু’ করার সময় কোন অনিয়ম করেছিলেন কি না। এসময় কোর্টে মামলার প্রধান সাক্ষী হিসাবে হাজির করা হলাে প্রাদেশিক সরকারের তৎকালীন শিল্প বিভাগের ডিরেক্টর জনাব রুহুল কুদ্স সিএসপিকে। বিচার্য ছিলাে, শিল্প বিভাগ থেকে প্রয়ােজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষার পর বস্ত্র মিলের অনুমতি দেয়ার লক্ষ্যে শিল্প ডিরেক্টরের দস্তখতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল, তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, সেই তালিকায় কোনরকম রদবদল করেছেন কিনা সাক্ষী রুহুল কুদ্স সাহেব নিবিষ্ট মনে ফাইল দেখে এ মর্মে বললেন যে, মন্ত্রীমহােদয় তালিকার কোন রদবদল করেননি। এবং তালিকা হুবহু অনুমােদন করেছেন।
ফলে শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতির মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেলেন এবং তাকে “এবডাে করাও সম্ভব হলাে না। অবশ্য তাঁকে নিরাপত্তা আইনে আটক রাখা হলাে। এখানে উল্লেখ্য যে, সেদিন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী রুহুল কুদুসের গুরুত্বপূর্ণ। সাক্ষীর দরুন শেখ মুজিবকে দুর্নীতির মামলায় সাজা দিতে ব্যর্থ হওয়ায়, আইয়ুব খানের জঙ্গী সরকার রুহুল কুদুসের উপর দারুণভাবে ক্ষিপ্ত হয়েছিল। এরই ফলে দীর্ঘ ৮ বছর পর সেই আইয়ুব সরকারই যখন শেখ মুজিবকে ১নং বিবাদী করে মােট ৩৫ জন বাঙালী সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করলাে, তখন আমরা জনাব রুহুল কুদ্স সিএসপি’কে ১০ নং বিবাদী হিসাবে দেখতে পেলাম। আমার সৌভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আলােচ্য দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলা এবং তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলা এই দুটো মামলার রিপাের্ট সংগ্রহের জন্য সাংবাদিক হিসাবে আমাকে প্রতিদিন কোর্টে হাজির থাকতে হতাে। এদিকে দীর্ঘ ১৪ মাস পরে ১৯৫৯ সালের একেবারে শেষ ভাগে শেখ মুজিবের মুক্তিলাভ এবং পুনরায় জেল গেটেই গ্রেফতার হাইকোর্টে রীট আবেদনে মুক্তিলাভ ১৯৬০ সাল নাগাদ সমগ্র পাকিস্তানে, বিশেষ করে পূর্ব বাংলায় এক ভয়াবহ অবস্থা বিরাজমান।
 
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হয় গ্রেফতার-না হয় এবডাে’ রাজনৈতিক কর্মীরা হয় কারাগারে-না হয় পলাতক সভা-শােভাযাত্রা আর বিক্ষোভ প্রদর্শন বেআইনী এবং সংবাদপত্রগুলাের ‘টু’ শব্দ করার সাধ্য নেই পুলিশের দুর্ধর্ষ আইজি জাকির হােসেন তখন পূর্ববঙ্গের গভর্নর। এমনি এক অবস্থায় সামরিক জান্তার মাথায় নতুন দুশ্চিন্তা সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রাক্কালে নতুন সংবিধানের প্রয়ােজন। অবশ্য এমনভাবে সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে, যাতে আইয়ুব খান সিভিলিয়ান প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারে। এজন্যই ‘মৌলিক গণতন্ত্রী মার্কা’ সংবিধান এতে জনগণের ভােটাধিকার হরণ করা হলাে। পূর্ব বাংলায় ৪০ হাজার এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার একুনে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীকে সদস্য করা হলাে। এরাই প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচনের ভােটারের দায়িত্ব পালন করবেন। উপরন্তু পূর্ববাংলার যে কোন বিক্ষোভ দমনের জন্য নয়া গভর্নর হিসাবে জেনারেল আজম খানকে ১৯৬০ সালের ১৫ এপ্রিল ঢাকায় পাঠানাে হলাে। অবশ্য এর আগেই ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান একমাত্র প্রার্থী হিসাবে মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভােটে নিজেকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট দাবি করলেন। পূর্ববঙ্গের ছাত্র সমাজে তখন ধূমায়িত অসন্তোষ ১৯৬১ সালের উল্লেখযােগ্য ঘটনা হচ্ছে, ২৭ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেরে বাংলা ফজলুল হকের ইন্তেকাল এবং জুলাই মাসে আইয়ুব খানের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর। ১৯৬২ সালের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা হচ্ছে পূর্ববঙ্গের গভর্নর জেনারেল আজম। খানের পরামর্শকে অগ্রাহ্য করে ৩১ জানুয়ারি করাচীতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হােসেন। শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার প্রতিবাদে ১১ মার্চ আজম খান গভর্নরের পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। কিন্তু আইয়ুব খান তার নীলনক্সা মােতাবেক স্বীয় কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখলেন। ১৯৬২ সালের ৮ জুন ৪৪ মাসব্যাপী সামরিক শাসনের অবসানে ‘গণতন্ত্রে’ উত্তরণের প্রাক্কালে তিনি আরও কিছু সাবধানতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। এসবের মধ্যে শেখ মুজিবের গ্রেফতার অন্যতম। তবে দিন দশেকের মধ্যে ১৮ জুন তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু শত অত্যাচারেও মুজিবকে দমানাে সম্ভব হলাে না। ৫ জুলাই পল্টন ময়দানের জনসভায় তিনি প্রকাশ্যে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের গণবিরােধী কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালােচনা করলেন।
 
এ বছরের আরও দু’টি উল্লেখযােগ্য ঘটনা হচ্ছে, সব কটি বিরােধী দলের মাের্চা “এনডিএফ” গঠন এবং হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ১৭ সেপ্টেম্বর সমগ্র পূর্ববঙ্গে হরতাল এবং ব্যাপক বিক্ষোভ ও পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের দফায় দফায় সংঘর্ষ ১৯৬৩ সালে ঘটনা পরম্পরায় পাকিস্তানের রাজনীতিতে ত্ৰিশংকু অবস্থার সৃষ্টি হলাে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট শিবিরে রুশ-চীন বিরােধের দ্রুত অবনতির প্রেক্ষিতে পূর্ববাংলায় মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসীদের মধ্যে শুরু হলাে ব্যাপক ভাঙ্গনের প্রক্রিয়া। রুশ-সমর্থকরা আইয়ুব-বিরােধী ক্যাম্পে অবস্থান নিলেও চীনপন্থীদের অবস্থান হলাে এর বিপরীতে এঁরা রুশ-ভারত সখ্যতাকে “সম্প্রসারণবাদ” হিসাবে চিহ্নিত করলাে। ফৌজি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এই সুযোেগ গ্রহণ করলেন তিনি গােপন যােগাযােগের  মাধ্যমে মওলানা ভাসানীর চীন সফরের ব্যবস্থা করলেন। এ সময় ভারত বিরােধী দৃষ্টিকোণ থেকে চেয়ারম্যান মাও-সে-তুং-এর অনুরােধে মওলানা সাহেব DON’T DISTURB AYUB (আইয়ুবকে বিরক্ত কর না) নীতি গ্রহণ করলেন। এদিকে আর এক দুঃসংবাদ এসে পৌঁছলাে। ইউরােপের জুরিখ হাসপাতালে তলপেটে অপারেশনের পর দেশে ফেরার পথে বৈরুতের এক হােটেলে অবস্থানকালে ‘রহস্যজনকভাবে’ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ইন্তেকাল  পূর্ববঙ্গের সর্বত্র বিষাদের ছায়া কিন্তু বসে থাকলে চলবে না। ৪৪ বৎসর বয়স্ক শেখ মুজিবকেই তখন আইয়ুববিরােধী আন্দোলন পরিচালনার মূল দায়িত্ব নিতে হলাে। প্রথমেই তার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, মােটামুটিভাবে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে গঠিত ‘অকেজো এনডিএফ’ নিয়ে কিছুতেই আন্দোলন করা সম্ভব নয়। অতএব অনতিবিলম্বে শেখ মুজিব দলবলসহ ‘এনডিএফ’ ত্যাগ করলেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হলাে। মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হলেন অবশ্য স্বল্প দিনের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ কাউন্সিল।
 
অধিবেশনে পার্টির সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন শেখ মুজিবুর রহমান আর সাধারণ সম্পাদক পদে তাজউদ্দিন আহমদ। শুরু হলাে মুজিব-তাজউদ্দিনের যুগ। বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং বিরাট প্রতিভাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ইন্তেকাল আর আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলন থেকে সাময়িকভাবে মওলানা ভাসানীর সরে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ষাট দশকের মাঝামাঝি সময়ে একজন সাংবাদিক হিসাবে আমার মনে হলাে পূর্ববাংলা তথা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে পূর্ণ অবয়বে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের আবির্ভাব হতে যাচ্ছে। ইনিই হচ্ছেন ত্যাগ ও তিতিক্ষার মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমান। অচিরেই এর প্রমাণ দেখতে পেলাম। পূর্ববঙ্গের তখন বড়ই দুঃসময়। জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মােহাম্মদ আইয়ুব খানের দোর্দণ্ড প্রতাপ অবাঙালী শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী এবং সামরিক ও বেসামরিক গােষ্ঠীর শাসন ও শােষণে বাঙালী জনগােষ্ঠীর জীবন ওষ্ঠাগত এসবই হচ্ছিল ধর্মীয় স্লোগানের আড়ালে। এটা এমন একটা সময়, যখন সম্মিলিত বিরােধীদলীয় মাের্চা। ‘এনডিএফ’ মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে; রুশ-চীন তীব্র মতবিরােধের জের হিসাবে পূর্ববঙ্গে প্রগতিশীল ও মার্কসিস্ট শিবির দ্বিধা-বিভক্ত; এবং সর্বোপরি আইয়ুব বিরােধী আন্দোলনে মওলানা ভাসানীর অনীহা সংবাদপত্রের কণ্ঠরােধের জন্য ১৯৬৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জারী হলাে প্রেস ও পাবলিকেশনস অর্ডিন্যন্স। এখানেই শেষ নয়।
ঠিক এমনি এক সময়ে পূর্ববঙ্গের সরকার-বিরােধী আন্দোলনকে বিপথগামী করার লক্ষ্যে কুখ্যাত গভর্নর মােনেম খা’র পৃষ্ঠপােষকতায় ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহীতে শুরু হলাে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সেদিনের কথা আমার আজও স্পষ্ট মনে রয়েছে। শেখ মুজিব এবং জনাকয়েক বিরােধীদলীয় নেতা এসে হাজির হলেন ঢাকা প্রেসক্লাবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধের উপায় বের করতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে এখানেই গঠিত হলাে “পূর্ব | পাকিস্তান দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি।” শেখ মুজিব উপস্থিত সাংবাদিকদের সহযােগিতা কামনা করলেন। প্রেসক্লাবে বসেই একটা প্রচারপত্রের মুসাবিদা করা হলাে। অবিলম্বে এটা ছাপিয়ে বিলির ব্যবস্থা ছাড়াও পরদিন নেতৃস্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলােতে ব্যানার হেড লাইনে ছাপাবার ব্যবস্থার দায়িত্ব দেয়া হলাে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর। দাঙ্গা বিধ্বস্ত ঢাকা নগরীতে শেখ মুজিব স্বয়ং দৌড়ালেন দৈনিক আজাদের মওলানা আকরাম খাঁ, পাকিস্তান অবজারভারের হামিদুল হক চৌধুরী  আর দৈনিক ইত্তেফাকের তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়ার কাছে। সবাই প্রস্তাবে রাজী হলেন। ১৯৬৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকার দৈনিক পত্রিকাগুলােতে ফলাও করে প্রকাশিত হলাে সেই ঐতিহাসিক প্রচারপত্র। শিরােনাম ছিল “পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও”। প্রচারপত্রটি ছিল নিম্নরূপ : 
 
পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও
 
“সাম্প্রদায়িক দুবৃত্তদের ঘৃণ্য ছুরি আজ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানের শান্ত ও পবিত্র পরিবেশ কলুষিত করিয়া তুলিয়াছে। ঘাতকের ছুরি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পূর্ব বাংলার মানুষের রক্তে লাল হইয়া উঠিয়াছে। দুবৃত্তদের হামলায় ঢাকায় প্রতিটি পরিবারের শান্তি ও নিরাপত্তা আজ বিপন্ন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি পােড়ানাে হচ্ছে, সম্পত্তি বিনষ্ট করা হচ্ছে। এমনকি জনাব আমীর হােসেন চৌধুরীর মতাে শান্তিকামী মানুষদেরও দুবৃত্তদের হাতে জীবন দিতে হচ্ছে। তাদের অপরাধ কি ছিল একবার চিন্তা করিয়া দেখুন। গুণ্ডারা মুসলমান ছাত্রীনিবাসে হামলা করিয়াছে। এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আমাদের মা-বােনের সম্ভ্রম আজ মুষ্টিমেয় গুপ্তার কলুষস্পর্শে লাঞ্ছিত হইতে চলিয়াছে।  “এই সর্বনাশা জাতীয় দুর্দিনে আমরা মানবতার নামে, পূর্ব পাকিস্তানের সম্মান ও মর্যাদার নামে দেশবাসীর নিকট আকুল আবেদন জানাইতেছি’ আসুন সর্বশক্তি লইয়া গুণ্ডাদের রুধিয়া দাঁড়াই, শহরে শান্তি ও পবিত্র পরিবেশ ফিরাইয়া আনি। “পূর্ব বাংলার মানুষের জীবনের ওপর এই পরিকল্পিত হামলার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে আমরা পূর্ব বাংলার সকল মানুষের নিকট আহ্বান জানাইতেছি”।
 
প্রতি মহল্লায় দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি গঠন করুন। গুণ্ডাদের শায়েস্তা করুন, নিমূল করুন। পূর্ব পাকিস্তানের মা-বােনের ইজ্জত ও নিজেদের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করুন। -দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি, পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃক প্রচারিত  বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই প্রচারপত্র প্রকাশিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী। দলগুলাের বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও কর্মী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরােধে ঝাপিয়ে পড়ে। ফলে ‘আলাউদ্দীনের আশ্চর্য প্রদীপের আলৌকিক ক্ষমতার মতাে কর্মীদের ব্যাপক প্রভাবে মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে দাঙ্গা বন্ধ হয়ে গেল। সর্বত্র আবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে এলাে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরােধের লক্ষ্যে এটা এক অভূতপূর্ব ঘটনা।  ১৯৬৪ সালে আর এক উল্লেখযােগ্য ঘটনা হচ্ছে, আইয়ুব-বিরােধী দক্ষিণপন্থী নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে “সম্মিলিত বিরােধী দল” গঠন সংক্ষেপে ‘কপ’ এই মাের্চার প্রভাবশালী দলগুলাে হচ্ছে কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, কেএসপি এবং ন্যাপের একাংশ। বিরােধী দলীয় ঐক্যের স্বার্থে আসন্ন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভােটার হচ্ছে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী) এই মাের্চার প্রার্থীর প্রতি সমর্থন দিল ন্যাপের অপর অংশ, কম্যুনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগ ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি আইয়ুব খানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলাে ‘কপ’-এর নমিনী কট্টর। দক্ষিণপন্থী মনােভাবাপন্ন মিস্ ফাতেমা জিন্নার নির্বাচনী ফলাফল নিম্নরূপঃ পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তান আইয়ুব খান ২১,০১২। ২৮,৯৩৯ ফাতেমা জিন্নাহ ১৮,৪৩৪ ১০,২৫৭ পরােক্ষ ভােটে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন এবার শুরু হলাে রাজনীতির নতুন অধ্যায়।
পাকিস্তানের ফৌজি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের চোখে তখন  এশিয়ার নেতা হওয়ার স্বপ্ন পিছনে মদদ দিল চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতকে বেকায়দায় ফেলা। ফলে কাশ্মীর প্রশ্নে অচিরেই শুরু হলাে দ্বিতীয় দফায় পাক-ভারত যুদ্ধ। এটাই হচ্ছে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ এই যুদ্ধ মাত্র ১৭ দিন স্থায়ী। হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্রের অংশ হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধকালে পূর্ববাংলা ছিল। সম্পূর্ণ অরক্ষিত। অবশ্য ভারতও এ সময় “কৌশলগত কারণে পূর্ববাংলা আক্রমণে। বিরত ছিল। ফলে দেখা দিল ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। সােভিয়েত রাশিয়ার উদ্যোগে যুদ্ধবিরতি হলাে। ১৯৬৬ সালে সুদূর তাসখন্দ নগরীতে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলাে। পাকিস্তানের পক্ষে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। “এশিয়ার। নেতা হওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হলাে আইয়ুব খানের। এখন ঘর সামলানাের পালা কট্টর চীনাপন্থী পররাষ্ট্র মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো যুদ্ধবিরতি চুক্তির তীব্র বিরােধিতা করলেন। শুধু তাই-ই নয়; তাসখন্দে বসেই তিনি আইয়ুব মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন সাংবাদিকদের কাছে এ মর্মে বললেন যে, “প্রয়ােজন হলে গাছের পাতা খেয়ে আমরা ভারতের বিরুদ্ধে হাজার বছর ধরে লড়াই করব” ফলে পশ্চিম পাকিস্তানে। দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর জুলফিকার আলী ভুট্টো আইয়ুববিরােধী প্রচারণায় মেতে উঠলেন।
 
পেশােয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত জনসভা করে ভাষণ দিলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি জনসমর্থন লাভ করলেন ফলে কিছুদিনের জন্য তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। মুক্তিলাভের পর ভুট্টোর মুখে নতুন স্লোগান-“রােটিকাপড়-আউর মােকান।” তিনি প্রতিষ্ঠিত করলেন নতুন রাজনৈতিক দল “পিপলস পার্টি” অন্যদিকে পাক-ভারত যুদ্ধাবসানে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন ও পরবর্তী কর্মপন্থা গ্রহণের লক্ষ্যে আইয়ুববিরােধী মূল দলগুলাের নেতৃবৃন্দ ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহােরে এক বৈঠকে মিলিত হলেন। সম্মেলনের নাম সর্বদলীয় জাতীয় সংহতি সম্মেলন” আশ্চর্যজনকভাবে মওলানা ভাসানী এই সম্মেলনে অনুপস্থিত ছিলেন। যে কারণে এই সম্মেলনের ঘটনাবলী ইতিহাসে স্থান লাভ করেছে, তা এক্ষণে উপস্থাপন করা বাঞ্ছনীয় মনে হয় সেদিন এই সম্মেলনে দলবলসহ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন তার লিখিত বক্তব্য সবাইকে হতবাক করলাে। তিনি এ মর্মে অভিযােগ উত্থাপন করলেন যে, ১৭ দিনব্যাপী পাক-ভারত যুদ্ধের ১২শ’ মাইল দূরবর্তী পূর্ববাংলা ছিল সম্পূর্ণভাবে নিরাপত্তাহীন এলাকা এ সময় পূর্ব বাংলার জনগােষ্ঠী এতিমের মত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে নিপতিত ছিল। এজন্য পূর্ব বাংলার বিশেষ ধরনের স্বায়ত্তশাসন প্রয়ােজন। বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে শেখ সাহেব আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপন এবং দফাওয়ারীভাবে ব্যাখ্যাদান করলেন। তিনি দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে ৬ দফা দাবি সমর্থনের আহ্বান জানালেন। কিন্তু মনে হলাে সভাস্থলে বিস্ফোরণ ঘটেছে। সীমান্ত প্রদেশের ন্যাপ-নেতা ওয়ালী খান থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী পাঞ্জাবী নেতা নেজামে ইসলামের চৌধুরী মােহাম্মদ আলী পর্যন্ত সবাই ৬ দফা দাবির তীব্র বিরােধিতা করলেন। এমনকি অনেকেই ৬ দফা দাবিকে পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি হিসাবে উল্লেখ করলেন। উপায়ন্তরবিহীন অবস্থায় শেখ মুজিব তার দলবলসহ সম্মেলন কক্ষ থেকে ওয়াক-আউট করলেন। এরপর দিন কয়েকের মতাে নিরাপত্তার অভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে লাহােরে লুক্কায়িত অবস্থায় থাকতে হয়। অবশেষে করাচীর ইংরেজী দৈনিক ‘ডন’ পত্রিকার মালিক ও প্রখ্যাত শিল্পপতি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন পিআইএ-র টিকিটের ব্যবস্থা করলে ১১ ফেব্রুয়ারি এঁরা লাহাের বিমানবন্দরে হাজির হন। এই বিমানবন্দরে শেখ মুজিবুর রহমান এক অনির্ধারিত সাংবাদিক সম্মেলনে ৬ দফা দাবির ঘােষণা ও ব্যাখ্যা করলেন। তিনি ৬ দফা দাবিকে বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ হিসাবে আখ্যায়িত করলেন।
 
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় যে, লাহাের থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পর শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবির পক্ষে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেন। এ সময় আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচী” শীর্ষক একটা পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। (ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬) তখন আওয়ামী লীগ অফিসের ঠিকানা ছিল ৫১, পুরানা পল্টন, ঢাকা। আলােচ্য পুস্তিকাটি ছাপা হয়েছিল ঢাকার গ্লোব প্রিন্টার্স থেকে এবং প্রকাশক ছিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচার সম্পাদক আব্দুল মমিন। এতে সংক্ষেপে ৬টি দফা পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়। তবে পুস্তিকার শেষ ক’টি লাইন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এখানে রয়েছে বাঙালী জাতির প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বান। এতে বলা হয়েছে যে, “ তিনিও (হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী) আজ বাঁচিয়া নাই; আমিও আজ যৌবনের কোঠা বহু পিছনে ফেলিয়া প্রৌঢ়ত্বে পৌছিয়াছি। আমার দেশের প্রিয় ভাইবােনেরা আল্লাহর দরবারে শুধু এই দোয়া করবেন, বাকী। জীবনটুকু আমি যেন আপনাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনায় নিয়ােজিত করতে পারি। -আপনাদের স্নেহধন্য খাদেম শেখ মুজিবুর রহমান।” এক্ষণে সে আমলের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কিঞ্চিৎ বিশ্লেষণ অপরিহার্য। সে ক্ষেত্রে পাঠকবৃন্দ বুঝতে পারবেন যে, কোন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগকে একাকী ৬ দফা আন্দোলন করতে হয়েছিল।
যেখানে ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলন থেকে শুরু করে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ বছর ধরে বামপন্থী মহল থেকে অবিরামভাবে একটা কথাই বিশেষ জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, “স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি পেটি বুর্জোয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বস্ত নয় এবং আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে”- সেখানে কিন্তু বাস্তবের চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বেজিং-মস্কোর মতবিরােধের জের হিসাবে আমরা দেখতে পাই যে, ষাট দশকের প্রায় পুরাে সময়টাই পূর্ব বাংলায় শহরভিত্তিক বামপন্থী নেতৃবৃন্দ দারুণভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এরা মার্কসীয় দর্শনের পরস্পরবিরােধী। ব্যাখ্যাদান লিপ্ত হয়েছেন এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবির কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। অথচ এ সময় একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। এটাই হচ্ছে পূর্ব বাংলার প্রাণের দাবি ঐতিহাসিক ৬ দফা। কায়েমী স্বার্থবাদী গােষ্ঠী, ধর্মীয় মৌলবাদী মহল এবং অবাঙালী শিল্পপতিরা প্রমাদ গুনলাে এ সময় বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া বিশেষভাবে লক্ষণীয়
১. অস্ত্রের ভাষায় ৬ দফার জবাব দেয়া হবে—প্রেসিডেন্ট আইয়ুব।
২. আমি পল্টন ময়দানে ৬ দফা দাবির প্রশ্নে মুজিবের মােকাবেলায় বাহাস’-এ। (বির্তক যুদ্ধ) রাজী আছি জুলফিকার আলী ভুট্টো। ৩. ৬ দফা হচ্ছে সিআইএ প্রণীত দলিল- কমরেড তােয়াহা। পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রণীত ৬ দফা। কর্মসূচী পূর্ববঙ্গে জনগােষ্ঠীর কাছে ব্যাখ্যাদানের জন্য মাত্র ৫ সপ্তাহের মতাে সময় পেয়েছিলেন। এই সময়কাল হচ্ছে ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসের শুরু থেকে ৮ মে পর্যন্ত  শেখ মুজিব উল্কার মতাে পূর্ববাংলার প্রতিটি জেলা সদরে জনসভায় ভাষণ দান করেছেন। দক্ষিণ ও বামপন্থী দলগুলাে সঠিকভাবে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করার আগেই বাঙালী জনগােষ্ঠী ৬ দফা দাবিকেই নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি সনদ হিসাবে গ্রহণ করলাে । ধর্মীয় স্লোগান আর মার্কসীয় দর্শন—এসব কিছুই আর ৬ দফার। জয়যাত্রাকে রােধ করতে পারলাে না। সবার অলক্ষ্যে গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় বাঙালী জাতীয়তাবাদের আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত হলাে। এখানে উল্লেখ্য যে, কুখ্যাত’ হিসাবে চিহ্নিত পূর্ববাংলার গভর্নর মােনেম খান এ মর্মে ঘােষণা দিলেন যে, “আমি যতদিন গভর্নর থাকব, ততদিন শেখ মুজিবকে জেলেই পচতে হবে। এজন্য তিনি আলােচ্য সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নির্দেশ দিলেন। শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে মােট ১২টি মামলার হুলিয়া জারি হয়। এখানেই শেষ নয়। ৮ মে তারিখে তিনি নারায়ণগঞ্জে আয়ােজিত এক জনসভায় ভাষণদানের পর ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করলে গভীর রাতে তাকে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়। এর পরেই প্রদেশব্যাপী আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের গ্রেফতারের হিড়িক পড়ে যায়। গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়ায় আট শতাধিক  হিসাব করলে দেখা যায় যে, এই দফায় শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে দেশরক্ষা আইনে এবং পরবর্তীতে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১নং বিবাদী হিসাবে। একনাগাড়ে মােট ২ বছর ৯ মাস ১৪ দিন আটক ছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের আহ্বানে পূর্ববাংলার বুকে পালিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে রক্তাক্ত ৭ জুনের মারাত্মক হরতাল। সেদিন বাঙালী ছাত্র-জনতা ৬ দফার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পুলিশের গুলিবর্ষণের মােকাবিলা করেছিল।
 
সরকারী হিসাব অনুসারে ৭ জুন নিহতের সংখ্যা ছিল ১৩ জন। শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবির দ্রুত জনপ্রিয়তার প্রেক্ষিতে সবার অলক্ষ্যে পূর্ব। বাংলার বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায় আইয়ুব সরকার দারুণভাবে বিব্রত বােধ করে। ফলে শুরু হয় বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে নতুন করে ষড়যন্ত্র। এ সময় সরকার রেডিও পাকিস্তান ও টিভি কর্পোরেশনের প্রতিটি কেন্দ্র থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। এমনকি কপালে টিপ পরা মেয়েদের টিভির পর্দায় হাজির হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ফলে ১৯ জন বুদ্ধিজীবী এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানালেন। এঁরা হচ্ছেন, ডঃ কুদরত্-ই- খােদা, ডঃ কাজী মােতাহার হােসেন, শিল্পী জয়নুল আবেদিন, বেগম সুফিয়া কামাল, এম এ বারি, অধ্যাপক আব্দুল হাই, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ডঃ সারওয়ার মুর্শেদ, কবি সিকান্দার আবু জাফর, অধ্যাপক মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম, ডঃ আহম্মদ শরীফ, কবি শামসুর রাহমান, কবি হাসান হাফিজুর রহমান, কবি ফজল শাহাবুদ্দীন, ডঃ আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ডঃ মনিরুজ্জামান এবং শহীদুল্লাহ কায়সার। অবশ্য এ সময় জনাকয়েক বাঙালী বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত সরকারী সিদ্ধান্তের সমর্থনে বিবৃতিদান করেছিলেন। প্রাপ্ত তথ্য মােতাবেক এদের মধ্যে ডাঃ হাসান জামান, ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী, অধ্যাপক দীন মােহাম্মদ প্রমুখ অন্যতম ছিলেন। এখানেই শেষ নয়।
প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে বাঙালী জাতীয়তাবাদের দর্শনকে সমূলে উৎপাটনের জন্য বদ্ধপরিকর হলেন। এজন্য শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। ১৯৬৮ সালের শুরুতেই আমরা এর আলামত দেখতে পেলাম। ৬ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ মর্মে ঘােষণা দেয়া হলাে যে, সামরিক ২৮ জন অফিসারকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এঁরা সবাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল বলে স্বীকারােক্তি দিয়েছে। অবশ্য বলাই বাহুল্য যে, বিবাদী সবাই হচ্ছেন বাঙালী। এই সংবাদ প্রকাশিত হবার পর পূর্ব বাংলার সব মহলেই তখন দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। মাত্র ৫ মাসের ব্যবধানে বাঙালীদের বিরুদ্ধে আইয়ুব সরকারের ষড়যন্ত্রের আসল চেহারা প্রকাশ পেলাে। ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে দেশরক্ষা আইনে মুজিব তখন ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। তবুও তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলায় জড়ানাে হলাে। কিন্তু কিভাবে? ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১টার সময় অর্থাৎ ১৮ জানুয়ারি ভাের রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শেখ মুজিবকে মুক্তির নির্দেশ দেয়া হলাে। ঘুম থেকে উঠিয়ে যখন জেল কর্তৃপক্ষ এই মুক্তির কথা জানাল, তখন শেখ মুজিবের মন অজানা আশঙ্কায় কেপে উঠল। ব্যাপার কি? হঠাৎ মুক্তির আদেশ? তাও আবার গভীর রাতে?
জেলারের কথা একটাই এবং তা হচ্ছে, এই মুহূর্তে জেল থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় শক্তি প্রয়ােগ করা হবে। স্যুটকেস হাতে দুরু দুরু বক্ষে যখন তিনি। জেল গেটের বাইরে এলেন, তখনই বুঝতে পারলেন তার জন্য এক ভয়ঙ্কর বিপদ অপেক্ষা করছে। তবুও তিনি মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলেন। হঠাৎ মুখের উপর গাড়ির হেড লাইটের চোখ ধাঁধানাে আলােতে তিনি চমকে উঠলেন। সামনেই যমদূতের মতাে দাঁড়ানাে দুটি সামরিক জীপ। দু’জন গার্ড নিয়ে জনৈক পাকিস্তানী সামরিক অফিসার তাঁর কাছে এগিয়ে এলাে। বললেন, “আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। সঙ্গে কোন গ্রেফতারী পরােয়ানা আছে কিনা জানতে চাইলে অফিসারের। সাফ জবাব “ওয়ারেন্টের দরকার হবে না”। অবিচল অবস্থায় শেখ মুজিব হাতের স্যুটকেসটা জীপের সিটে রেখে মিনিট খানেক সময় চাইলেন। এরপর তিনি রাস্তার পাশ থেকে এক মুঠা ধুলা নিজের কপালে আর মাথায় স্পর্শ করালেন। পরম করুণাময় আল্লার দরবারে তিনি দু’হাতে তুলে। মােনাজাত করে বললেন, হে আল্লাহ তােমার দরবারে একটি মাত্র আরজ যে, সামরিক বাহিনীর হেফাজতে যদি আমার মৃত্যু হয়, তাহলে আমার কবর যেন এই বাংলার মাটিতেই হয়। সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। সবার অজান্তে ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ভাের রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। অথচ তিনি লাপাত্তা। এভাবেই দীর্ঘ ৭ সপ্তাহ সময় অতিবাহিত হলাে।
দেশবাসী তাে দূরের কথা, তার পরিবারের সদস্যরা পর্যন্ত জানেন না যে, মুজিব কোথায় আছেন। অবশেষে ১৯৬৮ সালের ১১ এপ্রিল পাকিস্তান জেল গেট থেকে গ্রেফতারের কথা স্বীকার করলাে। তবে এ দফায় আর নিরাপত্তা আইনে নয়; এবার গ্রেফতার করা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার সুনির্দিষ্ট অভিযােগে। এদিন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের এক ঘােষণায় বলা হলাে যে, মােট ৩৫ জন বিবাদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ইতােপূর্বে ৬ জানুয়ারিতে ঘােষিত ২৮ জন বাঙালী সামরিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এক্ষণে পূর্ব বাংলার ৭ জন বেসামরিক অফিসার ও রাজনীতিবিদের নাম যুক্ত করা হলাে। এঁদেরই এক নং বিবাদী হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। এটাই তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এই মামলার বিচার পরিচালনার জন্য সুপ্রীম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি পাঞ্জাবের এস এ রহমানের নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। অপর দু’জন সদস্য বাঙালী। একজন ময়মনসিংহের বিচারপতি এম আর খান এবং অপরজন বিচারপতি মকসুমুল হাকিম। উপরন্তু মামলার অন্যতম তদন্তকারী অফিসার হচ্ছেন, বাঙালী সামরিক গােয়েন্দা অফিসার লেঃ কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান। এখানে উল্লেখ্য যে, পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মকসুমুল হাকিম হচ্ছেন বৃহত্তর খুলনার বিএনপি নেতা। খুলনার সন্তান। অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান জিয়া মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং খালেদা মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৬৮ সাল হচ্ছে ডিক্টেটর আইযুব। খানের রাজত্বের ১০ বছর পূর্তি। এ সময় জঙ্গী সরকারের এমর্মে ধারণা ছিল যে, ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’র অভিযােগের দরুন মামলা শুরু হলে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার জনগােষ্ঠীর চোখে দারুণভাবে ধিকৃত হবেন। কিন্তু সেখানে হিতে বিপরীত হলাে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের জন্য পুরাে ব্যাপারটাই বুমেরাং হয়ে দাঁড়াল। ১৯ জুন। সামরিক প্রহরায় ঢাকার কুর্মিটোলায় তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হলে পূর্ব বাংলায় দারুণ বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলাে। সর্বত্র আইয়ুব বিরােধী ধূমায়িত আক্রোশ। বছর শেষ হওয়ার আগেই ঝানু রাজনীতিবিদ মওলানা ভাসানী “বাতাসে। লাশের গন্ধ” পেলেন। বুঝতে পারলেন আইয়ুব রাজত্বের যবনিকাপাত হতে যাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো আর পূর্ব বাংলায় ৬ দফা দাবিদার শেখ মুজিবের মােকাবিলা করা আইয়ুবের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই দীর্ঘ ৫ বছর পরে ৫ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানী DON’T DISTURB AYUB (আইয়ুবকে বিরক্ত করাে না) নীতি নর্দমায় নিক্ষেপ করে গর্জন করে উঠলেন। তিনি আইয়ুব খানকে “অবসর গ্রহণের পরামর্শ দিলেন এবং বাস্তবে আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনের নেতৃত্ব। গ্রহণ করলেন। তখন বিপুল সংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী কারাগারে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসের গােড়া থেকেই তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলার । প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র পূর্ববাংলা দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ। নানা স্থানে সেনাবাহিনী মােতায়েন । এবং বিক্ষোভকারীদের ওপর দফায় দফায় গুলিবর্ষণেও কাজ হলাে না। জনতা কারফিউ অগ্রাহ্য করলাে এবং সমগ্র পূর্ববাংলা তখন ৬ দফা আর জয় বাংলা স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠলাে। এই জানুয়ারি মাসেই ‘ডাকসু’র নেতৃত্বে গঠিত। হলাে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। নেতৃবৃন্দ হচ্ছেন, তােফায়েল আহমদ (ভিপি, ডাকসু), নাজিম কামরান চৌধুরী (সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু), আব্দুর রউফ (সভাপতি, ছাত্রলীগ) খালেদ মােহম্মদ আলী (সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রলীগ), সাইফুদ্দিন আহমদ। মানিক (সভাপতি, রুশপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন).সামসুজ্জোহা (সম্পাদক, রুশপন্থী ছাত্র। ইউনিয়ন), মােস্তফা জামাল হায়দার (সভাপতি, চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন) এবং দীপা দত্ত। (সহসম্পাদিকা, চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন)। এঁরা ৬ দফা দাবির সম্পূরক হিসাবে ১১ দফা দাবি উত্থাপন করলেন। ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে ২৪ মার্চ।
মাত্র ৬৭ দিন। এই সময়ের মধ্যে আইয়ুব বিরােধী রক্তাক্ত গণঅভুত্থানের উল্লেযােগ্য ঘটনা হচ্ছে। – ২০ জানুয়ারি ঢাকার রমনা এলাকায় জনৈক পুলিশ অফিসার কর্তৃক পিস্তলের গুলিতে প্রগতিশীল ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানকে হত্যা, ২৫ জানুয়ারি সেনাবাহিনী তলব ও ঢাকাবাসীদের কারফিউ ভঙ্গ, ৬ ফেব্রুয়ারি প্রায় ১০ হাজার মারমুখী জনতা কর্তৃক দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা (বর্তমানে দৈনিক বাংলা, বিচিত্রা ও টাইমস) অফিস ভস্মীভূত। ষড়যন্ত্র মামলার রায় প্রদান না করেই ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি এস এ রহমান কর্তৃক এক বস্ত্রে ঢাকা থেকে লাহােরে পলায়ন, ১৫ ফেব্রুয়ারি ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম বিবাদী সার্জেন্ট জহুরুল হককে সামরিক হেফাজতে হত্যা, ১৮ ফেব্রুয়ারি সৈন্যবাহিনীর গুলিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রােক্টর ডঃ শামসুজ্জোহাকে হত্যা, ১৯ ফেব্রুয়ারি কারফিউ ভঙ্গ করে ঢাকায় বিশাল জনতার বিক্ষোভ-মিছিল। মুখে নতুন স্লোগন, “জেলের তালা ভাঙবাে, শেখ মুজিবকে আনবাে।” ২০ ফেব্রুয়ারি। পরিস্থিতির আরও অবনতি হলাে। এদিন শেখ মুজিব ‘প্যারােলে মুক্তি নিয়ে রাওয়ালপিণ্ডিতে আইয়ুব খানের প্রস্তাবিত গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। এ মর্মে বললেন যে, ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত কোনাে আলােচনা সম্ভব নয়। ১৯ এবং ২০ ফেব্রুয়ারি সমস্ত দিন ধরে ঢাকায় খণ্ড খণ্ড। মিছিল। ঢাকায় জোর গুজব পরদিন পাঁচ লাখ জনতার মিছিল কুর্মিটোলায় অভিযান করে প্রিয় মুজিব ভাইকে মুক্ত করবে। ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স বাতিল এবং সমস্ত বিবাদীর মুক্তিলাভ। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়ােজিত বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবের গণসংবর্ধনা। ছাত্র-জনতার পক্ষে সভার সভাপতি তােফায়েল আহমদ কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু” উপাধি দান। এদিন রাতে ভাসানী-মুজিবের একান্ত বৈঠক। মওলানা সাহেবের একটাই অনুরােধ যে, পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো এবং পূর্ববাংলা থেকে আমি এই দু’জনেই আইয়ুব খানের প্রস্তাবিত বৈঠক বয়কট করেছি। সেক্ষেত্রে তুমি না গেলেই আইয়ুবের অনিবার্য পতন।
তাই তুমিও রাওয়ালপিণ্ডির বৈঠকে যােগ দিও না। আইয়ুব খান তাে এখন একটা মরা লাশ’। বঙ্গবন্ধুর জবাব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। হুজুর আমি যখন কথা দিয়েছি যে, মামলা প্রত্যাহার করলে গােলটেবিল বৈঠকে যােগ দেব-তখন আমি কথা রাখবই। আমি পিণ্ডিতে যাব আর ৬ দফা দাবির প্রশ্নে সামান্যতম আপােস করব না। তাহলেই আইয়ুব খান শেষ। হুজুর, আমাকে আইয়ুবের ‘জানাজাটা পড়ে আসতে দিন। স্বৈরাচারী আইয়ুবের সঙ্গে কোন আলােচনা হতে পারে না বলে যেখানে ভাসানীভুট্টো তাদের জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন রেখেছিলেন, সেখানে ‘আইয়ুবের দালাল হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১০ মার্চ পিণ্ডিতে গিয়ে হাজির হলেন। ৪ দিনব্যাপী এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ৬ দফা দাবি থেকে সামান্যতম টলানাে সম্ভব হলাে না। ফলে। গােলুটেবিল বৈঠকে ব্যর্থ হলাে। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ লৌহমানব প্রেসিডেন্ট মােহাম্মদ আইয়ুব খান পদত্যাগ করলেন। সবাই বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করলেন। কৃতিত্বের সিংহভাগ তাঁরই। পদত্যাগপত্রটি ছিল নিম্নরূপ (বাংলায় অনুবাদ) ঃ প্রেসিডেন্ট হাউজ ২৪ মার্চ, ১৯৬৯ প্রিয় জেনারেল ইয়াহিয়া, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যে, দেশের সমস্ত বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা ও নিয়মতান্ত্রিক কর্তৃত্ব অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানের উদ্বেগজনক অবস্থার অবনতি যদি আরও অব্যাহত থাকে, সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক জীবনধারা তথা সভ্য জীবনের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। এমতাবস্থায় ক্ষমতার আসন থেকে নেমে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোন গত্যন্তর দেখছি না।  তাই আমি পাকিস্তান দেশরক্ষা বাহিনীর হাতে পূর্ণ কর্তৃত্ব ন্যস্ত করার সাব্যস্ত করেছি। কেননা সামরিক বাহিনীই এ সময় দেশের একমাত্র কর্মক্ষম ও আইনানুগ যন্ত্র।
ভবদীয়, প্রেসিডেন্ট মােহাম্মদ আইয়ুব খান। ২৪-৩-১৯৬৯ এই হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের মােকাবিলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০ বছরব্যাপী রাজনৈতিক লড়াই-এর ইতিবৃত্ত। শেষ পর্যন্ত পরাক্রমশালী আইয়ুব খানই ইতিহাসে বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেলেন। রাজনৈতিক মঞ্চে রয়ে গেলেন অকুতােভয় জননেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার রাজনীতির মূল মন্ত্রই হচ্ছে “ধাপে ধাপে রাজনীতি”। এবার ক্ষমতায় এলেন আর এক জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। শুরু হলাে নতুন করে রাজনৈতিক লড়াই- স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা, সর্বত্র বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবি। সে তাে আর এক বিরাট ইতিহাস। 

সূত্রঃ   একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল