স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে শুধু বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবি
আমি ইতিহাসের কথা বলছি। আমি অত্র ভূখণ্ডের বিচিত্র রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অধ্যায়ের কথা বলছি। এসবই ঘটেছিলাে ১৯৭১ সালের প্রথমার্ধে স্বল্পদিনের ব্যবধানে। একদিকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী, ব্যুরােক্রেট, অবাঙালী। শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি, কেএসপি, চীনপন্থী মার্কসিস্ট আর পিপলস পার্টির সমর্থনপুষ্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের জঙ্গী সরকার এবং অন্যদিকে আপামর বাঙালী জনগােষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। কারণ একটাই এবং তা’হচ্ছে সামরিক প্রহরায় অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনী ফলাফল। এই নির্বাচনে ফলাফলের দরুন দেশ-বিদেশের। রাজনৈতিক পণ্ডিতরা বিস্মিত ও হতভম্ব হলাে। কেননা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৮টি আসনের কোনােটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করা সত্ত্বেও ৩৩০ আসনবিশিষ্ট প্রস্তাবিত গণপরিষদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। “এক মাথা এক ভােটের” ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পূর্ববঙ্গের হিস্যায় তখন একুনে ১৬৯টি আসন। এরমধ্যে সরাসরি নির্বাচনে ১৬২টি এবং মহিলাদের জন্য পরােক্ষ নির্বাচনে ৭টি আসন। সেক্ষেত্রে প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের জন্য। বঙ্গবন্ধুর প্রয়ােজন ১৫৭টি আসনের। কিন্তু নির্বাচনঅন্তে দেখা গেলাে যে, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ২টি মাত্র আসন ছাড়া ১৬৭টি আসনে (মহিলা ৭টিসহ) জয় লাভ করেছে।
এটাই হচ্ছে ইয়াহিয়া খানের জঙ্গী সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৮৮টি আসনে বিজয়ী পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর মাথা ব্যথার কারণ। প্রথমত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালীরা এই প্রথমবারের মতাে এককভাবে সরকার গঠন করবে এবং সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ওয়াদা ৬-দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন করবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কট্টর সমর্থক ভুট্টোর কথা হচ্ছে, এ ধরনের একটা অবস্থা কিছুতেই বরদাশত করা যায় না। অতএব ছলে-বলে -কৌশলে এবং ষড়যন্ত্র করে হলেও শেখ মুজিবের এই প্রচেষ্টা রুখতে হবে। ফলে শুরু হলাে নতুন ষড়যন্ত্র। সামরিক জান্তা, ব্যুরােক্রেট, অবাঙালী রাজনীতিবিদ আর ধর্মীয় শ্লোগানের পলিটেশিয়ানরা সব এক জোট হলাে। ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৩০০ ফুট দীর্ঘ নৌকার মতাে এক মঞ্চে বঙ্গবন্ধু সমস্ত আওয়ামী লীগ সদস্যকে জমায়েত করলেন। কয়েক লাখ লােকের উপস্থিতিতে এসব সদস্য ৬-দফা দাবির প্রতি সমর্থন অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে শপথ গ্রহণ করলেন। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললেন যে, বাংলার জনগণ ৬-দফার। পক্ষে রায় দিয়েছে তাই ৬-দফা থেকে কিছু পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধন করার কারাে ক্ষমতা নাই। তাই ৬-দফার ভিত্তিতেই প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্র প্রণীত হবে। জবাবে ভুট্টো বললেন যে, আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করায় জাতীয়। পরিষদ এখন “কসাইখানায় পরিণত হয়েছে। অতএব আসন্ন পরিষদ অধিবেশনে যােগদান অর্থহীন ফলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে আবার দেখা দিলাে। দুর্যোগের ঘনঘটা। সিন্ধু প্রদেশের অন্তর্গত লারকানায় ভুট্টোর পৈত্রিক বাসভবন ‘আল্ মারকাজ’ প্যালেসে ইয়াহিয়া ভুট্টো গােপন বৈঠক হলাে। এর পরেই ১৯৭১ সালের ১লা। মার্চ দুপুরে আকস্মিকভাবে বেতারে এমর্মে ঘােষণা হলাে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায়। প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি করেছেন। আগুনের লেলিহান শিখার মতাে মুখে মুখে এই কথাটা রটে গেলাে। মাত্র ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যে পুরাে ঢাকা শহরের চেহারাই বদলে গেলাে। দোকান পাট বন্ধ হলাে। স্কুল-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা বেরিয়ে এলাে। রাজপথে তখন অসংখ্য মিছিল, উচ্চারিত শ্লোগান হচ্ছে- “৬-দফা মানতে হবে, জয় বাংলা।” মতিঝিলের এক হােটেলে সেদিন দুপুরেই অনুষ্ঠিত হলাে, আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির অনির্ধারিত বৈঠক পরে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে বঙ্গবন্ধু বললেন, আমরা যে কোন পরিস্থিতির মােকাবিলা করতে সক্ষম। আপাতত কর্মসূচী হচ্ছেঃ
১। ৩রা মার্চ থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে পূর্ণ হরতাল।
২। ৩রা মার্চ জাতীয় শােক দিবস’ এবং বিক- ছাত্রলীগের উদ্যোগে জনসভা।
৩। বেতার ও টিভিতে আন্দোলন সংক্রান্ত সঠিক সংবাদ ও বিবৃতি প্রচারিত না হলে, বাঙালী কর্মচারীদের কর্মবিরতি। ৪। ৭ই মার্চ বেলা ২টায় রেসকোর্স ময়দানে জনসভা এবং পরবর্তী কর্মসূচী ঘােষণা। ৩রা মার্চ পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু এ মর্মে ঘােষণা করলেন যে, জনপ্রতিনিধিদের। হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত কেউ সরকারী খাজনা ও ট্যাক্স দেবেন না। ৪ঠা মার্চ বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বললেন, “আমি এ মর্মে নির্দেশ দান করছি যে, দেশের সমস্ত অফিসগুলাে শুধুমাত্র বেতন দেয়ার জন্য প্রতিদিন বেলা ২-৩০ থেকে বিকেল ৪-৩০ পর্যন্ত খােলা থাকবে। ব্যাংকগুলাে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতনের চেক ভাঙ্গানাের জন্য খােলা থাকবে।” সমগ্র পূর্ববাংলা একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হলাে। এরমধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ জনতার উপর গুলিবর্ষণের খবর এসে পৌছালাে, ফলে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটলাে। ৬ই মার্চ নাগাদ এ মর্মে খবর প্রকাশিত হলাে যে, নীতিগত প্রশ্নে জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে মতবিরােধ সৃষ্টি হওয়ায় পূর্ববাংলার তৎকালীন গভর্নর ও আঞ্চলিক সামরিক অধিকর্তা ভাইসএডমিরাল এস এম-আহসানকে অপসারণ করা হয়েছে। প্রকাশ, আহসান সাহেব এ মর্মে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, কোনাে অবস্থাতেই পূর্ব বাংলায় গণহত্যা বাঞ্ছনীয় হবে এতে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে।
কিন্তু জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে এই পরামর্শ গ্রহণযােগ্য হলাে না। ভাইস এ্যাডমিরাল আহসানের স্থলে তিনি “বেলুচিস্তানের কসাই” নামে পরিচিত লেঃ জেনারেল টিক্কা খানকে ৬ই মার্চ নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়ােগ করলেন। উপরন্তু পূর্ববাংলায় আরাে সৈন্য পাঠানাের লক্ষ্যে আরাে কিছু সময়ের জন্য ২৫শে মার্চ পুনরায় গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা ছাড়াও টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথাবার্তা বললেন মােদ্দা বিষয়টি হচ্ছে, সংলাপের উদ্দেশ্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় আগমনে ৬ই মার্চ রাত ছিলাে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে এক মারাত্মক সমস্যাপূর্ণ রাত। কেননা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সামান্যতম ভুল হলে তা হবে ভয়াবহ। তিনি দফায় দফায় বৈঠক করে ছাত্র ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে। পরামর্শ আহ্বান করলেন। প্রতিটি উপদল ও গােষ্ঠী থেকে দারুণ চাপ সৃষ্টি করা হলাে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অবিচল রইলেন। ৭ই মার্চের ভাষণ ছিলাে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্নিপরীক্ষা সবাইকে হতবাক করে তিনি এই পরীক্ষায় দারুণ কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ৭ই মার্চের এই ভাষণ সেদিন চীনপন্থী মার্কসিস্ট ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সবাইকে সন্তুষ্ট করেছিলেন।
ইতিহাসের পাতায় শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে এটা চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। আজও পর্যন্ত আমার চোখের সামনে এই জনসভা এবং বঙ্গবন্ধুর তর্কবাগিশের কণ্ঠে পবিত্র কোরান তেলাওয়াতের পর প্রথমেই শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মােনাজাত বেলা ৩টা ২মিনিট থেকে মােট ১৮ মিনিটকাল ভাষণ দান কালে। তিনি বাঙালী জনগােষ্ঠীকে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতির আহ্বান জানালেন। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, যা কিছু আছে, তাই-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরাে দেবাে- এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে, ইনশাআল্লাহ।” এরপর একই নি:শ্বাসে উচ্চারিত ঐতিহাসিক বাণী হচ্ছে, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম জয় বাংলা।” এদিকে জারিকৃত এক প্রেসনােটে বলা হলাে যে, ৬ই মার্চ ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙ্গে কয়েদীরা পালিয়ে গেছে এবং গুলিতে ঘটনাস্থলে ৭ জন নিহত হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সৈয়দপুরে বাঙালী-অবাঙালী সংঘর্ষের দরুন সৈন্যবাহিনী গুলিবর্ষণ করেছে।
এছাড়া খুলনা, যশাের, রংপুর ও চট্টগ্রামে সংঘর্ষ হয়েছে। গত এক সপ্তাহে নিহতের সংখ্যা ১৭২ জন এবং গুরুতররূপে আহত ৩৫৮ জন। এ ধরনের এক প্রেক্ষিতে সংখ্যাগুরু দলের নির্বাচিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কার্যত বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে দু’দফায় ৩৫ দফা কর্মসূচী ঘােষণা করলেন। এটাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একাত্তরের যুগান্তকারী অসহযােগ আন্দোলন হিসেবে নতুন অধ্যায় সংযােজন করেছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান কড়া নিরাপত্তা প্রহরায় ১৯৭১ সালের ১৫ই মার্চ ঢাকায় আগমন করলেন নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শেষবারের মতাে আলােচনার জন্য। উদ্দেশ্য হচ্ছে, গণপরিষদের বাইরে একটা খসড়া সংবিধান প্রণয়নের জন্য শেখ মুজিবকে সম্মত করা; অন্যথায় গণহত্যা। নিম্নে আলােচনার বিবরণ দেয়া হলােঃ ১৬ই মার্চ ঃ কোনাে রকম পরামর্শদাতা ছাড়া মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক।
১৭ই মার্চ ঃ পরামর্শদাতাদের নিয়ে বৈঠকে ৬-দফা সম্পর্কে আলােচনা। আওয়ামী লীগের পরামর্শদাতারা হচ্ছেন সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ডঃ কামাল হােসেন। ১৮ই মার্চ পরামর্শদাতাদের নিয়ে উভয় পক্ষের বৈঠক। ১৯শে মার্চ ঃ মুজিব-ইয়াহিয়া ৯০ মিনিটকাল আলােচনা। ৬-দফার দাবিগুলাে ছাড়াও “জয় বাংলা” শ্লোগানের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধুর জবাব হচ্ছে, “শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময়ও আমি কলেমা পাঠের সঙ্গে ‘জয় বাংলা উচ্চারণ করবাে।” ২০শে মার্চ ঃ মুজিব-ইয়াহিয়া ৪র্থ দফা বৈঠক। এ সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে আরাে তিনজন পরামর্শদাতা যথাক্রমে এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং খন্দকার মােশতাক যােগ দেন। ২১শে মার্চ : ভুট্টোর ঢাকা আগমন এবং ভুট্টো-ইয়াহিয়া একান্তে বৈঠক। ভুট্টো কর্তৃক প্রকাশ্যে ত্রিপক্ষীয় সমঝােতা’ দাবি। ২২শে মার্চ ঃ এক সরকারী ঘােষণায় ২৫শে মার্চ তারিখের গণপরিষদের অধিবেশন পুনরায় স্থগিত । ঢাকার জাতীয় দৈনিকগুলােতে “বাংলাদেশের মুক্তি” শীর্ষক ক্রোড়পত্র প্রকাশ। এতে বঙ্গবন্ধুর দস্তখতে লিখিত বাণী হচ্ছে, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়তে হবেপ্রতিরােধ দুর্গ। আমাদের দাবি ন্যায়সঙ্গত । তাই সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত জয় বাংলা।” ২৩শে মার্চ ও আওয়ামী লীগের পক্ষে সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও ডঃ কামাল হােসেন এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার পক্ষে এম এম আহম্মদ, বিচারপতি কর্নেলিয়াস, লেঃ জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসানের মধ্যে সকাল ও সন্ধ্যায় দু’দফা বৈঠকে মিলিত হন।
২৪শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর পরামর্শদাতা এবং সামরিক জান্তার পরামর্শদাতাদের মধ্যে। আরাে দু’দফা বৈঠক। ২৫শে মার্চ ঃ সকালে ভুট্টো-ইয়াহিয়া খানের মধ্যে ৪৫ মিনিট বৈঠক। সাংবাদিকদের কাছে ভুট্টোর বক্তব্য হচ্ছে, “আওয়ামী লীগ যে ধরনের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে অটল রয়েছে, তাকে আর প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন বলা যায় না। ওদের দাবি তাে স্বায়ত্তশাসনের চেয়েও বেশী প্রায় সার্বভৌমত্বের কাছাকাছি।” এদিন নির্ধারিত বৈঠকের জন্য লেঃ জেনারেল পীরজাদার টেলিফোন আর এলাে বঙ্গবন্ধু অশনি সংকেত পেলেন। সমস্ত দিন ধরে তিনি আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দের ভবিষ্যতে করণীয় বিষয়াদি সম্পর্কে নির্দেশ দিলেন। সন্ধ্যা নাগাদ তিনি জানতে পারলেন যে, জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া করাচীতে চলে গেছে। তাই অবিলম্বে সবাইকে আত্মগােপনপূর্বক সীমান্ত অতিক্রম এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রবাসী সরকার গঠন ও স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার দিক নির্দেশনা দিলেন। এসব নেতৃবৃন্দের মধ্যে যাদের নাম উল্লেখ করতে হয় তাদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ডঃ কামাল হােসেন, ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম প্রমুখ। এদের মধ্যে তাজউদ্দিন আহমদ, ডঃ কামাল হােসেন ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের একই সীমান্ত অতিক্রমের কথা ছিলাে। কিন্তু ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী ডঃ কামাল এতে অংশ নেননি।
১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ ছিলাে দারুণ ঘটনাবহুল। সন্ধ্যার পর রাত ৯টা নাগাদ ইয়াহিয়ার অনুমােদিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুসারে ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে একই সঙ্গে শুরু হলাে গণহত্যা। অর্থাৎ প্রথম আক্রমণটা এলাে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর পক্ষ থেকে। ফলে গভীর রাতে নির্বাচিত সংখ্যাগুরু দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণহত্যার মােকাবিলায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করলেন। সর্বত্র বেতারযােগে পাঠাবার জন্য তিনি টেলিফোনে নিম্নোক্ত বাণীটি সেন্ট্রাল টেলিফোন অফিসে ডিকটেশন দিলেনঃ “THE PAKISTAN ARMY HAS ATTACKED POLICE LINES AT RAJARBAG AND EAST PAKISTAN RIFLES AT PILKHANA AT MIDNIGHT STOP GATHER STRENGTH TO RESIST AND PREPARE FOR A WAR OF INDEPENDENCE.” | (পাকিস্তান সামরিক বাহিনী মাঝরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানায়। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস- এর হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করেছে। প্রতিরােধ করার লক্ষ্যে শক্তি সঞ্চয় করুন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরু হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরিত স্বাধীনতা ঘােষণার বাণী যখন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানের কাছে পৌছলাে, তখন রাত ১২টা বেজে গেছে, অর্থাৎ ইংরেজী ক্যালেন্ডারের তারিখ পরিবর্তন হয়ে ২৬শে মার্চ শুরু হয়েছে।
এজন্যই ২৬শে মার্চ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান আরাে একদিন পরে ২৭শে মার্চ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর বরাতে একটা লিখিত এনাউন্সমেন্ট’ পাঠ করেছিলেন। এর পরের ইতিহাস হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিন আহমদ কর্তৃক প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠন ও সফলভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালন করা। তখন তঙ্কালীন মেজর জিয়াউর রহমানের অবস্থান হচ্ছে প্রবাসী সরকারের অধীনে প্রথমে একজন সেক্টর কমান্ডার ও পরে তিনজনের একজন ফোর্সেস কমান্ডার হিসেবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে তিনি ছিলেন প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর অধীনে উপ-প্রধান। তাহলে ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ থেকে এ কথাটাই সুস্পষ্টভাবে বলতে হচ্ছে যে, পাকিস্তানের তেইশ বছর ধরে ধাপে ধাপে যে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিলাে এবং বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাঝদিয়ে এক মহানায়কের সৃষ্টি হওয়ায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনিই হলেন সংখ্যাগুরু দলের নির্বাচিত নেতা। এরই নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এজন্যই পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর গণহত্যার মােকাবিলায় বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাংলাদেশের আপামর জনগােষ্ঠী স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাে এবং বিজয়কে ছিনিয়ে এনেছিলাে। উপরন্তু গণতান্ত্রিক বিশ্ব এতে সমর্থন জানিয়েছিলাে। সংক্ষেপে এই হচ্ছে স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস।
সূত্রঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল