You dont have javascript enabled! Please enable it! একুশে ফেব্রুয়ারির আগের রাতের ভোট | ভাসানী টাঙ্গাইলে | বঙ্গবন্ধু কারাগারে | পরদিন সকালে দশজনী মিছিল - সংগ্রামের নোটবুক
কেমন করে গুলি হয়েছিলাে
আমি ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারির কথা বলছি। এদিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা নাজিমউদ্দীন ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা করলেন। এক পর্যায়ে তিনি এমর্মে ঘােষণা করলেন যে, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করলাে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ। কেননা পাকিস্তানের মােট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগের মাতৃভাষা হচ্ছে বাংলা। ছাত্রদের দাবি হচ্ছে উর্দুর পাশাপশি। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে দিনকয়েকের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ দারুণভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠলাে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের চত্বরে ২৭শে জানুয়ারি থেকে শুরু করে প্রতিদিনই অনুষ্ঠিত হলাে প্রতিবাদ সভা।  এ সময় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি আর টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক অন্যতম যুগ্ম-সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বিনা বিচারে আটক ছিলেন ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বাংলা ভাষা আন্দোলনকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এগিয়ে এলেন ১৯৫২ সালের ৩০শে জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে তারই সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হলাে এক সর্বদলীয় সম্মেলন আওয়ামী লীগ ছাড়াও খেলাফতে রব্বানী পার্টি, তমদুন মজলিশ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সম্মেলনে যােগ দিলেন। গঠিত হলাে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ সভাপতি মওলানা ভাসানী।  এখানে উল্লেখ্য যে, কর্মপরিষদের প্রথম বৈঠকেই আসন্ন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে ঘােষণা দেয়া হয়। অর্থাৎ এই দিন বাংলা ভাষার দাবিতে সমগ্র পূর্ব  বাংলায় হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। তা’হলে ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি বেছে নেয়ার পিছনে কি কারণ ছিলাে? এইদিন অপরাহ্ন তিনটায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা এজন্যই ২১শে ফেব্রুয়ারী ভাষা দিবস হিসেবে ঘােষণা দেয়া হয়েছিলাে এবং সেই মােতাবেক ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয়েছিলাে।
 

পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, তৎকালীন প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারই প্রথমে উস্কানিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করলাে। ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি বিকাল নাগাদ আকস্মিকভাবে এই সরকার ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করলাে। ফলে বিরাজমান পরিস্থিতিতে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য নবাবপুর আওয়ামী লীগ অফিসে সেদিন রাত ৮টায় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের জরুরি বৈঠক আহবান করা হলাে। মওলানা ভাসানী তখন টাঙ্গাইলে আর শেখ মুজিব কারাগারে। খেলাফতে  রব্বানী পার্টির প্রধান জনাব আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে বেশ  কিছুক্ষণ বাদানুবাদ হলাে। প্রশ্নটা হচ্ছে, পরদিন ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে কিনা। শেষ পর্যন্ত জনাব হাশিম এই প্রশ্নে ভােটের ব্যবস্থা করলেন। ভােটের ফলাফল ১১-৪। অর্থাৎ ১১ জন ১৪৪ ধারা না ভাংগার পক্ষে এবং কমরেড তােয়াহা ভােটদানে বিরত। ফলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের ২১শে ফেব্রুয়ারি কর্মসূচী প্রত্যাহার করা হলাে।  ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা নাগাদ ফজলুল হক হলে বসেই আমরা কর্মপরিষদের এই কাপুরুষােচিত’ সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারলাম। পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে গত ২০ দিন যাবৎ শত শত ছাত্র ও যুব কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রমে একুশের হরতালের জন্য যে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিলাে, তা’ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক সিদ্ধান্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেলাে। কিন্তু আমরা কিছুসংখ্যক ছাত্রনেতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্তে অটল রইলাম।  কিন্তু কিভাবে? হাতে তাে’ আর ঘণ্টা আটেক সময়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সদস্য নন, এমন কিছু সংখ্যক ছাত্রনেতাকে অনতিবিলম্বে খবর দেয়া হলাে যে, রাত ১২টায় ঢাকা হলের পুকুরের পূর্ব ধারের সিড়িতে জরুরি গােপন বৈঠক হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার কর্মসূচী স্থির করা। বৈঠকে নিম্নোক্ত ১১ জন ছাত্রনেতা হাজির হলেন।

১। গাজিউল হক (বিশিষ্ট আইনজীবী)
২। হাবিবুর রহমান শেলী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি)
৩। জিলুর রহমান (হাসিনা মন্ত্রিসভার সদস্য)।
৪। এস এ বারি এটি (মরহুম, বামপন্থী নেতা)
৫। মােহাম্মদ সুলতান (মরহুম, বামপন্থী নেতা)
৬। আনােয়ারুল হক খান (মরহুম, মুজিবনগর সরকারের তথ্য সচিব)
৭। মঞ্জুর হােসেন (মরহুম, চিকিৎসাবিদ)।
৮। আব্দুল মােমেন (আওয়ামী লীগ সরকারের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী)
৯। এম আর আখতার মুকুল (স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ‘চরমপত্রে’র কথক ও রচয়িতা)।
১০. সৈয়দ কামরুদ্দীন হােসেইন শহুদ (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
১১। আনােয়ার হােসেন (পরিচয় অজ্ঞাত)
২০শে ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতের বাকি ঘটনাবলীর জন্য বর্তমানে বিশিষ্ট আইনজীবী গাজিউল হকের স্মৃতিচারণের অংশবিশেষ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি  বৈঠকে প্রথমেই স্থির করা হলাে আমাকেই পরদিন আমতলার সভায় সভাপতিত্ব করতে হবে। কিন্তু সভা অনুষ্ঠানের পূর্বেই যদি আমি গ্রেফতার হয়ে যাই, তবে সভাপতিত্ব করবেন এম আর আখতার মুকুল এবং তারও গ্রেফতারকৃত অপারগতায় সভাপতিত্ব করবেন কামরুদ্দিন শহুদ। বৈঠকে আরও একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভা শুরু হওয়ামাত্র সর্বদলীয় কর্মপরিষদের অন্যতম সদস্য এবং আওয়ামী লীগের সম্পাদক শামসুল হক সাহেবকে বক্তৃতা করতে দেয়া হবে এবং তারপর বক্তৃতা করতে দেয়া হবে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক আব্দুল মতিনকে (পরবর্তীকালে বামপন্থী নেতা)। এরপর আমি সভাপতি হিসাবে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গায় পক্ষে বক্তব্য রাখব এবং সিদ্ধান্ত জানিয়ে সভার কাজ শেষ করবাে।
 
২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি শুরু হয়েছিলাে স্বাভাবিকভাবেই। একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়া পুরােনাে ঢাকায় দোকানপাট, অফিস-আদালত সময়মতাে কর্মচঞ্চল হয়ে উঠলাে। কেবলমাত্র টাউন সার্ভিসের বাসগুলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরােনাে ভবন এড়িয়ে বিকল্প রাস্তা দিয়ে চলাচল শুরু করলাে। আর এখন যেখানটায় ইউনিভার্সিটির স্টেডিয়াম, সেই মাঠটায় সকাল থেকে প্রায় সহস্রাধিক পুলিশ আস্তানা গাড়লাে। পাশেই  দাড়াননা পুলিশের স্পেশাল টিয়ার গ্যাস স্কোয়াড।’ বেলা সাড়ে আটটা নাগাদ ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে স্কুলের ছাত্রদের ছােট ছােট মিছিল আসতে শুরু করলাে কলা ভবনের চত্বরে সকাল ন’টা থেকে শুরু হলাে। কলেজের ছাত্রদের মিছিলের আগমন সরকারী কর্তৃপক্ষ তখনাে আন্দাজ করতে পারলাে। না যে, প্রকারান্তরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী এসব ছাত্র মিছিলগুলােকে শক্তি প্রয়ােগে বাধা দেয়া ঠিক হবে কিনা এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে দলে দলে হাজির হলাে মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আর বিভিন্ন হলের ছাত্ররা এই বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে তখন উচ্চারিত শ্লোগান হচ্ছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। অন্যদিকে কলাভবনের রাস্তায় সশস্ত্র পুলিশের দল টহল দিতে শুরু করেছে। পাশেই দাঁড়ানাে টিয়ার গ্যাসের স্কোয়াডগুলাে শুধুমাত্র হুকুমের প্রতীক্ষায় এমনি এক উত্তেজনাকর অবস্থায় এম আর আখতার মুকুলের প্রস্তাব মােতাবেক গাজিউল হক সভাপতিত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। প্রথমে বক্তৃতা করলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষে শামসুল হক। তিনি কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে না। অবশ্য সভাস্থল ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্তে তিনি বললেন, ছাত্রদের এই আন্দোলনের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে তার সমর্থনের কথা।
এরপর ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে বক্তব্য দিলেন বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক আব্দুল মতিন। এমন সময় খবর এলাে যে, লালবাগ থানার সামনে স্কুলের ছাত্রদের একটা মিছিলে পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা ছাড়াও লাঠিচার্জ করেছে। ফলে কলাভবনে তখন চরম উত্তেজনা। সবশেষে সভার সভাপতি গাজিউল হক এমর্মে ঘােষণা দিলেন যে, ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে হবে। চারিদিকে মুহুর্মুহু স্লোগান হচ্ছে, “১৪৪ ধারা মানি না-মানি না।” এতােসব হৈ-চৈ-এর মধ্যে সিলেটের তৎকালীন ছাত্রনেতা (বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) আব্দুস সামাদ ১৪৪ ধারা ভাংগার কৌশল বর্ণন্না করলেন। এটাই হচ্ছে ঐতিহাসিক দশজনী মিছিল’। তিনি বললেন, একসঙ্গে হাজার হাজার ছাত্র রাস্তায় বেরুলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। এর বদলে প্রতি দফায় দশজন করে ছাত্র রাস্তায় বেরিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে তা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সামাদ সাহেবের প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে গৃহীত হলাে। শুরু হলাে ছাত্রদের ‘দশজনী মিছিল’। স্বেচ্ছায় গ্রেফতারের মাধ্যমে এক নতুন ধরনের সত্যাগ্রহ। এই দশজনী মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের নাম লিখে রাখার দায়িত্ব ছিলাে মােহাম্মদ সুলতান (পরবর্তীকালে বামপন্থী নেতা) এবং কাজী আজাহারের (পরবর্তকিালে স্বরাষ্ট্র সচিব) উপর এমন সময় আকস্মিকভাবে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলাে  রাস্তায় এবং কলাভবনের গেটে শুরু হলাে পুলিশের বেপরােয়া লাঠিচার্জ। অসংখ্য টিয়ার গ্যাসের শেল এসে পড়তে শুরু করলাে কলাভবনের চত্বরে ছাত্ররা সব দৌড়ালাে কলাভবনের পুকুরে। চোখে পানি দিয়ে আর রুমাল ভিজিয়ে সবাই ফিরে এলাে নতুনভাবে জবাব দেয়ার জন্যে। শুরু হলাে ছাত্রদের ইষ্টক নিক্ষেপের পালা। এমন সময় একটা কাদানে গ্যাসের  শেল এসে সরাসরি গাজিউল হকের বুকে লাগায় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। আমরা ধরাধরি করে গাজিউল হককে রেখে এলাম দোতলার একটা রুমে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এলাকায় ছাত্র-পুলিশের সংঘর্ষ অব্যাহত রইলাে। বেলা দু’টা পর্যন্ত। তখন পর্যন্ত গ্রেফতারের সংখ্যা প্রায় দেড় শতাধিক এসময় সবাইকে জানিয়ে দেয়া হলাে যে, বিক্ষোভের স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। বেলা। তিনটায় প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হতে যাচ্ছে অতএব এর পরে বিক্ষোভের স্থান হবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ব্যারাক হােস্টেলের ওপাশটায়। ওই রাস্তা দিয়েই এম এল এদের যেতে হবে পরিষদ ভবনে। আজকের দিনে যেখানটায় জগন্নাথ হল, ১৯৫২ সালে এই পুরােনাে জগন্নাথ হলেই ছিলাে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদ। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন আর মেডিক্যাল হাসপাতালের সীমানার দেয়াল ভেঙ্গে যাতায়াত আরম্ভ করলাে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাত্র-পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হলাে এই নতুন স্থানে। মহাকালের গর্ভে এক এক করে পঁয়তাল্লিশটি বছর বিলীন হয়ে গেছে।

কিন্তু বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি তাে ভুলবার নয়। তখনকার দিনে ছায়ায় ঢাকা রমনা অপরূপ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। সেই রমনার পীচে ঢালা সরু সরু পথগুলাের দু’পাশটায় দাঁড়িয়ে থাকা রক্তকরবী আর হিজল গাছগুলাে হঠাৎ সেদিন থরথর করে কেঁপে উঠলাে। ঢাকার বুকে সংগঠিত হলাে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড কোন রকম পূর্ব সংকেত ছাড়াই একদল সশস্ত্র পুলিশ অবাঙালী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশীর নির্দেশে যমদূতের মতাে দৌড়ে এসে মেডিকেল হােস্টেল প্রাঙ্গণে ‘পজিশন’ নিয়েই ‘ওয়ালী ফায়ার করলাে। এই পুলিশের দল মেডিক্যাল হােস্টেলের রাস্তার উল্টো দিকের একটা দোকানের পিছনে লুকিয়ে ছিলাে। চারিদিকে টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ার মধ্যে কেউ কিছু বুঝবার আগেই গােটা কয়েক অমূল্য প্রাণ মাটিতে লুটিয়ে পড়লাে আর আহতদের আর্তচিৎকার দ্বিতীয় কারবালা’র সৃষ্টি হলাে।  কেনাে জানি না, গুলির আওয়াজে সবাইকে শুয়ে পড়ুন” বলে বিকট এক চিৎকার দিয়ে নিজেও মটিতে উপুর হয়ে রইলাম মাথার উপর দিয়ে কয়েক ঝাঁক গুলি। মেডিকেল হাসপাতাল ভবনের দেয়ালে লাগলাে। কাঁদানে গ্যাসের যন্ত্রণায় চোখ দুটো কচলিয়ে মাটি থেকে উঠে এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখলাম। আহতরা ক্ষতস্থান হাতে ধরে চিৎকার করছে, আর দেহের সেসব জায়গা থেকে ফিকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। অনেকেই পানি’ ‘পানি’ বলে আর্তনাদ করছে। বেশ কটা মৃতদেহ স্ট্রেচারের উপর ।কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। তখন সময় হচ্ছে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রােজ বৃহস্পতিবার অপরাহ্ন বেলা ৩টা ১০ মিনিট। এরপরেও কথার পিঠে কথা থেকে যায়। সেটা হচ্ছে ইতিহাসের কথা। আর সেই ইতিহাস হচ্ছে, বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকেই বাংলাদেশের বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ।পরবর্তী পর্যায়ে শুরু হলাে ধাপে ধাপে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং শেষ অবধি একাত্তরের রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধ সর্বত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব।

সূত্রঃ   একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল