বাংলাদেশের বাঙালী জাতির ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, বিগত সহস্রাধিক বছরের ইতিহাসে আমরা বিশ্বাসঘাতকার দরুন বহিরাগতদের আক্রমণে বারবার পর্যদস্ত ও পরাজিত হয়েছি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে ও মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তর থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাকের নেতৃত্বে গােপন ষড়যন্ত্র হয়েছিলাে। কিন্তু মুজিবনগরের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের তৎপরতা এবং ভারত সরকারের সহযােগিতায় এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করা সম্ভব হয়েছিলাে। এছাড়া অতীতের হাজার বছরের ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার দরুন গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় বাঙালী জাতির ভাগ্যে শুধুমাত্র পরাজয়ের গ্লানি। আর এসব গ্লানি ও পরাজয়ের ইতিহাস দেশী ও বিদেশী ইতিহাসবিদরা নানাভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। শুধু তাই-ই নয়, বুদ্ধিজীবীরাও এসব পরাজয়ের ইতিহাসকে ভিত্তি করে অসংখ্য গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র ও কবিতা রচনা করেছেন। অথচ আমাদের ইতিহাসে একমাত্র বিজয় একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ভিত্তি করে তেমন কোনাে সাহিত্য রচিত হয়নি। উপরন্তু ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের একটা সঠিক ইতিহাস পর্যন্ত লিপিবদ্ধ হয়নি। সর্বত্র হিসাবের গরমিল এবং বিকৃত ইতিহাস রচনার প্রবণতা। এমনকি সুষ্ঠু গবেষণার ব্যবস্থা পর্যন্ত অনুপস্থিত। তা হলে কেন এমনটি হলাে? আমরা যাদের বামপন্থী কিংবা প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যায়িত করে গর্ব অনুভব করি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কম্যুনিস্ট চীনের ভূমিকার দরুন এঁদের অংশবিশেষের মধ্যে ১৯৭১ সালে এই যুদ্ধ সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকায়, এঁরা এই ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে সযত্নে দূরে সরে ছিলেন কিংবা বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছিলেন। ফলে বাঙালী জনগােষ্ঠীর রক্তাক্ত যুদ্ধ এবং বাঙালীর মনমানসিকতার সঙ্গে এসব বুদ্ধিজীবীর কোনােই যােগাযােগ ছিলাে না। এসব বুদ্ধিজীবী আশ্চর্যজনকভাবে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভে বঞ্চিত হয়েছেন। এটা এক বিরাট ট্র্যাজেডি’। কারণ একটাই এবং তা’ হচ্ছে ১৯৭১ সালে পাক-চীন-মার্কিন সখ্যতা দ্বিতীয় বুদ্ধিজীবী গােষ্ঠী ছিলাে ধর্মান্ধ এবং ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়াশীল। এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। তাই এরা বাঙালী গণহত্যাকে অস্বীকার করে দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ্যে বিবৃতি দেয়া ছাড়াও সরাসরিভাবে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর মদ যুগিয়েছেন। আশ্চর্যজনকভাবে এদের অধিকাংশই পেশায় শিক্ষক ও শিল্পী। অবশ্য এদের সংখ্যা অতি নগণ্য। এরা বাংলাদেশের বাঙালী জাতির কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছেন। এদের জীবনের ইতিহাস হচ্ছে স্বৈরাচার ও খুনী শাসকগােষ্ঠীর পদলেহন ও জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস।
অবশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সবাই এসময় হয় ঢাকায়, আর না হয় মুজিবনগরে অবস্থান করছিলেন। যেসব বুদ্ধিজীবী ঢাকায় ছিলেন, মােটামুটিভাবে অসুবিধায় থাকলেও এরা প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে চাকরিতে যােগদান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা করেছিলেন। অথচ এসময় সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক সরকারী কর্মচারী ‘ডিফেক্ট’ করেছিলাে। অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতে এসব বুদ্ধিজীবী চাকরিতে লিপ্ত থাকা: এঁদের পক্ষে গ্রামবাংলায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ ও নারী নির্যাতনের বীভৎস কর্মকাণ্ড কিংবা এর বিপরীতে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহসিকতাপূর্ণ লড়াই, কিছুই দেখা সম্ভব হয়নি। মহল বিশেষের মতে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এসব বুদ্ধিজীবীর ‘পলায়নী মনােবৃত্তি’র বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলাে প্রকটভাবে ফলে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি এদের নৈতিক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও এঁরা যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে যে বিপুল সংখ্যক শ্রদ্ধাভাজন বুদ্ধিজীবী দুর্গম পথ অতিক্রম করে মুজিবনগরে গিয়েছিলেন, তারা প্রবাসী সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন। এরা সভা, শােভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল, সেমিনার, চিত্রপ্রদর্শনী ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে নানাভাবে প্রচার ও প্রােপাগাণ্ডায় লিপ্ত ছিলেন। এমনকি এঁরা শরণার্থী শিবিরগুলােতে পর্যন্ত নিয়মিতভাবে যাতায়াত করেছিলেন। কিন্তু এদের কেউই একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করা তাে দূরের কথা, রণাঙ্গন পর্যন্ত পরিদর্শন করেননি। এঁরা কেউই রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধাদের লড়াই দেখেননি কিংবা রাজাকার, আলবদর এবং পাকিস্তানী রাজাকার বাহিনী নারকীয় কর্মকাণ্ড অবলােকন করেননি। এঁরা জীবনের দুর্লভ অভিজ্ঞতা লাভে বঞ্চিত হয়েছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই এসব বুদ্ধিজীবী এবং গ্রামবাংলার জনগােষ্ঠীর মধ্যে চিন্তাধারার বিরাট ব্যবধানের সৃষ্টি | হয়েছে। আর এই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার পর যখন সমগ্র জাতি প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছােটগল্প, উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্রের জন্য সাগ্রহে প্রতীক্ষা করছিলাে, তখন বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাবে আমাদের লেখক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ জাতির সেই চাহিদা মেটাতে পারেন।
বরং মুক্তিযােদ্ধাদের “আবার তােরা মানুষ হ” অর্থাৎ রাজাকার হবার উপদেশ দিয়েছেন। এর চেয়ে লজ্জার ব্যাপার আর কি হতে পারে? ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় নয়াদিল্লীতে ১৮ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর নাগাদ এক আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবী সম্মেলনের আয়ােজন করা হয়েছিলাে । বিশ্বের ২৪টি দেশের ১৫০ জনের মতাে বুদ্ধিজীবী এই সম্মেলনে যােগ দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে সােচ্চার হয়েছিলেন। প্রখ্যাত ফরাসী মনীষী আঁন্দ্রে মারােকে এই সম্মেলনের জন্য আমন্ত্রণলিপি পাঠানাে হয়েছিলাে। তিনি অপারগতার কথা জানিয়ে এক চমৎকার জবাব দিয়েছিলেন। তিনি এমর্মে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর বয়স এখন সত্তরের ঊর্ধ্বে। এসময় প্যারিস থেকে বিমানে দিল্লী যাওয়ার ধকল সহ্য করার মতাে যদি তার শারীরিক সামর্থ্য থাকতাে, তাহলে তিনি আরও কিছুদূর এগিয়ে অস্ত্র হাতে বাংলাদেশের রণাঙ্গনে বাঙালী মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই-এ অংশ গ্রহণ করতেন। এতে অন্তত এই বয়েসেও তার জীবনের অভিজ্ঞতায় একটা নতুন অধ্যায় সংযােজিত হতাে।
বর্তমান শতাব্দীর তিরিশ দশকে হিটলারের দোসর ফ্যাসিস্ট ফ্রাংকোর বিরুদ্ধে স্পেনের বিপ্লবের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গণতন্ত্রের আদর্শকে সমুজ্জ্বল রাখার লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক যােগদান করেছিলাে। এঁদের মধ্যে বৃটেনের শ্রমিক নেতা এটলী (পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী) এবং প্রখ্যাত মার্কিনী লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে অন্যতম ছিলেন। হেমিংওয়ে এসময় সুদূর আমেরিকা। থেকে স্পেনে আগমন করে ডিক্টেটর ফ্রাংকোর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতার ফসল হচ্ছে বিশ্ব সাহিত্যের অমর সৃষ্টি ‘ফর হুম্ দি বেল টলস’। তবে অত্র ভূখণ্ডে বুদ্ধিজীবীদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত ঐতিহ্য সম্পূর্ণ ভিন্নতর এবং দারুণ বিতর্কিত। ১৭৫৭ খৃস্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ১৯০ বছরব্যাপী ইংরেজ রাজত্বে এঁরা কোনাে সময়েই ইংরেজ-বিরােধী কোনাে বিদ্রোহ কিংবা লড়াই-এর প্রতি সামান্যতম সমর্থন কিংবা সমবেদনা জানাতে এগিয়ে আসেননি; বরং বিরােধিতা করেছেন। সমসাময়িককালে কোলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিন্দনীয় বলে চিহ্নিত করতেই হয়। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করতে হয় যে, ১৮৫৭ খৃস্টাব্দের জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ সিপাহীদের বিপর্যস্ত অবস্থা এবং পরাজয় সংক্রান্ত সংবাদ দিল্লী থেকে কোলকাতায় এসে পৌছালে ২০শে জুন পণ্ডিত গৌরীশংকর ভট্টাচার্য। সম্পাদিত ‘সংবাদ ভয়ঙ্কর’ পত্রিকায় প্রকাশিত মন্তব্যের অংশবিশেষ নিম্নরূপঃ “হে পাঠক সকল, ঊর্ধ্ববাহু হইয়া পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া জয়ধ্বনি করিতে করিতে নৃত্য কর।
আমাদিগের প্রধান সেনাপতি (ইংরেজ) মহাশয় সসজ্জ হইয়া দিল্লী প্রদেশে প্রবেশ করিয়াছেন, শত্ৰুদিগের মাের্চা শিবিরাদি ছিন্নভিন্ন করিয়া দিয়াছেন, যাহারা বাহিরে যুদ্ধে আসিয়াছিল আমাদের তােপমুখে অসংখ্য লােক নিহত হইয়াছে, রাজসৈন্যরা ন্যূনাধিক ৪০ তােপ এবং শিবিরাদি কাড়িয়া লইয়াছেন, হতাবশিষ্ট পাপিষ্টেরা দূর্গ প্রবিষ্ট হইয়া কপাট রুদ্ধ করিয়াছে। আমাদিগের সৈন্যরা (ইংরেজ) দিল্লীর প্রাচীরে উঠিয়া নৃত্য করিতেছে । এছাড়া ওয়াহাবী আন্দোলন, তিতুমীরের লড়াই, ফকির বিদ্রোহ, রংপুর, সন্দ্বীপ ও। সিরাগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহ, ময়মনসিংহে হাজংবিদ্রোহ এমনকি চট্টগ্রামে মাস্টারদার | নেতৃত্বে অস্ত্রাগার দখল ও বিদ্রোহ প্রভৃতি রক্তাক্ত ঘটনাবলীর সর্বত্র সমসাময়িককালের বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। তাই ইংরেজ রাজত্বে উনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গীয় এলাকায় রেনেসাঁর আগমনের যে কথা বলা হয়, সেটা সঠিক অর্থে কিছুতেই ‘রেনেসা’ নয়। আসলে সেটাই ছিলাে ইংরেজের বশ্যতা স্বীকার এবং ইংরেজের দালালী। সে আমলের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই লিখেছেন যে, “অনেকে রাগ করিয়া বলিবেন যে, তবে কি স্বাধীনতা পরাধীনতার তুল্য? তবে পৃথিবীর তাবজ্জাতি স্বাধীনতার জন্য প্রাণপাত করে কেন? যাহারা এইরূপ বলিবেন, তাহাদের নিকট আমার আবেদন এই যে, আমরা সে তত্ত্বের মীমাংসায় প্রবৃত্ত নই। আমরা পরাধীন। জাতি, অনেককাল পরাধীন থাকিব- সে মীমাংসায় আমাদের প্রয়ােজন নাই।” (ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও পরাধীনতা, বিবিধ প্রবন্ধ ১ম খণ্ড) বিংশ শতাব্দীর ষাট দশকের মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মার্কসিস্ট গবেষক সুপ্রকাশ রায় বুদ্ধিজীবীদের মনমানসিকতার যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন। তিনি লিখেছেন, “উনবিংশ শতাব্দীতে যখন বিহার ও বঙ্গদেশের উত্তর দিয়া কৃষক বিদ্রোহের ঝড় বহিতে ছিল, তখন এই শিক্ষিত মধ্যশ্রেণী গণসংগ্রামের দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া বিদেশী ইংরেজ প্রভুদের শাসনকে “ভগবানের আশীর্বাদ” রূপে বরণ করিয়া ইংরেজী শিক্ষাদানের ভিত্তিতে নিজেদের নূতনভাবে গড়িয়া তুলিতে ব্যস্ত হইয়াছিলেন।” (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ, সুপ্রকাশ রায়, কলিকাতা) অবশ্য ইংরেজ রাজত্বের অন্তিম সময়ে অর্থাৎ প্রথম মহাযুদ্ধের পর যখন নির্যাতনের আশংকা পরিমাণে অনেকটা হ্রাস পেয়েছে, তখন পলাশীর যুদ্ধ, সিপাহী বিদ্রোহ এবং কৃষক বিদ্রোহের পটভূমিতে নাটক ও উপন্যাস রচনা এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে। বুদ্ধিজীবীদের প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। কিন্তু লক্ষণীয় যে, ইতিহাসের আলােচ্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত আমাদের পরাজয় ও ব্যর্থতার গ্লানি বহন করতে হয়েছে। তাই শুধু হতাশা আর ক্রন্দন।
পাকিস্তান আমলেও এর জের অব্যাহত ছিলাে। ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্র সম্পর্কে লিয়াকত আলী খানের প্রস্তাবিত খসড়া মূলনীতির বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিলাে, তাতে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীও অবদান রেখেছিলেন। অবশ্য ১৯৫১ সালের ১৬ই অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীখান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে এই আন্দোলনের আর প্রয়ােজন হয়নি। বায়ান্নোর বাংলাভাষা আন্দোলন পুরােপুরিভাবে কেবলমাত্র ছাত্ররাই সংগঠিত করেছিলাে। আসলে ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণের পর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একাংশ মাত্র ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন এবং তৎকালীন মুসলিমলীগ সরকারের নির্যাতন সহ্য করেছিলেন। পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী হিসেবে যেসব বুদ্ধিজীবীর নামের উল্লেখ করা হচ্ছে, ১৯৫২ সালে কিন্তু তাদের মুখ্য পরিচয় ছিলাে ছাত্র হিসেবে। পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভাসানী-মুজিবের নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আওয়ামী লীগের মঞ্চ থেকে যে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিলাে, সেখানেও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিলাে নগণ্য। “সহায়ক শক্তি হিসেবে উল্লেখ করলে তা কিছুটা অতিরঞ্জিত হবে বৈকি। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৬২ সালে যে রক্তাক্ত ছাত্র আন্দোলন হয়েছিলাে, তাতে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আইয়ুব-মোনায়েমের স্বৈরাচারী শাসনে ১৯৬৪ সালে ঢাকা ও খুলনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে, সেদিন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান বিক্ষুব্ধ হৃদয়ে স্বয়ং দৌড়ে প্রেসক্লাবে এসে হাজির হয়েছিলেন। তারই উদ্যোগে প্রণীত হয়েছিলাে সেই ঐতিহাসিক প্রচারপত্র “পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও”। পরদিন ঢাকার সমস্ত দৈনিক পত্রিকায় ব্যানার হেডিং-এ এই প্রচারপত্র ছাপা হয়েছিলাে এবং মাত্র ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে দাঙ্গা বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত ৬-দফা দাবির আন্দোলন আওয়ামী লীগকে একাকী করতে হয়েছিলাে। অন্য কোনাে রাজনৈতিক দল তাে দূরের কথা; সেদিন কোনাে বুদ্ধিজীবী পর্যন্ত ৬-দফার সমর্থনে এগিয়ে আসেননি। ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য ৩৪ জনের বিরুদ্ধে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হলে আওয়ামী লীগ ছাড়া ছাত্র সমাজও আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিলাে। ডাকসুর ভিপি তােফায়েল আহমদের নেতৃত্বে ছাত্রদের ১১ দফা দাবি ছিলাে ৬-দফার সম্পূরক। এটা এমন একটা সময় ছিলাে, যখন একদিকে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং অন্যদিকে কুখ্যাত প্রেস অর্ডিনান্সে সংবাদপত্রের কণ্ঠরােধ করা হয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত এবং বেতার ও টিভিতে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার পর্যন্ত বন্ধ । এমনকি মেয়েদের কপালে টিপ দিয়ে টিভি’র পর্দায় আসা পর্যন্ত বেআইনি। সমগ্র দেশব্যাপী এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। শেষ অবধি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের এক রিবাট অংশ আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনের “লেজুড়” হিসেবে ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে এগিয়ে এলেন। ১৯৬৯ সালের ১৫ই জানুয়ারি প্রবীণ বুদ্ধিজীবী ডঃ মুহম্মদ এনামুল হকের সভাপতিত্বে বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হলাে। এতে বক্তৃতা করেছিলেন সর্বজনাব শিল্পী জয়নুল আবেদীন, কবি সুফিয়া কামাল, কবি সিকান্দার আবু জাফর, সাংবাদিক কে জি মুস্তাফা, অধ্যাপক মনসুর উদ্দীন, সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত, অধ্যাপক আহম্মদ শরীফ এবং সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখ। প্রায়ই একই সময়ে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ‘DON’T DISTURB AYUB’ নীতি নর্দমায় নিক্ষেপ করে আইয়ুব বিরােধী আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত গণপরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ এবং জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করলে পূর্ব বাংলায় শুরু হয় এক সর্বাত্মক আন্দোলন। নানা স্থানে তখন জনতা ও সৈন্যবাহিনীর মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ।
এরই মােকাবেলায় আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক অসহযােগ আন্দোলন শুরু হলে, বুদ্ধিজীবীরাও এর সমর্থনে এগিয়ে এলেন। তখন গঠিত হলাে ‘পূর্ববাংলা বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’। এরাও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এরপরের ইতিহাস সবারই জানা। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গণহত্যার মােকাবেলায় ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর । রহমানের আহ্বানে শুরু হলাে স্বাধীনতাযুদ্ধ। আবারাে উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, যেসব। বুদ্ধিজীবী এসময় সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন, তারা প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে প্রশংসনীয় অবদান রাখলেও অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা তাে দূরের কথা, এরা রণাঙ্গন পর্যন্ত পরিদর্শন করেননি। এরই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতাত্তর যুগে আমরা চাঞ্চল্যকর ঘটনা অবলােকন করেছি। মুক্তিযুদ্ধে দুই নম্বর সেক্টরে বীর খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে লড়াই, বাংলাদেশ-মেঘালয় সীমান্তে তাহেরের নেতৃত্বে কামালপুরের লড়াই, নয় নম্বর সেক্টরে মেজর জলিলের নেতৃত্বে লড়াই, উত্তরাঞ্চলে এম কে বাশারের বাহিনীর যুদ্ধ, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ-কমান্ডোর এ্যাকশন, সুন্দরবনে মেজর জিয়াউদ্দিনের লড়াই এবং ময়মনসিংহ-ঢাকা-টাঙ্গাইল এলাকায় টাইগার সিদ্দিকীর দুঃসাহসিক লড়াই আর খােদ্ ঢাকা নগরীতে মােফাজ্জল হােসেন মায়ার নেতৃত্বে এ্যাকপ্লাটুনের অবিস্মরণীয় গেরিলা হামলার কাহিনীভিত্তিক উল্লেখযােগ্য সংখ্যক নাটক, উপন্যাস, ছােটগল্প, চলচ্চিত্র সৃষ্টি হলাে না। যা কিছু রচিত হয়েছে, সবই পাসে মনে। হয়। কেননা লেখকদের বাস্তব অভিজ্ঞতার বড় অভাব। অন্যের হাতে তামাক খাওয়া। যায় না। | আমরা লেখক সমাজ ভেবেছিলাম যে, একাত্তরের যুদ্ধের দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর আমাদের পাঠক সমাজ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম আর বােধ হয় স্বাধীনতাযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক, উপন্যাস, ছােটগল্প, চলচ্চিত্র ইত্যাদির জন্য “বিরক্ত করবে না। কিন্তু বাস্তবে অবস্থাটা আরাে জটিল হয়ে দাড়িয়েছে। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বর হামলা থেকে প্রাণ বাঁচানাের জন্য যে বালক তার পিতার হাত ধরে ঝােপ, জঙ্গল, নদীনালা আর মাঠঘাটের মাঝ দিয়ে দৌড়িয়েছে, যে বালক বুঝতে পেরেছিলাে যে তার মুক্তিযােদ্ধা পিতা রাতের অন্ধকারে বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর। আর ফিরে আসেনি কিংবা যে কিশাের সেই অন্ধকার রাতে গুলির শব্দে আকস্মিকভাবে ঘুম ভাঙ্গার পর আগুনের লেলিহান শিখা আর বীভৎস হত্যাযজ্ঞের মাঝে নিজের। পরিবারের আর পড়শীদের বিকৃত লাশ দেখেছে, তাদের এখন পূর্ণ যৌবন।
তারা এখন জানতে চায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেননা হয়েছিলাে? মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা কিভাবে লড়াই করেছিলাে? প্রবাসী মুজিবনগর সরকার কিভাবে। সাফল্য অর্জন করেছিলাে? আমাদের শত্রুর চেহারাটাই বা কেমন ছিলাে? এরই পাশাপাশি ১৯৭১ সালে যে শিশু মাতৃজঠরে ছিলাে, সে আজ যৌবনে পদার্পণ করে পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ধাপে ধাপে রাজনৈতিক আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ এবং সঠিক ইতিহাস জানতে চায়। সে আজ বুঝতে চায় ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস। আর ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের আসল তাৎপর্য কি? তার মনে অনেক প্রশ্ন। যেখানে । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বাঙালী জাতির একমাত্র উচ্চারিত শ্লোগান ছিলাে ‘জয়। বাংলা’, সেখানে ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পাকিস্তানী স্টাইলের বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি আগমন হলাে কিভাবে? যেখানে আমাদের জাতীয় পরিচয়। হচ্ছে বাঙালী’ হিসেবে, সেখানে স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি। মাসে বাংলাদেশী” শব্দের অনুপ্রবেশ হলাে কিভাবে? ঢাকার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের। যেখানে পরাজিত পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যরা আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিলাে, সেখানে কোনাে বিজয় স্তম্ভ নাই কেননা? এরকম অসংখ্য কেনাের উত্তর চাওয়া নিশ্চয়ই কোনাে অপরাধ নয়।
স্বাধীনতা লাভের ২৫ বছর পরে আমাদের বংশধরেরা এবং নতুন প্রজন্য ছােটগল্প, উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্রে এসব ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতিফলন দেখতে চায়। আজকের দিনে যখন সংবাদপত্রে ছােট্ট করে খবর ছাপা হয় যে, মুক্তিযােদ্ধার রিকশা। চালকের বৃত্তি গ্রহণ কিংবা মুক্তিযােদ্ধা পরিবারের ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ’, তখন আজকের যুব সমাজ আমাদের সহিত্য ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বুঝতে চায় যে, স্বাধীনতাত্তর ২৫ বছরে এমন কি সামাজিক অবস্থার বিবর্তন হয়েছে যার ফলশ্রুতিতে গ্রামের মুক্তিযােদ্ধাদের এমন পরিণতি হয়েছে? তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এমর্মে প্রশ্ন উত্থাপিত হবে যে, | আধুনিক কবিতা ও নাটক ছাড়া সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় লেখকদের এমন ব্যর্থতা হলাে কিভাবে? একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং এতদ্সংক্রান্ত বিষয়াদির কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশের মেহনতী জনতা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যে সংগ্রাম করছে, কিংবা কোন্ প্রেক্ষাপটে এবং কিভাবে প্রতি বছর লাখ লাখ কৃষি পরিবার ভূমিহীন হচ্ছে— আমাদের সাহিত্যে এসবের কিছুই তাে প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না! আশ্চর্যজনক হলেও একথা সত্য যে, আমাদের লেখকদের মধ্যে যে ক’জনার এসব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা রয়েছে, তারাও সম্ভবত সমাজচ্যুত হওয়ার আশংকায় তাদের অভিজ্ঞতা ব্যবহারে বিমুখ হয়ে রয়েছেন। একথা আরাে সত্য যে, ঢাকায় এখন প্রবীণ লেখক, অধ্যাপক, সংস্কৃতিবিদ শিক্ষাবিদ এবং বুদ্ধিজীবীর ঠিকানা খোঁজার জন্য ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, ইন্দিরা রােড, মগবাজার, ইস্কাটনের অত্যাধুনিক এলাকায় যেতে হয়- পুরানাে ঢাকায় নয়। ফলে আমরা যারা শহর-ভিত্তিক বুদ্ধিজীবী নিজেদের লেখক হিসেবে দাবি করছি, তাদের মধ্যে নিঃশেষিত মানুষের বিচিত্র আর বাস্তব অভিজ্ঞতার বিস্তর ফারাক হয়ে গেছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে আমরা সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছি।
প্রগতি আর গণতন্ত্রের নামে স্লোগান উচ্চারণ করে আমরা ঢাকা মহানগরীতে এক অপরূপ আর অদ্ভুত কোটারি সদস্য এন, জি, ও’ আর কন্সাল টেসির’ নবদিগন্তে আমাদের বিচরণ শুরু হয়েছে। মনি-কাঞ্চনের হাতছানিতে আমরা উদভ্রান্ত হয়ে উঠেছি। আমরা নিজেদের অজান্তেই উনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ বুদ্ধিজীবীদের অনুকরণে সৃষ্টি করেছি বাঙালী ‘ফেবিয়ান সােসাইটি’ আমরা খুবই | দক্ষতার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারের কাছ থেকে ফায়দা আদায় করেছি। তীব্র সমালােচনার মুখােমখি হবাে জেনেও শুধুমাত্র আত্মবিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের জন্যই প্রশ্নগুলাে উত্থাপন করতে বাধ্য হলাম। কেননা বাংলাদেশের গণমানুষের চোখে আমরা অপাংতেয় ও জীর্ণ-পুরাতন এবং চৈত্রের ঝরা পাতার মতাে। আসলে আমরাই হচ্ছি প্রতিক্রিয়ার ছদ্মবেশী প্রতীক ।
সূত্রঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল