You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৪ই অক্টোবর, সোমবার, ১৯৭৪, ২৭শে আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

ভারত মহাসাগর অভিমুখে ‘এন্টারপ্রাইজ’

‘এন্টারপ্রাইজ’ আবার ভারত মহাসাগরে আসছে। পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন এই বিমানবাহী জাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’ একবার আলোড়ন তুলেছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে। সপ্তম নৌবহরের এই বিমানবাহী জাহাজ দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসছিল বঙ্গোপসারের দিকে। সারা দুনিয়া উপমহাদেশের এই দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপকতর এক ধ্বংসযজ্ঞের আশঙ্কায় রুদ্ধ নিঃশ্বাসে দিনক্ষণ গুণছিল। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আমাদের যৌথ কমান্ডের কাছে মার খেয়ে ধীরে ধীরে তাদের শক্তি গুটিয়ে নিচ্ছে অগ্রভাগ থেকে। এমনি সময় ‘এন্টারপ্রাইজের’ ভারত মহাসাগরে আগমন।
শান্তিকামী মানুষ সেদিন সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছিল বঙ্গোপসাগর অভিমুখী ‘এন্টারপ্রাইজের’ অভিযানের বিরুদ্ধে। আজ আবার ‘এন্টারপ্রাইজ’ ভারত মহাসাগর অভিমুখে ধেয়ে আসছে না জানি কোনো ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে শরীক হতে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উত্তেজনাকর পরিস্থিতির অবসান ঘটেনি। পাকিস্তানে স্বৈরতান্ত্রিক শাসকেরা উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণে অকারণে শুধু কালক্ষেপণ করছে। খোদ পাকিস্তানে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাদের সঙ্গে সংগ্রামরত। কম্বোডিয়ায় লননল সরকারের বিরুদ্ধে জনমনে প্রচন্ড বিক্ষোভ; তার অর্ধেকেরও বেশী অঞ্চল মুক্তি সংগ্রামীদের দখলে। অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের প্রভাব এবং কর্তৃত্ব দক্ষিণ ভিয়েতনামে দিনের পর দিন বাড়ছে। অধিকৃত এলাকাতে পর্যন্ত থিউ বিরোধী আন্দোলন একেবারে তুঙ্গে পৌঁছেছে। লাওসে চলছে জাতীয় কোয়ালিশন সরকারের অগ্রযাত্রা প্রতিরোধে দক্ষিণপন্থী ষড়যন্ত্র। উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পুনর্মিলনের প্রচেষ্টা গণবিরোধী মহলের নানারকম উস্কানী এবং ছল-ছাতুরীর ফলে নিদারুণভাবে বিঘ্নিত। থাইল্যান্ডে গণতান্ত্রিক শক্তি দিনের পর দিন আরো সংঘবদ্ধ এবং সেখানে মার্কিন উপস্থিতির বিরুদ্ধে আরো সোচ্চার হয়ে উঠছে। এমনি পরিস্থিতির মুখে ‘এন্টারপ্রাইজের’ এই অকস্মাৎ আগমন সন্দেহের সৃষ্টি না করে পারেনা।
ভারত মহাসাগরকে এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ ‘শান্তি এলাকা’ ঘোষণার দাবী জানিয়ে আসছে বহুদিন ধরে। জাতিসংঘেও এর স্বপক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি পাকিস্তান এবং ইরানের মতো দেশও এই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। অথচ সমস্ত অঞ্চলের জনমতের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক শক্তি বাড়িয়েই চলেছে দিনের পর দিন।
অজুহাত দেখানো হয়েছে রাশিয়ার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পদলেহী দেশের শাসকবর্গ মাঝে-মধ্যেই ভারত মহাসাগরে রাশিয়ার নৌ-উপস্থিতির ধুয়া তুলে সেখানে মার্কিনীদের সামরিক উপস্থিতির ন্যায্যতা প্রমাণ করতে চায়। বাংলাদেশ আর ভারতই শুধু নয়, এই এলাকার অন্যান্য দেশও সুস্পষ্টভাবে এই অজুহাতের বিরোধিতা করেছে। তারা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এখানে রুশ সামরিক শক্তির অবস্থানের কথা অস্বীকার করেছে। যারা রাশিয়ার নৌ-উপস্থিতির কথা তোলেন তারা কেউ কিন্তু আজ পর্যন্ত রুশ সামরিক শক্তির সঠিক শক্তি নিরূপণ অথবা অবস্থানের দিক নির্দেশ করতে পারেননি।
যে অজুহাত তুলেই ভারত মহাসাগরে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের সামরিক সমাবেশ ঘটাক না কেন আমরা তার প্রতিবাদ করি। যদি রাশিয়ার কোনো নৌ-উপস্থিতি আদৌ থেকে থাকে তবে তাও সরিয়ে নেয়ার দাবী জানাতে আমরা কসুর করবোনা। মোটের উপর ভারত মহাসাগরে তথাকথিত শক্তির ভারসাম্য অথবা ‘মাতবরীর ঠিকাদারী’ আমরা কাউকে দিতে রাজী নই। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কোটি কোটি গণতন্ত্র এবং শান্তিকামী মানুষের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে আমরাও দাবী জানাবো এ সাগর থেকে সকল সামরিক অবস্থান সরিয়ে নেয়া হোক।

দুগ্ধজাত মিষ্টি ও অতঃপর

দুধের অভাব পূরণের জন্য সরকার সারাদেশে দুগ্ধজাত মিষ্টি তৈরীর উপর নিষেধাজ্ঞা জারীর কথা খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন বলে গত পরশু খুলনাতে খাদ্যমন্ত্রী জনাব আবদুল মোমিন ঘোষণা করে বলেছেন, অবিলম্বে এই নির্দেশ জারী করা হবে। খবরটি পাওয়া মাত্রই মধ্যবিত্ত মায়েদের পুলকিত হবার কথা। কারণ শিশুখাদ্য সংগ্রহের জন্য দেশের অপরাপর অংশের কথা বাদ দিলেও খোদ এই ঢাকা শহরে এমন একটা দিনও বাদ যায় না, যেদিন ন্যায্যমূল্যে টিনের দুধ কিনবার জন্য মহিলারা এই আশ্বিন মাসের ভরা রোদ্র মাথায় করে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। বলাবাহুল্য দুধের মুখ দেখতে পারার সৌভাগ্য ঘটে থাকে তাদের খুব কম জনারই। সেক্ষেত্রে দুগ্ধজাত মিষ্টি তৈরী বন্ধ করে দেশের কচি শিশুদের মুখে দু’চামচ দুধ তুলে দেয়ার এ সরকারী প্রচেষ্টা একটা বিরাট সুখবর নিঃসন্দেহে।
দুগ্ধজাত মিষ্টি তৈরী বন্ধ করে সমস্যার সমাধান করতে পারলে সেটা বাস্তবিকই আনন্দের কথা ছিল। তদুপরি এর ফলে প্রচুর পরিমাণ চিনিও বেঁচে যাবে। সুতরাং বহু চিন্তা-ভাবনা করে যুগপৎভাবে দুধ ও চিনি বাঁচানোর ফন্দি যারা বের করেছেন তাদের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন : দেশের শিশুখাদ্যের অভাব আজ সৃষ্টি হয়নি। বহুদিন থেকে এই সমস্যায় আমরা আক্রান্ত। শিশু খাদ্যের অভাব পূরণের জন্য সরকার কম কাঠ-খড় পোড়াননি। বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে দুধ আনা হয়েছে। ন্যায্যমূল্যে বিক্রির নামে দশ টিন দুধ লাইনের প্রথম দিকে দিয়ে দোকানের ঝাঁপ টেনে দিয়েছে দোকানদারেরা, এসবই আমাদের জানা কথা এবং এতদিনে সরকারের তরফ থেকে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। অন্য আর দশটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মতো শিশু খাদ্যও কালোবাজারীর গুদামে যেয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বাইরের থেকে হম্বিতম্বি ছাড়া কালোবাজারীর গুদামে হাত দেয়ার সাহস আজ পর্যন্ত কর্তারা দেখাতে পারেননি। যদি পারতেন শিশু খাদ্য সহ চাল-ডাল-নূন-তেলের এ অবস্থা দাঁড়াতো না। রাতারাতি তা ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে আসতো। কাজেই ময়রার দোকানে দুধ দিয়ে মিষ্টি তৈরী বন্ধের খবরে যারা আনন্দে বগল বাজাতে শুরু করেছেন, তাদের উদ্দেশে আমাদের নিবেদন, বহু নির্দেশ আর গরম গরম কথা শুনে আমরাতো আগেও বহুবার বগল বাজিয়েছি; কিন্তু ঐ পর্যন্তই, কাজের কাজ তো কিছুই হয়নি। সুতরাং পুলকিত হবার কিছু নেই আপাততঃ। তাছাড়া স্বাধীনতার আগেও ময়রার দোকান ছিল। তখন যদি এ প্রশ্ন না উঠে তবে আজ উঠছে কেন? সবচাইতে দুঃখজনক হলো, কর্তারা গোড়ায় হাত দেন না। আগে বেশী পরিমাণ শিশু খাদ্য আমদানীর প্রশ্ন উঠলে নানা মহল থেকে বৈদেশিক মুদ্রার কথাও বলা হতো। আজ বাজারে বিদেশী ব্লেডে ছেয়ে গেছে। এ সব তারাই পাঠাচ্ছেন, যারা বিদেশে যেয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন। অথচ সরকারীভাবে যদি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রবাসী বাঙালীদেরকে শিশু খাদ্য আমদানীর ব্যাপারে উৎসাহিত করা হতো আমাদের মনে হয়, দুর্মূল্যের ব্লেডের মতো শিশু খাদ্যও প্রচুর আমদানী হতো সরকারের একটি বৈদেশিক মুদ্রাও খরচ না হয়ে।
এরপর রয়েছে পশু পালন ইত্যাদির ক্ষেত্রে সরকারীভাবে উৎসাহ প্রদানের ব্যাপারে অনীহা। এই একটি ব্যাপারে যদি যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো তাহলে দেশের শিশু খাদ্যের এ বর্তমান দশা হতোনা। তাছাড়া দুগ্ধজাত মিষ্টি তৈরী বন্ধের নির্দেশ দিলেও সে নির্দেশ যে যথারীতি কার্যকরী হবে তার কি কোনো সঠিক নিশ্চয়তা দিতে পারেন খাদ্যমন্ত্রী? অথচ এমনও হতে পারে যে, এই নির্দেশ বাস্তবায়নে নিযুক্ত একশ্রেণীর কর্মচারীর পকেট ভারী হতে থাকবে আর দশটা নির্দেশ বাস্তবায়নে এদেশের বিভিন্ন বিভাগের কর্মচারীদের মতো। সুতরাং আমরা জানিনা দুধ দিয়ে মিষ্টি তৈরী বন্ধ করার আগে কর্তা ব্যক্তিরা এ সমস্ত দিক সম্পর্কে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করে দেখবেন কি-না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!