You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.08.02 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | ঢাকা-বেলগ্রেড যুক্ত ইশতেহার | বন্যার দ্বিতীয় ছোবল? | ইদি আমিনের বায়না | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
২রা আগস্ট, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ১৭ই শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

ঢাকা-বেলগ্রেড যুক্ত ইশতেহার

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ দিনের যুগোশ্লাভিয়া সফরান্তে গত পরশু ঢাকা এবং বেলগ্রেড থেকে একযোগে প্রকাশিত হয়েছে এক যুক্ত ইশতেহার। ইশতেহারে উপমহাদেশের সমস্যাবলী সমাধানের প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আলোচনা অনুষ্ঠানের আহ্বান জানানো হয়েছে। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলে উপমহাদেশে যে মানবীয় সমস্যাবলীর জন্ম হয়েছে, সেই সব সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করে যুগোশ্লাভ প্রধানমন্ত্রী জামাল বিয়েদিচ বলেছেন, উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পদক্ষেপ যৌক্তিকতাপূর্ণ। যুক্ত ইশতেহারে বাংলা-যুগোশ্লাভের মধ্যে সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং অব্যাহত রাখার প্রশ্নে উভয় দেশই সম্মতি জ্ঞাপন করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের অবস্থা যে দিনের পর দিন চরম অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং মানবীয় সমস্যা নিরসনকল্পে যে ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত ঘোষণা রচিত হয়েছিলো সে সম্পর্কেও ঢাকা-বেলগ্রেড যুক্ত ইশতেহারে আলোকপাত করা হয়েছে। দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে আশু ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং আরব জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার কায়েমের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা আরও প্রশমিত হওয়া আবশ্যক। যুক্ত ইশতেহারে অধিকাংশ আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেই দুই দেশ সম্পূর্ণ এক এবং অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। জোট নিরপেক্ষতার নীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বলে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী অভিমত প্রকাশ করেছেন। সম্মেলনের গুরুত্বের প্রতিও যুক্ত ইশতেহারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। যুক্ত ইশতেহারে ঘোষণা করা হয়েছে যে, জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে যুগোশ্লাভিয়া তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। দু’দেশের দুই প্রধানমন্ত্রীই ঔপনিবেশিকতা, নয়া ঔপনিবেশিকতা এবং বর্ণবাদী নীতির নিন্দা করেছেন। যুক্ত ইশতেহারে ভিয়েতনাম ও লাওসে যুদ্ধাবসানকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
মোদ্দা কথা, আন্তরিকতাপূর্ণ হার্দিক পরিবেশে দু’পক্ষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিস্তৃত আলোচনার পরই প্রকাশিত হয়েছে এই যুক্ত ইশতেহারে। উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠাকল্পে বাংলাদেশের নিরলস প্রচেষ্টা এখনো থেমে নেই। কিন্তু সমস্যার কোন সমাধান আজও হচ্ছে না। যুক্ত ইশতেহারে অবশ্য উপমহাদেশের বিরাজিত সমস্যাবলী যাতে মিটিয়ে ফেলা যায় সে জন্যে সমমর্যাদার ভিত্তিতে পারস্পরিক আলোচনার উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যুক্ত ইশতেহারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার জন্য জোট নিরপেক্ষতাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোই জোটনিরপেক্ষ তৃতীয় ব্লক গঠনের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা। বাংলাদেশও জোটনিরপেক্ষ নীতির বলিষ্ঠ সমর্থক। শুধু তাই নয়, অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রশ্নেও বাংলাদেশ যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে একই মত পোষণ করে। কাজেই সমমনা এই দু’টি দেশের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন যে গভীর ও ঘনিষ্ঠতর হবে তাতে আর সংশয়ের কি আছে।
বাংলাদেশ-যুগোশ্লাভ ইশতেহারকে তাই আমরা আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাই। কারণ, শান্তি সংগ্রামে বাংলাদেশ যুগোশ্লাভিয়াকেও অন্যতম বন্ধু হিসেবে পেয়েছে। ‍পৃথিবীর যেখানে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি দেখা দেবে, যেখানেই ন্যায়সঙ্গত দাবীর বিরুদ্ধে অস্ত্রের খেলা জমে উঠবে, সেখানেই এই দু’টি দেশ জানাবে তীব্র প্রতিবাদ। সমগ্র বিশ্বব্যাপী আজ যে শান্তির অন্বেষণ অব্যাহত রয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা-বেলগ্রেড যুক্ত ইশতেহারকে একটি শান্তি ও স্বস্তির প্রতীক বলেই আমরা আখ্যায়িত করছি।

বন্যার দ্বিতীয় ছোবল?

নদীর পানি বাড়ছে। বাড়ছে সেই সঙ্গে বিপদের আশঙ্কা। এই কিছুদিন আগেই বন্যায় বেশ ক’টি জেলার বিস্তৃত অঞ্চল প্লাবিত হয়েছিলো। শস্যহানি থেকে প্রাণহানি যা হয়েছে তার রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই যে বন্যা দ্বিতীয়বারের মতো আবার আমাদের অর্থনীতিতে আঘাত হানবে সেটা হয়তো অনেকেরই ধারণার বাইরে ছিলো। কিন্তু আমাদের দেশে যাকে বর্ষাকাল বলা হয় সেই আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের সমাপ্তি হয়নি এখনো। এটা শ্রাবণের মাঝামাঝি সময়। প্রবল বারিবর্ষণে পাহাড়ী এলাকায় ঢল নামার ফলে দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে জল দুর্দমগতিতে প্রবেশ করেছে। অনেকগুলো নদীতে জলস্ফীতি ইতিমধ্যেই বিপদসীমার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। বন্যা প্রতিরোধক বাঁধগুলো ভাঙনের মুখোমুখি। একবার সে বাঁধ ধসে পড়লে আর রক্ষে নেই। এমনিতেই খাদ্যের পাত্র খুব একটা ভরাট নয়। বিদেশ থেকে আমদানী করা চাল-শস্যের উপর নির্ভর করে আমাদের চলতে হচ্ছে। ক্ষেতের ধান হঠাৎ বন্যায় ডুবে গেলে আগামীতে খাদ্যসংকট তীব্রতর হবে।
ব্যাপকহারে জলস্ফীতির ফলে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একে প্রতিরোধ করবার জন্য প্রকৌশলীদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। সে নির্দেশ অনুযায়ী কাজ কবে শুরু হবে অথবা তা শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে কিনা আমাদের জানা নেই তবে বিপদের সম্ভাবনা এবং তার ‍গুরুত্ব সম্পর্কে বন্যা নিয়ন্ত্রণ দপ্তর নিশ্চয়ই ওয়াকিবহাল আছেন।
স্বাধীনতাত্তোরকালে বাংলাদেশের নদী অববাহিকা সংরক্ষণ, তার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ এবং বন্যা প্রতিরোধের বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে অনেক কথা শোনা গিয়েছিলো। এ ব্যাপারে সম্ভাব্য সকল সহযোগিতা দানের আশ্বাসও ভারত দিয়েছিলো। আমাদের প্রায় সব ক’টি নদীর উৎসমুখ যেখানে ভারতে সেখানে নদী অববাহিকা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে যে কোন পদক্ষেপই নেওয়া হোক না কেন ভারতের সহযোগিতা অবশ্যই প্রয়োজন। পাকিস্তান আমলে এটাকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তখনো একবার যখন আওয়ামী লীগ সরকারে ছিলো তখন বন্যা নিয়ন্ত্রণের একটা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশবিরোধী করাচীর স্বার্থবাদী মহলের চক্রান্তে পড়ে সে মহাপরিকল্পনার কি অবস্থা হয়েছিলো তা আমাদের সব্বারই জানা। এখন আবার নতুন করে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। সম্পদ আমাদের সীমিত। কিন্তু এই সীমিত সম্পদের মধ্যেই বন্যা প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দিয়ে যতশীঘ্র সম্ভব বাংলাদেশের সুদীর্ঘকালের অভিশাপ থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করবার জন্য প্রচেষ্টা চালানো হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। প্রতি বৎসরে বন্যায় যে প্রচুর সম্পদ হানি হয় তাতে করে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের কোন লক্ষ্যই হাসিল করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না যদি প্রথমেই বন্যার ব্যাপারে আমরা সুষ্ঠু এবং পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ না করি।

ইদি আমিনের বায়না

উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন বায়না ধরেছেন। আজ অটোয়ায় যে কমনওয়েলথ সম্মেলন উদ্বোধন হচ্ছে, সেই সম্মেলনে যোগদানের জন্য তাঁকে নিয়ে যাবার জন্য স্কট প্রহরীর প্রহরাধীনে বিশেষ বিমানে করে যেন অটোয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। ইদি আমিন কমনওয়েলথ প্রধান বৃটেনের রাণী এলিজাবেথের কাছেই এই বায়না ধরেছেন।
রাণী তাঁর এই বায়না পূরণ করেছেন কিনা সেটা অবশ্য জানা যায়নি। যদি পূরণ করে থাকেন তবে সেটাকে রাণীর মহানুভবতা এবং এক অবুঝ খোকার আবদার পূরণ বলেই ধরতে হবে। না পূরণ করে থাকলেও অবশ্য কিছু বলবার নেই। তবে ইদি আমিন তাঁর সাম্প্রতিক ক্রিয়াকান্ডে নিজেকে একজন রাষ্ট্র-নেতার চাইতেও এক না-বুঝ খোকা হিসেবেই পরিচিত করেছেন বেশী। তাঁর ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। তিনি এক মারাত্মক পবিয়ায় ভুগছেন। তিনি মনে করেন বিশ্বের সবাই তাঁর শত্রু। এমনকি তিনি তাঁর দেশবাসীকেও বিশ্বাস করতে পারেন না অনেক সময়—অনেক সময় নিজের প্রাসাদরক্ষী-দেহরক্ষীদের সন্দেহ করেন। তাঁর ভয়, তিনি যদি অন্য কোন বিমানে অটোয়ায় যাত্রা করেন, তবে ওবেটের সমর্থকরা হয়তো বা তাঁকে হাইজ্যাক করবেন। তার সেজন্যই তিনি রাণীর কাছে এই আবদার জানিয়েছেন হয়তো বা। অবশ্য এই আবদার জানানোর পেছনে তিনি কোন যুক্তি খাড়া করেননি। কেউ জিজ্ঞেস করলে হয়তো বা বলে বসতে পারেন যে, তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছেন। বলা তো যায় না। তিনি আবার সব কিছু স্বপ্নাদিষ্ট হয়েই তো করেন।
আসলে জেনারেল আমিন আজকের দিনে বিশ্বের রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে এক বিচিত্র চরিত্রের—বিচিত্র ঢংয়ের মানুষ। ১৯৭০ সালে প্রেসিডেন্ট মিল্টন ওবেটেকে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে উগান্ডার রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখল করার পর তাঁর এই বিচিত্র চরিত্রের বেশ পরিচয় পাওয়া গেছে। গত বছর উগান্ডাস্থ এশীয় ও ইউরোপীদের স্বদেশ থেকে বের করে দেবার সময় যখন কথা উঠলো—যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, তখন তিনি জবাব দিয়েছিলেন যে, স্বপ্নাদিষ্ট হয়েই তিনি এটা করেছেন। কোন বাস্তব যুক্তি নেই—অথচ কেমন একটা খোকাসুলভ উক্তি। অবশ্য এই কাজ করে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ উগান্ডার তরুণ সমাজের মন হয়তো বা সাময়িক কালের জন্য তিনি জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু এখন আর তা বোধ হয় ধরে রাখতে পাচ্ছেন না।
বস্তুতঃ মিল্টন ওবেটেকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেও ইদি আমিন কিন্তু ওবেটেকে এবং ওবেটের প্রতি দেশের জনসমর্থনকে সাংঘাতিক ভয় করেন। সেই ভয়টাই এখন তাঁর ‘পবিয়ায়’ পরিণত হয়েছে। জনসমর্থন না থাকলে একজন রাষ্ট্রনেতার যা হয়—তাই। কাজেই সেই ভয়ই তাঁকে রাণীর কাছে বিশেষ বিমানের বায়না ধরার ইন্ধন যুগিয়েছে—এমনটি সহজেই অনুমান করা যায়। আমরা বলি, রাণী তার এই বড়ো খোকার বায়নাটা রাখুন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন