বাংলার বাণী
ঢাকা : ২০শে নভেম্বর, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
উৎপাদিত ধানের সংরক্ষণ ও পাচার বন্ধ নিশ্চিত করতে হবে
বিভিন্ন সূত্র থেকে যতদূর জানা গেছে, তাতে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই এবার ধানের উৎপাদন বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হয়েছে। পর্যবেক্ষক মহলের আশাতিরিক্ত এ ধান উৎপাদন গোটা জাতির জীবনে অত্যন্ত শুভ লক্ষণ বলে প্রতীয়মান। কর্তৃপক্ষ এই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উৎপাদন লক্ষ্য করেই ধান ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এবং ইতিমধ্যেই সরকার ধান এবং চাউল ক্রয়ের কাজ শুরু করেছেন। চাউলের সরকারী দেয় মূল্যও ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ধানের এই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উৎপাদন যেমন আশার কথা তেমনি উৎপাদিত ধানের যথার্থ ব্যবহার ও সংরক্ষণ করার কাজটিও মহান দায়িত্বপূর্ণ। এই দায়িত্ব পালনের জন্যে সরকার তার প্রশাসনিক যন্ত্র সমূহকে যথার্থ প্রয়োগ করে ধান ও চাউল সংরক্ষণের এবং পাচার বন্ধের ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারেন। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় চাউল বা ধান পাচার হয়ে যেতে পারে এমন সন্দেহ করে সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকায় পাচার হচ্ছে বলেও সংবাদ ছাপা হয়েছে। চাউলের উৎপাদন আশাপ্রদ হেতুই এ ধরনের সংবাদের সারবত্তা জনমনে প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা মনে করি, এবারের ধানের উৎপাদন আশাপ্রদ বলেই তা পাচারের সম্ভাবনা অত্যধিক। তাছাড়া ভারতের মুদ্রামান বাংলাদেশের তুলনায় বেশী ছাড়াও চাউলের দামও এদেশের তুলনায় বেশী। ফলে দেশের বিশেষত সীমান্ত এলাকায় উৎপাদিত ধানের এক বিরাট অংশ ভারতে পাচার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই অত্যধিক। বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী উৎপাদন বৃদ্ধির ডাকে সাড়া দিয়েই দেশের জনগণ এগিয়ে এসেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। কর্তৃপক্ষ যতদূর আশা করেননি তার চাইতে উৎপাদন যদি বেশী হয়ে থাকে তবে সে কৃতিত্ব জনগণের। ধানের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হেতু আমরা উদ্বিগ্ন এর সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে। কৃষকরা চাউল নিজে খেয়ে এবং বাকীটা সরকারের কাছে ন্যায্যমূল্যে বিক্রয় করে জীবনধারণ করুক এটাই আমাদের কাম্য। কিন্তু এক ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া ও টাউট ব্যবসায়ীরা ধান বা চাউল কিনে নিয়ে ভারতে পাচার করবে এটা হ’তে পারে না। সে কারণে সরকারী লেভী ব্যবস্থা আরো ব্যাপক কার্যকর করতে হবে। সরকারী চাউল সংগ্রহের এই কার্যসূচী বাস্তবায়নের জন্যে শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপ যথার্থ নয় বলে আমরা মনে করি। বরং এটাকে একটি আন্দোলন হিসেবে মনে করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উভয় পদক্ষেপই গ্রহণ করতে হবে। প্রশাসনিক পদক্ষেপের সঙ্গে যদি রাজনৈতিক পদক্ষেপ যুক্ত না হয় তাহলে কৃষকরা তাদের ধান বা চাউলের ন্যায্যমূল্য পাবেনা এবং দেশের সকল অঞ্চল থেকে চাউল সংগ্রহের বিরাট কাজও যথার্থভাবে বাস্তবায়িত হবেনা। ইতিপূর্বে সরকার যে অদূরদর্শিতা দেখিয়েছেন দেশের পাট ক্রয়ের ব্যাপারে তা চাউলের বা ধানের ব্যাপারেও প্রযোজ্য হোক এটা আমরা যেমন চাইনা তেমনি দেশের জনগণও চাইবেনা। সে কারণে ধান সংগ্রহ ও সংগৃহীত ধানের ন্যায্যমূল্য যাতে করে দেশের অসহায় কৃষকরা পায় তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আন্দোলন একযোগে পরিচালিত করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে পাচার বন্ধ করার জন্যে অত্যন্ত বাস্তব প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও দূরদর্শীসম্পন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। সীমান্ত এলাকার প্রশাসন ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর এ ব্যাপারে বিরাট দায়িত্ব পালন করা উচিত বলে আমরা মনে করি। সীমান্তের জনগণও পাচার বন্ধ করার কাজে এগিয়ে আসবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। তবে তাদেরকে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নেতৃত্বের মাধ্যমে নিয়ে সীমান্তব্যাপী চোরাচালান বন্ধের আন্দোলনের কাজে নিয়োগ করাতে পারেন। আমরা মনে করি, গণঐক্য জোটের এ ব্যাপারে অবশ্যই কিছু করণীয় রয়েছে। এবারের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ধান উৎপাদনের টুকরো টুকরো সংবাদ যেমন গোটা জাতির কাছে আশার বাণী নিয়ে এসেছে তেমনি কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক কর্মচারীদের ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর উপর মহান দায়িত্ব অর্পণ করেছে। আমাদের বিশ্বাস, দেশের জনপ্রিয় সরকার ও দেশপ্রেমিক সংগঠনগুলো তাদের সেই মহান দায়িত্ব পালনে কোনো প্রকার শৈথিল্য প্রদর্শন করবেন না।
সোনালী আঁশের ভবিষ্যত
বাংলার সোনালী সম্পদ পাটের ভবিষ্যত সম্পর্কে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বেশ কিছুদিন থেকে দেশের বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত পাট সংক্রান্ত খবরাখবর এবং এতদবিষয়ক প্রতিবেদন অনুসারে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
পাট চাষীদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, সুষ্ঠুভাবে রপ্তানী, বিদেশের বাজারে পাটের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থা রক্ষা করা ইত্যাদি বৃহৎ স্বার্থ এবং কল্যাণের প্রেক্ষিতেই সরকার পাট শিল্পকে জাতীয়করণ করে নিয়েছেন এবং সেজন্যে পাঁচটি সংস্থার প্রতি এর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। এছাড়া সরকার ঘোষিত মূল্যে পাট ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও শতকরা ৮২ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বাংলাদেশের সবচেয়ে অর্থকরী ফসল এই সোনালী আঁশের ভবিষ্যত সম্পর্কে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত খবরগুলোর প্রতিবেদনে পাটের এই অনিশ্চয়তার কারণ সম্পর্কে সরকার ঘোষিত মূল্যে পাট ক্রয়কারী সরকারী সংস্থা কর্তৃক সঠিকভাবে পাট ক্রয় না করা, পর্যাপ্ত সংখ্যক ক্রয় কেন্দ্র না থাকা, পাট উৎপাদনকারী এলাকা থেকে দূর-দূরান্তে সরকারী ক্রয় কেন্দ্র থাকায় দীর্ঘপথ অতিক্রম করে সরকারী ক্রয় কেন্দ্রে পাট বিক্রির সুযোগ ও সামর্থ্য পাট চাষীদের না থাকা, সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রচুর পাট পাচার হওয়া, সরকারী পাট সংস্থার পর্যাপ্ত গুদাম না থাকা, অর্থের অভাব, ক্রয় কেন্দ্রগুলোতে কর্মরত কর্মচারীদের কর্মতৎপরতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি গণমুখী না হয়ে বরং কাজে গাফিলতি, চোরাকারবারীদের সংঘবদ্ধ তৎপরতা ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এবং এছাড়া ধৃত চোরাকারবারীদের যথাযথ শাস্তি না হওয়ার দরুণ ক্রমান্বয়ে তাদের অশুভ তৎপরতা বন্ধ হওয়া দূরে থাক বরং অব্যাহত গতিতে চলতে বলেও প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
চলতি বছর পাট রপ্তানীর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে বত্রিশ লক্ষ বেল। এই লক্ষ্যমাত্রা কার্যকর করার জন্যে মাসে তিন লক্ষ বেল পাট রপ্তানীর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত সে লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে দেশের পূর্বাঞ্চলে সরকারী ক্রয় কেন্দ্র কর্তৃক ক্রয় করা অন্যূন সাড়ে তিন লক্ষ মণ এবং উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রায় এক কোটি মণ পাট পড়ে আছে বলে খবরে প্রকাশ। এই সব পাট পর্যাপ্ত গুদামের অভাবে পড়ে আছে এবং আরো বিপুল পরিমাণ পাট টাকার অভাবে সরকারী পাট সংস্থা ক্রয় করতে পারছে না বলে সরকারী ক্রয় কেন্দ্রগুলো বন্ধ হবার উপক্রম হয়ে পড়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, গত বছরের বেশ কিছু অ-রপ্তানী পাট এখনো গুদামে জমে আছে। ফলে সব কিছু মিলিয়ে দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ এবং বাংলার সোনালী ঐশ্বর্য পাটের ভবিষ্যত সম্পর্কে পাট চাষীরা পর্যন্ত সন্দিহান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পাট চাষীদের এই সন্দেহ দৃঢ়রূপ ধারণ করলে ভবিষ্যতে তারা পাট চাষে অনীহা প্রকাশ করতে বাধ্য হবে সে কথা বলাই বাহুল্য। আর তাই যদি হয় তাহলে শুধু পাটের নয়। গোটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে কি ভয়াবহ দুরবস্থার সৃষ্টি হবে সে কথা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
সুতরাং আমরা মনে করি, আর মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে পাট বিষয়ে যে অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে দূর করার জন্যে ত্বরিৎ কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সরকার ক্রুটি করবেন না। আমরা আশা করি, স্বর্ণআঁশ পাটের জহুরী বাংলাদেশ—সোনা চিনতে ভুল করবে না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক