বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৮শে নভেম্বর, বুধবার, ১৯৭৩, ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ও বাংলাদেশ
প্রকৃতির খেয়ালী প্রতিদানেই হোক বা মানুষের প্রয়োজনের পরিমাপেই হোক আমাদের সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলাদেশ সেই এক বিস্মৃত অনাদিকাল থেকেই কৃষি নির্ভরশীল। আমরা কৃষিপ্রধান জাতি।
মাটির মদির গন্ধের মাঝে আমরা খুঁজে পাই আমাদের প্রাণ প্রাচুর্যভরা জীবনের আশ্বাস। মেঠো গাঁয়ের পাশে প্রবাহমান খাল-নদীর শান্ত কুলুকুলু ধ্বনিতেই আমাদের জীবন ছন্দ ঝংকারিত। সকালের প্রথম অরুণোদয়ের রক্তিম আভায় আমাদের যুগ যুগের ঝরানো লহুর পরোক্ষ ইঙ্গিত। এখানে দোয়েল শ্যামা আর কোকিলের সুললিত গানে আমাদের হৃদয় উদ্বেলিত। সকৃতজ্ঞ আনত আমাদের কোটি হৃদয় বিশ্ব স্রষ্টার অসীম কৃপার পাদদেশে।
পৃথিবীর মানুষ যখন এক ফোঁটা পানির আশায় হন্যে—বিভ্রান্ত, প্রকৃতির অসীম বর্ষণে আমরা তখন বন্যার মতো পরিপ্লাবিত। পৃথিবীর মানুষ যখন একটি মাত্র দানার আশায় এ পাশ ওপাশ, আমাদের মানুষ তখন ভরাপেটের আনন্দে স্বপ্নে বিভোর। তাই তো যুগে যুগে আমাদের এ দেশ সোনার দেশের নামে আখ্যায়িত। সবারই নিবদ্ধ লোলুপ দৃষ্টি আমাদেরই উপর। বৃটিশ শাসন ও ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে বাংলার দিগন্ত প্রসারিত ক্ষেত খামারের সঙ্গেই বাঙালীর জীবন সূতো আজ বাঁধা।
পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এখানে শিল্প-সম্ভাবনার চেয়ে কৃষি সম্ভাবনাই সমধিক অত্যুজ্জ্বল। তাই দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে সরকার আমাদের কৃষি উন্নয়নের দিকেই বেশী নজর দিয়েছেন।
আগে যুগে যুগে লুটেরা ও হার্মাদেরা আমাদের ভান্ডার লূটে নিয়ে গেছে এবং আমরা আমাদের শ্রমের ফসল পেতাম না। কিন্তু দেশ শত্রু মুক্ত হবার থেকে আমাদের সে আশংকা সম্পূর্ণ বিদূরিত। এখন আমাদের সামনে বিপুল সম্ভাবনা।
আমাদের দেশের শতকরা ৮৫ জন লোকই কৃষি নির্ভরশীল। সুতরাং কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলা ছাড়া আমাদের জাতীয় উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়।
তাই চলতি সপ্তাহে উত্তরাঞ্চল সফরকালে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষকদের জন্যে উৎসাহবর্ধক মূল্যের নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক নয়া অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্যে সার্বিক প্রচেষ্টা চালানোর যে হৃদয়গ্রাহী আবেদন জানিয়েছেন তাকে আমরাও সর্বতোভাবে এবং সর্বান্তঃকরণে স্বাগত জানাই।
কিন্তু তার এ স্বপ্নের প্রকৃত বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের কৃষি জগতে স্তূপীকৃত যুগ যুগের জঞ্জাল ও দুর্বলতা দূর করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। যেমন, খন্ড-বিখন্ড জমির একত্রীকরণের মাধ্যমে কৃষকদের পুরনো অন্তর্বিদ্বেষ দূর করে সমবায় কাজের প্রতি উৎসাহিত করা, কৃষক যাতে তার শ্রমের ন্যায্যমূল্য পায় সেজন্যে নিশ্চয়তা বিধান করা, কৃষক ও জনসাধারণের মাঝখানে অসংখ্য টাউট ও ফড়িয়াদের উচ্ছেদ করা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ বিষয়ে প্রকৃত সার্থকতা অর্জন করতে হলে এবং উন্নতির নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে হলে প্রথমেই সর্বাত্মকভাবে সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষকারী সহযোগিতা সৃষ্টি করতে হবে।
অনিয়মকে নিয়ম করা চলবেনা
নিয়মানুবর্তিতা নয় অনিয়মানুবর্তিতাই নিয়ম—অনিয়মানুবর্তিতাই যেন তাদের আদর্শ। গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে বাংলাদেশ সচিবালয়ের কর্মকর্তা থেকে অতি নিম্নপদস্থ কর্মচারী পর্যন্ত সকল পর্যায়ের কর্মচারীদের অফিসে আসা যাওয়া এবং কাজকর্ম সম্পর্কে যে তথ্য পরিবেশিত হয়েছে, সেই তথ্য যদি আংশিকভাবেও সত্য হয়, তবে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পূর্ণ হওয়া তো দূরের কথা নিয়মমতো সরকার ও দেশ পরিচালনা করাও দুঃসাধ্য। শুধু দুঃসাধ্যই নয়, প্রশাসনযন্ত্র বলে যে একটা কথা চালু রয়েছে সেই যন্ত্র ভবিষ্যতে টিকে থাকবে কিনা তাও প্রশ্নের আওতায় পড়ে।
সপ্তাহের সোমবার থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত সাতদিনে সর্বমোট ১৫৬ ঘন্টার মধ্যে সরকারী কর্মচারীদের মোট ৪১ ঘন্টা ৩০ মিনিট কাজ করার কথা। এটা সকল পর্যায়ের সরকারী কর্মচারীর জন্যেই প্রযোজ্য। অথচ অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, কোনো সরকারী কর্মচারীই তিনি যত উচ্চ অথবা নিম্নপদস্থ হোন না কেন সপ্তাহে ১৬ ঘন্টা ঘন্টা ৩০ মিনিটের বেশী সরকারী কাজে কাটান না বা অফিসে থাকেন না। প্রতিদিন সকাল ১০টায় তাঁদের অফিসে হাজির হয়ে নিজ নিজ দায়িত্বে আত্মনিয়োগ করার কথা থাকলেও ১১টার আগে কেউ আসেন না। আবার দুপুর দেড়টা থেকে দু’টা পর্যন্ত লাঞ্চ আওয়ার থাকলেও কেউই সাড়ে বারোটার পরে অফিসে থাকেন না। এবং তিনটার আগে ফেরেন না। বিকাল ৫টা পর্যন্ত তাদের ‘নর্মাল ডিউটি আওয়ার’ থাকা সত্ত্বেও ৪টাতেই অফিস খালি হয়ে যায়। অফিস থেকে বাড়ী ফেরার জন্যে সবাই যেমন হন্যে হয়ে উঠেন তেমনটি বাড়ী থেকে অফিসে আসার বেলায় কাউকেও দেখা যায় না।
অথচ জাতির জনক দেশ গড়ার কাজে তথা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের কাজে নির্ধারিত সময়ের বেশী সময় কাজ করার আকুল আবেদন জানিয়েছেন কয়েকবার বিশেষ করে সরকারী কর্মচারীদের প্রতি। আর তার সাথে সাথে নিজেও দৈনিক কমপক্ষে বারো ঘন্টা করে অনবরত খেটে চলেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর এবং দুর্ভাগ্য এদেশের মানুষের। এদেশেরই সরকারী কর্মচারীরা জাতির জনকের আবেদনে তো কোনো সাড়া দেনইনি পরন্তু দেশের মানুষের হাড় জল করা অর্থ থেকে যে বেতন নেন, তাও সঠিকভাবে নিয়ম মাফিক কাজ করে নেন না। নির্ধারিত সময়ের বেশী সময় তো দূরের কথা—নির্ধারিত সময়টাতেও কাজ করেন না।
আজ বাংলাদেশ সচিবালয়ের যে দুরবস্থা তার জন্যে সবচাইতে বড় বেশী করে দায়ী আমলাতন্ত্র তথা পদস্থ কর্মচারীরা। কেননা তারাই তাদের নিজস্ব দায়িত্বের প্রতি দায়িত্বশীল নন—সচেতন নন। নিম্নপদস্থরাও তাই সাহস পেয়েছেন। না হয় কোনো বিভাগের বা কোনো অফিসের কোনো কর্মকর্তা যদি ঠিক সময় অফিসে আসতেন—তাঁর নিম্নপদস্থরা তা হলে ঠিক সময়ে অফিসে না এসে পারতোনা। সেজন্যেই আজ বড় প্রয়োজন আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান। তথাকথিত অভিজ্ঞতার প্রহসন দেখিয়ে যারা আজ বড় বড় চেয়ার দখল করে এসব অনাচার চালাচ্ছে—তাদের বিদেয় করে সৎ, কতর্ব্যনিষ্ঠা এবং তারুণ্যে ঝলমল সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী কর্মীদের নিয়োগ করতে হবে। ওদের অভিজ্ঞতা হঠাৎ করে হয়তো আসবেনা—কাজ করতে প্রথমতঃ কিছু ভুল হয়তো বা হবে—কিন্তু তারা অসৎ আর অভিজ্ঞতার ছাপ মারাদের মতো দায়িত্বহীন হবেন না অবশ্যই।
বেড়া যেন ক্ষেত না খায়
অধ্যক্ষ সাহেবরা ছাত্রদের জ্ঞান বিতরণ করে থাকেন বলেই আমরা জানি। জ্ঞান বিতরণের দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে বশীভূত রাখার ক্ষমতা অর্জন করেছেন বলেই মানুষ তাঁদের শ্রদ্ধা করে। কিন্তু তিনি যদি চোরাচালানের দায়ে অভিযুক্ত হন তাহলে ‘বেড়া ক্ষেত খাওয়ার’ মতো অবস্থাই দাঁড়ায়। এমনি একটি ঘটনার জন্ম হয়েছে কুমিল্লায়।
গতকাল বিভিন্ন পত্রিকায় এই মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, কুমিল্লা চকবাজার আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মওলানা আলী হোসেন সহ নয় ব্যক্তিকে বেআইনীভাবে ভারতীয় বিড়ি পাতা ও কাপড় রাখার দায়ে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পুলিশ তাদের কাছ থেকে দু’লাখ টাকা মূল্যের ভারতীয় বিড়ি পাতা ও কাপড় উদ্ধার করেছে।
খবরে প্রকাশ, কুমিল্লার কোতোয়ালী পুলিশ গোপনে সংবাদ পেয়ে উক্ত মাদ্রাসায় হানা দেয় এবং মাদ্রাসার কয়েকটি শ্রেণী কক্ষের মধ্যে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় বিড়ি পাতা ও কাপড় দেখতে পায়।
সংবাদটি নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ ও তাৎপর্যপূর্ণ। মওলানা সাহেব চোরাচালানীর দ্রব্যাদি সংরক্ষণ করার স্থানটিও বেছে নিয়েছেন ভালোই। বিদ্যায়তনে শিক্ষা বিতরণের পরিবর্তে চোরাচালানী মাল সংরক্ষণ করাই শ্রেয় বলে মওলানা সাহেব মনে করেছেন।
অবস্থাদৃষ্টে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে এ কথা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, চুরি বিদ্যাই মহাবিদ্যারূপে আপাততঃ মওলানা সাহেবের জীবনের একমাত্র ব্রত বলে মনে হচ্ছে।
কীর্তিমান (!) অধ্যক্ষ মওলানাটি যা করেছেন তার নিন্দা করার ভাষা আমাদের নেই। সমাজের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি, মুনাফাখোরী, চোরাচালানী ও মওজুতদারীর মতো অশুভ তৎপরতা কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছে অধ্যক্ষ মওলানা সাহেবের কীর্তিকলাপই তার প্রমাণ।
চোরাচালানের দায়ে গ্রেফতারকৃত অধ্যক্ষটির সমুচিত শাস্তি হোক এটা যেমন আমরা দাবী করবো তেমনি সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি, মুনাফাখোরী, মওজুতদারী ও চোরাচালানীর মতো অশুভ তৎপরতার পরিধি সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ার আগেই তার গতিরোধ করা প্রয়োজন। অন্যথায় দেখা যাবে, অধ্যক্ষ মওলানাটির মতো আরো অনেকেই জ্ঞান বিতরণের পরিবর্তে অন্যায় ও অসঙ্গতভাবে ‘টু-পাইস’ কামাই করার জন্যে চুরি বিদ্যাকেই মহাবিদ্যারূপে বেছে নিয়েছেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক