You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.05.18 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | বাংলাদেশ-ভারত যুদ্ধ ঘোষণা | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ১৮ই মে, শনিবার, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১

বাংলাদেশ-ভারত যুদ্ধ ঘোষণা

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচদিনব্যাপী সরকারি সফর শেষে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা ও নয়াদিল্লি থেকে বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণা প্রকাশিত হয়েছে। এ যুক্ত ঘোষণায় দুটি প্রতিবেশী বন্ধু দেশের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতায় দুই প্রধানমন্ত্রী তাদের গভীরতার প্রশান্তি ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। দু’দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান এই সহযোগিতার সম্পর্ককে আরও সম্প্রসারিত, আরো উন্নত ও সুদূরপ্রসারী করে তোলার কথা তারা আবার উল্লেখ করেছেন।
দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সব রকম সমস্যার সমাধান করার প্রতি দুই বন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রীই সব সময় ঐকমত্য পোষণ করে এসেছেন। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত দীর্ঘমেয়াদী মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তি তারই প্রতিফলন ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর সাম্প্রতিক ভারত সফর এই সহযোগিতা সম্প্রসারণের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য হতে হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এমন কতগুলি সমস্যা বিরাজমান যেগুলি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অনেক পূর্ব থেকে জমে ছিল। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে এই সমস্যাগুলি সমাধানের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হয়নি। আবার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার অস্বাভাবিক বৈরী মনোভাব এর জন্য এমন কতকগুলি সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছিল যেগুলো কোনক্রমেই পারস্পরিক স্বার্থের অনুকূলে এবং সৎ প্রতিবেশীসুলভ নয়। আজকের সেই ঐতিহাসিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলেও পটভূমিকা মুছে যায়নি। তার জের-এর বোঝা আমাদের বহন করতে হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের এজেন্টরা এশিয়রা এশীয়দের বিরুদ্ধে বিবাদ করে মরুক এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সেগুলি উসকিয়ে তোলার কাজে লিপ্ত রয়েছে। সমস্যার সমাধান নয়, সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলে পরস্পরের উপর অভিভাবকত্ব করার নীতি তারা বর্জন করেনি।
তাই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি আর ভারতের ৫৫ কোটি মানুষের স্থায়ী শান্তি ও প্রগতির প্রতি লক্ষ্য রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে এমন কতগুলি কাজ সম্পাদন করতে হবে, এমন কতগুলি জটিল সমস্যার সমাধান দিয়ে যেতে হবে যাতে করে উপমহাদেশের শান্তি স্থাপনের সম্ভাবনাকে বাইরের কোন শক্তি বিনষ্ট করতে না পারে। ভারত আর বাংলাদেশের কোন পরিত্যক্ত সমস্যা নিয়ে বাইরের অন্য কোনো তৃতীয় শক্তি যাতে আর খেলতে না পারে। আর আমাদের সবসময় স্মরণ রাখতে হবে, সার্বভৌম ক্ষমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা দুই দেশের দরিদ্র লাঞ্চিত জনতার কল্যাণ করতে পারব। যুগ যুগ ধরে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের শক্তিসমূহ উপমহাদেশের জনগণের আভ্যন্তরীণ বিবাহ কোন দলকে সম্বল করে এখানকার জনতাকে শোষণ করেছে। কখনো ধর্মীয় আবেগ এর স্লোগান তুলে, কখনো জাত্যাভিমানকে জাগিয়ে তুলে, কখনো বর্ণবৈষম্যবাদ প্রচার করে তারা আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে আর আজ এর কাল ওর ঘাড়ে চেপে বসে অবাধ শোষণ চালিয়েছে।
ফলে আমরা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছি। একদিনের সভ্যতার, সম্পদ ও বৈভবের কেন্দ্রভূমি আজ দরিদ্রতম ভূখণ্ড হিসেবে পরিণত হয়েছে। আমাদের জনগণ দারিদ্র, অনাহার, জরা, মহামারী, সামাজিক অনগ্রসরতা ইত্যাদির অভিশাপে লাঞ্চিত হচ্ছে।
আমরা সবাই এখন স্বাধীন। উপমহাদেশের প্রতিটি দেশ সার্বভৌম। এই সার্বভৌম স্বাধীন সত্তা নিয়ে আর বিবাদ নয়, প্রগতির পথে সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু এক মহান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। মিসেস গান্ধী তার দেশে জনপ্রিয়। উভয় ব্যক্তিত্বের ওই তাদের স্ব-স্ব জনগণের মনে একটা ভাবমূর্তি বা ইমেজ আছে। এই ভাবমূর্তিকে তারা দুই দেশের মধ্যকার সকল সমস্যার সমাধানে কাজে লাগাতে পারলে সকলেরই মঙ্গল। আর দিল্লির দ্বিপাক্ষিক বৈঠক এর মূল তাৎপর্য এখানেই। সমস্যা নিয়ে বিবাদ নয়, সমাধানের জন্য এই দুই নেতার আলোচনা, দুই দেশের আলোচনা চলেছে এবং আরো চলতে থাকবে।
বঙ্গবন্ধুর পাঁচদিনব্যাপী রাষ্ট্রীয় সফরকালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তাহলো সীমানা চিহ্নিতকরণ চুক্তি। রাজনীতি পর্যবেক্ষকমহল এটাকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা স্বর্ণ সাফল্য বলে মনে করছেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানি আমলে সীমানা চিহ্নিতকরণ এর প্রশ্নে জটিলতা সৃষ্টি হয়। নূন-নেহেরু চুক্তি এই জটিলতাকে আরও ঘনীভূত করে। ভারত কর্তৃক বেরুবাড়ী ইউনিয়ন হস্তান্তরের বিষয়টি সে দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরও এই সংবেদনশীল প্রশ্নটি নিয়ে দুটি দেশের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টির অবকাশ ছিল। সীমানা চুক্তি স্বাক্ষর এর ফলে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে মৈত্রী বন্ধন আরো দৃঢ়তর হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। সীমানা চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ-ত্রিপুরা বাংলাদেশ সীমান্তের সমগ্র আসালং এলাকা, পাথুরিয়া বনাঞ্চল, সিলেট সীমান্তে লাঠিটিলা গ্রাম ও দহগ্রাম ছিটমহল লাভ করবে। ভারত পাবে শুধু বেরুবাড়ী ইউনিয়ন।
ফারাক্কা প্রকল্পের প্রশ্নটিও কম জটিল ছিল না। পাকিস্তানি আমল থেকেই ফারাকা প্রকল্প নিয়ে বহুবার অফিসার পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে কিন্তু কোনো সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। বলা যেতে পারে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ইচ্ছে করেই ফারাক্কা প্রকল্পের প্রশ্নটিকে ঝুলিয়ে রেখেছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। ভারত ফারাক্কা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল এমন একটা সময় যখন সে আজকের পরিস্থিতির কথা ভাবতে পারেনি। অথচ অপরদিকে পাকিস্তান তারবেলা ও মঙ্গলা বাঁধের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে একটা সমঝোতায় উপনীত হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকরা চাইত না যে, এ সমস্যাটির সমাধান হোক। বঙ্গবন্ধুর ভারত সফরে এ প্রশ্নটি একটা সুষ্ঠু সমাধান খোঁজা হয়েছে। যুক্ত ঘোষণা উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ বছরের শেষ নাগাদ ফারাক্কা প্রকল্প চালু করার আগে গঙ্গা নদীতে সবচেয়ে কম পানি প্রবাহের সময় যে পানি পাওয়া যায় তা বরাদ্দের ব্যাপারে উপদেশ পরস্পরের পক্ষে গ্রহণযোগ্য একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছুবে। এবং ১৯৭৪ সাল শেষ হবার আগে একটা সমাধান বের করতে হবে। দুই দেশের মধ্যে এটাই সবচাইতে জটিল সমস্যা।
দুই প্রধানমন্ত্রী উভয় দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতার বিষয়াদি পর্যালোচনা করে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন (ক) দুই দেশের অর্থনীতিতে পাটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও উৎপাদন, বাণিজ্য, কারিগরি উন্নয়ন এবং পাটজাত দ্রব্য উৎপাদনের ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠতর সহযোগিতার কথা বিবেচনা করে মন্ত্রী পর্যায়ের একটি যৌথ কমিশন গঠন করা হবে। (খ) অতীতে শুল্ক ও মুদ্রা বিধি লংঘন রোধে ব্যবস্থা নেয়া সত্বেও বেআইনি লেনদেন অব্যাহত থাকায় বেআইনি লেনদেন কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রী পর্যায়ের একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন যৌথ কমিটি গঠন করা হবে। এ ধরনের লেনদেন এবং বিশেষ করে যারা এধরনের তৎপরতায় অর্থ ও উৎসাহ যোগাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কমিটির সম্মানিত এবং জোরদার ব্যবস্থা গ্রহণের নিশ্চয়তা বিধান করবে। (গ) বর্তমান সুষম বাণিজ্য ও দায় পরিশোধ ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে লক্ষ্য অর্জনের নিশ্চয়তা বিধানে দু’দেশের সরকার রপ্তানি বৃদ্ধি করবেন। (ঘ) দু’দেশের মধ্যে বৃহত্তম অর্থনৈতিক সহযোগিতার পথে আরও একটি পদক্ষেপ হিসেবে দুই দেশের সরকার এক দেশ থেকে অন্য দেশে কাঁচামাল ও পণ্য সরবরাহ এবং পরস্পরের পক্ষে গ্রহণযোগ্য শর্তে রপ্তানিযোগ্য উদ্ধৃত মাল নিয়ে নেবার নিশ্চয়তার ভিত্তিতে চারটি কারখানা স্থাপন করবেন।
ভারতের মেঘালয় চুনাপাথর সরবরাহের ভিত্তিতে বাংলাদেশের ছাতকে একটি সিমেন্ট কারখানা, বাংলাদেশে ক্লিংকার সরবরাহের জন্য একটি কারখানা, ভারতে ইউরিয়া সরবরাহের জন্য একটি সার কারখানা এবং ভারতের আকরিক লোহা সরবরাহের ভিত্তিতে বাংলাদেশে একটি স্পঞ্জ লৌহ কারখানা স্থাপন করা হবে।
১৯৭৪-৭৫ আর্থিক বছরে ভারত বাংলাদেশকে ৩৮ কোটি টাকা ঋণ দেবে। এতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেন। এর আগে ছাতকে নয়া সিমেন্ট কারখানা স্থাপনে ৫ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশের জন্য ভারত থেকে পণ্য ক্রয়ের উদ্দেশ্যে ১০ কোটি টাকার সরকারি পর্যায়ে দেয়া হবে। অবশিষ্ট ২৩ কোটি টাকা দেবে ভারতের শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক।
দুই প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আবার উল্লেখ করেন যে, দুটো দেশেরই নীতি জোট নিরপেক্ষতা। এই জোট নিরপেক্ষ নীতির মৌল শক্তি হলো জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, শান্তি ও ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ও স্থিতিশীলতা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উন্নয়নশীল দেশসমূহে আশু ও দীর্ঘমেয়াদি সাহায্য দেবার যে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে তারা তাকে স্বাগত জানান। দখলীকৃত আরবে এলাকা থেকে আরব সৈন্য প্রত্যাহার, পালিস্টাইনি জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার, বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়া ভিয়েতনামের ভাগ্য নির্ধারণ। দিয়াগো গার্সিয়াতে নৌ ঘাঁটি নির্মাণ নিয়ে উদ্বেগ, ভারত মহাসাগরকে শান্তি এলাকায় চিহ্নিতকরণ এবং আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার জনগণের উপনিবেশবাদ ও বর্ণ বৈষম্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে সমর্থন জানান দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। এ কথা আর বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখেনা যে, বঙ্গবন্ধুর ভারত সফর সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিত্ব ও বন্ধুত্ব এক্ষেত্রে (অস্পষ্ট) মৈত্রীর পথ প্রশস্ত করতে (অস্পষ্ট) হয়েছে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন