You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.10.24 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | উন্নত দেশগুলোর খাদ্যনীতির অন্তরালে | শিশুখাদ্য বন্টনের নতুন ব্যবস্থা | কান টানলেই মাথা আসে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৪শে অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ৬ই কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

উন্নত দেশগুলোর খাদ্যনীতির অন্তরালে

খাদ্য নিয়ে এক মারাত্মক আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রকাশ পেয়েছে। অভিযোগটা আপনার আমার রাম-রহিম-যদু-মধুর নয় যে, এক কথায় তুবড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যায়। অভিযোগটা একটি বিশেষজ্ঞ দলের এবং খোদ, মার্কিন সরকারই নিযুক্ত করেছেন এই বিশেষজ্ঞ দলকে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যের যে ‘হাহাকার’ বিরাজ করছে তার কারণ খতিয়ে দেখাই মার্কিন সরকারের উদ্দেশ্য ছিল কিনা তা আমরা জানি না।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অনুসন্ধানের ফল যে এমন ‘বুমেরাং’ হবে এ কথা বোধ হয় মার্কিন কর্তাব্যক্তিরা আগে থেকে ভাবেননি কিংবা ভেবে উঠতে পারেননি। কাঁদা ছিটিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার যত চেষ্টাই করা হোক না কেন সে কাঁদা যে নিজের গায়েও লাগতে পারে তা তাঁরা বোধ হয় ভুলেও চিন্তা করেননি। সেজন্যই বোধ হয় নিতান্ত বেকায়দায় পড়ে মার্কিন কৃষি বিভাগ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ দলের উক্ত রিপোর্টটির প্রকাশ বন্ধ রেখেছেন।
বিশেষজ্ঞ দল অবশ্য রিপোর্টটির ‘চাপা দেওয়ার’ একটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেছেন আগামী মাসে রোমে যে বিশ্ব খাদ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তাতে মার্কিন কৃষি বিভাগ যাতে নিজেদের বাড়তি খাদ্যশস্য বিক্রি সম্পর্কে বেকায়দায় ‘মাত্রাতিরিক্ত ওয়াদা’ করে না ফেলেন তার জন্যেই এই ঢাক ঢাক গুড় গুড় ব্যবস্থা। আসলে মার্কিন সরকার তথা উন্নত দেশগুলো যে খাদ্য নিয়ে রাজনীতি করছেন তা খোলাখুলিভাবে না বললেও বোঝা যায়। খাদ্যশস্যও যে মার্কিনী ধনকুবেরদের কাছে আর দশটা পণ্যের মতো মুনাফা লুটার একটা পণ্য এ কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত করে গবেষণা করার প্রয়োজন হয় না। উৎপাদন কম হলে দাম বাড়বে, মুনাফাও বেশী হবে, পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই যে অমোঘ নিয়ম এ কোনো বিতর্কের অপেক্ষা রাখে না। ত্রিশ দশকের মন্দার দিনে মুনাফার মাত্রা ঠিক রাখতে গিয়ে কিংবা মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা করতে গিয়ে একদিকে অনাহারক্লিষ্ট অগণিত বেকার লোকের মিছিল, অপরদিকে লক্ষ লক্ষ টন সঞ্চিত খাদ্যশস্য সমুদ্রে ফেলে দেয়ার কাহিনী কে না জানে? তাই কৃত্রিম খাদ্যাভাব সৃষ্টি করে মুনাফা লুটার কাহিনীও বিশ্ববাসীর কাছে নতুন কিছু না।
আজকাল অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ‘সম্মুখ সমরে’ অবতীর্ণ হওয়া তেমন নিরাপদও নয় কিংবা বুদ্ধিমানের কাজও নয়। কারণ তাতে ঝুঁকি অনেক বেশী। হতে পারে এটা আন্তর্জাতিক মার্কিন ‘তেল রাজনীতির এক অঙ্গ’ কিংবা ‘গ্লোবাল পলিসির হেরফের।’ কিন্তু আসল উদ্দেশ্য যে অনুন্নত দেশের ‘বেয়াদবগুলোকে’ কিছুটা শায়েস্তা করা এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাম্প্রতিককালে তেল নিয়ে যে হুমকি ও পাল্টা হুমকি চলছে বাড়তি উৎপাদনকারী দেশগুলোর খাদ্যনীতি তারই ফলশ্রুতি কিনা কে জানে?
আলোচ্য রিপোর্টে যে চারটি দেশের খাদ্যনীতির কথা বলা হয়েছে যেমন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও আর্জেন্টিনা এই দেশগুলোর কৃষি পদ্ধতি অত্যন্ত আধুনিক ও উন্নত ধরনের। অর্থাৎ এদের বিশেষ করে আমেরিকার, কৃষি ব্যবস্থা প্রকৃতির খেয়াল-খুশীর উপর ততটা নির্ভরশীল নয় বলে আমাদের মতো অনুন্নত দেশগুলোর অনেক কিছু বলার আছে। কারণ, খাদ্য নিয়ে এমনতর রাজনীতি চলতে থাকলে বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলো বিশেষ করে কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশগুলো কোনো কালেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। তারা যে তিমিরে সে তিমিরেই থেকে যাবে।
বিশেষজ্ঞদল বলেছেন, উদ্বৃত্ত দেশগুলো কর্তৃক উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করার ফলে গম চাষের জমির পরিমাণ কমে গিয়ে ১২ কোটি একর থেকে ৮ কোটি ১০ লক্ষ একরে দাঁড়িয়েছে। ফলে ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালের তুলনায় ৯ কোটি টন গম কম উৎপন্ন হয়েছে। তা হলেই বোঝা যায় অনুন্নত দেশগুলোর কাছে ‘অতিরিক্ত ওয়াদা’ করার ভয়ে নয় বরং উৎপাদন কমানোর অসাধু অভিপ্রায়কে গোপন রাখাই বিশেষজ্ঞ দলের রিপোর্টটি চাপা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য।

শিশুখাদ্য বন্টনের নতুন ব্যবস্থা

শিশু খাদ্যের সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য সরকার সারাদেশে মহকুমা পর্যায়ে শিশুখাদ্য সরবরাহ করার নতুন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে পত্রিকান্তরের প্রতিবেদনে জানা গেল। এই নতুন ব্যবস্থাধীনে মহকুমা প্রশাসকরা নির্ধারিত মূল্যে শিশুখাদ্য সরবরাহের পারমিট ইস্যু করবেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই নাকি এই নতুন বন্টন ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য সমুদয় প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে। নতুন বন্টন ব্যবস্থা চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলোর মাধ্যমে শিশুখাদ্য বিক্রির বর্তমান ব্যবস্থা বাতিল বলে গণ্য হবে। শিশুখাদ্য সুষ্ঠুভাবে বিতরণের জন্য সরকার দেশের বিভিন্ন মহিলা সংগঠনগুলোকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে শিশুখাদ্য বরাদ্দ করবেন। বিশেষ করে মহিলা সমিতি এবং মহিলা পরিষদ সহ অন্যান্য মহিলা সংগঠনগুলোর মাধ্যমে শিশুখাদ্য বন্টন করা হলে নাকি প্রকৃত ব্যবহারকারিণীরাই শিশুখাদ্য পাবেন। এতে শিশু খাদ্যের ঢালাও কালোবাজারীরাও নাকি কমবে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সরকারী, আধা-সরকারী এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের রেজিষ্টার্ড সমবায় সমিতিগুলোর মাধ্যমে শিশুখাদ্য বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে। সুখের কথা, বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত শিশুখাদ্য আমদানীরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওয়েজ আর্ণার স্কীমের অধীনে শিশুখাদ্য প্রেরণের জন্য বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী প্রবাসী বাঙালীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ ধরনের আহ্বান আগে থেকেই জানানো উচিত ছিল। তাহলে হয়তো ত্রিশে’জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তিন মাসে ছয় লাখ ছাপ্পান্ন হাজার টাকার বিদেশী দামী সিগারেট আমদানী হতো না। বলাবাহুল্য, মাত্র ঐ সময়ের মধ্যে শিশুখাদ্য এসেছিল চার লাখ ঊননব্বই হাজার টাকার। শিশুখাদ্যের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে কোনো রকম আগ্রহের সঞ্চার না করার জন্যই শিশুখাদ্যের তুলনায় বেশী সিগারেট এসেছিল। শিশুখাদ্যের প্রকট অভাবে আজ শিশুদের জীবন মরণ সমস্যা। এই সমস্যা উত্তরণের জন্য ছানার মিষ্টি তৈরীর উপর নিষেধাজ্ঞা সকল মহলে অভিনন্দিত হয়েছে। বিপুল পরিমাণ শিশুখাদ্য আমদানীর ব্যবস্থা না করলে দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা পরিপূরণ করা সম্ভব নয়। শিশুখাদ্য আমদানীর পর তা যদি হাত বেহাত হয়ে কালোবাজারীদের করতলগত হয়ে যায়, তাতে সমস্যার ক্ষত আরো তীব্র আকারে প্রকাশিত হবে। তাই শিশুখাদ্যের বন্টন ব্যবস্থার প্রতি সুতীক্ষ্ম নজর দেয়া বাঞ্ছনীয়। আমরা চাই, আমদানীকৃত শিশুখাদ্য যেন কোনো অবস্থাতেই দুষ্টগ্রহের পাল্লায় পড়ে বেপাত্তা না হয়ে যায়। শিশুখাদ্য যেন চালের বস্তার অভ্যন্তরে মুখ না লুকায়। মূল্য যেন ক্রয় ক্ষমতার আওতা ছাড়য়ে না যায়।

কান টানলেই মাথা আসে

কান টানলেই মাথা আসে। কান থেকে মাথাকে আলাদা করাটা সহজ নয়। এটা অত্যন্ত সহজ সরল কথা। অথচ এ সহজ কথাটাই অনেকে অনেক সময়ে বুঝতে চান না। অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকেন। চলতি সপ্তাহে ভিয়েনাতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির ৭৫তম অধিবেশনে ভাষণদানকালে কমিটির সভাপতি লর্ড ক্যালিনিন ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতির অনুপ্রবেশ সম্পর্কিত যে বক্তব্য পেশ করেছেন তাতে কিন্তু এ রকম একটা ব্যাপারই প্রতিভাত হয়ে উঠে।
লর্ড ক্যালিনিন দুঃখ করে বলেছেন যে, ‘রাজনৈতিক কারণে সম্প্রতি একদল ক্রীড়াবিদকে অন্যদলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি—কারণ যে দেশের ক্রীড়াবিদরা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন সেই দেশের সরকার অপর দেশের রাজনৈতিক ও জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেন না।’
লর্ড ক্যালিনিনের বক্তব্যকে একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে তিনি কিন্তু আসল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে গেছেন। অথবা সমস্যাকে জেনেশুনেও এড়িয়ে গেছেন।
এটা তো অত্যন্ত স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কোনো ক্রীড়াবিদ ব্যক্তি হিসাবে যোগদান করেন না। বিশেষ একটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। কাজেই সেদিক দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বিরোধটা কিন্তু ব্যক্তির সঙ্গে নয় দেশের সঙ্গে।
লর্ড ক্যালিনিন আজ যে কথা বলছেন সেই কথার সূত্র ধরেই বলা যায় যে, এই অলিম্পিক ক্রীড়াঙ্গনে অতীতে এমন সব ক্রিয়াকর্ম অনুষ্ঠিত হয়েছে যাতে লজ্জায় মাথা নুয়ে পড়ে। তিরিশ দশকে বার্লিনে অবস্থিত অলিম্পিক প্রতিযোগিতাতেই বলদর্পী হিটলার কৃষ্ণাঙ্গ বলে ক্রীড়াবিদ জেসি ওয়েন্সকে পুরস্কার প্রদান করেননি। সেদিন বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে গিয়েছিল ফ্যাসিস্ট হিটলারের এহেন অমার্জিত ও অশোভন ব্যবহার দেখে। সেদিন কিন্তু অলিম্পিক কমিটির কর্মকর্তারা নীরব ছিলেন। সে যাই হোক আজকের দিনে কেন ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতি এসে ঠাঁই নিয়েছে তারই একটা পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ বিচার বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। জাতিসংঘ থেকে সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবার পরও তাইওয়ান এখনো কিভাবে অলিম্পিক কমিটিতে থাকে? এ নিয়ে যদি চীন কোনো প্রশ্ন তোলে তাহলে অন্যায় হবে কি? দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবাদ ও ইসরাইলের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের জন্য যদি কোনো দেশ সেইসব দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে অস্বীকার করে তাহলে মনঃক্ষুন্ন হবার কি আছে? ভারত দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ডেভিস কাপ ফাইনালে খেলতে রাজী হয়নি। যে স্টেডিয়ামে হাজার হাজার শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে চিলির সেই স্টেডিয়ামে সোভিয়েত রাশিয়া বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে যদি অসম্মত হন তাহলে কি বলার আছে? কাজেই আসল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে কোনো লাভ নেই। কান টানলেই মাথা আসে। ক্রীড়াঙ্গনকে ইচ্ছে করলেই রাজনীতি মুক্ত করা যাবে না। সেজন্য প্রয়োজন পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন