বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৪শে মে, শুক্রবার, ১০ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১
সর্বশেষ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে
দেশের আইন শৃংখলার অবনতিতে প্রশ্নটি বেশ কিছুদিন ধরে জনগণের মনে যে আতঙ্কের উদ্রেক করেছিল তা আজও প্রশমিত হয়নি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজিত নানাপ্রকার অনাচার-অবিচার, হত্যা, খুন, গুম, হাইজ্যাকিং, লুট, মজুতদারী, মুনাফাখোরী, কালোবাজারি, চোরাচালানী ও বেআইনি অস্ত্রের ঝনঝনানি প্রভৃতি নির্মূল করার প্রত্যাশায় সরকার তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। তবু সর্বক্ষেত্রে কোন বিশেষ পরিবর্তন সূচিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়না। আইন-শৃংখলার বিষয়টি আজো হতাশাব্যঞ্জক। গত পরশুদিন বরিশাল শহরে যে মর্মান্তিক নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তা বর্তমানে কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপের প্রতি একটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। ঘটনার বিবরণে, জানা গেছে যে, দু’জন যুবলীগ কর্মী ও একজন বিমানবাহিনীর পদস্থ কর্মচারী শহরের রাস্তায় অবস্থিত শাপলা ষ্টুডিওতে বসে যখন আলাপ করছিলেন তখন একজন স্বচ্ছ ব্যক্তি নিয়ে তাদের উপর প্রকাশ্য আক্রমণ চালায়। ঘটনাস্থলে একজন প্রাণ ত্যাগ করেন এবং অপর দু’জন হাসপাতালে। কতৃপক্ষ বরিশাল শহরের কার্ফু জারি করে তদন্ত কাজ পরিচালনা করছেন। ঠিক একই দিনে রাজবাড়ীর মহাকুমার পাংশা থানার অন্তর্গত কালুখালী ইউনিয়নের যুবলীগ কর্মীকে দুর্বৃত্তরা গুলি করে। একজন যুবকর্মী ঘটনাস্থলে মারা গেছেন, অপরজন মারাত্মকভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। উল্লেখিত দুটি হত্যাকান্ড জনমনে দারুন উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।
গত এক প্রকারের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি তাহলে এক হতাশাব্যঞ্জক চিত্র দেখতে পাওয়া যাবে। হাইজাকিং, গুম-গুপ্তহত্যা প্রভৃতিতে বেশ কিছু সংখ্যক সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক কর্মী এই সময়কালের মধ্যে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছে। গত ৬ই মে সান্তাহার থেকে ৬৮ হাজার টাকা ছিনতাই হয়েছে, ৫ই মে সাতক্ষীরার এক বিল থেকে গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, ৩রা মে দুর্বৃত্তদের গুলিতে ফরিদগঞ্জ থানার একজন পুলিশ নিহত হয়েছেন, ৬ই মে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানা আওয়ামী লীগের একজন বিশিষ্ট কর্মী আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন, ৮ই মে শ্রীপুরের মৌচাক ইউনিয়নের দু’ব্যক্তির লাশ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে, ৮ই মে মঠবাড়িয়া থানার ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ও তার ভাইকে আততায়ীরা গুলি করে হত্যা করেছে, ৯ই মে বাগেরহাটের ফকিরহাট থানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে, একই সময় পীরগঞ্জে ও শেরপুরে একজন করে গলাকাটা লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে, ফতুল্লা থানার নবীনগর গ্রামের একটি আখক্ষেত থেকে গলাকাটা লাশ উদ্ধার হয়েছে, ১০ই মে কলাবাগানের নিকটে দুর্বৃত্তদের গুলিতে জনৈক পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর নিহত হয়েছেন, ১৪ই মে মতলব থানা ৩ জন ছাত্রকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, ১৭ই মে রায়পুরা থানার মির্জাপুর গ্রামের একজন সাধারন মানুষ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, ২০শে মে মাদারীপুরের গোসাইরহাট থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি তার কর্মীদের সঙ্গে আলাপ রত অবস্থায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন, সম্প্রতি মিঠাপুকুরের জনৈক আওয়ামীলীগ নেতাকে খুন করা হয়েছে এবং গত পরশু দিন অর্থাৎ যেদিন বরিশালে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে সেদিন চাঁদপুরের পূর্ব ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি দুষ্কৃতকারীরা এছাড়া প্রতিদিন খবরের কাগজ ও থানা মারফত খুন-জখম, রাহাজানি ডাকাতির এতো বেশি খবর জানা যাচ্ছে যার তালিকা দিয়ে লাভ নেই। গতকালই ঢাকার একটি দৈনিক খবর দিয়েছে, “ঘোড়াশাল বাইশে মে। – গতকাল রাত বারোটায় ঘোড়াশালের নিকটবর্তী গাবতলী ও সানেরবাড়ী গ্রামের প্রায় প্রত্যেকটি বাড়িতে একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত আক্রমণ চালায়। তারা নিরীহ গ্রামবাসীদের কাছ থেকে সর্বস্ব লুটে নেয় এবং হাতের কাছে যাই পেয়েছ তাই নিয়ে পলায়ন করে। দুর্বৃত্ত দলগুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে গ্রামে প্রবেশ করে এবং দুই ঘন্টা যাবৎ লুটতরাজ চালায়। দুর্বৃত্তদের গুলিতে মধুর দেবনাথ (৫৫) নামে এক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। আরো দু’জন আহত অবস্থায় রয়েছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে গ্রামের চারশো গজের মধ্যে তিনটি পুলিশ ক্যাম্প রয়েছে। কিন্তু পুলিশরা কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ থানার বিভিন্ন মামলা দায়ের করা হয়েছে।”
মোটামুটি এর থেকে দেশের সর্বশেষ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটি চিত্র পাওয়া যায়। অপহরণ করে নিয়ে গেছে। গত পরশুদিন বরিশাল রাজবাড়ী কালুখালী ইউনিয়নের যে দুঃসাহসিক ঘটনা দুর্বৃত্তরা ঘটিয়েছে তারা নিঃসন্দেহে বলা যায় দেশের অভ্যন্তরে এমন কিছু কিছু দুঃসাহসী ও পরিকল্পিত সশস্ত্র শক্তি বিদ্যমান রয়েছে যারা সরকারের সকল প্রকার সশস্ত্র শক্তি প্রদর্শন করতে দ্বিধাবোধ করে না। এই সকল গুপ্ত সন্ত্রাসী শক্তির মোকাবিলা করার জন্য আমরা গোটা জাতীয় শক্তির সম্মিলিত অভিযান কামনা করি। ইতিপূর্বে বহুবার আমরা একথা বলেছি। শত শত আওয়ামী লীগ কর্মী এদের হাতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। কতৃর্পক্ষের তাতেও যথার্থ সচেতনতা লক্ষ করা যায়নি। এদেশের সরকার যখন তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে সকল ব্যবস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা উন্নতির জন্য সর্বাত্মক তৎপরতা লিপ্ত হয়েছে তখন যারা বরিশালের যুবকদেরকে নৃশংসভাবে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছে তাদেরকে খুঁজে বের করে যথাযথ শাস্তি দানের জন্য আহ্বান আমরা জানাই। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। গুপ্তহত্যা, খুন-গুম প্রভৃতি যত দ্রুত বন্ধ হয় ততই জাতির মঙ্গল।
আফ্রিকান উপনিবেশের স্বাধীনতা
দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আফ্রিকান উপনিবেশগুলোতে চলেছে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেখানকার বৃহত্তম সংখ্যা ও জনসাধারণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সাবেক ফ্যাসিস্ট পর্তুগিজ সরকার বিভিন্ন সময়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে দমন করতে চেয়েছে। কিন্তু মুক্তিকামী জনসাধারণের স্বাধীনতার সংগ্রাম স্থাপিত হয়নি। দেশ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাবার পথে উদ্দীপ্ত হয়েছে মুক্তিকামী নর-নারী। মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা ও গিনি-বিসাউয়ের স্বাধীনতা সূর্যকে ছিনিয়ে আনার স্বপ্ন আজও সার্থক হয়নি। সংগ্রাম এখনো চলছে। এমনই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পর্তুগালে এসেছে সরকার বদলের ঢেউ। সাবেক সরকারকে হটিয়ে দিয়ে জেনারেল স্পিনোলার নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে নতুন সরকার। বর্তমান সরকারের সময়ে দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা ছাড়াও রয়েছে উপনিবেশিক সমস্যা। পর্তুগালের সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তির সরকারের কাছ থেকে সেই ধরনের পদক্ষেপ বা কার্যধারা আশা করছে, যা জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও জাতীয় স্বাধীনতার অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও স্বীকৃতি প্রদানের নীতির ভিত্তিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে সহজতর করে তুলবে।
পর্তুগালের বর্তমান সরকার যে উপনিবেশ গুলির স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে পর্তুগালের ওভারসীজ মন্ত্রী অ্যান্টোনিও ডি আইমেইডা সাণ্টসের বক্তব্যে। তিনি ঘোষণা করেছেন যে, পর্তুগাল আগামী বছরের মধ্যে আফ্রিকার উপনিবেশ গুলিকে স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার দিয়ে সম্ভবতঃ আইবেরীয় উপদ্বীপের প্রাচীন এবং সর্বশেষ উপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটাবে। তিনি প্রকাশ্যে এই বলে অঙ্গীকার করেছেন যে, পদ্ধতির সরকার এই সর্বপ্রথম তার আফ্রিকান উপনিবেশিক গুলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ শাসন প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, পর্তুগিজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ আলমেডা সম্প্রতি মোজাম্বিকে এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পর্তুগাল তার আফ্রিকার উপনিবেশগুলিকে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার দেবে।
এদিকে গিনি-বিসাউ ও কেপ ভার্দে দ্বীপপুঞ্জের স্বাধীনতা সংগ্রামী পার্টিগুলির প্রতিনিধিগণ চলতি সপ্তাহেই লন্ডনে এক বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন। সেখানে পর্তুগাল সরকারের পক্ষ থেকে থাকছেন একজন শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধি।
একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, পর্তুগালের বর্তমান সরকার উপনিবেশগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি যে বক্তব্য রেখেছেন তা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও অভিনন্দন যোগ্য। আমরা বিশ্বাস করি যে, বর্তমান সরকার কোনো অঘটন না ঘটলে হয়তো প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে পিছ-পা হবেন না। তবে নতুন পর্তুগিজ সরকারকে কতকগুলি বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। যতদূর সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে তারই পরিপ্রেক্ষিতে একথাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, পর্তুগালের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। সেখান থেকে ফ্যাসিবাদ বিদায় নিয়েছে একথাও জোর দিয়ে বলা যাবে না। উপনিবেশবাদের যুদ্ধ থেকে যে সমস্ত বড় বড় ব্যবসায়ী ও উচ্চপদস্থ কর্মচারী ফায়দা লুটেছিল তারা এবং সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিবর্গ গণতান্ত্রিক সংস্কার সমূহের বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করেছে। নতুন সরকার রাজনৈতিক শক্তির অধিকারী হওয়া সত্বেও বিপদটা এই যে, তার হাতের কোন অর্থনৈতিক ক্ষমতা নেই। আগের মতোই এই শক্তি বড় বড় মালিক ও কতিপয় ব্যক্তির কুক্ষিগত। সুতরাং বর্তমান সরকারকে উল্লেখিত বিষয়ের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখেই এগিয়ে যেতে হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক