You dont have javascript enabled! Please enable it! 1948.03.04 | সাপ্তাহিক নও বেলালে প্রকাশিত রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত সম্পদকীয় - সংগ্রামের নোটবুক

সাপ্তাহিক নও বেলালে প্রকাশিত রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত সম্পদকীয়

এই পত্রিকাটিতে ৪ঠা মার্চ তারিখে পাকিস্তান গণপরিষদের ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব এবং তার সম্পর্কে আলােচনা ও সিদ্ধান্তের উপর রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নের সাথে পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক জীবনের ও সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের যােগসূত্রের কথা উল্লেখ করে তাতে বলা হয় :
পাকিস্তান লাভ করিবার পূর্বে পূর্বে পাকিস্তানবাসীদের ধারণা ছিল যে তাহাদের সংস্কৃতি, তহজিব, তমদুন সকল অবস্থায়ই অক্ষুন্ন থাকিবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের এলাকাধীন বিভিন্ন প্রদেশের অধিকাংশ বাসিন্দা মুসলমান গতিকে, তাহাদের মধ্যে মজহাবী একতা ছাড়া ভাষাগত বিষয়ে বিভিন্ন প্রদেশের নানাবিধ পার্থক্য রহিয়াছে তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। যদি এক ভাষার আধিপত্যে অন্য ভাষার প্রসার সংকুচিত হয় অথবা অন্য প্রদেশের সংস্কৃতি নষ্ট হইবার সূচনা দেখা যায় তাহা হইলে যে প্রদেশের ভাষার মর্যাদার হানি হইয়াছে তাহার প্রতি অবিচার করা হইবে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের তুলনা করে পত্রিকাটি বলেন : সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের আমলেও গভর্নমেন্টের কারেন্সী নােটেও বাংলা ভাষার স্থান ছিল। পাকিস্তান সরকার বাংলাকে তুলিয়া ফেলিয়াছেন। পাকিস্তান সরকারের মনি অর্ডারের ফরম, ডাক টিকিট, পােস্ট কার্ড ইত্যাদিতে বাংলার স্থান নাই। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর উক্তি সম্পর্কে নওবেলাল বলেন :
এই প্রস্তাবের প্রসঙ্গে পাকিস্তানের উজিরে আজম জনাব লিয়াকত আলী যে অসংলগ্ন কথার অবতারণা করিয়াছেন তাহাতে বাস্তবিকই মর্মাহত হইতে হয়। তিনি বলিয়াছেন পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র, তাই পাকিস্তানের ভাষা হইবে মুসলিমদের ভাষা উর্দু। এই সব অপরিণামদর্শী ভাষণের আলােচনাও এক দুঃখজনক ব্যাপার। তবে এই সব ঘােষণার প্রতিক্রিয়া যে মারাত্মক হইতে পারে সে সম্বন্ধে আমরা জনাব লিয়াকত আলী খানকে ভাবিয়া দেখিতে অনুরােধ করি।
খাজা নাজিমুদ্দিনের উক্তির সমালােচনা প্রসঙ্গে এতে বলা হয় :
এই প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের জনমতের উল্লেখ করিতে যাইয়া জনাব নাজিমুদ্দিন ও তমিজুদ্দিন খান যেসব অপ্রত্যাশিত মন্তব্য করিয়াছেন তার জন্য নিশ্চয়ই তাহাদিগকে একদিন পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিকট জবাবদিহি করিতে হইবে। খাজা সাহেবের পারিবারিক ভাষা উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ তাহাদের সাধারণ ভাষারূপে গ্রহণ করিতে চায় এই তথ্য কোথায় আবিষ্কার করিলেন।
গণপরিষদের মুসলিম লীগ দলীয় বাঙালি সদস্যদের উদ্দেশে পত্রিকাটি বলেন :
এইভাবে আপনার মাতৃভাষার মূলে যাহারা কুঠারাঘাত করিতেছেন, তাহার কি একথার ভাবিয়াও দেখেন নাই যে ভাষার ভিতর দিয়াই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, আদর্শ প্রভৃতি রূপ পাইয়া থাকে। ভাষা সম্পূর্ণ বিশাল লাভ না করিলে জাতির মেরুদণ্ড গঠিত হইয়া উঠিতে পারে না। কোনাে এক বিশেষ প্রভাব পড়িয়া তাঁহারা হয়ত আপনাদের অস্তিত্বের বিলােপ করিতে পারেন, তবে পূর্ব পাকিস্তানের চারি কোটি চল্লিশ লক্ষ লােক কিছুতেই তাহাদিকে ক্ষমা করিবে না। কিছুতেই তাহারা তাহাদের মাতৃভাষা বাংলার অবমাননা সহ্য করিবে। তাই ইতিমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের ধর্মঘট করিয়াছে এবং মিছিল সহকারে সর্বত্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করিয়াছে। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণই নহে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়িয়া উঠিতেছে। এই গণবিক্ষোভ যখন পূর্ব আত্মপ্রকাশ করিবে তখন এইসব নেতাদের আসনও টলটলামান হইয়া পড়িবে।
সর্বশেষে পাকিস্তানের শান্তি এবং ঐক্য বজায় রাখার আবেদন জানিয়ে সম্পাদকীয়টিতে বলা হয় :
তাই পূর্বাহ্নেই আমরা কর্তৃপক্ষ মহলকে অনুরােধ করিতেছি যদি পাকিস্তানের সংহতি, ঐক্য ও সর্বোপরি শান্তি বজায় রাখিবার জন্য তাহাদের মনে এতটুকু আগ্রহ থাকে তাহা হইলে অনতিবিলম্বে তাহাদের কর্মের সংশােধন করুন। পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমরূপে বাংলাকে গ্রহণ করুন। তাহা না হইলে স্বভাবতই পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হইতে থাকিবে যে পূর্ব পাকিস্তানের উপর যুক্তপ্রদেশ ও পশ্চিম পাঞ্জাবের লােকের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য বাংলাকে আস্তে আস্তে তার ন্যায্য আসন হইতে সরাইয়া ফেলা হইতেছে।
* এই সময় ঢাকা থেকে কোনাে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হতাে না। সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘নও বেলাল’ এর ভূমিকা ছিল প্রগতিশীল ও বাংলা ভাষার পক্ষে।

বেলাল।সূত্রঃ ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতিঃ বদরুদ্দীন উমর।পৃষ্ঠা ৬২