You dont have javascript enabled! Please enable it! জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় -আব্বাস আলী খানের জন্য ঘৃণা ও ধিক্কার - সংগ্রামের নোটবুক
আব্বাস আলী খানের জন্য ঘৃণা ও ধিক্কার
জামাত নেতা আব্বাস আলী খানের মৃত্যুর সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে সকল সংবাদপত্রে। ৮৫ বছর বয়সে তার মৃত্যুর বার্তা পাঠ করলে মনে হবে এদেশের অন্যতম রাজনৈতিক ধারার একজন প্রবীণ ব্যক্তির জীবনাবসান ঘটেছে। সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচয়ে তিনি যে ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন সেকথার উল্লেখ রয়েছে, কোনাে এককালে শেরে বাংলার সচিব ছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে, তবে কৃতির আরাে কিছু পরিচয় দেয়া হলেও ১৯৭১ সালে জবরদখলকারী পাক হানাদার বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহযােগী হিসেবে তার কাজ করার কোনাে উল্লেখ কোথাও ঘটে নি। জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশে গঠিত প্রাদেশিক মন্ত্রীসভায় তিনি যে অন্যতম সদস্য ছিলেন তথ্য হিসেবে এরও কোনাে প্রতিফলন কোথাও দেখা যায় না! স্পষ্টত এই জীবনকথা জামাত হেডকোয়ার্টার থেকে পরিবেশিত হয়েছে এবং প্রদত্ত তথ্যে তিনি এককালে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন বলা হলেও কোকালে ছিলেন তা বলা হয় নি। বােঝা যায় এখানে তথ্য গােপন করার দ্বারা একটি মিথ্যাচারের অবতারণা করা হয়েছে এবং কাজটি তার স্বজাতিরাই করেছে। আব্বাস আলী খানের নির্দোষ রাজনৈতিক জীবনবৃত্তান্ত যারা রচনা করেছেন সেখানে সাফল্য হিসেবে মন্ত্রীর গদিতে সমাসীন হওয়াটা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। একাত্তরের এই তথ্যটি তারা যে সজ্ঞানে চেপে গেছেন সেটা তাদের অন্তরের গভীরে চাপা দেয়া পাপবােধেরও অনিচ্ছুক প্রকাশ ঘটিয়েছে। পাশাপাশি, দুঃখজনক দিক হলাে, অগ্রসারির গণতান্ত্রিক পত্রিকাগুলাে আব্বাস আলীর মৃত্যুসংবাদের তৈরি মুসাবিদাটি হুবহু ছেপে দিয়েছে। নিজেদের পক্ষ থেকে একাত্তরের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকাটুকুর উল্লেখ করার কথাও কারাে মনে হয় নি।
 
আমরা যখন গণতান্ত্রিক সংবাদপত্রের কথা বলি তখন নিশ্চয় গণতান্ত্রিক মানবিক অর্থেই তা বােঝাতে চাই। বাংলাদেশের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার যারা শরিক ও সােসাহী সমর্থক তাদের পুরােধা ব্যক্তি জল্লাদীয় ভূমিকার জন্য অচিহ্নিত অবস্থায় কবরে প্রবেশ করতে চাইবে, তার সহকর্মীরাও তাই চাচ্ছে এবং মৃত ব্যক্তি বিচারের বাইরে চলে যাচ্ছে বটে, কিন্তু জনধিক্কার ও ঘৃণার দ্বারা চিহ্নিত করেই তার মৃত্যুসংবাদ বিবেচনা করা হবে। এর অন্যথা ঘটলে মানবিকতার অপমান করা হয়, যেটা পত্রিকার পাতায় এক্ষেত্রে অন্তত ঘটেছে ক্রাইম অব জেনােসাইড বা গণহত্যার অপরাধ বিষয়ে আমাদের সমাজে একটি ভ্রান্তি রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে আইখম্যান-সহ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বিভিন্ন কম্যান্ডান্টদের বিভিন্ন সময় নাটকীয়ভাবে গ্রেফতার করে বিচারানুষ্ঠানের মধ্য দিয়েও কতক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে মনে করেন যুদ্ধাপরাধী তারাই যারা যুদ্ধকালে নিজ হাতে ব্যাপক সংখ্যক সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। এরকম ব্যক্তিরা যুদ্ধাপরাধী নিঃসন্দেহে, তবে তারাই একমাত্র যুদ্ধাপরাধী নয়। নিজ হাতে মানুষ হত্যার বিবেচনায় হয়তাে দেখা যাবে আব্বাস আলী খান পরম নির্দোষ ব্যক্তি, মানুষ হত্যা তাে দূরের কথা তিনি হয়তাে জল্লাদের ছুরিটিও কখনাে হাতে তােলেন নি। এরকম একটা ভাব দেখিয়ে আব্বাস আলী খানেরা নিজেদের পাপস্খলনের চেষ্টা করে, বিবেকের দংশন, যদি তার কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকে, এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু কেবল জল্লাদরা নয়, আসল যুদ্ধাপরাধী তাে তারাই যারা জল্লাদ তৈরি করেন। সেজন্যই যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রচলিত আইনে প্রচলিত আদালতে হওয়ার নয়, কেননা যুদ্ধাপরাধ নিছক কোনাে হত্যা মামলা নয়, যুদ্ধাপরাধী প্রচলিত সাদা চোখে দেখা হত্যাকারী নয়। যুদ্ধাপরাধের এই বৈশিষ্ট্য এবং যুদ্ধাপরাধ সংজ্ঞায়িত করতে বিশ্বসমাজের অনেক বিলম্ব ঘটেছে এবং কেবল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে নাৎসি বর্বরতার মুখােমুখি হয়ে মানবসমাজ এই চ্যালেঞ্জের মােকাবিলায় এগিয়ে যায়। প্রতিষ্ঠিত হয় যুদ্ধাপরাধ বিচারের নুরেমবার্গ বিচারশালা এবং জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠার একেবারে সূচনায় গৃহীত হয় গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের প্রকৃতি ও শাস্তিবিধানের কনভেনশন।
 
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ গণহত্যার অপরাধের শাস্তি ও নিরােধ সংক্রান্ত কনভেনশন অনুমােদন করে। এতে শাস্তিযােগ্য অপরাধ হিসেবে। নিম্নোক্ত কর্মকে চিহ্নিত করা হয় : ক, গণহত্যা খ. গণহত্যা সংঘটনে সহায়তা গ.সরাসরি ও প্রকাশ্যে গণহত্যা সংঘটনে উত্তেজনা সঞ্চার করা ঘ, গণহত্যা সংঘটনে প্রচেষ্টা নেয়া এবং ৬. গণহত্যার কাজে সহযােগিতা। জাতিসংঘের এই বিধান অনুযায়ী একাত্তরে পাকবাহিনীর গণহত্যার দোসর হিসেবে জামাত নেতারা নিশ্চিতভাবেই অভিযুক্ত হবেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে চব্বিশ ব্যক্তিকে দণ্ডিত করা হয় যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং ৬০ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর জন্য ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত পরিচালিত এই আন্তর্জাতিক আদালতে ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাভােগের সাজা প্রদত্ত হয়। আদালতের রায়ে বলা হয়, “অধিকৃত এলাকার রাজনৈতিক নিরাপত্তা বিধানের অজুহাতে এই গােষ্ঠী নির্দয়ভাবে উৎখাতে অবতীর্ণ হয়েছিল নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে সকল প্রতিরােধ, কেবল বর্তমান প্রতিরােধই নয়, অতীত ও ভবিষ্যৎ সকল প্রতিরােধ। কোনােরকম তদন্ত, অনুকম্পা অথবা মমতা ছাড়া গােটা জনগােষ্ঠীকে হত্যা করা হয়েছে। স্বামীর সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে স্ত্রীকে, নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। শিশুদের, কেননা বাঁচার সুযােগ দিলে বড় হয়ে তারা নাৎসিবাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে।”
 
এই যে বাক্যসমষ্টি, “অধিকৃত এলাকার রাজনৈতিক নিরাপত্তা বিধানের অজুহাতে,” এটা একাত্তর সালের বাংলাদেশে খুবই কার্যকর ছিল এবং এমনি অজুহাত তুলেই জামাত নেতারা খুনি, ধর্ষক, মদ্যপ, কসাই এক সেনাগােত্রের সঙ্গে হাত মেলাতে কসুর করে নি এবং নিজেদের সমস্ত পাপাচরণকে সিদ্ধ করার জন্য ইসলামের ঝাণ্ডা তুলে ধর্মের মৌলিক মানবিক চেতনাকে পদতলে পিষ্ট করেছে। তারা কেবল মানুষ হত্যার অভিযান চালায় নি, ধর্মকেও কবর দিতে সক্রিয় হয়েছিল। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় আব্বাস আলী খানের যােগদানের সময়কে অধুনা জামাত নেতারা নিচুপতার মিথ্যা দ্বারা আড়াল করতে চাইলেও একাত্তরে এবিষয়ে গােলাম আজম ছিলেন একান্ত সােচ্চার। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ গােলাম আজম জামাত মন্ত্রীদের সংবর্ধনা সভায় বলেছিলেন, “এক দল পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়, আর এক দল পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। জামাতে ইসলামী শেষােক্ত দলভুক্ত। জামাতের যে দুজন সদস্য মন্ত্রিসভায় যােগ দিয়েছেন তাদেরকে দলের পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে জামাত রাজাকার বাহিনীতে তােক পাঠিয়েছে, শান্তি কমিটিতে যােগ দিয়েছে, সেই উদ্দেশ্যেই মন্ত্রিসভায় লােক পাঠিয়েছে। মন্ত্রীপদ ভােগের বা সম্মানের বস্তু নয়, আমরা তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছি।” একাত্তরে যে বিপদের কথা উল্লেখ করেছিলেন গােলাম আজম নিরানব্বইতে এসেও সেই বিপদ থেকে আব্বাস আলীকে রক্ষায় তিনি ভণ্ডামির আশ্রয় নিতে দ্বিধা করেন না। তাই এবারে মন্ত্রীত্বের কথা উল্লেখ করেন কিন্তু সেটা যে ছিল একাত্তরের মন্ত্রীত্ব সে তথ্য চেপে যান। ঐ বক্তৃতাতে তিনি উল্লেখ করেন যে, তারা রাজাকার বাহিনীতে লােক দিয়েছেন, সরকারে লােক দিয়েছেন কিন্তু চেপে যান আল-বদর বাহিনীর কথা, তবে ঐ দুই বাহিনীতে সদস্য যােগানাের অপকাজ যারা করেছে তারা যে গােপন ঘাতকদল বদর বাহিনীতেও লােক পাঠাবে সেটা তাে নিঃসন্দেহে বলা যায়। জল্লাদবাহিনীর শিক্ষামন্ত্রী হয়ে জল্লাদীয় শিক্ষাদর্শ প্রচারে জোরেসােরে নামেন আব্বাস আলী খান।
 
গণহত্যাকারীদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে চাইলে আমরা দেখবাে এমন বিপুল রক্তপাত ঘটানাের জন্য তাদের একটি আদর্শগত আশ্রয় চাই, একটা কোনাে যুক্তি চাই। পাশবিক কর্মকাণ্ড জায়েজ প্রতিপন্ন করার জন্য একটি আদর্শগত অবলম্বন দরকার হয় ঘাতকদের। নাৎসিদের জন্য এমনি আদর্শগত অবলম্বন যুগিয়েছিলেন হিটলার আর্যজাতির শ্রেষ্ঠত্ব এবং শ্রেষ্ঠ জাতির জন্য ভূমি বা লেবেনড্রামের প্রয়ােজনীয়তার তত্ত্ব যুগিয়ে। একাত্তরে পাকবাহিনীর নরহত্যার কর্মকাণ্ডকে সিদ্ধ করতে আদর্শগত অবলম্বন হিসেবে ঘােষিত হয়েছিল খাটি ইসলামী আদর্শের প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে গণরায় ঘােষণা করেছিল, যে স্বাধিকারের দাবি তুলে ধরেছিল তা পাকিস্তানের সামরিক চক্রের ভিত্তি ভেঙ্গে দেয় এবং সেটাকেই তারা ইসলামের ভিৎ-এর বিরােধী হিসেবে দেখাতে চেয়েছিল। এই হার্মাদের ইসলাম, খুনির ইসলাম, যার সঙ্গে কোনাে সম্পর্ক নেই মানবিক ইসলামের, ধ্বজাধারী হলেন আব্বাস আলী খান অ্যাণ্ড কোম্পানি। তারা তাদের তথাকথিত ইসলাম দ্বারা গণহত্যার আদর্শগত ইন্ধন যােগালেন। একাত্তরে শিক্ষামন্ত্রী আব্বাস আলী এই আদর্শের প্রকাশ ঘটিয়ে বলেছিলেন, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাই আমাদের সকল ক্ষতির কারণ। বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ ও অর্থহীন শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন না করা হলে আমরা কিছুতেই আমাদের ধ্বংস রােধ করতে পারবাে না। বিভিন্ন শিক্ষায়তনে প্রচলিত সহশিক্ষা সম্পর্কে তিনি বলেন, এ-ব্যবস্থা অত্যন্ত ক্ষতিকর, এ-ব্যবস্থা অবশ্য পরিত্যাজ্য। তিনি আরাে বলেন, ইসলামী অনুপ্রেরণামূলক শিক্ষা ছাড়া আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে পাকিস্তানের পটভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে পারবাে না।
ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে এখন বুঝতে অসুবিধা হয় না এইসব বুলি আউড়ানাে হয়েছিল জল্লাদদের হত্যাকাণ্ডের জীবনদর্শন যােগাতে, তারা যা করছে ইসলামের রক্ষক রূপেই করছে। এই ধারণা যােগাতে। একাত্তরের সেপ্টেম্বরে দখলিকৃত বাংলাদেশে পাকবাহিনী যখন নররক্তের হােলি খেলছে, বিশ্ব-ইতিহাসের ঘৃণ্যতম হত্যাকান্ডে মেতে উঠেছে, এক কোটি মানুষকে দেশছাড়া করেছে তখন পাক-সামরিক বাহিনী গঠিত মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করে যারা এই হত্যা ও পীড়নের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ ও পরিচালনাকর্মের অংশী হয়ে ওঠে তারা তাে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী, গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত। এমনি এক যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যাকারীর মৃত্যু ঘটেছে। আব্বাস আলী খানের মৃত্যুবার্তা তাই পত্রিকায় প্রকাশিত সচিত্র সংবাদের অতিরিক্ত মনােযােগ দাবি করে। এই মৃত ব্যক্তির প্রতি বাঙালি জনসমষ্টির প্রবল ঘৃণা, অনন্ত ঘৃণা ও ধিক্কার উচ্চারণের মধ্য দিয়েই রচিত হবে তার কবর।

(ভােরের কাগজ, অক্টোবর ১৯৯৯)