আবদুর রহমান বিশ্বাস ও কুর্ট ওয়াল্ডহাইম : দুই দেশ এক জিজ্ঞাসা
স্বৈরাচারী শাসকের উৎখাতের পর সিভিল সােসাইটি বা নাগরিক সমাজ র নির্মাণে যে যাত্রা শুরু হয়েছে সেখানে দুটি বড় অর্জন আমাদের রয়েছে। এর একটি হচ্ছে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান। দ্বিতীয়টি হচ্ছে তথাকথিত রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা বা সােজা কথায় একব্যক্তি-নির্ভর শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় উত্তরণ। এই দুটি কাজ সুসম্পন্ন হওয়ার পেছনে কি কি কার্যকারণ ছিল কিংবা এই দুই কর্ম থেকে কোন্ কোন্ শিক্ষা আমরা অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে জমা করতে পারি সেসব আলােচনায় না গিয়ে আমরা বরং মনােনিবেশ করতে চাই দুই সাফল্যের পরতে পরতে যেসব ব্যর্থতা বা শঙ্কা জড়িত রয়েছে তার প্রতি এবং সিভিল সমাজ নির্মিতির মধ্য দিয়ে নাগরিকজনের ক্ষমতা প্রসার ও রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্তিতে তাদের প্রান্তিক ভূমিকা পাল্টাবার আয়ােজন কীভাবে অগ্রসর হতে পারে তার ওপর। এই পর্যায়ে আমরা বর্তমান আলােচনায় কেবল একটি প্রশ্ন বিবেচনার জন্য সামনে রাখবাে, তা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি পদে জনাব আবদুর রহমানের বিশ্বাসের নির্বাচন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন বিধি মােতাবেক সম্পন্ন হয়েছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের ভােটে নির্বাচিত হয়ে নব-রাষ্ট্রপ্রধান দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন ও অর্পিত দায়িত্ব তিনি পালন করে চলেছেন। কিন্তু নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে গেলেও মান্যবর আবদুর রাহমান বিশ্বাস নৈতিকতার এক প্রবল বাধা এখনও অতিক্রম করতে পারেননি এবং অচিরেই যদি সন্দেহ, অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার উৎসস্বরূপ এই জিজ্ঞাসাগুলাে নিরসনের কোনাে ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ না করেন তবে রাষ্ট্রপ্রধানের পদের মর্যাদা রক্ষা এবং গণতন্ত্রকে অর্থময় করে তােলার সংগ্রামে রত নাগরিকজনকে তার বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান গ্রহণ ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না এবং আমরা এটা জানি নৈতিক অবস্থানের শক্তি সততা ও ন্যায়ভিত্তিক এবং এক থেকে অযুত হতে হয়তাে সময় লাগতে পারে; কিন্তু এই নৈতিক ধিক্কারকে রুখবে কার সাধ্য!
রাষ্ট্রপতির যে শপথবাক্য সর্বজনসমক্ষে প্রধান বিচারপতি দ্বারা উদ্দিষ্ট হয়ে মাননীয় আবদুর রহমান বিশ্বাস পাঠ করেছেন সেখানে উক্ত হয়েছে, “আমি আবদুর রহমান বিশ্বাস সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ করিতেছি যে, আমি আইন-অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পােষণ করিব; আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব; আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।” এই দৃঢ়সংবদ্ধ শপথনামার পাশাপাশি স্মরণ করতে হয় আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশ যেখানে বলা হয়েছে, “আমরা বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘােষণা করিয়া জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছি।” জনাব আবদুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তার যে সরকারি জীবনী প্রচার করা হয়েছে সেখানে দেখা যায় তিনি জন্মেছেন বরিশালের শায়েস্তাবাদের সম্রান্ত মুসলিম পরিবারে। ১৯৬২ এবং ১৯৬৫ সালে ৩৬ এবং ৩৯ বছর বয়সে মুসলিম লীগের টিকিটে মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই নির্বাচন যে সার্বজনীন ছিল না, ছিল আইয়ুব খানের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের আওতাধীন, একথার উল্লেখ সরকারি জীবনভাষ্যেই করা হয়েছে এবং এই সততা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘে প্রেরিত দশ-সদস্যবিশিষ্ট পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলে তিনি শরীক ছিলেন, জীবনীতে সেই উল্লেখও ঘটেছে। আরাে রয়েছে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে তার নানা তৎপরতার বিবরণী। কিন্তু ১৯৬৭ সালের পর থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত, বিশেষভাবে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ঘােষণাপূর্বক বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের সময়কালে রাষ্ট্রপতি কি করেছিলেন তার কোনাে বিবরণ আমরা পাই না। হতে পারে এই সময়কালে জীবনের ভাণ্ডারে কোনাে সুকৃতি তিনি যুক্ত করতে পারেননি। হয়তাে সাইডলাইনে বসে খেলা দেখেছেন, ঘটনার গতিধারা প্রভাবিত করতে সক্রিয় কোনাে ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেননি। কারাে নিষ্ক্রিয়তা কিংবা যুগের দাবি মেটাতে অপরাগতা কোনাে অপরাধ নয়। এটা বড় জোর ব্যক্তির চরিত্রবলের দৃঢ়তা-দুর্বলতার একটি ইঙ্গিত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, ব্যক্তিমানুষ সম্পর্কে চূড়ান্ত রায় দেয়ার ভিত্তি এটা হতে পারে না।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালে জনাব আবদুর রহমান বিশ্বাসের ভূমিকা সম্পর্কে আরাে কিছু গভীরতর জিজ্ঞাসা জন্ম নিয়েছে যেসব প্রশ্নের নিরসন হওয়া একান্ত প্রয়ােজন। মূল যে প্রশ্ন, বাংলাদেশে পাকবাহিনী সংঘটিত গণহত্যা ও নির্মমতার সঙ্গে কোনাে পরােক্ষ বা অপরােক্ষ সংযােগ, গণহত্যা সংঘটনে সহায়ক সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে কোনােপ্রকার সম্পর্ক তাঁর ছিল কিনা, এসব অস্থির জিজ্ঞাসা আমাদের মনে করিয়ে দেয় সমকালীন আরেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান সম্পর্কে এমনি ঘটনাধারার কথা। ১৯৮৬ সালের ৮ জুন অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহাইম। রাষ্ট্রপতি পদে তার প্রার্থিতা যখন ঘােষিত হলাে তখনই কিছু কানাঘুষাে শুরু হয়েছিল চল্লিশাধিক বছর আগে নাৎসি যুগের অস্ট্রিয়ায় তার ভূমিকা সম্পর্কে। তখনই কোনাে সুস্পষ্ট অভিযােগ কোনাে মহল থেকে উত্থাপিত হয়নি, কোনাে নথিপত্রও কেউ দাখিল করেনি, কিন্তু সেই পটভূমিকাতেও দূর অতীতে স্বীয় ভূমিকা সম্পর্কে জবাবদিহিতা থেকে বিরত থাকেননি কুর্ট ওয়াল্ডহাইম। ‘প্রােফাইল পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি জানালেন, নাৎসি আমলে ছাত্রত্ব শেষ করে তিনি যােগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর তথ্য দপ্তরে, বরাবরই তিনি ছিলেন হাসপাতালে এবং কিছুকাল বলকান অঞ্চলে কর্তব্যরত ছিলেন আর্মি গ্রুপ ই-র সঙ্গে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে জার্মান নাগরিকদের এমনতরাে ভূমিকার জন্য দোষারােপ করা যায় না এবং এটা কোনাে নাৎসি যােগসাজশও প্রমাণ করে না। এই বিবরণী প্রকাশের পরপরই কৃর্ট ওয়াল্ডহাইমের অনুমােদন নিয়ে পত্রিকা সম্পাদক অস্ট্রিয়ার যুদ্ধকালীন মহাফেজখানায় ওয়ান্ডহাইম সংক্রান্ত নথিপত্র খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ ‘প্রােফাইল’-এ প্রকাশিত হয় কূৰ্ট ওয়াল্ডহাইমের যুদ্ধকালীন সার্ভিস বুক, তাতে দেখা যায় তিনি ছিলেন এস.এ. বা স্পটুপারের এর সদস্য। এরা ছিল নাৎসি দলের ঠ্যাঙারে বাহিনী, হিটলারের ক্ষমতারােহণের পেছনে তাদের ছিল বিরাট ভূমিকা, কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর গেস্টাপাে বা এস,এস, বাহিনীর তুলনায় তাদের ভূমিকা নিপ্ৰভ হয়ে আসে। এছাড়া ওয়ার্ল্ডহাইম নাৎসি ছাত্র সংগঠনেরও সদস্য ছিলেন। এসব তথ্য প্রকাশের পরপর ‘প্রােফাইল’ পত্রিকাতে কুর্ট ওয়ান্ডহাইমের জবাব এবং সম্পাদকীয় পর্যালােচনা প্রকাশিত হয়। পর্যালােচনায় বলা হয়, নাৎসি ছাত্র সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ করলেই অনিষ্টকর কাজ করা হয়েছে বােঝায় না, কেননা সেই সময়ে হােস্টেলে একটা সিট পেতে হলেও এমনি সদস্যপদ থাকা প্রয়ােজন হতাে।
আর এস.এ. সংগঠন হিটলারের ক্ষমতায় উত্থিত হওয়ার আগে যতােকাল নিষিদ্ধ ছিল ততােকাল সমাজের নিম্নবর্গের মাস্তানদের আখড়া ছিল, পরে এর ভূমিকা হয়ে পড়ে। গৌণ এবং এর সদস্যপদ গ্রহণ সুবিধাবাদিতা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে, নাৎসি | আদর্শের সঙ্গে কোনাে ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্তি এতে প্রকাশ পায় না। কৃর্ট ওয়ান্ডহাইম তার ভাষ্যে জানান, তিনি শুধু এক অশ্বচালনা সমিতির সদস্য ছিলেন, সমিতিগতভাবে এই যে এস.এ-তে যােগ দিয়েছিল সে বিষয়ে তিনি অনবহিত ছিলেন। তিনি এস,এর সদস্যপদ গ্রহণের কোনাে আবেদনপত্রে কখনাে সই করেননি, তাই নিজেকে কখনােই এস,এ গােত্রের একজন হিসেবে ভাবেননি। একইভাবে তাদের গােটা যুবগােষ্ঠীকে নাৎসি ছাত্র সমিতির আওতাভুক্ত করা বিষয়েও তিনি ছিলেন অনবহিত। এরপর থেকে অভিযােগ উত্থাপনের স্রোত বয়ে যেতে থাকে। ইহুদীবাদী কোনাে কোনাে মহল তাে তাঁকে ‘নাস যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে বসে; কিন্তু সেসবের কোনাে তথ্যপ্রমাণ তারা দাখিল করতে পারেন নি। দলিলপত্র অবশ্য আরাে কিছু পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় বলকান অঞ্চলে প্রতিরােধ যােদ্ধাদের নাৎসিরা যেভাবে হত্যা করেছে সে-বিষয়ে ওয়ান্ডহাইম অবহিত ছিলেন। সালােনিকা থেকে হাজার হাজার ইহুদীদের যখন উৎখাত করা হয়, তাদের বিপুল সংখ্যায় পাঠানাে হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে সে-সম্পর্কে কতােটা অবগত ছিলেন কুর্ট ওয়াল্ডহাইম তা বিতর্কিতই থেকে গেল।
কিন্তু এই সমস্ত জিজ্ঞাসার জবাবদানে বাধ্য ছিলেন কুর্ট ওয়ান্ডহাইম জবাবদিহিতা কোনাে নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘটেনি, বিধিসম্মতভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর মূলত তা অব্যাহত ছিল। কেননা যে নৈতিক প্রশ্ন সমাজ থেকে উথিত হয়েছিল তাকে নিরসিত না করে নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত ভাবতে পারেননি কুর্ট ওয়াল্ডহাইম। কুট ওয়াল্ডহাইম সত্য গােপনের চেষ্টা করেছিলেন এটা ঠিক। কিন্তু তারপরেও দেখা যায় যেসব সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে এবং যেসব বিবরণী তিনি স্বীকার করেছেন সেসবের ওপর নির্ভর করে তাকে যুদ্ধাপরাধী অথবা ফ্যাসিস্টদের সহযােগী হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না মােটেই। এ ব্যাপারে সবচেয়ে কার্যকর রায় এসেছে বােধকরি নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের স্বরূপ মােচনে আজীবন সংগ্রামী পুরষ ও আইখম্যানের পরিচয় উদ্ঘাটনের কৃতিত্বের অধিকার নাৎসি হান্টার বা নাৎসি অপরাধী সন্ধানকারক সাইমন ভিজেনথালের কাছ থেকে। তিনি নিজে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের প্রাক্তন বন্দি এবং নাৎসি সহযােগীদের মুখােশ খুলে দিতে সদা সক্রিয় হলেও কুর্ট ওয়ান্ডহাইমের ঘটনা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, গণমাধ্যম ও কিছু কিছু ইহুদী সংগঠন এটা নিয়ে বেশি মাতামাতি করেছে।
তিনি বলেছেন যে, সাধারণ মানুষ এস.এ এবং এস,এস-এর মধ্যে ফারাক বােঝে না। তত্ত্বালে নাৎসি পার্টির সদস্যপদ এড়াতে গিয়েও অনেকে যে। অশ্বারূঢ় সেনাদলের সদস্য হয়েছিল সেটাও অনেকের অজানা। তকালীন বাস্তব। পরিস্থিতি পর্যালােচনা করে তিনি লিখেছেন, সুবিধাবাদিতার যেসব লক্ষণ ছড়িয়ে পড়ছিল তখনকার বিরাজমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেসব ঘটনাকে খুব কঠোরভাবে নিন্দিত করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক কোনাে না কোনাে ছােটোখাট নাৎসি ক্লাবের সদস্যপদ দেখাতে সক্ষম হতাে না তাদের পক্ষে সরকারি চাকরি পাওয়া ছিল মুশকিল। ধনী পরিবারের সন্তানদের জন্য এটা তুচ্ছ ব্যাপার হতে পারে কিন্তু ওয়ান্ডহাইমের মতাে সাধারণ ঘরের ছেলের কাছে এটা ছােট ব্যাপার ছিল এতদসত্ত্বেও আমি মনে করি প্রাক্তন জাতিসংঘ মহাপরিচালকের আচরণে শুরু থেকেই বিশ্বাসযােগ্যতার ঘাটতি ছিল। তার মতাে মাপের মানুষের কাছে থেকে আমরা আশা করবাে সেই সময়ে যা যা করেছেন স্ব-উদ্যোগেই সে-সম্পর্কে বলবেন, প্রতিটি উক্তি নানা দলিলপত্র হাজির করে তার কাছ থেকে আদায় করার প্রয়ােজন ছিল না। তবে তাকে কড়াপাকের নাৎসি’ বা ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলা থেকে এসব দূরের ব্যাপার।” কুর্ট ওয়ান্ডহাইম বিষয়ক বিতর্ক এখন স্তিমিত হয়ে এসেছে।
একসময়ে তার প্রতি জনসমর্থন ৪০ শতাংশের নিজে নেমে এলেও পরে দেখা গেছে অধিকাংশজনের সমর্থন রয়েছে তার প্রতি তিনি যেভাবে অভিযােগগুলাে মােকাবিলা করলেন তা নিয়ে অনেককিছু বলার থাকলেও শেষ পর্যন্ত যে তিনি সত্য স্বীকার করলেন সেটা প্রশংসনীয় এবং আমাদের কাছে যেটা বিশেষভাবে বিবেচ্য তা হলাে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়েও তিনি কখনােই নিজেকে জনসাধারণের মধ্যে বিরাজিত সংশয় ও জিজ্ঞাসা থেকে মুক্ত বিবেচনা করেননি, গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত জবাবদিহিতার প্রতি অনুগত থেকেছেন বরাবর সমকালীন ইতিহাসের এই শিক্ষা বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে ১৯৭১ সালে বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানীদের গণহত্যা সংঘটনকালে নব রাষ্ট্রপ্রধানের অবস্থান সম্পর্কে সত্য পরিচয় ও ব্যাখ্যার দাবি যখন বিশেষ সােচ্চার হয়ে উঠেছে।
বরিশাল কোতােয়ালী এলাকা থেকে সংসদ নির্বাচনে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়েছেন জনাব আবদুর রহমান বিশ্বাস। তার উদ্দেশে বিনীতভাবে একই প্রশ্ন আমরা করতে চাই যেমন ছিল কুর্ট ওয়াল্ডহাইমের কাছে সেদেশবাসীর জিজ্ঞাসা, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনী কৃত গণহত্যা সম্পর্কে তিনি কতােটুকু জানতেন এবং এক্ষেত্রে তিনি কোন্ ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের জিজ্ঞাসা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র অষ্টম খণ্ডের ২৯৪ এবং ২৯৫ পৃষ্ঠায় বর্ণিত বিবরণী সম্পর্কে তিনি কতােটুকু জানতেন। ঐ গ্রন্থে পত্রস্থ বরিশালের বগুড়া রােডের ভারতী দেবী চক্রবর্তী আশ্রয় নিয়েছিলেন দুর্গম গ্রাম আটঘর কুড়িয়ানাতে। মে মাসের শেষে সেখানে উপস্থিত হয় পাকসেনারা। ভারতী দেবী লিখেছেন, “পাকসেনারা প্রত্যহ মানুষ ধরে হত্যা করেছে। ঐ বাগানে লাইন দিয়ে দেড় মাসের মধ্যে ২ হাজারের মতাে লােককে হত্যা করে। ওখানে আমাদের মতাে যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারাই বেশি মারা গেছে . লাইনে দাঁড় করিয়ে আমাদের সবকিছু খুলে নেয়। বরিশাল ব্রজমােহন কলেজের অধ্যক্ষ ইমদাদুল হক মজুমদার বলেছেন, ‘প্রতি রাতে পাকবাহিনী অসংখ্য লােককে হত্যা করেছে। দিনের বেলায় ট্রাক ভর্তি করে লােক ধরে আনতাে প্রথম দিকে গুলি করে হতা করতাে। পরের দিকে জবাই করেছে, অসংখ্য লাশ নদীতে ভাসতে দেখেছি, বেয়নেট দিয়ে চিড়ে ফেলে রাখতাে, আমার ধারণা ৭৫,০০০ এর মতাে লােককে পাকবাহিনী হত্যা করেছে সমগ্র বরিশালে।’
মাননীয় আবদুর রহমান বিশ্বাস কতােটা অবগত ছিলেন এইসব বাস্তবতা বিষয়ে এবং এই নিরিখে কোন অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন তিনি এই জিজ্ঞাসা বারংবারই উত্থাপিত হবে। ঢালাও বিচারের প্রশ্ন নয়, নির্বিচার দোষারােপ নয়, প্রতিহিংসা বা প্রতিশোেধস্পৃহা নয়, বিবেকতাড়িত ন্যায়সঙ্গত অবস্থান গ্রহণের জন্যই উখিত হচ্ছে এইসব প্রশ্ন একাত্তর আমরা পিছনে ফেলে আসিনি, ইতিহাসের ফেলে আসা অধ্যায় নয় মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের জাতিগত ও রাষ্ট্রগত সত্তা দাঁড়িয়ে আছে এই অহঙ্কারের ভূমিতে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পর দুঃখ-জর্জর বাংলাদেশ আবার যখন পা বাড়িয়েছে গণতান্ত্রিক নির্মিতির পথে তখন কুর্ট ওয়ান্ডহাইমেন যতাে জনাব আবদুর রহমান বিশ্বাসও এগিয়ে আসবেন জবাবদিহিতার অবস্থানে, এটা গণতন্ত্রে আস্থা অর্পিত দল ও ব্যক্তির কাছে আমাদের সম্মিলিত আশাবাদ এক্ষেত্রে আশাভঙ্গ ঘটলে নাগরিকজনের প্রাথমিক করণীয় হবে ব্যক্তিগত নৈতিক প্রতিবাদ ধ্বনিত করা। অল্পকাল পরেই যে বিজয় দিবসকে আমরা বরণ করবাে সেদিনই হতে পারে নৈতিক ধিক্কার উচ্চারণের দিবস, বর্জিত হতে পারেন রাষ্ট্রপতি বিবেকবান মানুষদের দ্বারা। পাদটিকা : বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার চাইতে মাননীয় আবদুর রহমান বিশ্বাস মনে হচ্ছে অধিক স্বচ্ছন্দ বােধ করছেন বরিশাল কিংবা শায়েস্তাবাদের সদা সরকার অনুগত সমিতির দ্বারা বরেণ্য হতে, হরেক কিসিমের প্রাক্তন ও হালফিল ধর্মব্যবসায়ী দল এবং গােষ্ঠী দ্বারা মাল্যভূষিত হতে। সংবর্ধনাদানকারীদের কাতারে একদিন দেখা গেল ‘মাওলানা মান্নানকে, যদিও ডা. আলীম-এর বাড়িতে আশ্রয়প্রাপ্ত হয়ে তাকে হত্যাকারী আলবদর বাহিনী লেলিয়ে দেয়া এই ব্যক্তির নামের আগে ‘মাওলানা’ শব্দটি ব্যবহার করলে খােদাভীরু ধর্মবেত্তা মানুষদের অপমান করা হয়, ‘মােনাফেক’ শব্দটিই সেখানে মানায় বেশি। এদের দ্বারা নিজেকে পরিবেষ্টিত হতে দিলে রাষ্ট্রপ্রধান তাঁকে নির্বাচনকারীদেরও হতাশ করবেন, দেশের মৌল চেতনাকে করবেন অপমান।
(আজকের কাগজ, নভেম্বর ১৯৯১)
সূত্রঃ জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় – মফিদুল হক